আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-০১

0
10

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_1
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

“আমি তোমাকে কিনে নিয়েছি। পুরো এক কোটি টাকার বিনিময়ে। এখন তোমার একমাত্র দায়িত্ব—আমাকে খুশি করা। অন্য কোনো পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকানোরও অনুমতি নেই তোমার। আমি যা বলবো, তুমি নিঃশব্দে শুনবে… অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।”

নিচু গলায়, মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল আরমান শাহরিয়ার।
তার কণ্ঠে ছিল এমন এক শীতলতা, যেন প্রতিটি শব্দ বরফে মোড়ানো আগুন। আর মায়া… মায়া কাঁপছিল—ভয় নয়, অজানা এক শিহরণে। তার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল সেই দম্ভী পুরুষের উষ্ণ, অধিকারবোধে টইটম্বুর নিঃশ্বাস।

———–

এক দিন আগে…

একটি প্রশস্ত ও অভিজাত ঘর। নিঃশব্দ, অথচ ভারী বাতাসে ভাসছে প্রতীক্ষা ও আগ্রহের চাপা উত্তাপ। এক একেকটা সিঙ্গেল সোফায় বেশ কিছু কোর্ট প্যান্ট পড়া ব্যাক্তি বসে আছে। ১০-১২ জন তো হবেই। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশি।

প্রত্যেকে এর হাতে ওয়াইনের গ্লাস। পাশেই একটা সিঙ্গেল সোফায় একজন মহিলা বসে আছে। পরনে নেটের শাড়ি। যার জন্য ফর্সা ধবধবে পুরো পেট দৃশ্য মান। মুখে একগাদা মেকআপের প্রলেপ। আর ঠোঁটে লেগে আছে নির্লজ্জ হাসি। তারা সবাই মিলে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বিজনেস এর ব্যাপারে টুকটাক কথা বলছে।

ওখানে থাকা একজন বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, “উফফ আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে উনার জন্য?”

মিস সুইটি ব্যানার্জি মানে ওখানে থাকা মহিলাটি নিজের হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বললেন, “দশটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট, মিস্টার। আপনি তো জানেনই, উনি কতটা পাংচুয়াল মানুষ। এক মুহূর্তেরও হেরফের করেন না।”

ওখানে থাকা একজন বলে উঠল, “হ্যাঁ এটা একদম ঠিক বলেছেন। ভীষণ মেপে মেপে চলে মানুষটা, আর তার জন্যই তো ব্যাবসায় উনি এতো তাড়াতাড়ি আমাদেরকে পিছিনে ফেলে এগিয়ে গেলেন। মানুষটার অ্যাটিটিউডই আলাদা।”

ওখানে থাকা বিদেশি লোকটি বলে উঠলেন, “ Yes, he is very different from everyone else. His personality fascinated me.”

—–

ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই ওর রুমের দরজা টা খুলে গেলো। রুমে উপস্থিত থাকা সকলের চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো, দরজা দিয়ে মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে প্রবেশ করা ব্যাক্তিটির উপর। পিছনে চার জন গার্ড ও আছে। তিনি পরেছেন নিখুঁত স্লিম ফিট চারকোল গ্রে স্যুট, সাদা শার্ট আর কালো সিল্ক টাই। একটুও ঢিলে নয়, একটুও বাড়তি নয়। পকেট স্কোয়ারে হালকা সাদা-ধূসর কনট্রাস্ট। হাতে রোলেক্স ঘড়ি, পায়ে চকচকে অক্সফোর্ড জুতো—ফর্সা মুখে চাপ দাড়ি উনার সৌন্দর্য আরো কিছুটা বাড়িয়ে তুলেছে।

পারফিউমের গন্ধটা ঠিক তার মতোই—তীব্র, প্রভাবশালী, এবং স্থায়ী।

আরমান শাহরিয়ার। শহরের নামজাদা ব্যবসায়ী, ২৮ বছর বয়সেই যিনি পৌঁছে গেছেন ক্ষমতা, খ্যাতি আর সম্পদের চূড়ায়। তার চোখের চাহনিই যথেষ্ট—যে কোনো ব্যাক্তির হৃদয়ে কাঁপন সৃষ্টি করতে।

আরমান মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে একটা সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে গেলো। চারজন গার্ড আরমানের পিছনে এসে দাঁড়ালো।

একজন বলে উঠলেন, “আমার মনে হয় না এই রুমের মধ্যে আপনার সেফটি নিয়ে কোনো অসুবিধা হবে। গার্ড তো আমাদের সাথেও আছে মিস্টার আরমান, তবে তাদেরকে বাইরেই রেখে এসেছি। আর এই রুমে যারা উপস্থিত আছে তারা সবাই আমাদের চেনা আবার বিজনেস পার্টনারও হতে চলেছি। এতোটুকু বিশ্বাস তো রাখাই যায় একে অপরের প্রতি।”

আরমান তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো উনার দিকে। বলল, “হুম! সবার আগে চেনা মানুষই পিছন থেকে ছুঁড়ি মারে, মিস্টার সিংহানিয়া। আর এই আরমান শাহরিয়ার বিজনেসের জগতে কাউকে বিশ্বাস করে না, সে যতোই চেনা এবং বিজনেস পার্টনার হোক না কেন।”

মিস্টার সিংহানিয়ার মুখ টা চুপসে গেলো। আরমান শাহরিয়ার এমনই মানুষ, কোনো রাখ ঢাক নেই, স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে পছন্দ করে। এতে সামনের মানুষ টা কি ভাবলো তা ভাবার প্রয়োজনও মনে করে না ও।

মিস্টার সিংহানিয়া ভাবতে পারেনি যে সবার সামনে তেঁতো মিশ্রিত সত্য কথা আরমান মুখের উপর বলে দেবে। বিজনেসের জগতে সবাই ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে, মনে মনে কখনোই চায় না যে অন্য জন নিজের থেকে উপরে উঠুক।

একটা আন্তর্জাতিক ডিল ফাইনাল করা হবে আজ এখানে। সবাই এতোক্ষণ আরমানের অপেক্ষাতেই ছিল। আরমান আসতেই তাদের মিটিং শুরু হলো। এরপর ডিল ফাইনাল করা হলো।

বিদেশি লোক গুলোর মধ্যে থাকা এই আন্তর্জাতিক ডিলের প্রধান প্রতিনিধি, মিস্টার অলিভার ব্রেটল ওখানে থাকা মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে বলে উঠলো, “Miss Banerjee, the deal is finalized. What’s up with the special event I asked you to organize for everyone?”

(“মিস ব্যানার্জি, চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আমি আপনাকে সবার জন্য যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেছিলাম, তার কী খবর?”)

মিস সুইটি ব্যানার্জি হচ্ছে এই ক্লাবের মালিক। আর মিস্টার অলিভার ব্রেটল এর গার্লফ্রেন্ড। মিস ব্যানার্জি তো এটাই মনে করেন। উনি মুখে একটা নির্লজ্জ মার্কা হাসি নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, “সব রেডি আছে ডার্লিং। তুমি অনুমতি দিলেই তাদের হাজির করবো।”

ওখানে থাকা আরো একজন বিখ্যাত বিজনেস ম্যান বলে উঠলো, “হ্যাঁ আমিও শুনেছিলাম, আমাদের জন্য একধরনের বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। তো কোথায় সেই বিশেষ আয়োজন?”

অলিভার ব্রেটল:- “Yes, bring them here.” (“হ্যাঁ, ওদের এখানে নিয়ে এসো।”)

—–

নরম আলোয় ভরা ঘরটি কোলাহলমুখর। এক কোণে রাখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক মেয়ে নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে একজন প্রবেশ করল। তার কণ্ঠে ছিল একরাশ তাড়াহুড়ো আর কৌতূহলের রেশ—
“চলো, সময় হয়ে গেছে, এবার তোমাদের যেতে হবে। আজ তোমরা যেসব মানুষের সামনে যাচ্ছো, তারা সবাই আমাদের দেশের এবং বিদেশের বিখ্যাত বিজনেস ম্যান। তাদের মধ্যে আছে আমাদের দেশের টপ ফ্যাশন হাউসের মালিক ‘আরমান শাহরিয়ার।’ যদি তাকে মুগ্ধ করতে পারো, তাহলে জীবনটাই বদলে যাবে। তবে মনে রেখো, তাকে মুগ্ধ করা এত সহজ নয়।”

‘আরমান শাহরিয়ার’— নামটা উচ্চারিত হতেই ঘরে যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রায় সব মেয়ের চোখ জ্বলে উঠল উত্তেজনায়। কিন্তু এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল সে— যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না তাকে আরমান শাহরিয়ার এর সামনে যেতে হবে। হ্যাঁ আরমান শাহরিয়ার নামক মানুষটিকে একটু আগেই দেখেছে ও এই ক্লাবে। কিন্তু ভাবতে পারিনি, আজ ওকে আরমান শাহরিয়ার এর সামনে যেতে হবে। একটা অজানা ভয়ে বুকের ভিতর টা কেঁপে উঠল মেয়েটার।

————–

কিছুক্ষণ পর, এক দল মেয়ে রঙবেরঙের ছোট বড়ো বিভিন্ন পোশাকে, মিটিং রুমে প্রবেশ করল। রুমের আবহ যেন হঠাৎ গাঢ় হলো।

সামনের সারিতে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা একঝাঁক রূপসী তরুণী—প্রত্যেকেই যেন একে অপরের চেয়ে আরও এক ধাপ বেশি মোহময়ী। সাজপোশাকে, মেকআপে, চলনে প্রত্যেকেই নিখুঁত।

সুইটি ব্যানার্জি মুখে একধরনের নির্লজ্জ হাসি নিয়ে বলল, “এই সুন্দরীরা আমাদের ক্লাবের বিশেষ নৃত্যশিল্পী। আজকের রাতটা আপনাদের জন্যই সাজানো। আমাদের নতুন ব্যবসায়িক চুক্তির আগাম শুভেচ্ছা হিসেবে এটি আমার তরফ থেকে একটি ছোট উপহার। আপনারা এদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছে বেছে নিতে পারেন, আজ রাতের জন্য। ওরা সবাই আজকেই জয়েন করেছে এই কাজে। একেবারে ফ্রেস।”

এই নারীসঙ্গের আয়োজন সকল বিজনেস ম্যানদের জন্য মিস্টার অলিভার ব্রেটল এই ক্লাবের মালিক সুইটি ব্যানার্জিকে দিয়ে করিয়েছেন। ওদের দেশে এটা কমন ব্যাপার।

ওই রুমে থাকা কিছু ব্যাক্তি লাজ লজ্জা ভুলে এগিয়ে গেলো সেই মেয়ে গুলোর দিকে। নোংরা ভাবে স্পর্ষ করতে থাকলো, আবার কেউ পছন্দ হওয়া মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো, আলাদা রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

তবে আরমান শাহরিয়ার এসব কিছুর প্রতি নির্লিপ্ত। সবকিছু বিরক্ত লাগছে ওর। একহাতে ওয়াইনের গ্লাস ধরে বসে আছে। ওখানে থাকা মেয়েদের দিকে একবারও ফিরেও তাকাচ্ছে না।

মিস্টার অলিভার ব্রেটল এর গা ঘেঁষে বসে থাকা মিস সুইটি ব্যানার্জি ওয়াইনের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কি ব্যাপার মিস্টার আরমান? কাউকে পছন্দ হলো না বুঝি?”

মহিলাটির কণ্ঠে ছিল নিঃসংকোচ নির্লজ্জতা, আর ঠোঁটে লেগেছিল এক বিব্রতহীন হাসি।

কিন্তু আরমান তখনো অনুভূতিহীন হয়ে বসে আছে। ওখানে উপস্থিত থাকা প্রতিটি মেয়ের চোখে ছিল আশা, প্রতিটি ঠোঁটে লোভনীয় হাসি—সবাই চায় যেন আরমান শাহরিয়ার তাকায় তার দিকেই…

তাদের অস্থির চোখের কোণে প্রতিফলিত হচ্ছিল আকাঙ্ক্ষার অগ্নি, আরমানের দৃষ্টি যেন কারো গায়ে পড়লেই সে হয়ে উঠবে বিজয়িনী।

আরমান অলিভার ব্রেটল এর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “Alright, Mr. Oliver. The deal is final. I am going now. I hope we meet again very soon.” (“ঠিক আছে, মিঃ অলিভার। চুক্তি চূড়ান্ত। আমি এখন যাচ্ছি। আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের আবার দেখা হবে।”)

কথাটি বলেই আরমান উঠে দাঁড়ালো। আরমানকে উঠতে দেখে মিস্টার অলিভারও উঠে দাঁড়ালেন।

অলিভার ব্রেটল:- “Certainly, I had a wonderful time as well. I hope we meet again very soon.”
(অবশ্যই, আমারও খুব ভালো সময় কেটেছে। আশা করি খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে।)

আরমান মিস্টার অলিভার ব্রেটল এর সাথে হ্যান্ডশেক করে এগিয়ে গেলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।

ওখানে থাকা একজন বলে উঠল, “হুম এটাই প্রত্যাশিত ছিল। অনেক প্রভাবশালী ঘরের মেয়েরা উনার জন্য পাগল। উনার একটা ইশারায় যথেষ্ট, সব মেয়েরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে দিতে রাজি। কিন্তু উনি তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না।”

আর একজন:- “উনি সত্যিই সবার থেকে আলাদা।”

আরমান বেরিয়ে যাচ্ছিল রুম থেকে। পাশেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাঁক তরুণী। তাদের চোখেমুখে লেগে আছে এক ধরণের আকুতি, মনে মনে করে চলেছে প্রার্থনা—
“আজ যদি মিস্টার আরমান শাহরিয়ার আমাকে বেছে নেয়…”

আরমান এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে, মেয়েগুলো আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গিতে আরমানকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ও কারোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

যেতে যেতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লো আরমান। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখ সোজা গিয়ে পড়ল এক বিশেষ মেয়ের উপর— লাল গাউনে মোড়া এক অপরূপা তরুণী। স্থির, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।

হঠাৎই আরমানের তখন কার দৃশ্য মনে পড়ে গেলো

———

তখন আরমান শাহরিয়ার মিটিং রুমে আসার আগে, লিফট থেকে বেরোতেই হঠাৎ একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলো। মেয়েটা পড়ে যেতে নিলে আরমান তার কোমর জড়িয়ে ধরে পড়া যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিলো।

মেয়েটি ভয়ে দুই চোখ চেপে বন্ধ করে আছে। যখন মেয়েটি বুঝতে পারলো ও পড়ে যায়নি, কেউ একজন ধরে আছে তখন ধীরে ধীরে চোখ খুলল মেয়েটি।

আরমান মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে ছিল। কেনো জানি প্রচন্ড চেনা চেনা লাগছে মেয়েটিকে। মেয়েটির পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ, আর একটা ওরনা দিয়ে পুরো মুখ বাঁধা আছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।

মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই আরমানের হার্টবিট থমকে গেলো যেনো। ওই চোখ দুটো ভীষণ চেনা লাগলো। ভীষণ ভীষণ চেনা।

মেয়েটি চোখ খুলে আরমান শাহরিয়ার মুখ দেখবে, সেটা হয়তো কল্পনাতেও ভাবেনি। মেয়েটির চোখে মুখে ফুটে উঠলো একরাশ ভয়। আরমানের নজর এড়ালো না সেটা। হঠাৎই মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। হাত দিয়ে দেখলো মুখে বাঁধা ওরনা ঠিক আছে কিনা, আর তারপরই এক ছুটে পালিয়ে গেলো মেয়েটা। যেনো আরমানের থেকে লুকাতে চাইছে নিজেকে। আরমান অবাক হলো ভীষণ। মেয়েটা ওকে দেখে এভাবে ভয় পেলো কেনো? আর এভাবে ওর থেকে নিজেকে লুকিয়ে পালিয়েই বা কেনো গেলো?

“বস আপনি ঠিক আছেন?”

আরমানের পিছনে থাকা চারজন দেহরক্ষী দের মধ্যে একজন বলে উঠল। আরমান গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো, “হুম।”

আরমান আবারও তাকালো একবার সেই দিকে, যেই দিকে মেয়েটি ছুটে গিয়েছে। এরপর নিজের মাথা থেকে মেয়েটির ভাবনা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেলো নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

————-

আরমান ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেই মেয়েটির দিকে। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও, তখন কার ওই ধাক্কা লাগা মেয়েটি ছিল এই মেয়েই।

রুমে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকটি ব্যাক্তিকে অবাক করে দিয়ে আরমান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেই মেয়েটির দিকে। আরো একজন ব্যাক্তি সেই মেয়েটির দিকেই এগিয়ে আসছিল। তিনি মেয়েটির গায়ে হাত দেওয়ার আগেই, হঠাৎ করেই আরমান মেয়েটির কোমরে হাত দিয়ে এক ঝটকায় নিজের উপরে এনে ফেলে।

মেয়েটি ভারসাম্য হারিয়ে আরমানের বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। শার্ট আঁকড়ে ধরে সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি তখনো নিচের দিকে। কোনো এক অজানা কারণে, একবারও আরমানের দিকে তাকাচ্ছে না।

সেই ব্যাক্তিটি বলে উঠলো, “বাহ আমাদের দুজনের পছন্দের অনেক মিল আছে দেখছি। তবে আপনি যেহেতু এই রমনীর গায়ে আগে হাত দিয়েছেন তাই এই রমনী আপনার। আমি অন্য কাউকে বেছে নিচ্ছি।”

এদিকে ওই রুমের সবাই হতবাক। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। সবার জানা মতে আরমান শাহরিয়ার এর মেয়েদের প্রতি কোনো নেশা নেই। কিন্তু আজ, চোখের সামনে দেখা এই দৃশ্য একেবারে অকল্পনীয়।

আরমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। গম্ভীর গলায় মিস সুইটি ব্যানার্জিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মিস ব্যানার্জি! আজ রাতের জন্য আমার একে চাই। আপনার কোনো আপত্তি আছে?”

ঘরের বাতাস যেনো থমকে যায়। আরমানের কথায় মহিলাটির মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর কিছু মানুষের মুখে বিস্ময়ের ছাপ। কিন্তু আশেপাশের অন্য মেয়েদের চোখে তখন ঈর্ষার ছায়া। তারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই মেয়েটির দিকে, যাকে আরমান নিজের জন্য বেছে নিল।

রঙিন ছোটো ছোটো কাপড়ে দৃশ্য মান শরীর এবং সেজে-গুঁজে আসা মেয়েদের উপেক্ষা করে এই সাধারণ, গাউন পড়ে পুরো শরীর ঢেকে রাখা, মাথা নিচু করে থাকা মেয়েটির মধ্যে এমন কী ছিল—এই প্রশ্ন তখন তাদের চোখে মুখে লেখা।

মিস সুইটি মুখে একটা নির্লজ্জ মার্কা হাসি নিয়ে বলল, “অবশ্যই মিস্টার আরমান, আপত্তি কেনো থাকবে? এই ব্যাবস্থা তো আপনাদের জন্যই। আপনি যার গায়ে হাত রেখেছেন, আজ রাতে সেই মেয়েই উপস্থিত থাকবে আপনার সেবায়। আপনি নিয়ে যেতে পারেন ওকে, আপনার জন্য স্পেশাল রুমের ও ব্যাবস্থা করা আছে। রুম নাম্বার 206।”

এতোকিছুর পরও মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, মাথা নিচু করে, সম্পূর্ণ উদাসীন। একবারও চোখ তুলে তাকায়নি সে। আরমানের হৃদয়ে যেন জমে থাকা আগ্নেয়গিরি আবারো জেগে উঠছে— কেন এতটা উদাসীন আজ ও? কেন ও তাকাচ্ছে না তার দিকে? এই অনাগ্রহ যেন আগুনের মতো জ্বালিয়ে দিচ্ছে আরমানকে।

আরমান এক ঝটকায় মেয়েটিকে নিজের কাঁধে তুলে নিলো। তারপর গটগট পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সকলকে অবাক করে দিয়ে।

এরপর 206 নাম্বার রুমে গিয়ে দরজা লক করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো মেয়েটিকে।

আরমানের চোখ তখনও মেয়েটির মুখে। তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে—যেন মেয়েটিকে নতুনভাবে চেনার চেষ্টা করছে। আর মেয়েটি? মাথা নিচু করে, চোখ তুলে তাকতেও সাহস পাচ্ছে না যেনো। কিন্তু তার মুখে কোনো অনুতাপের ছাপ নেই, নেই কোনো কাতরতা।

আরমান ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“এই ব্যবসা কবে থেকে শুরু করলে মিস মায়া তালুকদার?”

হ্যাঁ মেয়েটির নাম মায়া। মায়া তালুকদার। আরমানের প্রাক্তন স্ত্রী। এই শহরের কেউ জানে না তাদের অতীতের সম্পর্কের কথা, শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া।

আরমান মায়াকে ডিভোর্স দিয়েছিল— তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হওয়া সেই বিবাহের ভার সইতে না পেরে।

এক বছরের দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম সে এত কাছে থেকে মায়াকে দেখছে। সেই বিয়ের পর, যে বিয়ে ছিল শুধুমাত্র পারিবারিক চাপের ফল, কখনো মায়াকে শাহরিয়ার ম্যানশনে আনতে দেয়নি।

বিয়ের পরও মায়া রয়ে গিয়েছিল তার বাবার বাড়িতে। শুধুমাত্র দু’পক্ষের পরিবার ছাড়া আর কেউ জানত না তাদের বিয়ের কথা। সম্পর্কটা যেন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই এক বছরে আরমান কোনো খোঁজ নেয়নি, কোনো যোগাযোগ রাখেনি। এবং একদিন হঠাৎ করে পাঠিয়েছিল ডিভোর্সের কাগজ, সঙ্গে কিছু ভরণপোষণের অর্থ।

মায়া চুপচাপ সেই কাগজে সই করে দিয়েছিল। টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিল, অভিমান নাকি, একরকম নীরব আত্মমর্যাদায়, আরমানের জানা নেই। তারপর থেকে আর কখনো তাদের দেখা হয়নি—আজকের এই রাত পর্যন্ত।

আরমান আবারো তাচ্ছিল্য মেশানো কন্ঠে বলল, “কি হলো? উত্তর দাও। কবে থেকে শুরু করলে এই ব্যাবসা?”

আরমানের কথার মধ্যে ছিল এমন তিক্ততা, যেন প্রতিটি শব্দ মায়ার হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধছে।
হয়তো সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে মায়ার—যেদিন প্রথম আরমানকে দেখেছিল, সেদিন থেকেই যেন একটা নিঃশব্দ ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল তার মধ্যে। জানত, এই বিয়ে আরমানের ইচ্ছায় হয়নি, কিন্তু তবুও নিজের হৃদয়কে প্রশ্রয় দিয়েছিল—আজ না হয় কাল, একদিন সে জায়গা করে নেবে এই মানুষটার মনে। নিজে থেকেই সে চেষ্টা করেছে—সংসার গড়ার, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার। কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছে শুধু অবহেলা, অবজ্ঞা আর মৌন তিরস্কার।

মায়ার সব স্বপ্ন এক ঝটকায় ভেঙে পড়েছিল যেদিন ডিভোর্সের কাগজ এসে পৌঁছেছিল হাতে। শেষ চেষ্টাটুকুও শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন।

আজ, এত বছর পর সেই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, একেবারে ভিন্ন অবস্থানে। নিজেকে ধরে রাখতে চেষ্টা করলেও কণ্ঠে ধরা পড়ে যন্ত্রণার ছাপ। ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে, “সেটা আপনার না জানলেও চলবে মিস্টার আরমান শাহরিয়ার। আপনি আপনার কাজ করুন।”

আরমান তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “খুব তাড়া দেখছি তোমার এই কাজ করার জন্য। তা হঠাৎ এই রাস্তায় নামলে যে? তোমার বাবা জানে তো?”

“বাবা জানে কি না সেটা আপনার দেখার বিষয় নয়। বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে। এখন এই ডিভোর্সি মেয়েরও কিছু স্বপ্ন, চাহিদা আছে। যেগুলো পূরণ করার জন্য টাকার দরকার পড়ে। আর বাবার ঘাড়েই বা কতদিন আর বোঝা হয়ে থাকবো? তাই নিজের চাহিদা মিটানোর জন্য নিজেই রাস্তা খুঁজে নিয়েছি।”

মায়ার কথা শুনে আরমানের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। কেনো জানি প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে।

“Wow, very good. আর তাই নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য এই রাস্তায় নেমে গেলে? ডাইরেক্ট দে*হ ব্য*বসা? তুমি যে এতোটা নোংরা এবং চরিত্রহীন মেয়ে সেটা আমি কল্পনাতেও ভাবেনি। তোমার মতো মেয়ের সাথে যে আমার বিয়ে হয়েছিল, সেটা ভাবতেই ঘৃণা আসছে। তোমার মতো মেয়ে আমার স্ত্রীর মর্যাদার পাওয়ার যোগ্য নয়!”

আরমানের বলা কথা গুলো মায়ার হৃদয়ে ধারালো ছুরির ন্যায় আঘাত করছিল। কিন্তু মুখে ধরে রেখেছিল এক অদ্ভুত হাসি। তারপর বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আরমানের কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। কণ্ঠে এক ধরনের নির্লজ্জ আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ল—
“এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই মিস্টার। চলুন আপনি আপনার কাজ শুরু করুন। যতো তাড়াতাড়ি আপনার সাথে কাজ শেষ করবো ততো তাড়াতাড়ি আবার অন্য ক্লাইন্টের কাছে যেতো পারবো আমি।”

আরমান যেন জমে গেল। চোখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল, আর গলায় স্পষ্ট রাগের কম্পন—
“অন্য ক্লায়েন্ট? তোমার কি অনেক ‘ক্লায়েন্ট’ আছে নাকি?”

প্রশ্নটাতে বিষ মেশানো কৌতুক ছিল, আবার ছিল ক্ষোভের চাপাও। মায়া ওর দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি টেনে বলল, “হুম অবশ্যই। এইসব কাজ করবো আর অনেক ক্লাইন্ট থাকবে না তাই কি কখনো হয় নাকি?”

ওর এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি শুনে আরমানের চোখ রক্তিম হয়ে উঠল, চোয়ালে উত্তপ্ত রাগের আঁচ। এক ঝটকায় ওর দিকে এগিয়ে এসে আরমান শক্ত হাতে মায়ার চিবুক চেপে ধরল। মায়া যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলেও মুখে সেই জ্বালাময়ী ঠোঁটের হাসিটুকু ধরে রাখল। আরমানের কণ্ঠে গর্জনের মতো শব্দ।

“ডিভোর্সের কাগজ পাঠানোর সঙ্গে কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছিলাম। যখন তুমি টাকাটা ফিরিয়ে দিলে, তখন ভেবেছিলাম তুমি আত্মসম্মানী একটা মেয়ে। মনে হয়েছিল কোথাও একটা ভুল করেছি আমি, তোমার জীবনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু আজ তোমাকে এই অবস্থায় দেখে সেই অনুভূতিটুকুও শেষ হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি, তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে একদম ঠিক করেছি। আজ পর্যন্ত কতজন পুরুষকে এই শরীরের স্বাদ দিয়েছ? কতজন পুরুষ তোমার এই দেহে তৃষ্ণা নিবারণের আশ্রয় পেয়েছে? উত্তর দাও। চুপ কেন?”

আরমান প্রচন্ড রাগে মায়ার চিবুক শক্ত করে ধরে কথা গুলো জিজ্ঞাসা করল। মায়ার প্রচন্ড ব্যাথা লাগছে কিন্তু সেই ব্যাথার ছাপ মুখে ফুটে উঠতে দিলো না। অনেক কষ্টে হাল্কা হেসে মায়া বলল, ” এতো কিছু জেনে আপনার কি লাভ মিস্টার আরমান শাহরিয়ার? শুধু এতোটুকু জেনে রাখুন, আমি অনেকের সাথে খেলেছি। বিশ্বাস করুন, আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে, আমার সার্ভিস আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। অভিযোগ করার একটুও সুযোগ দেবো না।

মায়ার কথাগুলো আরমানের রক্তকে আরও গরম করে দিচ্ছিল, ও মায়াকে বিছানার কাছে নিয়ে যায় এবং জোর করে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয়। মায়ার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে আরমান বলল, “তোমার কতটা অভিজ্ঞতা আছে দেখাও আমায়, আমি চাই তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করো।”

মায়া তার মুখে একটি ধূর্ত হাসি দিয়ে আরমানকে কাছে টেনে নেয়।

চলবে….