#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_17
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
মায়ার হাত থেকে জিনিসটা কে ঝড়ের গতিতে এসে ছিনিয়ে নিলো সেটাও দেখার সুযোগ মায়া পেলো না। সাথে সাথে সামনের মানুষটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
আর মায়া যেন পুরো থমকে গেলো। কি হচ্ছে ওর সাথে ও নিজেও বুঝতে পারছে না। আরমান মায়াকে নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কন্ঠে উৎফুল্লতা নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস মায়া! থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। হাজার ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে তোমায়। তুমি নিজেও জানো না, যে তুমি আমায় কি পাইয়ে দিয়েছো। অনেক অনেক থ্যাংকস।”
মায়া অবাক হয়ে বোকার মতো বলল, “কিন্তু আমি করেছি টা কি? আর আপনি প্লিজ আমায় ছাড়ুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। আর এমনিতেই আপনি এতো শক্ত করে ধরেছেন যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
আরমান মায়াকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে, কন্ঠে উৎফুল্লতা নিয়েই বলল, “ওহ সরি। আর তুমি যা করেছো তা হাজার ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে। আমার জান টাকেই ফিরিয়ে দিয়েছো তুমি।”
মায়া এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে ভাই কি করেছি সেটা তো বলেন?”
আরমান ওর হাতে থাকা নেম প্লেটটা দেখিয়ে বলল, “এই যে এটা। এটার মধ্যে আমার জানটা লুকিয়ে আছে। তুমি বুঝবে না।”
মায়া জিনিসটা কি সেটা হাতে নিয়ে দেখার জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু তার আগেই আরমান নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে হাত সরিয়ে দিলো।
মায়া বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে জিনিসটা কি সেটা তো দেখতে দিন।”
আরমান মুখে হাসি নিয়ে বলল, “না একদম না। এটা কারোর হাতে দেওয়া যাবে না। বললাম না এটার মধ্যে আমার জান লুকিয়ে আছে। আর হারাতে চাই না আমি এটাকে। আচ্ছা আমি যাই। পরে কথা হবে। আর হ্যাঁ এটা খুঁজে দেওয়ার জন্য তুমি যা চাও তোমাকে তাই দেবো। এখন আসি। ওকে খুঁজে বের করতে হবে আমায়।”
বলেই আরমান ওই বাক্সটা মায়ার হাত থেকে নিয়ে নেম প্লেট টা নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আর এই পুরো বিষয়টা মায়ার মাথার উপর দিয়ে গেলো। কি থেকে কি হলো কিছুই বুঝলো না ও। হ্যাঁ ওই নেম প্লেটটি ভীষণ চেনা চেনা লাগলো ওর কাছে। তাই হাতে নিয়ে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আরমান চলে গেলো। আরমানের এমন অদ্ভুত বিহেভ করাই ভীষণ অবাক হলো মায়া। কি আছে ওতে? যে বলছে ওর জানটাই নাকি আছে ওর মধ্যে? মিস্টার আরমান হয়তো পাগল হয়ে গেছে, আর ও বেশি বেশি ভাবলে নিজেও পাগল হয়ে যাবে। তাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো দিল পুরো বিষয়টা। তারপর ও নিজের কাজে মন দিলো।
এদিকে আরমান নিজের রুমে এসে নেম প্লেটটি হাতে ধরে বসে আছে। মুখে তার লেগে আছে বিজয়ের হাসি। মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া জিতে নিয়েছে ও। যেই মানুষটির মুখ সব সময় রাগী গম্ভীর হয়ে থাকত আজ সেই মানুষটিকে দেখলে যে কেউ অবাক হবে। কারণ আজকের আরমান যে সবার অচেনা।
ও বাক্স থেকে সেই ভাঙ্গা ঘড়িটা বের করলো। এই ঘড়িটা ওরই ছিল। আজ থেকে দশ বছর আগে যখন ওর এক্সিডেন্ট টা হয় তখন ওর হাতে এই ঘড়িটাই পড়ে ছিল। তাই ঘড়িটা চিন্তে একটুও ভুল হলো না আরমানের। এই বাক্সটা মায়া দাদুর আলমারি থেকে বের করলো। তার মানে এই জিনিস দুটো ওর দাদুর কাছেই ছিল। কই কখনো বলেনি তো এই বিষয়ে। আর দাদুই বা কেন এটাকে এতো যত্ন করে রেখে দিয়েছিল? সেই অ্যাক্সিডেন্টে ওর জ্ঞান হারানোর আগে পর্যন্ত এই নেম প্লেটটি ওর হাতেই ছিল। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর এটার কথা ওর আর মনে ছিল না। এটা যেভাবেই হোক ওর হাত থেকে হয়তো ওর দাদু পেয়েছিল। আর রেখে দিয়েছিল। যাক গে সে সব। ও যে এই নেম প্লেটটি খুঁজে পেয়েছে এটাই অনেক। এবার ও ওর পিচ্চি মায়াবতীকে সহজেই খুঁজে বের করবে।
আরমান নেম প্লেটটি হাতে নিয়ে আবারও দেখতে শুরু করলো। প্রথমেই স্কুলের নাম গোল করে লেখা। তারপর নাম- মাইশা তালুকদার। ক্লাস- 6। রোল নাম্বার- 23।
মাইশা তালুকদার। আবারো সেই তালুকদার। মায়াও তো তালুকদার, তাহলে ওই কি ওর সেই পিচ্চি মায়াবতী? না না এটা কিভাবে সম্ভব? ওর নাম তো মায়া, আর ওর পিচ্চি মায়াবতীর নাম তো মাইশা। আর তালুকদার পদবি কি একজনেরই আছে। তালুকদার পদবি তো আরো অনেকের আছে। ও কি একবার মায়ার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখবে? না না ওকে সবকিছু বাদ দিয়ে এই নেম প্লেট এর মালকিন কে খুঁজতে হবে। মাইশা। হ্যাঁ মাইশায় ওর পিচ্চি মায়াবতী। এই মায়ার কথা ওর মাথা থেকে বের করে এই নেম প্লেটের মানুষটিকে খুঁজতে হবে।
আরমান ফোন বের করে, নেম প্লেটটির একটি ছবি তুলে নিলো। তারপর ছবিটা একজনকে পাঠিয়ে দিয়ে কল লাগালো তাকে। উনি কল রিসিভ করতেই আরমান বলে উঠলো, “বিরাট! মাইশার কোনো খবর পেয়েছো?”
বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “না স্যার। শুধু মাত্র একটা মেয়ের নাম দিয়ে কি তাকে খুঁজে বের করা যাই? তাও তো 20-22 বছরের মাইশা নামের অনেক মেয়েদের তারা যখন 10-12 বছরের ছিল সেই ছবি আপনাকে দেখিয়েছি। আপনি তো বলেছেন ওরা কেউ নয়। ছবিও আঁকিয়েছি আপনাকে দিয়ে, কিন্তু আপনি বর্ণনা ঠিক ঠাক না দিতে পারার জন্য সেই ছবি নাকি মাইশার মতো দেখতে হয়নি। এরপর আর কি করবো বলুন”
আরমান:- “আর চিন্তা নেই বিরাট। এবার হয়তো খুব তাড়াতাড়ি তুমি খুঁজে বের করতে পারবে। খুব বড়ো একটা ক্লু পাঠিয়েছে তোমায়। মোবাইল টা একবার চেক করো।”
বিরাট ওর ফোন চেক করে দেখলো আরমান একটা ছবি পাঠিয়েছে। ও ছবিটা ওপেন করে দেখলো। তারপর আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “স্যার এটা তো কোনো স্কুল ড্রেসের নেম প্লেট মনে হচ্ছে। নাম মাইশা তালুকদার। এক মিনিট… তার মানে আপনি যেই মাইশাকে খুঁজছেন এটা তারই স্কুল ড্রেসের? ওয়াও গ্রেট। এবার তো খুব সহজেই খুঁজে বের করা যাবে তাহলে।”
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
আরমান:- “হ্যাঁ ওটাই বলছি আমি। তুমি আগে এই স্কুল টিকে খুঁজে বের করো। তারপর ওই স্কুলে গিয়ে খোঁজ লাগাও মাইশার।”
বিরাট:- “একদম স্যার। আমি কালই বেরিয়ে পড়বো আপনার মাইশার খোঁজে। আপনি একদমই চিন্তা করবেন না। এবার আপনার মাইশাকে যেভাবেই হোক আপনার সামনে হাজির করবো।”
আরমান:- “না ওকে আমার সামনে হাজির করার দরকার নেই। তুমি শুধু ও কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করো। তারপর আমি নিজেই ওর সামনে হাজির হবো। আর কাল কেন? আজই বেরিয়ে পড়ো।”
বিরাট কিছুটা মিনতির সুরে বলল, “প্লিজ স্যার আমাকে আজকের দিনটা সময় দিন। আমি আসলে বাড়িতে এসেছি সকলের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। কাজের চক্করে বাড়িতে আসা হয় না অনেক দিন। তাই প্লিজ আমাকে আজকের দিনটা সময় দিন।”
আরমান বিরক্ত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, তারপর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে খুঁজে বের করো। আর টাকা পয়সার দিক দিয়ে কোনো চিন্তা করবে না। যত টাকা দরকার হবে আমি দেবো। কিন্তু আমার মাইশাকে চাইই চাই। তাই যেভাবেই হোক তুমি ওকে খুঁজে বের করো। তাতে তোমাকে যেখানে যেতে হয় যাও।”
বিরাট:- “ঠিক আছে স্যার। থ্যাঙ্কস আমাকে আজকের দিনটা সময় দেওয়ার জন্য। খুব শীঘ্রই আমি আপনার মাইশাকে খুঁজে বের করবো ইনশাআল্লাহ।”
এই বলে বিরাট কল কেটে দিলো। বিরাট একজন গোয়েন্দা। একটা বিরাট বড়ো গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করে ও। ছেলেটা মধ্যবিত্ত ঘরের হলেও অনেক বড়ো বড়ো কেস সলভ করেছে ও। তাই অনেক আগে থেকেই আরমান মাইশার কেসটাও এই বিরাট কেই দিয়েছে ও।
তখনি আবির ওর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “কি ব্যাপার মাইশাকে খুঁজে পেয়ে গেলি নাকি। মাইশা মাইশা করছিস শুনলাম?”
তখনি আবিরের পিছু পিছু সামিরাও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আবির ভাইয়া এই মাইশাটা সেই মেয়ে না, যে অনেক আগে দার্জিলিং এ বড়ো ভাইয়াকে বাঁচিয়ে ছিল?”
আবির:- “হ্যাঁ এটা সেই মাইশা যাকে তোর ভাইয়া পাগলের মতো খুঁজছে।”
সামিরা:- “হ্যাঁ সেটা জানি। আর এটাও জানি যে ভাইয়া সেই মেয়ের জান্যই মায়া ভাবীকে ডিভোর্স দিয়েছে। আচ্ছা ভাইয়া তাকে কি খুঁজে পেয়ে গেছো?”
আরমান ওদের দুজনের আগমনে ভীষণ বিরক্ত। আরমান ওর বোনকে খুব ভালোবাসলেও, ও যদি আবিরের সাথে থাকে তাহলে দুটোতে মিলে আজাইরা বকবক শুরু করে। এই দুটোকে একদম একসাথে দেখতে পারে না ও। আরমান বিরক্ত গলায় বলল, “না পাইনি। তবে খুব শীঘ্রই পাবো।”
এরই মধ্যে আবিরের চোখ গেলো খাটের উপরে থাকা দাদুর সেই কাঠের বাক্সে আর সেই ঘড়িটাতেও। আবির তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলল, “আরে এই ভাঙ্গা ঘড়িটা এখানে কি করছে? আর এই বাক্সটা দাদুর না? দাদু বেঁচে থাকতে এই বাক্সটা আমি দাদুর কাছে দেখেছিলাম।”
আরমান:- “হ্যাঁ এটা দাদুরই বাক্স। আর এই ঘড়িটা আমার। দার্জিলিং এ যখন আমার অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছিল তখন এই ঘড়িটা পড়ে ছিলাম আমি।”
আবির তৎক্ষনাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোকে হসপিটালে অ্যাডমিট করানোর পর, ডক্টর এই ঘড়িটা সাথে আরও একটা কি যেনো ছিল, আমার হাতে দিয়েছিল। বাড়ির সবাই ওখানে যাওয়ার পর আমি এগুলো দাদুকে দিয়ে দিয়েছিলাম। আর কি যেনো একটা ছিল ঠিক মনে পড়ছে না।”
আরমান আর নেম প্লেটটি পকেটে ভরে নিয়েছে ওদের দুজনকে দেখে। ওটা আর আবিরকে দেখানোর প্রয়োজন মনে করল না। কারণ ও খুব ভালো করে জানে আবির চাই না মাইশা ওর জীবনে ফিরে আসুক। ও জানে, আবির একদম মাইশাকে সহ্য করতে পারে না। তাই ওকে আর এই বিষয়ে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না।
আরমান:- “তোকে আর মনে করার দরকার নেই। কি বলতে এসেছিলি সেটা বল?”
আবির:- “ও হ্যাঁ। মিস্টার ড্যানিয়েল এর অ্যাসিস্ট্যান্ট মেইল করেছে, আর তিন দিন পর উনারা আসছেন। এই তিনদিনের মধ্যে যেনো মায়ার সব ডিজাইন রেডি থাকে। ডিজাইন পছন্দ হলে, উনি সেইদিনই ডিজাইন সিলেক্ট করে ডিল ফাইনাল করবে অ্যাডভান্স পেমেন্ট সহ। ওটাই জানাতে এসেছিলাম তোকে।”
আরমান:- “আচ্ছা ঠিক আছে। আর ছুটকি তুই কিছু বলবি?”
সামিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ ভাইয়া। রোজ রোজ ড্রাইভারের সাথে কলেজ যেতে ভালো লাগে না। তাই আমি ঠিক করেছি আজ সবাই এক সাথে মিলে যাবো। মানে তোমরা অফিস যাওয়ার পথে আগে আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাবে। আর তোমরা মানে, আবির ভাইয়া, মায়া আপু, আর তুমি। সবাই এক সাথে যাবো।”
আরমান:- “কিন্তু ছুটকি তুই তো জানিস আমি বেশি গেঞ্জাম একদম…
আরমানকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সামিরা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। তুমি বেশি গেঞ্জাম একদম পছন্দ করো না। কিন্তু একটা দিনেরই তো ব্যাপার, প্লিজ ভাইয়া রাজি হয়ে যাও। আমার ভীষণ বোর লাগে একা একা যেতে। প্লিজ ভাইয়া।”
সামিরার এতো রিকোয়েস্ট করাই আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোরা চল আমি আসছি।”
সামিরা ইয়াহু বলে চিৎকার করে উঠে চলে গেলো। ওর পিছু পিছু আবিরও চলে গেলো। এদিকে আরমান আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পকেটে হাত দিয়ে নেম প্লেটটি বের করলো। তারপর সেটার দিকে তাকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলল, “হাজার মানুষের ভীড়ে থেকেও আজ আমি একা—কারণ, এই হাজার মানুষের ভীড়ে তুমি নেই, আমার পিচ্চি মায়াবতী। (বুকে হাত দিয়ে) এই বুকে আছে এখন শুধুই শূন্যতা, আর এই শূন্যতা বুকের ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। একবার দেখা দাও পিচ্চি মায়াবতী… তোমায় এই বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করি বুকের ভেতরটা। একবার দেখা দাও প্লিজ…ভালোবাসি পিচ্চি মায়াবতী… ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”
এই বলে নেম প্লেটটিতে একটা কিস করে, সেটা দাদুর সেই বাক্সটিতছ ভরে খুব যত্ন করে তুলে রাখলো নিজের আলমারিতে। এরপর ওর ল্যাপটপ ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অনেক আগ থেকেই অফিসের জন্য রেডি হয়েছিল ও।
_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..
আরমান সিঁড়ি দিয়ে নেমে ড্রয়িংরুম হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দরজার দিকে। আবিররা অপেক্ষা করছে গাড়ির কাছে। ড্রয়িংরুমে এখন কেউ নেই, সবাই ব্রেকফাস্ট করে যে যার কাজে গেছে। আরমান দরজা দিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় কেউ একজন এসে ওকে দিলো এক ধাক্কা।
এদিকে মায়াকে অনেক্ষন আগে সামিরা ডেকে গেছে। আজকে নাকি ওরা একসাথে যাবে। ওরা বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই মায়া ওর ব্যাগ চেক করতে করতে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ওর সামনে কেউ চলে আসায় ধাক্কা খেলো ও। আর নিজেকে সামলাতে গিয়ে সামনের মানুষটার জামার কলার চেপে ধরলো।
বুঝতেই তো পারছেন ঘটনা কি। কিন্তু এইবার আর আরমান মায়াকে পড়ে যেতে দেয়নি। কোমর জড়িয়ে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে আটকে নিলো। এদিকে মায়া তো ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।
চলবে…..
#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_18
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
এইবার আর আরমান মায়াকে পড়ে যেতে দেয়নি। কোমর জড়িয়ে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে আটকে নিলো। এদিকে মায়া তো ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।
আরমান মায়াকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, “এই তুমি সব সময় এভাবে আমাকে ধাক্কা দাও কেন বলোতো?”
মায়াও জোড় দিয়ে বলল, “আর আপনি সবসময় হঠাৎ করে আমার সামনে চলে আসেন কেন? আর এমনিতেও সব সময় কই ধাক্কা দিলাম? এটা নিয়ে তো দুবার হলো।”
আরমান আবারও বিরক্তি নিয়ে বলল, “ওফফ তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। ডিসগাসটিং।”
কথাটা বলেই আরমান চলে গেলো আর মায়া আরমানকে উদ্দেশ্য করে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “আমার সাথে কথা বলা বেকার, তো বলতে কে বলেছে? হুঁহু 😏😏 ডিসগাসটিং… (চিল্লিয়ে) আপনি ডিসগাসটিং… আপনার চোদ্দগুষ্ঠী ডিসগাসটিং।
কথাটা বলেই সাথে সাথে মায়া নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর চারিপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ওর কথাটা কেউ শুনেছে কিনা। দেখলো আপাতত আশেপাশে কেউ নেই। তাই মুখ থেকে হাত সরিয়ে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ল। যাক বাবা কেউ শুনেনি। বাঁচা গেলো।
তখনি বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ। এই রে ওরা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। আর ও এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গবেষণা করছে। নাহ, আর কিছু ভাবতে পারলো না মায়া। ছুট লাগালো বাইরের উদ্দেশ্যে।
মায়া গিয়ে দেখলো, আবির আর সামিরা গাড়ির পিছনের সিটে বসে আছে। আরমান ড্রাইভারের সিটে। মায়া প্রথমে একটু কনফিউজড হলো ও কোথায় বসবে এই ভেবে। ‘নাহ এই রাগী, গম্ভীর, বদমেজাজি মানুষের পাশে বসার থেকে, পিছনে বসাই ভালো।’
এই ভেবে মায়া পিছনের দরজা খুলে বসে পরলো। এতে আবির আর সামিরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
সামিরা:- “একি আপু, সামনে বসলে না? পিছনে কেন বসলে।”
মায়া কিছু বলার আগেই আরমান গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। আবির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, “কি হলো? নেমে গেলি কেন?”
আরমান রাগী গলায় বলল, “আমাকে কি তোদের ড্রাইভার মনে হয়?”
আবির দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “না একদম না। এই মায়া! সামনে যাও।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কেন যাবো। তোমাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজন যাও।”
সামিরা:- “আমি যাবো না। আমার সামনে বসতে ভালো লাগে না। পিছনে বেশ আরাম করে বসা যাই।”
মায়া আবিরের দিকে তাকালে তৎক্ষণাৎ আবির তাড়াহুড়ো করে বলে উঠে, “আমি সামনে বসবো না। সামনে বসলে আমার বমি পাই।”
মায়া আর সামিরা এটা শুনে অবাক হয়ে তাকালো আবিরের দিকে। আর আবির বুঝলো ও তাড়াহুড়োই কি বলে ফেলেছে। তাই বোকা বোকা হাসি দিলো ও। আর আরমান ওদের কথা শুনে প্রচন্ড রেগে গেলো।
সামিরা বলল, “কিন্তু ভাইয়া তুমি তো এর আগে ভাইয়ার সাথে সামনে বসেই যেতে।”
আবির বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল, “আগে বমি পেতো না। এখন পাই।” 😁😁
সামিরা বিরবির করে বলল, “বাহ বাহ, কি এক্সকিউজ। অসাম! অসাম!
আরমান রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোরা থাক তোদের আজাইরা বকবক নিয়ে। আমি চল্লাম। তোদের জন্য ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই আরমান চলে যেতে নিলে, সামিরা চিল্লিয়ে বলল, “নাহ, এই তো মায়া আপু যাচ্ছে সামনে। আপু যাও যাও।”
বলেই গাড়ির দরজা খুলে মায়াকে ঠেলে ঠেলে বের করে দিলো সামিরা। মায়া ফুঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে সামনের দরজা খুলে সিটে গিয়ে বসলো।
আরমান মায়াকে বসতে দেখে নিজেও গাড়িতে উঠে বসলো। তারপর সিট বেল্ট লাগিয়ে বসে থাকলো গাড়ি স্টার্ট না দিয়ে। সামিরা আরমানকে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না দেখে বলল, “কি হলো ভাইয়া চলো।”
আরমান গম্ভীর গলায় মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনাকে কি নিমন্ত্রণ কার্ড দিতে হবে সিট বেল্ট লাগানোর জন্য?”
এটা শুনে মায়া তাড়াতাড়ি সিট বেল্ট পড়ে নিলো। আর তারপর আরমান গাড়ি স্টার্ট দিলো।
______________________
তিন দিন পর…..
আজ মিস্টার ড্যানিয়েল আসবে। ডিজাইন পছন্দ হলে ডিল ফাইনাল হবে আজ। এই নিয়ে অফিসের সবাই চিন্তায় আছে। কারণ এই ডিলটা সাকসেসফুল হলে, এই কম্পানি আরো কিছুটা উপড়ে উঠে যাবে। সকল কর্মচারী দের মাইনে বাড়বে। বোনাস পাবে সবাই। তাই এই কম্পানির সবাই চাই যেনো ডিল টা ফাইনাল হয়।
এদিকে মায়াও যেন সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে নিজের একটি আলাদা জায়গা এই অফিসে। প্রথমদিকে মায়ার সাজ পোশাক দেখে সবাই ভেবেছিল, এক সাধারণ মেয়ে—কি বা এমন কিছু করতে পারবে? কিন্তু সময়ই দেখিয়ে দিল, মায়া শুধুই সাধারণ নয়, তার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ সৃষ্টিশীল মন। অফিসে পা রাখার কয়েক দিনের মধ্যেই তার কাজ সকলের নজর কেড়ে নেয়। প্রতিটি ডিজাইনের প্রতিটি রেখা যেন কথা বলে, যেন শিল্প আর মায়ার মধ্যে এক অদ্ভুত আত্মিক বন্ধন।
সহকর্মীরা যখন বুঝতে শুরু করল, এই মেয়েটির কাজ কেবল পেশাদারিত্বে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার প্রতিটি সৃষ্টি একেকটা শিল্পকর্ম—তখনই তারা মায়াকে হেড ডিজাইনার হিসেবে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। মায়ার চারপাশে যেন তৈরি হয়েছে এক ধরনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আবহ। সবাই মনে করে, মায়ার মতো একজনের কাছ থেকে শেখার এখনো অনেক কিছু বাকি তাদের।
তবু, এত কিছুর পরেও মায়া রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই—সহজ, সরল, বিনয়ী। কেউ ভুল করলে মায়া রাগারাগি না করে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয় সেটা, তখন বোঝা যায়, মায়ার মতো মানুষ সত্যিই দুর্লভ। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠেছে অফিসের প্রিয়তম মুখ, সকলের স্নেহের পাত্র। মায়ার বন্ধুসুলভ আচরণ আর আন্তরিক ব্যবহারের জন্য ও হয়ে উঠেছে এই অফিসের সকলের চোখের মণি।
এই অফিস এখন আর শুধুমাত্র মায়ার কর্মক্ষেত্র নয়—এটা তার ভালোবাসার এক পরিসর, যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পায়, আর অন্যরাও খুঁজে পায় তার মাঝে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা।
আর এদিকে দিশা এগুলো দেখে হিংসায় জ্বলে যাই।
এদিকে আরমান মুখে প্রকাশ না করলেও মায়ার কাজ দেখে সে ভীষণ খুশি। তার মতো কঠোর ও মেপে চলা একজন মানুষও যেন অবাক হয়ে যায় মায়ার সৃষ্টিশীলতায়। প্রতিটি ডিজাইনে, প্রতিটি রঙের ছোঁয়ায় সে যেন খুঁজে পায় এক নিখুঁত শিল্পীর স্পর্শ।
মায়ার সঙ্গে আরমানের সম্পর্কটিও দিনে দিনে এক বন্ধুসুলভ আকার নিয়েছে। মায়া যখন নিজের কেবিনে বসে এক মনে কাজ করে, তখন আরমান নিজের কেবিনে বসে মায়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিরক্ত হয় নিজের এই কাজের প্রতি আর মায়ার প্রতি। কারণ এই তাকিয়ে থাকার জন্য ও নিজেই বুঝতে পারে না কখন সময় পেরিয়ে গেছে। এই তাকিয়ে থাকার জন্য ও নিজের কাজ শেষ করতে পারে না।
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
মায়া প্রতিটি কাজের আপডেট নিজের হাতে নিয়ে আসে আরমানের কাছে। অফিসজুড়ে ব্যস্ততা চললেও, প্রতিদিন কিছুটা সময় যেন তারা নিজেদের জন্য চুরি করে রাখে। মায়া যখন আরমানের কেবিনে এসে বসে, দুজনে মিলে কাজ নিয়ে আলোচনা করে, তখন ঘরের পরিবেশটাও যেন বদলে যায়—কেমন এক মন্থর, নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
মায়া যখন একটানা বলে চলে তার ভাবনা, পরিকল্পনা আর ডিজাইনের খুঁটিনাটি, তখন আরমান মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। মায়ার চোখে-মুখে যখন কাজের প্রতি ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্নের ঝলক খেলে যায়, তখন আরমানের মনে হয়—এই মেয়েটার মধ্যে যেন পুরো একটা পৃথিবী লুকিয়ে আছে। একটা সৃষ্টিশীল, সংবেদনশীল, অদ্ভুত রকমের আলো ছড়ানো পৃথিবী।
আরমান নিজের কেবিনে বসে কাজ বাদ দিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছিল। তখনি ওর কেবিনের দরজায় নক হয়। আরমান আসার অনুমতি দিলে, মায়া ভেতরে প্রবেশ করে।
আজ মায়া নিজেকে সাজিয়েছে এক অনন্য রূপে। পরনে কালো রঙের শাড়ি— শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে খেলা করছে পরিপক্ব রুচির ছাপ, আর তার সাথে মায়ার উপস্থিতি যেন এক অতুলনীয় সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
চুলগুলো সে খুলে রেখেছে—পিঠের উপর এলিয়ে থাকা সেই ঘন কালো চুলে আরো ওর সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে। কানে হালকা দুল, কালো রঙের, শাড়ির সঙ্গে অসাধারণভাবে মানিয়ে গেছে। গলায় পরেছে একটি ছোট্ট অথচ নজরকাড়া লকেট, যা যেন তার ব্যক্তিত্বের গভীরতাকে আরও এক ধাপ উজ্জ্বল করে তুলেছে।
মুখে খুব হালকা সাজ—না বাড়িয়ে, না কমিয়ে। চোখে গভীর করে টানা কাজল, যা যেন মায়ার চোখদুটিকে আরও রহস্যময়, আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তার চোখের চাহনিতে যেন এক অদ্ভুত টান, কথা না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলার ক্ষমতা। ওর চলাফেরা, চোখের ভাষা, এবং উপস্থিতি—সব মিলিয়ে এক নির্ভেজাল, নিখুঁত সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।
আরমান মায়াকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মুগ্ধ হলেও তা চোখে মুখে প্রকাশ করলো না আজ। তার বদলে মুখটাকে আরো গম্ভীর করে তুলল। গলাতেও গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল, “এসো মায়া, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সবকিছু রেডি তো?”
মায়া মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার একদম সব রেডি। শুধু উনার আসার অপেক্ষা।”
আরমান:- “তা তোমার রেডি করা ডিজাইন এর ফাইল গুলো সব ঠিকঠাক আছে তো? চেক করে দেখেছো তো সব?”
মায়ার সাদা মনে কাদা নেই। তাই ও আরমানের কথার ঘোর প্যাঁচ অতো বুঝলো না। হাসি মুখেই জবাব দিলো, “হ্যাঁ স্যার। আমি কাল রাতেই সব চেক করে নিয়েছি।”
আরমান:- “আচ্ছা মায়া যদি এমন হয়, ভাবো যে তুমি মিস্টার ড্যানিয়েলকে ডিজাইন দেখাতে গিয়ে, দেখছো যে ফাইলে ডিজাইন নেই। মানে ওটা সেই ফাইল না যেটা তুমি রেডি করেছিলে, তখন কি করবে? কিভাবে সামলাবে এমন পরিস্থিতি?
মায়া আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “এমন পরিস্থিতিত আসবেনা স্যার। আর যদি এমন পরিস্থিতি আসেও তাহলে আমি ঠিক সামলে নেবো। এমনি এমনি আমি এই কাজের দায়িত্ব নিইনি। সকল প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছি। আর দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন সেটা সঠিক ভাবেই পালন করবো। বিশ্বাস রাখুন।”
আরমান বাঁকা হেসে বলল, “কনফিডেন্স ভালো কিন্তু ওভার কনফিডেন্স ভালো নয়, মিস মায়া।”
তখনি আবির বিনা নোটিশে হাজির হলো সেখানে। আর এসেই বলল, “এই তোমরা দুজনেই এখানে? আমি কিন্তু ভীষণ এক্সসাইটেড ব্রো। মিটিং শেষ হলে আজ জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে। জানিস তো আজ মায়া নিজে হাতে রান্না করেছে।”
আরমান কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, “আগে দেখ মিটিং টা ভালো ভাবে সম্পূর্ণ হয় কিনা। তারপর তো খাওয়া দাওয়া।”
আবির:- “আরে চিন্তা করিস না। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কে এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছে দেখতে হবে তো।”
তখনি আরমানের পি.এ কেবিনে নক করেই বিনা অনুমতিতে দরজা একটু খুলে মাথা টা ঢুকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “সরি স্যার অনুমতি না নিয়েই প্রবেশ করলাম। মিস্টার ড্যানিয়েল চলে এসেছেন। উনার গাড়ি আফিসে ঢুকে গেছে। তাড়াতাড়ি আসুন আপনারা”
এটা শুনে মায়া আর আবির তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো। ওদের পিছু পিছু আরমানও গম্ভীর মুখে হাঁটা দিলো।
________________________
মিস্টার ড্যানিয়েল অফিসে পা রাখতেই একে একে সকল ডিজাইনার ও কিছু বিশেষ কর্মচারী সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে এসে উনাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। হাসি খুশি ড্যানিয়েল এর মুখে আরো চওড়া হাসি খেলে যায় । এক শ্রদ্ধামিশ্রিত আবেগ নিয়ে সবাই মিলে তাকে নিয়ে যায় মিটিং রুমের দিকে।
মিটিং রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মায়া….হাতে একটি সুগন্ধি ফুলের তোড়া, চোখে ভরপুর একাগ্রতা আর হৃদয় ছোঁয়া আন্তরিকতা। ঠিক তার পিছনেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে আরমান, আবির আর সাথে আরমানের বাবা ও চাচা। ওরাও এসেছে আজ। আজকের মিটিং টার জন্য যেন তারা সবাই নীরবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকের মিটিং রুম যেন সাধারণ অফিস ঘর নয়—চেয়ার-টেবিলের বদলে আরামদায়ক সোফা, নরম আলো, পরিপাটি করে সাজানো দেয়াল, টেবিলের উপর স্নিগ্ধ কিছু ফুল আর ঘরজুড়ে এক রুচিসম্পন্ন সাজসজ্জা—সবকিছু যেন বলে দেয়, এখানে আজ কিছু বিশেষ ঘটতে চলেছে।
এই ব্যতিক্রমী পরিবেশের সাজসজ্জায় যেই নামটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে মায়া। পুরো সাজসজ্জা, পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনার পেছনে তার সৃজনশীল মন আর নিষ্ঠা। সে চেয়েছিল মিস্টার ড্যানিয়েলের এই মিটিং যেন একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে—দেখলেই যেন বোঝা যায়, কতটা যত্ন নিয়ে করা হয়েছে প্রতিটি আয়োজন।
মায়া যখন প্রথম এই আইডিয়াগুলো নিয়ে আরমানের কাছে যায়, সে একনিমিষেই রাজি হয়ে যায়। মায়ার চোখে যে দৃঢ়তা, যে আত্মবিশ্বাস ছিল, তা দেখে আরমান বুঝেছিল—এই কাজটা ওর হাতেই সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। তাই আর এক মুহূর্তও না ভেবে সে পুরো দায়িত্ব মায়ার কাঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
আর এখন, দাঁড়িয়ে থেকে মায়া দেখছে তার পরিকল্পনা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে বাস্তবতায়, আর প্রতিটি মুহূর্তে সে অনুভব করছে—সাফল্যের গন্ধ আর স্বপ্নের ছোঁয়া।
মিস্টার ড্যানিয়েল মায়ার সামনে গেলে মায়া তার হাতে থাকা ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয়, কিন্তু মিস্টার ড্যানিয়েল তা নেওয়া বাদ দিয়ে হাঁ করে, মুগ্ধ হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতে অনেকেই মিটিমিটি হাসে। আবির আরমানকে রাগানোর জন্য আরমানের কানে কানে বলে, “আমার মনে হয় মিস্টার ড্যানিয়েল মায়ার প্রেমে পড়ে গেছে। দেখ কেমন মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।”
আরমানের এমনিতেই মেজাজ চটে আছে। এখন আরো চটে গেলো। ও বিরক্ত হয়ে বলল, “কি হলো মিস্টার ড্যানিয়েল আসুন।”
তবুও মিস্টার ড্যানিয়েল এর কোনো সাড়া শব্দ নেই। ও এক ধ্যানে মায়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এতে মায়াও ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো। ড্যানিয়েল এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ড্যানিয়েলকে কুনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। এতে মিস্টার ড্যানিয়েল বিরক্ত হয়ে ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর দিকে তাকিয়ে বলল, “What happened?”
অ্যাসিস্ট্যান্ট মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ Sir, we are here for a meeting, you may have forgotten that.
মিস্টার ড্যানিয়েল সামনে ফিরে মায়ার হাত থেকে ফুলের তোড়া টা নিয়ে হাসি মুখে বলল, “মিস মাইহা! খেমন আছো ঠুমি? You look very beautiful in this dress.”
মায়া মুখে হাসি নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস মিস্টার ড্যানিয়েল।”
আবির মুখে জোড় করে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আসুন মিস্টার ড্যানিয়েল, আমদের মিটিং এর জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “হ্যাঁ হ্যাঁ। ছলুন ছলুন।”
মায়ারা উনাকে সাইড দিলে উনি এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন। এদিকে অফিসের বাকি সবাই যে যার ডেস্ক এ ফিরে গেলো। রুমে থাকলো শুধু মিস্টার ড্যানিয়েল, তার অ্যাসিস্ট্যান্ট, আরমান, মায়া, আবির, আরমানের বাবা ও চাচা, এবং আরমানের পি.এ মিরাজ, এবং মায়ার একজন সহকারী তানিশা। তানিশাও একজন ডিজাইনার। মায়ার সাথে ভীষণ ভাব হয়ে গেছে তার। আরমান তানিশাকে বলেছিল মায়ার সহকারী হিসাবে থাকতে। তানিশার মায়াকে ভীষণ পছন্দ, তাই সেও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে আরমানের কথা। এই কদিনে তানিশা মায়াকে সব কাজে ভীষন ভাবে হেল্প করেছে।
আরমান প্রথমে ওর বাবা চাচার সাথে মিস্টার ড্যানিয়েল এর পরিচয় করিয়ে দিলো।
আবির মিটিং রুমের দরজা বন্ধ করতে গেলে তখনি হুড়মুড় করে ঢুকে গেলো দিশা। আবির এতে ভীষণ রেগে গেলো, ও রাগ নিয়েই বললো, “মিস দিশা! এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?
দিশা:- “সরি স্যার।”
আরমান:- “আবির! মিস দিশা থাক এখানে। উনাকে দরকার হতে পারে।”
এই কথায় আবির বিরক্ত হলেও দিশা ভীষণ খুশি হলো। এরপর সবাই যে যার মতো জায়গা করে নিয়ে সোফায় বসলো। আরমান মিস্টার ড্যানিয়েল এর সোজাসুজি একদম সামনে একটা সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো।
মিস্টার ড্যানিয়েল এর সামনেই একটা টেবিল। আর সেই টেবিলের উপরে অনেক ফুল ছাড়ানো। আর ওই ফুলের উপড়ে রাখা দুটো ফাইল। মিস্টার ড্যানিয়েল একটা ফাইল তুলে নিয়ে হাসি মুখে উল্টাতে লাগলো। কিন্তু প্রথম পাতাই কিছুই নেই। পুরো সাদা। উনি একবার সবার দিকে তাকিয়ে পরের পাতা উল্টালেন। কিন্তু এই পাতাটাও সাদা। কিচ্ছু নেই। এরপর উনি আরো এক পাতা উল্টালে দেখতে পান এটাও সাদা। এবার উনার হাসি হাসি মুখ চুপসে গেলো। উনি তাড়াহুড়ো করে অনেক গুলো পাতা উল্টালেন। কিন্তু দেখতে পেলেন সব গুলোই সাদা পাতা। কিচ্ছু নেই এতে।
উনার মুখের এমন পরিবর্তন দেখে সবাই ঘাবড়ে গেলো। আর এদিকে মিস দিশা মনে মনে শয়তানি হাসি দিলো। আরমানের মুখের কোনো পরিবর্তন নেই। সব সময় যেমন থাকে তেমনই। মুখে কোনো রিয়্যাকশন নেই।
এরপর মিস্টার ড্যানিয়েল প্রথম ফাইলটা রেখে দ্বিতীয় ফাইলটা তুলে নিলেন। এবং একই ভাবে দেখতে লাগলেন। কিন্তু এই ফাইলটাও পুরো ফাঁকা সাদা পাতা। কিচ্ছু নেই।
এবার উনি রাগে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর ফাইল ছুঁড়ে মেরে চিল্লিয়ে বললেন, “ “What is this? Where is the design?”
মিস্টার ড্যানিয়েল এর এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলো। আবির তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ফাইল হাতে নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো। ও দেখলো ফাইলে সত্যিই কোনো ডিজাইন নেই। এতে আবির মায়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “মায়া! ডিজাইন কোথায়? এটা কোন ফাইল এনেছো তুমি?”
মায়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও পুরো থমকে গেছে। মায়া তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আবিরের হাত থেকে ফাইল নিয়ে দেখলো, কোনো ডিজাইন নেই। ও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “এ..এটাতেই সব ডি..ডিজাইন ছিল ভাইয়া। এটাই সেই ফাইল। ডি..ডিজাইন গুলো কো..কোথায় গেলো?”
মিস্টার ড্যানিয়েল রেগে বলল,“মজা খরা হচ্ছে হামার সাথে? নাখি ঢেকে হেনে অফমান খরছেন মিস্টার হারমান? ডিজাইন কোঠায়?”
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলোও আরমান তখনো চুপচাপ নিজের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে।
মায়ার সহকারী তানিশা বলল, “হ্যাঁ স্যার ডিজাইন তো এই ফাইলেই ছিল। কাল অফিস থেকে বেরোনোর আগে আমি আর মায়া ম্যাম সব চেক করেই বেরিয়ে ছিলাম। তখন সব ঠিকঠাকই ছিল।”
আবির:- “তাহলে ডিজাইন গুলো কোথায় গেলো মিস তানিশা। আর তার বদলে এই সাদা পাতা কেন?”
মায়া এবার ছলছল চোখে তাকালো আরমানের দিকে। আরমানও তখন মায়ার চোখের দিকেই তাকিয়ে। যেন বলতে চাইছে, “কি মিস মায়া? কোথায় গেলো তোমার কনফিডেন্স?”
চলবে….