আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
97

#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৬|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

ধ্রুব বাড়িতে যখন পৌঁছেছে তখন প্রায় দুপুর বারোটা বাজে। এলোমেলো ধ্রুব একপ্রকার ঢুলতে ঢুলতে বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছিল; ড্রয়িং রুমে নিজের সৎ মা আর বাবাকে দেখে ধ্রুব সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। ধ্রুবর ফুরফুরে মেজাজ যা ছিলো সেটা মুহূর্তের মধ্যে ধুলিস‍্যাৎ হয়ে গেল, ধ্রুব দাঁতে দাঁত পিষে ঘরে ঢুকলো। সৌরভ সৌরভ ইয়ামিন ছেলের রাগান্বিত মুখটা দেখে তৃণার দিকে তাকালেন। তৃণা দুজন বাবা-ছেলের মুহুর্তকার দন্ধ দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উঠে চলে গেল পাশের রুমে। ওরা বাবা-ছেলে এখন প্রতিবারের মতো অসভ্যদের ঊর্ধ্বে যত খারাপ ভাষা আছে সেগুলো নিয়ে তর্ক করবে। তৃণা সম্ব্রাম্ত পরিবারের মেয়ে, এসব কাচা ভাষা কখনো শুনে অভ্যস্ত নয়। অথচ এই একটা পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আজ অব্দি কোনো গা/লি বা কাচা ভাষা নেই; যেসব ও শুনেনি। ধ্রুবকে শুরুতে নিজের আদর-ভালোবাসা বোঝাতেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই বেয়াদব-একরোখা ছেলে বুঝেনি ওকে। বরং একবার সবার সামনে চরম অ/পমান করার পর; তৃণা লজ্জায় আর এই ছেলের সামনে যায়না।

মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে ওর-ও, ডিভোর্স দিতে মন চায় সৌরভকে। কিন্তু শেষ অব্দি সৌরভের মুখের দিকে চেয়ে পারেনা। বুড়ো হচ্ছেন; ছেলে একটা থেকেও নেই। সেখান থেকে তৃণা চলে গেলে; সৌরভ পাগল হয়ে যাবেন একাকিত্বে। তাই এখন-ও মুখটা বুজে ও রয়ে গেছে!

তৃণার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো ধ্রুব। সৌরভ কফি খেতে খেতে পেপার হাতে তুলে নিয়েছেন। তৃণা এ বাড়িতে আসা উনার জন্যে স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও; ধ্রুবর জন্যে সেটা বিষ সমতুল্য। এই বাড়িটা ওর মায়ের হাতে সাজানো; সেখানে আরেকটা নারী এসে রাজত্ব চালাচ্ছে; ধ্রুব সেটা একদমই কেন যেন সহ‍্য করতে পারেনা।

ধ্রুব কুর্তার হাতা ফোল্ড করে; এগুতে এগুতে বললো——-‘ওই মহিলা আমার মায়ের বাড়িতে আজ কি করছে?’

ধ্রুব গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সৌরভের মুখোমুখি; জবাব চাইলো তার তথাকথিত ‘বায়োলজিকার ফাদারের’ কাছে। ওর চোখ-দুটো রাগান্বিত!

সৌরভ পেপার হাত থেকে না নামিয়েই; জবাব দিলেন—-‘ও মহিলা না, তোমার ওকে ছোট মা বলা উচিত; অন্তত যতদিন আমি জীবিত আছি।’

ধ্রুব শব্দ করে হেসে ফেলে; যেন ভীষণ মজার কথা শুনে ফেলেছে ও। সোফায় বসে কুশন কোলে নিয়ে সেটায় হাত ঠেসে বসে। হেসে হেসেই বলল—-‘তোমাকেই বাবা মানি না; সেখানে আর ওই মহিলা? জোকস অফ দ্য ইয়ার।’

ধ্রুবর হাসি যেন সৌরভের সামনে ভীষণ চুড়ান্ত বেয়াদবি লাগল। সৌরভ পেপার নামলেন; ধ্রুবর ওই হাসিহাসি মুখের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললেন———‘যাকে তুমি বাবা হিসেবে মানো না; তার টাকা-পয়সার উপরেই তোমার এই ফুর্তিগুলা চলছে। বাবা না মানার সঙ্গে সেগুলো অস্বীকার করা উচিত তোমার, রাইট?’

ধ্রুব আবারও হাসল; তারপর হাসি থামিয়ে বললো——-‘আমি অস্বীকার করছি। ইট’স লাইক আ… গিভ এন্ড টেইক। আমি তোমার কাজে আসছি; তুমি আমাকে পয়সা দিচ্ছ। এন্ড তুমি নিজেও জানো ধ্রুব নেই; তো তুমিও ফিনিশড!’

ধ্রুব নিজের গলার দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করলো; ওর চোখ-দুটো হাসছে! যেন সৌরভকে চোখে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলছে— দেখ; নিজের ছেলে আজ তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার দেখাচ্ছে। মানুষ করতে পারলে না ছেলেকে।

সৌরভের বুকটা ভার হয়ে আসছে। কিন্তু ধ্রুবকে সেটা বুঝতে দিলেন না। কাকে বোঝাবেন নিজের ব্যথাগুলো? এ মানুষ নয়, হা/য়না একটা। দয়া-মায়া নেই! না আছে কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ!

সৌরভ আবারও পেপার হাতে তুলেন; পেপার পড়তে পড়তে বললেন——‘কিছু বলতে এসেছো?’

ধ্রুবর মুখ এবার গম্ভীর হয়ে আসে।ও পকেট থেকে কতগুলো ছবি বের করে টেবিলের উপর ছড়িয়ে ফেলে দিলো। পেপার থেকে চোখ সরিয়ে সৌরভ ছবি-গুলোর দিকে তাকালেন। ছবির লোকজনের গতরাতের খবর উনার কানেও এসেছে। তবে তিনি সেটা জানেন;এসব ধ্রুবকে বুঝতে দিলেন না।

ধ্রুব ছবি-গুলোর দিকে দাঁতে-দাঁত পিষে তাকিয়ে আছে; বললো——-‘এই ছেলেগুলোকে আজ সন্ধ‍্যার মধ্যে আমার সামনে চাই; একসম ফিটফাট অবস্থায়; বাকিটা আমি দেখে নিব।’

সৌরভ ছবিগুলো হাতে নিলেন। ধ্রুব সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। সৌরভ ছবির ছেলেগুলোকে দেখে নিয়ে বললেন—-‘এরা তো এমপি কামরুলের ছেলেপেলে। সেদিন আমার ফ্যাক্টরিতে ঝামেলা করেছিলো।’

কথাটা কানে আসা মাত্রই ধ্রুবর রাগের পারদ হুট করে যেন চিরিক দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। ও হঠাৎ সৌরভের দিকে ঝুঁকে এসে হিসহিসিয়ে উঠলো—-‘হ্যাঁ; আজ তোমার জন্যে আমি একটা পুরো রাত সাফার করেছি। এখন তুমি এটার প্রায়শ্চিত্ত করবে। তোমার ঘেউঘেউ দলকে বলে এগুলারে এনে দাও। বলে দাও যে; সন্ধ‍্যার পর আমি ধ্রুব ইয়ামিন ওদের সঙ্গে হকি খেলতে চাইছি।’

ধ্রুবর চোখ থেকে যেন লাভা ঝরছে। ওর কথা বলার ধরন শুনে মনে হচ্ছে: যেন সৌরভই অদিতির কিডন্যাপের পেছনে দায়ী।

সৌরভ বাঁকা চোখে তাকালেন; ছেলের চোখে চোখ মিলিয়ে বললেন——‘তুমি চাইলে নিজে এই কাজ এক্ষুনি করে ফেলতে পারো; এখান আমাকে কেন লাগবে?’

ধ্রুব এবার হেলান দিয়ে বসলো সোফায়; বললো—–‘পারি; বাট নাও আ’ম টায়ার্ড! এখন একটা ঘুম দেবো; সন্ধ‍্যার জন্যে এনার্জি দরকার।’

সৌরভ সেক্রেটারি রাহুলকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। রাহুল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছবিগুলো হাতে তুলে নিল। ধ্রুব কুশন ফেলে উঠে গেল সোফা থেকে। সৌরভ বললেন—-‘ ছেলেগুলোকে মেরে ফেলিওনা। সামনে ইলেকশন আছে। হাত নোংরা করলে বিপদ!’

ধ্রুব সৌরভের দিকে তাকালো; ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রহস্য করে বললো——‘মারা লাগবে না। না মেরেই এমন অবস্থা করবো যে বাঁচতে ইচ্ছে করবে না আর।’

সৌরভ তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ধ্রুবর এমন আচরণের পেছনে মূল হোতা তো উনি নিজেই! তাই ধ্রুবর এমন কথা তাঁকে খুব একটা অবাক করতে পারলো না। আর যেখানে বিষয়টা অদিতিকে ঘিরে; সেখানে এসব কিছু ভীষণ স্বাভাবিক ব্যাপার।

ধ্রুব সিঁড়ির সামনে গেলে; পেছন থেকে সৌরভ প্রশ্ন করলেন——-‘সেই মেয়েটা কি এখন ঠিক আছে?’

ধ্রুব থেমে গেল; কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাল না। ওর চোখে ভেসে এল অদিতির ওই সরল;ভয়ার্ত মুখটা! ধ্রুব চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো; সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো-—‘এখন থেকে ঠিক থাকবে।’

কথাটা বলে ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে সিড়ি দিয়ে উঠে গেল। সৌরভ রাহুলের দিকে তাকালেন; রাহুল স্যারের তাকানোর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চশমার আগা নাকের উপরে উঠিয়ে জবাব দিলেন—-‘আজ প্রপোজ করেছেন ধ্রুব স্যার ওই মেয়েকে।’

সৌরভ ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে থেজে জবাব দিলেন—-‘নজরে রাখো। মেয়েটা আজ তোমার নজরে থাকা অবিস্থাত কিডন্যাপ কি করে হয়ে গেল, আমি তো সেটা চিন্তা করেই অস্থির! ঘোড়ার ঘাস কাটছিলে তুমি তখন?’

রাহুল আইপ্যাড হাতে কাচুমাচু গলায় জবাবি দিল—-‘আপনি বলেছিলেন ওরা দুজন একসঙ্গে থাককে নজর রাখতে। স্যার ওইদিন চলে এসেছেন; তাই আমিও —-‘

‘রা/স্কেল!’ ——-সৌরভ ধমকে উঠলেন।

রাহুল কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। সৌরভ টেবিল থেকে মোবাইল হাতে নিলেন। রুমে যাওয়ার আগে রাহুলের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে গেলেন——‘সামনে ইলেকশন; মেয়েটার উপর নজর রাখো। আরেকবার যদি ওই মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে; মনে রেখো ধ্রুব তাণ্ডব চালাবে বাড়িতে। একরাতেই ও ওই মেয়ের জন্যে আগামী বছরগুলোতে কি করবে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে; আমি কোনো রিস্ক নেব না।’

‘জী স্যার।’—- রাহুল দ্রুত সায় দিল!
_____________

অদিতি চা কেটলি থেকে কাপে ঢালছিলো। চায়ের কাপ থেকে চা উপচে পরছে; ওর এতে মন নেই। মন তো দিয়ে বসেছে অন্য কাউকে।বারবার ধ্রুবর বলা —-‘ অ্যাই লাভ ইউ অদিতি।’ কানে সানাইর মতো বেজেই চলেছে ক্রমাগত। হাতে ওর কাজ উঠে না;পড়াশানা ভালো লাগে না। সারাক্ষণ চোখের সামনে বখাটে ধ্রুব এলোমেলো কুর্তা গায়ে হেঁটে বেড়ায়; তার ওই মদ‍্যক ওই চোখের চাওয়া; অদিতির ব্যান্ডেজে তার আঙ্গুলের ছোঁয়া! এসব কিছু অদিতির রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে অদিতি এলোমেলো হয়ে পরছে। ছন‍্যছাড়া-বাধনহারা মনের বিবাদে ও ক্লান্ত ভীষণ! ওর অবস্থা করুন! একদিকে ওর পরিবার, অন্যদিকে প্রেম। দু-দিকের দন্ধে অদিতি মাঝখানে পিষে যাচ্ছে।

‘অ্যাই অদিতি; চা পরে যাচ্ছে তো।’ —-তানিয়া অদিতিকে ধাক্কা দিয়ে উঠলো!

ভাবনার মধ্যেও চমকে উঠলো অদিতি। দ্রুত হাত থেকে কেটলি রেখে দিল। পুরো চা-য়ে ভেসে যাচ্ছে টেবিল। অদিতি দ্রুত কাপড় এনে জায়গা পরিষ্কার করে ফেলল। তানিয়া এসব দেখছিল; ও বললো——‘তোর ইদানিং কি হয়েছে? এমন খুইয়ে-খুইয়ে টাইপ হয়ে গেছিস কেন?’

অদিতি হাসার চেষ্টা করে চায়ের কাপ হাতে নিলো; বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো——‘ কই? তেমন কিছুই না।’

তানিয়া ওর বেডে বসে অদিতিকে দেখে যাচ্ছে। চা খেতে খেতেও মেয়েটা অন্যমনস্ক! তানিয়া হঠাৎ ঠোঁট টেনে হেসে বললো—-‘ তুই প্রেমে পরেছিস নাকি রে? ধ্রুব ভাই জানে?’

অদিতি চমকে উঠে দ্রুততার সাথে জবাব দিলো—-‘না, না! আমি ওমন মেয়ে নই।’

তানিয়া ভ্রু বাঁকালো; বললো—-‘ওমন মেয়ে মানে? প্রেম করা পা/প নাকি?’

অদিতি ঠান্ডা গলায় জবাব দিল——‘আমি যে জায়গা থেকে এসেছি; সেই জায়গায় প্রেম শুধু পা/প না বরং মহাপা/প! তুমি আমাদের বাড়িতে গেলে বুঝবে।’

তানিয়া অবাক হয়ে তাকাল অদিতির দিকে। এই যুগে এসেও এমন গ্রাম হয় নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার! পরপর ও হঠাৎ ধ্রুবর কথা মনে পরায় গা-ছেড়ে বেডে হেলান দিল ফোন হাতে; একপ্রকার অদিতির কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো—-‘তোর ধ্রুব ভাই আছে; তোর আবার কিসের চিন্তা! নিশ্চিন্তে থাক।’

তানিয়া ফোন দেখছে। অদিতি তানিয়ার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল—-‘তা..তাকে নিয়েই সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার; তুমি যদি জানতে।’

তানিয়া ফোন দেখছিল! হঠাৎ ও একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বসলো। অদিতির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখালো——-‘এই অদিতি; দ্যাখ! দ্যাখ।’

অদিতি ফোনের দিকে ঝুঁকে লেখা-গুলো পড়ছে—— ‘এমপি কামরুলের দলের চারজন ছেলে নিখোঁজ; খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দুদিন ধরে।’

ক্যাপশনের নিচে ছেলেগুলোর ছবি দেওয়া।ছবির লোকগুলোকে দেখে অদিতি চমকে উঠে। এরা তো ওকে সেদিন কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিলো।

তানিয়া চোখ-মুখ উজ্জল করে; স্বস্থির শ্বাস ফেলে বললো——‘দারুণ হয়েছে।এগুলো নির্ঘাত ধ্রুব ভাইর কাজ! তোকে নিয়ে একরাতেই যা করেছে; এরপর উনার আর রিস্ক নেওয়ার কথা না।’

তানিয়ার হেসে হেসে কথা-গুলো বললেও অদিতির বুক কাঁপতে লাগল! ও জিজ্ঞেস কর—-‘ ওরা কি বেঁচে থাকবে? নাকি..’

তানিয়া গা-ছাড়া ভাবে বেডে শুয়ে পরলো; জবাব দিল——‘মনে তো হচ্ছে না। ভাইকে যেভাবে নাচিয়েছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে টপকে গেছে।’

অদিতির গা হিম হয়ে এলো! ওর জন্যে কিছু ছেলেকে ধ্রুব খু/ন করেছে?. আইন হাতে তুলে নিয়েছে? ধ্রুবর বাবা মন্ত্রী; চাইলেও ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া সম্ভব ওদের মতো মানুষদের কাছে। কিন্তু ধ্রুব নিজে…

অদিতির হয়রান লাগতে শুরু করলো! ও যা-যা দেখছে; এসবকিছু ওর হজম হচ্ছে না। ও দ্রুত টেবিলে থেকে পানির গ্লাস তুলে নিলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতে অদিতির কি করা উচিত? এ কোন পাগল প্রেমিকের খপ্পরে পরলো ও?
_____
তারপর কেটে গেছে কটাদিন! অদিতি এখন বেশ সুস্থ! নিয়মিত ভার্সিটি আসা-যাওয়া করছে। তবে ধ্রুবকে এড়িয়ে চলছে নিয়মিত। অদিতি চায়না; সেদিনের ঘটনার পর ধ্রুবর মুখোমুখি হতে!

ধ্রুবর কাছে হয়তো কাউকে খু/ন করা তার কোনো বড় ব্যাপার নয়। তবে অদিতির কাছে এটা মারাত্মক ভয়ের একটা ব্যাপার! ও চায়না; ওর জন্যে ধ্রুব নতুন ভাবে কোনো পাগলামি বা অপরাধে জড়িয়ে পড়ুক! আর সে দায় নিক অদিতি!
তাই ও প্রতিবার ধ্রুবর আড্ডার জায়গা এড়িয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। ধ্রুব সেদিন ওকে পুরো ভার্সিটি খুঁজেছে! লোক পাঠিয়েছে ডিপার্টমেন্টে; অদিতিকে পাওয়া যায়নি।

অদিতির হঠাৎ করে শুরু করা এমন আচরণে হতভম্ব ধ্রুব! ও তাই খুঁজে বের করেছে; অদিতির হোস্টেলে ফেরার রাস্তা! আজ এখানেই বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে ধ্রুব ইয়ামিন! উদ্দেশ্য; অদিতি হায়াতকে জন্মের শিক্ষা দেওয়া! জানিয়ে দেওয়া; তার এসব উদ্ভট কাজ-গুলো ধ্রুবকে যেন আর
না দেখায়।

অদিতি আজো এই অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল! হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে ওর চোখ গেল; ওই রাস্তার মোড়ে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে! ওর চোখ-দুটো অন্যরকম ভীষণ; যেন এক্ষুনি খেয়ে ফেলবে অদিতিকে!

ধ্রুবকে দেখেই সঙ্গেসঙ্গে অদিতির পা থেমে গেল। ধ্রুব বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে! ওর রাগী চোখ-গুলো ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে! মনে হচ্ছে, কতো কোটি বছর হয়ে গেছে: ও দেখে না অদিতিকে! মেয়েটা শুকিয়ে গেছে অনেক! আজও সবসময়ের মতো ঢিলে সেলোয়ার-কামিজ পড়নে! ধ্রুব বারবার এই এক মেয়ের প্রতিই এত মুগ্ধ হয় কেন?

অদিতি নিজেকে সামলাতে পারছে না। পা বলছে; উল্টো দৌড়ে চলে যেতে। অথচ হৃদয় বলছে—- ধ্রুব কি আগের থেকে আরও সুদর্শন হয়েছে? এই ময়লা টিশার্ট; এলোমেলো চুল কি আগেও এতো ভালো লাগত?

দুটি তৃষ্ণার্থ চোখ একে অপরের দিকে চেয়ে রয়েছে! কেটে যায় কয়েক পল; দুজনের খবর নেই। ডুবে আছে ওরা; একজন আরেকজনের মাঝে।

ধ্রুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অদিতির বুকটা আবারও থেমেছে; খানিক থেমেই শুরু করেছে লাফানো। ধ্রুব ধীর পায়ে এগিয়ে এসে অদিতির সামনে দাঁড়ালো.। ওর চোখ গেল অদিতির কপালের ব্যান্ডেজে! ধ্রুব ছুঁতে চাইল হাত উঠিয়ে। কিন্তু অদৃশ্য অনধিকারবোধ ওকে আটকে দিল। ধ্রুব হাতটা আবারও নামিয়ে ফেলল। অদিতির চোখটার দিকে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো—-‘অবশেষে আপনার দেখা মিলে গেল; আমার তো উচিত এবার সিন্নি করানো; রাইট?’

ধ্রুব টিটকারি করে বললো এল। অদিতি চোখ নামিয়ে নিলো। ধ্রুবর কণ্ঠ এবার কঠিন হলো; কড়া গলায় শোধালো—-‘আমার থেকে পালাচ্ছিলে কেন? আমি তোমাকে কিছু জানিয়েছি; জবাব চেয়েছিলাম। হ্যাঁ বা না। অথচ তুমি আমাকে এ কটাদিন ভীষণ খাটিয়েছো অদিতি। হুয়াই?’

অদিতি অপরাধবোধে ডুবে গেল! চোখটা নামিয়ে ফেলল; ধীর গলায় জবাব দিল——‘আপনি—‘

‘হু, আমি?’ — ধ্রুব ধৈর্য্য নিয়ে শুনছে যেমন।

অদিতি একটু থামে। খানিক থেমে, জোরে শ্বাস টেনে বলে—-‘আমাদের যায়না; আপনি আরো ভালো কাউকে ডি..ডিজার্ভ করেন। আমি প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে নই।’

ধ্রুবকে হতাশ হতে দেখা গেল। এতদিনের অপেক্ষায় এই উত্তর ও আশা করেনি। ধ্রুব অন্যদিকে চেয়ে নিজের এই হতাশা আড়াল করার চেষ্টা চালালো। পরপর অদিতির নিচু হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে নিজের মুখ ঝুঁকে এনে ঠান্ডা গলায় শুধু এটুকু বলে গেল—–‘ফার্স্ট, আনসার ম্যাই কোশ্চেন; অদিতি! তুমি কি একবারের জন্যে আমার কথা এই কয়েকদিনে ভাবো নি? আমি কি একবারের জন্যে তোমার কল্পনায় আসিনি? শুরু থেকে এই সবকিছুতে কি আমি একাই ছিলাম? তুমি ছিলে না?’

‘ন..না।’ —- অদিতি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। ধ্রুবর চোখে-চোখ রেখে মিথ‍্যা বলার সাধ্য ওর নেই।

ধ্রুব অদিতির ঘুরিয়ে ফেলা মুখটার থুতনি চেপে ধরে আবার ওকে নিজের মুখোমুখি আনে। অদিতি মাথাটা নামিয়ে ফেলল। ধ্রুব অধৈর্য‍্যের মতো করে অস্থির গলায় বললো—-‘ডোন্ট লাই টু মি, অদিতি। তুমি চেয়ে থাকতে আমার দিকে; যখনই আমি তোমার সামনে এসেছি। আমি তোমার চোখে আমার জন্যে দরদ দেখেছি; তুমি আমাকে কেন মিথ‍্যা শোনাচ্ছো? আমি জানি তুমি কি ফিল করো আমার জন্যে।’

ধ্রুব থামে; জোরে শ্বাস টেনে অদিতির হাত টেনে ওকে নিজের দিকে এগিয়ে আনে। হাত ছেড়ে: চোখের কোনে আঙুল ছুঁয়ে কাতর গলায় বললো——‘তোমার চোখ যে কথা বলে তোমার ঠোঁট কেন সেটা বলতে চায়না; অদিতি। কিসের ভয় তোমার, আমি আছি তোমার সাথে।’

অদিতি চোখ টলমল করছে।ধ্রুবর আঙ্গুল তখনও ওর গাল ছুঁয়ে; চোখের কোণ ছুঁয়ে আছে। ধ্রুবকে ও কিভাবে বোঝাবে আর? কি ভাবে বোঝালে ধ্রুব কষ্ট পাবে না? অদিতি শ্বাস আটকে পিছিয়ে গেল। ধ্রুবর হাত নেমে গেল নিচে। ধ্রুব হতাশ হয়ে তাকালো। অদিতির চোখ গড়িয়ে দু-ফোঁটা পানি পরলো; ও দুহাতে চোখ মুছে থেমে থেমে বললো—-‘আমি ভালোবাসতে জানিনা; আমাকে ভালোবেসে আপনি শুধুই কষ্ট পাবেন; আর কিচ্ছু না।’

ধ্রুব জবাবে বললো—‘আমি শিখিয়ে দেবো তোমায়। কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছো?’

‘আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না; বরং কষ্ট পাওয়া থেকে বাঁচাচ্ছি। আপনি চলে যান; আমার সামনে আর আসবেন না। আমার হৃদয় এত বড় নয়; বারবার আপনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার মধ্যে আর নেই।’——-অদিতি কথাগুলো বলে দুহাতে চোখ মুছে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো!

ধ্রুব পেছনে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো! অদিতির চোখের পানি ওকে আজ এলোমেলো করে দিয়েছে। ধ্রুব অনেকক্ষণ লাগলো পুরো ব্যপার হজম করতে। অদিতি ততক্ষণে চলে গিয়েছে।

ধ্রুব একসময় বুকের বা-পাশে হাত রেখে; ঘাড়টা সামান্য কাত করে ফিচেল গলায় বলে উঠলো——‘তুমি পালাতে থাকো অদিতি; আমি পাকড়াও করতে থাকব। তুমি হারিয়ে যেতে থাকবে; আমি অন্ধকার-দিন একসঙ্গে তোমার পায়ে হাজির করে যাবো। তুমি ভয় পেতে থাকো; আমি ধ্রুব তোমার ভয়-গুলো নিজের হাতে পিষে ফেলতে থাকব! যেই প্রান্তে তুমি থাকবে; ধ্রুবকে তোমার সঙ্গে পাবে।’

#চলবে

#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৭|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

আজ রবিবার! রবিবারে; মাথার উপর শনির ন্যায় নেচে যাচ্ছে সূর্য। দুপুরটা বড্ড খরখরে! তীব্র রোদ আর অসহ্য গরমে অদিতির অবস্থা করুন-বেহাল। কোনোরকমে টিউশন করিয়ে বেরিয়েছে সে। রিকশা খুঁজছে, মহাখালীর এদিকটায় আজকাল রিকশা মেলে না। অদিতি কপালের ঘাম ওড়নায় আগায় মুছে; চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে।
হঠাৎ এক রিকশা ওর সামনে এসে দাঁড়াল। রিকশাওয়ালা মামা রিকশার প্যাডেল থামিয়ে; মুখে হাসি টেনে বললেন—-‘ ভাবি; ছলেন , আপনারে হোস্টেলে নামায় দেই।’

অদিতি ভ্রু কুঁচকাল। ‘ভাবি’— শব্দটা ইদানীং ঘুমের মধ্যেও ওর কানে বাজে। সারাক্ষণ ভার্সিটি, রোডে এ, নাহলে ও ভাবি ডেকেই চলেছে। কোন ভাইয়ের বউ হয়ে আছে ও; খোদা জানে। অদিতি কাঁধের ব্যাগটা এক হাতে চেপে ধরে; চাপা স্বরে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো——-‘আপনাকে কে পাঠিয়েছে, মামা?”

‘ধ্রুব ভাইয়ে।’ ——বলে রিকশাওয়ালা ইশারা করল পেছনে; কাউকে খুঁজতে লাগলো যেমন। অদিতিও অবাক হয়ে পেছনে তাকাল; কেউ নেই সেখানে। ওর মুখ থমথমে হয়ে এলো; যা বোঝার সে বুঝে গেল। সে সামনে আসবে না; অথচ ঠিকই অদিতির আশেপাশে না থেকেও কেমন করে সে থেকে যায়। অদিতির ঠোঁটে না চাইতেই হাসি চলে এল! পরপর ও নিজেকে শাসিয়ে; হাসি লুকিয়ে ভ্রু–ট্রু কুঁচকে তাকালো।

ওপাশ থেকে রিকশাওয়ালা মামা অদিতিকে এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে; অবাক হয়ে বললেন—-‘ভাবি আপনে যাইবেন না? ধ্রুব ভাইয়ে বকবো আমারে।’

আবারও এই অসহ্য ‘ভাবি’ -ডাক। অদিতি এবার কিছুটা কঠোর গলায় বললো—-‘মামা; আমি বিয়ে করিনি আপনার কোনো ধ্রুব ভাইকে। আমাকে ভাবি আল্লাহর ওয়াস্তে ডাকবেন না।’

রিকশাওয়ালা মামা যেন ভারি অবাক হলেন! অদিতির গরম-গরম রাগ দেখে উনি মিইয়ে গিয়ে বললেন—-‘ভাবি, আপনাগো কি ঝগড়া হইসে? ঝগড়া করিয়েন না; ধ্রুব ভাইয়ে ভালা মানুষ; একদম মাটির মানুষ। রিকশায় উঠে আহেন; রোদে দাঁড়ায় আবার কিসের রাগ?’

অদিতির এবার ইচ্ছে হচ্ছে— মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে। ভাইর নাই প্রেমের খবর; তার সঙ্গে আবার নাকি রাগ করাও হয়। অসহ্য এবং বিশ্রী রাগে মাথার ভেতরটা অব্দি ধবধবিয়ে উঠল। অদিতি আর দাঁড়ালো না; দ্রুত উঠে বসলো রিকশায়; ব্যাগ কোলের উপর রেখে বললো—-‘মামা; যান তো যান।’

মামার খুশি কে দেখে! আজ অদিতিকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে পারলেই; করকরে এক হাজার টাকার নোট মিলবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। রিকশাওয়ালা মামা ধ্রুবর নির্দেশ মতো; শেষবারের রিকশা চালানোর আগে একবার অদিতির জামা, ওরনা দেখে নিল, কোনোভাবে ওরনা ওর চাকায় আটকে গেলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। ধ্রুব ভালোর ভালো; খারাপের খারাপ! মাইর লাগাবে ধরে! উনি সাবধানে সব দেখে নিয়ে; স্বস্থির শ্বাস ফেলে রিকশা চালানো শুরু করলেন।

অদিতি অস্বস্তি নিয়ে রিকশায় বসে আছে। ওর মনে চলছে অন্য ভাবনা! ধ্রুব এসব করে কী বোঝাতে চাইছে? সে কি সত্যি অদিতির প্রেমিক হয়েছে?অদিতি তাকে ফিরিয়ে দেবার পরেও; ওর আশেপাশে থেকে ওকে এভাবে দুর্বল করে দিয়ে কি শান্তি পাচ্ছে ওই ছেলে? অদিতির বুকের মধ্যে ভোঁতা এক যন্ত্রণা হচ্ছে। ওর বেহায়া মন বারবার বেহায়া কিছু করে বসতে চাইছে; অথচ মস্তিষ্ক আটকাচ্ছে ওকে।

মাঝরাস্তায় অদিতির ফোনে কল এলো। রিকশায় বসে থেকেই ফোন রিসিভ করলো সে। অদিতি সালাম দিল; ফাহিমা ওপাশ থেকে বললেন—-—‘কি রে মা, কবে আসবি বাড়ি? তোর কলেজ বন্ধ দিবে কখন রে?’

অদিতি হালকা গলায় উত্তর দিল—-‘পরশু থেকে ছুটি আছে, সাতদিনের। দেখি আসতে পারি কিনা।’

ফাহিমা এবার একটু দোনামনা করতে লাগলেন; উশখুশ করছেন কিছু বলার জন্যে। অদিতি যেন বুঝে ফেললো; ও লাই দিয়ে বললো—-কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, মা। আমার সামনে এত কি ভাবছো?’

ফাহিমা কিভাবে কথাটা উঠবেন বুঝতে পারছেন না। এই ব্যাপারে উনার নিজেরও তেমন মত নেই। শুধু স্বামীর চাপে পরে মেয়ের চলার পথে বাধা হতে মন চাইছে না। তবুও উনি বললেন; অপ্রস্তুত গলায়——‘আসলে…তোর জন্য একটা বিয়ের আলাপ এসেছে। ছেলে পাশের গ্রামের, ঢাকাতেই চাকরি করে। তোর আব্বা রাজি। বলছিলেন, যদি আকদ করিয়ে রাখি…’

অদিতির বুকটা ধ্বক করে উঠলো সঙ্গেসঙ্গে। চোখের সামনে ধ্রুবর পাগলাটে মুখটা ভেসে উঠল; ভেসে উঠল সেদিন রাতের ধ্রুবর শিহরণ জাগানো একেকটা ছোঁয়া! অদিতির শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে; ও চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর থেমে থেমে বলল,—-‘ মা; এ..এখনই এসব কেন? আমি তো এখনো প..পড়াশোনা করছি।”

ফাহিমা মেয়ের কথার উত্তরে কি বলবেন; খুঁজে পেলেন না। একই কথা উনি নিজেই স্বামীকে বলেছেন; তোফাজ্জল এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। ফাহিমা গলাটা নরম করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন——-‘উঠিয়ে তো নেবে না রে। এবার বাড়ি এলে ওরা যদি দেখে পছন্দ করে, তবে পরে কথা এগোবে।”

এ কথা শুনে অদিতির বাড়ি যাওয়ার যেটুকু ইচ্ছা ছিল, তাও মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। ওর এতদিন শুধু ধ্রুবর থেকে পালানোর জন্যে বাড়ি যাওয়ার জন্যে ছটফট করছিলো। আর এখন? সেখানেও আরেক বিপদ ছুটে আসছে। এখন কোথায় যাবে অদিতি?

অদিতি যেটুকু বলার ছিলো; সেই কথাটাও মুখ থেকে বের করতে পারলো না। বাড়ি না যাওয়ারও আর কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না। তবুও ও চেষ্টা করলো, বলল——‘আমি রিকশায় আছি, মা। আর এই মাসে ছুটি পাবো কি না এখনো তো নিশ্চিত হয়নি। রুমে গিয়ে তোমার সাথে কথা বলি?’

ফাহিমা উত্তরে কচু বলার আগেই; উনার কথার মাঝপথেই ফোনটা কেড়ে নিলেন অদিতির বাবা তোফাজ্জল। বাবার গমগমে গলা শোনার সাথেসাথে অদিতির শ্বাস আটকে এলো; গা কাঁপতে লাগলো।

তোফাজ্জল ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার ধার ধারলেন না; শুরুতেই বলে ফেললেন——‘অদিতি, তুমি পরশুর ট্রেন ধরে বাড়ি আসছো!আমি ছেলেদের কথা দিয়ে ফেলেছি, এখন তোমার বাবার মুখ রাখা উচিত তোমারই, আমি কি ঠিক বলছি?”

অদিতি কিছু বলার সাহস পেল না; হাত কাঁপছে তার। ও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো—-‘আ…আমি আসব, আব্বা।”

তোফাজ্জলকে শান্ত হতে দেখা গেল; উনি গমগমে গলায় বললেন——‘তোমার ট্রেনের টিকিট আমি কেটে রেখেছি সামনের সপ্তাহে। সময়মতো চলে আসবে, আর রিকশায় বসে এত কথা বলার দরকার নেই। রুমে গিয়ে কল করো।”

অদিতি মাথা নাড়লো; তারপর সালাম দিয়ে কল কেটে দিল। ফোন কেটে ও ফোনটা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরলো! ধ্রুব; ধ্রুব পাগল হয়ে যাবে এসব শুনলে! অদিতি; অদিতিও তো ঠিক নেই। ধ্রুবকে যতই ফিরিয়ে দিক; দিনশেষে যেটুকু ফেঁসে যাওয়ার ও তো ফেঁসেই গেছে। অদিতির চোখ টলমলে হয়ে যাচ্ছে, ও অনেক কষ্টে কান্না আটকে রাখল পুরোটা রাস্তায়।এদিকে ওদের পুরো কথোপকথন রিকশাওয়ালা মামা কান খাড়া করে শুনছিলো।
____________
ধ্রুব সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে সবে রুমে ফিরেছে। রুমটা ওর বড্ড অগোছালো! ড্রয়ারের ওপর জিন্স-শার্ট ছড়ানো, বিশাল আয়নার কোণে ঝুলিয়ে রাখা টাওয়াল, বিছানার একপাশে স্তূপ করে ফেলে রাখা কাপড়-চোপড়। রুমে ঢুকেই এসব দেখে ধ্রুবর মেজাজ বিগড়ে গেল।ও ভ্রু-ট্রু কুঁচকে মহা বিরক্ত হয়ে কাপড়ের স্তূপ একপাশে সরিয়ে বিছানায় বসলো। বসে পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখল; এলোমেলো রুমের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ওর মনে হলো——বিয়ে করার পর তার রুম তো আর কখনোই এমন থাকবে না। অদিতি তার গোলগাল-নরম হাত দিয়ে ধ্রুব; ধ্রুবর রুমকে ঠিক গুছিয়ে নেবে। ধ্রুবকে অন্ধকার থেকে টেনে আনবে আলোর দিকে।

অদিতির কথা ভাবতেই ধ্রুবর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। ধ্রুবর এখন ইচ্ছে করছে, অদিতির কাছে একবারে ছুটে যেতে। নতুন প্রেমে পরলে কি মানুষ এমন পাগল হয়ে যায়? নিজের ভাবনাতেই নিজেই হেসে ধ্রুব মাথার চুল একহাতে এলোমেলো করে ফেললো। তারপর হেসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে নিজেকে আগাগোড়া দেখলো। আজ রাজন বলছিল—ধ্রুব নাকি বদলে যাচ্ছে,প্রেমের সব সিমটম নাকি ওর মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে? ধ্রুব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই সিমটম-গুলোই খুঁজে চলেছে। তার মধ্যে কি সত্যিই অনেক পরিবর্তন এসেছে?প্রেমে পড়ে কি মানুষ এতটা পরিবর্তন হয়?

এমন সময় ফোন এলো। ধ্রুব মুখ স্বাভাবিক করে পুরনো গম্ভীর রূপে ফিরে এসে; এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কেউ তাকে কিছু বলল। সব শুনে হঠাৎ ধ্রুবর মুখটা থমথমে হয়ে গেল। ও ঠান্ডা গলায় শুধু বললো—–‘করাচ্ছি বিয়ে উনাকে।’

ধ্রুব ফোন কেটে পকেটে পুড়লো। দ্রুত হেটে গিয়ে বিছানার উপর থেকে শার্ট নিয়ে গায়ে দিল; তারপর বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল রুমের বাইরে। ড্রয়িং রুমে আসতেই পেছন থেকে সৌরভ এতরাতে ছেলেকে বাইরে যেতে দেখে ডাক দিলেন——-‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছো?

ধ্রুব ফিরেও তাকাল না। ওর এখন বড্ড তাড়া, মাথায় চড়ে আছে আশি কেজি ওজনের জেলাসি। ও কোনো জবাব না দিয়েই দ্রুত পা চালিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।

অদিতি সেই কখন থেকে সামনে বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু তার আজ পড়াশোনায় একদমই মন বসছে না। পুরো মন জুড়ে ধ্রুবর চিন্তা; ওর ভাবনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে অদিতির মনে হয়; ওর মস্তিষ্ক আর ওর নেই; পুরোটাই ধ্রুবর দখলে চলে গেছে। শান্তি দিচ্ছে না এই ভাবনা-গুলো ওকে।

অদিতি ভাবছে; এবার বাড়ি গেলে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে, এটা জানলে ধ্রুব কী করবে? কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবে হয়তো। শুধু ধ্রুবই নয়, অদিতি নিজেও চাইছে না ছেলেপক্ষের সামনে যেতে। গ্রামের ছাপোষা মেয়ে অদিতি কীভাবে এমন একটা বখাটে প্রেমিকের প্রেমে পরে গেল, কে জানে? প্রেমে পরলো তো; তার উপর তার প্রেমে পরে এই করুণ হাল; মানুষ কি বলবে? অদিতির ভালো লাগছে না কিছুই। কি করবে? কাকে বোঝাবে মনের এই ব্যথা-গুলো, অসহ‍্যকর এই দ্বিধা-গুলো?

অদিতি মনের এক টানাপরনে হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা ওই ফোন বেজে উঠলো। অদিতি ভাবনার মধ্যেই চমকে উঠলো। নম্বর সেভ করা নেই;ও ভ্রু কুঁচকে বইটা বন্ধ করে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে একটা থমথমে গলার স্বর ভেসে আসলো——-‘ধ্রুব বলছি। নিচে আসো; আ’ম ওয়েটিং।’

অদিতি চমকে উঠে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে চোখের সামনে ধরল। ভালোভাবে নম্বরটা দেখল; এটা কি নতুন কোনো নম্বর তার? ধ্রুব কীভাবে এতবার নম্বর পাল্টায়; ভেবে পাচ্ছে না ও।

অদিতি ফোনটা কানে লাগালো ধীর হাতে; ঢোক গিলে সরাসরি বলার চেষ্টা করলো—-‘আ..আমি আসতে পারবো না। রাত অনেক হয়েছে; বাড়ি চলে যান প্লিজ।’

ওপাশ থেকে ধ্রুব যেন ব্যঙ্গ করে হাসল; কপাল আঙুলে চুলকে নিতে নিতে উপরের দিকে অদিতির জানালার দিকে তাকিয়ে বলল —-‘ফিফথ ফ্লোর; রুম নম্বর ৫০২; রাইট অদিতি?’

অদিতি চমকে উঠল; দ্রুত গিয়ে জানালার পাশে দাড়িয়ে নিচে তাকালো; ধ্রুব ওর দিকেই চেয়ে আছে। অদিতি আঁতকে উঠে বুকে ফুঁ দিয়ে সরে গেল আড়ালে; ভীতু গলায় বলল—-‘আ..আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?’

ধ্রুব এবার কঠোর গলায় স্পষ্ট করে বলে ফেলল—-‘আমি উপরে উঠব নাকি তুমি নিচে আসবে? আমাকে দয়া করে আর জ্বালিও না, অদিতি। আমি জ্বললে ঝাঁঝরা করে ফেলবো তোমাকে; জানো তো?’

অদিতি ঢোক গিললো! একবার বলে দিয়েছে; উপরে আসবে মানে চলে আসবেই। যা ঘাড়ত্যাড়া ছেলে! অদিতি অজুহাত দেখানো শুরু করলো এবার—-‘নিচে দারোয়ান আছে।’

ওপাশ থেকে ধ্রুব হাসে;কৌতুক শুনেছে যেমন তেমন করে বললো—-‘আমার মতো দারোয়ানও তোমার জন্যে ওয়েট করছে,বেচারা ঘুমে ঢুলছে। নিচে নামো তুমি।’

দারোয়ান ওর নিচে নামার অপেক্ষা করছে? এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না অদিতির। এই দারোয়ান অনেক রাগী; রাত দশটা বাজলেই গেট বন্ধ করে ফেলে। রাত এগারোটায় কীভাবে তার জন্য গেট খুলে রেখেছে?

ধ্রুব ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে; ফোন কাটার আগেও অবশ্য কয়েকবার শাসিয়েছে। ওদিকে অদিতির মন মানছে না। ভেতরের মন বলল, যা; প্রেমিক ধ্রুবের জন্যই তো মন খারাপ করে বসে ছিলি এতক্ষণ।
কিন্তু মস্তিষ্ক বলল, নিজেকে আটকে রাখ; অদিতি। নিজের বিপদ তুই নিজেই ডেকে আনছিস।

অতঃপর শেষ পর্যন্ত মনের কথাই জিতলো। অদিতি চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে, মুখ লুকিয়ে বেরিয়ে এলো। গেইটের সামনে আসতেই দারোয়ান মুখ ভরে হেসে দরজা খুলে দিল। অদিতি শুধু অবাক হয়ে দেখছিল দারোয়ানের আচরণ-গুলো।

গেইট পেরিয়ে আসতেই দূর থেকে ধ্রুবকে দেখতে পেল। ব্যাস; ওর মন বেপরোয়া গতিতে লাফানো শুরু করে দিলো। অদিতি বুকের বা-পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ বুজে জোরে-জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর চোখ খুলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ধ্রুবর সামনে। ধ্রুব ওর দিকে পিঠ করে আছে; অদিতি আস্তে করে ডাকল——‘শুনছেন?”

ধ্রুব ঘুরে তাকাল। ধ্রুবর চোখ-দুটো অদিতির চোখ আটকে গেল। দুজনেই ভেসে গেল এক অন্য দুনিয়ায়! অদিতির মাথা ঢেকে রাখা চাদরে; ধ্রুবর মাথায় ক্যাপ! অন্ধকারে দুজন দুজনের চোখে কি এমন দেখলো কে জানে! দুজনের মধ্যে একে অন্যের জন্যে যেটুকু রাগ; ঈর্ষা ছিলো সব দূর-দূর করে পালিয়ে গেল। বাকি যেটুকু থাকল; সেটুকু শুধুই ভালোবাসা। একজনের প্রকাশিত প্রেম; অন্যজনের অপ্রকাশিত।

অদিতি নিজের চোখ বড্ড কষ্টে সরালো; অন্যপাশে চেয়ে হৃদয়ের যন্ত্রণা চেপে; ধীমে গলায় জিজ্ঞেস করলো——‘ক…কেন ডেকেছেন?’

ধ্রুবর ধ্যান ফিরলো; ও চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালালো। তারপর আবার তাকাল অদিতির দিকে। ধীরে ধীরে ওর চোখে সেই ‘আশি কেজি ওজনের’ জেলাসি ফুটে উঠল; ধ্রুব ঠান্ডা গলায় বললো——‘ছেলেটা কি করে?ওই শা* কি আমার চেয়েও অনেক বেশি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে?’

অদিতি শুরুতে বুঝতে পারল না ধ্রুব কি বোঝাতে চাইছে? ও অবাক চোখে ধ্রুবর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল; জিজ্ঞেস করলো——-‘কোন ছেলের কথা বলছেন?’

ধ্রুব এবার নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না; অদিতির হাত টেনে ধীরে নিজের সঙ্গে ওকে মিশিয়ে নিলো! অদিতির বাহু দুহাতে দুদিকে চেপে ধরে চোখে চোখ মিলিয়ে; চেঁচিয়ে বলে গেল শুধু নিজের ঈর্ষার কথা——‘কোনো ছেলেপক্ষের সামনে তুমি একদম বসবে না অদিতি; কসম তোমার। যদি বসো; তুমি জানবেও না আমি ওই ছেলেকে কি করে ফেলব। আমি ধীরে ধীরে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছি; জাস্ট বিকজ অফ ই‍্যয়ু! আমাকে আমার পুরনো রাগ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করিও না অদিতি; প্লিজ।’

ধ্রুবর রাগের পারদ লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছিল। ও অদিতির সামনে নিজের রাগী সত্ত্বা প্রকাশ করতে চায়নি; কিন্তু ও নিজেকে আটকেও রাখতে পারেনি। অদিতি বড়বড় চোখে ধ্রুবর রাগ আর ঈর্ষা দেখছিল। ধ্রুবর এই অস্থিরতা দেখে অদিতির ভেতর নড়ে উঠল যেমন।ও ভয়ার্ত মুখে ধ্রুবকে দেখছিল। অদিতির ভয়ার্ত মুখ দেখে আচমকা ধ্রুবর ওর হুশ ফিরলো; কি করছিল ও এতক্ষণ?

ধ্রুব ওর চোখের দিকে চেয়ে; আচমকা ওকে ছেড়ে দিলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে; নার্ভাস গলায় নিচু স্বরে বলল——‘ স..সরি!’

তারপর; ও পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো; কোমরে হাত রেখে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। ধ্রুব চোখ বুজে নিজের রাগটুকু সামলাচ্ছিল;আর অদিতি শুধু অবাক চোখে ওকে দেখে যাচ্ছিলো। ধ্রুব এই প্রথমবার ওর উপর এমন রাগ দেখাল; এসব কি শুধুমাত্রই অদিতি ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে সেজন্যেই?

অদিতির হঠাৎ কি যে হলো। ও নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর বাহু স্পর্শ করলো। ধ্রুব অবাক হয়ে ফিরে তাকাল! ওর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে; অদিতির চোখের দিকে তাকাল। অদিতি ধ্রুবকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলল—-‘একটু শান্ত হোন; প্লিজ! আমি রাজি নই এই বিয়েতে। আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।’

ধ্রুব স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল; ওর চোখ-দুটো অদিতির চোখে আটকে আছে। অদিতির হাতটা তখনও ধ্রুবর শক্ত বাহু ছুয়ে আছে। দুজনেই দুজনের চোখের দিকে চেয়ে!
তারপর; হঠাৎ ধ্রুবর পুরুষালি মনে মনে খুশি দৌড়ঝাপ করে উঠলো; তার অদিতি কি আজ তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে? এই অধিকার কি সে ফাইনালি পেয়েই গেছে?

#চলবে

#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৮|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

রাত বাড়ছে; অদূরে থেকে কটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছিল। অদিতি-ধ্রুব হাঁটছে ফুটপাথ ধরে। অদিতির গা চাদর দিয়ে ঢাকা; ধ্রুবর মাথায় ক্যাপ! অদিতি দুহাতে গায়ের চাদর শরীরের সঙ্গে চেপে ধরে জোরোসরো ভঙ্গিতে হাঁটছে; ওর পেছনে ধ্রুব! ধ্রুবর মুগ্ধ চোখ-দুটো অদিতির পিঠে ঝুলানো বেনুনি দেখছিলো; হাঁটার তালে অদিতির বেনুনি নড়ছিল—ভীষণ সুন্দর দৃশ্য ছিলো এটা।

অদিতি বলা শুরু করলে; ধ্রুবর ধ্যান ভাঙে! অদিতি বলে গেল——‘আমি লক্ষ্মীপুরের ভীষণ অজপাড়া গ্রাম থেকে এসেছি; যেখানে প্রে… প্রেম ভালোবাসা পা/প নয়, মহাপা/প!’

ধ্রুব অবাক হয়ে তাকালো অদিতির দিকে! অদিতি ঢোক গিলে আবারও বলতে থাকে—— ‘আমাদের গ্রামে একটা ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে সন্দেহভাজনভাবে দেখা গেলে ওদের নিয়ে গ্রামের পঞ্চায়েতে সালিশ বসানো হয়; নি-ষ্ঠুরভাবে অ/পমান করা হয় ছেলে-মেয়ের দুই পরিবারকে। বিচার বসে; ওই ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়, এবং ওদের পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হয়।’

ধ্রুব এবার ভীষণ অবাক হলো; জিজ্ঞেস করলো— ‘এই যুগে এসেও এমন, ইম্পসিবল!’

অদিতি শুনে মলিন হাসল! বলে যায় নিজের কথাগুলো——‘এসবের পেছনে ওদের যুক্তি—প্রেম হারাম! হারাম সম্পর্কে আল্লাহর আযাব আসে, গ্রামের বরকত কমে যায়।’

ধ্রুব শুনে যায় শুধু। অদিতি বলে—-‘ওই প্রেম জড়ানো দুই ছেলে-মেয়ের পরিবারকে কিভাবে দেখা হবে সামাজিকভাবে; সমাজে তাদের অবস্থান কেমন থাকবে; সবাই ওদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে; কতটা ব্যবসায়িক লেনদেন হবে— এসব কিছু কে সিদ্ধান্ত নেয় জানেন?’

ধ্রুব প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল; অদিতি জোরে একটা শ্বাস টেনে আকাশের দিকে চেয়ে উত্তর দিল——— ‘আমার আব্বা! তোফাজ্জল হায়াত!’

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেললো তাৎক্ষণিক। অদিতি আকাশের থেকে চোখ সরিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকাল! হেঁটে যেতে থেকে; বলতে থাকে—— ‘ছোটবেলা থেকে আমাকে, আমার ছোট ভাই-বোনকে ভীষণ রক্ষণশীলভাবে বড় করা হয়েছে। আব্বার অনেক ভয়— উনি প্রেমের এতটা বিরোধী, উনার মেয়ে প্রেমে জড়ালে উনার মুখ থাকবে না। গ্রামের লোক ছি-ছি করবে।’

ধ্রুব ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো—— ‘এন্ড ফর দ্যাট, তুমি আমাকে এতদিন ধরে ফিরিয়ে দিচ্ছো, রাইট?’

অদিতি ধ্রুবের দিকে তাকালো একবার; পরপর চোখ সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—— ‘আমাদের পরিবার মূলত আব্বার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ছোটবেলা থেকে মায়ের কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবারে খাটেনি। আব্বা যা বলতেন; সেটাই ফাইনাল কথা ছিল।’

ধ্রুবর হঠাৎ মনে পরে গেল নিজের মায়ের কথা! ও হাঁটতে হাঁটতে কল্পনা করে যায়— ওর মা জীবিত থাকা পর্যন্ত ওদের পরিবার মোটেও এমন ছিল না। সুখের সংসার ছিল ওদের। মায়ের প্রতি ধ্রুবর বাবা ভীষণ যত্নবান ছিলেন; সব সিদ্ধান্তে স্ত্রীর মত চাইতেন। ধ্রুবর চোখে ভাসে সেদিনের সুন্দর স্মৃতিগুলো। ওদের পরিবারও তো কত সুন্দর ছিলো; আদুরে ছিলো! তারপর; একটা রাত এলো! সেই রাত ধ্রুবর থেকে সবকিছু কেড়ে নিলো সমূলে। ওর শখের পরিবার…

অদিতি এবার ঘুরে ধ্রুবের দিকে তাকায়। ধ্রুবও তাকায়; ওর চোখ দিধান্বিত! অদিতি টলমলে চোখে চেয়ে বলে—— ‘আমি ঢাকায় আসার সময় আব্বা ভীষণ বিরোধী ছিলেন। উনি চাননি আমি ঢাকা আসি; ঢাকা আসলে আমি উনার নজরের বাইরে চলে যাবো। আর যদি প্রেমে জড়িয়ে যাই; আব্বা মূলত এটারই ভয় পাচ্ছিলেন।’

অদিতি এবার ধ্রুবর দিকে অসহায় চোখে চাইলো। ধ্রুবর দৃষ্টি অদিতির চোখের দিকে। অদিতি ধ্রুবর ওই নেশালো-স্থির চোখের দিকে চেয়ে; ঢোক গিলে কান্না আটকে রেখে বলে গেল—— ‘তারপর এখানে এসে আমার দেখা হয় আপনার সঙ্গে। একটা বেপরোয়া; ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেদিন আমার সামনে সিগারেট মুখে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি সেদিন একটা ওয়াশরুমে একটা ছেলের সঙ্গে প্রথম দাঁড়িয়েছিলাম; আমি আটকে গিয়েছিলাম ওইদিন। আমাদের গ্রামের একটি দৃশ্য আমার চোখে ভাসছিল; গ্রামের পঞ্চায়েত, সালিশ, আব্বার বিচার করা। সব একের পর এক আমি নিজের চোখে সামনে দেখে যাচ্ছিলাম। আমি ভি..ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাই আপনার দিকে দুবার না তাকিয়ে দৌঁড়ে চলে এসেছিলাম সেখান থেকে। তারপর আমার-আপনাকে নিয়ে ছড়িয়ে যায় গুজব, আরও কত বিশ্রী কথা। আমি সেদিন দুই চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম। বারবার আব্বাকে ডেকজছিলাম; যে সবার সামনে আঙুল তুলে বিচার করছে আমার। ভেতরে ভেতরে এই চিন্তা-গুলো আমাকে মানসিকভাবে পাগল করে দিচ্ছিলো।’

ধ্রুব তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে; ওর চোখ ভীষণ শান্ত! অদিতি নিজের কান্না আর আটকে রাখতে পারলো না। চোখের জল ফেলে দিলো; বললো—— ‘যে আব্বা লোকের প্রেমের উপর আঙুল তোলেন; লোকের প্রেমের কারণে ওর পরিবারকে শা/স্তির কাঠগড়ায় তুলেন, তার মেয়ে যদি প্রেম করে আব্বা ম/রে যাবেন বিশ্বাস করুন। আব্বার কাছে নিজের সম্মান; নিজের গৌরব উনার সন্তানদের থেকেই আগে। আমার ব্যাপারে এসব জানতে পারলে; উনার হাতে সবচেয়ে প্রথম খু/ন হবো আমি! নিজের সম্মান রাখতে; মানুষের সামনে নিজেকে মহান প্রকাশ করতে উনি সবার সামনে আমার বলিদান দেবেন। এবং লোককে বলবেন— তোফাজ্জল হায়াত নিজের মেয়ের বেলাতেও কোনও কম্প্রোমাইজ করেননি; নজির তৈরি করেছেন গ্রামে।আমার মন; আমার প্রেম; আমার মৃ/ত্যু উনার কাছে নস্যি; বিশ্বাস করুন।’

অদিতি কেঁদে যাচ্ছে! ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে থাকে! অদিতির দুই-চোখে পানি ভেসে যাচ্ছে। ও মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে ক্রমশ। ধ্রুব শুধু দেখে যাচ্ছে। ধ্রুব কান্না দেখে অধৈর্য‍্য হলো; এগিয়ে গেল দু কদম; পরপর আচমকা আটকে গেল কোনো অজানা বাঁধায়!

ওর হুশ ফেরে। অদিতিকে ওর ছোয়ার কি কোনও অধিকার আছে? অদিতি কি আদৌ কখনো দিবে ধ্রুবকে সেই অধিকার? আজ প্রথম ধ্রুব কেন যেন অদিতিকে শান্ত করতে পারছে না; ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না; গালে হাত দিয়ে ওর কান্না ভেজা চোখ মুছে দিতে পারছে না। এতটাই দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল দুজনের মধ্যে আজ?

অদিতি একসময় নিজে নিজেই শান্ত হলো। দুহাতে এলোমেলোভাবে চোখ মুছে; ধ্রুবের দিকে অসহায় চোখে তাকাল! ধ্রুবর স্থির-শান্ত দুই চোখের দিকে চেয়ে; ভারি শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো —— ‘আপনি আমার জীবনে হয়তো ভালো কোনো অধ্যায় ছিলেন। কিন্তু আমি অধম সেই ভালো-টুকুও গ্রহণ করতে পারছি না। আপনি আরো ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন। আমাদের মধ্যে কিছু হবার নেই; হলেও শেষ অব্দি আমি আব্বার মুখের উপর আপনার নাম বলতে পারবো না। আর প্রেম করে ছেড়ে দেওয়া আপনাকে আমার সেই সাহস নেই। আমি আপনাকে সত্যি ভালো…’

অদিতি হুট করে থেমে গেল! কি বলতে যাচ্ছিলো ও?এসব ধ্রুবকে বলে কি বোঝাতে যাচ্ছে? অদিতির মুখটা ছোট হয়ে গেল; ও মাথাটা নামিয়ে ফেলল। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ছিল তখন ওর দিকে। অদিতি পুরো কথা না বললেও; ধ্রুব বুঝে গেছে কি বলতে চেয়েছিলো ও।

ধ্রুবর এলোমেলো হৃদয় এতক্ষণে যেন শান্ত হলো। ওই মেয়ে ধ্রুবকে কিছু না বলেও অনেক কিচি বুঝিয়ে ফেলেছে আজ। ধ্রুব মৃদু হাসল; ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অদিতির দিকে।অদিতি অনুভব করছে; ধ্রুব এগুচ্ছে। ধ্রুবর গাঁয়ের পারফিউম, হাঁটার সঙ্গে জুতোর শব্দ সব অদিতির বুকের কাপন বাড়িয়ে দিচ্ছে শুধু। ধ্রুব কিছুটা দূরত্ব রেখে অদিতির নিচু হওয়া মুখের দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে এলো; অদিতির নামিয়ে রাখা চোখের দিকে চেয়ে ফিচেল গলায় বললো—-‘তাকাও আমার দিকে।’

অদিতির ঢোক গিললো! কান্না আটকে রেখে; ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল ধ্রুবর ওই নেশাল-আত্মবিশ্বাসী চোখের দিকে। দুজনের চোখে-চোখ মিলে গেল। ধ্রুব ওই মায়াবী-কান্নাভেজা মুখের দিকে চেয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে ঠান্ডা গলায় বলে গেলো—— ‘তুমি আমাকে নিজের থেকে কখনোই ছাড়াতে পারবে না অদিতি। তোমার বাবা নিজের হাতে আমার কাছে তোমাকে তুলে দিবেন; ট্রাস্ট মি। সেদিন নিজেকে আর আটকে রেখো না; আজকের অর্ধেক বলা কথাটা পুরোপুরি বলে দিও-

আরেকটু ঝুঁকে এসে; ধ্রুব এবার ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল ——-‘অ্যাই উইল বি ওয়েটিং ফর দ্যাট ডে; অদিতি! ডেসপারেটলি!’

অদিতি দ্রুত চোখ খিঁচে নিল! ধ্রুব এভাবে ফিসফিস করে বলছে; ওর বুক কাঁপছে! মনটা হরমোনের জ্বালাতনে চুড়ান্ত বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে—নিজেকে আর এতটা কঠোর ভাবে না আটকে রাখতে। ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে এই প্রেমিক ধ্রুবর বুকে।

ধ্রুব ধীরে সরে গেল। অদিতির দিকে চেয়ে বললো—— ‘হোস্টেলে নামিয়ে দেই তোমায়; চলো।’

ধ্রুব অদিতিকে যখন হোস্টেলে নামিয়ে দিলো; যাওয়ার আগে অদিতি ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ উসখুস করতে লাগল। ধ্রুব ওকে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল; বলল——‘কিছু বলবে?’

অদিতি থামল! উসখুশ গলায় বলতে চাইলো——‘‘আমি বাড়ি যাচ্ছি সামনের সপ্তাহে! হয়তোবা আমার আকদ…’

‘রুমে যাও অদিতি; গো!’—— অদিতিকে ধ্রুব ওর কথা শেষ করতে না দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল।

অদিতি অবাক হয়ে তাকালো! বিয়ের কথা শোনার পর থেকে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। আর ধ্রুব এতটাই শান্ত হয়ে আছে?ও স্থির দৃষ্টিতে ধ্রুবের দিকে চেয়ে রইল! ধ্রুব এখনো হয়তো অদিতির পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। ও জানতেই পারছে না—ওদের দেখা হওয়াটা, একসাথে পথ চলা এটুকুই ছিল!ও যদি ধ্রুবকে না দেখে আর…

অদিতির আজ শুধু ইচ্ছে করছে— শেষবারের মতো ধ্রুবর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে! বারবার মম বলছে ওর—আর যদি না দেখে এই মানুষকে! অদিতির অন্য জায়গায় বিয়ে হলে ও কি পারবে আদৌ সংসার করতে? যেখানে ও তন-মন-রুহ দিয়ে বসে আছে আরেকজনকে।

ধ্রুব বাইকে হেলমেট রেখে; দাঁড়িয়ে ছিল। অদিতি চেয়েই থাকল ওর দিকে। ধ্রুব এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো ; অদিতি তখনই দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেলল। ধ্রুব অদিতির এলোমেলো চোখের দিকে চেয়ে আছে; অদিতির কষ্টে জর্জরিত মনটা ধ্রুব বুঝে নিলো মুহূর্তেই। এবার নিজের গলার স্বর অনেকটাই নরম করে বললো—-‘বাড়ি যাও অদিতি! কিন্তু এটা ভেবো না- যে ধ্রুব তোমাকে ছেড়ে দিবে। তুমি যতই আমাকে ফিরিয়ে দাও; আমি জানি তুমি ফিল করো আমার জন্যে। তোমার মুখের কথা সত্য ভেবে বসে থাকার মতো আমি ধ্রুব ঘাস খাই না।’

অদিতি অবাক হয়ে তাকাল! ধ্রুবর চোখ বিশ্বাসী আজ! অদিতিকে ও জয় করেই ছাড়বেই! অদিতির খরার মতো বুকটায় কেন যেন পানির ঢল নামল! আজ এতবার কেন ইচ্ছে করলো- ধ্রুবর আরো একটু কাছে যেতে; জড়িয়ে ধরতে! অথচ সেই অধিকার তো নেই অদিতির! বুকটা ভারি হয়ে এলো ওর! অদিতি ধীর পায়ে হোস্টেলের গেটে ঢুকে গেল।

অদিতি ধ্রুব তখন কাউকে কল লাগাল! ওপাশে কল রিসিভ হলে ধ্রুব বলল——‘‘লক্ষ্মীপুরের একটা বাসের টিকিট কেটে রাখ সামনের সপ্তাহে!’
_____________
অদিতি বাড়ি যাচ্ছে! বাসের জানালার পাশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে! ওর স্থির দৃষ্টি জানালার বাইরে তাক করা। বুকে আজ বড্ড আকুতি! ফোনের মধ্যে ছেলের একটা ছবি পাঠানো হয়েছে। অদিতি এখনো সেই ছবি দেখেনি। দেখার ইচ্ছেও হয়নি। মনে হচ্ছে— জীবনে প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো ভুল কেন করে ফেলল ও। ধ্রুব ওর জীবনে না আসলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত! অদিতির কান্না আসছে এখন! ও একসময় জিজের এই এলোমেলো ভাবনা-গুলোতে অতিষ্ট হয়ে দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরলো! কেন জড়িয়েছিল ও ধ্রুবর সঙ্গে? ধ্রুব কেন, কেন ওর জীবনে এসেছে?

বাস ছেড়ে দিবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাড়ি যাবে; তারপর—আকদ। এরপরেই ধ্রুব ওর থেকে যোজন-যোজন দূরে চলে যাবে! কীভাবে সইবে ও এই দূরত্ব! অদিতি চোখ মুছে; ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। নতুন এই টাচ-ফোন কিনেছে কদিন আগেই। মাত্র ৫ হাজার টাকার ফোন, ছবি ভালো আসে না। তবুও ও লুকিয়ে এই ফোনেই ধ্রুবর একটা ছবি তুলেছিল।

ছবিতে ধ্রুব ময়লা সাদা শার্ট গায়ে; সানগ্লাস বুকের শার্টে ঝুলিয়ে রাখা! মুখটা গম্ভীর; এক হাতে কোকাকোলার ক্যান, অপর হাতে ওর পাশে থাকা ইমনের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলছে। অদিতি ছবিটা দেখতেই থাকে! একসময় আঙুল দিয়ে ছবির ওপর ছুঁয়ে দিতে দিতে বললো ——-‘আপনি আমার প্রেমিক হলে; হয়তো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী হতে পারতাম।আমার এই এলোমেলো-বিস্বাদ জীবনে আপনার আসা উচিত হয়নি, একদমই না।

অদিতি থামল! একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ফোনের স্ক্রিনে; ও সেই জল দ্রুত আঙুল দিয়ে মুছে ফেলল। ছবির দিকে তাকিয়েই রইলো!

‘ছবিটাতে আমাকে ভালো দেখাচ্ছে না, অদিতি!’ ——-আচমকা ধ্রুবর গলা শুনে অদিতির হাত থেকে ফোন পড়ে গেল নিচে; চমকে উঠে সামনে তাকাল। ধ্রুবর চোখে সানগ্লাস; কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো; আজ একটা পরিপাটি কালো শার্ট আর জিন্স পরেছে। ধ্রুব অদিতির দিকে চেয়ে আছে গম্ভীর দৃষ্টিতে!

ধ্রুব এবার একটু ঝুঁকে ফোন মাটি থেকে তুলে সেটার ময়লা মুছে অদিতির পাশে এসে ঠাস করে বসে গেল। অদিতি তখনও বিস্ময়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে! ওর এসবকিছু বিশ্বাসই হচ্ছে না। ধ্রুব অদিতির ফোন পরিষ্কার করে এগিয়ে দিয়ে বলল——‘নতুন ফোনের প্রথম ছবিটাই আমার? গুড; ভেরি গুড!’

অদিতি তখনও অবাক চোখে চেয়ে আছে। ও বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো—-‘আপনি এই বাসে? এটা তো লক্ষ্মীপুর যাচ্ছে।’

ধ্রুব বুঝতে পারল অদিতির মনের দ্বিধা! ও সানগ্লাস চোখ থেকে খুলে বুকের শার্টে ঝুলিয়ে রেখে নিজের মাথা এগিয়ে নিয়ে যায় অদিতির দিকে; অদিতি জমে যায় যেন। ধ্রুব ওর চোখে চোখ মিলিয়ে ফিচেল গলায় বললো——-‘অ্যাই নো এটা লক্ষ্মীপুরের বাস! এন্ড আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, তোমার গ্রামে থাকতে; ইনফ্যাক্ট তোমাদের প্রেম বিরোধী বাড়িতে কদিন থাকব ভাবছি।’

ধ্রুবর চোখে কৌতুক খেলে গেল যেন। অদিতি বিস্ময়ে হতবাক! ও নিজের বিস্ময় লুকিয়ে ধ্রুবের হাত থেকে ফোন নিয়ে বললো——‘অসম্ভব! আপনি খামোকা কষ্ট করেছেন! আমাদের মধ্যে আর কিছুই সম্ভব নয়।’

ধ্রুব অদিতির দিকে হঠাৎ ঝুঁকে এলো। দু’জনের মুখ ছুঁইছুঁই হবে, সেই ভয়ে অদিতি মাথাটা পিছিয়ে নিলো! তাকিয়ে রইল ধ্রুবর চোখের দিকে! ধ্রুব নিজের মতো ওর দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল——‘সম্ভব; আমাদের মধ্যে সবই সম্ভব অদিতি।’

#চলবে