#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব —|২৮|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছে। পাশেই কোনো মসজিদে আসরের আজান হচ্ছিল। বৃষ্টি কমেছে সেই কখন! আকাশ তখনো মেঘলা! অদিতি ভেজা গায়ে; কোনরকম শাল পেঁচিয়ে ছোট-ছোট পা ফেলে হোস্টেলের করিডোর থেকে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে এক নিঃশ্বাস ফেলল। গায়ে ভেজা জামা; লম্বা কোমর-ছড়ানো চুল কয়েকটা কপালের কাছে লেপ্টে গেছে, অথচ চোখদুটো যেন বৃষ্টির চেয়েও ভারী-অস্থির!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অদিতি। ঘরটা অন্ধকার; রুমে তানিয়া নেই। অদিতি ভেজা গায়ে রুমে ঢুকে দরজায় সিটকিনি দিল।
তারপর দৌড়ে জানালার সামনে দাড়িয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল; ধ্রুব বাইকের সিটে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। সাদা শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে;কয়েকবার হাঁচিও দিচ্ছে। অদিতির তাকিয়ে রইল; হঠাৎ ধ্রুব সিগারেটের ধোয়া উড়াতে উপরের দিকে তাকাল। অদিতি ওকে তাকাতে দেখে মুহূর্তেই সরে গেল জানালার আড়াল থেকে। ধ্রুব এলোমেলো পর্দার নড়াচড়া দেখে যা বোঝার বুঝে গেল! ও আর তাকাল না একবারের জন্যেও; একটা ম্লান হাসি দিয়ে সিগারেট ফেলে বাইক স্টার্ট দিল।
বাইকের আওয়াজ শুনে অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পর্দা টেনে দিল। ধ্রুব রেগে আছে এখনও। কিন্তু অদিতির এখানে দোষটা কি? ধ্রুব কেন বুঝতে চাইছে না ওকে!
মন খারাপ করে অদিতি পেছন ফিরতেই দেখে,তানিয়া গামছা চুলে পেঁচিয়ে সামনেই দাড়িয়ে। ভেজা গায়ে অদিতিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে তানিয়া জিজ্ঞেস করলো——‘কই ছিলি তুই? আর ভিজে এসেছিস? তোর কাছে না ছাতা থাকে সবসময়।’
অদিতি নজর লুকিয়ে;দ্রুত শুকনো কাপড় ড্রয়ার থেকে নিতে নিতে বললো——-‘বা…বাইরে যাওয়া লেগেছে।ছা…ছাতা হারিয়ে গেছে।’
তানিয়া হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পুরো রুমটা দেখে বললো——‘তুই রুমের কী অবস্থা করেছিস? এখন গোসল করে আবার সব মুছতে হবে।’
অদিতি শুকনো জামা কাপড় হাতে নিয়ে বললো——‘ আমার ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।ফ্যান চালিয়ে দাও। গোসল করে এসে মুছে দিচ্ছি।’
অদিতি মাথা নিচু করে শুকনো জামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। গরম পানির স্পর্শে কিছুটা স্বস্তি পেলেও বুকের ভেতরের সেই অস্থিরতা কমল না। ও অনেকক্ষণ পর জামা বদলে বেরিয়ে দেখে; তানিয়া ফ্যান চালিয়ে ঘর মুছছে। অদিতি তানিয়ার হাত থেকে ঘর মোছার লাঠি নিয়ে নিজে মোছা শুরু করলো।
তানিয়া চুল থেকে গামছা খুলে; সেটা মেলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। ব্যস্ত অদিতির দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললো——‘ধ্রুব ভাইর সাথে ছিলি?’
অদিতি ঘর মুছতে মুছতে একটু ইতস্তত করে বলল——‘হু।’
তানিয়ার কাছে অদিতিকে ঠিক লাগছে না। ও চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো——-‘সব ঠিক আছে তোদের মধ্যে? তোকে এমন শুকনো লাগছে কেন?’
অদিতির ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কী বলবে সে? ধ্রুব বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ভীষণ রাগী; জেদি! ছোট-মোটো অদিতির দ্বারা তাকে সামলানোই যাচ্ছে না আজকাল। আজ দুপুরে ধ্রুবর সেই রাগী চেহারা, কর্কশ কণ্ঠ, আর চোখের সেই কঠিন দৃষ্টি যেন এখনও তার সামনে ভাসছে। ধ্রুব এমন কেন? এতটা রাগী কেন হতে গেল?
অদিতি বুঝতে পারছে না— আদৌ ও ধ্রুবর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে কি না। কিন্তু অদিতি তো বোকা! মনটা তো পুরোটাই দিয়ে বসেছে ওই রাগী-জেদি ধ্রুবকেই!
ফ্যান অফ করে দিয়ে অদিতি বিছানায় বসলো! ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিল। ধ্রুবর এখন অব্দি কোনো মেসেজ; কল আসেনি। অদিতি মনটা খারাপ করে ফোন রেখে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। বাড়ি থেকে কল এসেছে। কল ধরতেই ওপাশে ফাহিমা বললেন———‘কি রে? তোকে কল দিচ্ছি দুপুর থেকে, তুই ধরলি না?”
অদিতি থামল! কি জবাব দেবে ও? কখনোই মিথ্যা না বলা অদিতি এবার মিথ্যা-টাই শোনালো তার মা-কে——-‘বাইরে ছিলাম মা, ভার্সিটিতে কাজ ছিল।’
ফাহিমা বললেন——‘ওহ। ভালো আছিস তো?’
অদিতি ছোট্ট করে উত্তর দিল——-‘হ্যাঁ। তোমরা?’
ফাহিমা কিছু বলার আগেই; পাশ থেকে ইফাজ ফোনটা কেড়ে নিল তার থেকে। শুরুতেই ভালো-মন্দের ধার ধারলো; বলে বসলো—‘অ্যাই আপু, জানিস আজ গ্রামে বিচার বসেছিল। ওই যে রুমা আপা আছে না? করিম চাচার মেয়ে? তাকে সাহেদ ভাইয়ের সাথে পাকড়াও করেছে স—-‘
ফাহিমা বাকি-কথা আর বলতে না দিয়ে তৎক্ষণাৎ ইফাজকে থামিয়ে ওর থেকে ফোন কেড়ে নিলেন; ধমকে উঠলেন ছেলেকে ফোনের মধ্যেই——‘ একটা চড় দেব। এই ছেলে, তোর বয়স কত? এসব কথার কি তুই বুঝিস? সবসময় পাকনামি। তোর আব্বারে বলবো?’
ইফাজ হয়তো চলে গেছে। অথচ এই কথা-গুলো আবারো অদিতির কানে আসলো! ভয় আগের ন্যায় অদিতির গলা-টা যেন চেপে ধরলো। বর্তমান সুখের আশায় অদিতি যে সবচেয়ে বড় ভুল করে বসে আছে। গলার স্বরটা এলোমেলো হয়ে এলো ওর; জিজ্ঞেস করলো——-‘ওরা… শাহেদ ভাইদের তো করিম চাচাদের সাথে জমি নিয়ে আগে থেকেই ঝামেলায় ছিল,তাহলে এসব?’
ফাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন———‘কি ঝামেলা? ছেলে-মেয়ে ওরা আগেই লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। আজ তোর বাবা বিচারে ওদের আবার সবার সামনে বিয়ে দিয়েছে।’
অদিতির কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো——-আর… একঘরে?’
ফাহিমা জবাব দিলেন——-‘না রে, একঘরে করেননি। বিয়ে তো করেই ফেলেছে, এখন আর কি বিচার করবেন। তাই তোর বাবা শাহেদকে চাকরি নিতে বলে; বিয়ে দিয়ে আলাদা থাকতে বলেছেন। গ্রামেই আছে ওরা।’
তারপর অদিতির আর কিছুই শুনতে পারলো না। পুরনো ভয়-গুলো আবারও ঝেঁকে ধরেছিল ওকে। ফাহিমা নিজের মতো করে অনেকক্ষণ কথা বলে তারপর ফোন কাটলেন। ফোন কেটে যাওয়ার পর অদিতি বিছানায় বসে রইল।মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ধ্রুব-অদিতির সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের শেষ কোথায়? অদিতি কি কখনো পরিবারকে লুকিয়ে ধ্রুবকে বিয়ে করার মতো সাহস আদৌ কোনোদিন করতে পারবে? এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি আদৌ আছে?
জানালার বাইরে আবারো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। অদিতির চোখে আবারও পানি জমতেই; দুহাতে অদিতি চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব ভেবে কি হবে? বাকি যা হবার দেখা যাবে।
অদিতি মলিন হেসে জানালার দিকে তাকাল! জানালার কাঁচে এখনো টপটপ করে জমে থাকা ফোঁটাগুলো গলে নামছে। হঠাৎ ওর মনে হলো— ধ্রুব এখন কী করছে? ও কি সুস্থ আছে? এমন রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে, তার ওপর ভিজেছে বৃষ্টিতে। ধ্রুব এমনিতেই ঠাণ্ডা লাগলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে শুনেছে অদিতি। আসার পর রেগে কল করেনি, মেসেজ করেনি। এত্ত রাগ এই ছেলের! অদিতি না চাইতেও হার মানলো। কল লাগাল ধ্রুবর নম্বরে।
ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক কলটা ধরলেন——-‘সালামুআলাইকুম। কে?’
অদিতি কিছুটা থামল; কে কল ধরেছেন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর ও জবাব দিল ——-‘ওয়ালাইকুম সালাম। এটা ধ্রু…ধ্রুবর নম্ব—-‘
ওপাশ থেকে সঙ্গেসঙ্গে কথা ফুরাবার আগেই বললেন——-‘জি, ধ্রুব স্যারের নম্বর এটা। আমি হারুন। ধ্রুব স্যারের বাসার কাজ করি। আপনি কেডা?’
অদিতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল——‘ফ্রেন্ড।’
হারুন চিন্তিত গলায় বললেন——-‘ ও, ফেরেন্ড! আপা স্যার খুব জ্বরে ভুগছেন। শুয়ে কাতরাচ্ছেন। আমি জলপট্টি দিচ্ছি তারে। বড় স্যার বিদেশে । বাড়িতে কেউ নাই। আপনারা কেউ এসে দেইখা যান উনারে।’
অদিতি মুহূর্তেই ব্যাকুল হয়ে গেল। হবে না জ্বর! গতকাল এতবড় এক্সিডেন্ট করে দুদিন যায়নি আজ আবার ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা। অদিতি চিন্তা নিয়ে বললো———‘জ্বর? কখন থেকে জ্বর?’
‘বাইরে থেকে আসবার পর থেকেই। মুখটা লাল হয়ে গেছে, কয়েকবার বমিও করেছেন।’
অদিতির চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন। উঠে দাড়িয়ে গেল বিছানা থেকে; জিজ্ঞেস করলো——-‘চাচা, সে কি কিছু খেয়েছিলেন? কোনো মেডিসিন?’
হারুন বিরস কণ্ঠে বললো——-‘না আপা, কিছুই খায়নাই। বড় স্যার তো এখন কাতারে। আমি তো এসব বুঝি না। কী অসুদ খাওয়ামু?’
অদিতি শুনে গেল! কি করবে এখন? অদিতি বললো——-‘ ধ্রুবর বাকি ফ্রেন্ডদের খবর দিয়েছেন?’
হারুন জবাবে হতাশ শ্বাস ফেলে বললো——‘ বলসিলাম আমি। স্যার তো ডাইরেক্ট মানা করে দিসেন। আপনাদের বন্ধুগো মধ্যে কি কিছু হইছে আপা?’
অদিতির কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। ও ছোট করে বললো——-‘ আপনি উনার পাশে বসুন চাচা। আমি আসছি।’
অদিতি আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। হাত পা কাঁপছে ওর। ও ঘরে ছোট ইলেকট্রিক চুলা দিয়ে, পাত্রে চাল আর ডাল দিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিল। খিচুড়ি রান্না শেষ হতেই একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ারে সেসব ভরল। ড্রয়ার থেকে একটা বড় শাল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে, তানিয়াকে বলে দ্রুত বেরিয়ে এলো।
____
অদিতির টিফিন হাতে ধ্রুবদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল! বিশাল বাড়ি; নেমপ্লেটে লেখা——‘Iyamin’s family’
অদিতি কলিং বেল বাজাতেই দরজা খোলা হলো। হারুন অদিতিকে দেখতেই মুহূর্তেই চিনে ফেললো। বিস্ময় নিয়ে বলল——-‘আপনি অদিতি ভাবি না? ধ্রুব স্যার যারে ভালোবাসেন? একটু আগে আপনি আমারে কল দিসিলেন?”
অদিতি কিছুটা হকচকিয়ে গেল! এ বাড়ির সবাই কি অদিতিকে চিনে? কিভাবে? ও তো কোনোদিন এ বাড়িতে পা-ও রাখেনি। অদিতি ইতস্তত করে বললো——-‘আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?’
হারুন মৃদু হেসে বললো——-‘আপনার ইয়া বড় একটা শাড়ি পড়া ছবি ধ্রুব স্যারের রুমে টাঙ্গানো আছে। আপনারে তো এই বাড়ির সবাই চিনে। আসেন ম্যাডাম, ধ্রুব স্যার রুমেই আছে। আমি আপনারে নিয়ে যাই।”
অদিতি লজ্জায় মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। ধ্রুবদের বাড়িটা বিশাল। অভিজাত পরিবেশ, দামি আসবাব, নিখুঁত সজ্জা—সব কিছুতেই পরিপূর্ণতা। অথচ বাড়ির ভেতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু দু-একজন কাজের মানুষ বাড়ি-ময় হাঁটাচলা করছেন।
হারুন অদিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল ধ্রুবর রুমের দিকে। দরজা ধাক্কা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল তারা। অদিতি দেখল্লো; ধ্রুব বিছানায় দুটো কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। কপালে জলপট্টি রাখা, মুখটা ফ্যাকাশে এবং রক্তিম। পাশে খাবার ঢেকে রাখা ট্রে। খাওয়া হয়নি তার এখনো বোঝা যাচ্ছে। রুমে বেডের উপরে দেয়ালে কালচারাল প্রোগ্রামে অদিতির নীল শাড়ি পড়া একটা বিশাল ছবি ফ্রেম টাঙ্গানো; যেখানে অদিতি গিটার হাতে হাসছিল কারোর সঙ্গে।
অদিতি ছবিটা দেখে মনেমনে অস্বস্তি বোধ করল। সবাই কি ভাবছে বাড়ির কে জানে? ও টিফিন হাতে এগিয়ে গেল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর পাশে বেডে বসলো না, চেয়ার টেনে বসলো।
হারুন বললো———‘আপনি খাবার আনসেন? দেন আমি প্লেটে বেড়ে দিতেসি।’
হারুন অদিতির হাত থেকে টিফিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হতেই অদিতি চুপচাপ চেয়ারে বসে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলো! কি শান্ত-ইনোসেন্ট লাগছিল ধ্রুব ইয়ামিনকে। অথচ এই ছেলেটাই রেগে গেলে চারপাশ লন্ড-ভন্ড করে ফেলে। অদিতি হাত বাড়িয়ে জ্বর দেখল!ইয়া আল্লাহ, চমকে হাত সরিয়ে ফেলল ও। এত্ত জ্বর! অদিতির মন আরও ব্যাকুল হলো যেন। ও দ্রুত জলপট্টি দেওয়া শুরু করলো! কপালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই ধ্রুব বিড়বিড়ালো—‘ম..মা! ঠা…ঠান্ডা লাগছে।’
অদিতির অস্থির হলো ভীষণ; ধ্রুবর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ——-‘ধ্রুব? শুনছেন? অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব জবাব দিল না। হারুন ততক্ষণে এসে গেছে——-‘ম্যাডাম, এই নেন, স্যাররে খাওয়াইয়া দেন। আর কিছু দরকার হলে ডাকবেন আমাকে। আমি পাশের রুমেই আছি।’
অদিতি হারুনের থেকে প্লেট নিলো। হারুন হাতে করে বাড়ির মেডিসিনের বক্সও এনেছে। অদিতি বক্স থেকে নাপা বের করে রাখলো। হারুন বক্স রেখে দিল টেবিলে। অদিতির দিকে চেয়ে বললো———‘আপনে এত্ত বালা ম্যাডাম। ধ্রুব স্যার ভাগ্য করে এমন একটা লক্ষ্মী পাইসেন।’
হারুনের কথাতে অদিতি চুপ হয়ে গেল! মাথাটা নিচু করে শুয়ে থাকা ধ্রুবর দিকে তাকাল; মনেমনে ভাবলো———‘ সত্য বলতে আমি না; বরং সে-ই আমার জীবনের ব্লেসিং।’
হারুন চলে গেল; যাবার আগে দরজা হালকা করে ভিড়িয়ে দিয়ে গেলো। রুমে এখন শুধুই অদিতি আর ধ্রুব। জানালার পর্দা হালকা দুলছে। রুমের বাতাস ভারী। ধ্রুব একটু নড়ে উঠল, যেন ঘুমের ভেতরেও ওর অশান্তি হচ্ছে ভীষণ।
অদিতি ধীরে ধীরে ধ্রুবর চুলে হাত রাখলো; ডাকলো আলতো গলায়——-‘ধ্রুব? উঠুন। খেয়ে নিন। মেডিসিন নিতে হবে আপনার।’
ধ্রুব কয়েকবার ডাকাডাকির পর ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ঝাপসা দৃষ্টিতে শুরুতেই অদিতির চিন্তিত মুখটা দেখতে পেল। অদিতির ওর দিকে ঝুঁকে আছে! ধ্রুব শুরুতে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না। ওর বাড়িতে ওকে না জানিয়ে অদিতি আসার মতো মেয়ে তো অবশ্যই নয়!
‘ত…তুমি এ..এখানে কেন?”—ধ্রুব অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো।
অদিতি খিচুড়ির ধোয়া উঠা প্লেটে ফুঁ দিতে দিতে বলল——‘আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছি। এখন উঠুন, খেয়ে নিন।”
ধ্রুব মুখ কুঁচকে ফেলল খাওয়ার কথা শোনা-মাত্রই! মুখটা সম্পূর্ণ তেতো হয়ে আছে ওর। মজা পাচ্ছে না কোনও খাবারেই। ও চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বললো———‘ খ…খাব না। খ..ক্ষুধা নেই।’
অদিতি এবার রাগ দেখিয়ে বলল——‘আমি অনেক কষ্টে বানিয়ে এনেছি।আমার আনা খাবার নষ্ট করবেন আপনি?’
ধ্রুব চুপচাপ অদিতির রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই রাগে ভরা মুখটা যেন অদ্ভুত ঠেকলো ওর কাছে। মায়ের পর কেউ কখনো এভাবে তাকে যত্ন করেনি। অসুস্থতার দিনগুলোতে সে বরাবরই একা থেকেছে। দরজাটা বন্ধ করে নিজেকে পৃথিবী থেকে আলাদা করে রেখেছে সৌরভ ইয়ামিনকেও দূরে রেখেছে। কিন্তু আজ অদিতি তার রুমে বসে তাকে এভাবে শাসন দেখাচ্ছে; এসব ধ্রুবর জন্যে নতুন একদম। ধ্রুব এসবে অভ্যস্ত নয়!
অদিতি ধ্রুবকে এখনও শুয়ে থাকতে দেখে, আবার চোখ রাঙালো; বললো———‘আপনি উঠবেন না? আমি খাবার নিয়ে বেরিয়ে যাব ঘর থেকে?’
ধ্রুব অসুস্থতার মধ্যেও মলিন হাসল। রাগী অদিতিকে ওর মারাত্মক লাগছে! ও আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করলে, অদিতি সাহায্য করল তাকে। ধ্রুব বালিশ পেছনে দিয়ে আরাম করে বসল। ক্লান্ত দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল——-‘দাও।’
অদিতির ঠোঁটে এবার হাসি ফুটল।ও প্লেট এগিয়ে দিলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব চামচ দিয়ে খেতে শুরু করল। খিচুড়ির ধোঁয়া উঠছে, ধ্রুব এক এক চামচ খাবার মুখে নিচ্ছে। অদিতির চোখের সামনে যেন পুরো দৃশ্যটা ভয়াবহ সুন্দর দেখালো। ধ্রুব ওর হাতের বানানো খাবার এই জ্বরের মধ্যেও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে; অনুভূতির আঁচড় অদিতির মনে এবারেও দাগ কেটে গেল। ও নির্নিমেষ চেয়ে দেখতে লাগলো ধ্রুবর খাওয়া।
ধ্রুব খাওয়া শেষ করে প্লেটটা অদিতির দিকে বাড়িয়ে দিল। অদিতি মেডিসিন এগিয়ে দিল। ধ্রুব ওষুধ খেয়ে নিল।
অদিতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ধ্রুব খাওয়া শেষ করে ক্লান্ত-ভঙ্গিতে বেডে হেলান দিল। অদিতি বললো——-‘শুয়ে পড়বেন?’
ধ্রুব উত্তর দিল——-‘না; বসি কিছুক্ষণ।’
অদিতি এবার সাহস সঞ্চয় করে বলল——-‘আপনার সাথে ইমন ভাইদের কী কোনো সমস্যা চলছে?’
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেল।মাথাটা এতক্ষণ কের ধরে ছিলো, অদিতির কথা শোনা-মাত্রই ওর চোখে-মুখে যেন ছড়িয়ে গেল সেই মাথা-ব্যথা। ধ্রুব ঠান্ডা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলো———‘তোমাকে কে জানিয়েছে?’
অদিতি ঠোঁট চেপে উত্তর দিল———‘হারুন চাচা।’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখ শীতল; ও সেভাবেই জবাব দিল———‘শাস্তি দিচ্ছি কিছু ভুলের জন্য। ক’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অদিতি শ্বাস আটকে শুনে গেল কথাগুলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অদিতি চোখ ছোটছোট করে ধ্রুবর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে; ভয়ে-ভয়ে প্রশ্ন করল——-‘আর আমার ওপর? আমার উপরও কি আপনি এখনো রেগে আছেন?’
ধ্রুব ভ্রু তুলে তাকাল। অদিতির দিকে শীতল চোখে চেয়ে হেয়ালি করে বললো———-‘রাগ করার মতো কিছু কি করেছো তুমি?’
অদিতি মৃদু কণ্ঠে বললো———‘আজ দুপুরে নদীর পাড়ে…’.”
ধ্রুব কথাটা শেষ করার সুযোগ দিল না। হাতে থাকা পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে; ঠান্ডা গলায় বললো——-‘জানিনা আমি কিছু।’
ধ্রুবর কণ্ঠে যে রাগ ছিলো; সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অদিতির বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ধ্রুবকে এভাবে এড়িয়ে যেতে দেখে তার কান্না পেয়ে গেল।
সে ধ্রুবর হাতটা আলতো করে ধরে ফেলল——-‘সরি ধ্রুব। আপনি রাগ করেছেন আমি জানি। আপনি আমার উপর রাগ না করলে এভাবে শান্ত গলায় কথা বলতেন না।”
ধ্রুব অদিতির চেপে রাখা দুজনের হাতের দিকে একবার চেয়ে অদিতির গোলগাল মুখের দিকে তাকাল! অদিতির চোখে অনুময়; অপরাধবোধ স্পষ্ট! ধ্রুব হতাশ শ্বাস ফেলল সেটা দেখে! শীতল গলায় সোজাসোজি একটা প্রশ্ন করল——-‘অদিতি; আজ অব্দি আমি কখনো তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে স্পর্শ করেছি? একবারের জন্যেও?’
অদিতি সঙ্গেসঙ্গে বললো——‘ধ্রুব আমি—-‘
ধ্রুব কথা থামিয়ে আবারও দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করলো ——-‘ফার্স্ট আনসার ম্যাই কুয়েসশন! হ্যা কি না?’
অদিতি মাথাটা নিচু করে বলল —-‘ন..না।’
ধ্রুব এবার কিছুটা রাগ নিয়েই বললো———‘তাহলে সেদিন কেন তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে? কেন তোমার আচরণে মনে হলো আমি… অ্যাই অ্যাম অ্যা ব্লাডি ইফটিজার; যে তোমাকে জোর-জবরদস্তি করছে। অথচ আমি তোমার অনুমতি তখনও চেয়েছিলাম; চাইনি আমি?’
অদিতি মাথা তুলে তাকাল ধ্রুবর দিকে। তার গলা কাঁপছে; ও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো———‘ধ্রুব, আমি সেটা ভেবে ধাক্কা দিইনি। আমি… আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ধ্রুব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল——‘ভয়? আমাকে ভয় পেয়েছিলে তুমি? তোমার কি মনে হয়েছে, আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে….ওহ গড! অদিতি আমি তোমাকে ভালোবাসি; তোমাকে জাস্ট ছোয়ার জন্যে আমি এতটা কষ্ট করিনি। তুমি একবার বলতে; এসব তুমি চাওনা। আমি একবারের জন্যেও তোমাকে টাচ-ই করতাম না। তুমি আমার ব্যাপারে এসব ভাবলেই বা কিভাবে? জাস্ট স্পিচলেস!’
অদিতি টলমলে চোখে চেয়ে অধৈর্য্য গলায় বললো——-‘ধ্রুব, প্লিজ আমাকে ভুল কেন বুঝছেন? আমি ভেবেছি— আপনি বোধহয় এসব চান। শহরে না থাকায় হয়তো আমি-ই এসব নিতে পারছি না। ধ্রুব, বিয়ের আগে এসব ব্যাপার নিয়ে আমি ভয় পাই ভীষণ। আমি ওরকম আপডেটেড মেয়ে ছিলাম না কোনোদিন।’
ধ্রুব এবার সরাসরি অদিতির দিকে তাকাল! কিছুক্ষণ অভাবেই তাকিয়ে থেকে; তারপর হঠাৎ করে বললো——-‘ওহ; সবকিছুর মুলে তাহলে এক বিয়েই। বিয়ে হলেই তোমার ভরসা হবে ধ্রুব ক্যারেক্টারলেস নয়। ওকে দেন! লেটস গেট ম্যারিড। আজকেই; এই মুহূর্তেই।’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব—-২৯
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুব এবার সরাসরি অদিতির দিকে তাকাল! কিছুক্ষণ অভিমানে তাকিয়ে থেকে; তারপর হঠাৎ করে বললো——-‘ওহ; সবকিছুর মূলেই তাহলে এক বিয়েই। বিয়ে হলেই তোমার ভরসা হবে ধ্রুব ক্যারেক্টারলেস নয়। ওকে দেন! লেটস গেট ম্যারিড। আজকেই; এই মুহূর্তেই।’
বোকা-সোকা অদিতি হায়াতের মাথায় যেন বাজ ছিটকে পরে! ধ্রুব চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে রয়েছে অদিতির ‘হা’—হয়ে থাকা মুখটার দিকে। অদিতিকে এই মুহূর্তে ভীষণ বাচ্চা-বাচ্চা লাগছিল! ২০ বছরের একটা বাচ্চা! ধ্রুবর হাসি এলেও; ও মুখ-চোখ ইচ্ছে করেই গম্ভীর করে রাখল।
অদিতি হতবুদ্ধি হয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে।ধ্রুব ওর এভাবে তাকানো দেখে নিজস্ব ভঙ্গিতে ডান ভ্রু-টা উঁচালো; অধরে দাঁত চেপে ঠান্ডা স্বরে বললো-——‘কি? তাকিয়ে আছো কেন এভাবে? অ্যানি প্রবলেম?’
কথাটা বলে; ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে অদিতির হা হয়ে থাকা মুখটা থুতনি ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে ভয় পাওয়ার ভান করে বললো——‘ই্যয়ুর রিয়েকশন ইজ স্ক্যারিং মি!’
ধ্রুব সরে বসলো; অদিতির হা হয়ে থাকা মুখটার বন্ধ আপাতত।অদিতি বিস্ময় চেপে রেখে; বললো ——‘মানে? বিয়ে….এইভাবে? এই অবস্থায়?’
ধ্রুব অবাক হওয়ান ভান ধরে নিজের দিকে তাকালো! এই মুহূর্তে ও ক্যাজুয়াল একটা টিশার্ট-ট্রাউজার পরে আছে! বাসার ড্রেস দেখে ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে অদিতিকে দেখলো! তারপর গা ছেড়ে দিয়ে; বললো——‘টিশার্ট পরে বিয়ে করা যায়না? পাঞ্জাবি পড়তে হবে?ফাইন! আজ তোমাকে নিয়ে গিয়ে শপিং করে দেব দুজনের। হবে?’
অদিতি বিরক্ত হয়ে গেল এবার। ধ্রুবর মজা করাটা ওর একটুও ভালো লাগলো না। ও হাতে থাকা খিচুড়ির প্লেট ঠাস করে টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল; চোখ-মুখ কুঁচকে বললো——‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন জাস্ট। আমার মনে হয় জ্বরে আপনার মাথাটা সম্পূর্ণ গেছে।’
ধ্রুব বিছানায় বসে থাকা অবস্থায় দুর্বল হাতে অদিতির হাত টেনে ধরে ওকে আবার বসিয়ে দিল নিজের পাশে, বিছানায়। অদিতি ধ্রুবর পাশে বসে বিরক্ত হয়ে তাকাল; বললো ——‘ধ্রুব; ভালো হচ্ছে না কিন্তু। মজা বন্ধ করবেন আপনি?’
ধ্রুব অদিতির হাতটা টেনে নিজের হাতে রাখলো! আঙ্গুলের ভাজে আঙুল রেখে অদিতির চোখের দিকে তাকাল; মৃদু কণ্ঠে বলে গেলো ——‘আ’ম ফাইন। তুমি শোনো আগে! আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে; তোমার বাবা ও আমাদের কোনোদিন আলাদা করতে পারবেন না। আর বিয়ে করা তো তোমার বাবাও সাপোর্ট করেন; রাইট? মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমার গ্রামের একজনের বিয়ে হওয়াতে তাদের আলাদা করা হয়নি। তোমার বাবা উল্টো খুশি ছিলেন তাদের উপর।’
আজকেই সবে বাড়ি থেকে পাওয়া এই খবর-গুলো স্বয়ং ধ্রুবর মুখে হুবুহু শুনে অবাক হয়ে গেল অদিতি। ও ভ্রু কুঁচকে ফেললো; ——‘আপনি? আপনি এই খবর কোত্থেকে পেলেন? আমার বাড়িতে এখনো নজর রাখছেন আপনি?’
ধ্রুব ভ্রু বাকিয়ে তাকাল; হেঁয়ালি করে বলল ——‘তুমি জানতে না এসব? আমার শালা বলেনি তোমাকে?’
‘শালা?’ —-অদিতি ধ্রুবর কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না।
ধ্রুব এবার গলা কেশে; মাথা তুলে তাকাল অবাক হয়ে বসে থাকা অদিতির দিকে। তারপর গলা খাকারি দিয়ে, সুর টেনেটেনে বলে গেলো——‘ই..ইফাজ। ইফাজ হায়াত! দ্য ব্রাদার অফ অদিতি হায়াত।’
অদিতির মুখ আবার হা হয়ে গেল! ও অবাক হয়ে বললো——‘ওর সঙ্গে আপনার কথা হয়? ইয়া আল্লাহ! আব্বা জানলে ওরে মেরে ফেলবে।’
ধ্রুব সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু বাঁকালো,—‘কেউ আমার শালাবাবুকে ধরতে পারলে তো! ওর দুলাভাই আছে না? হি উইল প্রটেক্ট হিম!’
অদিতি হাল ছাড়লো! ধ্রুব যা নাছোড়বান্দা, যা বলে তাই করবে!
ও ছোট করে শ্বাস ফেলে বলল ——‘ধ্রুব, আমার যেতে হবে। রাত হচ্ছে। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি রান্না করে রেখে যাচ্ছি। সময়মতো খেয়ে নিবেন। মেডিসিন নিবেন। আমি কিন্তু কল করে খোঁজ নেব।’
অদিতি কথাটা বলে ধ্রুবর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, উঠে দাড়ালো। টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলালো! ধ্রুবর মুখটা মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। আবার সেই একাকী দিন; অন্ধকার রুম!
ছোট থেকে একা থেকে থেকে এতকাল অভ্যাস হলেও; এখন অদিতি ওর জীবনে আসার পর মনে হয়— কেউ একটা থাকুক পাশে। হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে, মনে মন ছুয়ে রয়ে যাক সারাটাজীবন। ঘরটা অন্ধকার না হয়ে মোমবাতির আলোয় ঝিলমিলাক, কাবার্ড জুড়ে শাড়ি-গুলো সাজুক যত্নে!
এতক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও,মুহূর্তেই ধ্রুব কেশে উঠে! কাশতে কাশতে বহু কষ্টে বলার চেষ্টা করলো ——‘আ..আমি সিক! আমাকে এভাবে রেখে চলে যাবে?’
অদিতি স্বাভাবিক চোখে দেখতে লাগল ধ্রুবর কাশি! এতক্ষণ যে লোক এত কথা বলে ফেলেছে; সে অদিতি চলে যাবার কথা শুনে আবার সিক হয়ে গেল! যত্তসব ধান্দাবাজি! অদিতি কোমরে হাত দিয়ে; বলল ——‘ধ্রুব! এক্টিং ভীষণ বাজে হচ্ছে কিন্তু।’
ধ্রুব কথাটা শোনামাত্রই কাশি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো! অদিতির কঠিন-নির্দয় চোখ-দুটো দেখে ও পরপর চোখ উল্টে শ্বাস ফেলে বললো——‘ফাইন, এক্টিং করছি না।’
অসুস্থ থাকায় ধ্রুব রীতিমত বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে! নিজের গম্ভীর-রাগী-জেদী স্বভাবের বাইরে গিয়ে ধ্রুব ইয়ামিনের এই ছেলেমানুষী আচরণ-গুলো অবাক ঠেকলো অদিতির কাছে।
অদিতি ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললো——‘আপনার কথা বলার ধরন শুনে মনে হচ্ছে না আপনি আর সিক আছেন। ব্রেইন ঠিকই ফাংশন করছে! ঘুমান এখন। আমি আসি! ফোনে যেন শুনতে না পাই; আপনি মেডিসিন নিচ্ছেন না।’
‘এত সন্দেহ থাকলে থেকে যাও তুমি! থেকে টেক কেয়ার করো।’—- ধ্রুবর কণ্ঠে বিরক্তি! এত দরদ ওর সহ্য হচ্ছে না!
অদিতি টেবিল থেকে মোবাইল ফোন নিতে নিতে বলল ——‘জি না। যেদিন বউ হয়ে আসব; সেইদিন থেকে এক্সট্রা টেক কেয়ার চলবে।’
ধ্রুব এবার অসভ্য চিন্তায় মাথার পেছনটা চুলকালো; বাঁকা হেসে বলল ——‘রাতভর?’
অদিতি সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুঁচকালো, ফোন হাতে নিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো——-‘কি?’
ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্র ভাব-টুকু মুখে ফুটিয়ে তুলে বললো——‘আই মিন কেয়ার; টেক কেয়ার চলবে। অন্য কিছু ভাবছো নাকি?’
ধ্রুব ভ্রু বাকাল! ওর চোখে দুষ্টু ইঙ্গিত! অদিতি মুহূর্তেই লজ্জায় পরে গেল; মুখ লুকিয়ে অন্যপাশে সরিয়ে ফেলল! নিজেই নিজের এমন উদ্ভট চিন্তায় বিরক্ত; লজ্জিত! ধ্রুব তো এখন পেয়ে বস্নে আরো!
অদিতির লাজুক মুখটার দিকে ধ্রুব তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করল; চোখ বড়বড় করে, অদিতিকে ইচ্ছে করে টিজ করতে বলল——‘কি তোফাজ্জল হায়াতের ভদ্র মেয়ে। এই অবস্থা তোমার? কি চিন্তা করছো আজকাল? আরে, এখনো আন্ডার এইজ তুমি! এখনই এসব? ছি-ছি!’
অদিতি লজ্জায় যেন মারা যাচ্ছে! ও লজ্জায় মুখ সরিয়ে ফেলল; ধ্রুবর দিকে না তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ——‘আমি আসছি।’
অদিতি চলে যাবে; তার আগেই ধ্রুব মজা থামিয়ে পেছন থেকে ডাকলো —-‘দাঁড়াও!’
অদিতি দাঁড়ালো, পেছন ফিরে তাকালো! ধ্রুব শরীর থেকে কম্বল এক ঝটকায় সরিয়ে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। ঠান্ডা লাগছে বিধায় টিশার্ট এর উপরে গ্রে কালারের হুডি পরে নিলো! টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবি হাতে নিতে নিতে বলল ——‘পৌছে দেই, চলো ।’
একটু আগেই ধ্রুব জ্বরে কথা অব্দি বলতে পারেনি। এখনও নিজের স্বভাবের মধ্যেও আসেনি। আর এখন এতদূর বাইক চালাবে? অদিতি সঙ্গেসঙ্গে মানা করে বলল ——‘না না, লাগবে না। আপনি সিক! বিশ্রাম নিন।’
ধ্রুব বাইকের চাবি পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে এগিয়ে এলো! অদিতির পাশে দাঁড়াতেই ছোট-মোটে অদিতিকে মাথা তুলে তাকাতে হলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব মৃদু হেসে অদিতির নাকে আঙুল দিয়ে হালকা করে টোকা দিয়ে বলল ——‘ধ্রুব সিক হতে পারে; কিন্তু নিজের রেসপন্সিবিলিটি জানে! পাকামো না করে চলো এখন।’
অদিতি নাকে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে! ধ্রুব ওকে ফেলেই আগে আগে হাঁটা ধরেছে ততক্ষণে! অদিতি কি করবে আর! এই ছেলেকে যা বোঝাবে তার উল্টোটাই বুঝবেন! তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা বাড়াল ধ্রুবর সঙ্গে।
বাইকের কাছে গিয়েই অদিতি আবার ধ্রুবর দুর্বল দেহ দেখে, কাতর গলায় মানা করে বললো ——‘ধ্রুব! আপনি এই অবস্থায় বাইক চালাবেন? কেন পাগলামো করছেন? জ্বর আপনার এখনো কমেনি।’
ধ্রুব এবার বিরক্ত হলো ভীষণ। এই মেয়েকে নিয়ে কই যাবে? ও অদিতির কথা এক ফোঁটা পাত্তা না দিয়ে সোজা ওর মাথায় কালো রঙের হেলমেট পরিয়ে দিয়ে সেটার উইন্ডো বন্ধ করতে করতে বলল ——‘আর কথা বললে বাইক কাজী অফিসের সামনে নিয়ে থামাবো! ধ্রুব জ্বর নিয়েই অনেককিছু করতে পারে; ই্যয়ু কান্ট ইমাজিন দ্যাট!’
অদিতি ভ্রু কুচকে ফেলল! ধ্রুব বাইকে উঠে বসে, হেলমেট মাথায় চরিয়েছে। অদিতি সেভাবেই দাড়িয়ে ধ্রুবকে দেখতে লাগল! ধ্রুব বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, হেলমেটের উইন্ডোর ফাকে অদিতির দিকে তাকালো! ওর এমন তাকানো দেখেই অদিতির সুরসুর করে উঠে বসলো বাইকে। বাইকের হ্যান্ডেলে হাত দিতেই ধ্রুব সামনে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল——‘ওটা ধরলে পরে যাবে; আমাকে ধরে বসো।’
অদিতি জানে; হ্যান্ডেল ধরলে ও পরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তোফাজ্জলের সঙ্গেই ও জীবনে বাইকে উঠেছে! যতবার বাবার সঙ্গে বাইকে উঠেছে, ঝাপটে ধরেছে! ধ্রুবকে কিভাবে ধরবে? অদিতি ভয় পেয়ে, না চাইতেই ধ্রুবর পেটের দুপাশের হুডি আঙ্গুলের ফাকে হালকা ভাবে খামচে ধরে রাখলো; লজ্জায় আয়নার দিকে আর তাকালো না! মুখ সরিয়ে অন্যপাশে তাকাল। ওর ভীষন অস্বস্তি হচ্ছিল! এভাবে…এভাবে কোনো ছেলের বাইকে ও! অদিতি কুণ্ঠিত!’
ধ্রুব আয়নায় এতক্ষণ ধরে অদিতির একেকটা কাজ দেখছিল! অদিতি ধরে বসতেই, ও নিশ্চিন্ত হয়ে বাইক চালু করলো!
হোস্টেলের সামনে আসতেই, অদিতি তাড়াহুড়ো করে নেমে দাঁড়াল। এতক্ষণ ধ্রুবর সঙ্গে বাইকে ছিলো; জমে আছে যেন অদিতির সারা গা!
ধ্রুব চাবি ঘুরিয়ে মাথা থেকে নিজে হেলমেট খুললো! ধ্রুবর এলোমেলো; ব্রাশ-ছাড়া ঝাকরা চুল-গুলো সঙ্গেসঙ্গে কপালের উপর ছড়িয়ে পরলো! অদিতি তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। অসুস্থ ধ্রুবকে মলিন চেহারায়ও খারাপ দেখাচ্ছে না! বরং হুডি গায়ে, ঝাকরা চুলে ধ্রুবকে দেখতে মারাত্মক লাগছিল! অদিতি লাজুক নাহলে; ধ্রুবকে বলে, ধ্রুবর গায়ের ওই গ্রে রঙের হুডিটা চেয়ে নিত!
ধ্রুব হেলমেট বাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে; অদিতির দিকে তাকাল! অদিতি তখনো ধ্রুবর হুডির দিকে চেয়ে আছে। ধ্রুব অদিতির চোখ লক্ষ করে ভ্রু কুঁচকে নিজের পরনের হুডির দিকে তাকাল। পরপর মাথা তুলে অদিতির দিকে তাকিয়ে; ভ্রু বাকিয়ে হঠাৎ বললো——-‘লাগবে এটা?’
অদিতি চমকে উঠল; দ্রুত চোখ সরিয়ে বলল——‘কি?’
ধ্রুব স্বাভাবিক গলায় বললো——‘ হুডি ভালো লেগেছে? নিবে?’
অদিতি লজ্জায় আই-ঢাই করে উঠে——‘ন…না, না! আমি এমনিতেই—-‘
ধ্রুব অদিতির কথা পুরোটা আর শুনেইনি! নিজের মতো করে গা থেকে হুডিটা খোলা শুরু করলো! অদিতি চুড়ান্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেল যেন! এভাবে কেন হ্যাবলার মতো হুডির দিকে তাকিয়েছিল; রাগে নিজেকেই থাপ্পড় দিতে মন চাইল ওর! অদিতি দুহাতে মানা করলো——‘লাগবে না আমার। আমি ছেলেদের এটা নিয়ে কি করব?’
ধ্রুব হুডিটা শরীর থেকে খুলে অদিতির হাতে জোর করে গছিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো——-‘এটা ছেলেদের না। ধ্রুবর, তোমার ধ্রুবর। নিতেই পারো তুমি; ইউ হ্যাভ নাও লিগ্যাল রাইট ফর দিস!’
অদিতি নিজের হাতে ধ্রুবর জোর করে দেওয়া হুডির দিকে তাকিয়ে আবার ধ্রুবর দিকে তাকাল! ধ্রুব হালকা করে হেসে; অদিতির নাকে আঙুল দিয়ে আলতো করে টোকা দিয়ে বললো—-‘নাকটা লাল হচ্ছে,চেরি টমেটো লাগছে দেখতে, ইয়াম্মি টমেটো।’
‘জী!’—- অদিতি তাড়াহুড়ো নাকে হাত দিল! ধ্রুব এক ভ্রু উঁচাতেই,অদিতি লজ্জায় নাক থেকে হাত সরিয়ে নিল; লাজুক গলায় হালকা হেসে বলল ——‘আসি!’
ধ্রুব নরম গলায় বললো-——‘বাই!’
অদিতি ধ্রুবর হুডি হাতে চলে যাচ্ছে। ধ্রুব তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে! বড় শাল অদিতির গায়ে জড়ানো; তবুও শালের ফাঁকে উকি দিচ্ছে ওর লম্বা বেনুনি! ভালো লাগছে দেখতে! অদিতি হোস্টেলের গেইটের সামনে যেতেই, ধ্রুব চোখ সরিয়ে নিল! হেলমেট হাতে নিয়ে, মাথায় দিবে; তখন হোস্টেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অদিতি পেছন ফিরে ডাকল ——‘ধ্রুব?’
ধ্রুব হেলমেট হাতে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো! অদিতি লম্বা শ্বাস ফেলল; তারপর ধ্রুবর প্রশ্নবোধক দৃষ্টির দিকে চেয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে বললো——-‘আপনার বউ হলে এই হুডি-গুলো কি সব আমার হয়ে যাবে?’
ধ্রুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অদিতির দিকে। ওর অবাক চোখ-মুখ তারপর ধীরেধীরে হেসে উঠল, ধ্রুব মৃদু হেসে মাথা নাড়াল—-‘এভসুলেটলি!’
অদিতি লাজুক হাসল; হাতের হুডিটা একহাতে নিজের সঙ্গে শক্ত করে চেপে, হেসে বাম হাত নেড়ে আবার ফিসফিস করে বললো——‘বাই।’
ধ্রুব উত্তরে মৃদু হেসে, বাই বলে হাত নাড়াল! অদিতি উত্তর পেয়ে লাজুক হেসে ভেতরে ঢুকে গেল।
অদিতি যেতেই ধ্রুব ডান হাতের আঙ্গুলের ডগায় কপাল চেপে; হেসে ফেলল শব্দ করে! কপাল চুলকে বিড়বিড় করলো——‘বাচ্চা একটা।’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব—-৩০
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুবর জ্বর আবার বাড়ছিল। বাইক চালাতে চালাতেই সেটা ভীষণভাবে টের পাচ্ছিল সে। হুডি পড়া থাকলে হয়তবা এতটা হিম করা ঠান্ডা লাগতো না। হুডির কথা মনে পড়তেই; ধ্রুবর গম্ভীর ঠোঁটে হালকা একটা হাসি দেখা গেল! ধ্রুব বাইকের হ্যান্ডেলে রাখা অদিতির পরা হেলমেটটার দিকে তাকাল! হালকা হেসে হেলমেটটার উইন্ডো বন্ধ করে দিয়ে বিড়বিড় করল——‘অ্যাই গেইজ অ্যাম বিং ডেসপারেট লাভার।!’
একচোট শীতল বাতাস শরীরে ঝাপটে পড়তেই শরীরের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো! শরীরটা যেন ঠান্ডায় হেলে পড়তে চাইছে। ধ্রুব ইয়ামিন বাইকের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে ধ্রুব লম্বা শ্বাস ফেলে, নিজেকে স্থির রাখার ব্যর্থ চেষ্টাও করে গেল পুরোটা রাস্তা।
বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই গেটের বাইরে সৌরভ ইয়ামিনের নিজস্ব টয়োটা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল সে। সামনে টহলরত দুইজন পুলিশ সদস্য একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। ধ্রুব বাইক পার্ক করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বসার ঘরের আলো তার চোখে এসে লাগলো।
সোফায় সৌরভ ইয়ামিন বসে আছেন। কালচে সাদা শার্ট, কালো কোট পরা। চোখের নিচে গভীর ক্লান্তির ছাপ। তার পাশে কয়েকটি লাগেজ রাখা। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল টেবিলের ওপর এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। সৌরভের মুখে সেই পুরনো শাসনের ছায়া।
ধ্রুব কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল। চোখের দৃষ্টিতে অবজ্ঞা স্পষ্ট। নিশ্চয়ই বিডিতে কাজ ছিলো; আর সেই কাজের কারণে সবাইকে ধ্রুবর অসুখের বাহানা শুনিয়েছেন! এগেইন পুরনো ড্রামা! এক মুহূর্তের জন্য সৌরভের চোখের দিকে তাকিয়ে, ধ্রুব পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল।
সৌরভ পেছন থেকে কঠোর গলায় ডাকলেন—-‘দাঁড়াও, ধ্রুব!’
সৌরভের গম্ভীর কণ্ঠ ঘরের নীরবতাকে ভেঙে দিল। ধ্রুব থেমে গেল, কিন্তু পেছনে ঘুরল না। হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল।
সৌরভ এবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। চওড়া কাঁধ সোজা, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ধ্রুবর দিকে চেয়ে কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন——‘তুমি এই জ্বর নিয়ে বাইরে কোথায় গিয়েছিলে? আমি পাগলের মতো সবকিছু ফেলে এখানে এসেছি। হারুন বলল তুমি খাওনি কিছু। এখন রেস্ট না নিয়ে কোথায় ছিলে?”
ধ্রুবর ঠোঁট বাঁকা হাসিতে বেঁকে গেল। তার চোখে তীব্র বিদ্রুপ ফুটে উঠল——‘তোমাকে সব বলা লাগবে নাকি?’
সৌরভের চিবুক শক্ত হয়ে গেল। চোখের মণি সংকুচিত হয়ে উঠল। রাগ যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে তার শরীরে——‘বেয়াদবি একদম করবে না ধ্রুব! কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
ধ্রুব কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। মুখের অভিব্যক্তি থেকে অবজ্ঞার ছাপ একটুও মুছে যায়নি। ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠল। রান্নাঘরের ভেতর থেকে হারুন বাপ-ছেলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে ভয় পেয়ে ছুটে এল।
ধ্রুব-সৌরভ নামক স্বয়ং দু-দুটো বাঘকে একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে থাকতে দেখে হারুনের মুখে ভয় আর উৎকণ্ঠার ছাপ খেলে গেল।
সৌরভ হারুনের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন——‘ও মেডিসিন নিয়েছে?’
হারুন এক মুহূর্ত ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুবের মুখে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব স্পষ্ট। হারুন দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়াল——‘ওই অদিতি ম্যাডাম এসেছিলেন। রান্না কর—”
সৌরভের ভ্রু কুঁচকে গেল। তার চোখে বিস্ময় ভেসে উঠল,—-‘অদিতি? সন্ধ্যায় এসেছিল?’
হারুন এবার নিচু গলায় বলল——‘ জী! ধ্রুব স্যার কিছু খাচ্ছিলেন না; তাই উনি রান্না করে রেখে গেছেন স্যারের জন্যে। আর এখন ধ্রুব স্যার উনাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন।’
সৌরভের চোখ এবার সরাসরি ধ্রুবর দিকে গিয়ে স্থির হলো। ধ্রুব সেই দৃষ্টি এড়িয়ে চোখ সরিয়ে নিল। কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বাইকের চাবি আঙ্গুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যেতে লাগল।
সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসলেন। হারুনের দিকে চেয়ে বললেন——-‘মেয়েটাকে কিছু দিয়েছ খেতে?’
হারুন মাথা নিচু করে বলল——‘নুডলস দিয়েছিলাম। খাননি ম্যাডাম।’
সৌরভ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করলেন। মনে মনে হয়তো কিছু ভাবলেন। তারপর হাত তুলে ইশারা করে হারুনকে চলে যেতে বললেন। পাশেই সিক্রেটারি রাহুল আইপ্যাড হাতে দাঁড়ানো! আইপ্যাডে কিছু একটা করছে! সৌরভ জিজ্ঞেস করলেন——‘ সমস্যা সলভ হয়েছে?’
রাহুল চিন্তিত গলায় বললেন ——‘ হিসেব এখনো মিলছে না স্যার। চেষ্টা করছি আমরা। টিম লাগিয়েছিলাম, ওরাও পজিটিভ উত্তর দিতে পারছে মা।’
সৌরভ এবার রেগে গেলেন; চিৎকার করে বললেন ——-‘ ঘোড়ার ঘাস কাটো বসে তুমি আর তোমার টিম। একটা খাতার হিসেব মেলাতে পারছ না। যদি কোনোভাবে এটা মিডিয়ার কানে যায়; ভাবতে পারছো কি হবে?’
রাহুল দ্রুত বললো—-‘ স্যা…স্যার আমরা ট্রাই করছি। আপনি প্লিজ শান্ত হোন।’
সৌরভ উঠে দাঁড়ালেন; টেবিল থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে আঙুল উঁচিয়ে রাহুলকে শাসালেন——‘ আজকের মধ্যে সব সলভ করো। করতে পারলে স্যালারি বাড়বে না পারলে চাকরি থেকে রিজাইন দিবে। রাবিশ লোকজন পুষে রেখেছি এতদিন।’
সৌরভ রাগে গজরাতে গজরাতে সিঁড়ির দিকে এগুলেন।
_________
ধ্রুব তার রুমের বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘরের আলো কমিয়ে রেখেছে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখের পাতা ভারী। পাশের টেবিলে রাখা পানির বোতলটা খালি। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়ল। ডাক্তার আফজাল প্রবেশ করলেন। সাথে সৌরভও। ধ্রুব তাদের দেখামাত্রই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল! শুরু হবে এসের ডাক্তারির নাটক এখন! ভালো লাগে না আর এসব!
ধ্রুবর ভাবনা মতোই; বেশ অনেকক্ষণ ধরে আফজাল পরীক্ষা করলেন ধ্রুবকে। তাপমাত্রা মেপে, কিছুক্ষণ চেকআপ করে বললেন——‘জ্বর একটু কমেছে। প্যারাসিটামল চালিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজে থাকার কারণেই এই অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তবে বিশ্রাম খুব দরকার।”
সৌরভ হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ধ্রুবর দিকে এক ঝলক দৃষ্টিতে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছিল পিতৃসুলভ যত্ন আর উদ্বেগ। ধ্রুব সেই দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য এড়াতে পারল না। কিন্তু সাথে সাথেই মুখ ফিরিয়ে নিল। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল—‘যত ন্যাকামো।’
অথচ ধ্রুব জানলোই না; সৌরভ ইয়ামিন এই মুহূর্তে লাইফের সবচেয়ে কঠিন সময়-টুকু পাড় করছেন। তবুও এই সময়েও ছেলের প্রতি নিজের দায়িত্ব-গুলো ঠিকঠাক করে যাচ্ছেন। ধ্রুব যতই উনার থেকে মুখ ফেরাক; সৌরভ ধ্রুবর মা-কে মৃত্যর সময় কথা দিয়েছেন— মা হারা ছেলেকে পুরোটা সময় দুহাতে আগলে রাখবেন। কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেবেন না। তবুও এত চেষ্টা করেও সৌরভ পারেননি। ধ্রুব বরং কয়েক লক্ষ মেইল দূরে সরে গেছে তার থেকে!
ডাক্তার চলে গেলেন। সৌরভ ছেলের ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়া মুখতার দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বললেন——‘কি খাবে? স্যুপ নাকি অন্য কিছু?’
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল; মাথার উপর কম্বল টেনে বলল——‘আই নিড স্লিপ নাও।’
সৌরভ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। হাত বাড়িয়ে ছেলের কপালে হাত রাখার ইচ্ছে হলো, কিন্তু ফোনের রিংটোন সেই মুহূর্তটাকে ভেঙে দিল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল— তোফাজ্জল নামটা।
ধ্রুবও দেখলো নামটা। ওর ভ্রু কুঁচকে গেছে মুহূর্তেই। ও তাকালো সৌরভের দিকে। সৌরভ স্বাভাবিক ভাবেই ফোন রিসিভ করলেন।
—‘কি তোফাজ্জল? কেমন আছো? অনেকদিন পর কল দিলে।’
ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠ—-‘ ভালো! তোমরা?’
সৌরভ বললেন ——‘ একটু ঝামেলায় আছি। ভাবি-বাচ্চারা ভালো তো?’
তোফাজ্জল উত্তর দিলেন ——‘ হ্যা। আছে ভালোই।’
সৌরভ বললেন ——‘ তোমার মেয়ের কি খবর? বিয়ে হয়ে গেছে?’
তোফাজ্জল থামলেন; বললেন ——‘ না। পাত্রের সমস্যা থাকায় বিয়েটা হয়নি। পাত্র খুঁজছি ওর জন্যে।তোমার জানামতে ভালো পাত্র থাকলে আমাকে বলিও।’
সৌরভ স্বাভাবিক ভাবেই বললেন—-‘নামটা কি যেন তোমার মেয়ের?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো——‘অদিতি হায়াত।’
সৌরভের চোখ বড় হয়ে গেল। ধ্রুবও চমকে তাকাল। দেয়ালের গায়ে ঝোলানো অদিতির ওই নীল শাড়ি পড়া ছবির দিকে এক ঝলক তাকালেন সৌরভ।
সৌরভ আলগোছে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন ——‘ ছবি আর বায়োডাটা পাঠিয়ে দাও। আমি দেখছি।’
কল কাটলেন সৌরভ। ফোনের ওপাশে ছবিটা দেখে সৌরভ-ধ্রুবর দুজনের ভ্রু একসঙ্গে কুঁচকে গেল! ধ্রুব হতবম্ব হয়ে সৌরভের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথায় কিছুই যেন ঢুকলো না।
সৌরব মজা করে যেসে বললেন বললেন——‘ওহ! তাহলে তোফাজ্জলই তোমার হবু শ্বশুর! বাহ!’
ধ্রুব নিজের বিস্ময়-টুকু লুকিয়ে বলল—-‘কি বলেছে উনি?’
সৌরভ হাসলেন। তার দৃষ্টিতে হালকা মজা যেন ঝিলিক দিল——‘তোমার প্রেমিকার জন্যে পাত্র খুঁজতে বলল।”
ধ্রুব ভ্রু কুচকে ফেলল!সৌরভ হেসে বললেন ——‘ ভালো হয়েছে। বাবা হয়ে আমি তোমাকে শুধরাতে পারিনি: তোফাজ্জল পারবেই।’
ধ্রুব সৌরবের এমন মজা নেওয়াটায় বিরক্ত হয়ে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল——‘উনার সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক? কিভাবে উনি তোমাকে চিনেন?”
ঘরের মধ্যে থমথমে নীরবতা নেমে এলো! সৌরভ শান্ত গলায়, অতীতের স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতে বলতে শুরু করলেন। তার কণ্ঠ যেন পুরনো স্মৃতিচারনে ভারী হয়ে উঠল———-‘‘তখন আমি উঠতি রাজনীতিবিদ। তোমার মা তখনও জীবিত। তখনও তার ক্যানসার ধরা পড়েনি। একদিন লক্ষ্মীপুর যাই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে। ওই বাসে তোফাজ্জল ছিল; ওর তখন পায়ে সমস্যা; একটা এক্সিডেন্টের পর হাঁটায় অসুবিধা হতো। পথিমধ্যে ওই বাসে ইঞ্জিন ব্লাস্ট করে আগুন লেগে যায়। আমরা সবাই বেরিয়ে আসতে পারলেও তোফাজ্জল আটকে যায়। সবাই যখন বেঁচে ফিরে যখন স্বস্তির শ্বাস ফেলছিলাম; হঠাৎ আমার মনে হলো গাড়িতে কাউকে দেখা যাচ্ছে। তখন আমরা তোফাজ্জলের চিৎকার শুনি গাড়ির ভেতর থেকে। বাকিরা ভয় পেয়ে যায়; তখন চারপাশে আগুন জ্বলছে। কেউ এগিয়ে যায়নি ভয়ে। আমি তখন যুবক; রক্ত টগবগ করছে! আমি কারো বাধা না মেনে ঝাঁপিয়ে পরি ভেতরে। কোনরকমে তোফাজ্জলকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার কাঁধের দিকে একটা পোড়ার দাগ আছে না? ওটা তখনকার। তোফাজ্জলের গায়েও আগুন লেগেছিল। ওর পিঠেও আছে পোড়ার দাগ! তারপর থেকে তোফাজ্জলের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়। ওর ছেলে-মেয়েরা তখন ছোট! আমি নাম জানতাম শুধু। কিন্তু ওখান থেকে ফিরে আমার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। তোমার মা মারা যাওয়ার পর আমিও একপ্রকার কাজে ডুবে যাই। বাড়িতে না গেলেও দুই তিন বছর আগে ওকে একবার ঢাকায় দেখেছিলাম। আমার সাথে তখনই লাস্ট দেখা হয়েছে। ভাবি-বাচ্চাদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা হয়নি। তাই জানতাম না; অদিতি এই যে এই অদিতি হায়াত; যাকে তুমি ভালোবাসো।’
ধ্রুব চুপচাপ শুনে গেল। তার মুখের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল। ভ্রু কুঁচকে আছে। চোখের পাতা কিছুটা ভারী হয়ে এল। সে একপাশে মুখ ফিরিয়ে নিল নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল——‘কো-ইনসিডেন্ট!’
সৌরভ এবার ধ্রুবর দিকে তাকালেন; বললেন ——-‘তুমি চাইলে আমি তোমার কথা তোফাজ্জলকে বলতে পারি।’
ধ্রুব চকিত দৃষ্টিতে সৌরভের দিকে তাকাল। এত সহজ সবকিছু; অদিতিকে বিয়ে করার কত সুন্দর উপায়। অথচ ধ্রুব জেদ দেখালো, ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে বলল—-‘দরকার নেই। আমার লাইফ আমাকে দেখতে দাও।’
সৌরভ এবার চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। আলো-আঁধারি ঘরে তার মুখটা যেন আরও গম্ভীর দেখাচ্ছে। শান্ত কণ্ঠে বললেন——‘বাবার কাছে হেল্প চাওয়া খারাপ কিছু না। সমস্যা নেই। যেদিন তোমার মনে হবে; আমাকে বাবা বলে হেল্প চাওয়া যাবে; চেও। আমি হেল্প করব! তোমার জীবনটা যদি আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে পারি; আমার চেয়ে বোধহয় বেশি খুশি আর কেউ হবে না।’
ধ্রুব তাকিয়ে রইলো সৌরভের দিকে। পরপর মুখ ঘুরিয়ে নিল! সৌরভ বাতি নিভিয়ে দিতে দিতে ধীর গলায় বললেন——‘ঘুমাও; অসুস্থ তুমি।’
তারপরে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
_______
ধ্রুব কোকের বোতল হাতে আড্ডাখানায় বসে আছে। জ্বর নিয়েই আজ ও ভার্সিটিতে। তার চোখেমুখে এক অস্থিরতা। বোতলটা হাতের আঙ্গুলের ফাকে বারবার ঘুরাচ্ছে। দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে কিছু একটা ভাবছে শুধু!
ইমন পাশ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল—-‘তুই অযথা এসব প্যাঁচাল পারছিস! আঙ্কেলের কাছে সাহায্য চাইতে আমি কোনো প্রবলেম দেখছি না।’
ধ্রুব কোকের বোতল ঝাকানো বন্ধ করে; বিরক্ত গলায় বলে উঠল—-‘দরকার নেই আমার।’
সুমন এবার পাশ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল—-‘অদিতি ভাবি উনার বাবাকে রাজি না করাতে না পারলে কখনোই আপনাকে লুকিয়ে বিয়ে করবে না ভাই। এটা জানেন?’
ধ্রুব রাগে ফুঁসে উঠল। কোকের বোতলটা মাটিতে এবার ছুড়ে মারলো——-‘অন্য উপায় বের করতে হবে। তবুও তার কাছে গিয়ে আমি নিজেকে ছোট করব না। সে ছাড়া কি এই বিয়ে ইম্পসিবল নাকি?’
ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধ্রুব অযথাই যে এই ফালতু জেদ-গুলো দেখাচ্ছে এসব ওকে কে বোঝাবে?
হঠাৎ কোথা থেকে রাজন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ধ্রুবর সামনে দাঁড়াল। কাপা গলায় বললো——‘ধ্রুব ভাই! আপনার বাবাকে মানি-লন্ডারিং মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। টিভিতে নিউজ হচ্ছে। মোবাইল কোথায় আপনার?’
ধ্রুব হতবাক হয়ে গেল। ধ্রুবর ভ্রু এটা শুনেই কুঁচকে গেল। তার চোখেমুখে স্পষ্ট অবিশ্বাসের ছাপ। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থাকার পর, হাত দিয়ে ইমনকে ইশারা করে বলল——-‘এমবি আছে? ফেসবুক অন কর।’
ধ্রুবর কণ্ঠে কিছু একটা যেন ছিলো। ইমন ভয়ে ভয়ে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকল। ফোনের স্ক্রিনের আলো ওর থমথমে মুখটা আরও স্পষ্ট করে তুলল। ঢুকেই ইমনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
পুরো নিউজফিড জুড়ে একের পর এক পোস্ট, লাইভ ভিডিও আর নিউজ আর্টিকেল! ‘সৌরভ ইয়ামিনের মানি লন্ডারিং কাণ্ড!’ বড় বড় হেডলাইন। সংবাদপত্রের কাটআউটের মতো ভেসে উঠছে স্ক্রিনজুড়ে। কিছু পোস্টে পুলিশের ছবি, কিছু পোস্টে সৌরভ ইয়ামিনের সাদা-অলিভ রঙের বাড়ির সামনে বিশাল পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি।
ইমন ফাঁকা ঢোক গিলে, ভয়ে কাঁপতে থাকা হাতে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ধীরে ধীরে ইমনের হাত থেকে ফোনটা নিল। ওর চোখের মণি স্ফীত হয়ে উঠল। আঙুল দিয়ে দ্রুত স্ক্রল করতে লাগল। একের পর এক ভয়াবহ তথ্য ভেসে উঠছে স্ক্রিনে।
তারপর ধ্রুব ইউটিউব খুলল। চোখ-মুখ শক্ত করে একটা ভিডিও ক্লিপ চালু করল। ভিডিওটি মাত্র দশ মিনিট আগে আপলোড করা হয়েছে। নিউজ অ্যানকারের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল——
‘খাদ্য মন্ত্রী সৌরভ ইয়ামিনকে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে আটক করা হয়েছে। এই অবৈধ অর্থ পাচার চক্র চলছে গত দশ বছর ধরে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আজ দুপুরে পুলিশ কমিশনার হিমেল হোসেন চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন ইয়ামিন বাড়িতে। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাংলো থেকে তাঁকে আটক করা হবে। আরও বিস্তারিত জানাবেন আমাদের প্রতিবেদক ফয়াজ।’
ধ্রুব ভিডিওটা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা বন্ধ করে ইমনের দিকে তাকাল। তার চোখে বিস্ময়, রাগ আর হতাশার মিশ্রণ।
ইমন আশপাশে তাকাল; কেউ কি ওদের দেখছে? তারপর ধ্রুবর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল——‘তুই এসব জানতিস? তুই কি কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছিস?’
ধ্রুব একথা শুনেই ইমনের ফোনটা ছুড়ে মারল তার কোলে। ইমন দ্রুত ক্যাচ করল। ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরল যেন সেটা হাত থেকে পড়ে না যায়। ধ্রুব দ্রুত কয়েকটা বড়বড় পা ফেলে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। তার মুখ কঠোর, চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে।
রাজন আর সুমন একে অপরের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল——‘ভাই, আমরাও যাচ্ছি। ইমন ভাই, আপনি ভাইয়ের লগে যান।’
ইমন তাড়াতাড়ি ধ্রুবর পেছনে বাইকে চেপে বসল। বাইকটা স্টার্ট দেয়ার পর মুহূর্তেই ধ্রুব গতি বাড়িয়ে দিল।
ইমন বাইকের ১৮০ স্পিড দেখে ভয়ে ধ্রুবর কাঁধে হাত চেপে ধরলো! ধ্রুব অদ্ভুত আচরণ করছে, তার গভীর শ্বাস নিতে থাকা কাঁধগুলো বোঝাচ্ছিল, ভিতরে কী যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ইমন তার কাঁধে হাত রেখেই ভাবছিল, ‘যে বাবাকে ধ্রুব কখনো বাবা বলে স্বীকারই করেনি, সেই বাবার জন্য ওর আজ এতটা অস্থিরতা কেন?’
_______
অদিতি অনেকদিন পর পড়ার টেবিলে বসেছে। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। বইয়ের পাতাগুলো ওর সামনে খোলা থাকলেও অদিতির মন অন্য কোথাও। সময়ের চাপ, নতুন নতুন প্রেমের দহন,তারমধ্যে পড়ার চাপ— সব মিলিয়ে মাথার ভেতর যেন যুদ্ধ চলছে।
হঠাৎ দরজা ঠেলে তানিয়া দৌড়ে ঢুকল রুমে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, নিঃশ্বাস দ্রুত। তানিয়া কোনও কথা না বলে সরাসরি ফোনটা অদিতির সামনে ধরল।
অদিতি ভ্রু কুঁচকে তানিয়ার দিকে তাকাল। তানিয়া একশ্বাসে বলে গেলো———‘তোর হবু শ্বশুরকে পুলিশ নিয়ে যাবে আজ; পুরো মিডিয়া ক্ষেপে গেছে।’
অদিতির তানিয়ার দিকে চেয়ে; পরপর অবিশ্বাসের চোখে ফোনের দিকে তাকাল। নিউজফিডে শুধু একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছে— ‘সৌরভ ইয়ামিন।’
তানিয়া বলল——‘অনেকে তো আন্দাজ করছে ধ্রুব ভাইও এতে জড়িয়ে আছে। পুলিশ প্রমাণ পেলেই উনাকেও নিয়ে যাবে।’
অদিতি অবিশ্বাস নিয়ে বলল——‘ধ্রুব এসব কখনোই করবে না!’
তানিয়া বলে উঠল——‘ধ্রুব ভাই কি আদৌ জানিস? তার বাবার ডান হাত! মন্ত্রী মানুষ; খু/ন-খারাবি; এসব ছোটখাটো মানি লন্ডারিং এসব ওদের কাছে দুধভাত। ধ্রুব ভাই যে আঙ্কেলের সব কাজে হেল্প করে; এটা সবাই জানে। আমার মনে হচ্ছে ধ্রুব ভাইও এই কেইসে ফেসে যাবে। কল করেছিস উনাকে?’
অদিতি তানিয়ার বাকিটা আর শুনল না। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ধ্রুবকে কল দিল।
ধ্রুব সবে বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে নামল! বাড়ির সামনে বিশাল ভিড়! আশপাশে মিডিয়ার লোকজন।বাড়ির সামনে মানুষ গিজগিজ করছে। পুলিশের বিশাল বাহিনী লাঠি উঁচিয়ে মানুষদের সামলাচ্ছে। কেউ কেউ মোবাইল তুলে ভিডিও করছে।
ধ্রুব বাইক থেকে নামতেই তার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল— ‘অদিতি ইজ কলিং…’
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য ফোনের দিকে তাকাল, তারপর কলটা কেটে দিল।তারপর সে এগিয়ে গেল পুলিশের ব্যারিকেডের দিকে। ঠিক তখনই গোয়েন্দা সংস্থার গাড়ি এসে থামল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তাকবির দেওয়ান। তিনি মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলছিলেন। ধ্রুব তার দিকে এগিয়ে গেল। তাকবির দেওয়ান ফোন রেখে ধ্রুবর দিকে তাকালেন।
ধ্রুব উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াল; কিছুটা উদ্বেগ দেখিয়ে বলল——‘আঙ্কেল, এসব কী হচ্ছে?’
তাকবির দেওয়ান ধ্রুবর কাঁধে রাখলেন——‘ডোন্ট ওরি, ধ্রুব। আমরা দেখছি বিষয়টা।’
ধ্রুবর চোখে রাগ; এসব ড্রামা মন্ত্রী জগতে নতুন নয়। দু বছর আগেও সৌরভ ইয়ামিন আরেকটা কেইসে ফেসেছেন। তাকবির দেওয়ান এর সাহায্যে সেই কেইস সলভ করা হয়েছিল।
ধ্রুবর চোখ-মুখ শক্ত; বললো——-‘এগেইন আবার এসব মেলোড্রামা! কে করছে এসব আমাদের এবার বের করাই লাগবে। বড্ড উড়ছে সবাই।’
তাকবির দেওয়ানের কানে ব্লুটুথ; ভীষণ ব্যস্ত এখন। উনি ব্যস্ত ভাবেই বললেন ——‘আমরা দেখব এটা নিয়ে; একসঙ্গে বসবো! কিন্তু তার আগে তোমার বাবাকে নির্দোষ দেখানো লাগবে।’
ধ্রুব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে. তাকবির দেওয়ান ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললেন——‘ষড়যন্ত্রও হতে পারে, আবার সত্যিও হতে পারে।তোমার বাবাকে আমি দুদিন আগেও সতর্ক করেছিলাম। যাই হোক; তোমার নামেও কিন্তু অভিযোগ এসেছে। প্রমাণ পেলে পুলিশ তোমাকেও গ্রেফতার করবে। তুমি কিছুদিন গা ঢাকা দাও। আমি বিষয়টা দেখছি।’
তাকবির দেওয়ান ফোর্স নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অদিতির বারবার কল আসছে। খোদা, এই মেয়েটা এত অধৈর্য্য কেন? ধ্রুব ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অদিতির কল রিসিভ করল। রাগে শুরুতেই দিল ধমক——-‘হোয়াট? বারবার কল দিচ্ছ কেন? কল ধরছি না মানে ব্যস্ত আছি, রাইট?’
অদিতি থেমে গেল; যা বলার ছিলো গিলে নিয়ে নিচু গলায় বললো——-‘সরি।’
সরি শব্দটা শোনামাত্রই ধ্রুবর সব রাগ পরে গেল! ধ্রুব নিজেকে ঠান্ডা করলো; বললো——-‘কি বলবে?’
অদিতি কম্পিত গলায় বললো—-‘ধ্রুব, এসব….আপনার নামেও কি মামলা? প্লিজ, বলুন!’
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করল। মৃদু গলায় বলল——‘ডোন্ট ওরি, আই উইল বি ফাইন। এখনো মামলা হয়নি; রাইট? আর হবেও না; প্রমিজ! আর শোনো; টেনশন না নিয়ে চুপ করে বসে থাকো। আমাকে কল দিয়ো না। আমি ব্যস্ত থাকব।’
ধ্রুব আবার হেঁয়ালিতে উত্তর দিচ্ছে। এড়িয়ে যাচ্ছে এত গুরুতর বিষয়টা। অদিতি ভয়ে প্রায় কান্না গলায় বলল——‘ধ্রুব, প্লিজ! রাগের মাথায় কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না।
ধ্রুব গভীর শ্বাস নিয়ে ভিড়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখে তাকাল. চোখ তো নয় যেন সিংহের দৃষ্টি! ধ্রুব হালকা হাসল এবার; তীব্র গলায় রহস্য করে বলল——‘ডোন্ট প্যানিক! ফ্রম নাও, এভরিথিং উইল বি নিট অ্যান্ড ক্লিন! বাই! এন্ড লাভ ইউ!’
অদিতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধ্রুব কল কেটে দিল ধ্রুব।
এমন একটা মুহূর্তে ধ্রুবর মুখে ‘লাভ ইউ’ শুনে সম্পূর্ণ গা যেন ঠান্ডা হয়ে গেল অদিতির। অন্যসময় হলে অদিতি লজ্জায় হেসে ফেলত; তবে এখন কেন যেন ওর হাসি বা লজ্জা কিছুই পেল না। ও দ্রুত আঙুল চালিয়ে ইমনকে কল লাগালো! ইমন ভিড়ের মধ্য থেকে পাশ কাটিয়ে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে অদিতি অস্থির কণ্ঠে বলল———‘ভাইয়া, আপনি কোথায়?’
আশপাশে ভিড়ের জন্যে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। ইমন চেঁচিয়ে বলল——‘ ধ্রুবদের বাড়িতে আছি আমি।’
অদিতি শুনে; দ্রুত বললো——‘প্লিজ ভাইয়া, ধ্রুবর দিকে খেয়াল রাখবেন। ও রাগের মাথায় কিছু একটা করে বসবে: আমার ভয় হচ্ছে।’
ইমন এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো! অদূরে ধ্রুবকে দেখা যাচ্ছে। যে ভিড়কে নিজের শক্ত-পোক্ত হাতে ঠেলে ইয়ামিন বাড়ির সদর গেইট দিয়ে প্রবেশ করছে। ইমন সেদিকে চেয়ে বলল——‘রিল্যাক্স, অদিতি। আমি আছি। কিন্তু তুমি তো জানো, ধ্রুব যা ভাবে, সেটা করেই ছাড়ে। দেখা যাক কি হয় সামনে।’
অদিতি চুপ করে গেল। ইমন এবার হুট করে ভাবুক কণ্ঠে বলল———‘কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না, ধ্রুব হঠাৎ করে তার বাবার প্রতি এতটা সফট হলো কীভাবে? এমনটা আগে কখনো দেখিনি। সামথিং ইজ ফিশি মেইবি……
#চলবে