#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৩|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
রাতের আঁধার ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই তখন অনুষ্ঠান ছেড়ে বাড়ি ফিরেছেন। সবেমাত্রই অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। কজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে স্যারের আদেশে ক্যাম্পাস পরিষ্কার করছিলো। ধ্রুব তখন একপ্রকার হাওয়া বলা চলে। কোথায় গেছে কে জানে? অদিতি তখন ভাগে পরা কাজগুলো শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যাবে-যাবে অবস্থা। হঠাৎ ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ধ্রুবর বাবা; সৌরভ ইয়ামিন। অদিতির সঙ্গে আলাদা করে দুটো কথা বলবেন ভেবেই, সবাই চলে গেলেও এতক্ষণ ধরে বসে ছিলেন।
ধ্রুবর বাবা ডাকলেন পেছন থেকে—‘শুনো মেয়ে!’
অদিতি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে পেছন ফিরে তাকাল। সৌরভকে দেখেই ও রীতিমত চমকে উঠে, ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। প্রধান অতিথি স্বয়ং তাকে ডাকছে; অদিতি কিছুটা গুটিয়ে গেল যেন এ কথা চিন্তা করে।!ও তখনও ধ্রুবর বাবাকে চিনে না। ও শুধু চিনে সৌরভ ইয়ামিন,যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন।
সৌরভের ডাকে অদিতি সাতপাঁচ চিন্তা করে এগিয়ে গেল; গলার স্বর নিচু রেখে বলল —‘আসসালামুয়ালাইকুম, স্যার।’
ধ্রুবর বাবা অদিতিকে জহুরিচোখে আগাগোড়া দেখলেন। বাবা হিসেবে উনার ছেলেকে তো উনি চিনেন। চুড়ান্ত বেয়াদব; উগ্র, বখাটে একটা ছেলে কেমন মেয়েকে ভালোবেসেছে সেটা উনি একবার পরীক্ষা করে দেখে নিচ্ছেন। নীল রঙ্গা শাড়ি পড়া মোটামোটি ছিমছাম গড়নের একটা মেয়ে। মুখে আজকাল যুগের মেয়েছেলেদের মতো একগাদা মেকআপ নেই, সামান্য কাজল চোখে। মুখের আদল ভারি মিষ্টি; সরল ভীষণ!
এই অনুষ্ঠানে অনেক মেয়েছেলে শাড়ি টাইট-ফিট করে পরে এসেছিলো আজ, কজন কোমর দেখিয়ে নেচেছেও সবার সামনে। অথচ এই মেয়ের এতটা মার্জিতভাবে শাড়ি পরা উনাকে উনার মরহুম স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ। কারিশমা এভাবেই গাঁ ঢেকে: কোমরের দিকের শাড়িতে ডজন সেফটিপিন লাগিয়ে মার্জিত ভাবে শাড়ি পড়তো, আজ অব্দি কেউ বলতে পারেনি- কারিশমার গায়ের বাঁক কেমন ছিলো; এতটাই মার্জিত ছিলো সে। এই মেয়েটাও তেমনি; অত্যন্ত মার্জিত! আজকাল ঢাকা শহরের কিছু বখে যাওয়া মেয়ের ন্যায় নয়।
ব্যাস! সৌরভের বাবা-বাবা মনটা অদিতিকে দেখে ভীষণ তুষ্ট হলো! সম্ভবত ছেলের বৌ হিসেবে অদিতির মধ্যে নিজের স্ত্রীর গুণগুলো উনি দেখেছেন। সৌরভ কণ্ঠে মায়া ঢেলে বললেন—-‘কেমন আছো তুমি, মা?’
অদিতি অবাক; উনি অদিতির ভালো-মন্দ কেন জিজ্ঞেস করছেন? তবুও সম্মান রক্ষার্থে অদিতি জবাব দিল —‘জ্বী, ভালো, স্যার। আপনি?’
সৌরভ যারপরনাই খুশি হলেন অদিতির আলাপে। হাসিহাসি মুখে জবাব দিলেন —‘ভালো আছি, মা। তোমার বাড়ি কোথায়?’
অদিতি তখনও অবাক, ও জবাব দিল—‘‘লক্ষ্মীপুর।’
সৌরভ চমকে উঠলেন; জিজ্ঞাস করলেন —‘লক্ষ্মীপুরের কোথায়?’
অদিতি জবাব দিল —‘ইসলামপুর, স্যার।’
সৌরভ হুট করে কিছু যেন মনে পরে গেল। উনি বিস্মিত হয়ে বললেন—-‘ আরে? ওখানে তো আমি গেছিলাম একদিন; আমার জোয়ান বয়সে; বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। আমার একটা প্রজেক্টের কাজ ছিলো তোমাদের গ্রামে। গ্রামটা অনেক সুন্দর ছিলো, আমরা ভীষণ এনজয় করেছিলাম।’
অদিতি অবাক হয়েছে বটে। দুনিয়াটা আসলেই গোল! ও ভদ্রতার খাতিরে বললো ——‘আরেকবার ওদিকে গেলে আমাদের বাড়িতে যাবেন, স্যার।’
সৌরভ যেন হাতে চাঁদ পেলেন, খুশিতে গমগম করে উঠে বললেন —‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তোমার বাবার নাম; বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ো। আমি ওদিকে বেড়াতে গেলে তোমাদের বাড়িতে ঘুরে আসতে চাই। পুরনো দিনটা আবার ফিরে পেতে কার না ভালো লাগবে।’
অদিতি এবার কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলো। ওদের ওই ওতো ছোট বাড়িতে এতবড় গনমান্য মানুষ যাবেন? ওদের বাড়িতে গেলে; ওরা তো সেইভাবে উনার খেয়ালই রাখতে পারবে না। অদিতি কিছুটা দোনামনা করতে পাগল। হঠাৎ কোথা থেকে ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
সৌরভ আগ বাড়িয়ে অদিতিকে কিছু বলতে যাবেন; ধ্রুব তখন ওদের সামনে দাঁড়ালো এসে। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস অশান্ত! চোখ-দুটো মারাত্মক লাল! অদিতি-সৌরভের দিকে চেয়ে যেন ফুঁসছে।
ওদের কাছে এই শুরুতেই অদিতিকে দিলো এক রাম ধমক—-‘অদিতি, জাস্ট লিভ।’
হঠাৎ ধ্রুবর এতবড় ধমক খেয়ে অদিতি রীতিমত চমকে উঠে তাকালো ওই গুরুগম্বীর-একরোখা, রাগান্বিত ধ্রুবর মুখের দিকে। সৌরভ নিজেই অবাক! ধ্রুব পারে না এক্ষুনি অদিতিকে কাচা চিবিয়ে খেতে ফেলতে। অদিতি অবাক হয়ে সৌরভের দিকে একবার চেয়ে আবার ধ্রুবর দিকে তাকালো; বলতে চাইল যেন কিছু —‘ আপনি— উনি এসেছেন..’
অদিতিকে কিছুই বলতে দেওয়া হলোনা। ধ্রুব চোখ বুজে রেখে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজেকে শান্ত করার খুব চেষ্টা চালালো। পরপর চাপা স্বরে রাগী কণ্ঠে এটুকু বললো—‘অ্যাই সেইড, লিভ রাইট নাও।’
ধ্রুবর এমন অদ্ভুদ ব্যবহারগুলো অদিতির কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ধ্রুব ওর মতো স্বল্প পরিচিত এক মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলছে; ভাবতেই অবাক হচ্ছে অদিতি। অদিতি অপমানিত ভঙ্গিতে সৌরভের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের মুখটা শুকনো লাগছে, ভয়ঙ্কর অপমানিত বোধ করছেন যেন। অদিতি বুঝলো না; ধ্রুব হঠাৎ এমন করে রেগে গেল কেন? তাও একজন গণমান্য অতিথিকে অপমান করছে। অদিতি ধ্রুবর র/ক্তচক্ষু দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। সৌরভকে আস্তে করে সালাম করে চলে এলো সেখানে থেকে।
ও যেতেই ধ্রুব এবার লাল চোখ নিয়ে দৃষ্টি ফেলল সৌরভের দিকে। ধ্রুব যেন নিজের মাঝেই নেই। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয়ে ও নিদারুণ ভাবে জর্জরিত।
সৌরভ ছেলের কাজে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন —-‘আমরা কথা বলছিলাম।’
ধ্রুব হাসলো অতিষ্ট ভঙ্গিতে। কোমরে এক হাত রেখে, আরেকহাতে বাম চোখ ডলে আবার সৌরভের দিকে তাকাল। তারপর তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল —‘কথা বলছিলেন? অদিতির সঙ্গে? কেন? হঠাৎ ওর সঙ্গে কি আপনার? পছন্দ হয়েছে? ওকেও বিয়ে করতে চাইছেন?’
সৌরভ নিজের ঔরসজাত সন্তানের মুখে এমন সস্তা-ছোটলোকি কথা শুনে ভয়ঙ্কর লজ্জায় পরে গেলেন। ছেলের মুখে ছেলের বউ নিয়ে এমন কথায় তার কান থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগলো। উনি এতবড় কথা সহ্য করতে পারলেন না। আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে উঠলেন ছেলেকে—‘ভদ্রভাবে কথা বলো ধ্রুব। ও আমার মেয়ের বয়সী।’
ধ্রুব হাসে; ভ্রু বাকিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে ——‘মিস তৃণাও তো আমার জানামতে তোমার মেয়ের বয়সী ছিলো? রাইট? ওকে বিয়ে করতে পারলে; অদিতি কেন নয়?’
সৌরভ চোখ রাঙালেন; বললেন —-‘তৃণা মোটেও মেয়ের বয়সী ছিলো না; ওর-আমার এইজ গ্যাপ সবে ১৩ বছরের। যেখানে তোমার আপন মায়ের সঙ্গে আমার বয়সের গ্যাপ ছিলো ১০ বছর। রাগে বিবেক হারিয়ে ফেলো না ধ্রুব।
‘ওহো, অপস! ভুল হয়ে গেল।’ —— ধ্রুব হাসে; যেন মশকরা করেছেন সৌরভ ওর সঙ্গে।
সৌরভ নিজের রাগ সামলালেন; ছেলের এমন উশৃঙ্খল আচরণের জন্যে যদি কেউ সবচেয়ে বেশি দায়ী হয় তবে সেটা উনি নিজে; কথাটা আর কেউ না জানুক উনি তো জানেন।
তাই উনি ধীর গলায় ছেলের ভুল বোঝাটা শুধরে দিতে চাইলেন; বললেন —‘তোমার জন্যে অদিতির বাড়িতে আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে চাইছিলাম ধ্রুব।’
ধ্রুব হতভম্ব হয়ে তাকাল সৌরভের দিকে। চুড়ান্ত অবাক হয়ে বললো—‘তোমাকে কোন ব্লা/ডি রা/স্কেল বলেছে আমি অদিতিকে বিয়ে করতে চাই?’
সৌরভ বললেন —‘ বাবা হই আমি তোমার। তোমার চোখ-দুটো আমার চেনা আছে।’
—‘ বাবা হই? ও গড।’—- ধ্রুব আবারও কপাল চুলকে অতিষ্ট ভাবে হাসে।
তারপর বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে বসলো—-‘ বাবা যদি হতেই; তাহলে আমার মা অসুস্থ থাকা অবস্থায় পরকীয়া করে বেড়াতে না। আমার মা ক্যানসারে বিছানায় শুয়ে কাতরে যাচ্ছিল; আর তুমি তার ওই নাজুক অবস্থাত ঘরের বাইরে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিলে।’
সৌরুভ হতভম্ব। ছেলের এহেন বিশ্বাসে তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন —‘আমি পরকীয়া করিনি। তৃণার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া অনেক আগে হলেই, আমি তোমার মায়ের মারা যাওয়ার পর ওকে ভালোবেসেছি। ও কখনোই তোমার মা জীবিত থাকা অবস্থায় আমাদের দুজনের মাঝে আসেনি।’
ধ্রুব হাসল; টিটকারি করে বললো—‘ওও! তাইতো মা মারা যাবার দু-মাস পরেই আমার ঘরে সৎ মা এমনি এমনি এসে গেছিল। রাইট?’
সৌরভের রাগ লাগছে। তবুও আজ সব বলা দরকার এই ভেবে বললেন——‘বিয়েটা আমি তোমার ভালোর জন্যেই করেছি ধ্রুব, তুমিও সেটা জানো। আমাদের ঘরটা নারীবিহীন উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছিল। তুমি বিপথে চলে যাচ্ছিলে; তাই আমি আমাদের সবার কথা ভেবেই—‘
ধ্রুব সৌরভের দিকে চেয়ে: চেঁচিয়ে উঠে এবার —‘না, তুমি শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের চিন্তা করেই বিয়ে করেছিলে। আমাকে এখানে খবরদার টানবে না। আমার ভালো তুমি কোনোদিনই চাওনি।’
সবার মধ্যে এভাবে চিৎকার করে বলা কথায় সৌরভ লজ্জায় আশেপাশে তাকালেন। কেউ নেই এদিকে।তবুও তিনি আর ভরা মজলিসে অপমানিত হতে চাইলেন না। এখন ধ্রুব অন্ধ ভাবে উনার প্রতি রেগে আছে। যেই রাগ শুরু হয়েছিল ধ্রুব যখন ১০ বছর বয়স। আজ ধ্রুব ২৫ বছরের ছেলে; এতটা বছর সে অনেক যত্ন নিয়ে বাবার প্রতি এই রাগ-অভিযোগগুলো পুষেছে। এতো সহজে এগুলো মিটবে না। ওকে এখন কিছু বোঝানো মানে শুধুশুধু সময় নষ্ট করা।
পাশ খেকে স্যারকে চুপ দেখে সেক্রেটারি রাহুল নিচু গলায় ধ্রুবকে বলল —‘তোমার বাবা চাইছেন: তুমি তোমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে সুখে থাক। তাই তিনি বলছিলেন-‘
ধ্রুব বাকিটা আর শুনলোই না। চেঁচিয়ে উঠলো আবার —-‘ওহ গড, প্লিজ! দয়া করে আমার লাইফে দখল দেওয়া বন্ধ করো সবাই। আমি কাকে বিয়ে করবো এটা আমি জানি। আমি চেয়েছি তোমার ফালতু ওই সাহায্যগুলো? তোমরা আবার আমার লাইফ এলোমেলো করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছো,যেখানে আমি মাত্র মাথাটা উঁচু করা শিখেছি।’
ধ্রুবর সামনে সৌরভ ইয়ামিন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছেন। ছেলের এই চুড়ান্ত বে/য়াদ/বিগুলো তার হজম হচ্ছে না আর। সৌরভ বহু কষ্টে নিচু আওয়াজে বললেন-‘আমি ভেবেছি যদি আরেকবার তোমার লাইফটা গুছিয়ে-‘
‘আমি বলেছি?’ – ধ্রুব আবারও চেঁচালো।
সৌরভ কথার খেই হারিয়ে ফেললেন; পাশ থেকে রাহুল নম্র কণ্ঠে; ভয় নিয়ে ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল, বললো—-‘ধ্রুব আস্তে কথা বলো প্লিজ, তোমার বাবার হাই প্রেশার আছে।’
ধ্রুব শুনে চোখ বুজে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো; নিজেকে রাগ কন্ট্রোল করে,একটাসময় নিজেকে শান্ত করে চাপা স্বরে লাল চোখ নিয়ে বলল -‘আমি আমার বিয়েতে তোমায় বলবোই না, চিন্তা নেই। বিয়ে যেদিন করতে ইচ্ছে হবে না? জাস্ট কাজী অফিসে গিয়ে কাজ সেরে বউ নিয়ে চলে আসব, তোমার লোক দেখানো দায়িত্বগুলোর আমার দরকার কখনো ছিলোই না; ভবিষ্যতেও হবে না।’
সৌরভ মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকালেন: বুকটা আবার ভারি হচ্ছে তার। বুকের ব্যথা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব হয়তো চিন্তাও করেনি- এই কথাগুলো একটা বাবার জন্যে কতটা পীড়াদায়ক। বাবা হিসেবে একজন পুরুষকে ব্যর্থ অনুভব করিয়ে ফেলতে পারে মুহূর্তেই।
ধ্রুব কথাটা বলে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করল না। বড়বড় পা ফেলে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। সৌরভ বুকে হাত দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে পরলেন। রাহুল দ্রুত ব্যাগ থেকে ইনহেলার; আর প্রেশারি ঔষুধ বের করে দিল উনাকে। সৌরভ সেগুলো ধরলেনই না। ছেলের যাওয়ার দিকে টলমলে চোখে চেয়ে থাকলেন!
______
ধ্রুব মারাত্মক স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলো। ওর হাত আজ কাঁপছে রীতিমত। শরীর হেলে পরতে চাইছে। তবুও স্পিড কমাচ্ছে না; আজ এই রাস্তায় মরে পরে থাকলেও ধ্রুবর আফসোস হবে না। শালা জিন্দেগির প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে রীতিমত। একটা তামাশা চলছে ওর লাইফে। ধ্রুব বারবার গাড়িগুলো ওভারটেক করছিল। যেন আজ কোনোরকমে মরে যেতে পারলেই ওর তৃপ্তি।
ধ্রুবর ফোন পকেটে বারবার বাজছে। কয়েকবার বেজে ফোন কাটল; ধ্রুব ফোন রিসিভ করল না। ওর চোখ-দুটো ঢুলছে.. যেন লুটিয়ে পরবি এক্ষুনি। হয়তো পুরনো মেন্টাল ট্রমাটা আবার হানা দিতে চাইছে।
বারবার ফোন বাজছিল; তাই একসময় অতিষ্ট হয়ে বাইকের স্পিড কমিয়ে ফোন রিসিভ করলো: ওপাশ থেকে তানিয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেল। কাঁদতে কাঁদতে বলছে—‘ধ্রুব ভাই; অ-অদিতি!’
গাড়ির শা-শা আওয়াজে ধ্রুব কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তানিয়ার কাছে ওর নম্বর দেওয়া ছিলো: যেন অদিতির খোঁজ নিতে পারে। তানিয়ার সাহস হবে না বিনা কারণে ধ্রুবকে কল দেওয়ার। অদিতির হয়তো কিছু প্রয়োজন, তাই ধ্রুব বাইক এক পাশে সাইড করল। কানে ফোন চেপে জিজ্ঞেস করলো —‘শুনতে পাইনি আমি। এখন বলো—‘
তানিয়া হাঁপাচ্ছে; ও কান্না আটকে অশান্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো—-‘ ভাইয়া, অদিতিকে পাওয়া যাচ্ছে না দু ঘণ্টা ধরে।’
হঠাৎ ধ্রুবর বুক কেঁপে উঠলো যেন। এমনিতেই অ্যানযাইটি অ্যাটাকের মতো হচ্ছিল, তারউপর এই খবর।ধ্রুব মনের মধ্যে নেগেটিভ কিছু ভাবতে চাইছে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললো—‘ হোস্টেলে ফিরে নি ও?’
—-‘ না ভাইয়া। ও হোস্টেলে নেই। আশেপাশের জায়গাগুলো খোজা হয়েছে। কোথাও নেই। কেউ কেউ বলছে—অদিতিকে লাস্ট বার কতগুলো ছেলের সঙ্গে নাকি দেখেছে কজন।’
ধ্রুব অবিশ্বাস নিয়ে বললো—-‘ অদিতি ছেলেদের সঙ্গে? কে দেখেছে ওটা?’
—‘ ভাইয়া আমাদের ক্লাসমেট কজন। আমরাও বিশ্বাস করতে পারছি না এটা।’ — তানিয়া থামল এবার।
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। ওর মন এবার কু ডাকতে শুরু করেছে। আবারও মনের মধ্যে- কিছু একটা হারিয়ে ফেলার শূন্যতা অনুভব করছে; যেমনটা অনুভব করত ওর মা মারা যাবার পরে।ধ্রুবর বুক ধুকপুক করছে; ও অতিষ্ট ভঙ্গিতে নিজের বুকের বা পাশটা কুর্তার উপর খামচে ধরলো।
ধ্রুবর অস্থিরতা বাড়ছে, ও বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো কটা কথা—‘হ-হো- হোস্টেলের সিসি টিভি ফুটেজ চেক করো তানিয়া। আ- আমি আসছি।’
ধ্রুব বাকি কথা শোনার আগেই; এক মুহূর্তের মধ্যেই বাইক এক টানেই ঘুরিয়ে ফেলল ভার্সিটির দিকে। তারপর বাড়িয়ে দিলো বাইকের স্পিড। আশপাশের গাড়ি-বাইক-সিএনজি চলছে; একটা বাইকের এত স্পিড দেখে সবাই বারবার তাকাচ্ছিল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর এসবে পরোয়া নেই। ওর ঘাম হচ্ছে ভীষণ; ও এক হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে, স্পিড বাড়াচ্ছে ক্রমশ! ওর বুক ধুকপুক করছে ভীষণ। যেন অদিতির কাছে উড়ে পৌঁছে গেলেই ওর শান্তি।
মায়ের পর আর কাউকে হারিয়ে ফেলার শক্তি সম্ভবত ওর আর নেই। ধ্রুবর বুক ব্যথা করছে; ক্রমশ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ও। মাথা ফেটে যাচ্ছে; আগের রোগের সিমটম দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব ঢোক গিললো। বিড়বিড় করে নিজের বুকের বা-পাশে চাপড় দিতে দিতে বললো—‘ও ঠিক আছে; সেইফ আছে। অল ইজ ওয়েল, অল ইজ ওয়েল!’
এসবের মধ্যে হঠাৎ করে ধ্রুব উপলব্দি করলো; ওর নিজের জীবনের থেকেও এখন ইম্পোরট্যান্ট কেউ আছে ওর জীবনে। যে হারিয়ে গেলে; যার গায়ে সামান্য আঁচড় লাগলে: ধ্রুব ইয়ামিন পাগল পাগল হয়ে যায়।সেই মেয়েটা এখন নিখোঁজ। তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; হারিয়ে গেছে ও।
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৪|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
একটা আয়োজিত,ঝমকালো রাত অদিতি হারিয়ে যাওয়ার খবরে যেন মুষড়ে পরলো। রাতের অন্ধকার বাড়ছিল ক্রমশ; সেই সঙ্গে বাড়ছে ধ্রুবর বুকের ব্যথাগুলো! ওই ব্যথাগুলো ধ্রুবকে উন্মাদ করে দিচ্ছে; ধ্রুব আজ যেন নিজের মধ্যেই নেই। কোনরকম নিজের মানসিক অসুস্থতাকে ঠেলে,এড়িয়ে ধ্রুব বাইক নিয়ে পৌঁছালো হোস্টেএল বিল্ডিংয়ে। অফিস রুমের সামনে যেতেই দেখে; রুমের সামনে অদিতির ডিপার্টমেন্টের অনেকেই জড়ো হয়ে আছে। অফিস ম্যানেজার হাক-ডাক ছেড়ে সবাইকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কিছু থেকে,বাকি সবাইকে চলে যাওয়ার জন্যে বারবার বলছে। ধ্রুব বাইকের চাবি পকেটে ঢুকতে ঢুকতে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বড়বড় পা ফেলে অফিস রুমে ঢুকে গেলো।
ধ্রুবকে দেখেই;ওরা কম্পিউটারের সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। ধ্রুব ধপ করে কম্পিউটারের সামনে চেয়ারে বসে গেল। পুরো হোস্টেলের গত দুই ঘণ্টার সিসিটিভি গুটেজ উন্মাদের ন্যায় চেক করে যেতে লাগলো একের পর এক!
পাশ থেকে ইমন ধ্রুবকে এভাবে মাউস-কিবোর্ড চাপতে দেখে, কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো—-‘ সিসিটিভি ফুটেজে কিছুই নেই, ধ্রুব।আমরা খুঁজেছি।’
ধ্রুব চোখ বুজে শ্বাস ছাড়লো! তবুও হাল ছাড়লো না, আবার লেগে গেল চেক করতে। ওর হাতের ভেইনসগুলো যেন এখন আরো বেশি ফুলে উঠেছে। ফোল্ড করা কুর্তার হাতার দিকটা নীল নীল ভেইনসে আরো আকর্ষণীয় হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ইমন সেগুলো দেখে চমকে উঠল! ধ্রুব..ধ্রুব কি আবার অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে? ওর মেন্টাল ট্রমা এলে ভেইনস ফুলে যায়; সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ারও রেকর্ড আছে।ইমন ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইল; এখন ধ্রুবকে কিছুই বলা যাবে না। এই মুহূর্তে ও বন্ধু-ফন্ধু দেখবে না।
পাশ থেকে তানিয়া বলল —-‘ভাইয়া, আমরা সব খুঁজে ফেলেছি, অদিতিকে দেখা যায়নি হোস্টেলের আশেপাশে।’
কিছু খুঁজে না পেয়ে ধ্রুব এবার হার মানল। কম্পিউটারের কিবোর্ড ছেড়ে দিয়ে; দুহাতে মুখ ঢলে, মুখে হাত চেপে বসে রইলো কিছুক্ষণ। যেন কিছু একটা ভাবছে সে। অদিতি- ধ্রুব, ধ্রুবর বাবা; রাজনীতি! এই ব্যাপারগুলো মেলানোর চেষ্টা করছে ও!
তারপর একদম হঠাৎ, ধ্রুব চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। বাকিরা তখনও অবাক চোখে এক উন্মাদ প্রেমিককে দেখে যাচ্ছিল।
ধ্রুব অফিস রুমের বাইরে গিয়ে সবার দিকে তাকাল। সবাইকে জহুরি চোখে দেখল; দেখল করো মুখের এক্সপ্রেশন কেমন। সবাইকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ধ্রুব তাই ওদেরকে সন্দেহ করলো না, বরং কথা তুললো; গমগমে স্বরে বললো———‘অদিতিকে কেউ দেখেছো আজ? কেউ দেখে থাকলে, কোথায় এন্ড কখন দেখেছিলে? মনে পরছে কিছু?’
পাশ থেকে এক ছেলে ক্লাসমেট কিছুটা উঁচু কণ্ঠে বললো—‘আমি দেখেছিলাম। ভার্সিটির গেইটের সামনে ওকে দেখা গেছিল লাস্ট বার; কতগুলো ছে..ছেলেদের সাথে।’
ধ্রুব থামল, জিজ্ঞেস করলো——‘ছেলেগুলোকে চেনো?’
ছেলেটা উত্তর দিল —‘মনে হয়না আমাদের ভার্সিটির কেউ। বাইরের কেউই লাগছিল।’
ধ্রুব চোখ বুজে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা কর! তারপর হুট করে কি মনে করে ছুট লাগাল সামনের দিকে। পেছনে ইমন দৌঁড়ে আসছে!
ধ্রুব ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। দারোয়ান তখন নক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। ধ্রুব ওর সামনে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করলো না আর। তাকে না জাগিয়েই, পকেট থেকে গেইটের চাবি বের করে গেইট খুলে ফেললো। ইমন ধ্রুবর কাণ্ড আর দারোয়ানকে এখনও মরার মতো ঘুমুতে দেখে ওর হাসি পেয়ে গেল। তবে ওর হাসি ঠোঁটে আসছে না; ধ্রুবর অতিরিক্ত উন্মাদনা দেখে।
ধ্রুব অফিস রুমের দিকে যেতে যেতে ইমনকে বলল ——‘অদিতি ভার্সিটি থেকে বেরোয় নি, তারমানে ভার্সিটির সিসিটিভি ফুটেজ দেখা লাগবে। তুই ম্যানাজার থেকে অফিস রুমের চাবি নিয়ে আয়, কুইক!’
ইমন হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো, বললো ——-‘কিন্তু চাবি তো উনারা আমাকে দিবেন না। তুই গেলে হয়তো তোকে—‘
ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে জবাবে বললো——‘ গিয়ে বল; ধ্রুব ইয়ামিন চেয়েছে; যা!’
ইমন এক দৌঁড়ে গেল। চাবি নিয়ে আসতেই ধ্রুব তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ম্যানেজার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে; সতর্কভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বলা যায়না এই বখাটে ছেলে আবার কোন কাণ্ড করে বসে। চাবি না দিলে চাকরি থাকবে না; আবার দিলেও বিপদ!
ধ্রুব কম্পিউটারের সামনে বসে দেখছে সব! পাশে ইমন ঝুঁকে আছে কম্পিউটারের দিকে। দুজনের তীক্ষ চোখ দুটো স্থির স্ক্রিনে।
হঠাৎ ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেল! ইমনও অবাক হয়ে বললো——-‘এই এই; এটা ওই ছেলেগুলো না? যাদের তুই পি//টিয়েছিলি তোদের ফ্যাক্টরিতে ঝামেলা করার জন্যে।’
ধ্রুব ঝুঁকে এলো অনেকটাই স্ক্রিনের দিকে। ভালো করে একেজনের কাজগুলো দেখলো ও। ওরা রাত নটা থেকে ভার্সিটির গেইটের সামনে ঘুরঘুর করছে। ধ্রুব বেরিয়ে আসার সময় যে যার জায়গায় লুকিয়ে পরেছিলো। ধ্রুব যেতেই আবার বেরিয়েছে।
যেইনা অদিতি বেরিয়েছে; ওরা সবাই মিলে ওর পিছু নিয়েছিল। অদিতি সেটা বুঝে ভয়ে সেটিয়ে, দ্রুত পা চালিয়েছিল। ওদের মধ্যে একজন আচমকা অদিতির সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর অদিতির ব্যাগ নিয়ে টানাহ্যাচড়া করলো কিছুক্ষণ, অদিতি ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। বারবার কিছু বলছে ওদের। তারপর ওদের সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। মুখোশ পড়া একটা ছেলে গাড়িতে বসা। ওই ছেলেগুলো অদিতিকে জোর করে গাড়িতে তুলে দিল। গাড়ি অদিতিকে নিয়ে চলে গেল। গাড়ি নম্বর—D189260
এসব কিছু দেখে ধ্রুবর রাগ আর দেখে কে! ও চেয়ার থেকে উঠে কম্পিউটার তুলে ফেলেছে হাতে,আছাড় দেওয়ার জন্যে। পাশ থেকে ম্যানেজার তটস্থ হয়ে চেয়ে আছে; ধ্রুবকে আটকাতে গেলেই বিপদ।
এদিকে ইমন দ্রুত ধ্রুবকে আটকে ফেলল—-‘কি করছিস? রাখ এটা, রাখ বলছি।’
ধ্রুবর হাত থেকে কম্পিউটার কেড়ে নিয়ে জায়গায় রাখলো ইমন। ধ্রুব রাগে হাঁপাচ্ছে; রাগে ওর কপালের রগ অব্দি ফুলে গেছে। চোখ-দুটো মারাত্মক লাল!
ধ্রুব এবার নিজের রাগে সহ্য করতে না পেরে পা দিয়ে লা/থি দিল চেয়ারে, চেয়ার ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে পরলো। ধ্রুব ওই ভাঙা চেয়ারটাকেই শুন্যে তুলে আ/ছাড় মারলো; গর্জে উঠলো ভয়ংকরভাবে—–‘শু/য়োরে/র বাচ্চাগুলো আমার কলিজায় হাত দেওয়ার সাহস কই থেকে পাইল?’
ধ্রুব আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না; ভাঙা চেয়ার ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসে। ইমন পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে। ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে যাচ্ছ; আর রাগে অন্ধ হয়ে পাশে যা পাচ্ছে তাতেই লা/থি বসাচ্ছে। ওর মেজাজ আজ যেন চুড়ান্ত উগ্র! ইমন ভয় পাচ্ছে; আজ ধ্রুব কাউকে খু//ন করেও ফেলতে পারে। ও কি করবে; কিভাবে সামলাবে ধ্রুবকে ভেবে পাচ্ছে না। ধ্রুব বাইকে উঠল, ইমন দ্রুত পেছনে উঠে বসলো।
বাইকের গতিও স্বাভাবিক না; পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ছুটছে। ইমন দুহাতে বাইক চেপে দোয়া-দুরুদ পড়েছে।যে স্পিড বাইকের; যেকোনো সময় ম/রে ভূত-টুত হয়ে যেতে পারে।
ধ্রুব ওই গ্যাংয়ের ডেরায় গিয়ে বাইক থামালো। বাইকের চাবি না খুলেই বড়বড় পা ফেলে এগুচ্ছিল, মাটিও হয়তো ধ্রুবর হাঁটাতে আজ ব্যথা পাচ্ছে। ইমন দ্রুত বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে, চাবি নিয়ে ধ্রুবর পিছু পিছু ছুটলো।
ছেলেগুলো তখন হই-হল্লোড় করে মেঝেতে বসে কার্ড খেলছিল। ধ্রুব সোজা ঢুকে মুহূর্তের মধ্যেই ওদের মধ্যমণি, শাহীনের কলার ধরে শুন্যে তুলে ফেলল। ওই অদিতির গায়ে হাত দিয়েছিল।
শাহিনের কলার ধরে শুন্যে তুলে ফেলতেই শাহীন বড়বড় চোখে তাকালো। কিচি বুঝে উঠার আগেই; ধ্রুব নিজের কপাল দিয়েই ওর নাকে একটা ঘু/ষি বসিয়ে দিল!
সঙ্গেসঙ্গে নাক দিয়ে ওর গলগল করে র/ক্ত পরতে লাগলো, ধ্রুব রীতিমত জা//নোয়ারে মতো ওই ছেলেটাকে মাটিতে নামিয়ে এবার ওর ঘাড় চেপে ধরে দেয়ালে মধ্যে ঠুকতে লাগলো, আর প্রতিবার হিং/স্র দা/নবের ন্যায় বলতে লাগল ———‘শি ইজ ম্যাই ওমেন, ম্যাই ওমেন। তুই কোন সাহসে ওর গায়ে হাত দিসোস, খা/নকি* পোলা!’
শাহীন আচমকা আ/ক্রমণ সামলাতে পারেনি। ওর গায়ে আর একটুও জোর নেই পাল্টা আ/ক্রমণ করার। ও বারবার, বারবার মাফ চাইতে লাগলো; কেঁদেই দিল ব্যথায়——‘ভা-ভাই, ম-মা-মাফ কইরে দেন। আ-আর হইবো ন-না।’
ধ্রুব বারবার, বারবার দেয়ালে ঠু/কছে ওর মাথা; এবার সিংহের মতো গর্জে উঠে বলল —‘কই আছে অদিতি? বল শু/য়োরে/র বাচ্চা!’
শাহিনের নাক-মুখ থে/তলে যাচ্ছে দেয়ালের সঙ্গে! ও হাপাতে হাপাতে বললো—-‘আ-আপনাদের আ..ভার..ভার্সিটির ভার্সিটির সামনে; আআ..ভাঙা পোড়াবাড়িতে…আ!’
বাকিরা ধ্রুবর এমন হিংস্র/তা দেখে শাহিনকে এই অবস্থায় রেখেই পালিয়ে গেল তাৎক্ষণিক। ইমন ওদের ধরতে চেয়েছিল পেছন থেকে; পারেনি।জানের ভয়ে ইমনকে রীতিমত ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
ধ্রুব এবার শাহীনকে মাটিতে ফেলে লা/থি দেওয়া শুরু করলো, একেকটা লা/থি শাহীনের পেট অব্দি পঁচিয়ে ফেলছে যেন!
শাহীনের কপাল ফেঁ/টে গেছে, চোখ উল্টে গেছে! যেকোনো মুহূর্তেই ম/রে যাবে। ইমন এবার দ্রুত ধ্রুবকে আটকাল; দুহাতে ধ্রুবকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গায়ের জোরে আটকাচ্ছে——-‘ও মরে যাবে ধ্রুব; খোদার কসম, থাম বন্ধু! থাম, অনেক হইসে; থাম;থাম!’
ধ্রুব তবুও থামছে না। ওর মানসিক অসুস্থতা এবার পুরোটাই এফেক্ট ফেলল শাহিনের উপর। শাহীন ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ধ্রুব ওর কলার ধরে ছিলো। কলার ওর হাত থেকে খসে গেল; লুটিয়ে পরলো শাহীন মাটিতে। ওই অজ্ঞান অবস্থাতেও আরো কয়েকটা লা/থি পরলো ওর শরীরে!
শাহীন হুশে নেই। ইমন দ্রুত ধ্রুবকে আটকে দিল, ধ্রুব নিজের মধ্যে নেই। ওকে শান্ত করতে হবে; নাহলে আজ যা হবে- তার জন্যে পরে দুজনেই ফেঁসে যাবে। ইমন দ্রুত গিয়ে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে ফেলল।
ধ্রুব কিছুক্ষণ ছোটাছোটি করল; ধস্তাধস্তি করলো। ইমন তবুও ছাড়লো না; বরং ধ্রুবর শক্ত পিঠে হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে দিতে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বলতে লাগলো—-‘কুল,ধ্রুব!! শান্ত হো ভাই, শান্ত হো!’
একটাসময় ধ্রুব ধীরে ধীরে শান্ত হলো। নেতিয়ে পড়ল ইমনের গায়ের উপর। ইমন ধ্রুবকে দ্রুত আগলে নিলো। বলল —-‘বাইক আমি চালাচ্ছি; তুই অসুস্থ!’
ধ্রুবর মনে পরে গেল আবার অদিতির কথা। ইমনকে ফেলেই এগিয়ে গেল বাইকের দিকে। বাইক চালাতে চেয়েছিল শুরুতে, ইমন ওকে সরিয়ে নিজে সামনে বসলো।
তারপর দিল এক টান। ধ্রুব অস্থির, বারবার বলছে জোরে চালাতে। ইমন হতাশ হয়ে নিজের বাইকের স্পিড দেখে, তো আরেকবার আয়নায় অস্থির ধ্রুবকে দেখে। ও পুরোটা রাস্তা নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিয়ে শান্ত করে রাখলো!
______________________
ভাঙা বাড়ির সামনে আসতেই ধ্রুব বাইক থেকে নামলো। দৌঁড়ে বাড়িটার সামনে। ধ্রুবকে আসতে দেখেই একেকজন হুড়মুড়িয়ে পালিয়ে গেল জায়গা ছেড়ে। ধ্রুবর এখন ওদিকে মন দেওয়ার সময় নেই। ওর পুরো মাথা-ভর্তি চেপে আছে—‘অদিতি, যেই মেয়েটা ভয় পায় ভীষণ ছেলেদের; ওই মেয়েকেই আজ ছেলেরা তুলে নিয়ে গেছে। ধ্রুব ওই মেয়ের সামনে একটা ছেলে হয়ে কি করে মুখ দেখাবে?’
দরজা খোলা; ধ্রুব উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল অদিতিকে। দড়ি দিয়ে ওর হাত বাধা, পা বাধা! ফেলে রেখেছে ওকে মেঝেতেই। শাড়ি এলোমেলো; চুল এলোমেলো। কামরার মেঝে জুড়ে লাল ছোপ ছোপ ভেজা র//ক্তের দাগ! ধ্রুব যখন দরজা ভেঙে ঢুকে তখন অদিতি নিভুনিভু চোখে দেখেছে ধ্রুবকে! ওর বুকে সাহস এলো যেন; বহু কষ্টে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলো ও——-‘ধ্রু….ধ্রুব!’
ধ্রুব দরজার সামবে বিধ্বস্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে; ওর চোখ টলমলে! ঘামে ভেজা পুরো গা; চুল এলোমেলো; কুর্তা অ্যাব্রো-থ্যাব্রো! অদিতির চোখ নিভে যাচ্ছে; বহু কষ্টে চোখ খুলে আছে সে। ওর চোখ-দুটো স্থির ধ্রুবর দিকে।
অদিতিকে এভাবে দেখে ধ্রুবর শরীর হেলে পরেছে যেন। পাঁচ-পাঁচটা ঘণ্টা পর মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখছে ও!রেখে গেছিল সহি-সালামত; অথচ পেলো র/ক্তা//ক্ত অবস্থায়! বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে ধ্রুবর অদিতিকে এভাবে দেখে। ইমন তখন দ্রুত অদিতির হাত-পায়ের বাঁধন খুলছিলো।
ধ্রুব উদ্ভ্রান্তের ন্যায়; ঢুলতে ঢুলতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে অদিতির দিকে।ও হাঁটু ভেঙ্গে; ঢুলতে ঢুলতে ধপ করে বসে পরলো অদিতির পাশে। ধ্রুব বসতেই, ইমন একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
ধ্রুবর ওর পাশে বসে টলমলে চোখে অসহায়ের মতো অদিতির দিকে চেয়ে রইল! তারপর কি হলো আচমকা! অদিতিকে ওই অবস্থায় দেখে ও নিজেকে আর একটুও সামলাতে পারলো না। দুহাতে আচমকা অদিতিকে টেনে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফেললো! অদিতি চোখ বুজে ফেলল;জোরে শ্বাস টানল! স্বাসকষ্ট হচ্ছে ওর এই মুহূর্তে; তার উপর ধ্রুবর এমন ছোঁয়া!
ধ্রুব আজ আর জাত-পাত, মান-সম্মান কিছু ভাবে না। শক্ত করে অদিতিকে জড়িয়ে ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ছেড়ে দিল। অদিতি চোখ বুজে আছে; ওর গায়ে একফোঁটা শক্তি নেই ধ্রুবকে আটকানোর; কথা বলে মানা করার।
হঠাৎ করে যেন ধ্রুবর ছোঁয়া ভালো লাগছে অদিতির; খরা বুকের মধ্যে এতক্ষণে যেন পানির ঢল নেমে এলো। অদিতি চোখ বুজে জুড়ে শ্বাস ছাড়ে, দুর্বল ভাবে গা পুরোটাই এলিয়ে দিল ধ্রুবর বুকে। ধ্রুব সঙ্গেসঙ্গে অদিতিকে আগলে ধরে; আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ওর যেন তাতেও শান্তি নেই। এই মেয়েটাকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে পারলেই আজ ওর শান্তি; তৃপ্তি!
ধ্রুব অস্থির আচরণ করছিল। অদিতির ঘাড় থেকে মুখ তুলে; চোখ মুছে অদিতির মুখটা দুহাতে আগলে ধরলো। বারবার ওর চুল গুছিয়ে দিচ্ছে, মাথায় ফুঁ দিচ্ছে; যেন ব্যথা কমে যায়। কি করবে, কি করা যায়; কি করলে মেয়েটা একটু শান্তি পাবে; ওর আত্মা ঠান্ডা হবে; ও নিজেও সেটা বুঝছে না।
ধ্রুব ছাড়ল ওকে! একটু সরে টলমলে চোখে চেয়ে রইল আহত অদিতির দিকে। ঢোক গিলে কাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো —-‘ঠ..ঠিক আছো ত..তুমি?’
ধ্রুবর কণ্ঠ যেন জমে আছে।ওর সারা শরীর কাঁপছে। ও কথা বলতে বলতেই কম্পিত হাতটা ধীরে ধীরে উঠিয়ে অদিতির মাথায় রাখল! শান্তিতে অদিতি চোখ বুজে ফেলল; এতক্ষণে…
হঠাৎ ধ্রুব হাতে ভে/জা র/ক্তের স্পর্শ অনুভব করতেই ওর রূহ অব্দি থমকে গেল। ধ্রুব ভয় পেয়ে গেল; হাত চোখে সামনে ধরলো; হাত-ভর্তি ট/কট/কে লা/ল র/ক্ত! ধ্রুব বিস্মিত; বিড়বিড় করলো—–‘র..ক্ত!’
ধ্রুব মাথা তুলে অদিতির দিকে তাকাল! অদিতির মাথা থেকে র/ক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে কানের পেছনে গড়িয়ে পরছে। ধ্রুব হতভম্ব হয়ে গেল! অদিতির দিকে তাকাল ও; অদিতি চোখ বুজে হেলে পরেছে ওর বুকের উপর।ধ্রুবর চোখ-গুলো আবার ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে!
ও হেলে পরা অদিতিকে দুহাতে আগলে ধরলো; অদিতির হাতটা চেপে ধরে কপালে চুমু খেলো শক্ত ভঙ্গিতে, দাঁতে দাঁত পিষে বললো-
‘অ্যাই প্রমিজ, ওরা একটাও বাঁ/চবে না। ধ্রুব ইয়ামিন ওদের একেকটা মাথা নিজের হাতে পি/ষবে!’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৫।
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
আকাশটা তখন ধীরে ধীরে রক্তিম হচ্ছিলো। অদিতি-ধ্রুবর ওই বন্ধ অন্ধকার ঘরটায় পূর্ব দিক হতে জানালা পেরিয়ে এক ছটাক আলো ছিটকে আসে। আলোটা সরাসরি ধ্রুব-অদিতির মুখের উপর লেপ্টে গেল যেন। আজ আলোরাও প্রেমের পক্ষে; ধ্রুব-অদিতির পক্ষে। ইমন পাশে হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; আলো গায়ে মেখে ধ্রুব, ও ধ্রুবর বুকের মধ্যে পরে থাকা অদিতিকে দেখতে স্বর্গীয় লাগছিল। ইমন বিড়বিড় করে মৃদু হেসে নিজের অজান্তেই বলে উঠলো—‘অ্যা..অ্যামেজিং!’
হঠাৎ করে ধ্রুবর কলার থেকে ধীরে ধীরে অদিতির হাতটা মাটিতে পরে গেল। ধ্রুব যেন চমকে উঠলো। দ্রুত অদিতির মুখ বুক থেকে সরিয়ে দুহাতের আজলায় তুলে ধরলো। অদিতির চোখ নিভু-নিভু; জ্ঞান হারাবে যেকোনো সময়। ইমন এদের জড়াজড়ি দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করেছিল। ও পাশ থেকে একসময় গলা পরিষ্কার করে; বললো—‘ধ্রুব আমাদের মনে হয় হাসপাতাল যাওয়া উচিত; ভাবি জ্ঞান হারাচ্ছে সম্ভবত।’
ধ্রুবর এবার টনক নড়ল! অদিতি ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ধ্রুব এরপর আর একটুও দেরি করলো না। সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কোলে তুলে নিলো নিজের শক্ত-পোক্ত দুহাতে। অদিতির হাত-দুটো ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরলো না; বরং নেতিয়ে পড়ল নিচের দিকে। ধ্রুব সেটা দেখে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানল। ওর কিছু ভালো লাগছে না। চারপাশ ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাইছে। ধ্রুব আজ সহ্য করছে; কাল থেকে ওদের ধ্রুব ইয়ামিনকে সহ্য করতে হবে!
ওই বা/স্টার্ডগুলোর কপালে কি নাচছে; সেটা হয়তো ওরা আন্দাজও করতে পারছে না।
__
ক্লিনিকে অদিতিকে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। রাত পেরিয়ে তখন সকাল ১০-টা! এখন অনেকটাই সুস্থ অদিতি। মাথায় তেমন ম্যাজর আঘাত লাগেনি: দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার কারনেই এই র//ক্তের উৎপত্তি।
ধ্রুব সেই ফজরের পর থেকে কেবিনের বাইরে বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে; ওর চোখ-দুটো জানালার বাইরে।।
ধ্রুব সেই ফজর থেকেই এভাবেই বসে আছে। এখানে আসার পর থেকে একবারও অদিতির মুখোমুখি হয়নি; উঠেওনি জায়গা থেকে। মাঝেমধ্যেই যখন অস্থির হচ্ছে- তখনই সিগারেট ধরাচ্ছে। এই নিয়ে পাঁচটা সিগারেট শেষ হয়েছে।
ধ্রুবর পাশে এসে ইমন বসলো। ধ্রুবর এমন শান্ত হয়ে বসে থাকা অদ্ভুত ঠেকলো ইমনের কাছে। ইমন একটাপর্যায়ে কাচুমাচু হয়ে বললো—‘ধ্রুব; ভাই তুই ঠিক আছিস?’
ধ্রুব জোরে শ্বাস টানল, শ্বাসের সঙ্গে যেন নিজের প্রতি অভিমান-অভিযোগ আর সমস্ত রাগ বেরিয়ে এলো! ও চুপ; দুহাতে মুখ চেপে ধরে ঘষলো। ইমন স্পষ্ট লক্ষ্য করছে; ধ্রুবর গা এখনো কাপছে; হাতে শিভারিং হচ্ছে ভীষণ। ইমনের নজরে এসব পরলে ইমন চিন্তিত ভঙ্গিতে ধ্রুবর হাত চাপলো; বললো—-‘তোর এখন মেডিসিন নেওয়া উচিত ধ্রুব। তোর হাত কাঁপছে।’
ধ্রুব ইমনের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে গা-ছাড়া ভাবে বলল—-‘আ’ম ফাইন।’
ইমন ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবকে দেখে।নিজে এতটা অসুস্থ ; অথচ চিন্তা করে যাচ্ছে অদিতিকে নিয়ে। অনেকক্ষণ পর কি মনে করে ধ্রুব এবার নিজে থেকে হঠাৎ বলে বসলো——-‘ য..যদি আজ ওর কিছু হয়ে যেত; আমি কি করতাম ইমন?’
ধ্রুবর কণ্ঠটা যেন কেঁপে উঠলো। গলায় যেন কিছু জমে আছে। বারবার ঢোক গিলছে ধ্রুব; ওর গলার অ্যাডমস-অ্যাপল নামছে-উঠছে বারবার। ইমন ধ্রুবকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে হাত রাখল ওর কাঁধে। ভরসা দিয়ে বললো—‘কিন্তু কিছু হয়নি রাইট? তুই প্লিজ, এবার একটু নরমাল হ ভাই!’
ধ্রুব আবারও অস্থির ভঙ্গিতে মুখটা দুহাতে চেপে ধরে ঘষলো, তারপর থেমে থেমে বলল ——-‘আমার লাইফে আমি যখনই কিছু মন থেকে চেয়েছি; ওগুলা আমার লাইফ থেকে ভ্যানিশ কেন হয়ে যায়, ইমন? অ্যাই ওয়াজ ইন ডার্ক; ও আমার লাইফের একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। আমি ধীরে ধীরে রিককোভারি করছিলাম। কিন্তু আবার আমার লাইফ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আজ আমার শত্রুতার জন্য অদিতির উপর হা/মলা হয়েছে। অদিতি এসব ডিজার্ভ করেনা। আমি ওর লাইফে আসায় ওর উপর হা/মলা হয়েছে। তুই বুঝতে পারছিস; অদিতির মতো মেয়ে আজ আমার জন্যে এতটা সাফার করছে। সবকিছুর মূলে আমিই! অ্যাম অ্যাই রং পারসন ফর হার, ইমন?’
ইমন হতভম্ব। যে ধ্রুব ইয়ামিনের জন্যে পুরো একটা ভার্সিটি পাগল; সেই ছেলে নিজেকে একটা অজপাড়া গ্রামের অদিতির যোগ্য মনে করছে না। ইমন নিজেকে সামলে বললো;——-‘তোর দুজন পারফেক্ট কাপল হবি। আর গতরাত যা হয়েছে এসব ভাগ্য ধ্রুব। তোর এতে দোষ নেই।’
ধ্রুব মানেনা; বলে যায় শুধু—-‘ওর কিছু হলে আমি নিজেকে কখনোই মাফ করতে পারব না। আমি আজ ওর সামনে দাঁড়াতে পারছিনা। তুই বুঝতে পারছিস সিচুয়েশনটা, ইমন? ওই শু/য়ো/রের বাচ্চাগুলো আমার কনফিডেন্ট; আমার মুখ অদিতির সামনে কতটা ছোট করে ফেলেছে।’
ইমন কি বলে ধ্রুবকে বোঝাবে বুঝতে পারছে না। সত্য বলতে; ঘুরেফিরে সবকিছুর মূলে ধ্রুবই।ধ্রুব এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছে; যেখানে ওর শ/ত্রুর সংখা নেহাত কম নয়। আজ অদিতির মতো একটা সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট মেয়ের উপর হা/মলা হওয়া অনেক বড় ব্যাপার। ইমন তবুও বন্ধুর খাতিরে বলে——‘তুই অযথা ভাবছিস; ধ্রুব। এসব আগে থেকেই লেখা ছিলো কপালে। তুই নাস্তিক নস যে, কপালের লেখা বিশ্বাস করবি না।’
ধ্রুব শোনে! ওর মন তখন কঠিন কিছু হিসেব কষতে ব্যস্ত! যেন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে: বড় কিছু ঘটানোর। ওর চোখ-দুটো তখনও অদিতির কেবিনের দিকে চেয়ে রয়েছে অপলক! ধ্রুব এখনো একবারও মেয়েটার মুখোমুখি হয়নি। ও আজ যেভাবে ওই মেয়েকে স্পর্শ করেছে; তাতে হয়তো ওকে চুড়ান্ত খারাপ; চরিত্রহীন মনে করেছে অদিতি। ধ্রুব লজ্জা; আর নিজের এমন বোকামোর মতো কাজে নিজেই চুড়ান্ত বিরক্ত এবং রাগান্বিত। অদিতিকে এভাবে ওর অসহায় অবস্থায় ছোঁয়াটা উচিত হয়নি। ও সিউর; আজকের পর ওই মেয়ে লজ্জায় আর ওর সামান এসে দাঁড়াবে না।
অদিতির কেবিনের ভেতরে তানিয়া; আর দুটো মেয়ে। ওদের ধ্রুব ফোন করে আনিয়েছে।অদিতি বেডে শুয়ে আছে; সেলাইন চলছে। ওর পাশে বসে আছে তানিয়া। নানাকিছু বলে ওর মনটা শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল ওরা। অদিতি ওদের কথা শুনে; তেমন মনোযোগ না দিয়েই হু-হা করছে শুধু।একসময় তানিয়া কথা থামিয়ে, ওর দিকে চাইলো। বিব্রত ভঙ্গিতে বললো—-‘অদিতি; একটা কথা বলার ছিলো।’
অদিতি সিলিং ফ্যানের দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল—-‘বলো।’
তানিয়া গলা পরিষ্কার করে, দোনামোনা গলায় বললো——‘আজকের ঘটনাটা তোমার ফ্যামিলিতে জানিও না। ওনারা হয়তো ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না।তাছাড়া ধ্রুব বলেছিলো…’
তানিয়া থেমে যায়। অথচ তখনমাত্রই অদিতি কান পেতে, মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেয়েছিল, কি বলেছে ধ্রুব? তানিয়া থেমে গিয়ে বললো—-‘তোমার ছুটি মঞ্জুর করেছে ভার্সিটি। তোমার যা লাগে এ কদিন আমাকে বলিও।’
অদিতি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ শুয়ে থাকল বিছানায়। ওর চোখে ভাসছে গতরাতটা। অদিতি অপহরণ হয়েছিল। ধ্রুব ওকে বাঁচিয়েছে; ধ্রুবর পাগলামি সব ধীরে ধীরে অদিতির চোখের সামনে ভাসে।ওর গায়ে এখনো সম্ভবত ধ্রুবর পারফিউমের গন্ধ মেখে আছে। অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ওর গা একটা ছেলে ছুঁয়েছে; অথচ আজ অদিতির খারাপ লাগছে না। বরং বারবার মনে হচ্ছে, ধ্রুব ওর জন্যে আজ কতটা উন্মাদ হয়েছিলো। কিন্তু ধ্রুব কবে থেকে ওকে…
___________
চার ঘন্টা পর অদিতিকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে। ওকে নিয়ে বেরিয়েছে তানিয়ারা কেবিন থেকে! অদিতির গায়ে চাদর; কপালে ব্যান্ডেজ! মুখটা মলিন হয়ে আছ ওর, হাতে এখনো ক্যানুলা লাগানো। শাড়ি খুলে ফেলে সাধারণ কামিজ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ডাক্তারের কথামত। অদিতি বেরিয়ে আসতেই; ধ্রুব দ্রুত বেঞ্চ থেকে উঠে গেল। অদিতি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ছিলো। দুজনের চোখে চোখ পরলো; ধ্রুবর চোখে ছিলো অসহায়ত্ব আর অদিতির চোখে নিরবতা। ওই দুই মিশ্র অনুভূতি দুজনের হৃদয় গিলে নিল; দুজনেই ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে ফেলল।
ধ্রুব আর এগিয়ে গেল না অদিতির দিকে, সেখানেই দাঁড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে ক্যাব বুক দিল। ইমন পাশ থেকে দুজনের এসব কাজ-কারবার দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুজন লাভারের মধ্যে সে এক অবলা প্রাণী!
ওরা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে; নিচে নেমে ক্যাবে উঠল অদিতি। ধ্রুব আলগোছে ওর দিকে না চেয়েই গাড়ির দরজা আটকে দিল। তারপর ড্রাইভারের জানালার দিকে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভারকে লোকেশন বুঝিয়ে দিল।ড্রাইবারের সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিল; ততক্ষণ অদিতি
অপলক চেয়ে ছিলো ধ্রুবর দিকে। যেই ধ্রুবর চোখ পরলো ওর দিকে; সঙ্গেসঙ্গে মেয়েটা দ্রুত ধ্রুবর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর সরে এসে বাইকের দিকে এগুলো!
ক্যাব থেমেছে হোস্টেলের সামনে। অদিতি নেমে দাঁড়ালো ক্যাব থেকে।
ধ্রুব অনেক আগেই এসেছে এখানে। ইমনকে চলে যেতে বলে, ও বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। অদিতির সঙ্গে কথা আছে ওর! ধ্রুব তানিয়াদের ইশারা করলো; চলে যেতে! ওরা অদিতির দিকে একবার চেয়ে হোস্টেলে ঢুকে গেল; অদিতিও ওদের আটকালো না। এমনিতেই মেয়েগুলো ফজর থেকে অনেক করেছে ওর জন্যে। তাই ও একা-একাই হেঁটে যেতে লাগল হোস্টেলের দিকে।
‘অদিতি!’
পেছন থেকে ধ্রুব বড্ড আবেগী কণ্ঠে ডেকে বসলো।অদিতির বুকটা কেঁপে উঠল এই ডাকে! চাদর গায়ে ও ধীরে ধীরে ফিরে তাকাল। ধ্রুব তখন বাইকের সঙ্গে হেলান দিয়ে দুহাত আড়াআড়ি বুকের উপর ভাঁজ করে অদিতির দিকে কেমন করা চোখে চেয়ে আছে। ওই মাতাল-মাতাল চাওনিতে অদিতির হৃদয়টাই নড়ে উঠল যেমন; ও চোখ সরিয়ে ফেলল! অপেক্ষা করল ধ্রুব কিছু বলবে।
ধ্রুব ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল, এগুলো না সামনে। ওর চোখ দুটোতে এখনো মারাত্মক ভয় লেপ্টে আছে। বুকের উন্মাদনা এখনো কমাতে পারেনি। আজ কিছু একটা হয়ে যেতে পারত, ও হয়তো ওই মেয়ের হাসিটুকু হারিয়ে ফেলতে পারত! অনেক, অনেক কিছুই আজ ঘটতে পারত! ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়াল। ও আজ এলোমেলো-কাহিল ভীষণ। ওর এই কথাটা এখন; এই মুহূর্তে না বললে আজ ও সম্ভবত পাগল হয়ে যাবে।
ধ্রুব ওভাবেই শরীরটা জোরপূর্বক দাঁড় করিয়ে রাখলো; অদিতির ফাঁপা চোখটার দিকে চেয়ে রইল অপলক; অতঃপর অদিতিকে অবাক করে দিয়ে একপর্যায়ে চুড়ান্ত বিধ্বস্তের ন্যায় বলে উঠলো—‘অ্যাই লাভ ইউ!’
অদিতি ভীষণ অবাক হয়ে মাথা তুললো! ওর চোখ-দুটো ধ্রুবর চোখে! ও জানত! আজ রাতে যা হয়েছে; তাতে ও যা জানার জেনে গিয়েছিল।কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি…
ধ্রুব হাত ছাড়লো বুক থেকে; ধীরে পায়ে এগুচ্ছে। অদিতি ধ্রুবর দুই চোখের দিকে অপলক চেয়ে আছে। মানুষটা এক রাতেই এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে?চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
ধ্রুব ধীর পায়ে এগিয়ে এলো অদিতির মুখোমুখি। অদিতি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এমন একটা মুহূর্তে কি বলা উচিত ওর? ও তো তেমনি অনুভব করে এই মানুষটার জন্যে! কিন্তু ও অদিতি, ভালোবাসা ওর জন্যে পা/প। ও যা-তা বলা শুরুলো—-‘ আ..আপনি ভুল করছেন!’
‘হুশশ!’ —- ধ্রুব হিসহিসিয়ে উঠল!
অদিতি থেমে গেল; কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলল। ধ্রুব কথা বাড়াল না; অতিরঞ্জিত কিছুই বলল না। শুধুমাত্র অদিতির কপালের ওই সাদা ব্যান্ডেজটায় হালকা ভাবে আঙুলে ছুয়ে, অদিতির গোলগাল-সরল ওই মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্যান্ডেজটা ছুয়ে দিতে দিতে শুধু বলে গেল নিজের কথাগুলো——‘কিচ্ছু এক্সপ্লেইন করবো না; কিচ্ছু বোঝাতে যাবো না আজ; না তোমার কাছে কিছু শুনবো। শুধু এটুকু বলবো, আমার পক্ষে আর হচ্ছে না। আমি পারিনি আর আটকে রাখতে এসব! যদি আজকের রাতটায় কিছু একটা….
ধ্রুব থামে, কথাগুলো আর বের করতে পারলো না। ওর গলা কাঁপছে! রাতের স্মৃতিটুকু ভুলতে চাইছে যত ততই যেন চোখের সামনে সেগুলো হানা দিচ্ছে।
অদিতি তখনও চেয়ে আছে; ওর চোখ এলোমেলো না আজ! ও নির্নিমেষ দেখে যাচ্ছে পাগল-ক্ষ্যাপাটে ধ্রুবকে, যাকে আজ রাতে অদিতি ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে।
ধ্রুব একটু থেমে ঢোক গিলে অন্যদিকে চেয়ে। পরপর অদিতির দিকে ফিরে চায়! এবার আর জড়তায় নয়; বরং স্পষ্ট গলায় বলে বসে ——‘আজকের রাতটা আমি কখনো ভুলবো না; তেমনি আমি তোমাকেও কোনোদিন ভুলতে দিব না। ফ্রম নাও; ধ্রুব ইয়ামিন ইজ বুকড টু দিস অদিতি হায়াত; ফরএভার ফরএভার!
আমার কথা শেষ; এখন তুমি চাইলে সবসময়ের মতো ছুটে পালিয়ে যেতেই পারো।’
অদিতির কানের কাছে তখনও ভেসে যাচ্ছে—-‘ধ্রুব ইয়ামিন বুকড টু অদিতি; ফরএভার ফরএভার।’
তারপর..তারপর হঠাৎ অদিতির ভয় বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে মনের প্রজাপতিগুলো পিষে গেল। চোখে ভেসে আসতে লাগলো, অদিতির বাবা, একটা সালিশ; গ্রামের কজন মানুষ; আর একটা পরিবারের দুর্বিসহ জীবন! ও এই ঢাকা শহরে কেন এসেছিল;আর কি করে যাচ্ছে এখন?
ধ্রুবর হাতটা তখনও অদিতির ব্যান্ডেজ ছুয়ে ছিলো। অদিতি আচমকা পিছিয়ে গেল; ধ্রুবর আঙুল ব্যান্ডেজ থেকে সরে যেতেই ধ্রুব তাকালো ওর দিকে। অদিতি ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে পেছাচ্ছে, ওর মুখটা ভয়ার্ত! ও এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চাপা স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলো——‘ এটা হয়না… সম্ভব না! আমার কাউকে ভালোবাসার অধিকার নেই! নেই, ক…কিচ্ছু নেই।’
ধ্রুব সেসব শুনতে পায়না। ও অদিতির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রয়েছে। অদিতি পেছাতে পেছাতে একর্যায়ে ঘুরে গিয়ে দৌড়ে হোস্টেলের গেইটে ঢুকে গেল। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল! এই রিয়েকশনটাই তো ও আশা করেছিল।
#চলবে