আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব-৪৫+৪৬

0
11

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_45
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫 কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

উনার কথায় মায়ার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলো মায়া….

“বাগানে যেই ঘরটা আছে, মানে ওই যে ছাদ আছে, কিন্তু চারিপাশ ফাঁকা। আর কি জেনো রাখা আছে ওগুলো…”

মায়া আর মনে করতে পারছে না ওগুলোকে কি বলে। সামিরা ঝট করে বলল, “সোফা, চেয়ার টেবিল রাখা আছে ওখানে।”

মায়া— “হ্যাঁ ওগুলো ওখান থেকে সরিয়ে আমার ঘরে যে খাট টা আছে ওটা ওখানে রেখে দেবে। আমি আজ থেকে ওখানেই থাকতে চাই। এটাই হচ্ছে আমার সব থেকে বড়ো ইচ্ছা।”

মায়ার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। আর আসিফ, সে যেনো আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে বাইরে বলল এক আর এখন সবার সামনে বলছে আর এক।

সাবিনা বেগম— “কিন্তু মায়া মামনি ওখানে তো সব সময় থাক যাই না। বৃষ্টি পড়লে তো ছাঁট আসবে ভিজে যাবে, আবার দিনের বেলা সূর্যের তাপ লাগবে, গরম করবে।”

মায়া জেদি গলায় বলল, “না আম্মু, আমি অতো কিছু বুঝি না। আমি আজ থেকে ওখানেই থাকবো। ওই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

আসিফ মায়াকে বোঝানোর মতো করে বলল, “কিন্তু মায়া, তুমি বাড়ির সবাইকে অন্য কিছু বলতে চাইছিলে। এটা তো নয়।‌ তোমার তো আরো একটা ইচ্ছা আছে বলছিলে, সেটা বলো।”

মায়া আসিফের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল, “অন্য কিছু? কি সেটা? এটাই তো আমার বড়ো ইচ্ছা, আমি ওই বাগানের ঘরটাতে থাকতে চাই।”

আসিফ মায়াকে মনে করানোর চেষ্টা করে বলল, “আরে এটা না। তুমি তখন আমাকে দোলনায় বসে যেটা বললে, ওটার জন্য বাড়ির সবাইকে রাজি করাবে বললে। ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি?”

আসিফ শেষের কথাটা কিছুটা অসহায় গলায় বলল। মায়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “দোলনায় বসে কি বললাম? আমি তো বসে বসে বাগানের ঘরটাতে থাকার কথা ভাবছিলাম। আপনাকে তো কিছু বলিনি।”

মায়ার কথায় আসিফ বোকা বনে গেলো যেনো। নির্বাক হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে যেন একরাশ বিস্ময়, আর মনের গভীরে এক তীব্র হতাশা। এমনটা হবে, ভাবেনি ও। যেন মুহূর্তেই ওর সমস্ত হিসেবনিকেশ গিয়ে ঠেকেছে শূন্যে। আসিফ মায়ার দিকে অসহায় চোখে তাকালো—কিন্তু মায়া সেদিকে কোনো পাত্তা দিলো না।

আসিফের মনে হচ্ছিল, যেন নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলে। মায়াকে নয়, বরং নিজেকেই ওর এখন পাগল মনে হচ্ছে।

ও জানে, মায়ার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে প্রতারণা করে ওর সাথেই—কিছু কিছু কথা, কিছু মুহূর্ত, অল্প কিছু সময় পরেই মুছে যায় যেন ধোঁয়ার মতো। আজ যা বলেছে, কাল তা হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে। কিছু কিছু স্মৃতি আটকে রাখে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই ওর ব্রেন যেন এক খরস্রোতা নদী—ধরা যায় না কিছুই।

এই অসহায় পরিস্থিতির সুযোগটাই তো নিতে চেয়েছিল আসিফ। মায়া যখন বিয়েতে রাজি হলো, তখন সে ভেবেছিল বাকিটুকু পথ সহজ হবে। পরিবারকে সে চাপে ফেলবে— মায়ার এখন যা অবস্থা তাতে মায়া এখন যা চাই ওকে তাই দিতে হবে না হলে ওর ব্রেনে উল্টো প্রভাব পড়বে। ভেবেছিল, একবার যদি মায়া নিজের জেদে বলত, “আমি বিয়ে করবো”, তবে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেত না।

কিন্তু এখন? এখন মায়া যেন সব ভুলে বসে আছে! মুহূর্তে সব কিছু গিলে ফেলেছে ওর মস্তিষ্কের অদৃশ্য অরণ্য। আসিফ কিছুতেই ভাবতে পারেনি এতো দ্রুত এমন একটা রূপ নিতে পারে পরিস্থিতি।

তার ঠান্ডা অবহেলা, স্মৃতির ছেঁড়াখোঁড়া ধরণ, আর সেই নিষ্পাপ দৃষ্টি—সব মিলে আসিফের সমস্ত কৌশল এক মুহূর্তেই মাটি করে দিয়েছে।

———-

“কি ব্যাপার, দেশের বিখ্যাত বিজনেস ম্যান আজ আমার দুয়ারে? তাও আবার এই অবস্থায়?”

কিছুটা তাচ্ছিল্য করে কথাগুলো বলল আসিফ।‌ আরমান নিজের হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে একাই আসিফের রুমে প্রবেশ করছে। আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “ভুল জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিস তুই আসিফ। ভালো হবে সময় থাকতে সরে যা, না হলে এই আরমান শাহরিয়ার এর কলিজায় হাত দেওয়ার ফল ভালো হবে না।”

আসিফ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “তোর কলিজা? ভাই, ওটা তো এখন একটা খালি ডায়েরি—যার পাতা আছে, গল্প নেই। তুই বোধহয় এখনও সেই পুরনো গল্প গুলো খুঁজে চলেছিস। এখন ভয় পাচ্ছিস নাকি, যে সেই খালি ডায়রির সাদা পাতা গুলোই যদি অন্য গল্প বসে যায়?”

আরমান ঠাণ্ডা গলায় আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “খালি ডায়েরির পাতা যে নতুন গল্প লিখতে দেয়, সেটা ঠিক। কিন্তু কিছু গল্প থাকে—যা একবার লেখা হয়ে গেলে মুছে ফেলা যায় না। হয়তো মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা সম্ভব কিন্তু হৃদয় থেকে নয়। তুই হয়তো সেই খালি পাতায় জোড় করে ঢুকতে চাইছিস, কিন্তু ভুলে যাস না—এই পাতাগুলো খালি হবার আগেও সেখানে আমার গল্পই লেখা ছিল। হ্যাঁ আমারই একটু অসাবধানতায় কেউ হয়তো মুছে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেই পুরনো গল্প। কিন্তু এবার আমি সেই গল্প আবারও লিখবো—নিজের কলমে, নিজের কালী দিয়ে, নতুন ভাবে। আর সেই পাতায় কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেবো না।”

আসিফ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, দেখা যাক—সেই সাদা পাতায় শেষ পর্যন্ত কার গল্প বসে যায়।”

_.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._.._..

কেটে গেছে প্রায় দু’মাস। আরমান এখন শারীরিকভাবে একেবারে সুস্থ। ফিরে এসেছে সেই আগের রুপে। কিন্তু বাইরের সেই নির্ভরতার মুখোশের নিচে—একটা ভেঙে পড়া হৃদয় নিঃশব্দে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। আরমান ভেঙে গেছে ভিতর থেকে, মায়ার অবহেলা, মায়ার নির্লিপ্ত আচরণে।

অন্যদিকে, মায়াও ফিরে এসেছে। তবে সেই আগের মায়া নয় সে—নতুন এক রূপে, যেন অনিশ্চিত এক ঝড়ের মতো। চোখেমুখে এখন আগুনের ছায়া, কথায় কথায় জেদ, আচরণে তীব্র রাগের আঁচ। ছোট ছোট বিষয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলে, আবার এক মুহূর্তেই সেই রাগের ভেতর থেকে চোখ টপটপ করে ঝরে পড়ে অশ্রু। যেন ভিতরে জমে থাকা হাজার প্রশ্ন, হাজার অস্পষ্টতা তাকে গ্রাস করে চলেছে প্রতিদিন।

তবে চিকিৎসকের সুশৃঙ্খল থেরাপি, আরমানের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর অক্লান্ত যত্নে মায়া এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এখন আর স্মৃতির পাতাগুলো সাদা পড়ে থাকে না। নতুন করে যা ঘটে, তা ধরে রাখতে পারে ওর মস্তিষ্ক। তবে হারানো অতীত—সেই অধ্যায়টা রয়ে গেছে এক অদৃশ্য কুয়াশায় ঢেকে।

মায়ার নিয়মিত ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে, যিনি ওর আবেগ আর মানসিক ওঠাপড়া বুঝতে চেষ্টা করেন। আর একজন শিক্ষিকা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন ওর ভাঙা জ্ঞানভাণ্ডার। মায়া—সে এখন ঠিকই বোঝে চারপাশের সবকিছু। আর এই বোঝার মাঝেই, ওর ভিতরে জন্ম নিচ্ছে এক তীব্র প্রশ্ন—কে সে? কেনই বা তার জীবনের এত বড়ো একটি অংশ ধোঁয়ায় ঢাকা? এই উত্তরহীনতা ওকে অস্থির করে তোলে, নিজের কাছেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে ফেলে প্রতিদিন।

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই প্রশ্ন গুলো উত্তর ও খুঁজে পাই না। সামিরা, রুবি এই বাড়ির সকলের কাছে জানার চেষ্টা করেছে নিজের সম্পর্কে, কিন্তু স্পষ্ট কোনো উত্তর ও পাইনি।

মায়া আর আরমানের সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক হয়নি। মায়াকে আরমান নিজের সাথে সহজ হওয়ার সুযোগ টাই দেয়নি। আরমানের কাছেও বহুবার করেছে নিজের মনের প্রশ্ন গুলো, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।

এখন ডক্টর বারণ করেছে, হঠাৎ ওর আগের জীবনের ঘটনা গুলো বলতে, এতটা চাপ মায়ার ব্রেন নিতে পারবে না। তাই সবাই অসহায় হয়ে পালিয়ে বেড়ায় মায়ার প্রশ্ন গুলো থেকে।

এই দুই মাসে মায়াকে খাবার খাইয়ে দেওয়া, ওষুধ খাইয়ে দেওয়া সবটাই নিজ হাতে করেছে আরমান। আর আরমানের হাতে খাবার খাওয়া টা মায়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আরমান আসে চুপচাপ মায়াকে খাবার খাইয়ে দিয়ে চলে যায়।

———

মায়া ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ কষে চলেছে, কিন্তু সেই হিসাব মিলেও যেনো মিলছে না।

“ম্যাম! স্যার অপেক্ষা করছে রুমে, উনি আপনাকে খাইয়ে আবার অফিস যাবেন।”

রুবির ডাকে মায়া ঘুরে তাকালো। বিরক্ত গলায় বলল, “রুবি তোমায় কত বার বলেছি আমাকে ম্যাম বলবে না। ভালো লাগে না শুনতে।”

রুবি:- “অভ্যাস হয়ে গেছে ম্যাম।”

মায়া:- “আবার?”

বিরক্ত হয়ে মায়া চলে গেলো। রুবি মনে মনে বলল, “সামান্য একজন কর্মচারী হয়ে এই বাড়ির বড়ো বউকে নাম ধরে কি করে ডাকবো ম্যাম? আপনি ভুলে গেলেও আপনার পরিচয় টা তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না।”

মনে মনে কথা গুলো ভেবে রুবি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

আর মায়া রুমে এসে দেখলো, আরমান সোফায় বসে আছে গম্ভীর মুখে, ফোনে কিছু কাজ করছে হয়তো। পরনে এখনো অফিসের ড্রেস আপ।

দুপুর তিনটে বাজতে চলল, মায়াকে দুপুরের খাবার ঘরে দিয়ে গেলেও ও খাইনি। মিসেস সাবিনা বেগমও অনেক জোড় করেও খাওয়াতে পারেনি মায়াকে। বলেছে এখন খিদে নেই, কিন্তু আসল কারণ তো অন্য কিছু।

প্রতিদিন আরমান লাঞ্চ টাইমে বাড়ি আসে, মায়াকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে আবারও অফিসে যাই। এটাই এখন ওদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ একটু কাজের চাপ থাকায় বাড়ি আসতে পারেনি আরমান, তাই রুবিকে বলেছিল মায়াকে খাইয়ে দিতো। কিন্তু মায়া খাইনি, সেই খবর পেয়ে নিজের কাজ ফেলে এখন ছুটে এসেছে ওকে খাওয়াতে।

মায়া চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় গিয়ে বসলো আরমানের পাশে, তবে দূরত্ব বজায় রেখে। আরমান মায়াকে নিজের পাশে বসতে দেখে, ফোন পকেটে ভরে নিঃশব্দে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিলো। এরপর চুপচাপ খাওয়াতে শুরু করলো।

আরমান খাওয়াচ্ছে, কিন্তু একবারও মায়ার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না আর মায়া সে তো এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। এই মানুষটা, এই মানুষটার ছোট ছোট যত্ন গুলো, বড্ড আপন লাগে। মনে হয় মানুষ টা ওর খুব কাছের কেউ, অনেক দিনের চেনা, এই মানুষটার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ওর। কিন্তু কি সেটা? কেনো এতো আপন মনে হয়?

মাথার ভিতর টাতে জেনো একটা গোলক ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। নিজের মনের এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে থাকে মায়া কিন্তু উত্তর মিলে না, এর ফল স্বরূপ চোখ থেকে টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ে অশ্রু।

আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই। খাওয়া হয়ে গেলে যতো ইচ্ছা কাঁদবে কিচ্ছু বলবো না।”

আরমানের এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে মায়ার কষ্ট দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলো। জোড়ে জোড়ে শব্দ করে কান্না করতে শুরু করলো ও। আরমানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। খাবারের প্লেট টা নামিয়ে রেখে মায়াকে এক হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। মায়া আরমানের আদুরে স্পর্শ পেয়ে আরো ভেঙে পড়লো যেনো। আরমানের বুকে মুখ গুঁজে কান্না করেই চলেছে। আরমান মায়াকে কাঁদতে দিলো কিছুক্ষণ। যদিও ওর বুকের ভিতর টা মুচড়ে উঠছে বারবার, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, পরিস্থিতি এখন ওর হাতের বাইরে।

মায়া কাঁদতে কাঁদতেই অসহায় গলায় প্রশ্ন করলো, “কেনো বলছেন না আমাকে আমার বিষয়ে? আমার নাম মায়া এটা ছাড়া আমি আর কিচ্ছু জানি না। আ..আমার পরিবার কোথায়? সবার মা বাবা আছে আমার কই? সবার জীবন সাজানো গোছানো আমার কেন ছন্নছাড়া?”

আরমান:- “এটাই তো তোমার পরিবার।”

মায়া এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো আরমানের কাছ থেকে নিজেকে। চিৎকার করে বলল, “নাহ!! নাহ!! মিথ্যা বলছেন আপনি আমায়। এটা আমার পরিবার নয়। আমি জানি, আমি এই বাড়ির আশ্রিতা।”

কথা টা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মায়া। আর মায়ার বলা আশ্রিতা কথা টা শুনে আরমানের বুকের ভিতর টা মুচড়ে উঠলো। আশ্রিতা? আরে ও তো আরমানের রাজ্যের রানী, সেটা কিভাবে বোঝাবে আরমান ওকে?

আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “আশ্রিতা? কে বলল তোমায় এই কথা?”

মায়া ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলল, “কেউ বলেনি, নিজে নিজে বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আছে আমার।”

মায়ার বলা প্রতিটা কথা যেন শাণিত ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছে আরমানের অন্তরে। এই মেয়েটা কি আদৌ জানে, ওর একটা শব্দ কতটা গভীর ক্ষত তৈরি করে? কীভাবে ওকে সবকিছু বোঝাবে? বোঝাতে গেলে তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব খুলে বলতে হবে—সেই প্রথম দিন থেকে, সেই তিক্ত শুরু থেকে।

কিন্তু ওদের গল্পের শুরুটা তো মোটেও সুন্দর নয়। অন্ধকার, ভুল বোঝাবুঝি, অবহেলা—সব মিলিয়ে এক বিষণ্ন অতীত। মায়া যদি সবটা জেনে ফেলে, তাহলে কি ও ভুল বুঝবে না? এখন যেটুকু বিশ্বাস আর টুকরো টুকরো অনুভবের বন্ধনে ওরা একসাথে আছে, সেটাও হয়তো আর থাকবে না।

আর মায়ার মানসিক অবস্থা—সেটাও তো আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। অতটা ভার একসাথে সে কি নিতে পারবে? এসব ভেবেই ভেতরটা হঠাৎ প্রচণ্ড অসহায় লাগল আরমানের।

আরমান:- “আর কখনো যেনো তোমার মুখ থেকে ওই কথাটা শুনতে না পাই। এখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, তোমার জন্য নিজের কাজ ফেলে এসেছি আমি। আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”

মায়া জেদি গলায় বলল, “খাবো না, খাবো না আমি। কে বলেছে আমার জন্য আপনাকে কাজ ফেলে আসতে? চলে যান, চলে যান আপনি।”

আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মায়া আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। এভাবে হবে না ওকে নরম গলায় বোঝাতে হবে। আরমান হাত রাখলো মায়ার মাথার উপর। নরম সুরে বলল,‌ “আচ্ছা তুমি যা যা জানতে চাও, সব বলবো আজ রাতে। এখন খাবার টা খেয়ে নাও। আমার লেট হচ্ছে তো, অফিসে ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে একটা।”

মায়া ছলছল চোখে তাকালো আরমানের দিকে, অসহায় গালায় বলল, “সত্যি বলবেন তো? কথা দিন আগে।”

আরমান:- “আচ্ছা কথা দিচ্ছি বলবো। এখন খেয়ে নাও।”

মায়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আরমান মায়ার চোখের পানি মুছে দিলো যত্ন সহকারে। এরপর ধীরে আবারও খাওয়াতে শুরু করলো। মায়াও আর জেদ দেখালো না চুপচাপ খেয়ে নিলো। এরপর মায়ার খাওয়া হয়ে গেলে ওই একই প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলো আরমান। আর মায়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আরমানের দিকে।

আরমানের নিজেরও খাওয়া হয়ে গেলে, মায়াকে ওর মেডিসিন গুলো খাইয়ে দিলো। এরপর মায়ার হাত ধরে ওকে নিয়ে আসলো বিছানার কাছে, বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “এখন একটু ঘুমাও।‌ ভালো লাগবে।”

মায়া:- “আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন একটু? প্রচন্ড ব্যাথা করছে, আমি না আর এতো চাপ সহ্য করতে পারছি না।”

মায়ার নিঃসংকোচ আবদার আরমানের হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেউ বয়ে গেলো। আরমান তাকালো তার হাত থাকা ঘড়ির দিকে, কিছুক্ষণ পরেই ওর একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে, কিন্তু ওর মায়াবতীর থেকে ইম্পর্টেন্ট অন্য কিছু নয়। পকেট থেকে ফোন বের করে ম্যাসেজ দিলো আবিরকে, মিটিং একঘন্টা পিছিয়ে দিতে বলল।

এরই মধ্যে মায়া বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিয়েছে। আরমান বসলো মায়ার ঠিক মাথার পাশে, মায়ার মাথায় হাত রাখতেই মায়ার কি হলো কে জানে? ওর মাথাটা তুলে দিলো আরমানের কোলের উপর। দুই হাত দিয়ে আরমানের কোমর জড়িয়ে ধরলো।

আরমান অবাক, একইসাথে বিস্মিত। ওর মনে এক আশ্চর্য রকমের ভালোলাগার ঢেউ বয়ে গেল। নিঃশব্দে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মায়ার মাথায়, কোমল আর স্নেহভরা স্পর্শে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরমানের স্পর্শে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল মায়া। নিঃশ্বাসের ছন্দে ছন্দে মুখে ফুটে উঠল এক প্রশান্তির ছায়া। আরমান স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

কে বলবে—এই মেয়েটাই কিছুক্ষণ আগে রাগে, জেদে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠেছিল? এখন তো যেন এক আদুরে বাচ্চার মতো লাগছে ওকে… আরমানের চোখে যেন সে এক নিষ্পাপ স্বপ্নের কন্যা।

চলবে…..

#আমার_নিষ্ঠুর_ভালবাসা
#পর্ব_46
#লেখিকা_সালমা_খাতুন

🚫 কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫

মায়া বিষণ্ণ মনে বসে আছে বারান্দায়, দৃষ্টি তার বাড়ির মূল ফটকের দিকে। চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে—কখন সেই কাঙ্ক্ষিত গাড়িটি ভেতরে প্রবেশ করবে।

সন্ধ্যাবেলাতেও মায়ার মেজাজটা ছিল বেশ ফুরফুরে, বিশেষ করে বিকেলের সেই ঘুমটার জন্য। অনেক দিন পর এতটা শান্তিতে ঘুমিয়েছিল ও। তবে ঘুম থেকে উঠেই আর দেখা মেলেনি সেই ‘গম্ভীর সাহেবের’। এতে মন কিছুটা খারাপ হলেও, নিজেই আবার নিজের মনকে বুঝিয়েছে—মানুষটা সত্যিই ব্যস্ত। ওর জন্যই তো সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিল—কেন জানি এই ভাবনাতেই মনটা আবার খুশি হয়ে উঠেছিল।

আর এখন এই বিষণ্ণতার কারণ— রাত প্রায় ১১ টা বাজতে চলল, আরমান এখনো বাড়ি ফিরেনি। মানুষটা কথা দিয়েছিল, আজ রাতে ওকে সবকিছু জানাবে—ওর জীবনের সমস্ত সত্য। আজ ও জানবে নিজের সম্পর্কে সবকিছু… অথচ, মানুষটা এখনও ফিরলো না।

“আপু খেয়ে নেবে আসো। অনেক রাত হয়েছে।”

সামিরার ডাকে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলোমেলো মায়া।

“গম্ভীর সাহেব..না মানে উনি..মানে তোমার বড়ো ভাইয়া এখনো আসেনি?”

সামিরা— “না এখনো আসেনি। অনেক রাত হয়েছে, তুমি খেয়ে নাও মেডিসিন আছে তোমার।”

সামিরার গলাটা কেমন যেন বিষণ্ণ শোনালো। বারান্দাটা অন্ধকারে ঢাকা, তাই স্পষ্ট করে সামিরার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। মায়া বারান্দা থেকে রুমে ঢুকল, সামিরাও পেছন পেছন এলো। রুবি সোফার পাশে রাখা টি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। ওর আচরণেও আজ একরকম নির্লিপ্ততা মায়ার চোখে পড়ল। মায়া মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “কিছু কি হয়েছে? তোমারা আজ এমন চুপচাপ কেনো? আর সামিরা? তুমি কি কান্না করেছো? তোমার চোখ গুলো কেমন জানি লাল হয়ে আছে।”

সামিরা:- “ওহ কিছু না আপু। তুমি এসো খেয়ে নাও।”

মায়া:- “কেন উনি আজ আসবেন না? কোথায় গেছেন উনি?”

সামিরা:- “ভাইয়া অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত আছে। হয়তো অনেক রাত হবে ফিরতে?”

মায়া মন খারাপ করে বলল, “আ.. আমার খিদে নেই। খাবো না।”

সামিরা অসহায় গলায় বলল, “একদিন কি ভাইয়া না খাইয়ে দিলে নিজে হাতে খাওয়া যায়া না? ভাইয়া কখন আসবে তার ঠিক নেই, আদেও জানি না আজ রাতে ফিরবে কিনা।”

মায়া মাথা নিচু করে বলল, “অভ্যাস হয়ে গেছে, চাইলেও ছাড়তে পারি না।”

এরপর মুখ তুলে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো, “উনি..উনি ঠিক আছেন তো। তোমাদের মুখটাও কেমন যেনো শুকনো লাগছে। সবকিছু ঠিক আছে তো?”

সামিরা:- “কেন? কেন মনে হলো উনি ঠিক নেই?”

মায়া বিচলিত হয়ে বলল, “মনটা কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে। ভালো লাগছে না কিছু। শুধু মনে হচ্ছে উনি..উনি ঠিক নেই। প্লিজ রুবি তুমি তো অন্তত কিছু বলো, সবকিছু ঠিক আছে তো?”

রুবি অসহায় চোখে তাকালো মায়ার দিকে, মুখে কিছু বলল না। সামিরা মনে মনে বলল, “ঠিক নেই ভাবী মনি, কিছুই ঠিক নেই। আমার ভাইয়াটা যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে—ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে ওর ভিতরটা। কবে সব ঠিক হবে? কবে আমার ভাইয়াটা সত্যিকারের সুখের মুখ দেখবে?”

সামিরা রুবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,“রুবি আপু মায়া আপুকে খাইয়ে দিও আমি রুমে গেলাম।”

সামিরা কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মায়া অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে।

রুবি:- “প্লিজ ম্যাম খেয়ে নিন। আজ অন্তত জেদ করবেন না।

মায়া:- “তুমি আগে বলো উনি কোথায়? ঠিক আছে তো? কেনো ফিরবেন না আজ রাতে?”

রুবি:- “হ্যাঁ ঠিক আছে। আর স্যার একটু কাজে আটকে গেছে, আমাকে কল করেছিলেন যেনো আপনাকে সময় মতো খাইয়ে দিই। এখন আপনি না খেলে স্যার আমার উপরে রাগ দেখাবে।”

মায়ার প্রচন্ড অভিমান হলো আরমানের উপর। কি এমন কাজ যে আজ রাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না? উনি তো কথা দিয়েছিলেন আজ সবকিছু জানাবে ওকে। কিন্ত উনি তো বাড়িই আসছে না, সত্যিই কি কাজে আটকে গেছে নাকি অন্য কিছু?

মায়া মনে একরাশ অভিমান নিয়ে খেতে বসলো। কিন্তু অল্প একটু খেয়েই আর খেতে পারলো না। কেনো জানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। এটাই এখন ওর সাথে হয়, নিজের আবেগ অনুভূতি গুলো ধরে রাখতে পারে না। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে, আবার একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতেই চায় না।

——-

আরমান প্রতিদিন রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। এই দুই মাসে এটাই ওর নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজ এখনও পর্যন্ত সে ফিরে না আসায় বাড়ির সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়। ফোন করেও যোগাযোগ করা যায় না—ওর ফোন বন্ধ।

অফিসে ফোন করে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো অনেক আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে আরমান।

আবির অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিল, কিন্তু আবারও বেরিয়ে পড়ে ওকে খুঁজতে। কিছুক্ষণ আগে আবির ফোন করে জানায়, আরমানকে পাওয়া গেছে—একটা বারে। প্রচণ্ড ড্রিঙ্ক করেছে, পাগলের মতো আচরণ করছে আরমান। সে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। বলছে, বাড়ি ফিরলেই মায়ার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি।

ডাক্তাররা স্পষ্টভাবে বারণ করেছে—এই মুহূর্তে মায়ার ব্রেনে কোনও চাপ দেওয়া যাবে না। কিন্তু মায়া তো মানতেই চাইছে না! বরং দিনকে দিন আরও বেশি ডেসপারেট হয়ে উঠছে।

আর যেই আরমান কখনো প্রয়োজন ছাড়া ড্রিঙ্কস করে না, সেই আরমান আজ গভীর রাতে মাতাল অবস্থায় ধরা পড়ল এক বারে। অথচ এই মানুষটাই, সবসময় গম্ভীর, কারও সামনে আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করেনি কখনো—সেই আরমান আজ ভেঙে পড়েছে। হ্যাঁ, কিছু পার্টি বা মিটিংয়ে, ক্লায়েন্টদের জোরাজুরিতে ভদ্রতার খাতিরে সামান্য সিপ নিয়েছে, তবে সেগুলো কখনোই মাত্রা ছাড়ায়নি। কিন্তু আজ?

আজকের এই ভাঙা আরমান যেন একেবারে অচেনা। নিজের ভার নিজেই আর বইতে পারছে না। হৃদয়ের ভেতরে একটা ভার জমেছে—কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না। ওর মায়াবতী—যার জন্য কত বছর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছ, পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আজ সে ওর খুব কাছে, অথচ সবচেয়ে দূরে। মায়া ওর কাছে থেকেও যেন শত সহস্র মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আর এখন, মায়াকে সামলানো যেন প্রতিদিনের যুদ্ধ।

———-

রাত তখন অনেক টা গভীর। মায়া বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। হঠাৎ শোনা গেল গাড়ির হর্ন এর আওয়াজ। মায়া ধরফর করে উঠে বসলো বিছানায়। আরমান এলো কি? প্রশ্ন জাগলো মায়ার মনে।‌ হ্যাঁ উনি ছাড়া আর কে আসবেন? মায়া এক ছুটে নিচে গেলো, ততক্ষণে বাড়ির বেল টা বাজতে শুরু করেছে।

মায়া দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো।‌ আরমান দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, দেওয়াল ধরে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। দুপুরে গায়ে যেই ব্লেজার টা ছিল সেটা এখন আর নেই, মাথার চুল গুলো এলোমেলো, পরনের শার্টটাও কুঁচকে আছে। এতোটা বিদ্ধস্ত অবস্থায় আরমানকে কখনো দেখেনি মায়া। শরীর থেকে ভেসে আসছে অ্যালকোহলের ঝাঁঝালো গন্ধ। মায়ার ভিতর টা সেই গন্ধে গুলিয়ে উঠলো, সাথে সাথে নাকে মুখে হাত চাপা দিলো ও।

মায়া:- “এই অবস্থা কেনো আপনার? আপনি ড্রিংক করেছেন?”

আরমান নিভু নিভু চোখে চাইলো মায়ার দিকে। জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলল, “আ..আমার এই অ..অবস্থা তো..তোমার জন্য। হুম ক..করেছি ডিংকস। তা..তাতে তো.. তোমার কি?”

কথা গুলো বলতে বলতেই টলমল পায়ে এগিয়ে এলোমেলো আরমান। নিজের পায়ের সাথে নিজেরই পা লেগে সামনের দিকে পড়তে নিলো, কিন্তু মায়া তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেললো। পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো আরমান মায়ার উপর। এতো বলিষ্ঠ বান পুরুষের ভর কি আর ওর মতো মেয়ে নিতে পারে? মায়া কিছুটা হেলে পড়লেও কোনো রকমে সামলে নিলো নিজেকে এবং আরমানকে।

(পরবর্তী পর্ব এই পেজে পেয়ে যাবেন)
https://www.facebook.com/share/19BxWdTt3h/

মায়া:- “আমার জন্য আপনার এই অবস্থা হয়েছে? কি করেছি আমি?”

আরমান:- “তু..তুমি তুমি একটুও বো..বোঝো না আমায়। খালি ক..কষ্ট দাও।”

মায়ার অভিমানী মনে আরো কিছুটা অভিমান জমা হলো। অভিমান মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করলো, “কি কষ্ট দিয়েছি আমি আপনাকে?”

আরমান:- “হুম, দি..দিয়েছো তো। নি.. নিজেকে আ..আশ্রিতা বলেছো‌। জা..জানো এই ক..কথাটা আ..আমার হৃদয়ে ক..কতটা আঘাত করেছে?”

মায়া ছলছল চোখে কান্না ভেজা গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “কেন? কেন কষ্ট হয় আপনার? নিজেকে আশ্রিতা বললে কেনো আপনার হৃদয়ে আঘাত লাগে? আশ্রিতা না হলে এই বাড়িতে আমার পরিচয় কি?”

আরমান এই অবস্থাতেও নিজেকে মায়ার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা ঝাঁঝ মিশ্রিত গলায় বলল, “নাহ আ..আশ্রিতা নও তুমি। তু..তুমি এই বাড়ির…”

নিজের বলা কথাটা শেষ করলো না আরমান, মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো।

মায়া অসহায় গলায় বলল, “কি হলো থেমে গেলেন কেনো? বলুন? আমি এই বাড়ির কি?”

আরমান মাথা নিচু করে নিলো। শোনা গেলো মিসেস সাবিনা বেগমের গলার আওয়াজ।

“মায়া আম্মু, আরমানকে ওর রুমে দিয়ে এসো। দেখছো তো ওর অবস্থাটা, এখনো ও নিজের হুঁসে নেই।”

আরমান:- “আ..আমি যেতে পা..পারব মম।”

কথাটা বলেই আরমান এগিয়ে যেতে শুরু করলো, কিন্তু আবারও পড়ে যেতে নিলো ও। সাথে সাথে মায়া ছুটে গিয়ে আঁকড়ে ধরলো আরমানকে। চোখে চোখ পড়তেই সময় থমকে গেলো। আরমানের দৃষ্টিতে ছিল মায়াবতীর জন্য ছুটে চলা সীমাহীন প্রেম, আর মায়ার চোখে সেই প্রেমেরই বিপরীত প্রতিচ্ছবি—শূন্যতা, নীরবতা আর হারিয়ে যাওয়ার ক্লান্তি।

মায়া নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে আরমানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মিসেস সাবিনা বেগম নিজের চোখের পানি মুছলেন শাড়ির আঁচলের কোনা দিয়ে। কখনো কল্পানাতেও ভাবেনি নিজের ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখতে হবে কোনোদিন।

মিসেস সাবিনা বেগম রুবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রুবি আবির তো আরমানের সাথেই ছিল ও কোথায়?”

রুবি:- “আমার আসার আগেই ভাবী মনি দরজা খুলেছে, হয়তো উনি আগেই নিজের রুমে চলে গেছেন।”

সাবিনা বেগম:- “আচ্ছা দরজা টা লাগিয়ে দাও তাহলে।”

রুবি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মিসেস সাবিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন নিজের রুমের উদ্দেশ্যে। রুবি দরজাটা লাগাতেই যাবে এমন সময় ওর পায়ের কাছে কেউ একজন হুমরি খেয়ে পড়লো। ভয়ে চমকে উঠে লাফিয়ে পিছিয়ে গেলো ও। পুরো ড্রয়িংরুমের উজ্জ্বল লাইট গুলো বন্ধ করে মৃদু আলো জ্বালানো আছে।

নিচে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে কিছুটা চেনা চেনা লাগলো ওর। তাই ভয়ে ভয়ে ব্যাক্তিটির সামনে বসলো, কাঁধ ধরে উপুড় হওয়া থেকে ঘুরালো। হ্যাঁ, ওর মন যা ধরেছিল ঠিক তাই, আবির নিচে চিত হয়ে শুয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

আবির:- “আ..আমাকে না নিয়েই দ..দরজা লাগিয়ে দি..দিচ্ছো রুবি ডা..ডার্লিং?”

রুবি নিজের কপালে চাপড় মেরে বলল, “এই আপনি না স্যারকে আনতে গিয়েছিলেন? এখন নিজেই মদ গিলে বসে আছেন?”

আবির দাঁত বের করে হেসে বলল, “ম..মদ খাইনি নি তো।‌ এ..একটু হু..হুইস্কি খেয়েছি। এ..এই এত্তু খানি।”

রুবি কটমট করে তাকালো আবিরের দিকে। রাগী গলায় বলল, “এই মদ আর হুইস্কি কি আলাদা?”

আবির নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, “হুম আলাদা তো, তুমি জানো না রুবি ডার্লিং?”

রুবি:- “না জানি না। আর জানতেও চাই না। আর কে ডার্লিং আপনার? হুম? কে ডার্লিং? একদম আমাকে ডার্লিং ডার্লিং করবেন না। উঠুন তো এখান থেকে। আমি দরজা লাগাবো।”

আবির হঠাৎ করেই ধরফর করে উঠে বাবু হয়ে বসলো ফ্লোরেই।

“তু..তুমিই তো আ..আমার ডার্লিং। এই চ..চলো না বিয়ে করি ফেলি। আর ভা..ভালো লাগছে না এ..একা একা থাকতে।”

রুবি মুখ বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো, “বয়েই গেছে আমার আপনাকে বিয়ে করতে। হুঁ। 😏 😏 আমি কোনো মাতালকে বিয়ে করবো না।”

আবির হামাগুড়ি দিয়ে সোফার কাছে গিয়ে ওখানে বসে সোফায় হাত দিয়ে বলল, “আ..আর কোনো দিন ম..মদ খাবো না। এ..এই সোফার দি..দিব্বি করে বলছি।”

রুবি বিড়বিড় করে বলল, “শুরু হয়েছে মাতালের মাতলামো। মদ না খেয়েইতো মাতলামো করে আর এখন গলা অবদি গিলে আছে।”

রুবি বাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর আবিরের কাছে গিয়ে বললো, “চলুন রুমে চলুন। অনেক রাত হয়েছে, ঘুম পেয়েছে আমার। আপনাকে রুমে দিয়ে এসে ঘুমাবো আমি।”

আবির হাত বাড়িয়ে দিলো রুবির দিকে, “তুলো আ..আমায়।”

রুবি আবিরের হাত ধরে টেনে তুলার চেষ্টা করলো।‌ কিন্তু পারলো না বরং আবির এক টান দিতেই ও গিয়ে আবিরের উপর পড়লো।

রুবি বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে কি করছেন টা কি? উফফ ছাড়ুন আমায়।”

আবির বাচ্চামো গলায় বলল, “নাহ ছা..ছাড়বো। একতুও ভা..ভালোবাসো না তুমি আমায়। স..সব সময় দূ..দূরে দূরে থাকো।”

রুবি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্লিজ ছাড়ুন। এইভাবে কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

আবির নাছোড়বান্দার মতো করে বলে উঠলো, “হ..হয়ে যাক কে..কেলেঙ্কারি। তাহলে স..সবাই আমাদের বি..বিয়ে দিয়ে দেবে।”

রুবি বিড়বিড় করে বলল, “হুম, জাতে মাতাল তালে ঠিক।”

——————

এদিকে আরমানের রুমে…

মায়া অনেক কষ্টে আরমানকে ওর রুমে নিয়ে আসলো। এতো ভারী মানুষটার ভর নিজের উপর নিয়ে এতোদূর সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে আসতে হাঁপিয়ে উঠলো ও। তার উপর আরমানের মুখ থেকে ভেসে আসা মদের উটকো গন্ধে ভিতর টা গুলিয়ে উঠছে মায়ার।

বেডের কাছে নিয়ে এসেই আরমানকে ছেড়ে দিলো মায়া। আরমান ধপাস করে বেডের উপর পড়ে গেলো, ততক্ষণে মায়া ছুট লাগিয়েছে ওয়াশরুমের দিকে। মায়া ওয়াশরুমে গিয়েই বেসিনের কাছে দাঁড়াতেই হরহর করে ভেতরের সবকিছু বাইরে বের করে দিলো। পেটের ভিতর টা মুচড়ে উঠলো ওর, ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো।

ততোক্ষণে আরমান টলতে টলতে উঠে এসেছে মায়ার কাছে। মায়ার পিঠে মাথায় হাত বুলাচ্ছে, আর বলছে, “এই মায়..মায়াবতী, তু..তুমিও ড্রিঙ্কস ক..করেছো নাকি আ..আমার মতো? জা..জানো আ.. আমারও এইসব স.. সহ্য হয়না। বা..বাড়ি আসার সময় আ.. আমিও বমি করেছি।”

মায়ার প্রচন্ড রাগ লাগলো আরমানের কথা শুনে। নিজে এইসব ছাইপাশ গিলে এখন ওকে জিজ্ঞাসা করছে ও ড্রিঙ্কস করেছে কিনা। ওর জন্যই এমন অবস্থা হলো মায়ার সেটা কি এই লোক বুঝছে না। হঠাৎই মায়ার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ করতে শুরু করলো। নিজের শরীরের ভর নিজেই ধরে রাখতে পারছে না এমন অবস্থা।

আরমান বুঝলো কি? হয়তো বুঝলো, আর তার জন্যই মায়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজের কোলে তুলে নিলো। সাথে সাথে আরমানের পা দুটো টলে উঠলো।

মায়া যেনো আঁতকে উঠলো, “আরে কি করছেন? আপনি নিজেও পড়বেন সাথে আমাকেও ফেলাবেন। নামান বলছি। আরে নামান আমাকে।”

না মায়ার কোনো কথা আরমানের কানে গেলো বলে মনে হলো না। ও কোনো রকমে মায়াকে কোলে নিয়েই টলতে টলতে রুমে আসলো। বেডের কাছে এসে মায়াকে নিয়েই আরমান ধপাস করে নিজের শরীর টা এলিয়ে দিলো বিছানায়। আরমান মায়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ছিল, তাই মায়াও আরমানের শরীরের উপরেই পড়লো। নিভু নিভু চোখে আরমান তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। আরমান জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলল, “তু..তুমি আমার বু..বুকে আছো। এ..এতদিন ধরে খালি বু..বুকটা আজ তো..তোমার স্পর্শে পূ..পূর্ণ হলো। ভেতরটা অ..অদ্ভুত শান্তিতে ভ..ভরে গেছে…শুধু এ..এতটুকু কাছাকাছি থা..থাকো, আ..আমি আর কিছু চা..চাই না। তুমি থাকলে আ..আমার বুকটা আর শূ..শূন্য লাগে না।”

আরমানের জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলা কথা মায়ার হৃদয়ে স্পর্শ করলো জেনো। কি হলো কে জানে? শারীরিক দূর্বলতার জন্য আর উঠতে মন চাইলো না ওর নাকি নিজে থেকেই আর উঠতে চাইলো না ও। একটা ঘোরের মধ্যে থেকে মাথা রাখলো আরমানের বুকে। আরমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মায়াকে। মাথার চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছোঁয়াল আরমান। এতো দিন ধরে ছটফট করতে থাকা দুটো রক্তাক্ত হৃদয়ে শীতল বারিধারা নেমে এলো যেনো।

———–

সকালে সূর্যের মৃদু আলো চোখে এসে পড়তেই ঘুমটা হালকা হয়ে এলো আরমানের। বুকের উপর ভারী কিছু একটা অনুভব হলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো আরমান। আর তাকাতেই ওর জীবনের সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য টা দেখতে পেলো ও, মায়া ওর বুকে গুটিসুটি মেরে একেবারে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে আছে। মনে মনে এই দৃশ্য কতবার যে কল্পনা করেছে তার হিসাব নেই। আর এখন সেটা বাস্তবে দেখে ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটা প্রাপ্তির হাসি।

তারপরই হঠাৎই ওর মুখে চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। ওর স্পষ্ট মনে আছে কাল ও ড্রাঙ্ক ছিল। ও কি মায়ার রুমে এসে নেশার ঘোরে মায়াকে জোড় করে…

চারিপাশ তাকালো আরমান, না এটা তো ওরই রুম। তাহলে মায়া কি নিজে থেকে ওর রুমে এসেছিল? নাকি ও জোড় করে মায়াকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে?

মাথায় অনেক টা জোড় দিতেই আবছা আবছা মনে পড়লো ওর। না মায়ার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে নি ও। মন চাইছে সময় টা এখানেই থেমে যাক, মেয়েটার ঘুম ভাঙলেই তো আবার দূরে চলে যাবে ওর থেকে। আবার শূন্য করে দেবে ওর বুকটা।

“কেন, মায়াবতী? কেন এমনটা হলো আমাদের সঙ্গে? এত সহজে ভুলে গেলে তুমি আমায়? তোমার গম্ভীর সাহেবকে ভুলে গেলে এতটাই সহজে? কতটা পর করে ফেলেছো আমায়—চাইলেও আর তোমার কাছে আসতে পারি না, ছুঁতেও পারি না!
বারবার জিজ্ঞেস করো—‘আমি তোমার কে?’ ‘কি সম্পর্ক আমাদের?’
সত্যিই কি এগুলো জানা খুব জরুরি? মুখে উচ্চারণ করাই কি একমাত্র প্রমাণ?
আমার অনুভূতির কোনও দাম নেই তোমার কাছে?
একটু বোঝার চেষ্টা করো না কেন সেই অনুভূতি গুলো? বুকটা পুড়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে।
একটু… একটু কি আপন করে নিতে পারো না আমায়?”

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অসহায় গলায় কথা গুলো বলল আরমান। এরপর কি জেনো ভেবে মায়াকে খুব সাবধানে নিজের বুক সরিয়ে পাশে শুইয়ে দিলো ও। তারপর উঠে গেলো বিছানা থেকে।

আরমান উঠে যেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো মায়া। ঘুমটা ওর অনেক আগেই ভেঙে গেছে। তবে কেনো জানি আরমানের হাত ছাড়িয়ে ওর বুক থেকে উঠতে মন চাইলো না। ভীষণ শান্তি অনুভব করছিল আরমানের বুকে এই ভাবে থাকতে। তারপর হঠাৎই বুঝতে পারে আরমানের ঘুম ভাঙছে। সাথে সাথে প্রচন্ড লজ্জা ঘিরে ধরে ওকে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চুপটি করে পড়ে থাকে আরমানের বুকে। আর এরপর আরমানের বলা কথা গুলো, সবই শুনেছে ও। সবটা।

চলবে….