#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_27
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
নিঃশব্দে কেটে গেছে দুইটি দিন। শোকের আবহে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে মায়াদের বাড়ি। আরমানের ছোটো আম্মু আনজুমা বেগম, ছোটো আব্বু এবং সামিরা—তিনজনেই এই দুইদিন মায়ার পাশে থেকেছেন ছায়ার মতো। বিশেষ করে সামিরা—এক মুহূর্তের জন্যও মায়াকে একা হতে দেয়নি। মেয়েটি যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়েছে বাবাকে হারিয়ে। সেই মানুষটি—যিনি ছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, মাথার উপর ছায়ার মতো ছড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ—তিনি আজ নেই। এই বাস্তবতা মনে পড়লেই হঠাৎ করে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে মায়া।
সারাদিন বোঝানো, মানানো, জোর করে এক-দু’মুঠো খাবার খাওয়ানোর চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন আনজুমা বেগম। আবিরও প্রতিদিন বাড়িটিতে এসে পড়ে থাকে। সামিরার সাথে মিলে মায়ার মন ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় তারা। কিন্তু সত্যিই কি তা সম্ভব? যে ব্যথা কেবল নিজের হৃদয়ে জন্ম নেয়, তাকে কি বাইরের কোনো ভালোবাসা বা সান্ত্বনা ছুঁয়ে যেতে পারে? মায়ার তো আর কেউ নেই—এই বাবা ছিলেন তার একমাত্র আপনজন, তার পৃথিবীর একমাত্র কেন্দ্রে।
আরমানের বাবা এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান ওদের সঙ্গে। তিনি চুপচাপ, গভীর সহানুভূতির ভঙ্গিতে পাশে থাকেন। মায়াকে বাবার স্নেহ দেওয়ার চেষ্টা করেন। সবাই মিলে চেষ্টা করছে মায়াকে আবারও একটুখানি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।
আর এদিকে যে কারো জীবন-মৃত্যু, দুঃখ-বেদনা কিছুই গোনে না—সেই আরমান শাহরিয়ারও যেন বদলে গেছে। কে কী বললো, কে দেখলো, তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে ও এসে খোঁজ নিয়েছে মায়ার। কিছুটা সময় ও নিজেও কাটিয়ে যাই ওদের সাথে। হয়তো মায়াকে শান্তনা দিতে পারে না মুখে কিছু বলে, তবে ও এখানে এসে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, আরমানও মায়ার পাশে আছে। ছোটো আম্মুর থেকে খোঁজ নেয় মায়া খেয়েছে কিনা।
এই অদ্ভুত পরিবর্তনে সবাই বিস্মিত হলেও, একরকম প্রশান্তিও অনুভব করেছে মনে মনে।
আরমানের মা এখনো কিছু জানেন না আরমানের এখানে আসার বিষয়ে। জানলে যে কী বিপর্যয় নেমে আসবে, তা যেন কল্পনাই করা যায় না।
এদিকে মায়ার চাচা, চাচী এবং চাচাতো বোনও এখন মায়াদের বাড়িতেই আছেন। ঘটনাচক্রে শাহরিয়ার পরিবারের আগমন এবং পরিপার্শ্বিকতা দেখে ওরাও খানিকটা বিস্মিত। এমন অভিজাত, প্রভাবশালী এক পরিবারের সঙ্গে মায়াদের আত্মীয়তা—এটা আগে উনারা জানতো না।
আরও বড়ো চমক এলো তখন, যখন আরমানের বাবা নিজে গিয়ে মায়ার চাচারকে পরিচয় দিলেন নিজের। মুহূর্তেই চিনে ফেললেন তিনি সেই মানুষটিকে।
মায়ার চাচা মোশারফ তালুকদার ছিলেন মায়ার বাবার বড়ো ভাই। বহু বছর আগে—তখন মায়ার বয়স মাত্র দশ, আর মাইশার বারো—তীব্র অভিমান আর রাগে ভর করে বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য হয় উনার। সেই রাগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে, আর কখনও ফিরে আসেননি। ধীরে ধীরে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কিন্তু রক্তের সম্পর্ক কি সহজে মুছে ফেলা যায়? হঠাৎ কোনো এক অদৃশ্য টানে, একান্ত অন্তর্গত অপরাধবোধে কিংবা ভাই হারানোর আশঙ্কায়, বহু বছর পর মন কেমন করে ওঠে তার। রওয়ানা দেন গ্রামের পথে। সেখানে পৌঁছে খোঁজ নিতে শুরু করেন ছোটো ভাইয়ের। কিন্তু কেউই তার খোঁজ দিতে পারে না। অবশেষে এক বৃদ্ধ প্রতিবেশীর মুখে জানতে পারেন তাদের বাবার মৃত্যুর খবর, এবং সেইসঙ্গে পান মায়াদের বর্তমান এই বাড়ির ঠিকানা।
দূরপাল্লার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে পৌঁছান, তখন সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। দোয়েল ডাকছিল দূরের গাছে। কিন্তু সে পাখির ডাককে ছাপিয়ে ওঠে শোকের নিস্তব্ধতা। দোরগোড়ায় পৌঁছে তিনি যা দেখলেন, তা কল্পনাতেও ছিল না—নিজের ছোটো ভাই শুয়ে আছেন বারান্দার মাঝখানে, সাদা চাদরে মোড়ানো নিথর শরীর। নির্বাক, চিরনিশ্চল।
বছরের পর বছর, রাগ-অভিমান, দূরত্ব—সব যেন এক নিমিষে চূর্ণ হয়ে যায় সেই দৃশ্যপটে।
এদিকে মায়ার চাচী মুনজিলা বেগম, মায়াদের এত সুন্দর, সুসংগঠিত বাড়ি দেখে যেন মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কলকাতায় এমন পরিপাটি পরিবেশে থেকে জীবন কাটানোর সুযোগ—তা সহজে হাতছাড়া করতে চান না তিনি। শুনেছেন, মায়া নাকি শাহরিয়ার কম্পানিতে খুব বড়ো পজিশনে আছে। তার মানে, এই শহরে থেকে জীবনের বাকি সময়টা কিছুটা স্বস্তিতেই কাটানো যাবে।
এতোদিন ধরে তাঁরা ছিলেন মাইশার মামার বাড়িতে, যেখানে এক ধরনের নির্ভরশীলতা থাকলেও ছিল সীমাবদ্ধতা ও অস্থায়িত্ব। এখন মায়ার এমন স্থিতিশীল অবস্থান ও পরিবেশ দেখে, মুনজিলা বেগম নিজের স্বামী মোশাররফ সাহেবকে বোঝাতে দ্বিধা করেননি—একটা মেয়ে, একা থাক, এত কষ্টের সময়ে তাকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। আরও অনেক যুক্তি-তর্ক তুলে ধরেছেন তিনি। শেষমেশ মোশাররফ সাহেবও রাজি হয়ে গেছেন এখানে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে।
তবে সত্যিকারের কারণটা অন্যত্র। এই চমৎকার পরিকল্পনার পেছনে মুনজিলা বেগমের যে বড়ো এক কৌশল লুকিয়ে আছে— যখন তিনি নিজের মেয়ের মুখ থেকে শুনলেন, মেয়েটির মনে দাগ কেটেছে একজন, আর তিনি আর কেউ নন—দেশের আলোচিত ও সম্মানিত ব্যবসায়ী আরমান শাহরিয়ার।
আর যখন দেখলেন, মায়াদের সঙ্গে শাহরিয়ার পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তখন যেন তার মন আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলো। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না—এমন এক পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্ভাবনা যাঁর সামনে এসেছে, তিনি তো সেটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েই ছাড়বেন। যেভাবেই হোক, আরমান শাহরিয়ারকে নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে দেখার ইচ্ছায় এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন মুনজিলা বেগম।
এদিকে যখনই আরমান এ বাড়িতে পা রাখে, মাইশা যেন অদৃশ্য কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে না চেয়ে গা ঘেঁষে আসে ওর পাশে। তার চোখেমুখে একরকম অদ্ভুত আগ্রহ—আরমান কী খাবে, কফি চাই কি না, কিছু লাগবে কি না—প্রতিটা কথায় অতিরিক্ত দরদের ছোঁয়া। তার কণ্ঠে ন্যাকামি আর আচরণে ঢং যেন মুহূর্তে মুহূর্তে ভেসে ওঠে।
আর তখনই হাজির হন মুনজিলা বেগম, মেয়ের গুণগান নিয়ে যেন ফুলে ভরা এক ঝুড়ি নিয়ে এসেছেন—প্রশংসার ঢালাও বন্যায় আরমানকে ভাসিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
সবকিছু মিলিয়ে আরমানের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ে, তবে মনে মনে একটা স্পষ্ট বিরক্তি কাজ করে। এক সময় সে চুপিচুপি খুঁজে ফেরে মাইশার ভেতরে নিজের ছোটোবেলার সেই পিচ্চি মায়াবতীকে। কিন্তু বারবার সে ব্যর্থ হয়। মাইশার চোখে-মুখে, কথায়-চলনে, একটুও খুঁজে পায় না সেই মায়াবতীর কোমল ছায়া। মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গেছে যেন—মনের মধ্যে এক অস্থির দ্বন্দ্ব।
কখনো মনে হয়, না, এ মেয়েই তো সেই—শুধু একবারই তো দেখা হয়েছিল ওদের, অত অল্প বয়সে। আর এতদিন ধরে তো শুধু কল্পনার উপর ভর করেই গড়ে তুলেছিল সেই মেয়ের মুখচ্ছবি ও আচার আচরণ। হয়তো বাস্তবের মাইশা তার সেই কল্পনার গড়নে একেবারেই মেলে না, তাই এই অমিল। আর বিরাটও প্রমাণ দেখিয়েছে ওকে, ওই নেমপ্লেট এর অধীকারী একমাত্র এই মাইশাই— সেই দিনের মায়াবতী।
দুপুর এগারোটার দিকে…
মায়া ও সামিরা রুমের বারান্দায় বসে আছে। সামিরা একই বকবক করছে, মায়া তাকিয়ে আছে অনেক দূরে শূন্য দৃষ্টিতে। সামিরার কথায় তার কোনো মন নেই। মন পড়ে আছে বাবার সাথে কাটানো মিষ্টি স্মৃতিতে। আবিরও ছিল ওদের সাথে, এই কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেলো ও অফিসের উদ্দেশ্যে।
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
হঠাৎ বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে সামিরা নিজের বকবক থামিয়ে দেয়। তারপর মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপু বাইরে কারা যেন চেঁচামেচি করছে। চলো দেখি।”
নাহ মায়ার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে একই ভাবে চুপচাপ বসে রইল। সামিরা বুঝলো মায়ার অবস্থা তাই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়াকে কিছুটা ঝাঁকিয়ে বলল, “আপু নিচে চলো। কারা যেনো চেঁচামেচি করছে।”
মায়া শূন্য দৃষ্টি নিয়েই ঘুরে তাকালো সামিরার দিকে। তারপর কোনো অনুভূতি ছাড়াই বলল, “চলো দেখি।”
এরপর দুজন রুম থেকে বেরিয়ে সোজা উঠানে এলো। দেখলো এখানে সবাই আছে। মায়ার চাচু কথা বলছে কিছু লোকের সাথে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনারা কোনো কম্পানি থেকে এসেছে। মায়া এগিয়ে গেলো সেই দিকে। নিজের চাচুকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে চাচু? কি বলছেন উনারা?”
মোশাররফ সাহেব বললেন— “দেখ না মা, ওরা নাকি বলছে বড়ো ওদের কম্পানি থেকে নাকি বাড়ির দলিল বন্ধক দিয়ে লোন নিয়েছিল। কিন্তু সময় মতো লোন শোধ করতে পারেনি। তাই নাকি উনারা এই বাড়ি দখল করবেন। কালকের মধ্যে যেনো আমরা এই বাড়ি খালি করে দিই।”
মায়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। চোখের সামনে জমা হলো কতগুলো কাগজ—সবই কড়া নোটিশ আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ছাপ বহন করে। কাঁপা হাতে সমস্ত ডকুমেন্টস একে একে খুলে দেখলো ও।
হ্যাঁ, কিছুদিন আগেই বাবা এই লোনের প্রসঙ্গ বলেছিলেন। কিন্তু এমন নির্মম সত্য—বাড়ির দলিল বন্ধক পড়েছে, নির্ধারিত সময়ে ঋণ শোধ না করতে পারলে এ বাড়ি কম্পানির দখলে চলে যাবে—এটা জানত না সে।
বাবা প্রথমে কিছুই জানাননি ওকে নিজের রোগের কথা। একমাত্র সন্তান, তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতে চাননি। কতখানি ভালোবাসলে একজন বাবা এমনভাবে নিজের যন্ত্রণাকে আড়াল করে যেতে পারে!
নিজের চিকিৎসার জন্য লোন নিয়েছিলেন তিনি, মায়ার অগোচরেই। ভেবেছিলেন সুস্থ হয়ে উঠেই শোধ করবেন ঋণ।
কিন্তু আমরা যা ভাবি, তা কি সব সময় বাস্তব হয়? উপরওয়ালার পরিকল্পনা অনেক সময় আমাদের ভাবনার বহু বাইরে।
মায়া অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো অফিসারদের। আবেগভরা গলায় বললো—ও লোনের পুরোটা শোধ করে দেবে। শুধু একটু সময় দিতে হবে।
কিন্তু ওদের চোখে ছিল কেবল নিয়মের শীতল ছায়া।
“আমরা এক সপ্তাহ আগেই নোটিশ পাঠিয়েছিলাম। সময়সীমা পার হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী বাড়ি এখন কোম্পানির দখলে। কাল সকাল পর্যন্ত সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে যেন বাড়ি খালি করে দেন।”
এই বলে তাঁরা চলে গেলেন।
মায়া নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সেই চৌকাঠে, বাবার স্মৃতিতে ঘেরা বাড়ির দরজায়।
চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়লো কান্না—বুকের মধ্যে কেউ যেন ধারালো কিছু দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে হৃদয়টা।
বাবার মৃত্যুর শোক এখনো দগদগে, তারই ওপর এই আঘাত—বাড়িটা… এই বাড়িটাও থাকবে না?
এই দেয়ালগুলো… এই উঠোন… এই ঘরটা, যেখানে বাবা বসতেন, মায়ার মাথায় হাত রাখতেন—সব কিছু কি হারিয়ে যাবে এক নিমিষেই?
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো… চারপাশ কুয়াশার মতো ঘোলাটে। অতিরিক্ত কান্না, দিনের পর দিন ঠিকমতো খাওয়া না-খাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা আর মানসিক ধাক্কা একসঙ্গে হঠাৎ এসে আছড়ে পড়লো ওর উপর।
দুলতে দুলতে এক পা এগিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো মায়া—জ্ঞান হারিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেল তার ছোট্ট পৃথিবী।
_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..
হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে মায়া। স্যালাইনের পাতলা সুঁচটা ওর হাতে স্থির হয়ে গেঁথে আছে, ধীরে ধীরে ওর শরীরে ঢুকছে স্যালাইন এর পানি। ডাক্তারের কথায় সামান্য স্বস্তি ফিরেছে চারপাশে—“ভয়ের কিছু নেই। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, নির্ঘুম রাত আর অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে পেসেন্টকে। আজ সারা দিন ও রাত স্যালাইন চলবে। কাল সকালে ছাড়পত্র দিয়ে দেব আমরা। ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।”
সামিরা এই খবর পৌঁছে দিয়েছিল তার বাবা এবং ভাইকেও। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ছুটে এসেছে হাসপাতালে। বাবার চোখে ছিল চিন্তার রেখা, ভাইয়ের মুখে একরাশ গম্ভীরতা।
তাঁরা আর দেরি করেননি। সামিরা যেই নোটিশের কাগজ দেখিয়েছিল, তা সঙ্গে নিয়ে আরমানের বাবা ও চাচা চলে গিয়েছিলেন সরাসরি সেই কম্পানির অফিসে। ভদ্রতায় আবৃত বহু অনুরোধ, বোঝানোর চেষ্টা—সবই করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ওরা ছিল নীতির বেড়াজালে বন্দি।
“আশরাফ তালুকদার নিজেই সব শর্ত মেনে এই লোন নিয়েছিলেন। তাঁর স্বাক্ষর সহ সমস্ত কাগজ বৈধ এবং যথাযথ। আমরা শুধু চুক্তি অনুযায়ী আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন বাড়ি কোম্পানির সম্পত্তি।”
একটি কড়া অথচ নির্লিপ্ত জবাব—তার বাইরে যেন কিছু ভাবতেই রাজি নয় ওরা।
চোখেমুখে ক্লান্তি নিয়ে ফিরে এসেছেন আরমানের বাবা ও চাচা। অন্তরে দুঃখ, মুখে নিঃশব্দ পরাজয়ের ছায়া।
হাসপাতালের এসেছিলেন মায়ার চাচা, চাচী এবং মাইশাও।
ডাক্তারের মুখে যখন শুনলেন—মায়া ভালো আছে, শুধুই শারীরিক ও মানসিক ধকলের কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল—তখনই যেন মুনজিলা বেগমের মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো।
আর এক মুহূর্তও দাঁড়াননি। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন চুপচাপ।
সবকিছু যেন উল্টে যাচ্ছে তাঁর ভাবনার বাইরে। যেই ছক কষে চলেছিলেন, সেই পরিকল্পনাগুলো যেন একে একে ভেঙে পড়ছে নিজের ভারেই।
চোখে মুখে বিরক্তি মিশ্রিত হতাশা। এখনকার প্রতিটা দৃশ্য, আরমানের ছোটো আম্মুর কান্না—সবকিছুই তাঁর কাছে শুধুই অভিনয়, একরাশ নাটক ছাড়া আর কিছু নয়।
রাত হয়ে এসেছে। মায়া এখনো ঘুমিয়ে। দুজনের বেশি কাউকে থাকতে দেবে না হসপিটালে। আরমানের বাবা, চাচা এবং মায়ার চাচাও অনেক আগেই চলে গেছেন। শুধু হসপিটালে ছিল সামিরা আবির আর আনজুমা বেগম। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরমানের ছোটো আম্মু ও আবির থাকবে হসপিটালে। একটা বেটা ছেলেকেও প্রয়োজন হসপিটালে তাই আবিরই থাকবে। আরমান অনেক আগেই চলে গেছে হঠাৎ করে। কিছুক্ষন পরেই সামিরাকে আবির বাড়িতে দিয়ে আসবে।
হঠাৎ করেই আনজুমা বেগমের মাথা ঘুরে উঠলো। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আবির। এখনি সামিরাকে দিতে যাবে ও। তাই আনজুমা বেগমের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎ উনাকে টলে পড়তে দেখে কোনো রকমে ধরে উনাকে করিডোরে রাখা চেয়ারে বসালো। সামিরাও ছুটে এসে পানি খাওয়ালো তার ছোটো আম্মুকে। তখনি আরমান আসলো ওখানে।
আনজুমা বেগমও মায়ার চিন্তায় আজ সারাদিন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেনি। তাই প্রেশার কমে গেছে।
সামিরা— “ছোটো আম্মু! তোমারও শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি বাড়ি চলে যাও, রেস্ট নাও। আমি থাকছি মায়া আপুর কাছে।”
আনজুমা বেগম তাড়াতাড়ি নাকোচ করে বলে উঠলেন— “না না মা! তুই ছোট মেয়ে। তুই হসপিটালে থাকতে পারবি না। আমি থাকছি এখানে।”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল— “তুমি যাও ছোট আম্মু। সামিরা থাকুক আর আমি থাকছি এখানে। কোনো অসুবিধা হবে না।”
আনজুমা বেগম— “কিন্তু আব্বু…”
আরমান উনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর কোনো কথা না ছোটো আম্মু। তুমি যাও রেস্ট নাও। আবির যা ছোটো আম্মুকে নিয়ে বাড়ি চলে যা। তোরও আসার দরকার নেই। আমি থাকছি এখানে। কোনো দরকার হলে ডেকে নেবো।”
আবিরও থাকতে চেয়েছিল এখানে। কিন্তু কি যেনো একটা ভেবে আরমানের কথায় সাই জানিয়ে চলে গেলো ছোটো আম্মুকে নিয়ে।
এদিকে আরমান এই হসপিটালে এর ম্যানেজার এর সাথে কথা বলে একটা ফাঁকা এবং পরিস্কার কেবিনের ব্যবস্থা করলো। তারপর সেই কেবিনে সামিরাকে নিয়ে গিয়ে বলল, “তুই এখানে রেস্ট কর। আমি মায়ার কেবিনের কাছে থাকছি। কোনো দরকার হলে তোকে ডেকে নেবো। আর তোর কিছু লাগলে বলে আমি আনার ব্যবস্থা করছি।”
সামিরা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল— “না ভাইয়া। আমার কিছু লাগবে না। আমি মাঝে একবার বাড়ি গিয়েছিলাম। ফ্রেশ হয়ে এসেছি। তুমি চিন্তা করো না।”
আরমান— “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোর জন্য খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। খেয়ে নিয়ে এই বেডেই কোনো রকমে আজকের রাতটা ম্যানেজ করে ঘুমিয়ে পড়িস। আর কোনো দরকার হলে ভাইয়াকে ডাকিস।”
সামিরা— “তুমি চিন্তা করো না ভাইয়া। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তুমি মায়া আপুর কাছে যাও। আপুর কোনো অসুবিধা হতে পারে। এখন কেউ নেই আপুর কাছে।”
আরমান সাই জানিয়ে বেরিয়ে গেলো সামিরার কেবিন থেকে। তারপর ক্যান্টিনে গিয়ে সামিরার জন্য খাবার অর্ডার করে আসলো। ক্যান্টিন এর কর্মচারীরাই খাবার পৌঁছে দেবে কেবিনে। তাই আরমান এবার হাঁটা দিলো মায়ার কেবিনের উদ্দেশ্য। তারপর আস্তে করে দরজা খুলে প্রবেশ করলো মায়ার কেবিনে।
চলবে….
#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_28
#লেখিকা_সালমা_খাতুন
🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫
হাসপাতালের কেবিনে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
মৃদু আলোয় ধূসর হয়ে আছে চারপাশ। মায়া এখনো ঘুমিয়ে আছে… চোখদুটো বন্ধ, ওর নিস্তরঙ্গ মুখে ছায়া পড়েছে ক্লান্তির, অথচ কী শান্ত, কী কোমল… যেন একটা হারিয়ে যাওয়া বিকেলের ছবি।
আরমান আস্তে করে কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তারপরে এক নিঃশ্বাসে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ মায়ার দিকে। বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মনের ভেতরটা হঠাৎ করেই খুব কাঁপতে শুরু করলো ওর।
আজকে সারাদিন কত কিছু ঘটে গেছে…
কত অস্থিরতা, দৌড়ঝাঁপ, টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে শরীরটাও ক্লান্ত, কিন্তু মনটা?
মনে যেন বয়ে যাচ্ছে এক অস্থির স্রোত… এক অনুচ্চারিত হাহাকার।
আরমান চুপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে গেলো বিছানার পাশে।
হাতটা বাড়িয়ে রাখলো খুব ধীরে… খুব নরম করে ছুঁয়ে রাখলো মায়ার হাতের পাশে। তবে ছোঁয়া নয়… কেবল অনুভব। ওর হাতে স্যালাইনের সুই গাঁথা, তাই সাহস হয়নি পুরোপুরি ধরার।
মাঝে মাঝে ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, বুকটা ধীরে ধীরে উঠানামা করে। কপালে এলোমেলো কিছু চুল পড়ে আছে, যেন ক্লান্ত মুখটার প্রশান্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আরমান আস্তে করে হাত বাড়িয়ে একটিমাত্র আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিলো চুলগুলো, যেন মায়ার মুখটা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পায়।
কিন্তু ওর সেই মৃদু ছোঁয়াতেই মায়া হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই ভয় পেয়ে শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
আরমান কেঁপে উঠলো ওর এমন প্রতিক্রিয়ায়। তাড়াতাড়ি করে কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো, যেন অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে। তবে মায়ার হাতে রাখা ওর হাতটা ঠিকই কিছুটা চেপে ধরে রাখলো, যেন আশ্বস্ত করতে চায় তাকে। এরপর আস্তে ঝুঁকে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—
“আমি এখানে আছি তো… তোমার পাশে… তবে ভয় পাচ্ছো কেন, মায়াবতী?”
শব্দগুলো যেন বাতাসে মিশে গেলো। মায়ার তরফ থেকে কোনো সাড়া এলো না। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজেরই বলা কথায় থমকে গেলো আরমান। ‘মায়াবতী’…!
সে তো শুধু মাত্র, সেই ছোট্ট পিচ্চি মেয়েটাকে এই নামে ডাকতো—পিচ্চি মায়াবতী। ওর নাম তো শুধু হৃদয়ে ছিল, মুখে কখনো আর আসেনি কাউকে দেখে। অথচ আজ… নিজের অজান্তেই, মায়াকে উদ্দেশ্য করে সেই নামটাই বেরিয়ে এলো!
এমনকি মাইশাকে তো কতবার দেখেছে, কথা বলেছে… একটিবারও তো মন থেকে সেই নামটা আসেনি! তবে আজ? আজ কেন এই ডাক?
হয়তো মায়ার মুখেই লুকিয়ে আছে সেই একই ‘মায়া’। ওর মুখের দিকে তাকালেই একটা গভীর মায়া এসে চেপে ধরে। এই মায়া হয়তো সেই পিচ্চির মায়াবতীর মতোই স্নিগ্ধ, সরল, তাই হয়তো এই ডাক। এই কথাগুলো ভেবে আরমান আবারও আনমনে ফিসফিস করে বলে উঠলো — “তোমার চোখে আমি যা দেখি, সেটা আমি আমার পিচ্চি মায়াবতীর চোখে দেখেছিলাম। অনেক বছর আগে…আর তাই হয়তো মন থেকে এই ডাক বেরিয়ে এলো।”
আরমান নিজের সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মায়ার মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকতে মন চাইছে। যেনো কোনো ক্লান্তি আসবে না এই মুখের দিকে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকলে। কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে তা আরমান বুঝতে পারছে না।
আজ কনফারেন্স রুমে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল। ফোন ভাইব্রেট করা ছিল। সামিরা কল করছে দেখেও প্রথমে রিসিভ করেনি। ইগনোর করেছিল ও। তারপর বার বার কল করতে দেখে, রিসিভ করে ।
যখন সামিরা মায়ার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানালো, তখন যেনো আরমানের হৃদয় থমকে গেলো। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আর কোনো কথা বের হচ্ছিল না ওর মুখ দিয়ে এদিকে সামিরা, ‘হ্যালো! হ্যালো!’ করে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে তখন আরমান নিজের মুখ দিয়ে কাঁপা গলায় বের করেছিল, “আ..আসছি আমি।”
এরপর আর কোনো কিছু না ভেবে, কনফারেন্স রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল ও। অবাক হয়ে দেখেছিল সবাই আরমানকে এইভাবে কোনো কিছু না বলে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখে। এরপর আবিরও নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সামিরার অনেক গুলো মিসডকল আর ম্যাসেজ। এরপর আবির অফিসের সবকিছু কোনোমতে সামাল দিয়ে নিজেও বেরিয়ে আসে।
___________
আরমান মায়ার মুখের কাছে খানিকটা ঝুঁকে মায়ার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ধূসর আলো আর স্যালাইনের ফোঁটার শব্দের ফাঁকে চোখ মেলে দেখে—আরমান। ওর মুখের ওপর ঝুঁকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্ত ভাব, যেন বহুদিন পর কোনো কিছুতে স্থির হতে পেরেছে।
মায়া চমকে ওঠে না। তবে ভেতরে কোথাও একটা আলতো কাঁপুনি বয়ে যায়—
স্মৃতি, দুঃখ আর দুর্বলতার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটা, এত কাছে কেন?
ওর ঠোঁট কাঁপে… খুব নিচু দূর্বল গলায় ফিসফিস করে উচ্চারণ, “এভাবে… তাকিয়ে আছেন কেন?”
কণ্ঠে কিছুটা দূর্বলতা, একটুখানি ভাঙা ভাঙা বিস্ময়, যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলছে ও।
আরমান মায়ার চোখ খোলা দেখতে পেয়েই সে যেন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। মুখের কাছ থেকে একটু সরে এসে সোজা হয়ে বসল। মুহূর্তেই নিজের স্বভাবজাত গম্ভীরতা ফিরিয়ে আনল সে। ঠোঁট কঠিন রেখায় বদ্ধ করে ফোনটা হাতে তুলে নিল, যেন ফোনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করছে এখন।
মায়া ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল চারপাশে, তারপর আরমানের দিকে। ক্লান্ত ও দুর্বল গলায় সে প্রশ্ন করল, “এটা… কোথায়? কোথায় নিয়ে এসেছেন আমায়?”
আরমান ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল মায়ার দিকে। গলার স্বর শান্ত, “হাসপাতালে। দুপুরের দিকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে তুমি। তাই নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।”
মায়া:- “ওহ।”
তারপর খানিক চুপ থেকে, যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল তার। কণ্ঠে অসহায়তার আভাস, চোখে মেঘ জমার ইঙ্গিত, সে আবার প্রশ্ন করল—
“বাড়িটা? আমার পাপার বাড়ি… সত্যিই কি ওনারা নিয়ে নেবে? কোনো উপায় নেই… আমার পাপার শেষ স্মৃতিটুকু বাঁচানোর?”
আরমান মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দৃষ্টিটা ছিল শীতল, অনুভূতিহীন, যেন দীর্ঘদিনের ক্লান্ত এক পুরুষ যে সমস্ত আবেগকে অন্তরের গহীন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সেখান থেকেই যেন নিঃসৃত হলো তার উত্তর—
“না, কোনো উপায় নেই। কোম্পানির দেওয়া সময় শেষ হয়ে গেছে। তোমার বাবা নিজে হাতে দলিল আর কন্ট্রাক্ট পেপারে সই করেছিলেন। এখন আইনের চোখে ওই বাড়ি আর তোমার নয়।”
আরমানের এমন নিষ্ঠুর কথায় মায়ার চোখে বৃষ্টি নেমে এলো। আরমান তখনো তাকিয়ে আছে মায়ার মুখের দিকে। কি যেনো গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত ও। আর মায়া দুঃখ, কষ্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
তখনি রুমে একজন নার্স প্রবেশ করলো। হাতে মেডিসিন ও খাবারের থালা। খাবারের থালা বেডের পাশের টেবিলে রেখে বলল, “এই যে উনার খাবার, আর এখন একটা ইনজেকশন আছে উনার।”
মায়া নার্সকে আসতে দেখে ফুঁপানো থামিয়ে দিয়েছে, তবে চোখ থেকে তখনও নিঃশব্দে পানি পড়ছে। আরমান তখনো মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে।
নার্স প্রথমে মায়াকে শোয়া থেকে উঠে বসালো ধীরে সুস্থে। তারপর ধীরে ধীরে ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা প্রস্তুত করে, মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা ম্যাডাম, একটু কষ্ট হবে, সহ্য করুন।”
মায়া নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওর সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। এখনো বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ দোলা দিচ্ছে। নার্স ইনজেকশন পুশ করতেই, চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকা আরমানের বাহু হঠাৎ করে বাঁহাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে ফেলল। ওর আঙুলের নোখ গুলো গেঁথে গেলো শার্টের উপড় দিয়েই।
আরমান নির্বাক ভঙ্গিতে তাকালো মায়ার সেই হাতের দিকে। ওর চোখে ধরা পড়ল মায়ার চোখের ভেতর জমে থাকা আতঙ্কের ছায়া। ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে মায়ার।
(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/
নিজের হাতের উপর আর একটা হাতের অস্তিত্ব পেতেই ধীরে চোখ খুলল মায়া। তারপর দৃষ্টি রাখলো আরমানের চোখের দিকে।
আরমান ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল না। বরং নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে ওর হাতের ওপর রাখল আস্তে করে। চোখে একটা নিশ্চিন্ত আশ্বাসের দৃষ্টি, যেনো বলতে চাইছে—“আমি তো আছি, ভয় কিসের?”
মায়া তাকিয়ে রইল আরমানের চোখের দিকে আরমানের দৃষ্টি তখন নিজের আরেক হাতে থাকা ফোনে। কিন্তু তবুও যেনো মায়া ভরসা পেলো আরমানের থেকে, তাই ওর আঙুলের চেপে ধরা শক্তিটা আস্তে আস্তে কমে এলো।
নার্স ইনজেকশন দিয়ে বলল, “হয়ে গেছে। এই ইনজেকশনটা ঘুম আনবে… তবে তার আগে কিছু খেয়ে নেবেন। অনেকক্ষণ কিছু খাননি তো।”
নার্স এর কথায় ঘোর কাটলো মায়ার। কিভাবে যে ইনজেকশন দিলো নার্স কি জানি? ও তো কিছু বুঝতেই পারলো না যেনো। ধীরে আরমানের বাহু থেকে হাত সরিয়ে আনলো মায়া। নার্স খাবারের থালাটা বিছানার পাশে রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
আরমান ওর মোবাইল টা পাশের টেবিলে রেখে চোখ মেলে তাকাল থালার দিকে। তারপর আবার মায়ার মুখের দিকে। মায়া মাথা নিচু করে নিজের কোলের দিকে দৃষ্টি রেখেছ। যেন শূন্য দৃষ্টিতে কী এক অতল কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। চোখের কোনায় জমে থাকা অশ্রু তখনও শুকিয়ে যায়নি।
আরমান ধীরে ধীরে খাবারের থালাটা টেনে কাছে আনল। থালার মধ্যে একটা মাঝারি সাইজের বাটিতে স্যুপ রাখা। আরমান চামচে কিছুটা স্যুপ তুলে, মুখে কিছু না বলে চামচ টা মায়ার মুখের কাছে ধরলো।
মায়া মুখ তুলে চাইলো আরমানের দিকে। তারপর বলল, “আমি নিজে খেয়ে নেব।”
আরমান বিরক্ত না হয়ে গম্ভীর গলায় বলল—
“ডান হাতে স্যালাইন চলছে। বাঁ হাত দিয়ে চামচ ঠিক মতো ধরতে পারবে না। তাই বেশি না বকে, চুপচাপ খেয়ে নাও।”
মায়া দু’চোখে অভিমান আর ক্লান্তির মিশ্র ছায়া। যেন কাঁদতেও ক্লান্ত, বিরোধও করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল, “এখন এতিম হয়ে গেছি বলে দয়া দেখাচ্ছেন?”
আরমান চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল একটুখানি। তারপর মুখটা গম্ভীরের থেকে গম্ভীর করে বলল— “ভেবে নাও তাই। আমার সময়ের একটা দাম আছে। তাই ফালতু বকবক না করে আমার সময় নষ্ট করবে না।”
মায়া ছলছল চোখে বলে উঠলো— “হ্যাঁ! আপনার তো সময়ের অনেক দাম। তাহলে এখানে এসেছেন কেন? আর এতোক্ষণ ছিলেনই বা কেন?”
আরমান এতোক্ষণে চামচ টা আবারও বাটিতে নামিয়ে নিয়েছে। মুখ তখনও গম্ভীর। গম্ভীর গলাতেই বললো— “মনে রাখবে, এই আরমান শাহরিয়ার কখনো কোনো কাজ নিজের স্বার্থ ছাড়া করে না।”
মায়া— “আমার খেয়াল রাখার পেছনে আপনার কি স্বার্থ আছে, মিস্টার আরমান শাহরিয়ার?”
আরমান এবার ধমকে উঠলো মায়াকে— “just stop it, Maya. আমি তোমার সব কথার উত্তর দিতে বাধ্য নয়। চুপচাপ খেয়ে নাও।”
আরমানের ধমকে ভয় পেয়ে চমকে উঠলো মায়া, থমকে রইল খানিকটা। আরমান নিজের কথা শেষ করে আবার চামচে খাবার তুলে নিয়ে মায়ার মুখের সামনে ধরেছে। মায়া একবার চামচের দিকে তাকাল, তারপর আরমানের চোখে। সেই চোখে কোনো মায়া নেই, কোনো অনুরোধও নেই—কিন্তু অদ্ভুত এক নিঃশব্দ জোর, অধিকার রয়েছে। যেনো মায়া বাধ্য আরমানের কাছে। একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়া আস্তে করে মুখ খুলল।
দুজনেই চুপ। কেবিনে তখন শুধু স্যালাইনের ফোঁটার শব্দ, ঘড়ির টিকটিকি, আর এক অজানা আবেগের নিঃশব্দ স্রোত।
আরমান যত্ন করে একে একে মায়াকে খাইয়ে দিতে লাগল। কোনো কথা নেই, তাড়া নেই—শুধু নিঃশব্দে এক মনোযোগে খাবার তুলে দিচ্ছে। যেন সেই মুহূর্তে এই কাজটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
মায়া ওর মুখের ভেতর খাবার গিলে নিতে নিতে মনে মনে ভাবছিল—এই মানুষটা কি শুধুই নিজের স্বার্থে জন্য ওর এতোটা যত্ন করছে? এই সব কিছু কি শুধুই দয়া? নাকি… অন্য কোনো কিছু আছে, যেটা ও বুঝতে পারছে না?
কিছু প্রশ্ন কখনো, চাইলেও মুখে আনা যাই না, হৃদয়েই ঘুরপাক খায়।
মায়ার খাওয়া শেষ। আরমান তার হাতে কিছু না লাগার সত্ত্বেও ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে আসলো। মায়া চোখ মুখ কুঁচকে বলল— “আপনার হাতে তো কিছুই লাগেনি তাও হাত ধুলেন যে?”
আরমান মায়ার এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ কেবিনে থাকা সোফাটায় বসলো। যা দেখে মায়া মুখ বাঁকালো। আরমান তা আরচোখে দেখলেও কিছু বলল না। মায়া মিনমিন করে বলল— “নার্স কে একবার ডেকে দিন না।”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “কেন?”
মায়া আবারও মিনমিন করেই উত্তর দিলো, “ওয়াশরুমে যাবো একবার।”
আরমান ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই বলল— “তো চলো আমি দিয়ে আসছি ওয়াশরুমে।”
মায়া অবাক হয়ে গেলো, চোখ গোল গোল করে বলল, — “কিহ?? আপনি আমার সাথে যাবেন মানে??”
আরমান কোনো কিছু না বুঝতে পেরে, ভ্রু কুঁচকে বলল— “হ্যাঁ আমি তো বলেছি ‘দিয়ে আসবো ওয়াশরুমে’ এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”
মায়া এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে নিলো ও। তারপর আমতা আমতা করে বলল— “তা তো ঠিক… কিন্তু শুধু দিয়ে আসলে তো হবে না। দাঁড়িয়েও থাকতে হবে… কারণ এই স্যালাইনের বোতলটাও নিয়ে যেতে হবে। আমার এক হাতে স্যালাইনের সুঁচ গাঁথা…আরো অন্য হেল্প লাগবে আমার।”
আরমান এতোক্ষণে বুঝতে পারলো সবকিছু। আর এতে নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলো ও। ও তো ভেবেছিল মায়া হয়তো একটু মুখে হাতে পানি দেবে। অন্য কিছু ভেবে দেখেনি ও। আরমান কিছুটা আমতা আমতা করে বলল— “মানে… দাঁড়িয়ে থেকে… স্যালাইনের বোতল ধরে… আর তুমি… মানে… আমি… তোমার…”
মায়া চোখ তুলে একঝলক তাকাল। এবার আরমান যেন পাথর। মুখ গম্ভীর রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ঝটকা খেয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। সে এক ঝটকায় বলে উঠল— “আমি নার্সকে ডেকে দিচ্ছি।”
আরমান কথাটা বলেই যেন নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত না পেয়ে তাড়াহুড়ো করে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যেন মুহূর্তে হারিয়ে যেতে চায় এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে, যেটা ওর চিরচেনা গাম্ভীর্যের দেয়ালে একটা সরু ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। আরমান চলে যেতেই কেবিনে ফিরে এলো নিস্তব্ধতা। সেই নিরবতার ভেতর মায়ার ঠোঁটে এক অচেনা হাসির রেখা—যেটা তার সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি, শোকের গহ্বর পেরিয়ে এক অনাবিল কোমলতায় ঝিকিমিকি করে উঠলো। কাঠখোট্টা, গম্ভীর মানুষটার ভেতর যে এতখানি অবুঝ মানুষের স্পর্শ লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে পেরে যেন একটুখানি আলো ছুঁয়ে গেল তার ভেতরের মেঘলা আকাশে।
কিছুক্ষণ পরেই কেবিনে প্রবেশ করলো একজন নার্স। কণ্ঠে পেশাগত সৌজন্য, মুখে একগাল হাসি।
“কি হেল্প লাগবে, ম্যাম?”
মায়া চোখ তুলে তাকিয়ে ধীরে স্বরে জানালো, “ওয়াশরুমে যেতে চাই।”
নার্স সহানুভূতির ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে নরম হাতে বেড থেকে নামতে সাহায্য করলো তাকে। স্যালাইনের পাইপ সামলে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো মায়া। কিন্তু ঠিক তখনই নিজের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই শূন্যতার এক হালকা ঢেউ খেললো। পরনে হাসপাতালের নরম আকাশি রঙের পোশাক—গলার কাছে খোলা, বুক জুড়ে ফাঁকা, কোথাও নেই চেনা ওড়নার আড়াল। মুহূর্তেই তার মুখে ছায়া ফেললো রক্তিমতা, লজ্জায় টকটকে হয়ে উঠলো দুই গাল। ভাবতেই কেমন হোঁচট খেল তার মন—এই বেশেই কি সে এতক্ষণ ছিল আরমানের সামনে?
চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। মনের গভীরে অদ্ভুত এক অনুভূতির ঢেউ বয়ে গেলো—লজ্জা, অস্বস্তি, আবার যেন কোথাও একটা অচেনা স্পর্শে নরম হয়ে আসা হৃদয়ের পরত।
.
চলবে….