আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-১৫+১৬

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_15
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

আরমান মায়ার মাথা টা ভালো করে বুকে চেপে ধরলো। ঝড়ের এতোটাই বেগ যে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে আরমানের। অতো স্বাস্থ্যবান মানুষটাকেও মনে হচ্ছে উড়িয়ে ফেলে দেবে ঝড়ে। চারিদিক অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে চারিপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে।

আরমান মায়াকে কোলে নিয়েই অনেক কষ্ট করে এগিয়ে গেলো ওই চায়ের দোকান টার দিকে। দোকান টার সামনে গিয়ে, দুই হাতে মায়াকে কোলে নেয়াই পা দিয়ে আওয়াজ করলো টিনের বানানো দরজায়। আর মুখে আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠলো, “কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প মি!! একটু দরজা টা খুলুন প্লিজ।”

চারিদিকে ঝোড়ো হাওয়া আর বজ্রপাতে আওয়াজে হয়তো ভিতরে থাকা মানুষগুলোর কানে আরমানের গলার আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না। আরমান পা দিয়ে জোড়ে জোড়ে শব্দ করতে লাগলো টিনের দরজায়। তখনি ভিতর থেকে আওয়াজ হলো হয়তো কেউ দরজা খুলছে।‌ আরমান একটু সরে দাঁড়ালো। ঠিক তখনি আওয়াজ করে খুলে খুলে গেলো টিনের দরজা, সামনে একজন একজন মধ্য বয়সী হ্যাঙলা পাতলা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলার সাথে সাথে ভিতর থেকে কিছুটা আলো এসে বাইরেটাও আলোকিত করে দিলো।

হ্যাঁ আরমান ঠিকই ধরেছিল, এটা একটা ছোটো চায়ের দোকান। ভিতর দিয়ে হয়তো ছোটো বাড়ির মতো আছে। আসলে একটা ছোটো বাড়িই তার সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট দোকান।

লোকটি বলল, “কি হয়েছে বাবা? এতো রাতে? আরে তোমার কোলে দেখছি কেউ আছে!! এসো, এসো আগে ভিতরে এসো। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো যে।”

লোকটির ভিতরে যেতে বলাই আরমান তাড়াতাড়ি মায়াকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। সামনেই একটা বেঞ্চ রাখা ছিল, আরমান আর কোনো কিছু না ভেবেই মায়াকে ওই বেঞ্চ এ শুইয়ে দিলো। অনেকক্ষণ থেকে কোলে নিয়ে আছে, তাই ওর পুরো হাত ব্যাথা করছে।

মায়া অজ্ঞান আর আরমানের কোলে থাকাই ওর গায়ের ওরনা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সামনে একজন বয়স্ক লোক। তাই আরমান কিছুটা সংকোচ নিয়েই মায়ার গায়ের ওরনাটা কিছুটা টেনে নামিয়ে দিলো। তারপর লোকটার দিকে ঘুরে বলল, “আসলে আমাদের গাড়িটা মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে গেছে। আর ও বজ্রপাতের ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।”

লোকটি:- “ওহ বুঝতে পেরেছি। তা ও তোমার বউ বুঝি?”

আরমান এই কথার প্রতিউত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। তখন একজন মধ্য বয়সী মহিলা এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি বলল, “কি সব বলছো তুমি? ওদের দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে যে ওরা স্বামী স্ত্রী। আর তুমি প্রশ্ন করছো?”

তারপর আরমানের দিকে তাকিয়ে মহিলাটি বলল, “তুমি ওকে এখানে শোয়ালে কেন বাবা? ভিতরে নিয়ে আসো। ওই টুকু বেঞ্চ থেকে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে।‌ তুমি ওকে ভিতরে নিয়ে আসো।”

মহিলাটির কথায় আরমান আবারো মায়াকে কোলে তুলে নিলো, তারপর মহিলাটিকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো ভিতরের দিকে। একটা ছোট্ট ঘরে একটা ছোট্ট কাঠের চৌকি। তাতে মহিলাটি তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁথা বিছিয়ে দিলো, সাথে একটা বালিশও দিলো। এটা দেখে আরমান বলল, “আন্টি ও তো ভিজে গায়ে আছে, কাঁথা ভিজে যাবে তো।”

মহিলাটি:- “ওহ কোনো ব্যাপার না বাবা। তোমরা বড়ো ঘরের মানুষ, শুধু চৌকিতে শোয়ালে গায়ে হাতে ব্যাথা করবে। তুমি চিন্তা করো না, জামা কাপড় পাল্টানোর পর আবারও আমি কাঁথাটা পাল্টিয়ে দেবো। তুমি শুইয়ে দাও তোমার বউকে।”

আরমান আর কিছু না বলে মায়াকে শুইয়ে দিলো। মহিলাটি বলল, “ওর তো জামা গুলো পাল্টাতে হবে বাবা। না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”

আরমান:- “হ্যাঁ আন্টি। প্লিজ ওর এই ভিজে জামাটা একটু পাল্টানোর ব্যবস্থা করুন।”

মহিলাটি:- “হ্যাঁ বাবা আমি দেখছি। তুমি আসো তোমারও তো জামা প্লাটাতে হবে। তুমিও ভিজে গেছো।”

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আরমান বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। দুই কামরার মাটির বাড়ি। ঘরে গুলো ছোটো ছোটো। বাড়িটির পিছনের দিকে দোকানটি। আর সামনেই রোড। বাড়ি যাওয়া আসার এই রাস্তায় এই দোকানটিকে প্রতিদিন দেখে আরমান। আশেপাশে কোনো ঘর বাড়ি নেই। এরই মধ্যে দূরে জোড়ে কোথাও বজ্রপাত হলো তাই কারেন্ট চলে গেলো। সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে গেলো চারিপাশ। লোকটি এবং মহিলাটি তাড়াতাড়ি করে হ্যারিকেন জালালো দুটো। একটা হ্যারিকেন নিয়ে মহিলাটি ছুটে গেলো মায়া যেই ঘরে আছে সেই ঘরে।

লোকটি জানালো তাদের নাকি বস্তির ভিতরে আগে বাড়ি ছিল। আর এই দোকান অনেক আগেই করেছিল। তাদের এক মেয়ে ছিলো, কঠিন রোগ হয়েছিল তার। টাকা পয়সার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারেনি। তাই মারা গেছে। জীবন তো কারোর জন্য থেমে থাকে না। জীবনে চলতে গেলে টাকার দরকার। উনি ইনকাম করা বন্ধ করে দিলে তো আর পেট চলবে না। তাই উনি দোকানে আসলে বউ তার মেয়ের শোকে সারা দিন কান্না করতো। বউকে বাড়িতে একা রেখে এসেও দোকানে তার মন টিকতো না তাই এই কারণে এই ফাঁকা জায়গা এই ছোট্ট বাড়িটা বানানো।

মহিলাটি মায়াকে যেই ঘরে রাখা হয়েছে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে একটা নতুন লুঙ্গি গেঞ্জি আর একটা শাড়ি নিয়ে এসে আরমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও বাবা ভিজে জামা কাপড় গুলো পাল্টে এগুলো পড়ে নাও। তুমি বলছি বলে আবার রাগ করো না, বুঝতে পারছি বড়ো ঘরের মানুষ তোমরা। তবুও তুমি বলছি কারণ তোমরা আমাকে ছেলে মেয়ের বয়সী।”

আরমান তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “আরে আন্টি, তুমিটাই ঠিক আছে। ওহ কোনো ব্যাপার না। আমি রাগ করছি না। বরং ভালো লাগছে।”

মহিলাটি মুচকি হেসে বলল, “তোমরা বড়ো ঘরের হলে কি হবে মনটা কিন্তু অনেক ভালো।”

আরমান কিছুটা বোকা হেসে লুঙ্গি গেঞ্জি এবং শাড়িটা দেখিয়ে বলল, “কিন্তু আন্টি আমি তো শাড়ি পড়াতে পারি না। আর এই লুঙ্গিও পড়তে পারি না।”

মহিলাটি:- “আরেহ দেখছো! আমিও না, হ্যাঁ সেটাই তো তুমিই বা কিভাবে শাড়ি পড়াতে পারবে? কোই আমাকে দাও আমিই পড়িয়ে দিচ্ছি। আর তোমার চাচা দেখিয়ে দেবে কিভাবে লুঙ্গি পড়তে হয়। আসলে তোমার চাচি লুঙ্গি ছাড়া তো আর কিছু পড়ে না তাই এইসব প্যান্ট আমাদের ঘরে নেই তাই কিছু মনে করো না বাবা।”

আরমান:- “না আন্টি আমি কিছু মনে করছি না। আপনি যান, ওর জামাটা পাল্টে দিন।”

মহিলাটি চলে গেলো। আর এদিকে আরমান শার্ট কোর্ট খুলে গেঞ্জি পড়ে নিলেও লুঙ্গি টা পড়তে পারলো না। লোকটি অনেক দেখিয়ে দিলেও পারলো না। শেষ পর্যন্ত ওই লোকটি পড়িয়ে দিলো। কিন্তু তবুও আরমান ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি লুঙ্গির গিট খুলে পড়ে যাবে। আর একবার যদি পড়ে যাই তাহলে ওর সাধ্য নাই যে নিজে পড়ে। তাই লোকটিকে একটি সেটপিন এনে দিতে বলল। লোকটি একটা বড়ো সাইজের সেটপিন এনে দিলে আরমান তা নিজের মতো করে লুঙ্গিটা টাইট করে সেটপিন এঁটে নিলো। এবার যেনো একটু শান্তি পেলো আরমান। যাক বাবা আর ভয় নেই লুঙ্গি খুলে যাওয়ার।ও চেয়েছিল ভেজা প্যান্টেই থাকতে। কিন্তু উনারা ওদের জন্য এতো করছে, আর ওর লুঙ্গি না পরায় যদি কিছু মনে করে, তাই এই সেটপিন দিয়ে লুঙ্গি পড়া।

কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন, “জামা তো পাল্টিয়ে দিয়েছি বাবা। জ্ঞান না থাকায় শাড়িটা কোনো রকমে গায়ে পেঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটার শরীরে তো ভীষণ জ্বর এসেছে। জ্বরে একেবারে গা পুঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।”

আরমান এটা শুনে তাড়াহুড়ো করে গেলো মায়া যেই ঘরে আছে সেই ঘরে। গিয়ে মায়ার কপালে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই গা ভীষণ গরম।‌ হাত দেওয়া যাচ্ছে না একেবারে। হ্যারিকেনের আলোয় মায়ার মুখটা আরো মায়াবতী লাগছে। চারিপাশে আবছা হোলদেটে আলো।

তখনি মহিলাটি একটা বাটি করে জল আর একটা কাপড়ের টুকরো হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। আরমান তাড়াতাড়ি মায়ার মাথার কাছে বসে বলল, “আমাকে ওটা দিন আন্টি আমি পানি পটি দিয়ে দিচ্ছি।”

মহিলাটি:- “আগে তুমি তোমার বুকে আর একবার কোলে তুলো। বিছানা টা কিছুটা ভিজে গেছে। পাল্টাতে হবে।‌”

আরমান মহিলাটির কথায় মায়াকে আবারও কোলে তুলল। এরপর মহিলাটি পানির বাটি পাশে রেখে বিছানা টা পাল্টে দিলে আরমান সাবধানে মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

এরপর মহিলাটি পানির বাটি আরমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আর আরমান কাপড় টা ভিজিয়ে মায়ার কপালে দিতে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলাটি হাতে একটি থালা এবং একটা ওষুধ নিয়ে ফিরে এলেন। উনি বললেন, “এতে দুটো রুটি আর তরকারি আছে বাবা। মেয়েটার একটু জ্ঞান ফিরলে খাবারটা খাইয়ে দিয়ে এই প্যারাসিটামল ট্যাবলেট টা খাইয়ে দিও।”

আরমান:- “ঠিক আছে আন্টি। আপনি যান। আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক টা কষ্ট পেতে হচ্ছে আপনাদের।”

চলবে…

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_16
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

আরমান:- “ঠিক আছে আন্টি। আপনি যান। আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক টা কষ্ট পেতে হচ্ছে আপনাদের।”

মহিলাটি:- “আরে না বাবা এতে কষ্টের কি আছে? একজন মানুষ হয়ে যদি আরেকজন মানুষের উপকার করতে না পারি তাহলে আর মানুষ কেন হলাম? চিন্তা করো না বাবা তোমার বউ আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা পাশের ঘরে আছি, কোনো দরকার হলে অবশ্যই ডাকবে।”

এই বলে মহিলাটি ঘরের দরজা টা টেনে দিয়ে চলে গেলো। আর আরমান হ্যারিকেনের আলোয় মায়ার কপালে পানি পটি দিতে থাকলো। আরমান মনে মনে ভাবে, কি আছে এই মেয়ের মুখে যে শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চায়? কেন চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না? আচ্ছা এই মায়াই যদি মাইশা হতো তাহলে কতই না ভালো হতো? না না কি ভাবছে এসব ও? মায়া কেন মাইশা হতে যাবে? ও কি এই মায়ার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে? না না ওকে কিছুতেই এই মেয়ের প্রতি দূর্বল হলে চলবে না। কিছুতেই না। ও শুধু ওর পিচ্চি মায়াবতী কে ভালো বাসে। হ্যাঁ মায়াবতীই তো। ওর পিচ্চি মায়াবতী। যার আবছা মুখ এখনো ভুলতে পারেনি আরমান। সেই মায়া ভরা দুই চোখ এখনো ভুলতে পারেনি আরমান।

সেই পিচ্চি মায়াবতীর চোখের কথা মনে করতেই আরো দুটি চোখ ভেসে উঠলো আরমানের মনের ক্যানভাসে। আর তাতেই চমকে উঠলো ও। হ্যাঁ এই দুই চোখের তো অনেক মিল। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ ও তো এতোদিন খেয়াল করেনি। মায়া আর ওর পিচ্চি মায়াবতীর চোখের তো অনেক মিল। আর মুখের গঠনটাও….. না না এটা কিভাবে সম্ভব? না ওর স্পষ্ট মনে আছে নেম প্লেট এ মাইশা তালুকদার নাম ছিল, আর এর নাম তো মায়া… একমিনিট, তালুকদার… হ্যাঁ তালুকদার। মায়া আর মাইশা নামের শেষে একই পদবি।‌ না না ওকে খোঁজ লাগাতে হবে। জানতে হবে মায়ার ব্যাপারে। হ্যাঁ ওকে খোঁজ লাগাতে মায়ার ব্যাপারে। যেভাবেই হোক ও ওর পিচ্চি মায়াবতীকে খুঁজে বের করবেই।

আরমানের মন খুব করে চাইছে যেনো মায়াই ওর পিচ্চি মায়াবতী হয়। ওর অবুঝ মন ধরে নিলো মায়াই ওর পিচ্চি মায়াবতী। কিন্তু উপরওয়ালার লীলা খেলা কেই বা জানে? আমরা কি আর যেমনটা ভাবি তেমন টা কি আর সব সময় হয়? হয় না। আর এটাই হচ্ছে বাস্তব।

এরই মধ্যে মায়ার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু এখনো জ্বরের ঘোরে আছে। জ্বরের ঘোরেই পাপা! পাপা! বলে ডাকছে মেয়েটা। আর মায়ার এই ডাকেই আরমান নিজের ভাবনার সাগর থেকে বেরিয়ে এলো?

আরমান:- “মায়া! এই মায়া! শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?”

কিন্তু না। মায়ার কোনো হুঁস নেই। আরমান মায়ার কপালে হাত দিয়ে দেখলো এখনো অনেক জ্বর আছে। মায়ার গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটো নড়ছে। হয়তো এখনো কিছু বলছে মেয়েটা। আরমান মাথাটা একটু নিচু করে তার কানটা নিয়ে গেলো মায়ার মুখের কাছে, কি বলছে মেয়েটা তা শোনার জন্য।

মায়া অস্পষ্ট স্বরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলার চেষ্টা করছে, “পা..পা..পাপা! খু..ক্ষু..ক্ষুধা লেগেছে তো। খা.. খাইয়ে দা..দা..দাও না পা..পাপা।”

ওই মহিলাটি খাবারের থালা এবং ওষুধটি একটা টুলের উপর রেখে গেছিল। আরমান মায়ার বলা অস্পষ্ট স্বরের কথাটা শুনে উঠে গিয়ে সেই টুল নিয়ে এসে চৌকির পাশে রাখলো। তারপর মায়াকে ধরে তুলে পিঠের কাছে একটা বালিশ রেখে বসানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মায়া অতিরিক্ত দূর্বল থাকায় হেলে পড়ে যাচ্ছে। তাই আরমান নিজে ওর পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলো তারপর মায়াকে নিজের বুকের কাছে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিলো। এরপর হাত বাড়িয়ে খাবারের থালা টা নিয়ে রুটি থেকে ছোটো টুকরা ছিঁড়ে তা তরকারিতে ডুবিয়ে মায়ার মুখে তুলে দিলো। মায়াও জ্বরের ঘরে থেকেই খাবারটা মুখে নিলো। এভাবেই আরমান একটা রুটির অর্ধেক টা খাইয়ে দিলো। এরপর মায়া আর খেতে চাইলো না। তাই আরমান প্যারাসিটামল ট্যাবলেট টা খাইয়ে দিলো মায়াকে। এরপর মায়া কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আরমানের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে আরাম করে শুয়ে পড়লো। ব্যাচারি মায়া বুঝতেও পারলো না যে যাকে ও জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে সে ওর পাপা নয় তার এক্স হাজবেন্ড আরমান।

এদিকে আরমান মায়ার এই কাজে পুরো স্ট্যাচু হয়ে গেলো। ওর মনে হচ্ছে যেন থমকে গেলো চারিপাশ। হার্টবিট এতোটাই বেড়ে গেলো যে ও নিজেই শুনতে পাচ্ছে।

ঘরটা নিস্তব্ধ। ঘরটিতে থাকা ছোট্ট জানালাটি দিয়ে ঢোকা ঝোড়ো হাওয়া শরীর জুড়ে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার মায়ার শরীরের উত্তাপ নিজের গায়েও কিছুটা অনুভব করতে পারছে আরমান। পুরো ঘর ডুবে আছে নরম, সোনালি হ্যারিকেনের আলোয়। সেই আলোতে মায়ার মুখটা যেন আরো বেশি নির্মল, কোমল মনে হচ্ছে। চোখে এক অপার মুগ্ধতা, নিয়ে তাকিয়ে আছে আরমান মায়ার দিকে। মায়ার ভেজা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আরমানের বুকে ছড়িয়ে আছে।

আরমানের হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মায়ার চুলের দিকে। আলগোছে সে চুলগুলো গুছিয়ে দেয়—ঠিক যেন গাছতলার ভেজা ভোরের ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছে খুব সাবধানে, যাতে একটাও ফুল নষ্ট না হয়।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

সকাল বেলা….

মায়া নিজেকে একটা শক্ত পোক্ত বাঁধনে আবিস্কার করলো। মনে হচ্ছে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। না আর থাকতে পারলো না মায়া। চোখ খুলে ফেললো ও। আর নিজেকে কারোর বুকে আবিস্কার করলো। অনেক কষ্টে নড়েচড়ে মুখ তুলে ঘুম ঘুম চোখে তাকালো কার বুকে আছে দেখার জন্য। আর তাকাতেই আরমানের মুখ দেখতে পেলো ও। মায়ার তখনো ঘুম ছাড়েনি। তখনো ঘুমের ঘোরে আছে ও। আরমানের মুখটা ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মায়া ওর হাতটা বাড়িয়ে আরমানের খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়িতে বুলিয়ে দিলো। কিন্তু নিজেও জানে না ও কি করছে।

এদিকে মায়ার নড়াচড়া আর তার গালে করা স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলো আরমানের। চোখ মেলে তাকালো ও। আর চোখ মেলে তাকাতেই মায়ার ফোলা ফোলা মুখে দৃষ্টি আটকে গেলো ওর। গাল গুলো ফুলে আছে সাথে চোখ গুলোও। ভীষণ মায়াবী লাগছে মায়াকে দেখতে। কালকে রাতেও মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার খেয়াল নেই।

এদিকে আরমানকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে মায়া যেন নিজের হুঁশ ফিরে পেলো। এক ঝটকায় নিজেকে আরমানের হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত করলো। ছিটকে দূরে সরে বসলো। তারপর অবাক গালায় বলল, “একি আপনি? আর এইভাবে আমরা দুজন…আবার কিছু করেছেন আমার সাথে তাই তো?”

মায়া কিছুটা জোড় গলাতেই কথাটা বলল, তাই আরমান তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে এক হাতে ওর মুখ আর এক হাত দিয়ে ওর দুটো হাত চেপে ধরলো। তারপর চাপা অথচ গম্ভীর গলায় বলল, “একদম চিল্লাবে না। চুপ থাকো। আর আগে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠিক করো। তারপর আমি বলছি।”

আরমান কথটা মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে চোখ বন্ধ করে নিলো। আর এদিকে আরমানের বলা কথাটা শুনে মায়া নিজের দিকে তাকালো। আর তাকাতেই চমকে উঠলো ও। এরপর মুখ দিয়ে জোড়ে জোড়ে উম উম শব্দ এবং হাত নড়াচড়া করতে লাগলো।

মায়ার চমকানোর কারণ, পেটিকোটে শাড়ি গোঁজা থাকলেও ওর বুকে শাড়ির আঁচল নেই। শুধু ব্লাউজ পড়া। তাই মায়া নিজের গায়ের শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু মায়া একটা মেয়ে হয়ে কি আর একটা জীম করা স্বাস্থ্যবান পুরুষের সাথে পারে?

আর এদিকে বোকা আরমান মায়াকে শাড়ি ঠিক করতে বললেও নিজেই ওর হাত চেপে ধরে আছে। মায়া মুখ দিয়ে জোড়ে জোড়ে শব্দ করাই আরমান নিজের চোখ খুলে মায়ার চোখের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “কি হয়েছে?”

মায়া চোখের ইশারা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে তার হাত ছাড়ার জন্য। আরমান তা বুঝতে পেরে বলল, “ওহ সরি।”

এই বলে ও মায়ার হাত ছেড়ে দিলো। আর মায়া নিজের হাত ছাড়া পেতেই শাড়ির আঁচল টা তাড়াহুড়ো করে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর নিজের হাত দিয়ে আরমানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

আরমান এটা দেখে আবারও মায়ার দুই হাত নিজের এক হাত দিয়ে চেপে ধরলো। মায়া তখনো মুখ দিয়ে শব্দ করছে। আরমান কিছুটা নরম গলায় বলল, “প্লিজ মায়া আমার কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমার মুখ থেকে হাত সরাচ্ছি, কিন্তু প্লিজ চিল্লাবে না। দেখো আমরা অন্যের বাড়িতে আছি। দেখো চারিদিকে তাকিয়ে দেখো।”

মায়া তাকিয়ে দেখলো, হ্যাঁ সত্যিই সে এক অচেনা জায়গায় আছে। ছোটো একটা মাটির ঘর। মায়া ভীষণ অবাক হলো। একেবারে শান্ত হয়ে গেলো ও।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আরমান মায়াকে শান্ত হতে দেখে। ধীরে ধীরে ওর হাত এবং মুখ ছেড়ে দিলো। মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ও অবাক গলাতেই বলল, “আমরা এখানে কিভাবে এলাম? কাল রাতে তো গাড়িতে ছিলাম আর প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল।”

আরমান:- “হ্যাঁ। কাল খুব জোড়ে বজ্রপাত হওয়ায় তুমি ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এদিকে গাড়িটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্টার্ট নিচ্ছিল না। গাড়িতে থাকাটা রিস্কি হয়ে যেত। এই বাড়িটা আমাদের গাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই ছিল তাই আমি তোমায় নিয়ে এই বাড়িটাতে এসেছিলাম। আর এই বাড়ির মানুষ দুজন ভাবছে তুমি আর আমি স্বামী স্ত্রী। তাই এই এক ঘরে থাকতে দিয়েছে। আর আমি তোমার সাথে কিছু করিনি মিস। কিছু করলে তুমি ভালোই বুঝতে পারতে। অতটাও খারাপ মানুষ আমি না যে কারোর দূর্বলতার সুযোগ নেবো। এই বাড়িতে যেই মহিলা থাকে তিনিই তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দিয়েছিল। আর কাল রাতে তোমার খুব জ্বর এসেছিল। বসে বসে সেবা করছি আমি তোমার। কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। আর তুমি নিজেই তোমার পাপা ভেবে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিলে।”

বসে বসে সেবা করেছি কথাটা আরমান টুলে থাকা পানির বাটি এবং কাপড় টা দেখিয়ে বলল। মায়া সেটা দেখলো। এবং কাল রাতে আরমানের খাইয়ে দেওয়ার আবছা কিছু দৃশ্য মনে পড়লো ওর। আর তাতেই নিজের করা কান্ডের কথা ভেবে লজ্জা পেলো ও। মায়া লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো।

ঠিক তখনি দরজায় নক হওয়ার শব্দ হলো। বাইরে থেকে মহিলাটি বলছে, “বাবা! উঠেছো তোমারা? একজন নিতে এসেছে তোমাদের।”

আরমান:- “হ্যাঁ আন্টি উঠেছি আসছি আমরা।”

মহিলাটি:- “ঠিক আছে বাবা।”

এই বলে উনি চলে গেলেন। আরমান মায়ার উদ্দেশ্য বলল, “শুনো মায়া, ওরা কিন্তু জানে আমরা হাসব্যান্ড ওয়াইফ। এটা মনে রাখবে। যদিও আমি ওদের বলেনি, ওরা নিজেরাই ভেবে নিয়েছে। আমিও আর ওদের ভুল ভাঙ্গায়নি। তাই ওদের সামনে আমাকে স্যার বলবে না। ঠিক আছে?”

মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো তারপর বলল, “কিন্তু উনি যে বললেন কেউ একজন এসেছে আমাদের নিতে?”

আরমান চৌকি থেকে উঠতে উঠতে বলল, “হ্যাঁ। আবির এসেছে আমাদের নিতে। কাল রাতে আমি ওকে ম্যাসেজ করে দিয়েছিলাম। নেটওয়ার্ক ছিল না তাই কল যাচ্ছিল না। ম্যাসেজ দিয়ে রেখে ছিলাম যাতে নেটওয়ার্ক এলে চলে যাই। আর হ্যাঁ, নিজেকে ঠিক মতো গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসো। বাইরে লোক আছে।”

কথটা বলেই আরমান দরজা খুলে বেরিয়ে আবারও দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিলো। আর এদিকে মায়া হাঁ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আরমানের যাওয়ার দিকে। ও এতোক্ষণ খেয়াল করেনি যে আরমান লুঙ্গি পড়ে ছিল। আরমানকে লুঙ্গি ধরে কোনোরকমে হেঁটে যেতে দেখে মায়া খেয়াল করলো। এটা দেখে মায়া প্রথমে ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর কিছুক্ষণ মন খুলেই হাসলো। আগে দেখলে লোকটিকে রাগানো যেতো খুব। কেমন একটা আজব লাগছে উনাকে এই লুঙ্গিতে দেখে।

আরমান কালকে রাতে লোকটির সাথে গল্প করার সময় এক ফাঁকে আবিরকে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়েছিল ওদের পরিস্থিতির কথা। আর এই সাত সকালে আবিরও আরমানের ফোনের লোকেশন ট্রাক করে হাজির হয়েছে এখানে।

আরমান মায়াকে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতে বলার কারণ, মায়ার পরনের শাড়ী এলোমেলো হয়ে আছে। একজন অজ্ঞান থাকা মেয়েকে তো আর ভালো ভাবে শাড়ি পরানো যাই না তাই মহিলাটি কোনো রকমে শাড়ি কোমরে গুজে পেঁচিয়ে দিয়েছিল।

মায়া শাড়ী ঠিক করে মাথায় আঁচল দিয়ে হালকা ঘোমটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে আবির, আরমান আর একটা লোক মোড়াতে বসে আছে। কাল রাতে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় মাটির মেঝেটা হালাকা ভেজা ভেজা ভাব। আবির মায়াকে দেখে চিল্লিয়ে বলল, “আরে মায়া তোমাকে তো পুরো বউ বউ লাগছে!”

আরমান আবিরের এই কথা শুনে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “হ্যাঁ আমার বউকে বউ বউ লাগবে না তো কি লাগবে? বিয়ে করা বউ আমার ও।”

আবির অবাক হয়ে বলল, “আরে তোদের তো বিয়ে হয়ে ডি…..”

আর বলতে পারলো না আবির। আরমানের চোখের দিকে তাকিয়েই থেমে গলো ও। চোখ বড়ো বড়ো ও লাল করে তাকিয়ে আছে আরমান। যেনো চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে।

তখনি আবিরের ফোনে ম্যাসেজ এলো। আবিরের ফোন ওর হাতেই ছিল। তাকিয়ে দেখলো আরমানের ম্যাসেজ। ও মুখ তুলে আরমানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারো আরমানের চোখ রাঙানিতে থেমে গেলো। তারপর চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করলো। দেখলো তাতে লেখা, “এই বাড়ির মানুষ দুটো জানে আমি আর মায়া হাসবেন্ড ওয়াইফ। এটা ভেবেই ওরা আমাদের এখানে থাকতে দিয়েছিল। তাই ভালো হবে নিজের মুখটা বন্ধ রাখ।”

তখনি এই বাড়ির মহিলাটি ওদের জন্য চা নিয়ে এসেছিল। আবিরের বলা কথা উনার কানেও গেছে। তাই উনি অবাক হয়ে বললেন, “কি বলছো বাবা? ওরা স্বামী স্ত্রী….

আবির উনাকে পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল, “আরে আরে আন্টি আমি তো মজা করছিলাম আমার বন্ধুর সাথে। আর আপনি সত্যি ভেবে বসে আছেন? আসলে ওদের এই কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে। আমি তো বলছিলাম, আরে তোদের তো বিয়ে হয়ে একদিনের জন্য ছোট্ট করে হানিমুনও হয়ে গেলো। সাথে দারুন একটা ঝড় বৃষ্টির ভয়ংকর অ্যাডভেঞ্চার।”

আরমান আবিরের এই কথায় ভীষণ বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা সব সময় একটু বেশি বেশি করে। আর এদিকে তো আবিরের কথায় মায়া লজ্জা পেলো ভীষণ। সবকিছু জেনে শুনেও কি সব বলছে ওর আবির ভাইয়া।

মহিলাটি মুচকি হেসে বললেন, “ওহ তাই বলো। আচ্ছা বাবা অনেক হয়েছে মজা করা এবার নাও চা টা খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাবে না হলে। আর তুমি দাঁড়িয়ে কেনো মা? এখানে এসে বসো। তোমার তো কাল রাতে ভীষণ জ্বর এসেছিল। এখন কমেছে?”

উনি সবাইকে চা দিয়ে এগিয়ে গেলো মায়ার দিকে। তারপর মায়ার কপালে হাত রেখে দেখলো এখনো জ্বর আছে কিনা।

মহিলাটি:- “যাক বাবা জ্বরটা আর নেই।”

আবির অবাক হয়ে বলল, “সে কি মায়া তোমার জ্বর এসেছিল?”

আরমান দাঁতে দাঁত চিবিয়ে আবিরকে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ ওর জ্বর এসেছিল! তাড়াতাড়ি চল ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”

লোকটি:- “আরে তোমারা এখনি চলে যাবে? বসো একটু খাওয়া দাওয়া করে যাবে।”

আরমান মুচকি হেসে বলল, “না আঙ্কেল! আর থাকলে হবে না। অফিস আছে আমার। অফিস যেতে হবে। আবার ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছেও যেতে হবে।”

কথা গুলো বলেই আরমান চা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। আবির আরমানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে নিজেও তাড়াতাড়ি চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। আরমান মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এসো মায়া, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।”

মহিলাটি:- “তোমার জামাগুলো তো এখনো ভিজে আছে মা। আর বাবা তুমি তোমার ভেজা কাপড় গুলোই পড়ে নিয়েছো?”

আরমান:- “ওহ কোনো ব্যাপার না আন্টি। আমার আসলে ওই সব পড়ার অভ্যাস নেই তো তাই।”

মহিলাটি:- “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আর একটু দাঁড়াও, আমি তোমার বউয়ের জামা গুলো একটা প্যাকেটে ভরে দিই।”

বলেই মহিলাটি চলে গেলো। আর এদিকে আরমান যখন লুঙ্গি পড়া অবস্থায় বেরিয়ে ছিলো তখন আবির তো পুরো হাঁ হয়ে দেখছিল। যেনো মনে হচ্ছিল সামনে কোনো এলিয়েন দেখছে। তারপর হু হা করে অনেকক্ষন হেসেছিল ও। তাই আরমান ওই লুঙ্গি গেঞ্জি পাল্টে নিজের ভেজা জামা প্যান্টই পড়ে নিয়েছিল।

কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলাটি একটা প্যাকেটে করে মায়ার জামা কাপড় ভরে নিয়ে এসে মায়ার হাতে দিলো। তারপর মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আবার আসবে হ্যাঁ মা? আর নিজের খেয়াল রাখবে। জানো তুমি না একদম আমার মেয়ের বয়সী। আমার মেয়েটা থাকলে হয়তো এতদিনে তোমার মতোই হতো।”

বলতে বলতেই মহিলাটির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। লোকটি বলল, “তুমিও না যে কি বলো! আমাদের এই গরিবের ঘরে এতো বড়ো মানুষদের আবার আসতে বলছো?”

মায়া:- “আরে আঙ্কেল কি বলছেন এসব আপনি? আপনার যদি না থাকতেন তাহলে কাল আমাদের কি হতো ভাবুন তো? আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। আমরা আবার আসবো।”

আরমান:- “হ্যাঁ আন্টি আমরা আবার আসবো। আর আপনারা আমাদের জন্য যা করেছেন তা কোনো দিনও ভুলবো না। ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না আপনাদের। তবে আমি ছেলে হিসাবে কিছু দিলে সেটা নিতে হবে। আর আজকেই নেওয়ার কথা বলছিনা। আবারো আসবো একদিন। আর সেদিন আমি যেটা দেবো সেটা নিতে হবে। ফেরাতে পারবেন না কিন্তু আপনার এই ছেলেকে।”

এরপর ওরা আরো কিছু কথা বলে, ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় যেখানে আরমানের গাড়িটা ছিল সেখানে গিয়ে দেখলো। গাড়ির উপরে একটি গাছ ভেঙে পড়ে আছে। গাড়িটারও অনেক ক্ষতি হয়েছে। আরমান যেটার ভয় পেয়েছিল সেটাই হয়েছে। ভাগ্যিস ও মায়াকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

দুই দিন পর….

মায়া অফিস যাওয়ার জন্য পুরো রেডি। ও আলমারি খুলে সেই লকার টা খুলল ডাইরিটা বের করার জন্য। ও ভেবেছে আজ এই ডাইরি থেকে কিছু ডিজাইন নেবে। এই ডাইরিতে আঁকা ওর ডিজাইন কখনো কোথাও ব্যবহার করেনি। তাই মায়া লকার টা খুলল ডাইরিটা বের করার জন্য। তখনি নজর গেলো ওখানে থাকা সেই কাঠের বাক্স টাই। মায়া কি যেনো ভেবে ওটা হাতে নিয়ে বাক্সটা খুলল। আর খুলতেই দেখতো পেলো, একটা কিছুটা ভেঙে যাওয়া ঘড়ি। সেটা হাতে নিয়ে দেখলো তারপর ওটা আবারও রেখে দিয়ে দেখলো আরো কি যেন একটা আছে। সেটা হাতে তুলতেই কে যেনো ঝড়ের গতিতে এসে ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো।

আরমান মায়ার ঘরেই আসছিল কাজের ব্যাপারে কিছু কথা বলার জন্য। মায়ার ঘরের দরজা খুলাই ছিলো। বাইরে থেকে ভিতরে চোখ যেতেই দেখলো মায়ার কাঠের বাক্স খোলার দৃশ্য। আর ওর হাতে থাকা চেনা ঘড়িটা। আর তারপরই মায়া বের করলো সেই খুব করে চেনা ওর পিচ্চি মায়াবতীর জামার নেম প্লেট, যেটা আজও ভুলতে পারেনি ও।

চলবে…???🤨🤨