#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব — ৩৪
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
(🛎️বিয়ে স্পেশাল পর্ব)
তোফাজ্জল ধ্রুবর দিকে চেয়ে আবার সৌরভের দিকে তাকালেন। সৌরভ তোফাজ্জলের কঠোর-কঠিন মুখ-টুকু দেখে ঢোক গিলে বললেন ———‘আমার ছেলের জন্যে তোমার অদিতির হাত চাই। অদিতি মাকে আমার বাড়ির বউ করতে চাই সৌরভ!’
তোফাজ্জলের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। ইফাজ চোখ বড় করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। ওর ছোট-মোটো হৃদয় ভয়ে নিভে আছে।বিয়ের কথাটা শোনামাত্রই সঙ্গেসঙ্গে এক দৌড়ে ভেতরে অদিতির রুমে চলে গেলো ইফাজ।
তোফাজ্জল সৌরভের কথা শুনে অবিশ্বাস নিয়ে বললেন ——‘অসম্ভব! এ দাবি আমি মানতে পারব না।’
ধ্রুব চেয়ারের হাতল চেপে ধরে শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো তোফাজ্জলের দিকে। সৌরভ তোফাজ্জলের অগোচরে চেয়ারের হাতলে রাখা ধ্রুবর হাত চেপে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। সয়রভের দিকে চেয়ে অনুরোধ নিয়ে বললেন ——-‘প্লিজ তোফাজ্জল! আমি তোমার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি! আমার ছেলে কিছু চেয়েছে তোফাজ্জল! ও মা মারা যাবার পর ওকে আমি এখন অব্দি কিছু দিতে পারিনি!তোমার মেয়েটা এত সরল-সহজ। আমার ছেলেটার লাইফ শুধরে যাবে। ছেলেটার একটা হিল্লে করতে না পারলে তোমার প্রয়াত ভাবি আমাকে কোনোদিন মাফ করবেন না তোফাজ্জল! আমাকে দয়া করো! দয়া করে; করুনা করে নাহয় তোমার মেয়েটাকে দাও!’
তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে গেলেন! ধ্রুবর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে; অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নিজের সন্দে অটুট থেকে সরাসরি বললেন ——-‘আমার মেয়ের বিয়ে কালকে! দাওয়াত খেতে আসায় আমি ভীষণ খুশি হয়েছি! আমাকে আর এসব বলে লজ্জা দিয়ো না সৌরভ! তোমরা বসো। আমি তোমাদের জন্যে খবরের ব্যবস্থা করছি!’
তোফাজ্জল এটা বলার সাথেসাথে লুঙ্গি সামলে বাইরের ঘরে চলে গেলেন! সৌরভ হতাশ গলায় ছেলের দিকে তাকালেন! ধ্রুব তোফাজ্জলের যাওয়ার দিকে চেয়ে ব্যাকুল ভন্যিতে আবার সৌরভের দিকে তাকাল। সৌরভ হতাস চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালে; ধ্রুবর এবার উনার কিছু বলার আগেই বলে ফেলল———‘নো; নো! আমি কিছু শুনতে চাইনা! তুমি জানো তুমি এ বিষয়ে আমাকে হেল্প না করলে আমার হেল্প ফিউচারের জন্যে তুমি ভুলে যাও! এন্ড অ্যাই মিন ইট!’
বলে ধ্রুব সৌরভকে আর কিছু বলারই সুযোগ দিল না, চুপ করে উঠে গেলো চেয়ার থেকে। উঠোনের দিকে যেতেই দেখে জানালার ফাঁকে অদিতি দৌড়ে এসেছে! ধ্রুব ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল! অদিতির চোখ ভেজা! ধ্রুব ঢোক গিলে! অদিতিকে কি খুব বেশি কেদেছে? হৃদয়টা যেন নড়ে উঠল ওর। ধ্রুব নরম চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল!
মাঝখানে গ্রিল; গ্রিলের ওপাশে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা! ধ্রুব গ্রিলের ওপাশে হাত বাড়িয়ে আঙ্গুলের ডগায় অদিতির চোখের পানি আঙুলে নিয়ে টোকা দিয়ে ফেলে বলল——-‘ইউর টিয়ার্স হার্টস মি! এই এইখানটায়!’
বলে ধ্রুব আঙুল দিয়ে নিজের বুকের বা পাশ ইশারা করল। ধ্রুবর চোখ ছোট হয়ে আছে; কপাল কুঁচকে; অসহায় এক ভঙ্গিতে চেয়ে আছে অদিতির দিকে। ওমন মুখ-ভঙ্গি দেখে অদিতি কান্নার মধ্যেও মাথাটা নিচু করে নিশব্দে হেসে ফেলল!
ওই হাসিতে ধ্রুব কুপোকাত! সেও হাসল! তারপর গ্রিলের ওপাশেই অদিতির কপালে নিজের কপালটা ঠেকালো। অদিতির আবার কান্না আসছে। ধ্রুব কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানছে। ধ্রুব একপর্যায়ে ঠান্ডা গলায় বলে——-‘কেঁদেছিলে কেন?’
কথাটা বলার সাথেসাথে অদিতির গাল বেয়ে আরেক ফোটা জল গড়ালো। ধ্রুবর গালে এসে লাগলো ওই জল। ধ্রুব দ্রুত মাথা সরিয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে দু গাল চেপে; চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো———‘ওকে; ওকে! ডোন্ট ক্রাই! অ্যাই ওয়াজ জাস্ট আস্কিং! ডোন্ট ক্রাই! হু? চোখ মুছো!’
অদিতি চোখ মুছে না; ফুপিয়ে উঠে বলল ——-‘এই বিয়ে হলে আমি ম-রে যাব ধ্রু…’
ধ্রুব অদিতির ঠোঁটে আঙুল চাপল; থেমে গেল এই মেয়ের কণ্ঠের সকল শব্দ। শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব বোঝাল সময় নিয়ে—-—‘হুশ! আমি আছি; রাইট? ডোন্ট ই্যয়ু ট্রাস্ট মি?
অদিতি মাথা নাড়ল; যার অর্থ সে বিশ্বাস করে ধ্রুবকে। ধ্রুব হাসার চেষ্টা করে বলল ———‘আমায় বউ আমি কাউকে দিব না; ই্যয়ু নো দ্যাট। আজ এলাম; কাল তুমি আমার ঘরের বউ হয়ে আমার ঘরে থাকবে। প্রমিজ!’
অদিতিকে ধ্রুব সেবার বেশ সময় নিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।
উঠোন থেকে ফিরে ধ্রুব বসার ঘরে এসে দেখে সৌরভ-তোফাজ্জল কেউ নেই! চেয়ারে বসতে বসতে ইমনের দিকে চেয়ে বলল ———‘এরা কোথায়?’
ইমন আইসক্রিম খেতে খেতে জবাব দিল——-‘আঙ্কেল তোর শশুরের সাথে কথা বলতে ভেতরের ঘরে গেছে।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পাশ থেকে সুমন বিরক্ত গলায় বললো——-‘ভাই; আপনার শশুর এত্ত ঘাড় ত্যাড়া ক্যান?’
ধ্রুব উত্তরে চোখ উল্টে হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল ———‘এই বিয়ে হলে অ্যাই সয়ার উনাকে আমি শেখাব বেস্ট বাবা হওয়া কাকে বলে। আমি কক্ষনো আমার চাইল্ডদের সাথে এত রূড হবো না; ডিফেনেটলি।’
পাশ থেকে রাজন টিপ্পনি কেটে বলল ——-‘বাপের দিক থেকে ভাবি কিন্তু আমাদের এক্কেরে সেরা! কোনও প্যাচ নেই; সরল সোজা! আর বাপ;পুরাই এক হিটলার!’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন পকেট থেকে বের করে স্ক্রোল করতে লাগলো।
ইমন এবার সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলো ——‘ভাবির সাথে দেখা হয়েছে তোর?’
ধ্রুব ফোনে কিছু একটা টাইপিং করছে! চোখ-মুখ ভয়াবহ গম্ভীর; দাঁত দিয়ে ঠোঁটের এক কোন চেপে ভ্রু কুঁচকে টাইপিং করছে। সেভাবে থেকেই উত্তর দিল——-‘হু!’’
ইমন একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো——-‘ঠিক আছে?’
ধ্রুব মোবাইল থেকে মাথা তুলল; জবাবে ছোট শ্বাস ছেড়ে বললো———-‘ঠিক আছে? কাঁদছে! অনেক কষ্টে সামলে এসেছি।’
ইমোন হেসে ফেলল হঠাৎ! বলল ———‘ভাই তুই জেলাস হোস না। আমার না অদিতির জন্যে আসলেই দুঃখ লাগে। ও আর দুনিয়ায় ছেলে পেলো না! তোরেই ক্যান…’
ধ্রুব বাকি কথা শোনার আগেই নিজের পেছন থেকে একটা সোফার কুশন ছুড়ে ফেলল ইমনের মুখের উপর; খ্যাকিয়ে উঠল——-‘শাট অ্যাপ!’
ইমন কুশন চেপে ধরে ধরে হাসছে রাক্ষসের মতো!
কেটে যায় ঘন্ট! সৌরভ-তোফাজ্জল এখনও বদ্ধ ঘরে কি কথা বলছেন কেউ জানে না। ওদিকে ধ্রুব প্রায় অস্থির তখন! নখ খুঁটিয়ে বারবার বাইরের তাকাচ্ছে। ওর মন-মেজাজ এই মুহূর্তে চুড়ান্ত চঞ্চল!
ঠিক ওই মুহূর্তে ইফাজ পাশ দিয়ে যেতেই; ধ্রুব দ্রুত ডাকলো————‘শালবাবু? এদিকে আসো!’
ইফাজ ডাক শুনে দৌড়ানো থামালো। সতর্ক ভঙ্গিতে আশপাশটা দেখে নিল! কেউ নেই আশেপাশে; ভেবেই স্বস্থির শ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। ইফাজ ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়াতেই; ধ্রুব ওকে নিজের হাটুর উপরে বসিয়ে দিল! ইফাজের ঝাকরা চুল এলোমেলো করতে করতে বলল ——-‘তোমার বাবা কোথায়? ঘরের দরজা বন্ধ এখনো?’
ইফাজ মাথা নাড়ল——‘না তো! একটু আগেই বেড়িয়েছে। আংকেল আর আব্বু আপুর ঘরে এখন। আপুর সঙ্গে কি কথা বলছে যেন।’’
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেলো মুহূর্তেই। এরা অদিতির ঘরে করছেটা কি? অদিতিকে কিছু উল্টাপালটা জিজ্ঞেস করছে? এমনিতেই এই মেয়ে যা সেনসিটিভ! হতে পারে; কেঁদে-কেটে বেহাল অবস্থা করে ফেলেছে নিজের।
ধ্রুব নিজের বেপরোয়া চিন্তা-গুলোকে চাপা দিয়ে; অস্থির ভাবে বলল——‘তুমি গিয়ে লুকিয়ে শুনে আসতে পারবে কি কথা হচ্ছে ওখানে?’
ইফাজ সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠে বলল ——-‘না না! আমার ঠেঙ্গাবে আব্বু।’
ধ্রুব এ কথা শুনে পকেট থেকে একটা মিউজিক ট্যাপ বের করল! আসার সময় ইফাজের জন্য গিফট হিসেবে এনেছিল! ইফাজের সামনে সেটা নাড়িয়ে-নাড়িয়ে দেখিয়ে বলল ——‘তোমার জন্যে এনেছি। ১০০+ মিউজিক আছে এটাতে। লাগবে তোমার?’
ইফাজের মুখটা চকমক করে উঠলো। ও নেচে উঠে বলল ——‘দেবের গান আছে এটায়?’
‘দেব?’ —- ধ্রুব প্রথমে চিনল না; ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
পরপর বলল ———‘যার গান ইচ্ছে; ডাউনলোড করতে পারবে তুমি; মেমোরি আছে এটাতে।’
ইফাজের খুশি কে দেখে! পরপর ওর খুশি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল; মুখটা হুতোম পেঁচার ন্যায় করে বলল ——‘আমাকে যেতে হবে আপুর রুমে?’
ধ্রুব ঠোঁট উল্টে; অবুঝের ন্যায় দু-কাঁধ ঝাকাল; যার অর্থ হ্যাঁ! ইফাজ কি করবে আর! অগ্যতা ধ্রুবর কোল থেকে নেমে গেলো! তারপর এক দৌড়ে গেলো অদিতির রুমে! দশ মিনিট পরে ফিরে এলো ও! এসেই ধ্রুবর সামনে হাপাতে শুরু করেছে; পালিয়ে এসেছে বোঝাই যাচ্ছে!
ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে আছে; চুড়ান্ত আগ্রহ নিয়ে! ধ্রুবর নিজেরই বুক ধুকপুক করছে। ইফাজ শ্বাস ফেলে নিজেকে ঠান্ডা করলো। ধ্রুব পানি এগিয়ে দিল। ইফাজ সেটা নিল না; বরং চঞ্চল ভঙ্গিতে এক স্যাস বলল ———‘ওরা অপুকে জিজ্ঞেস করছে; আপু তোমাকে বিয়ে করতে রাজি কিনা। ‘
‘কি?’ ——- সুমন চেঁচিয়ে উঠল! পাশ থেকে ইমন ফল খাওয়া থামিয়ে হা করে ইফাজের দিকে তাকাল! রাজনের রীতিমত থুতনি ঝুলে গেছে!
ধ্রুব নিজেও চুড়ান্ত হতবম্ব! ও নিজের হতবাক ভাব-টুকু কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে; ঢোক গিলে শিউর হতে আবারও বলল ——‘শি…শিওর তুমি? এটাই শু..শুনেছো?’
ইফাজ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল ——‘হ্যা তো! আপুও অবাক হয়েছে!’
ধ্রুব অনুভব করছে; ওর হাত কাপছে। গলাও কাপছে; ধ্রুব কম্পিত গলায় বলল ——‘তোমার আপু কি বলেছে উত্তরে?’
ইফাজ এক শ্বাসে জবাব দিল——-‘রাজি আপু!’
‘হুহোহো!’—— পাশ থেকে বাকি তিনজন চেঁচিয়ে বলে উল্লাসে মেতে উঠলো! ইমন এসে ঝাপিয়ে পরেছে ধ্রুবর গায়ে। বাকিরাও একে একে ধ্রুবর গায়ের উপর পরে উল্লাস করছে। ধ্রুবর শরীর স্তব্ধ হয়ে গেছে রীতিমত; ও ঢোক গিলে চোখ বুজে পরপর হেলে পরলো সোফাতেই!
ওর চোখ-দুটো বুজে,শ্বাস অস্থির; অশান্ত! সোফার হাতল চেপে রাখা হাত রীতিমত কাঁপছে! ইমন ওর কেঁপে কেঁপে উঠা হাত চেপে ধরল খুশিতে! ধ্রুব চোখ খুলে টলমলে চোখে তাকালো ইমনের দিকে! ইমন খুশিতে যেন নাচছে!
ও ধ্রুবর হাত ধরে হেসে বললো——-‘শালা; ঢং করস কেন এখন! বিয়ে করছিস; ট্রিট চাই আমাদের! জনে ১০,০০০ হাজার!’
ধ্রুবর বুক এখন কাঁপছে! ও তাকিয়ে রইল শুধু! বিশ্বাস হচ্ছে না ওর! ধ্রুবর এডামস অ্যাপল বারবার উঠছে-নামছে। ওর বুকের হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক না; চুড়ান্ত বেগে ছুটছে। ধ্রুব সোফার হাতল আঙ্গুলের নখে খামচে ধরলো পরমুহূর্তে!
_________________________
সৌরভ এসে বসলেন ধ্রুবর পাশে! ধ্রুব তখন সোফায় বসে মুখে দু-হাত চেপে চুপচাপ বসে রয়েছে। চোখ-দুটো চুড়ান্ত শীতল! সৌরভ এসে সোজা ধ্রুবর সামনে দাড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন ———-‘রেডি হও; কাজী আসছে!’
ধ্রুব মাথা তুলে তাকালো! পাশ থেকে ইমন বলল ——-‘এক্ষুনি বিয়ে? ক্যামনে কি?’
সৌরভ উত্তর দিলেন——-‘তোফাজ্জল জানতে পেরেছেন শহরে অদিতির কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে। তাই ও দ্রুত অদিতির বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছে। আজ বিয়ে করে ওরা এখানেই থাকবে; আগামীকাল আমরা অদিতিকে বাড়ি নিয়ে যাব। এক সপ্তাহ পর আমাদের পক্ষ থেকে রিসেপশন করা হবে।’
ধ্রুব শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ওর মুখে একটা শব্দও কেন যেন এখন আর আসছে না। ওর হাত-পা এখনো অস্বাভাবিক কাঁপছে! নিজেকে স্থির-ই করতে পারছে না।
ইমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো———‘আংকেল; আপনি উনাকে রাজি করালেন কিভাবে? এটা তো অসম্ভব ছিল!’
সৌরভ রহস্য করে হাসলেন; ধ্রুবর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে বললেন ———‘অবশ্যই জানবে একদিন! সময় আসুক; ততদিন সবুর করো; আর বন্ধুকেও সবুর করতে বলো!’
_______________________
আধা ঘন্টার মাথাতেই সেদিন কাজী আসলো! ধ্রুবকে শেরওয়ানি গ্রামের বাজার থেকেই কিনে দেওয়া হয়েছে।অদিতির জন্যে আসার পথে তৃণা তখন কি মনে করে ধ্রুবর মায়ের বিয়ের বেনারসি শাড়িটা এনেছিলেন! হয়তবা মনে করেছিলেন; ধ্রুব যা জেদ; আর ওর বাবা সৌরভ ছেলের প্রতি যতটা অন্ধ! তাতে এই বিয়ে কেউ হওয়া থেকে আজ কেউই আটকাতে পারবে না সম্ভবত। আসার পথে এই বেনারসি আনার জন্যে; যখন ধ্রুবর থেকে ওর মায়ের আলমারির চাবি চেয়েছিলেন; ধ্রুব সরাসরি মানা করেছে। পরে অবশ্য নিজে চাবি দিয়ে আলমারি খুলে; নিজেই বেনারসি খুঁজে বের করে নিজেই ইস্ত্রি করেছে; তারপর প্যাকেট করে নিজে গাড়িতে নিয়েছে। একদিকে ভালো হয়েছে; বেনারসি আনায় কাজে লাগছে!
ধ্রুব ধবধবে সাদা রঙের; সোনালি কারুকাজ করা শেরওয়ানি গায়ে সোফায় বসে আছে! ওর মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর! চোখ-দুটো লাল; রক্তিম! ইমন সব কাজ সামলে ধ্রুবর পাশে বসল! সেই তখন থেকে ধ্রুবকে এতটা নীরব-শান্ত দেখে ও কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেল!
ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল———‘অ্যাই ধ্রুব; ঠিক আছিস তুই?’
ধ্রুব উত্তর দিল না! ইমন আবার ডাকলো——‘অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব টলমলে চোখে পাশ ফিরে ইমনের দিকে তাকাল! ইমন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। অনেকক্ষণ পর ধ্রুব এবার মুখ খুললো; কম্পিত কণ্ঠে স্রেফ বললো ——-‘ব..বিয়েটা কি সত্যিই হচ্ছে ইমন?’
ইমন ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে গেলো! ধ্রুবর দিকে চেয়ে অবিশ্বাস নিয়ে বললো—-—‘ভাই তুই ভাবির বাপের দেওয়া বিয়ের শেরওয়ানি পরে আছিস! কাজী ওই ঘরে তোর বিয়ের কাবিননামা রেডি করছে! বাস্তবে ফির ভাই!!’
ধ্রুব জবাবে কিছু বলল না! ওর চোখ অন্যরকম হয়ে গেছে আজ! চেনাই যাচ্ছে না ধ্রুবকে! ধ্রুব চুপ হয়ে গেল; আর কথাই বাড়াল না! ইমন মাথা নিচু করে দেখে— ধ্রুবর হাত কাপছে! ইমন অবাক হয়ে চেয়ে রইল ধ্রুবর মুখের দিকে! ভালোবাসা ধ্রুবকে কবে এতটা দূর্বল করে ফেলল! এই ধ্রুবর সঙ্গে ছয় মাস আগের ধ্রুবর সঙ্গে কোনো মিল নেই; বিন্দুপরিমাণ মিলও নেই! অদিতির হাতে ওই বখাটে ধ্রুব আরো চার-মাস আগেই খু-ন হয়ে গেছে!
অদিতি নিজের রুমে! কাজী অদিতির রুমে আগে নেওয়া হল!
অদিতি ধ্রুবর মায়ের লাল বেনারসি পরে বসে আছে বিছানায়! মুখে সামান্য সাজ! জুয়েলারি বলতে চিকন গলার হার; আর হাতে তৃণার পরিয়ে দেওয়া আংটি!
ঠিক এই মুহূর্তে; অদিতির কি মনে হচ্ছে সেটা স্বয়ং অদিতি নিজেও জানে না। ওর চোখ-মুখে এখনও বিস্ময়! ও বারবার হাত দিয়ে নিজের শাড়ি ছুঁয়ে দেখছে; আংটি ছুঁয়ে দেখছে। এসব…এসব সত্যিই ধ্রুবর নামে পরেছে ও? ওই বখাটে ধ্রুব ইয়ামিনের নামে? ধ্রুব; অদিতির ওই পাগলাটে প্রেমিকের নামে আজ অদিতি কবুল বলবে? এটা সত্যি বাস্তব তো? অদিতির ভীষণ মাথা ঘুরাচ্ছে এই মুহূর্তে! শরীরটা হেলে পড়তে চাইছে যেন। বহু-কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে ঘর-ভর্তি মানুষের সামনে।
ফাহিমা একটা প্লেটে খেজুর এনে রাখলেন টেবিলে! তৃণা বাথরুমে গেছে! সেই সুযোগে ফাহিমা অদিতির কাছে এগিয়ে মাথায় শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে ফিসফিস করে বললেন——-‘শহরে যে ছেলের সঙ্গে তোর সম্পর্ক ছিলো; ওই ছেলেটা কিন্তু তোর খবরও নেয়নি। এই যে তোর বিয়ে হচ্ছে; ভালবাসলে এই কথা সে কোনোভাবে না কোনোভাবেই জানতে পারতো। ওই ছেলে খবর নিল একবারও? শোন অদিতি; ধ্রুব ভালো ছেলে! ওদের পরিবার বড়! তুই সুখে থাকবি! ধ্রুবকে যদি কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করে থাকিস; আগেই বলে রাখছি এসব উল্টাপালটা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল এক্ষুনি। ছেলে ভালো; মন দিয়ে সংসার করবি! আমি যেন আমার মেয়ের নামে তার শশুরবাড়ি থেকে বদনাম না শুনতে পাই। তোর বাপ জীবিত আছে এখনও; বন্ধুর সামনে তার ইজ্জত খাইস না; দোহাই তোর!’
অদিতি শুধু শুনে গেল! ফাহিমা মেয়ের মাথায় আরো ভালো করে আঁচল তুলে দিলেন; কোমরের কাছের শাড়ি ঠিক করে দিলেন। অদিতির খুব ইচ্ছে হলো বলতে—- মা, ওই শহরের ছেলেটাই ধ্রুব মা. তোমার বলা,দেখা ভালো ছেলেটাই ধ্রুব! আমি যাকে ভালোবাসি; যাকে ভোলার জন্যে তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো! কত বোকা তোমরা মা! ধ্রুব ইয়ামিনকে তোমরা চেনোই নি! সে এসেছে মা; আমাকে বিয়ে করার জন্যই সে এসেছে। ধ্রুব আমার ব্যাপারে কোনোদিন দায়িত্বহীন ছিলোনা! তোমার অদিতি ভুল কাউকে নিজের জীবনে বাছাই করেনি; মা!
ওসব আর বলা হলো না অদিতির। ফাহিমা বেরিয়ে যেতেই; তোফাজ্জল ডাকলেন উনাকে। ফাহিমা এগিয়ে গেলেন; তোফাজ্জল বললেন ——-‘কাজী অদিতির রুমে যাবে। তুমি গিয়ে বসো ওখানে। মেয়েকে বুঝিও; অতিরিক্ত কান্নাকাটি যেন না করে। কাজী গ্রামের লোক; কি না কি ভেবে বসে থাকবে।’
ফাহিমা মাথা নাড়লেন; তারপর আবার যেভাবে এসেছিলেন; ওভাবেই ফিরে গেলেন মেয়ের ঘরে। তৃণা তখন অদিতির পাশে বসে আছেন! অদিতি মাথাটা নামিয়ে রেখেছে; তৃণা তখন অদিতির কানে ফিসফিস করে বললেন ——-‘তোমার বরের এতো বুদ্ধি! লাভ ম্যারেজ-কে কি করে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বানিয়ে দিলো! তোমরাও পারো বটে!’
বলে শব্দ করে হেসে উঠল তৃণা! ফাহিমার কানে ওদের হাসির আওয়াজ গেলো! ফাহিমা ঘরে ঢুকে মেয়ের পাশে বসলেন——‘কি নিয়ে হাসছেন ভাবি?’
তৃণা নিজেকে সামলে অদিতির দিকে চেয়ে মজা নিয়ে জবাব দিল——‘এইতো! বুঝাচ্ছি আপনার মেয়েকে. সংসার করবে যার সাথে সে কিন্তু এক পিস!’
ফাহিম সেটা শুনে গদগদ ভঙ্গিতে শুরু করলেন নিজের মেয়ের গুণগান——‘অদিতি এমনিতেও অনেক বুঝদার মেয়ে; ভাবি। রান্না পারে; ঘর গোছগাছ করে রাখে ছোটবেলা থেকেই। আপনারা একটু সাহায্য করলেই সংসার চালানোও শিখে যাবে। বুদ্ধি আছে ওর।’
তৃণা এসব কথা শুনে সঙ্গেসঙ্গে ফাহিমাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বললেন——-‘ও ঘরে অদিতি কাজ করতে যাবে না। ওর বরের সংসার করতে যাবে আপনার মেয়ে! বরকে খুশি রাখতে পারলেই; ওর কাজ শেষ!’
এটা শুনে ফাহিমা মলিন হেসে মেয়ের দিকে তাকালেন; চোখের চাহনিতেই শাসালেন —— পুরনো প্রেমিক তোর সংসারে আসলে; তোর খবর আছে।
অদিতি হতাশ শ্বাস ছাড়ল! ঠিক তখন তোফাজ্জল কাজী নিয়ে ঘরে ঢুকলেন!
কাজী অদিতির সামনে বসতেই; বুকের কাপুনি এবার যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল ওর। অদিতি আঙ্গুলের নখ দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ বুজলো। কাজী অদিতির সামনে বসে সুরা পড়ছেন। আল্লাহর কালাম অদিতির কানে যাচ্ছে! শুনেছে আল্লাহর কালাম পড়েই নাকি একজন বিয়ের মাধ্যমে অপরজনের সঙ্গে সারাজীবনের জন্য জুড়ে যায়। অদিতিও তাহলে কালাম পরেই ধীরে ধীরে জুড়ে যাচ্ছে ধ্রুবর সঙ্গে! অদিতির চোখ টলমল করে উঠল। ও ঢোক গিলে বিছানার চাদর খাঁচা ধরতেই; তৃণা ওর অস্থিরতা বুঝতে পেরে হাত চেপে ধরলেন। অদিতির হাত কাপছিলো! তৃনা অদিতির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ও শান্ত হয়ে এলো।
কাজী এবার জিজ্ঞেস করলেন——-‘দশ লক্ষ টাকা মোহরানা ধার্য করে সৌরভ ইয়ামিনের একমাত্র পুত্র ধ্রুব ইয়ামিনের সঙ্গে তোফাজ্জল হায়াতের কন্যা অদিতি হায়াতের বিবাহ ধার্য করা যাচ্ছে। কন্যা রাজি থাকলে বলুন, কবুল!’
অদিতির পুরো গা যেন কেঁপে উঠলো! অদিতি মনে হচ্ছে, ওর হৃদপিণ্ড বাইরে আসবে বুকে চিরে! এতটাই জোরে লাফাচ্ছে সেটা! মুখ থেকে শব্দই বেরোচ্ছে না আর! হাত কাঁপছে! তৃণা ওর কাঁপতে থাকা হাতটা চেপে ধরে; অদিতি চোখের জল ছেড়ে দিল। ফাহিমা বড্ড নরম গলায় বললেন——-‘ কবুল বলো, মা!’
অদিতি দুবার জোরে জোরে শ্বাস নিল; তারপর নিচু গলায় ধীরে ধীরে বলল——‘কবুল!’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ ——- কাজী সশব্দে বললেন!
সাইন করতে বলা হয়েছে অদিতিকে! অদিতি কলম হাতে বসে আছে। চোখের সামনে ভাসছে; কাবিননামায় লেখা —-‘ধ্রুব ইয়ামিন-অদিতি হায়াত’ নামটা! ঢোক গিলে তাকাল আবার অদিতি; চোখ থেকে কাবিননামার উপরেই এক ফোঁটা জল পড়লো। অদিতি ধীর হাতে নিজের নামটা সাক্ষর করে দিল বধূর জায়গায়!
তোফাজ্জল এতক্ষণে যেন স্বস্তির শ্বাস ফেললেন! কাজী চলে গেলেন ধ্রুবর কাছে। অদিতি কাজী যেতেই অদিতি ফুপিয়ে কেঁদে উঠল! ফাহিমা দুহাতে অস্থির অদিতিকে আগলে নিলেন! অদিতি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে যায় ফুপিয়ে।
এখন থেকে ওর স্বামী ধ্রুব! ধ্রুবকে নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই অদিতির! আর কেউ অদিতিকে কলঙ্কিনী বলবে না। আর কেউ অদিতি-ধ্রুবর সম্পর্কে আঙুল তুলবে না! অদিতি ধ্রুবকে নিয়ে খোলা রাস্তায় হাঁটলে কেউ বাঁকা চোখে দেখবে না। খুশিতে মরতে ইচ্ছে করছে ওর!
ধ্রুবও কবুল বলেছে! ও কবুল বলার সাথেসাথেই ইমন ঝাঁপিয়ে ধরল ধ্রুবকে! ধ্রুব নিষ্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে আছে; নিজেদের কাবিননামার দিকে! যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ধ্রুবর পাশে; অদিতির নামটুকু! কাজী সাইন করার জন্যে কাবিননামা ধ্রুবর হাতে দিলেন। ধ্রুবর হাতে কলম; ওর নামের পাশে অদিতির নামের সাক্ষর! ধ্রুব কম্পিত হাতে সেই সাক্ষর-টুকু ছুয়ে দেখে! বুকটা এত বেপরোয়া গতিতে ছুটছে কেন? ধ্রুব কলম টেনে খসখসে আওয়াজ সাক্ষর করে দিল অদিতির নামের পাশের জায়গায়।
_____________
রাতে মেহমানদের খাবারের সময়-টুকুতে অদিতির শোবার ঘরটায় বাসর সাজানো হয়েছে! অদিতিকে তখন অন্য রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে! তৃণা অদিতিকে হালকা সাজিয়ে দিলেন! চোখে কাজল; ঠোঁটে হালকা রেড লিপস্টিক; ব্যাস এটুকুই! গলায় চিকন চেইন রয়ে গেছে; বেনারসিও এখনো গায়ে!
তৃণা সাজানো শেষে অদিতির কাঁধে থুতনি রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে আয়নায় ওর দিকে তাকায়; হেসে মজা করে বলে ———-‘ধ্রুব কিন্তু সাজগোজ তেমন একটা পছন্দ করেনা। মানে ভারি মেকআপ আরকি! ওর বাবাও তেমন। কিন্তু আমি মেকআপ করি নিজের মর্জিতে; ঐক্ষেত্রে সৌরভের মত আমার বেলায় খাটেনা। তবে আশা করি তুমি আমার মতো নও! ধ্রুব যা বলে; আমার কাছে মনে হয় তুমি সেটাই মানো। রাইট?’
অদিতি লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে নিল। তৃণা হেসে সরে গেল; একটা চেয়ার টেনে বসে অদিতির দিকে চেয়ে বললো———‘আমি ওর সৎ মা হলেও ধ্রুবর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানি! সবটাই ওর বাবার জন্যে। সেই জ্ঞ্যান থেকে বলি— ধ্রুব বাসর ঘরে ঢোকার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। খবর নিয়ে এলাম আমি।’
অদিতির বুক কেপে উঠলো মুহূর্তেই। আজ ওরা একসঙ্গে; এক ঘরে; এক বেডে শোবে!
ধ্রুব এমনিতেও যা অসভ্য; আজ কিভাবে সামলাবে নিজেকে! অদিতির সেসব ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব—৩৫
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
(🛎️ফার্স্ট নাইট স্পেশাল পর্ব)
~~ ১৮+ এলার্ট~~
তৃণা সাজানো শেষে অদিতির কাঁধে থুতনি রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে আয়নায় ওর দিকে তাকায়; হেসে মজা করে বলে ———-‘ধ্রুব কিন্তু সাজগোজ তেমন একটা পছন্দ করেনা। মানে ভারি মেকআপ আরকি! ওর বাবাও তেমন। কিন্তু আমি মেকআপ করি নিজের মর্জিতে; ঐক্ষেত্রে সৌরভের মত আমার বেলায় খাটেনা। তবে আশা করি তুমি আমার মতো নও! ধ্রুব যা বলে; আমার কাছে মনে হয় তুমি সেটাই মানো। রাইট?’
অদিতি লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে নিল। তৃণা হেসে সরে গেল; একটা চেয়ার টেনে বসে অদিতির দিকে চেয়ে বললো———‘আমি ওর সৎ মা হলেও ধ্রুবর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানি! সবটাই ওর বাবার জন্যে। সেই জ্ঞ্যান থেকে বলি— ধ্রুব বাসর ঘরে ঢোকার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। খবর নিয়ে এলাম আমি।’
অদিতির বুক কেপে উঠলো মুহূর্তেই। আজ ওরা একসঙ্গে; এক ঘরে; এক বেডে শোবে! ধ্রুব এমনিতেও যা অসভ্য; আজ কিভাবে সামলাবে নিজেকে! অদিতির সেসব ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!
অদিতির সেসব ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে! ও পুনরায় আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। সারা অঙ্গে বেনারসিটা; অলংকার যেন স্পষ্ট বলে দিচ্ছে— আমি অদিতি হায়াত; দ্য ওয়াইফ অব ধ্রুব ইয়ামিন!
ধ্রুবকে মেহমানদারি করে খাওয়ানো হচ্ছে! বাড়ির নতুন জামাই এর মেহমানদারির কোনো কমতি রাখেননি তোফাজ্জল! মেয়ের বিয়েতে সবটুকু জান যেন হাজির তার!
ওদিকে খাবার টেবিলে বসে সৌরভ আর তোফাজ্জলের গল্পই যেন শেষ হচ্ছে না আজ! সৌরভ বলে যাচ্ছেন— কিছুদিন আগের কেইসের আদ্যপান্ত! কেমন করে বিরোধী দলের এক চক্রান্তে ফেসে গেছিলেন সৌরভ। তোফাজ্জল শুনে যাচ্ছেন নীরব শ্রোতার মতো করে সবটুকু কথা। সৌরভের কথার মধ্যেই বারবার; আড়চোখে তোফাজ্জল ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছেন। সৌরভ যা বলেছে এজে; তাতে তোফাজ্জল একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন পাত্রপক্ষকে কল করে মানা করে; ধ্রুবর সঙ্গে বিয়েটা দিতে। ধ্রুব ইয়ামিন; কথা-বার্তায় কেমন গম্ভীর; কাঠখাট্টা! লম্বায় উনার মেয়ের থেকে অনেক উচুই! তোফাজ্জল ভাবেন- কতটা চতুর হলে সৌরভ এমন একটা ফন্দি আঁটতে পারে! ধ্রুব যেদিন জানবে; হয়তোবা বাবার উপর খুশি না হয়ে উল্টো রাগ-ই দেখাবি। ওসব কথা থাক আজ; বিয়েটা তো হয়েছেই! বাপ-ছেলে শান্তি থাকুক এবার!
ওদিকে ওদের গল্পের কারণে ধ্রুব; ওর বন্ধুরা বড়ই বিরক্ত! কানের পোকা অবধি এরা নাড়িয়ে দিচ্ছে! ওদিকে বাসর ঘরে ঢোকার জন্য ধ্রুবর প্রাণ যায়যায় অবস্থা! এখন অবধি বউ সাজে অদিতিকে দেখা হয়নি। শক্ত করে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত নিশপিশ করছে রীতিমতো!
ধ্রুব দ্রুত খাবার খাওয়া শেষ করছে! বড় বড় লোকমা তুলছে পোলাউর! ইমন পাশেই বসা ছিলো; আড়চোখে সেটা দেখে ও কিছুটা ঝুঁকে ধ্রুবর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো—— ‘ভাই;, আস্তে! নির্লজ্জের মতো কাজ করিস না, তোর শ্বশুর বারবার তোর দিকেই কিন্তু তাকাচ্ছেন! উনার মেয়ে হয় ভাই তোর বৌ-টা!’
ধ্রুব সেটা শুনে খাওয়া থামিয়ে আঁড়চোখে তোফাজ্জলের দিকে তাকাল! তোফাজ্জল ওর দিকেই চেয়ে আছে; ধ্রুব তাকাতেই উনি চোখ সরিয়ে নিলেন! ধ্রুব এটা দেখে মুহূর্তেই অতি মাত্রায় ভদ্র হয়ে গেল, আস্তে করে ভদ্র ছেলেটির ন্যায় আস্তে করে বিরিয়ানি মাখতে লাগলো হাতে! যেন এ তল্লাটে তোফাজ্জল হায়াতের জামাতার মতো কোনো ভদ্র ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ!
অতঃপর; হাজার বছর অপেক্ষার শেষে বাসর রাতে ধ্রুব যখন নিয়ম শেষে রুমে ঢুকে, অদিতি তখন লজ্জায়-অস্বস্তিতে মূর্ছা যাবার পথে। গুটিশুটি মেরে পালং-এর উপর বসে আছে! ধ্রুব রুমে ঢুকে সিটকিনি তুলে দিতেই অদিতি আড়চোখে তাকালো! ধ্রুব সাদা রঙের শেরওয়ানি পরেছে আজ! শেরওয়ানির হাতা-টাও আজ ফোল্ড করে কনুই অব্দি তুলে রাখা। বুকের উপরের দুটো বোতাম রুমে ঢুকেই খুলে দিয়েছে ধ্রুব! ওভাবেই কি অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে! অদিতি নির্লজ্জের মতো তাকিয়েই রইল!
ধ্রুব সিটকিনি আটকে; ওভাবেই দরজায় হেলান দিয়ে কোমর বাকিয়ে দাড়িয়ে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে থাকা তার বধূ অদিতির দিকে। অদিতি ওই দৃষ্টিতে কুকড়ে গেল যেন! বহু লজ্জা-সঙ্কোচ ঠেলে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে সালাম করবে বলে!
কিন্তু ও উঠে দাঁড়াতেই, ধ্রুব এক দৌড়ে এসে আচমকা অদিতিকে জড়িয়ে ধরলো। রীতিমতো চমকে উঠল অদিতি! আচমকা টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়েও গেল! বিছানার উপর পড়তে পড়তে গিয়ে বাঁচল! ধ্রুব অদিতির ঘাড়ে ছোট্ট চুমু খেয়ে অনেকটাই শক্ত করে মেয়েটার পিঠ চেপে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। অতোটা শক্ত বাঁধনে অদিতির কষ্ট হলো; ব্যথাও হলো! তবুও ও দুহাতে আগলে নিলো নিজের অতি আকাঙ্ক্ষিত স্বামী-টিকে! দুহাতে ধ্রুবর পিঠ জড়িয়ে ধরতেই কাঁধে জলের অনুভব পেল।
ধ্রুব কাঁদছে? অদিতি জমে গেল যেন! ও অস্ফুটে বলার চেষ্টা করল——‘ধ্রু-ধ্রুব? আপনি কাঁদছে—-‘
বলে শেষ করার আগে; ধ্রুব আবারো আগের চেয়ে আরও শক্ত করে অদিতির পিঠ চেপে ধরে; মিশিয়ে নিলো নিজের বুকের ভেতর! যেন মেয়েটাকে পিষে ফেলতে চাইছে নিজের মধ্যে। অদিতি —-‘আহ!’ বলে গুঙিয়ে উঠল! ধ্রুব এখন নিজের মধ্যে নেই। বহু সাধনার পরে সে অদিতিকে পেয়েছে! নিজের বুকের মধ্যে বয়ে চলা ঝড় কিছুতেই আজ শান্ত হচ্ছে না! অদিতিকে পেয়েছে ও! এখন অদিতিকে হারিয়ে ফেলার ভয় আর তার থাকবে না; কেউ অদিতিকে ধ্রুব এর থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। ব্রেকআপের ভয় পেতে হবে না ধ্রুবর প্রতিনিয়ত! অদিতি ওর; শুধু এবং শুধুমাত্রই ধ্রুব ইয়ামিনের! এই খুশি; এই আনন্দ কাকে বোঝাবে ধ্রুব; কাকে বলবে যে- ধ্রুবর বুকের ভেতরে কি বইছে; কোন আনন্দে ছটফট করছে ওর হৃদয়!
ধ্রুব অদিতির ঘাড়ে চুমু খেয়ে বুঝিয়ে দিল ওই বেপরোয়া-ছটফটে অনুভূতি-টুকু! লজ্জায়; শিহরনে চোখ বুজে, ঘাড় সঙ্কুচিত করে ফেলল অদিতি!
ধ্রুব অনেকক্ষণ পর সরে গেল! ওর চোখ-দুটো ভয়াবহ লাল হয়ে আছে! যেন অনেক কেঁদে এসেছে। অদিতি তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর মুখপানে! ধ্রুব চোখ ডলছে অন্যদিকে চেয়ে! দেখাতে চাইছে না অদিতিকে নিজের কান্না! অদিতি শুধু চেয়েই রইল; কিছু বলার ভাষা নেই ওর!
ধ্রুব তাকালো; অদিতির সরল মুখটার দিকে চেয়ে কম্পিত গলায় স্রেফ বলল——-‘ফ্রম নাও; উই আর ম্যারেড; রাইট?’
অদিতি শুধু মাথা হেলালো; ধ্রুবর পাগলামি দেখতে লাগল নিঃশব্দে! ধ্রুব হাসার চেষ্টা করলো! ওর চোখ তখনও টলমলে!
ধ্রুবর খসখসে কপাল; ওর ঝাকরা চুল আজ হঠাৎ করেই বড্ড টানছিল অদিতিকে! অদিতির বহু কালের ইচ্ছে; ধ্রুবর কপালে চুমু খাওয়ার! যখনই ধ্রুব ওর সামনে হেলমেট খুলত; ওর ঝাকরা চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়তো কপালে! ওইসময়টাই অদিতির ইচ্ছে হতো চুমু খেতে ওই কপালে!
তারপর যখন; ধ্রুব হাসার সময় ওর সামনে কপালের একপাশ চুলকাতে থাকে; অদিতি তখনও ইচ্ছে হতো গাল চেপে ওই ছেলেটার কপালে ঠোঁট বসাক!
এতদিন অদিতি নিজেকে আটকেছে! আজও কি আটকানো লাগবে নিজেকে? লজ্জায় কি এজীবনে ধ্রুবকে বলা হবে; ——‘ ধ্রুব;আমাকে কি আপনার কপালে একটা চুমু খেতে দিবেন? শুধু একটা চুমু?’
মিসেস ধ্রুব ইয়ামিনের সে কথা মুখ ফুটে বলাও লাগল না! হয়তো মিস্টার ধ্রুব ইয়ামিন সেটা বুঝলেন! ধ্রুব অদিতির দিকে ঝুঁকে এসে; নিজের কপাল এগিয়ে দিলো! স্বাভাবিক গলায় বলল——‘ ওয়ানা কিস মি? অ্যা ফরহেড কিস?’
অদিতি তাকিয়েই রইল, ঢোক গিলে! লজ্জায় এগুচ্ছে না! মাথাটা নামিয়ে নিল ও! ধ্রুব তাড়া দেখিয়ে আবার বলল—— ‘বি ফাস্ট! কিসিং হারাম নয় আমাদের জন্যে! সো কিস মি মিসেস ধ্রুব!’
অদিতি তাকালো মাথা তুলে! ধ্রুব চোখ বুজে; নিচু হয়ে মুখ বাড়িয়ে রেখেছে ওর দিকে! অদিতির লজ্জায় হাসি আসছে! তবুও নিজের লজ্জা-গুলোকে একপেশে করে; মুখ বাড়িয়ে আলতো করে চুমু খেলো ধ্রুবর কপালে!
ধ্রুব আবেশে চোখ বুজে ফেলল! ওর এত শান্তি লাগছে কেন! অদিতির নিজে থেকে করা এটাই প্রথম চুমু! তাই বোধহয় ওতটুকুতে ধ্রুব ইয়ামিনের পোষালো না!
ধ্রুব হাত বাড়িয়ে অদিতির কোমর চেপে ওকে নিজের দিকে আরো টেনে আনল! শ্বাস আটকে এলো এতেই ওর বধূর! ধ্রুব সেসব তোয়াক্কা করল না; বরং চোখ বুজে কণ্ঠে প্রবল ঘোর নিয়ে বলল——‘ফিল আসেনি! প্লিজ; মোর ডিপলি!’
অদিতির কোমরে দুহাত রাখা ধ্রুবর; ওর দিকে নিচু হয়ে বাড়িয়ে রাখা ধ্রুবর মুখ! অদিতির এবার কি হলো? নিজেই নিজের লজ্জা-গুলোকে গলা টি-পে মে-রে; দু’হাতে ধ্রুবর রূক্ষ-খোচা খসখসে গাল চেপে ধরলো! তারপর মুখ বাড়িয়ে ঠোঁট রীতিমত দাবিয়ে দিল ধ্রুবর কপালে!
ধ্রুব বড় করে এক শ্বাস টেনে নিয়ে চোখ বুজে নিল! বাহিরে ঝড়ো বাতাস জানাল ডিঙিয়ে ঘরের ভেতরটাই বইছে! বৈরী এই আবহাওয়া অদিতি হঠাৎ ধ্রুবকে এত কাছে পেয়ে; নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো!
কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে দুহাতে ধ্রুবর মুখ শক্ত করে চেপে ধরে; ধ্রুবর সঙ্গে মিশে গেল! ধ্রুব তাকিয়ে রইলো অদিতির দিকে! অদিতি আজ ওই তাকানোতে লজ্জা পেল না; বরং মুখ এগিয়ে পাগলের মতো চুমু খেলো ওর পুরো মুখ জুড়ে! নাকে, দু’গালে, কানের লতিতে, তারপর ঠোঁটের কিনারায় এসে থেমে; দু’হাতে ধ্রুবর গাল চেপে ধরে রাখা অবস্থায় ডুকরে কেঁদে ফেলল অদিতি!
ধ্রুব এতক্ষণ চোখ-দুটো বুজে অদিতির নিজে থেকে করা চুমু-গুলো উপভোগ করছিল! এমন সময়ে অদিতির কান্নার শব্দে ও ভড়কে গেল! অদিতি ধ্রুবর কপালে কপাল ঠেকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে! ধ্রুব দু’হাতে ওকে বুকের ভেতর আগলে নিলো——‘হুশ! ডোন্ট ক্রাই! ধ্রুব ইজ ইয়োর্স; টোটালি; কমপ্লিটলি!অ্যাই অদিতি; চোখ খুলো! দেখো, আমরা বাসর ঘরে! বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো?’
অদিতি তবুও কেঁদেই যাচ্ছে! ধ্রুব ওকে দু’হাতে পাজকোলে তুলে নিল!কোলে তোলার সময় ধ্রুবর হঠাৎ মনে পরলো; ভার্সিটির একটা দিনের কথা! তখন ধ্রুব নিজেকে আটকে রেখেছিল অদিতির প্রতি ফল করা থেকে! তারপর ঘটে একটা কাণ্ড! অসুস্থ অদিতি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরে ভার্সিটিতে! কি দিন ছিলো সেসব!
অদিতির যখন ধ্রুবর শেরওয়ানি মুষ্টিতে পেঁচিয়ে ধরলো ধ্যান ফিরলো ধ্রুবর! ধ্রুব অদিতিকে বুকে আগলে বিছানায় শুইয়ে দিল! অদিতি তখনো ওর গলা ছাড়েনি! ধ্রুব ওর অর্ধেক শরীর ছেড়ে দিল অদিতির গাঁয়ের উপর! তারপর মেয়েটার চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বললো———‘হুশ অদিতি! থামো প্লিজ! বাইরে আওয়াজ যাবে! কাঁদছ কেন? আমি তোমার সামনেই; লুক! ই্যয়ু আর ম্যাই ওয়াইফ; ম্যাই বিলাভড ওয়াইফ! নিজেকে দেখো; বিয়ের সাজে তুমি! এন্ড লুক এট মি; আমি শেরওয়ানি পরে আছি! ই্যয়ুর ফেভরেট কালার; হোয়াইট!’
ধ্রুব অনেকক্ষণ বোঝাল! তারপর অদিতির কান্না থামলো অবশেষে; সেই অনেকক্ষণ পর!
ধ্রুব ওর কান্নার শব্দ থামতে দেখে, আলগোছে ওর ভেজা চোখের উপর চুমু খেয়ে বলল—— ‘ফিলিং বেটার?’
অদিতি ভেজা চোখে মাথা নাড়ল! ধ্রুব মেয়েটার টলমলে চোখ; রক্তিম নাক; ভেজা গাল দেখতে দেখতেই হঠাৎ থামলো! অদিতি তখনো ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরেছে! ধ্রুব এবার আধার রাতের ন্যায় ফিসফিসিয়ে বলল——‘ক্যান অ্যাই হ্যাভ ইউ?’
অদিতি তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে! ধ্রুবর দুই চোখ অদিতির চোখে; তারপর নাকে; তারপর ঠোঁটে এসে থামলো! সর্বনাশ ঠিক তখনই ঘটল! ধ্রুবর এখন নিজেকে বড্ড তৃষ্ণার্থ মনে হচ্ছে! ওর চোখ তখনো অদিতির ঠোঁটের দিকে তাক করা; ফিসফিসিয়ে আবার বললো —— ‘ক্যান অ্যাই কিস ইউ? নাও?’
অদিতি ঢোক গিলে; জোরে নিঃশ্বাস টানল! ধ্রুব ঘোরের মধ্যে চলে গেছে! ও ধীরে ধীরে; সময় নিয়ে অদিতির ঠোঁটের দিকে এগোচ্ছে! ঠোঁট ঠোঁটে মিলবে, তখন অদিতি ধীর গলায় ডাকলো———‘ধ্রুব?’
ধ্রুব ঘোরে তখনো; ঠোঁটের দিকে এগুতে এগুতে জবাব এলো তার——‘উম?’
অদিতি ফাঁকা ঢোক গিলে বলল——— ‘এ…এখন না এসব!’
ধ্রুব শুনছে না যেন! ওর নেশা লেগে গেছে! ঘোরে মাথাটা আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই! দুজনের হৃদস্পন্দন এতই দ্রুত আর সশব্দে ছুটছে যে; একজন আরেকজনের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে!
তারপর ঠোঁটে ঠোঁট যখন প্রায় ছুঁইছুঁই, তখন অদিতি ধ্রুবর ঠোঁট ডান হাত চেপে ধরল! বাধা পেয়ে চোখ খুলে তাকাল ধ্রুব ওর চোখের দিকে! অদিতি কম্পিত গলায়, নিচু স্বরে ফিসফিসাল———‘এ—এ ঘরে না! এসব; ম-মানে আপনি যা চাইছেন স-সেসব আপনার বাড়িতে, আপনার র-রুমে! সবকিছু আমাদের ম-মতো করে আ-আয়োজন করে!’
ধ্রুবর ঠোঁট অদিতির হাত চেপে ধরা; এমন অবস্থাতে ধ্রুব তাকিয়ে রইল অদিতির দিকে। অদিতির ভয়ার্ত; ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে; ধ্রুব আলতো করে ডান হাতের তালুতে চুমু খেতেই অদিতির ওর ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে দিল! ধ্রুব সামান্য হেসে; দুষ্টু ইঙ্গিত করে বললো-———‘ওয়ানা ট্রাই ইট ইন অ্যা পারফেক্ট প্লেস?’
অদিতি লজ্জায় পেল, তবুও মাথাটা নিচু করে বলল——‘হুঁ!’
ধ্রুব অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে সামান্য হেসে তারপর আবারও ফিরে তাকাল অদিতির দিকে! নেশালো চোখ-দুটো; ওর পেটানো দেহের নিচে পরে থাকা অদিতির ঠোঁটের দিকে রেখে, ওর সফ্ট ঠোঁটের কোণ-টুকু ছুয়ে দিতে দিতে চূড়ান্ত ফিসফিস করে বললো——— ‘অ্যাটলিস্ট ওয়ান লিপকিস? প্লিজ?’
অদিতি কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল! ধ্রুব যা বোঝার বুঝে গেল! ও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদিতির উপর থেকে সরে যেতে নিলে হুট করে অদিতি ধ্রুবর শেরওয়ানির কলার চেপে ধরে আটকে দিল। ধ্রুব বাধা পেয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাল! অদিতির চোখ-দুটো নামানো; সেভাবেই দু’আঙুলের মুষ্টিতে খামচে ধরে আছে ধ্রুবর শেরওয়ানি। ধ্রুব মাথা ঘুরিয়ে অদিতির শেরওয়ানি চেপে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আবার অদিতির দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল!
অদিতি চুপ করে আছে; ওর নিঃশ্বাস এলোমেলো! ধ্রুব অদিতির উপর আবার শুয়ে ভ্রু উঁচালো——— ‘আমি সবসময় সাইলেন্স টক বুঝি না অদিতি। ক্যান ই্যয়ু এক্সপ্লেইন…’
বলে শেরওয়ানি থেকে অদিতির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের হাতে চেপে ধরে বলল——— ‘ক্যান ই্যয়ু এক্সপ্লেইন; এটার মানে এক্সাক্টলি কি?”
অদিতি ঢোক গিলে, মাথাটা সেভাবেই নামিয়ে অন্যপাশে সরিয়ে ফেলল! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে; অস্থির শ্বাস ফেলছে! মুখ ফুটে বলতেও পারছে না কিছু! ধ্রুব ধৈর্য্য দেখালো; আবার জিজ্ঞেস করলো——— ‘সরে যাব? না কিস করব? কোনটা?’
অদিতি অন্যপাশে চেয়ে ছিলো! ধ্রুব ওর থুতনি চেপে ওর মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে; আবার ভ্রু উঁচালো! অদিতি ওই প্রশ্নের উত্তরে অস্ফুট স্বরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল———‘ক…ক…কি…’
বলার সাথে সাথে ধ্রুবর খসখসে পুরুষালি ঠোঁট চেপে ধরল অদিতির নরম মেয়েলি ঠোঁট! অদিতি চমকে উঠে বড় বড় চোখ করে তাকাল! ধ্রুব চোখ-দুটো বুজে দুহাতে অদিতির গাল চেপে ধরে রেখেছে তখন!
অনুভূতির আচরের জ-খম যখন একের পর এক নিজের ওষ্ঠপুটে পাচ্ছিল; আবেশে অদিতির চোখ-দুটো ধীরে ধীরে বুজে এলো! খামচে ধরল ধ্রুবর বুকের কাছের শেরওয়ানি, মুষ্টিতে পুড়ে মুচড়ে ধরলো সেই অংশ!
মাথায় আপাতত দুজনের কিছুই নেই! ধ্রুবর অস্থির স্পর্শ, গালে স্পর্শ করা ওর গরম হাত! সবটাই অদিতির পুরো সত্তা ভয়ঙ্কর ভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্রুবর এক হাত গাল থেকে নেমে অদিতির কোমর ছুলো; নিঃশ্বাস আটকে এলো যেন অদিতির! ধ্রুব চুমু খাওয়া অবস্থাতে; কোমর থেকে এক হাতেই শাড়ির কোমরের সেফটিপিন খুলে ফেলে দিল বিছানার ওপাশে! কোমরের শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হলো প্রথমবারের মতো অদিতির গাঁয়ের নিষিদ্ধ কোনো অংশ! ধ্রুব সেই নিষিদ্ধ অংশে হাত ছুয়ে দিচ্ছে বেলাজে; অবলীলায়!
অদিতি হাপিয়ে উঠছে! প্রথম চুমু! জীবনের প্রথম চুমু ব্যাপারটা অদিতি নিজের প্রেমিকের সাথেই আস্বাদন করল! ধ্রুব নিজের তৃপ্তি-টুকু মিটিয়ে আস্তে করে সরে গেল! অদিতির চোখ-দুটো তখনো বন্ধ রাখা! হাঁপাচ্ছে ও!ঠোঁটে জখ-ম; রক্তিম! ধ্রুবর ঠোঁটে-চোখে তখনো প্রবল নেশা! ও সেভাবেই অদিতির বন্ধ দু চোখের পাতার দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল——— ‘মাই ফার্স্ট কিস উইদ ইউ! আই হ্যাভ গিভেন মাই বেস্ট! ইজ ইট গুড; মিসেস ধ্রুব!’
অদিতি লজ্জায় চোখ খুলে; মুখ ঘুরিয়ে ফেলল! অন্যদিকে চেয়ে আছে, শ্বাস-প্রশ্বাস অস্থির; চূড়ান্ত অশান্ত! ধ্রুব অদিতির থুতনি চেপে আবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো! মেয়েটা চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকুও করতে পারছে না সামান্য চুমুর পর।
ধ্রুব অদিতির চুল গুছিয়ে দিল; তারপর ঠোঁটের কোনটুকু ছুঁয়ে দিতে দিতে বললো——— ‘আমার উত্তরটা?’
অদিতি বড় শ্বাস ফেলল; মাথা নাড়াল আস্তে করে! ধ্রুবর এতটুকুতে পোষাল না; বলল——— ‘ইউজ ই্যয়ুর ওয়ার্ডস!’
অদিতি অনেকক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিল———‘হা-হারিয়ে গে-গেছিলাম মনে হ-হচ্ছিল!’
ধ্রুব নিশব্দে হেসে ফেলল! অদিতি ওই হাসির শব্দে যেন আরও লজ্জায় পড়ে গেল! মুখ ঘুরিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে চোখ খিঁচে ফেলল!
ধ্রুব হেসে বালিশে মাথা রাখল! বালিশে মাথা রেখে তারপর অদিতিকে সেভাবেই দেখতে লাগল! অদিতি আর একবারের জন্যও এদিকে তাকাচ্ছে না।
ধ্রুব এবার আর মেয়েটাকে আর লজ্জা দিল না। আলতো করে দুটো হাত বাড়িয়ে বলল——— ‘বুকে আসো?’
অদিতি এলো না, লজ্জায়! ধ্রুব এই নাজুক মেয়েকে নিয়ে করবেটা কী? সামান্য ছোঁয়াতেই এত অস্থির, এত লজ্জা! ধ্রুব এবার অধৈর্য্য হয়ে নিজেই হাত টেনে অদিতিকে বুকের ভেতর নিয়ে নিলো।
অদিতি ধ্রুবর বুকে মাথা রাখল! ধ্রুব ওর এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল——— ‘মেবি আমাদের চেঞ্জ করা উচিত! আমি শার্ট-প্যান্ট তো আনিনি!’
অদিতি এবার উঠে বসল; পাক্কা গিন্নির ন্যায় দায়িত্ব নিয়ে বলল———‘আব্বা এনে রেখেছেন! আমার রুমেই রাখা। বের করে দেই?’
ধ্রুব ভ্রু বাঁকাল; এতক্ষণে এই মেয়ের কথা ফুটেছে! ধ্রুবও আর লজ্জা দিল না। নিজেও উঠে বসে বলল——— ‘ইয়াহ প্লিজ! চুলকাচ্ছে এই ড্রেসে!’
অদিতি নিজের শাড়ি সামলে নেমে দাঁড়াল বিছানা থেকে। খুঁজে ধ্রুবর জন্যে শার্ট-জিন্স বের করে দিল; সদ্য কিনে আনা তোয়ালেও দিল! ধ্রুব সেসব হাতে নিয়ে বললো——— ‘তুমি শাওয়ার নেবে?’
অদিতি উত্তর দিল——— ‘হুঁ! আপনি করে আসুন আগে!’
ধ্রুবর ইচ্ছে হলো বলতে— ‘একসঙ্গে শাওয়ার নিলে কি প্রবলেম?’
কিন্তু বলা হলো না আর। সবে বিয়ে হয়েছে। যে মেয়ে ওকে কাল অব্দি হাত ধরা ছাড়া আর কিছু করতে দেয়নি, সেই অদিতির ওর সঙ্গে এসব ব্যাপারে সহজ হতে সময় লাগবে! কিন্তু ধ্রুব ও ছেড়ে দিবে না! সময় যা দেওয়ার দিবে; তবে যেদিন সময় ফুরাবে সেদিন ধ্রুব নিজের সমস্ত বেখেয়ালি ভাবনা-গুলো তুলে ধরবে অদিতির কাছে!বউ ওর; হক তো আছে ধ্রুবর!
ধ্রুব চুপচাপ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। অদিতি ততক্ষণে যা মেকআপ ছিল মুছে ফেলেছে, চুলের কিছু ক্লিপ ছিলো; খুলে চুল খোঁপা করেছে। ধ্রুব ততক্ষণে বেরিয়েছে! অদিতি রুমে, তাই ওয়াশরুম থেকে শার্ট-প্যান্ট পরেই বেরিয়েছে।
ধ্রুব বেরিয়ে আসতেই, অদিতি নিজের তোয়ালে নিয়ে ঢুকলো! ধ্রুব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাল!
আয়নায় নিজেই নিজেকে দেখে আজ যেন চিনতে পারছে না ধ্রুব! ধ্রুবকে দেখতে আজ হঠাৎই যেন অন্যরকম লাগছে।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আয়নায় তাকাল; পরপর নিজেকে ভালো করে দেখতে দেখতে বিড়বিড় করলো——-‘ইয়াহ! দ্য ধ্রুব ইয়ামিন; ফ্রম নাও অ্যা ম্যারিড গায়!’
বলে নিজেই হাসলো ধ্রুব! তারপর পেছন ঘুরে নিজেদের নিউলি ওয়েডেড বাসর সাজানো বেডের দিকে তাকাল! গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা, ফুল দিয়ে সাজানো পুরো বেড! ধ্রুবর পুরুষালি বুকটা আবার ধ্বক করে উঠল! বেডের পাশে তখন ওর ফোনের মেসেজ টোন বাজছে! ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে ফোন তুলল। স্ক্রিন অন করতেই; ইমনের অনেকগুলো মেসেজ! লাস্ট তিনটা মেসেজ পরল ধ্রুব ———
‘মাম্মা, বাসর নাইট কেমন যায়?’
পরে আরো একটা মেসেজ——
‘ভাই, প্রথম রাতে বেড়াল মা-রতে হয় জানি। বাট অদিতির বেলায় এই কাজ ভুলেও করিস না। এই মেয়ে অক্কা যাবে ফর শিওর!’
পরে আরও একটা মেসেজ———
‘Tor pocket check korish! Kichu ekta diyechi ami! Maybe kaaje lagbe tor!’
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেল! কি দিয়েছে এই ছাগলটা? ও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে শেরওয়ানির পকেট দেখল! যা দেখল, পরমুহূর্তে চূড়ান্ত বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল ওর!মুখ থেকে ইমনের জন্যে দুটো গা-লিও বের হয়ে গেল আপনা-আপনি!
ঠিক তখনই অদিতির বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই ধ্রুব ব্যস্ত হাতে দ্রুত সেটা আবার পকেটেই রেখে দিল। ধ্রুব ইয়ামিন এই প্রথম ভয় পেল সম্ভবত! ধ্রুব শেরওয়ানি আবার জায়গায় রেখে দিল!
ধ্রুবকে শেরওয়ানি নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে; অদিতি নিজের ভেজা চুল গামছায় ঝাড়তে ঝাড়তে বলল——-‘ওটা রেখে দিন! ও বাড়ি গিয়ে আমি ধুয়ে দেব!’
ধ্রুব হাসার চেষ্টা করল! অদিতি চুল ঝাড়ছে! পরনে একটা সুতির শাড়ি! যার ব্লাউজের পেছনের দিকটা অনেকটাই ভেজা! আজও কোমরের কাছের শাড়িতে সেফটিপিন আটকে; কোমর ঢেকে দেওয়া! আশ্চর্য হয় ধ্রুব! এখন ধ্রুব ওর হাজবেন্ড! এখন এত ঢেকে চলার কি আছে? চুমুর সময়টায়; একটু আগে এই সেফটিপিন খুলে ফেলে দিল ধ্রুব; এই ইশারা-টুকুও কি বুঝেনা এই মেয়ে?
ধ্রুব ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে! আলতো করে অদিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রাখল। অদিতি চমকে উঠে সামনে ঝুঁকে গেল! ধ্রুব ওর ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে দুহাতে অদিতির কোমরের দুপাশ থেকে ধীর ভঙ্গিতে সেফটিপিন খুলে দিল! উন্মুক্ত হলো আবার অদিতির গায়ের নিষিদ্ধ অংশ! ধ্রুব টেবিলের উপর সেফটিপিন রেখে; দুহাতে ওই উন্মুক্ত অংশ-টুকু চেপে ধরে; গম্ভীর গলায় বলল——-‘বয়ফ্রেন্ড ছিলাম যখন, তখন এসব হয়তোবা টলারেবল ছিল! বাট নট নাও!’
অদিতি লজ্জা পেল ভীষণ! ও অস্ফুট স্বরে বলার চেষ্টা করল—‘অ-অভ্যাস!’
‘পাল্টাতে হবে!’—— ধ্রুবর সহজ উত্তর!
অদিতির চুল ছড়িয়ে আছে পুরো ঘাড় জুড়ে! ধ্রুব আলতো হাতে অদিতির সবগুলো চুল ঘাড় ছুয়ে-ছুয়ে সেখান থেকে সরিয়ে কাঁধে এনে ফেলল। অদিতি জমে গেল; শিরশিরে অনুভূতি মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল যেন। দুহাতে শাড়ির খাঁজ চেপে ধীরে স্থির হয়ে গেল প্রায়!
ধ্রুব আয়নায় তাকাল নিজেদের দিকে। তারপর বলল——‘শুনেছি ফার্স্ট নাইটে হাজবেন্ডদের গিফট দিতে হয়! আমি তো মোহরানা দিয়েছি আঙ্কেলের কাছে। তারপরও ইমন বললো, স্পেশাল কিছু দেওয়া জরুরি! কি চাই তোমার?’
অদিতি আয়নায় নিজেদের দিকে তাকাল! ধ্রুব প্রশ্নবোধক চোখে অদিতির দিকে আয়নায় তাকিয়ে আছে। অদিতি ধ্রুবর ওই সরু, নেশালো চোখ-দুটোর দিকে চেয়ে টলমলে চোখে কাঁপা গলায় স্রেফ বলল—‘একটা ধ্রুব ইয়ামিন! ব্যাস, এইটুকুই চাই একজীবনে!’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব —৩৬
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
(বিয়ে স্পেশাল -৪)
বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটি ধ্রুব-অদিতির বড্ড দীর্ঘ কাটল! শ্বশুরবাড়িতে থাকায় বেচারা ধ্রুবর কপালে সেদিন আর বাসর জুটেনি।! তার ওপর সকাল সকাল ইফাজ দরজায় ধাক্কাচ্ছে! ধ্রুব-অদিতি ঘুমিয়েছে ফজরের প্রায় অনেক পরে।
বরাবরই সকালের ঘুমটা অদিতির আগে ভাঙে। শরীর স্ট্রেচ করে ঘুমঘুম চোখে সবার আগে নিজের দিকে একবার তাকাল! পরনের সুতির শাড়ির আঁচল গায়ে নেই; ওটা শরীর থেকে সরে গিয়ে আরামে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। শরীর অজস্র ক্লান্ত, মাথাটা ভারী লাগছে; শরীরের এই ক্লান্তি-টুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে— সারারাত ওদের এক-ফোঁটাও ঘুম হয়নি।
ধ্রুব ঘুম থেজে উঠার আগেই; সতর্কভঙ্গিতে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে দ্রুত উঠে বসে গেল। হামি তুলে পাশে তাকাতেই দেখে, ধ্রুব ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে উদোম গায়ে বালিশে পুরো মুখ-নাক গুঁজে ঘুমাচ্ছে। পিঠের খাঁজে শ্বাস নেওয়ার প্রতিটি ওঠানামা স্পষ্ট!
অদিতি ধ্রুবর ওমন উদোম গা এই প্রথম দেখলো। ধ্রুব কখন শার্ট খুললো? ওর দৃষ্টি প্রায় আটকে গেল ধ্রুবর পেটানো পিঠের দিকে। বিয়ের আগে, বয়ফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও ধ্রুব কখনোই ওর সামনে নির্লজ্জতার পরিচয় দেয়নি। সবসময় একটা সীমারেখা রেখেছে। আর আজ? বিয়ে হতে না হতেই শার্ট খুলে আরামে ঘুমানো হচ্ছে?
হরমোনের ওমন জ্বালাতনে; দেখা গেল অদিতি ওভাবেই তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর অর্ধ-নগ্ন দেহের দিকে। ধ্রুবর ব্রড শোল্ডার, ডিপ ওয়েস্ট শেপ, অ্যাবস-এর খাঁজ, পুরোটাই ভীষন ম্যানলি। ঢোক গিলে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, অদিতি তাকিয়ে রইল। মাথার ভেতর কেমন একটা আনচান অনুভূতি খেলে গেল হঠাৎ!
ওপাশ থেকে আবার ধাক্কা এলো দরজায়——‘এই আপু, উঠো! দুলাভাইর বাবা শহরে যাবে এখন। তোমাদের রেডি হতে বলল।’
অদিতির ধ্যান ভাঙে; বেহায়া হরমোন-গুলো পালিয়ে যায়। ও ধড়মড় করে উঠে দরজার দিকে তাকাল। হ্যাঁ খোদা, সে এতক্ষণ কি দেখছিল! নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় দিয়ে নিজেকে ফিসফিস করে শাসিয়ে বললো—-‘নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার! চোখ কই, কই যায় তোর?’
লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেলল ও। তারপর আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে ধ্রুবকে ডাকতে যাবে বলে ওর দিকে তাকাল। ধ্রুব এখনও সেভাবেই দুহাতে মাথার বালিশ চেপে ধরে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছে। ইফাজের ডাক ওর কানে পোছাচ্ছে না এখনো। অদিতি আস্তে করে ডাকল—‘ধ্রুব! অ্যাই ধ্রুব।’
ধ্রুব বালিশে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় ঘুমঘুম কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল——‘উ-মমম…’
গলার স্বরটা শোনামাত্রই অদিতির গায়ের লোম অব্দি যেন দাঁড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুক-ধুকপুক শুরু হলো! ধ্রুব ঘুমন্ত অবস্থায় কি সবসমময়ই এতটা হাস্কি আর লো টোনে কথা বলে? বিয়ে না হলে ধ্রুবর এই আকর্ষণীয় দিকটা কি মিস করে যেত না অদিতি?
অদিতি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, নিজের বুকে হাত রেখে ধীর নিঃশ্বাস নিল। অদিতি; মিসেস ধ্রুব! এখন তোমার আপনার স্বামীকে ডেকে তোলার সময়। তার প্রেমে পড়ার সময় এখন অবশ্যই নয়। প্রেমে পড়ার সময় যখন আসে; তখন তো ভয়ে-লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকিস- তাহলে এখন এত প্রেম উদয় কোত্থেকে হচ্ছে? ফাজিল মেয়ে; আব মিসটেক; ফাজিল ওয়াইফ হবে ওটা।
নিজে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে ; অদিতি আবার ডাকল——-‘ধ্রুব, উঠুন! আমাদের রেডি হতে হবে!’
ধ্রুব কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল! অদিতি হতাশ হয়ে মুখ বাঁকাল! যে ছেলে সকাল বারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না, তার জন্যে ফজরের পর ঘুমিয়ে সকাল সাতটায় ওঠা প্রায় অসম্ভব! কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব অদিতিকে করতে হবে।
অদিতি একটু দ্বিধায় পড়ল, কীভাবে ডাকবে? হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর পিঠ ছুঁয়ে ডাকতে যাবে— মাঝপথে থেমে গেল! লজ্জায় ওর হাতটা কাঁপছে। কীভাবে ছোঁবে ধ্রুবকে? উদোম গায়ে…অদিতি চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শক্ত করল। স্বামীই তো! আর সে তো শুধু ঘুম থেকে তোলার জন্যে ডাকবে।
শ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল। আলতো করে ধ্রুবর পিঠ ঠেলল——‘ধ্রুব, প্লিজ উঠুন! ওরা ডাকছে আমাদের। অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব এত ডাকাডাকিতে চোখ খুলল। বালিশে মুখ গুঁজে সেভাবেই মাথা ঘুরিয়ে এপাশে তাকাল অদিতির দিকে! অদিতির নিঃশ্বাস আটকে গেল!
ধ্রুবর চোখদুটো ভারী, ঘুম জড়ানো। নাক অব্দি ঢেকে আছে বালিশে; শুধু ওই চোখ-দুটো দেখা যাচ্ছে। রুক্ষ কপাল, সূক্ষ্ম আইব্রো, আর ওই চোখ! অদিতি এক পলক তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগল যেন!
ধ্রুব সেভাবেই মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় হামি তুলে; অস্ফুট স্বরে বলল—‘ডাকতেছো কেন? ঘু-ঘুম কমপ্লিট হয়নি আমার।’
অদিতি ভ্রু বাঁকাল, জবাব দিল——‘কেন ঘুমাননি? বলিনি আমি, ঘুমিয়ে যাই চলুন? আপনিই তো পাগলামি করলেন।’
ধ্রুব এবার ভ্রু উঁচালো! চোখের ভেতর একরকম দুষ্টুমি খেলে গেল! মুহূর্তের মধ্যেই অদিতির হাতটা টেনে নিয়ে ওকে নিজের পাশে শুইয়ে ফেলল!
“আঁ।’——- আচমকা আক্রমণে চেঁচিয়ে উঠল অদিতি।
ধ্রুব শক্ত করে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল——‘চুপ! নিজেও ঘুমাও এখন।’
অদিতি তৎক্ষণাৎ ছটফট করে উঠতে গেল——‘না না, এখন ঘুমানো যাবে না! আমাদের রেডি হওয়া লাগবে! ডাকবে আমাদের! ধ্রুব,আমি কিন্তু বকা খাব আব্বার।’
ধ্রুব ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজেই অস্ফুটে বলল——‘বকবে না। তুমি এখন ম্যারিড, আংকেল বুঝেন এসব।’
অদিতির চোখ বড় হয়ে গেল! এটা আবার কী ধরনের উত্তর! ধ্রুব আসলেই ঘুমিয়ে আছে, নাকি জেগে থেকে ওকে নিয়ে মজা নিচ্ছে?
ধ্রুব হালকা হেসে ঘাড়ে নাক ঘষতেই, অদিতি শিউরে উঠে——-‘আহ! প্লিজ! ধ্রুব।’
ধ্রুব এবারও ছাড়ল না! বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল——‘প্লিজ; আর জাস্ট পাঁচ মিনিট।’
‘না।’——— অদিতি এবার আর কিছু না শুনে ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল! তারপর বিছানা থেকে একদম ঠেলে নামিয়ে দিল ওকে!
ধ্রুব অবাক হয়ে বললো——‘হেই; আমাকে শক্তি দেখাচ্ছো তুমি? আমি চেপে ধরবো নাকি?’
অদিতি ধ্রুবর টিশার্ট-জিন্স বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো———‘প্লিজ!’
অদিতির গলায় অনুরোধ; চোখে কাতরতা ইচ্ছে করেই দেখানো হলো ধ্রুবকে। ধ্রুব ভ্রু কুচকে চেয়ে; পরপর হতাশ ভঙ্গিতে চোখ উল্টে তাকাল; ———-‘ম্যানুপুলেশন; ড্যাম! যাচ্ছি!’
অদিতি হাসল; তারপর ধ্রুবকে হাত ধরে টেনে ওয়াশরুমের দিকে ঠেলতে লাগল——‘আর কথা না, ফ্রেশ হয়ে আসুন! আমি ওয়েট করব!’
_________________
খাবার টেবিলে সবাই নবদম্পত্তির জন্যে অপেক্ষা করছে। সৌরভ তোফাজ্জলের পাশে বসে আছেন। ধ্রুবর বন্ধুরা চেয়ারে বসে খাচ্ছে; আর ঢুলছে ঘুমে। অদিতি মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে চুপচাপ ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ধ্রুব ওর যাওয়ার দিকটায় এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আবার সবার দিকে তাকাল।
রাজন ধ্রুবকে দেখেই; দুষ্টু ইঙ্গিতে হেসে ডাকল—‘ ধ্রুব ভাই যে; আসেন আসেন।’
ধ্রুব ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাল; নিশ্চয়ই সবগুলো মিলে এখন দুনিয়ার অসভ্যতা শুরু করে দিবে। ও ছোট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে জিন্সের পকেটে হাত গুঁজে ধীরে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলো।
চেয়ারে বসতেই; সৌরভ বললেন—-‘আমাদের খেয়ে বেরুতে হবে, ধ্রুব। ঢাকায় জরুরি মিটিং আছে।’
ধ্রুব মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত দিল; সে শুনেছে!
ইমন ওদের আড়াল করে মুখটা একটু এগিয়ে এনে ধ্রুবর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল——-‘ফার্স্ট নাইট কেমন কাটল, মামা? দেখি তো, তোর গলা দেখি! লাভ বাইট পাইছিস?’
বলেই অসভ্য হেসে ধ্রুবর টি-শার্টের কলার ধরতে যাবে, ধ্রুব মুহূর্তের মধ্যে ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুচড়ে ফেলল! ওমন হাতের ব্যাথাতেও, ইমন খিলখিল করে হাসছে! ধ্রুব ওর হাত আরো শক্ত করে মুঠোতে পুড়ে চেপে ধরে, কঠিন স্বরে বললো——-‘ঢাকা গিয়ে তোকে যদি আমি কুত্তার মতো দৌড় না খাওয়াই, তাহলে আমার নামও ধ্রুব না। ঢাকায় যাইতে দে আগে।’
বলে ধ্রুব ওর হাত ছেড়ে আবার খেতে মন দিল। ইমন হাসছে তখনো রাক্ষসের মতো। ওই হাসিতে রাগে ধ্রুবর গা অব্দি জ্বলে গেল। ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——‘ছাগল একটা; পকেটে কাল রাতে এগুলা কী দিসোস?অদিতি যদি বাই চান্স দেখে ফেলত, কী বিশ্রী হতো ব্যাপারটা!’
ইমন এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলল——-‘ওমা! বিবাহিত কাপলের জন্য এগুলা আবার বিশ্রী কবে থেকে হলো? এগুলাই তো এখন তোদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।’
ধ্রুব আবার দাঁত কিড়মিড় করে তাকাল। তারপর খাবার টেবিলের নিচেই রেগে পা বাড়িয়ে লা-থি বসিয়ে দিল সোজা ইমনের হাঁটুতে।
‘আহ!’— আর্তনাদ করে উঠে হাঁটু চেপে ধরে ইমন। ওর চিৎকারে সবাই তাকালো ওর দিকে। ধ্রুব নির্বিকার মুখে খাচ্ছে, যেন কিছুই জানে না!
তোফাজ্জল ভ্রু কুঁচকে বললেন———‘চেঁচাচ্ছো কেন?’
ইমন নিজের ব্যথা গিলে ফেলার চেষ্টা করে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। গিরগিটি একটা!
ও তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে মিথ্যা হাসি হেসে বলল——‘পোকা, আংকেল।’
তোফাজ্জল ইমনের ওই পোকার কামড় তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। আবার সৌরভের সঙ্গে গল্প করতে মন দিলেন। তোফাজ্জল অন্যদিকে তাকাতেই ইমন ধ্রুবর দিকে চেয়ে চাপা স্বরে বলল——-‘তুই বিয়ে করে বদলে গেছিস, ধ্রুব! ছিঃ! এত চেঞ্জ? আমি জাস্ট ভাবতেই পারছি না।’
ধ্রুব হতাশ ভীষণ! চোখ উল্টে শ্বাস ছেড়ে আবার খেতে মন দিল। খেতে খেতে রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছে। অদিতির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। ফাহিমার সঙ্গে কথা বলছে। কিছু একটা নিয়ে ফাহিমা ওকে উপদেশ দিচ্ছেন; আর নিশ্চয়ই এই মেয়েও সব উপদেশ-গুলো গিলে খাচ্ছে।
_______________
গাড়িতে অদিতির দরকারি জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে। ঘরে ফাহিমা একটা সুটকেসে কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছেন। ফাহিমা কাপড়ের ভাঁজ দেখেশুনে ঠিক করছেন আর বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন। অদিতি চুপ করে বিছানায় বসে আছে, বুকের মধ্যে যেন কিছু ভারী হয়ে আছে, শ্বাস নিতে পারছে না। ও চুপ করে দেখে যাচ্ছে কম্পিত হাতে ফাহিমার কাজ!
ফাহিমা কাপড় গোছাতে গোছাতে বলে যাচ্ছেন নিজের মা-মা কথা-গুলো———-‘ও বাড়ি যাচ্ছিস, অদিতি। কাউকে কষ্ট দিস না। শ্বশুর-শাশুড়ির মান রাখিস, তাদের মায়া দিস। তৃণা ভাবি ধ্রুবর সৎ মা হলেও, তুই কোনোদিন উনাকে সৎ মা হিসেবে দেখবি না। আপন শাশুড়ি ভাববি। ধ্রুবকে বোঝাবি, যেন ওর বাবার সঙ্গে মিলে চলে। ওর বাবার অভিমানটা যে কত গভীর, তুই বুঝিস? মেয়েদের হাতে অনেক ক্ষমতা রে মা! ওরা চাইলে, পুরুষদের সমস্ত অভিমান দু’দিনেই গলে যায়। তুই বোঝাস ধ্রুবকে যে ওর বাবা ওকে কতটা ভালোবাসে। এসব রাগ যেন ঝেড়ে ফেলে দেয়!’
অদিতি মাথা হেলাল, ঠোঁট চেপে রেখেছে শক্ত করে। চোখের জল আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর হাতে হয়তবা অনেক শক্তি; অনেক অনেক ক্ষমতা। ধ্রুবকে তো ও পেয়েছেই; তবে আদৌ কি সেটা পাওয়া বলে? মিথ্যা বলে; বাবাকে ঠকিয়ে করা এই বিয়েকে অদিতি কি নাম দেবে?
ফাহিমা দরকারি সব জিনিস ঠিকঠাক করে সুটকেস লক করলেন। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলেন বাইরে, গাড়িতে তোলার জন্য।
অদিতি এবার উঠে এসে পেছন থেকে শক্ত করে ফাহিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে নিশব্দে চোখের জল ছেড়ে দিল! অস্ফুট স্বরে আহ্লাদ নিয়ে বললো——–‘ভীষণ মিস করবো তোমাকে!’
ব্যাস, এ কথাতেই যেন এই মায়ের সব কান্না বাঁধভাঙা নদীর মতো বেরিয়ে এলো। ফাহিমার গাল বেয়ে পানি ঝরছে, কণ্ঠ কাঁপছে————‘ভা- ভালো থাকিস! নিজের যত্ন নিস! আল্লাহ চাইলে তোরও একটা সুখের সংসার হবে, দোয়া করি আল্লাহর কাছে।’
অদিতির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ও কি ঠকালো তাদের? এই বিয়ে— এই সম্পর্ক… এটা কি সত্যি? এটা কি কোনোভাবে ঠকানো নয়? অদিতির বুকটা যেন ভারী হয়ে এলো। ও ফাহিমার কাঁধে মুখ গুঁজে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল——-‘আমার এই বিয়েতে তুমি খুশি তো, মা?’
ফাহিমা সঙ্গে সঙ্গেই উনার গলায় রাখা অদিতির হাতের উপর হাত রেখে বললেন—‘ওমা! সোনার টুকরো জামাই পেয়েছিস, খুশি হব না? তোর আব্বাও অনেক খুশি।’
অদিতি চেয়ে রইল! ফাহিমা ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। অদিতি কাঁদছে; ফাহিমা বড্ড আদুরে ভঙ্গিতে ওর চোখের জল মুছে কপালে চুমু দিলেন। গভীর স্বরে বললেন———‘ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস। পড়াশোনা চালিয়ে যাস। সৌরভ ভাই বলেছেন, হোস্টেল থেকে বই নিয়ে ওখানেই পড়বি। পড়াশোনা ছাড়িস না, ওটা তোর সাথে আমারও স্বপ্ন!’
অদিতি কেঁপে উঠল,একটা মৃদু হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
বাইরে থেকে ডাক আসছে। ফাহিমা ওর হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্রুব চোখে সানগ্লাস পরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অদিতি সাথে সাথে শাড়ির আঁচলটা মাথায় আরও ভালো করে টেনে নিল।
সৌরভ-তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে আছেন একসঙ্গে। অদিতি ধীরে পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
সৌরভ অদিতিকে দেখে; তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন———‘মেয়েকে বিদায় দাও এখন। আমি গাড়িতে উঠে বসি।’
সৌরভ চলে গেলেন। তোফাজ্জল স্থির দাঁড়িয়ে আছেন! মুখ কঠিন, কিন্তু চোখে যেন চাপা কিছু কষ্ট! অদিতি চুপচাপ বাবার পাশে দাঁড়াল। তোফাজ্জলকে দেখেই ওর ভয় লাগছে। যেন মনে হচ্ছে—- উনি অদিতিকে দেখেই বুঝে যাবেন— এই বিয়ে মিথ্যা, উনাকে তার সরল মেয়ে ঠকিয়েছে। চোখ লুকিয়ে ফেলল অদিতি! চোখে চোখ মেলানোর সাহস ওর মধ্যে একটুও নেই।
তোফাজ্জল ওর দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর অদিতি ভয় নিয়ে নিচু গলায় বলল——-‘আ-আব্বা… আসি! দ-দোয়া করবেন।”
তোফাজ্জল একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন, গম্ভীর স্বরে বললেন——-‘সুখী হও, সংসারে আল্লাহতায়ালা রহমত দিক!”
অদিতি এতদিন পর বাবার স্নেহমাখা স্পর্শ মাথায় পেয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলল! কান্নাটা যেন বুকের ভেতর থেকে ফুলে-ফেপে উঠল। ধ্রুব ওর কান্নার শব্দ শুনে ব্যাকুল ভঙ্গিতে বড়বড় পা ফেলে হেঁটে এলো। বাবা-মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে; আর এগুলো না। ওভাবেই দূরে দাড়িয়ে রইল। অস্থির হয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অদিতির দিকে। তোফাজ্জল মেয়ের কান্নায় অস্থির হওয়া ধ্রুবকে দেখলেন এক মুহূর্তের জন্য— তীক্ষ্ম চোখে মেয়ের স্বামীকে জরিপ করলেন খানিকক্ষণ।
ধ্রুব এসে অদিতির পাশে দাঁড়াতেই তোফাজ্জল মেয়ের কাঁধে হাত রাখেন। নিজের আবেগ-টুকু বরাবরের মতো লুকিয়ে; অদিতির কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন———‘কেদো না। পড়াশোনা করতে চাইলে অনুমতি আছে। করতে পারো। যাও এখন। তোমার শ্বশুরের ঢাকাতে কাজ আছে, দেরি হচ্ছে ওর।”
অদিতি তবুও কাঁদতেই থাকল।তোফাজ্জল মেয়ের কান্নার সামনে গলে যাচ্ছেন। ঢোঁক গিললেন; তারপর ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় কোনরকম বললেন———‘ও-ওকে নিয়ে যা। দেরি হচ্ছে তোমাদের!’
বলে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘুরে চলে গেলেন ভেতরের দিকে। হয়তো একটু দাঁড়ালেই মেয়ে আর স্বামীর ঘরের জন্যে বেরোতে পারত না। তোফাজ্জল চলে যেতেই ধ্রুব অদিতিকে নিজের দিকে টেনে নিল।
অদিতি ধ্রুবর কাঁধে মুখ গুঁজে দিল, ওর কাঁধের টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে ফোঁটাফোঁটা কান্নায়। ধ্রুব একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। ওর চোখে ভাসল প্রথম দিন দেখা অদিতিটা— যে লাজুক মেয়েটা চোখ তুলে তাকাত না, যার আঙুলের ডগায় সবসময় নার্ভাস কাঁপন লেগে থাকত।
ধ্রুব একজন পারফেক্ট স্বামীর ন্যায় আগলে নিলো স্ত্রীকে———‘ওকে; ওকে! ডোন্ট ক্রাই, আমরা এক মাস পরে আবার আসব। কান্না করে না, অদিতি। অ্যাই মেয়ে; থামো এবার।’
অদিতি কোনো উত্তর দিল না। ধ্রুব ওর মাথায় হাত রাখল, আলতো করে বুলিয়ে দিতে লাগলো চুলের ভেতর দিয়ে। সেসময় বহু কষ্টে অদিতিকে গাড়িতে তুলতে পেরেছিল ধ্রুব।
______________
ভীষণ বড়সড় একটা তিনতলা বাড়ি। বাড়ির নেমপ্লেটে খোদাই করে লেখা —-‘ Iyamins family’! অদিতি এর আগে একবার এসেছিল এই বাড়িতে, তবে ধ্রুবর প্রেমিকা হয়ে। তখন ওদের না ছিল কোনো বৈধ সম্পর্ক, না ছিল কবুলের জোর। আজ অদিতি এই বাড়ির বউ!
ধ্রুব শক্ত করে অদিতির হাত চেপে ধরে এগিয়ে চলেছে, সামনে সৌরভ-তৃণা দাঁড়িয়ে, এদের চোখে কৌতূহল। অদিতি চোখ নামিয়ে তাকাল ওদের দুজনের একসঙ্গে চেপে রাখা হাতে। ধ্রুবর আঙুল এখনো ওর হাতের আঙুলে একসঙ্গে জড়িয়ে আছে শক্তভাবে। আবার মুখ তুলে ধ্রুবর দিকে তাকাল ও। ধ্রুব তখন চোখে সানগ্লাস পরে আছে, গম্ভীর মুখে কথা বলছে ইমনের সঙ্গে। পেছন পেছন রাজন; সুমন অদিতির বাপের বাড়ি থেকে আনা ব্যাগ নিয়ে এগুচ্ছে।
বাড়ির ভেতর তখন ভিড়। সৌরভ ইয়ামিনের নতুন পুত্রবধূকে দেখতে এসেছে অনেক মানুষ। তৃণা ঘরে ঢুকেই; রুমে ব্যাগ রেখে রান্নাঘরের দিকে এগুলেন। যাওয়ার আগে অদিতির দিকে তাকিয়ে বললেন———‘রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কিছু মুরুব্বি আছেন, দেখা করতে হবে। সমস্যা হবে না তো তোমার? টায়ার্ড বেশি?’
ধ্রুব তখন দূরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে দ্রুতপায়ে সিড়ি ভাঙছে। অদিতি তৃণার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল——‘গোসল করতে হবে, তারপর আসি?’
তৃণা হেসে বললেন——‘ঠিক আছে। যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।’
অদিতি আঁচল সামলে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল ধীরপায়ে।ধ্রুবর রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর কানে এলো উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি। ইমন আর ধ্রুব এককথায় ঝগড়া করছে! অদিতি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ইমন ওর দিকে তাকাল, এবার যেন আরো পেয়ে বসেছে।
ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে; ইমন কথা তুলল——‘অদি— ওহ, সরি, ভাবি। আপনার হাসব্যান্ডকে বোঝান! আমরা সারপ্রাইজ রেডি করছি আপনাদের জন্যে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, প্লিজ!’
অদিতি চোখ ছোট করে তাকাল দু’জনের দিকে। এদের কথা বলার ধরন মোটেও স্বাভাবিক নয়। ও কিছু বলার আগেই ধ্রুব বলে উঠল——‘ছাগলামি পরে কর! ফ্রেশ হয়ে নেই আমরা। দু’জনেই টায়ার্ড।’
ইমন এবার অদিতিকে ছেড়ে ধ্রুবর কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল——‘বেড সাজাব মাম্মা! কোঅপারেট করবি না?’
ইমন ধ্রুবর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে রেখেছে; ধ্রুব ঢোক গিলে একটা দৃষ্টি ফেলল অদিতির দিকে, অদিতি ভ্রু কুচকে ওদের আচরণ বোঝার চেষ্টা করছে।
ধ্রুব সরে গেল দুকদম! ইমনের দিকে চেয়ে, আবার অদিতির দিকে তাকাল। খানিক কেশে উঠে তারপর হাত পকেটে গুঁজে নিয়ে দোনামোনা করে বলতে থাকে———‘অদিতি, নিচে যাই আমরা? গেস্টদের সঙ্গে কথা বলে খেয়ে উপরে উঠব।’
অদিতি অবাক; ও ভ্রু কুঁচকে বলল——‘কিন্তু আমি গোসল করব না?’
ধ্রুব ওর কাঁধে হাত রেখে; আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে বলল——‘পরে, গেস্ট ফার্স্ট!’
বলে অদিতিকে ঠেলে সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগলো। অদিতি তখন বারবার পেছনের দিকে চেয়ে বলতে থাকে——‘ আগে রুমে ব্যাগ ইও রেখে আসতে দিন। কি করছেন? ধ্রুব?’
ধ্রুব ওসব শুনে না। ঠেলে নিয়ে নামতে লাগল সিড়ি ভেঙ্গে।
নিচে নেমে অদিতি শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে তৃণার পাশে বসতেই তিনি অবাক হয়ে বললেন——‘তুমি এখানে? যাওনি রুমে?’
অদিতি চোখ সরিয়ে তাকাল ধ্রুবর দিকে। সে তখন ডাইনিং টেবিলের দিকে হেঁটে, জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে।
‘ন… না!’——- অদিতি জবাব দিল সেভাবেই।
তৃণা এসবে তেমন মাথা ঘামালেন না। বরং আলতো করে অদিতির কাঁধ চেপে ধরে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইয়ামিন বাড়ির পুত্রবধূর সঙ্গে—‘কাকিমা, ও অদিতি। ধ্রুবর বউ।’
অদিতি নিচু স্বরে সবাইকে সালাম দিল। অদিতিকে সবাই আগাগোড়া তখন দেখতে ব্যস্ত। এক মহিলা ঢঙের স্বরেই তো বলে উঠলেন——‘ধ্রুব বিয়ে করল শেষে? তা এই ছেলেমেয়ের ঘরে টিকবে তো? যা রাগ তোমার স্বামীর!’
কিছুটা ব্যাঙ্গ করেই বললেন কথাটা! অদিতি চোখ নামিয়ে বসে রইল। ও জানে না এই কথার উত্তরে কী জবাব দেবে। ধ্রুব আজ অব্দি ওর সঙ্গে রেগে কথা বলেনি; এমন নয়। তবে সীমিত সেই রাগ। রাগ কমে এলে; নিজেই এসে কথা বলে। অথবা রাগের সময়টুকুতে ও জানে; কিভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। ধ্রুব সবসময়; সব অবস্থাতেই অদিতির প্রতি ভীষণ দায়িত্বশীল! ধ্রুবর এই দিকটা অদিতির ভীষণ রকম টানে নিজেকে।
অদিতির ভাবনার মধ্যে পান চিবোতে চিবোতে এক দাদি মহিলা সভার মধ্যে বিস্ফো-রণ ঘটিয়ে বলে উঠলেন——‘ওসব রাগী; বদমেজাজি স্বামী গো ঘরে একটা জিনিসই বান্ধবার পারে। একটা বাইচ্চা! বিয়ার পরপর ট্যাপলা-ট্যাপলি নিয়া নিলে স্বামীগো কদর বেড়ে যায় বাইচ্চার মার!’
এক মুহূর্তের জন্য পুরো ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল! অদিতি চোখ বড় বড় করে তাকাল দাদির দিকে। ধ্রুব তখন গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছিল, কথাটা কানে যেতেই ও পানি মুখে হঠাৎ কেশে উঠল! কোনোরকমে পানি গিলে বড়বড় চোখে তাকাল অদিতির দিকে।
অদিতি ধ্রুবর ওই চাওনি দেখে মুখ নিচু করল সাথে সাথে।লজ্জায় শেষ ও। বিয়ের একদিনের মাথায় এসব কথা; তাও ধ্রুবর সামনে। মাটি ফাঁক করে ভূগর্ভে ঢুকে পড়তে মন চাইছে ওর এই মুহূর্তে।
ধ্রুব অদিতির থেকে চোখ সরাল; তারপর দ্রুত পকেট থেকে ফোন নিয়ে সেটাতে চোখ রেখে বড়বড় পা ফেলে সোফার দিকে এগুলোও। যেন ও এখানের কোনো কথাই শুনেনি। একপ্রকার যেন পালিয়ে বাঁচল। ও জানে, এখানকার কথা এরপর এখন লাগামছাড়া হয়ে যাবে! ওরা আজ কেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ধ্রুবকে— ‘লাস্ট নাইট; নাথিং হ্যাপেন্ড!’ —-ধ্রুবর মুখটা সে কথা মনে করিয়ে ভোতা হয়ে থাকল পুরোটাসময়!
রাতের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। ধ্রুব সেভাবে তখনও সোফায় বসা। ইমন কাজ শেষ করে, ধ্রুবর পাশে বসল! ধ্রুব স্বভাবতই জিজ্ঞেস করল———‘ কাজ শেষ?’
কথাটা ধ্রুব তেমন দুষ্টু ইঙ্গিতে বলেওনি। কিন্তু ইমন সেটা শোনে বাকা চোখে ধ্রুবকে আগাগোড়া দেখে দুষ্টু চোখে বললো ———‘এহহে, রাহা নেহি যাতা, উউ?’
ধ্রুব এটা শোনামাত্রই সোফার কুশন তুলে সেটা দিয়ে ইমনের মাথায় মেরে দিল——‘জাস্ট শাট অ্যাপ!’
ইমন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। ধ্রুব ওর হাসি শুনে গা রীতিমত জ্বলে গেলো; ও ধপ করে সোফা থেকে উঠে চলে গেল দুতলার দিকে!
ধ্রুবর রুমের পাশের রুমটাই গেস্ট রুম। ধ্রুব সোজা ওই রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলো। বাইরের টিশার্ট-জিন্স পাল্টে বাসার আরামদায়ক টিশার্ট-ট্রাউজার পরে নিলো। বাথরুম থেকে বেরুতেই দেখে, অদিতি গেস্ট রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে। হয়তো অন্য রুম থেকে গোসল নিয়েছে।
দরজা হালকা ভিড়িয়ে রাখা। ধ্রুব সুযোগ পেল সম্ভবত। হাতের ভেজা টাওয়াল বিছানার উপর ফেলে, ধীর পায়ে এগুলো। অদিতি ভেজা চুল কাঁধের পাশে এনে ঝাড়ছে। পেছনের ব্লাউজের দিক বেশ ভেজা। ধ্রুব আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই রীতিমতো আঁতকে উঠে সামনে ঝুঁকে গেল তার স্ত্রী।
‘আ..আপনি? এ রু..রুমে?’——— অদিতি টাওয়াল হাতে স্থির হয়ে গেল প্রায়। ধ্রুবর বিয়ের পর এই হুটহাট ছোয়া এখনো না ঠিকঠাক হজম হয়না তোফাজ্জল হায়াতের এই ভদ্র কন্যা অদিতি হায়াতের। এখনো শরীর কাপে; মনে হয় নিজেকে অবশ। ধ্রুব ছুয়ে দিলেই; মনে হয় এই বুঝি সব শেষ হলো! এই বুঝি ধ্রুব হরণ করে নিলো ওর লজ্জা-গুলোকে একের পর এক; দয়া-মায়াহীন ভাবে।
ধ্রুব ওর ভেজা ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল—— ‘ উওমম..স্মেলিং লাইক ফ্লাওয়ারস!’
অদিতি৪ ঘাড়ে ধ্রুবর ছোয়া; উষ্ণতা ঘিরে রেখেছে দুজনকে! ঘাড় এর ওই অংশ আবেশে বারবার সরিয়ে নিতে নিয়ে অদিতি নিচু গলায় জবাব দিল—— ‘লা..ল্যাভেন্ডার ব..বডি ওয়াশ ইউজ করেছি।’
ধ্রুব ঘাড় থেকে মাথা তুলে আয়নায় নিজেদের দিকে তাকাল। অদিতি লজ্জায় চোখ নামিয়ে রেখেছে; ঠোঁট কাপছে। উফ; নেশালো সেই দৃষ্টি! ধ্রুব হাত নামিয়ে আনলো; কোমরের কাছে হাত রেখে সেফটিপিন খুলতে যাবে; তার আগেই অদিতি টাওয়াল হাতে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়।
অথচ সম্ভব হয়না; তার আগেই শাড়ির আঁচল আটকে যায় ধ্রুবর হাতের মুঠোয়। অদিতি থেমে যায়; চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। বুকের কাছে শাড়িটা চেপে ধরেছে ততক্ষণে; যেন ধ্রুব খুলে না ফেলতে পারে। ধ্রুব শাড়িটা ধীরে ধীরে টানছে, অদিতি একটু একটু পিছিয়ে যাচ্ছে ধ্রুবর দিকে। একসময় অদিতির পিঠ লেগে গেল ধ্রুবর বুকে; মুহূর্তেই শিউরে উঠল ও!
ধ্রুব অদিতির শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিল! আলতো করে হাত রাখলো অদিতির দুই পাশের কোমরে! অদিতির গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল; ও দুহাতে নিজের শাড়ি খামচে ধরলো! ধ্রুব অদিতির কোমর টেনে ওকে আরও কাছে টেনে, ওর কানের লতিতে ঠোঁট রাখল! জমে উঠে অদিতি আওড়ালো——‘ছা..ছাড়ুন! কে..কেউ এসে—‘
ধ্রুব কোমরে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত করতেই; অদিতি ঠোঁট কামড়ে সেই হাতখানা চেপে ধরলো হঠাৎ! ধ্রুব ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বললো——‘আমরা ম্যারেড, অদিতি। যদি কেউ এসেও যায়, হোয়াটস দ্য ম্যাটার?”
অদিতি চোখ বুজে আছে। ধ্রুব ওর গালে গাল ঘষে হেসে ফেলে বললো——‘আরে, চোখ তো খুলো।’
অদিতি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো! ধ্রুব ওর চোখের দিকে, আয়নায় তাকালো। দুজনের চোখে চোখ মিললো! হারিয়েই গেল ওরা! অদিতি আয়নায় নিজেদের দিকে তাকিয়ে রইল; তারপর আস্তে করে নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল ধ্রুবর গালের উপর। এক দৃষ্টিতে দুজন দেখে যাচ্ছে দুজনকে।
একসময় ধ্রুব অদিতির কানের ঝুমকো আঙুলের ডগা দিয়ে নড়িয়ে দিয়ে মদ্যক কণ্ঠে প্রশ্ন করল——‘কি বলছিল দাদীরা আজ? বেবি নিলে আমি তোমার হাতের মুঠোয় থাকব?’
অদিতি লজ্জায় মাথা সরিয়ে নিলো! ধ্রুব শুনেছে তাহলে? ছিঃ! কি লজ্জার ব্যাপার! চোখ-মুখ কুঁচকে আই-ঢাই করে বলে উঠল——‘না, না! উনারা বলছিলেন—‘
ধ্রুব অদিতির ঠোঁটে আঙুল ঠেসে ধরল; বলা বন্ধ হয়ে গেল মেয়েটার। বড়বড় চোখে তাকাল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব অদিতির ঠোঁটের দিকে পিপাসার্ত চোখে চেয়ে বলে গেল——‘দাদিদের একটু জানিয়ে দিবে— ধ্রুবকে কেমন ভাবে তাদের বৌমা নিজের হাতের মুঠোয় দলাই-মলাই করে পিষে রেখেছে? ওরা শুনলে— আর বেবির কথা বলে আপনাকে আর লজ্জায় ফেলবে না।’
অদিতি বাকহারা! ধ্রুব আলগোছে খুলে ফেলা সেফটিপিন আটকে দিল কোমরের কাছে শাড়িতে। তারপর ঘাড়ে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল——‘লিসেন; রাতে সারপ্রাইজ আছে!’
অদিতি বোকার মতো বলে বসল—— ‘কার জন্যে?’
ধ্রুব বিরক্ত হলো; ভ্রু কুঁচকে বলল——‘কটা ওয়াইফ আমার?’
অদিতি হেসে ফেলল শব্দ করে———‘সরি! একটাই বউ আপনার; আমি জানি এটা।’
অদিতি আবার মাথাটা হেলিয়ে দিল ধ্রুবর গালের উপর। ধ্রুব অদিতির দিকে চেয়ে আলতো গলায় ডাকলো——‘অদিতি?”
অদিতি চোখ বুজে; গায়ের সম্পূর্ণ ভর রেখেছে ধ্রুবর গায়ে। সেভাবেই অস্ফুটে জবাব দিল—— ‘হু?’
ধ্রুব কণ্ঠে প্রবল ঘোর নিয়ে বলল——‘আমরা এখন আমাদের বাড়িতে আছি। আমার রুম আমাদের মতো করে সাজিয়ে দিলে আজ, আমি কি পারমিশন পাব? রিমেম্বার, লাস্ট নাইট? কি বলেছিলে তুমি?’
অদিতি চোখ খুলে তাকাল আয়নায় নিজেদের দিকে। ধ্রুবর চোখে নেশা! ও নেশাতে অদিতির মরণ সই! মরণ-টুকু যে ও সাদরে গ্রহণ করবে; মেলে দিতে চাইবে নিজেকে তার ভালোবাসার তরে! অদিতির কি মুখ ফুটে বলা লাগবে যে— ধ্রুব যা চায়; ওর চাওয়াটাও তাই?
ওকে চুপ থাকতে দেখে, ধ্রুব তাড়া দিল—— ‘আনসার দাও!’
অদিতি জবাবে স্রেফ মাথা নাড়লো দুদিকে; তারপর ধ্রুবর কাছ থেকে শাড়ির আঁচল ছুটিয়ে নিয়ে একপ্রকার পালিয়ে গেল গেস্ট রুম থেকে।
ধ্রুব মাথার ঝাঁকড়া চুল পেছনের দিকে ব্যাকব্রাশ করে তৃপ্তির হাসিটুকু ঠোঁটে ফুটিয়ে অদিতির পেছন পেছন নেমে এল!
#চলবে