আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-২৯+৩০

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_29
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

সকালের নরম আলো নিঃশব্দে জানালার ফাঁক গলে কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সাদা দেয়ালের ওপর ঝরে পড়া সেই আলোকছায়া এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা ঘরে। দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু নাম না-জানা পাখির কিচিরমিচির শব্দ, আর বাইরে রাস্তায় শুরু হয়েছে দিনের প্রথম গাড়িচলা—নিয়মিত, কিন্তু বিরক্তিকর এক শব্দের ধারা।

আরমান এখনো সোফায় বসে ঘুমিয়ে। মাথাটা একদিকে হেলে পড়ে আছে, মুখে হালকা ক্লান্তির ছাপ। সূর্যের আলো তার মুখে এসে পড়তেই সে একবার চোখ কুঁচকে নিল বিরক্তিতে। একটু পরে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল চারদিকে—প্রথমে অস্পষ্টভাবে, তারপর ধীরে সোজা হয়ে বসে পড়ল।

দৃষ্টি গিয়ে পড়লো, সাদা চাদরে মুড়ে, গলা অবধি টেনে রাখা সেই মেয়েটি যেন এক নিঃশব্দ দুঃখের অবয়ব হয়ে ঘুমিয়ে আছে। চোখ বুজে আছে, তবু চোখের কোণের চারপাশে চাপা ক্লান্তি, মুখে এক ধরনের বিষণ্নতা—যা ঘুমের মাঝেও স্পষ্ট।
সেই শান্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে আরমানের চোখে ক্ষণিকের জন্য ঝিলিক দিয়ে উঠল এক অদ্ভুত অনুভূতি—কেমন যেন বোধের অতলে নেমে যাওয়া একটা নরম ঢেউ।

এক মুহূর্তের জন্য আরমান অনুভব করল—এই মেয়েটিকে সে যতটা বুঝেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু লুকিয়ে আছে মায়ার ভেতরে।
অনেক না বলা কথা, অনেক চাপা কান্না… এবং হয়তো কোথাও লুকিয়ে থাকা এক অপূর্ণ অপেক্ষা।

কাল রাতে নার্স কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরে, সে আবার কেবিনে ফিরে এসেছিল।
ততক্ষণে মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে, হয়তো ওষুধের ঘোরে কিংবা দিনের সমস্ত ক্লান্তি আর হৃদয়ের দহন মিলিয়ে এক ধরনের গভীর ঘুমে ডুবে গেছে।

আরমান চুপচাপ সোফায় বসে নিজের মোবাইলে ইমেইল চেক করছিল তখন। সবকিছুই স্ক্রিনের পাতায় পাতায় ভেসে উঠছিল। কিন্তু ঠিক কখন যে তার নিজের চোখ বুজে এসেছে, সে নিজেও জানে না।

আরমান ধীরপায়ে সোফা থেকে উঠে হাঁটা দিল ওয়াশরুমের দিকে। চোখে-মুখে এখনও ঘুমের আবেশ, শরীরে ক্লান্তির রেখা। কয়েক মিনিট পর, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। হাতে নিজের রুমাল, নিঃশব্দে ভেজা মুখ আর হাত মুছে নিচ্ছে। ঠিক তখনই—

ঠক ঠক, আওয়াজে কেবিনের দরজায় টোকা পড়লো।

সাথে সাথেই শোনা গেল এক চেনা কণ্ঠ—
“আসতে পারি?”

আরমান মুখ না তুলে, স্বাভাবিক গাম্ভীর্য বজায় রেখেই ছোট্ট করে উত্তর দিল,
“হুম।”

দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল আবির। মুখে স্বাভাবিক এক প্রাণবন্ত হাসি, হাতে একটা ছোট ব্যাগ।

আরমান ওর দিকে না তাকিয়ে বলল,
“তুই এত সকালে এখানে?”

আবির হাসি মুখেই উত্তর দিল,
“তোদের এখানে রেখে নিজের বিছানায় ঘুম হচ্ছিল না রে ভাই। তাই ভাবলাম এসে একটু দেখে যাই।”

আরমান ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়ে বলল, তারপর ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা,
“এত সকালে তোকে ঢুকতে দিল কে? এই নার্সিংহোম তো খুব কড়া।”

আবির দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আরে আরমান শাহরিয়ার বলে একটা নাম আছে না? সেই পাওয়ার খাটিয়েছি।”

এ কথায় হালকা এক বাঁকা হাসি খেলো গেলো আরমানের ঠোঁটে, কিন্তু মুহূর্তেই, মৃদু আওয়াজে তাদের দৃষ্টি চলে গেল বেডের দিকে। মায়া ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করছে। চোখে ঘুম আর ক্লান্তির ছায়া।

আবির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ওর পাশে এগিয়ে গেল। নরম হাতে সাহায্য করল বালিশে ভর দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসতে।
আরমান চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো দৃশ্যটা যেন গেঁথে নিল ভেতরে ভেতরে।

মায়া মুখ তুলে তাকিয়ে, দুর্বল কণ্ঠে বলল, “তুমি কখন এলে ভাইয়া?”

আবির পাশে রাখা টুলটা টেনে নিয়ে বসল। চোখে ছিল একরাশ স্নেহ, কণ্ঠে ছিল অভ্যস্ত দায়িত্ববোধ।

“এই তো, এইমাত্র এলাম। এখন কেমন আছো তুমি?”

মায়া মাথা একটু নেড়ে ছোট্ট করে জবাব দিল,
“ভালো আছি।”

আবির কিছুটা ঝুঁকে, মৃদু কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করল,
“সত্যিই ভালো আছো তো? কোনও অসুবিধা বা কষ্ট হচ্ছে না তো? বলো আমাকে। তাহলে আমি সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলব।”

মায়া চোখ নামিয়ে বলল, “না ভাইয়া, এখন আর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ঠিক আছি।”

ওদের কথোপকথনের মাঝখানে কেবিনে একটা মুহূর্তের জন্য নেমে এলো গভীর এক নিরবতা। আবিরের চোখে বোনসুলভ স্নেহ, আর মায়ার কণ্ঠে ধরা পড়ে এক অনুচ্চারিত কৃতজ্ঞতা—যা সে প্রকাশ করতে পারছে না, শুধু অনুভব করছে।

আরমানের কেন জানি বিরক্ত লাগলো সব কিছু, তাই কোনো কিছু না বলেই গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলো। আবির আর মায়া তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

সকাল দশটা…

ডাক্তারের চেকআপ শেষ। সব রিপোর্টই আশ্বস্ত করেছে—মায়ার শারীরিক অবস্থা ভালো। স্যালাইনের ক্যানোলা খুলে দেওয়া হয়েছে তার হাতে থেকে। হালকা ব্যথা রয়ে গেছে সুঁচের প্রবেশপথে, কিন্তু সে ব্যথার চেয়েও বড় যে ক্ষত, তা ছিল মনের গভীরে—

এখন মায়া আবিরের নিয়ে আসা বাড়ির পোশাক পরে প্রস্তুত হয়েছে হসপিটাল ছাড়ার জন্য। চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও সাজানো রয়েছে এক ধরণের নির্লিপ্তি। যেন কোনো কিছুতেই আর অবাক হবার মতো কিছু বাকি নেই তার জীবনে।

ওদিকে আবির আর আরমানের বাবা আনোয়ার সাহেব গিয়েছেন ডিসচার্জের যাবতীয় ফর্মালিটিজ পূরণ করতে।

আনোয়ার সাহেব একটু আগে যখন বললেন—
“আমি তোকে নিতে এসেছি মায়া মামনি। আজ থেকে তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি। আমার মেয়ে হয়ে।”

তখনই বুকের ভেতর কোথা থেকে যেন এক গোপন হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল মায়ার। চোখ ভিজে উঠল। কোনো কিছু বলার আগে, নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা অশ্রু। একটানা তাকিয়ে রইল সামনের দেয়ালে, যেন সেখানেই লুকিয়ে আছে তার সমস্ত অতীত, সমস্ত স্মৃতি। তার চাচা চাচী নাকি আজ সকালেই চলে গেছেন। তার সাথে দেখা না করেই। হয়তো ভয় পেয়েছে, যদি এখন মায়ার দায়িত্ব তাদেরকে নিতে হয়।

মনের ভেতর হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটাই সত্য—সে এখন এতিম। মাথার উপর ছাদ নেই। নিজের বলতে এমন কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর।

প্রথমটায় যেতে রাজি হয়নি সে আরমানদের বাড়িতে। ভেতরের এক গোপন দ্বিধা, এক অদ্ভুত অস্বস্তি তাকে আটকে রেখেছিল। কিন্তু আনোয়ার সাহেব ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিলেন মায়াকে। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেই মুহূর্তটা, যেদিন হাসপাতালে বসে তার প্রিয় বন্ধু—মায়ার বাবা—নিজের কাঁপা হাতটা মেয়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে তুলে দিয়েছিলেন আনোয়ার সাহেবের হাতে। নিঃশব্দে, গভীর এক আস্থায় ভর করে বলে গিয়েছিলেন, “আমার একমাত্র মেয়েটার দায়িত্ব তোর হাতে তুলে দিলাম। এখন থেকে তুই ওর বাবা। দেখে রাখিস আমার মেয়েটাকে।”

আনোয়ার সাহেবও কথা দিয়েছিলেন—এই মেয়েটাকেই নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখবেন। যত্ন করবেন। কোনো কষ্ট আসতে দেবেন না তার জীবনে। আর তখনই মায়ার বাবা বলে গিয়েছিলেন আরও একটা কথা—
“ভালো ছেলে দেখে মায়ার বিয়ে দিস, আনোয়ার। যেনো আমার মেয়েটা সারা জীবন সুখে থাকে।‌ খুব ইচ্ছে ছিল জানিস, মেয়েটাকে সুখী হতে দেখার— কিন্তু সব ইচ্ছে তো শেষ পর্যন্ত পূরণ হয় না…

মায়ার বাবা দেখে যেতে পারলেন না মেয়েকে সুখী হতে। এটাই ছিল তার অপূর্ণতার গভীর দাগ, আর সেই দায়ের ভারই আজ আনোয়ার সাহেব তুলে নিয়েছেন মায়ার জীবনের একমাত্র ছায়া হয়ে।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._

আবির যখন সেই কেবিনে ঢুকল, তখন দৃশ্যটা দেখে মুহূর্তেই তার চোখ বড় হয়ে গেল। সামিরা ঘুমে এমনভাবে গা ছেড়ে দিয়েছে, যেন পৃথিবীর কোনো চিন্তাই তার নেই। বিছানার এক কোণে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ও, বালিশের জায়গা দখল করেছে ওর এক হাত। বালিশ নিচে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সামিরার একটা পা আর একটা হাত বেডের বাইরে ঝুলে আছে, মুখটা আধখোলা, আর গলা দিয়ে হালকা শোঁ শোঁ শব্দ বেরোচ্ছে।

এই অবস্থায় আবিরের দুষ্টুমে মন ভরপুর আনন্দে ভরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করল, ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল সামিরার এই রাজকীয় ঘুমের। তারপর ওর মানিব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো বার করে পাকিয়ে সরু বানিয়ে, নিঃশব্দে সামিরার কানে খোঁচাতে শুরু করল।

ঘুমে বিঘ্ন ঘটতেই সামিরা বিরক্ত মুখে হাত নেড়ে আবিরের হাত সরিয়ে দিলো। কিন্তু আবির থেমে থাকার ছেলে না, আবারও একই কাণ্ড করল। এদিকে সামিরা পাশ ফিরতে গিয়ে একেবারে ধপ করে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গেল।

“উফ্ মা গো!”—একটা ঝাঁকি খেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আবির তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার দশা! সামিরা ততোক্ষণে চোখ কচলাতে কচলাতে ফ্লোরে উঠে বসে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় বুদ্ধি ফিরতেই দাঁত কিঁচিয়ে তেড়ে এল আবিরের দিকে।

“এই তুমি! নিশ্চয়ই কিছু করেছো, তাই না? আমি এমনি এমনি পড়ে যাবো না?”—রাগে মুখ লাল করে চেঁচিয়ে উঠল সামিরা।

আবির কোনোমতে নিজের হাসি থামিয়ে বলল, “আরে না রে! আমি কি করবো? তোকে ডাকার জন্য এসেছিলাম। তোকে ডাকার সাথে সাথে তুই নিজেই পড়ে গেলি, এতে আমার দোষ কী?”

সামিরা রেগেই বলল, “তা আমি তো তোমার ডাক শুনলাম না! নিশ্চয় কিছু না কিছু করেছো তুমি।”

আবির:- “শোন, তুই যখন ঘুমাচ্ছিলি, তখন দেখলাম তুই বিছানার অর্ধেক ঝুলে আছিস! আমি যদি না ডাকতাম, এমনিতেই পড়ে যেতিস। বরং আমি তো তোর প্রাণ বাঁচাতে এসেছিলাম বলা যায়!”—আবির নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, তারপর আবার হাসতে লাগল।

তারপর বলল, “বিশ্বাস হচ্ছে না তো? দাঁড়া, প্রমাণ দেখাচ্ছি।”

বলেই সে ফোনটা সামিরার সামনে ধরল। ছবি দেখে সামিরার মুখ যেন কালো হয়ে গেল।

সামিরা:- “ছিহ ভাইয়া! এসব কী? আমার এত বাজে ছবি! তুমি এই অবস্থায় ছবি তুলেছো কেন?”

চিৎকার করে উঠল সামিরা, “তাড়াতাড়ি ডিলিট করো বলছি!”

সামিরা মোবাইল কেড়ে নিতে এগোতেই আবির এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো।

আবির এক চোখ টিপে বলল, “না, একদম না! এই ছবিগুলো খুব মূল্যবান। পরে কাজে লাগবে।”

তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “তুই বল, তোকে এখানে কেন রাখা হয়েছিল?”

সামিরা বলল, “মায়া আপুর খেয়াল রাখার জন্য…”

আবির:- “হ্যাঁ, তো! তাহলে তুই কতটা খেয়াল রাখলি শুনি?”

সামিরা মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বলল, “সরি ভাইয়া… কাল রাতে ভাইয়া বলেছিলে খেয়ে একটু রেস্ট নিতে… খাওয়া শেষ করে একটু শুয়েছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি…”

তারপর মুখ তুলে আবার বলল, “মায়া আপু কেমন আছে এখন? আপুর কোনো অসুবিধা হয়নি তো? আমি জানি, খুব খারাপ করেছি আমি। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হয়নি…”

আবির:- “মায়া এখন ভালো আছে চিন্তা করিস না।

এরপর আবিরও কিছুটা দুঃখিত হওয়ার ভান করে বলল, “হ্যাঁ এটা তুই একদম ঠিক বলেছিস। তুই ভীষণ খারাপ। আর তাই তো তোর কথা কেউ মনে রাখেনি। সবাই তোকে হসপিটাল থেকে না নিয়েই, মায়াকে ডিসচার্জ করিয়ে চলে গেছে।”

আবিরের এই কথায় অবাক হয়ে গেলো সামিরা। ও চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কিহ?? সবাই আমাকে না নিয়েই চলে গেছে?”

আবির:- “হ্যাঁ তো। সবাই দেখছি মায়াকে নিয়েই ব্যস্ত বাড়িতে। আমার হঠাৎ করে মনে পড়লো তোর কথা। জানিসই তো তোকে আমি কতটা ভালোবাসি। তো আমি সবাইকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই, সবার মনে পড়লো। তুই তো কুম্ভকর্ণের মতো পড়ে পড়ে ঘুমাস, তাই সবাই বলল আমি যেনো তোকে তুলে নিয়ে আসি। আমি ভাবলাম, ওই ছোটো খাটো একটা হাতির বাচ্চার মতো মানুষটাকে তুলে আনা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই একটা জেসিবি নিয়ে আসি। ওটাতে করে তুলে নিয়ে যেতে সুবিধা হবে। তবে দুঃখের বিষয় হলো এই যে, অতো বড়ো জেসিবি টাকে এই নার্সিংহোমের ছোটো দরজা দিয়ে প্রবেশ করানো গেলো না।”

সামিরা প্রথমে অবাক হলো ওকে সবাই না নিয়েই চলে গেছে শুনে। কিছুটা মন খারাপও হলো। কিন্তু আবিরের পুরো কথাটা শুনে আবারও রেগে গেলো। ও তেড়ে গিয়ে আবিরকে কিল ঘুষি মারতে শুরু করলো। মুখে বলতে থাকলো, “কিহ? আমি ছোট খাটো হাতির বাচ্চা? আর তুমি? তুমি কি হ্যাঁ? তুমি একটা গন্ডার, জলহস্তী।”

ওদের এই দুষ্টুমির মাঝেই আরমানের গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল— “ কি হচ্ছে টা কি?? তোরা এখানেও শুরু করেছিস?”

সামিরা দরজার কাছে আরমানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখ ওর কাছে গিয়ে আবিরের নামে নালিশ জানিয়ে বলল, “ভাইয়া তুমি জানো! আবির ভাইয়া আমাকে হাতির বাচ্চা বলেছে। আবার আমাকে তুলে নিয়ে যেতে নাকি জেসিবি লাগবে।”

আবির তাড়াতাড়ি নাকোচ করে বলে উঠলো, “আরে হাতির বাচ্চা বলেনি তো। বলেছি ছোটো খাটো হাতির বাচ্চার মতো মানুষ।”

সামিরা:- “দুটো একই হলো। আচ্ছা তোমরা সবাই নাকি আমাকে না নিয়েই চলে গেছো, মায়া আপুকে ডিসচার্জ করিয়ে।”

আবির থমথমে গলায় উত্তর দিলো, “না এখনো যাইনি। তবে আর দুই মিনিটও লেট করলে চলে যাবো তোদের রেখেই।”

বলেই আরমান আবার হনহন করে চলে গেলো। আর এদিকে সামির আবিরের দিকে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “মিথ্যে বাদীর পাহাড় একটা, হুঁ।” 😏 😏

বলেই মুখ ঘুরিয়ে সামিরাও হনহন করে চলে গেলো।

________________

মায়া ধীরে ধীরে বেড থেকে নামল। স্যালাইন খুলে ফেলার পরও শরীরে এখনো ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সামিরা ইতিমধ্যেই ওর কালরাতের পোশাক একটি ব্যাগে গুছিয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ডিসচার্জের সমস্ত ফর্মালিটিও শেষ হয়ে গেছে।

মায়া প্রথম পা বাড়াতেই হঠাৎ যেন চারদিক ঘুরে উঠল তার। শরীরটা দুলে উঠতেই, নিজেকে সামলে নিলো বেডের ধরে। সামিরা এক ঝটকায় এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।

“কি হলো আপু? আবার শরীর খারাপ করছে?” — উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল সামিরা।

মায়া ম্লান হাসির চেষ্টা করে বলল, “না, ঠিক আছি। শুধু একটু মাথাটা ঘুরে গেলো…”

সামিরা ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি পারবে? বাইরে গাড়ি পর্যন্ত…”

কথাটা শেষ করতে পারল না সে। ঠিক তখনই হনহন করে কোথা থেকে যেন আরমান এসে হাজির। এক মুহূর্তও দেরি না করে মায়াকে তুলে নিলো কোলে। তারপর কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে।

সামিরা বিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন হজম করতে পারছিল না। তারপর হঠাৎ দৌড়ে ছুটে চলল ওদের পেছন পেছন।

ওদিকে আরমান বাইরে থেকে দেখছিল কেবিনের দরজার দিয়ে মায়ার প্রতিটি নড়াচড়া। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে দেখেই, আর এক মুহূর্তও ভাবেনি সে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে মায়াকে।

মায়া প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখল অনেকে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ আবার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। হালকা ঘেমে যাওয়া কপাল নিয়ে মায়া নিচু স্বরে বলল, “আপনি কি করছেন? নামিয়ে দিন আমাকে… আমি নিজেই যেতে পারব।”

আরমান গম্ভীর গলায়, ওর দিকে না তাকিয়েই দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই জবাব দিল, “হ্যাঁ, কেমন পারবে সেটা তো দেখলাম। আর তোমার জন্য সারাদিন হাসপাতালে বসে থাকার সময় আমার নেই।”

মায়া রাগে ঠোঁট কামড়ে বলল, “কে আপনাকে বলেছে আমার জন্য হাসপাতালে আসতে?”

এরই মধ্যে ওরা গাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে। গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আবির বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, মুখের অভিব্যক্তি যেন সিনেমার দৃশ্য দেখছে এমন।

আরমান বিরক্ত মুখে বলল, “ওভাবে তাকিয়ে না থেকে দরজাটা খুলে দে।”

আবির যেন হুঁশ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে দিল। আরমান মায়াকে গাড়ির ভেতরে সিটে গিয়ে সতর্কভাবে বসিয়ে দিল। মায়া কিছু না বলেই একপাশে চোখ ফিরিয়ে নিল। সামিরাও ততক্ষণে এসে পাশে বসে পড়েছে।

ঠিক তখনই আরমানের বাবা, আনোয়ার সাহেব এসে পৌঁছালেন। হাতে একটা ছোট ব্যাগ—মায়ার বাকি ওষুধ গুলো এনে দিয়েছেন, সঙ্গে শেষবার ডাক্তারের সঙ্গেও কথা বলে নিয়েছেন।

আরমান ওনার দিকে তাকিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বলল, “তোমরা যাও ড্যাড, আমি আসছি।”

আবির এতক্ষণে নিজের অবাক ভাব কাটিয়ে উঠে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। আনোয়ার সাহেব পাশে উঠে বসলেন, সাই জানিয়ে। তারপর গাড়ি ছুটে চলল শাহরিয়ার ম্যানশনের দিকে, হাসপাতালের রেখে গেল কিছু না বলা প্রশ্ন, কিছু অপূর্ণ অনুভূতি।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

শাহরিয়ার ম্যানশনের প্রশস্ত ড্রয়িংরুমে তখন সবার উপস্থিতি। মায়া এক কোণার সোফায় বসে আছে। তার পাশে বসে আছেন আনজুমা বেগম। স্নেহময় হাতে এক এক করে মায়ার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন তিনি। যেন নিজের মেয়েকেই যত্ন করছেন। মায়াকে এখন একা রুমে থাকতে দিচ্ছে না কেউ। সবাই জানে—এই মুহূর্তে একাকীত্বই সবচেয়ে বড়ো বিষ। বাবার শূন্যতা আর স্মৃতির ভারে ভেঙে পড়তে পারে ও যে কোনো সময়।

তাই সবাই মিলে একসাথে ড্রয়িংরুমে। ঠিক তখনই, হঠাৎ করেই বেজে উঠল কলিং বেলের শব্দ।

ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল এক মুহূর্তে। দরজার দিকে এগিয়ে গেল এই বাড়ির এক মেড। সামান্য সময় পরেই দরজা খুলে দিল সে।

প্রবেশ করলেন মিসেস সাবিনা বেগম। পরিপাটি সাজ, কিন্তু মুখে অভিব্যক্তি কঠিন পড়তে। তাঁর দুপাশে দুজন মানুষ। একজনকে তো তিনি সম্পূর্ণ জড়িয়ে ধরে রেখেছেন—যেন বহুদিন পর ফিরে পাওয়া কাছের কিছু।

ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সবাই চমকে তাকালেন দরজার দিকে। মিসেস সাবিনার সঙ্গে থাকা সেই দুই ব্যক্তি যেন চেনা নয়, আবার একেবারে অচেনাও নয়। তাদের আগমনে ঘরের পরিবেশে নেমে এলো একরাশ জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়।

চলবে……

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_30
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সবাই চমকে তাকালেন দরজার দিকে। মিসেস সাবিনার সঙ্গে থাকা সেই দুই ব্যক্তি যেন চেনা নয়, আবার একেবারে অচেনাও নয়। তাদের আগমনে ঘরের পরিবেশে নেমে এলো একরাশ জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়।

নিঃশব্দ ঘরে তখন একমাত্র কণ্ঠস্বর মিসেস সাবিনা বেগমের—
তিনি কোমল অথচ দৃঢ় গলায় সেই অল্পবয়সী মেয়েটিকে পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
“হয়তো তোমরা অনেকেই ওকে আগেই চিনো। তবে আজ থেকে ওর আরেকটি নতুন পরিচয় হলো—এই বাড়ির হবু বউ। আমার ছেলে আরমান শাহরিয়ারের হবু স্ত্রী, মাইশা তালুকদার। আমার আরমানের সেই ভালোবাসা… যার জন্য আজও সে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারেনি। বছরের পর বছর যে মেয়েটিকে ও খুঁজে ফিরেছে উন্মাদের মতো—এই সেই মেয়ে…মাইশা তালুকদার।”

ঘরের এক কোণে থমকে গেল মুহূর্তটা। উপস্থিত সবার মুখেই বিস্ময়ের ছায়া। এ বাড়ির সকলেই জানে ‘মাইশা’ নামটা। জানে, এটাই সেই নাম যার টানে একসময় আরমান বিয়েতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল। জানে, এই নামেই পেছনে ফেলেছিল সংসার, ডিভোর্স দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল মায়াকে।

সামিরা প্রথম নীরবতা ভাঙল, কণ্ঠে স্পষ্ট অবাক ভাব, “মম…এই মাইশাই সেই মাইশা? যার জন্য ভাইয়া মায়া ভাব…মানে মায়া আপুকে ডিভোর্স দিয়েছিলো?”

সাবিনা বেগম মায়া-মায়া চোখে তাকিয়ে মেয়েটির গালে স্নেহভরে হাত বুলিয়ে বললেন,
“এই সেই মাইশা… যে আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছিল আজ থেকে দশ বছর আগে। আর এই মেয়েটার জন্যই ডিভোর্স দিয়েছিল মায়াকে।”

মায়া যেন হঠাৎ জমে গেল। শরীর ঠান্ডা হয়ে এল, মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল হাজার প্রশ্ন। ওর চাচাতো বোন মাইশার জন্য ওকে ডিভোর্স দিয়েছে আরমান? আরমান, মাইশাকে ভালোবাসে? তাহলে বিয়েটা করল না কেন তখন? ও তো শুনেছিল, তাদের বিয়ে নাকি জোর করে করানো হয়েছিল আরমানের দাদুর ইচ্ছায়।

তবে কি এই বাড়ির সবাই শুরু থেকেই জানত ‘মাইশা’ কে? তাহলে মায়ার সঙ্গে সেই বিয়েটা কেন দিলো?

সবকিছুই যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে মায়ার। চিন্তা করতে গিয়েও মাথাটা আর সাড়া দিচ্ছে না ঠিক করে…

হঠাৎ সামিরার চোখ পড়লো সদর দরজার দিকে। সেখানে একা, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে আরমান। ওর চেহারায় এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য, চোখেমুখে অনির্বচনীয় এক দ্বিধা। যেন কিছু বোঝা যাচ্ছে, আবার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাইশাকে সামনে দেখে ওর মুখে যে প্রকাশ ফুটে উঠেছে, সেটাকে কি খুশি বলা যায়? নাকি বিস্ময়? কেউই নিশ্চিত হতে পারলো না।

সামিরা দরজার দিকে ইঙ্গিত করে হঠাৎ বলে উঠলো, “ওই তো ভাইয়াও চলে এসেছে।”

ওর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস থাকলেও ঘরের পরিবেশ এক মুহূর্তে থমকে গেল। উপস্থিত সবার দৃষ্টি চলে গেলো দরজার দিকে। মিসেস সাবিনা বেগম তখনই এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। কাছে গিয়ে আদরের পরশে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “কি হলো আব্বু? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো, ভেতরে এসো। আমি কিন্তু তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ এনেছি, সেটা নিশ্চয় বুঝে গেছো? আর হ্যাঁ, কালকের মিটিংটা কেমন হলো? হোটেলটা তো অনেক দূরে ছিল, তাই না? সারারাতই তো সেখানে কাটাতে হয়েছে তোমায়।”

মিসেস সাবিনা বেগমের মুখে ‘মিটিং’ আর ‘হোটেলে রাত কাটানো’ কথাগুলো শুনে যেন বাতাস থমকে দাঁড়াল। চারপাশটা এক নিমিষে ভারি হয়ে উঠলো। কারণ সবাই জানে—গতকাল রাতটা আরমান হাসপাতালেই ছিল, মায়ার পাশে। ও যে মাকে মিথ্যে কথা বলেছে, এটা বিশ্বাস করা কারো পক্ষেই সহজ নয়। কারণ মায়ের কাছে ও কখনো মিথ্যে বলেনি। আর এই অসংগতিতেই জন্ম নিল বিস্ময়।

সামিরা কিছু না বুঝেই মুখ খুলতে গিয়েছিল, “কিন্তু ভাইয়া তো কাল সারারাত হাস…..”

বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই আবির ঝট করে ছুটে এসে ওর মুখ চেপে ধরলো হাত দিয়ে। সামিরা বিস্ময়ে উম! উম! আওয়াজ করতে লাগল, নিজের মুখ ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও পারল না।

আবির ফিসফিস করে বলল,
“কোথায় কি বলতে হয় এখনো শেখোনি শামুকের বাচ্চা শামুক? মুখটা বন্ধ রাখ, না হলে বাড়িতেই শুরু হয়ে যাবে মহাযুদ্ধ।”

সাবিনা বেগম এবার ঘুরে তাকালেন ওদের দিকে। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে আবির? এভাবে মুখ চেপে ধরলে কেন ওর? কী যেন বলতে চাইছিল সামিরা?”

আবির সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত সরিয়ে নিল আর মুখে ঝটপট একটা বোকা বোকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এমনি আসলে আমার মনে হলো ওর কথার মাঝে হঠাৎ করে হাঁচি পেয়েছে, তো আমি ভেবেছিলাম কাশবে, তাই একটু… মানে…”

সামিরা তখনো ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। নিজের অজান্তেই কী বলার চেষ্টা করছিল—তা ভেবেই নিজের উপর বিরক্তি জন্মালো ওর। বোকা বোকা একটা হাসি মুখে এনে বলল,
“গুরুত্বপূর্ণ কিছু না মম।”

কথা শেষ করে সামিরা আস্তে করে একবার চোখ তুলে তাকালো আরমানের দিকে। ওর দৃষ্টি পড়লো ভাইয়ের চোখে—তীক্ষ্ণ, জ্বলন্ত। সেই চোখে যেন আগুন লুকিয়ে আছে। সামিরার বুক কেঁপে উঠলো, নিঃশব্দে একটা শুকনো ঢোঁক গিলে নিল।

তারপর কোনো কথা না বলে ধীর পায়ে মায়ার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। একদম গা ঘেঁষে। যেন আশ্রয় নিতে চাইছে মায়ার কাছে।

আনজুমা বেগম তাড়াতাড়ি উঠে এসে সাবিনা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললেন,
“আরে ভাবী, তুমি তো ওদের দুষ্টামির কথায় এত মন দিয়েছো যে খেয়ালই করছো না—তোমার মেহমানেরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে! ওদের তো বসতে বলবে।”

সাবিনা বেগম যেন হঠাৎই বাস্তবে ফিরে এলেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে হালকা ভঙ্গিতে বললেন,
“আরে দেখো কাণ্ড! আমিও না একেবারে ভুলেই গেছি। এই বয়সে মনটাই যেন গুবলেট হয়ে গেছে! চলুন বেয়াইন সাহেবা, আসুন আসুন বসুন। আর মাইশা বেটা, তুমিও এসো মা। সেই কখন থেকে তোমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি, বুঝতেই পারিনি।”

বলতে বলতে উনি নিজেই এগিয়ে গিয়ে মুনজিলা বেগম আর মাইশাকে হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসালেন। কিন্তু বসার মুহূর্তেই মুনজিলা বেগম ও মাইশার চোখে মুখে পড়ে গেল এক অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। কিছুক্ষণ আগে যেটুকু শুনেছেন, তার মানে বুঝে উঠতে পারছিলেন না—”আরমান মায়াকে ডিভোর্স দিয়েছে!” কথাটা যেন এক ধাক্কায় চেপে বসেছে তাঁদের কানে।

মুনজিলা বেগম অবাক কণ্ঠে সাবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ভাবী, একটা কথা ঠিক বুঝলাম না… আরমান বেটা মায়াকে ডিভোর্স দিয়েছে মানে?”

সাবিনা বেগম হালকা গলা নামিয়ে, যেন অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
“আসলে কী বলো বেয়াইন, আমার শ্বশুর মশাই বেঁচে থাকতে জোর করেই আরমানের সঙ্গে মায়ার বিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বিয়েতে আরমানের একদমই মত ছিল না। বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করেও রাজি করিয়েছিলেন উনি। আর যেই না উনি মারা গেলেন, আমার আরমান সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স দিয়ে দেয় মায়াকে। তবে চিন্তার কিছু নেই—ওদের বিয়ে হলেও একদিনের জন্যও সংসার করেনি তারা। আমার ছেলেটা ওই মেয়েকে এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে পর্যন্ত দেয়নি। বিয়ের পর থেকেই মায়া ছিল ওর বাপের বাড়িতেই। আর আমার আরমান ডিভোর্স দিয়েছে কেবলমাত্র মাইশা বেটার জন্যই। শুধু অপেক্ষা করছিল মাইশাকে খুঁজে পাওয়ার।”

সব কথা বলার পরও মিসেস সাবিনা বেগমের মুখে ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরা এক আশ্বাসময় হাসি। কিন্তু তার প্রতিটি উচ্চারণ যেন বিষের মতো বিঁধে গেল মায়ার বুকে। সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকা মায়ার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা পানি— ওর নিজের অজান্তেই।‌ ও বুঝলো না কেন এত ব্যথা হচ্ছে, কেন বুকটা এত ভার হয়ে উঠলো। কিন্তু মিসেস সাবিনা বেগমের কথাগুলো যেন কোনো এক দগ্ধ ইতিহাসের গায়ে লবণ ছিটিয়ে দিল।

অন্যদিকে, মাইশা ও মুনজিলা বেগম হতবাক হয়ে শুনছিলেন সবটা। এত কিছু ঘটে গেছে, অথচ তারা কিছুই জানতেন না! তবু আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই অবাক লাগার মাঝেও মুনজিলা বেগমের মুখে যেন এক পরোক্ষ তৃপ্তির আভা খেলে গেল। কারণ যা কিছু ঘটুক না কেন, পরিস্থিতি এখন ওদের পক্ষে। মায়ার মতো একটা অতীত লুকোনো সম্পর্কের মেয়ের জায়গা সরিয়ে দিয়ে যদি নিজের মেয়েকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায়—তবে সে সুযোগ হাতছাড়া করার মতো মানুষ তিনি নন।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আরমান তাকিয়ে ছিল মায়ার দিকেই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কারোর চোখে না পড়লেও ওর চোখে ঠিকই পড়লো, মায়ার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দুই ফোঁটা পানি।‌ আর এটাই কেন জানি সহ্য হলো না ওর।‌ ভীষণ বিরক্ত লাগলো নিজের প্রতি, আবার ওর মায়ের প্রতিও। সবকিছু এখন এলোমেলো লাগছে ওর কাছে। ও তো চাইনি, মাইশাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসতে। মাইশাকে এই বাড়িতে দেখে ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর, কিন্তু কেন সেটা হচ্ছে বুঝতে পারছে না ও। ঠিক এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল।‌ ও মাইশাকে খুঁজে পেলে নিয়ে আসবে এই বাড়িতে। তারপর বউ করে নিজের ঘরে তুলবে। কিন্তু কেন সব কিছু এলোমেলো লাগছে ওর? হ্যাঁ ও ভালোবাসে পিচ্চি মায়াবতীকে। এখনো ভালোবাসে ও।‌ তবে মাইশাকে দেখে সেই অনুভূতি কেন আসছে না ওর? কেনো মনে হচ্ছে মাইশা সেই মেয়ে নয়, যার জন্য এই অনুভূতি?

মিসেস সাবিনা বেগম— “আর একটা কথা, মাইশাকে আমাদের আরমানই খুঁজে বের করেছে।‌ কিন্তু ও হয়তো লজ্জায় আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। আমি বুঝি আমার ছেলেকে। আর তাই মাইশাকে ডাইরেক্ট এই বাড়িতে নিয়ে এসেছি আমার ছেলের জন্য।”

এই কথার প্রতিউত্তরে কেউ কিছু বলল না।‌ শুধু আরমান শান্ত গলায় বলল, “মম আমি রুমে গেলাম। রুবির কে ঠান্ডা পানি দিয়ে যেতে বলো এক গ্লাস।”

আর দাঁড়ালো না আরমান, গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে গেলো। সবাই কিছুটা অবাক হলো আরমানের কোনো রিয়্যাকশন না দেখে। আরমানতো মাইশাকে না দেখেই ভালোবেসে এসেছে এতোদিন। কিন্তু কই তার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না। সবসময় যেমন থাকে তেমনই স্বাভাবিক। মিসেস সাবিনা বেগম কিছুটা হেসে মুনজিলা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “কিছু মনে করবেন না বেয়ান। আমার ছেলেটা এমনই। সবসময় গম্ভীর থাকে। এটাই ওর স্বভাব। মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারে না।”

মুনজিলা বেগম— “হ্যাঁ বেয়ান! বুঝতে পেরেছি। আরমান বেটা হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। মাইশা তুই যা আরমান বেটাকে পানি দিয়ে আই। ঠান্ডা পানি চাইলো তো। এই বাড়ির বউ হবি তুই। তাই এখন থেকে দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে তোকে।”

সাবিনা বেগম— “হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছেন। যাও মাইশা বেটা, আরমানকে পানি দিয়ে আসো এক গ্লাস আর এই ফাঁকে দুজনের কথা বলাও হয়ে যাবে।”

এরপর সাবিনা বেগম রুবিকে বলে দিলো এক গ্লাস পানি দিয়ে মাইশাকে আরমানের রুমটা দেখিয়ে দিতে। রুবি একবার বলল, “কিন্তু ম্যাম স্যার যদি রেগে যাই‌। উনি পছন্দ করে না উনার কোনো কাজ অন্য কেউ করুক।”

সাবিনা বেগম— “আরে রুবি কি সব বলছো? মাইশা আর অন্য কেউ এক হলো নাকি? মাইশা হচ্ছে আরমানের হবু বৌ। তাই চিন্তা করো না, আরমান রাগ করবে না বরং খুশি হবে।”

এরপর উনি মাইশার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাও মাইশা বেটা। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাও। কোনো ভয় নেই।”

মাইশা হালকা হেসে জবাব দিলো— “ওকে আন্টি।”

মিসেস সাবিনা বেগম মৃদু রাগ দেখিয়ে বললেন, “এই মেয়ে! কে তোমার আন্টি হ্যাঁ? মম বলবে মম। ঠিক আছে?”

মাইশা মুচকি হেসে জবাব দিলো— “আচ্ছা ঠিক মম।”

মায়ার পাশে বসে থাকা সামিরা মুখ বেঁকিয়ে মাইশাকে নকল করে বিরবির করে বলে উঠলো, “আত্তা ঠিকাতে মম! হুঁ 😏 😏 ঢং দেখলে বাঁচি না।”

সামিরার কথা শুনে আবির ফিক করে হেসে দিলো। ও ওদের কাছাকাছিই বসে ছিল তাই শুনেছে সামিরার কথা। আর মায়াও হাসলো কিছুটা, কিন্তু সেই হাসিতে নেই কোনো প্রাণ। কেমন যেনো মরা মরা লাগলো সেই হাসি।‌

সামিরা মায়া এবং আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মায়া আপু আবির ভাইয়া চলো আমার রুমে চলো। আড্ডা দেবো।”

আবির— “নারে শামুক সময় নেই আমার। এরপর আবার অফিসে যেতে হবে। তোর জল্লাদ ভাইয়া ছাড় দেবে না।”

সামিরা— “ভাইয়া তুমি আবার শামুক বলছো? যাও আমি তোমার সাথে আর কথায় বলবো না। চলো তো আপু আমরা যাই।”

বলেই সামিরা টেনে নিয়ে গেলো মায়াকে উপড়ে নিজের রুমের দিকে।

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

আরমান একবারে গোসল করে বেরোলো ওয়াশরুম থেকে। আর বেরোতেই দেখতে পেলো অচেনা মানুষের উপস্থিতি। সত্যিই কি অচেনা? নিজের মনকেই প্রশ্ন করলো আরমান।

এদিকে মাইশা ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে ঘুরে তাকালো আরমানের দিকে। আর তাকাতেই নির্লজ্জের মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। আরমানের কোমড়ে শুধু একটা টাওয়েল পেঁচানো। আর কোনো বস্ত্র নেই শরীরে।

আরমানের ভীষণ রাগ হলো, এভাবে মেয়েটা হুট করে রুমে এসে বসে থাকাই। ও গটগট পায়ে এগিয়ে গিয়ে, খাটের উপর রেখে যাওয়া জামা প্যান্ট তুলে নিয়ে আবারও গটগট পায়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। তারপর জোড়ে আওয়াজ করে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।

আর এই শব্দে কেঁপে উঠলো মাইশা, সহ বাইরে দরজার কাছে থেকে উঁকি দেওয়া সামিরাও। আরমানের রুমের দরজার কাছ থেকে কিছুটা দূরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। আর ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখে দরজা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সামিরা। মায়া সামিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সামিরা, এই ভাবে কারোর ঘরে উঁকি দিয়ে তাদের পার্সোনাল কথা শোনা ঠিক না।”

সামিরা ফিসফিস করে বলল, “আরে আপু কিছু হবে না। দেখতে দাও কি চলে ভেতরে।”

মায়া— “আচ্ছা, তাহলে তুমি দেখো। কিন্তু আমাকে যেতে দাও। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”

সামিরা আবারও ফিসফিসিয়ে বললো, “আরে কেউ খারাপ ভাববে না। আর এই সব কাজে একা একা মজা পাওয়া যাই না। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।”

মায়ার নিজেকে ভীষন অসহায় ফিল হলো। যদি কেউ এই অবস্থায় ওদেরকে দেখে তাহলে বিষয়টা যে কতটা খারাপ দেখায় সেটা এই মেয়ে বুঝতে চাইছে না। এমনিতেও ওর মনটা ভালো নেই। কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে যেনো। এখনো মাইশা এবং আরমানের বিষয়টা ক্লিয়ার নয় ওর কাছে। আবার এটা ভেবেও কষ্ট হচ্ছে যে, ওর চাচী বা মাইশা আপু একবারও এখনো পর্যন্ত ওকে জিজ্ঞাসা করলো না যে ও কেমন আছে।

মায়ার ঘোর কাটলো আরমানের গম্ভীর আওয়াজে। যা রুমের দরজা খোলা থাকার জন্য স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বাইরে থেকে।

আরমান— “কারোর রুমে ঢোকার আগে যে নক করতে হয় সেটা জান নেই?”

আরমানের গম্ভীর গলার আওয়াজে মাইশা ওর মাথা নিচু করে নিলো। তারপর মিনমিন করে বলল, “আমি নক করেছিলাম। আপনি ওয়াশরুমে থাকায় হয়তো শুনতে পাননি।”

আরমান আবারও গম্ভীর গলাতেই বলল, “তার জন্য সাড়া না পেলেই এইভাবে পারমিশন ছাড়াই রুমে ঢুকে যাবেন?”

মাইশা এবার মুখ তুলে তাকালো আরমানের দিকে— “আরে আপনি রাগ করছেন কেন? আপনাকে ওই অবস্থায় দেখে ফেললাম বলে? এতে রাগ করার কি আছে? আর আমি আপনার জন্য ঠান্ডা পানি এনেছিলাম।

আরমান শান্ত গলায় বলল, “আমি কি একবারও আপনাকে বলেছিলাম আমার জন্য পানি আনতে? আর আমার রুমে আমার পারমিশন ছাড়া কেউ প্রবেশ করুক এটা আমার পছন্দ না। আর আমি চাইনা আমার কাজ অন্য কেউ করুক। তাই দ্বিতীয় বার আর এসব করার চেষ্টা করবেন না। এখন যান এখান থেকে।”

মাইশা— “আপনি আমায় এইভাবে অপমান করছেন কেন? আমি তো কিছুদিন পরেই আপনার বৌ হবো।

আরমান— “বৌ হবেন কিন্তু হননি তো। আরো কেই বা গ্যারান্টি দিলো যে আপনি আমার বৌ হবেন?”

মাইশা— “আপনি আমার সাথে এইভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি না আমায় ভালোবাসেন অনেক বছর আগে থেকে?”

আরমান— “ হ্যাঁ ভালোবাসি! ভালোবাসি সেই ছোট্ট মেয়েটাকে, যেই মেয়েটা আমকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল…আর যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে চিনে নিতে চোখের দরকার হয় না, হৃদয়ের কম্পনে চেনা যায় তাকে। তুমি মাইশা, আমি মানি…কিন্তু আমার হৃদয় যে ‘মায়াবতী’কে চায়, যার কোনো প্রতিচ্ছবি তোমাতে পাই না।
তাই তো, তুমি মাইশা হয়েও আমার পিচ্চি মায়াবতী না…।”

চলবে….