#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব —৪১
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
—-‘শান্তিমত কিসটাও করতে পারবো না নাকি এখন? এত সফ্ট স্কিন ক্যান?’
অদিতি লজ্জায় হাসফাস করে বললো——-‘এটা স্কিনের দোষ না।’
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বললো——-‘তো কিসের দোষ? আমি তো ক্যাসুয়ালি কিস করেছি। ডিড অ্যাই রাফ টু ইউ?’
অদিতি লম্বা শ্বাস ফেলল! এসব ব্যাপারে ধ্রুব যতবার ডিসকাস করে ওর সাথে; লজ্জায় একপ্রকাশ শ্বাস আটকে বসে থাকে অদিতি। অদিতি কিছু বলবে তার আগেই দরজায় টোকা এলো; ডাকছে ওপাশ থেকে ওদেরকে।
ধ্রুব একবার দরজার দিকে চেয়ে আবারও অদিতির দিকে তাকাল। কিছু একটা মনে পরে গেল ওর; তাই আগেভাগেই বলে ফেলল——-‘লিসেন অদিতি। মেইবি রিসিপশন পর বউদের ওদের বাবার বাড়ি যাওয়া লাগে। কিন্তু আমি আগেই ক্লিয়ার করি; আমি কিন্তু তোমাকে পারমিশন দেইনি। সো ইউ আর স্টেইং উইদ মি; ইন ম্যাই হাউজ!’
ধ্রুবর ঠান্ডা স্বরে ওটা বোধহয় অভিমান ছিলো, কিছু হারানোর ভয় ছিলো; হুট করে একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা-টুকুও হয়তবা ছিলো। অদিতি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল ধ্রুবর ফোলা-ফোলা মুখটার দিকে। অদিতির ভেতর ভেতর অসম্ভব হাসি আসছে ধ্রুবর ওই মুখটা দেখে। হাসি চেপে, অদিতি ওভাবে চেয়ে আছে দেখে ধ্রুব ভ্রু কুচকালো;———-‘কি? ওভাবে কি দেখো? আ’ম সিরিয়াস কিন্তু, ওকে?’
অদিতি আর হাসি আটকে রাখতেই পারলো না; ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকা অবস্থায় ঠোঁট কামড়ে; হেসে হেসে মাথাটা আস্তে করে নাড়িয়ে বুঝদারের ন্যায় বললো—-‘হু; বুঝেছি। আর কিছু বলবেন? ওরা ডাকছে আমাদের।’
ধ্রুব পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাল; তারপর আবার অদিতির দিকে চেয়ে ওকে কিছুটা দূরে সরে ভ্রু বাকিয়ে আপাদমস্তক দেখলো একবার। অদিতি ধ্রুবর ওই তাকানো দেখে নিজেও নিজের দিকে চেয়ে দেখল; ঠোঁট উল্টে বললো———‘কি দেখেন? ভালো দেখাচ্ছে না আমাকে?’
ধ্রুব জবাব দিল না শুরুতেই। ও কিছু একটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল। খুলে রাখা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সেফটিপিন তুলে দুই ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে; কোমরের যে দিকটা উপরের পার্ট সরে দেখা যাচ্ছিল; সেটা দুহাতে ভালো করে চেপে ধরে। ঠোঁটের ফাঁক থেকে সেফটিপিন হাতে নিয়ে কোমরের দিকটায় আটকে দিল ভালো করে। অদিতি হা হয়ে মাথা নিচু করে ওর কোমরের দিকে ঝুকে সেফটিপিন লাগাতে ব্যস্ত ধ্রুবকে দেখল। ধ্রুব নিজের কাজ সেরে সরে দাড়ালো; খুলে ফেলা ড্রয়ার লাগাতে লাগাতে বললো———‘নিজের দিকে খেয়াল রাখবে না একটু? গেস্ট আসবে অনেক, ওদের সামনে একটু প্লিজ রয়েসয়ে থেকো; ওকে?’
ধ্রুব কথা শেষ করতেই; অদিতি মৃদু হেসে বাধ্য স্ত্রীর ন্যায় মাথা নাড়ালো। ধ্রুব অদিতির মাথা টেনে ওর কপালে ছোট চুমু গেঁথে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই দেখে সামনে ইফাজ একদম ফিটফাট হয়ে ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। ধ্রুব ওকে দেখে অবাক হলো——-‘তুমি?’
ইফাজও ধ্রুবকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছে। বেচারা দৌড়ে এগিয়ে এলো ধ্রুবর দিকে, সঙ্গে কণ্ঠে উচ্ছাস——‘দুলাভাই…’
ইফাজ দৌড়ে সামনে আসতেই, ধ্রুব দ্রুত হাতে হাঁটুগেড়ে বসে ইফাজকে কোলে লুফে নিলো সঙ্গেসঙ্গে———‘আরে; শালা সাহেব? কখন এলে?’
ইফাজ আচমকা কোলে উঠামাত্রই হইচই শুরু করে দিল; লজ্জায় মুখ একদম লাল হয়ে গেছে ওর——-‘ইমন ভাইয়া এনেছে। দুলাভাই; নামাও, নামাও না। আমি বড় হয়ে গেছি।’
ধ্রুব নামাল না; বরং হেসে ইফাজের ঝাকরা চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল———-‘আরে, আস্তে আস্তে! বাচ্চা, তোমার জন্যে সারপ্রাইজ আছে একটা।’
সারপ্রাইজের কথা শোনামাত্রই ইফাজ জগতের সমস্ত লজ্জার কথা ভুলে গেল; তাৎক্ষনিক খুশি হয়ে গেল ওর চোখ-মুখ———‘আমার জন্যে? কি সারপ্রাইজ?’
ইফাজ-ধ্রুবর কথা শুনে অদিতি বাইরে বেরিয়ে এল, ধ্রুবর কোলে ইফাজ বড্ড হইচই করছে।ধ্রুব বড্ড আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলছে ইফাজের সঙ্গে। ইফাজের মুখেও হাসি স্পষ্ট। অদিতি দরজায় হেলান দিয়ে তুষ্ট হয়ে দেখে গেল ওসব মুগ্ধকর দৃশ্য! ধ্রুব ইফাজকে কোলে নিয়ে নিচে নামতে নামতে পেছন ফিরে অদিতিকে দেখে বললো—-‘তুমিও রেডি হয়ে নেমে আসো। আমি গাড়িতে ওয়েট করব।’
অদিতি মাথা নাড়ালো চুপচাপ। ধ্রুব চলে যেতেই এক ঝাঁক মেয়ে এসে অদিতিকে বাকি যা সাজগোজ বাকি ছিলো সেসব করে ওকে তৈরি করে নিচে নিয়ে এলো।
___________________
খাদ্য মন্ত্রীর ছেলের রিসিপশনের আয়োজন। পুরো শহর বলতে গেলে নিমন্ত্রিত ছিলো এই আয়োজনে। কমিউনিটি সেন্টারও আজ বিশাল বড়। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে কোনো রাজপ্রাসাদ; ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন তো এটাই বলছে। অদিতি-ধ্রুব গাড়ি থেকে নামলে, কিছু ইয়াং মেয়ে-ছেলে ওদের দুপাশে জড়ো হয়ে ফুল ছেটাতে লাগল, ওদের প্রত্যেকের হাতেই ফুলের পূর্ণ ঝুড়ি। অদিতি এসব দেখে অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুবও তাকাল তখন, ওর মধ্যে অবাক ভাব-টুকু নেই। ও ধীর ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে অদিতির ডান হাতটা চেপে ধরলো। সামনে তোফাজ্জল-ফাহিমা দুজনেই দাড়িয়ে আছেন। এই দুজন মানুষের সামনে অদিতির হাত-টুকু এভাবে ধরে রাখা; তাও এতটা অধিকারবোধ নিয়ে—- ধ্রুব-অদিতি দুজনের কাছে সবসময়ই স্বপ্নের ন্যায় ছিলো। অথচ আজ দেখো, দুজনের স্বপ্নই ওদের সামনে সত্য হয়ে হাতছানি দিচ্ছে। ধ্রুবর হাতে হাত রাখা অদিতি হঠাৎ অনুভব করে—- ধ্রুবর হাত কাঁপছে। অদিতি টলমল চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব সামনে তাকিয়ে আছে; তোফাজ্জল হায়াতের দিকে আড়চোখে চেয়ে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে সে! আজ তোফাজ্জল মেয়ে জামাই নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। তবুও ধ্রুবর চেপে রাখা অদিতির হাত তোফাজ্জল খুব ভালো করেই দেখলেন। হয়তবা ধ্রুবও তাকে সেটা দেখাতেও চেয়েছিলো।
সজ্জিত স্টেজে বসানো হয়েছে সদ্য বর-বধূকে! এ-ও এসে ছবি তুলছে; মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। জীবনেও মিষ্টি পছন্দ না করা ধ্রুব এবার বিরক্ত হলো। তাকাল ও ইমনের দিকে, সঙ্গে ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে বসলো—-‘ওই, আর কতক্ষণ চলবে এসব সার্কাস?’
ইমন পাশে ডিজেকে মেসেজ দিয়ে গান সিলেক্ট করে দিচ্ছে। আজ ইমনের সিলেক্ট করা গান-ই বাজানো হচ্ছে। ও ধ্রুবর কথা শুনে মেসেজিং করতে করতে বলল——-‘হু? ওহ, কখন শেষ হবে? সবে এলি, টাইম লাগবে ভাই।’
ধ্রুবর এই স্যুট-কোট পরে ইচিং হচ্ছিল ভীষণ। ও মুখটা ভোতা করে কোনরকম কষ্ট করে বসে অদিতির পাশে। এত মেহমান না থাকলে হয়তবা ধ্রুব কখন বউ নিয়ে বেরিয়ে যেত এখান থেকে। অদিতিরও এত মানু দেখে বমি-বমি পাচ্ছিল। তারউপর এতো মিষ্টি খেয়েছে; এবার মনে হচ্ছে আর সইবে না পেটে। কিন্তু ও তো বউ-মানুষ। ওর অভিযোগ করলে মানুষ কি বলবে? তাই মুখটা কষ্ট করে ওভাবেই বসে রইলো নিজের জায়গায়।
এবারের যাত্রায় আরও একজন এসে ছবি তুলে মিষ্টি খাওয়াতে যাবে; তার আগেই ধ্রুব উনাকে থামিয়ে দিল, যথাসম্ভব নিজের মেজাজ ঠান্ডা রেখে বললো—-‘আংকেল শুধু ছবি তুলেন। মিষ্টি অনেক খাওয়া হয়েছে। ওকে?’
অদিতি অবাক হয়ে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ওই লোকও হেসে শুধু ছবি তুলে চলে গেল। সে যেতেই ধ্রুব অদিতির দিকে চেয়ে ভীষণ হতাশ গলায় বললো——-‘কিছু ভালো না লাগলে বলা লাগে অদিতি, থাউসেন্ড টাইমস আমি এসব শিখাই তোমাকে, তারপরেও?
ধ্রুবর কণ্ঠে হতাশা চুইয়ে পড়ছে যেন। অদিতি কেন মুখ ফুটে নিজের সমস্যার কথা কখনো বলে না- এটা নিয়েই আপাতত তার বরের ভীষণ মাথা ব্যথা। অদিতিও ব্যথাটুকু নিরাময় করার জন্যে ওর মাথা নিচু করে ধ্রুবর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল———‘আপনি আছেন না? ওতেই হবে।।’
ধ্রুব চুপ করে চেয়ে রইল অদিতির দিকে। ওর পুরুষালি মনটা হুট করে মুগ্ধতায় চেয়ে গেল। প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট চাওয়া মেয়েদের কে বোঝাবে- যখন একটা ছেলে প্রিন্স ট্রিটমেন্ট পায় তারও ভালো লাগে; আদর আদর লাগে সবকিছু, মুগ্ধতা চোখে-মুখেই ফুটে যায়। ধ্রুবর বেলাতেও তাই হয়েছে। ও কাপতে থাকা হৃদপিন্ড সামলে, আলগোছে অদিতির হাতটা আলতো হাতে চেপে ধরলো; ধীরে ধীরে শক্ত হলো সেই স্পর্শ। অদিতি তাকাতেই, ধ্রুব সামনে তাকিয়ে ফেলল! ওর হাতটা তখনও তার স্ত্রীর হাত-টুকু ওভাবেই ছুয়ে রেখেছে।
রিসিপশন শেষ হতে রাত একটা বাজলো। তোফাজ্জল হায়াত মেয়ের রিসিপশনে সৌরভ ইয়ামিনের সবার সঙ্গে দেখা করে করে ক্লান্ত প্রায়। ফাহিমা তৃণার সঙ্গে যে গল্পে লেগেছেন; এখনো উঠার নাম নেই। একটা উৎসবের মতো লাগছিল সবকিছু।
সবাই গল্প-আড্ডা থামাল যখন সৌরভ ইয়ামিন হাতে মাইক তুললেন। স্টেজে বসা ধ্রুব-অদিতি; সামনে বসে থাকা সকল মেহমান সবাই তাকাল সৌরভের দিকে। হুইল চেয়ারে বসা সৌরভ ইয়ামিনের পাশে রাহুল দাড়িয়ে আছে; তার হতে ইনহেলার। সচরাচর সৌরভের হুইল চেয়ার লাগে না। তবে আজ অসুস্থ, তারউপর চলাফেলায় সমস্যা তাই হুইল চেয়ার এনেছেন সাথে।
সৌরভ মাইক টেস্ট করলেন——-‘হ্যালো; 1..2..3…’
বলার পরপর মেহমানদের মধ্যে একঝাঁক মানুষ একসাথে বললো——-‘শোনা যাচ্ছে…’
সৌরভ হেসে ফেললেন। পরে নিজেকে ধাতস্ত করে বলা শুরু করলেন নিজের কথা-গুলো একের পর এক———‘ল্যাডিস এন্ড জেন্টেলম্যান। আমি সৌরভ ইয়ামিন। স্টেজে বসে থাকা বর, ধ্রুব ইয়ামিনের বাবা। এখন আসা সকল মেহমানকে আমার সালাম থাকল। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে আমাকে নাকি কিছু বলা লাগবে; বন্ধুরা বলল। ওরা আমাকে একটা স্ক্রিপ্ট রেডি-ও করে দিয়েছে বলার জন্যে।’
সৌরভ থামলেন; তারপর সামনে থাজ বন্ধুদের সাড়ির দিকে চেয়ে চোরামুখে বললেন——-‘এন্ড ওদেরকে সরি; আমি ওই স্ক্রিপ্ট হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমার মনে হয় বাবা হিসেবে ছেলেকে নিয়ে বলার জন্যে আমার কোনো স্ক্রিপ্ট প্রয়োজন নেই। তো আমি বলি?’
সৌরভ থামলেন। সবাই ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছে সৌরভের কথা———‘এখানে অনেকেই আমাকে কাছে রোজ রোজ অভিযোগ করতেন; আমাকে বলতেন আপনার ছেলে ওমন-এমন।সে হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে; আপনার লাগাম টানা উচিত। অবশ্যই ওসব আমার ছেলের ভালোর জন্যেই বলতেন। কিন্তু কেন জানি না, আমি আজ অব্দি আমার ছেলেকে ওভাবে কারও কথায় ইনফ্লুয়েনস হয়ে শাসন করিনি, ইচ্ছে হয়নি কখনো। একটাই ছেলে আমার। আমি ভেবেছিলাম—যেদিন ও নিজে বুঝবে কোনটা খারাপ; কোনটা ভালো সেদিন আমি বাবা হিসেবে সফল হবো। বাবা হিসেবে আজ বলি—আমার ছেলে ধ্রুব আগের মতোই আছে। তবে হ্যাঁ ও শিখে গেছে কিভাবে রাগ কন্ট্রোল করতে হয়। কিভাবে আমার অসুখে মাথার কাছে গভীর রাতে পানির বোতলটা রেখে আসা লাগে, কিভাবে অজানা আশঙ্কায় আমার ঔষধ এর কোনো সাইড এফেক্ট আছে কিনা সেটা প্রতিবার গুগল করা লাগে, আমার গোসলের সময় গিজার ঠিকঠাক কাজ না করলে দিনে দিনে মানুষ ডেকে গিজার ঠিক করে ফেলা লাগে। সে শিখেছে সবই।’
কথাগুলো বলতে বলতে সৌরভ ধ্রুবর দিকে তাকালেন। অদিতি নিজেও অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। ধ্রুব ওদের সবার এমন চাওনিতে কেশে থতমত ভঙ্গিতে অন্যদিকে চেয়ে চোখ লুকালো।
সৌরভ ধ্রুবর এমন চোরের মতো লুকিয়ে ফেলা শ্যামলা মুখ-টুকু দেখে হাসলেন; তারপর আবারও বলা শুরু করলেন———‘আমার ছেলে শিখে গেছে- তার বাবার বিরুদ্ধে কেউ এক কথা বললে তার সঙ্গে কিভাবে লড়াই করতে হয়। বাবা মিথ্যা মামলায় জেলে থাকা অবস্থায় নিজে দিনের পর দিন না খেতে অপজিশনের বিরুদ্ধে দিনরাত এক করে প্রমাণ জোগাড় করা লাগে। আমার ছেলে বাইরে যেমন কঠোর সাজে; সে ভেতরে এমন নয়। আমার ছেলে জানে সবকিছু; এভরিথিং! কিন্তু ওর আচরণের ভিন্ন; ওর স্বভাব বৈশিষ্ট ভিন্ন! তবুও ও বদলেছে। মেইবি হি হ্যাজ গট অ্যা ওয়ার্ম হ্যান্ড টু বি চেঞ্জড!’
কথাটা বলে সৌরভ অদিতির দিকে তাকালেন। অদিতি উনার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। ধ্রুব তখন আড়চোখে সৌরভের দিকে তাকাল; সৌরভও হালকা হেসে টলমল চোখে বললেন ———‘আমি সৌরভ ইয়ামিন আমার স্ত্রীর দেওয়া বেস্ট গিফট পেয়ে গর্বিত! ধ্রুব আমার ছেলে: এতদিনও আমি সেটা যেভাবে বদনামের পরেও অন্যের মুখের উপরে গর্ব করে বলেছি; আজও বলছি— স্টেজে বসে আছে যে। সে আমার ছেলে; ধ্রুব ইয়ামিন, আমার একমাত্র রত্ন! পাশে তার স্ত্রী অদিতি! দুটো মানুষের গুরুত্ব আমার সৌরভ ইয়ামিনের কাছে আজীবন থাকবে।’
ধ্রুব ওভাবেই তাকিয়ে রইলো সৌরভের দিকে। ওর মনে পড়ে যাচ্ছে— একদিন ধ্রুবর বার্থডের সময়; যখন ওর মা জীবিত ছিলো— ঠিক তখনও সৌরভ মাইক হাতে ওভাবেই সবার সামনে বলেছিলেন——-‘আমি সৌরভ ইয়ামিন আমার স্ত্রীর দেওয়া বেস্ট গিফট পেয়ে গর্বিত।’
সৌরভের কথাতে সেদিন ওর বার্থডেতে তামাশা করা লোকদের মুখ বন্ধ হয়েছিল।
ধ্রুবর ধীরে ধীরে মনে পড়ে যাচ্ছে— ওর মা বেচে থাকাকালীন ওদের ফ্যামিলির কিছু সুন্দর মুহূর্ত! অদিতি ধ্রুবর কাপতে থাকা হাত চেপে ধরল আড়ালে; ওড়নার নিচে— সঙ্গেসঙ্গে ঢোক-টুকু গিলে ধ্রুব মাথা নামিয়ে জোরে-জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। অদিতি ওসবও নজরে রাখে।
সৌরভ ইয়ামিন কথা থামাতেই সবাই করতালি দিয়ে উঠল। একে একে রিসিপশন থেকে সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তোফাজ্জল হায়াত তখন এসে দাঁড়ালেন বর-বউয়ের সামনে। সৌরভের দিকে চেয়ে বললেন——-‘রাত অনেক হয়েছে; গাড়ি অপেক্ষা করছে। অদিতি-ধ্রুবকে আজ নিয়ে যাই?’
অস্থিরতায় ভুগতে থাকা ধ্রুবরএতক্ষণের টনক নড়ল। পাশ থেকে ফাহিমাও বললেন———‘হ্যাঁ ভাই। বিয়ে হয়ে গেলো; এখন অব্দি ওরা আমাদের বাড়ি যায়নি। ওরা ঘুরে আসুক আমাদের বাড়ি থেকে। আমাদেরও তো চেনা-জানা আছে। ওরা ধ্রুবর সঙ্গে পরিচিত হতে চায়।’
অদিতি সঙ্গেসঙ্গে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব চোখের ইশারায় বারবার মানা করছে অদিতিকে। অদিতি কি বলবে; পড়েছে ও এক মহা ফ্যাসাদে। এত বড়-বড় লোকের সামনে এখন অদিতি কি করে বলবে—সে তার স্বামীর ঘরে থাকতে চায়।
সৌরভও সায় দিয়ে বললেন——-‘ঠিকাছে; নিয়ে যাও তোমরা। আমাদের বাড়ি আজ রাতে থেকে ওদের ব্যাগ প্যাক করে তোমরা বেরিয়ে পড়ো কাল সকাল সকাল। কি বলো ধ্রুব?’
তোফাজ্জলও বিনয়ের সঙ্গে বললেন——-‘রাতে থাকা যাবে না সৌরভ। বেরুলে এখনই বেরুব। বুঝোই তো, অনেকটা দূরের পথ।’
সৌরভ তবুও অনেক জোর করলেন; কিন্তু তোফাজ্জলের ওই এক কথাই। ধ্রুব এবার এসব টানা-হ্যাচড়া আর নিতে না পেরে সবার সামনে বলে ফেললো—-‘আপনরা থাকুন আজ। অদিতি কদিন পরে যাক। ওর ক্লাস মিস হচ্ছে অনেক দিন ধরে; তেমন আমারও। আমার ফাইনাল এক্সাম সামনে; অদিতির এক্সাম ও কাছেই। তো….কদিন পর আমরা থেকে আসব? রাইট অদিতি?’
অদিতির দিকে তাকাতেই; অদিতি চোখ বড়বড় করে তাকালো একবার বাবার দিকে, তো আরেকবার ধ্রুবর দিকে। পরপর ধ্রুবর মতো নির্লজ্জ নয় বলেই, কিছু না বলে চুপ করে মাথায় নামিয়ে রাখলো। ধ্রুবর হয়তবা এটা পছন্দ হলো না। ও তীক্ষ্ম চোখে অদিতিকে দেখল; চোখের ইশারায় ওকে শাসাতেই অদিতি ঠোঁট উল্টে তাকালো। এখানে ওরই বা কি করার আছে! ওর সঙ্গে কেন অযথা রাগটা দেখাচ্ছে ধ্রুব?
ফাহিমা মেয়ের দিকে তাকালেন। বর-বউয়ের চোখে ইশারায় চলা কথা-বার্তা হয়তবা উনি বুঝলেন। মৃদু হাসলেন; স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন———‘থাক না। ওরা কদিন পর আসুক বাড়িতে। অদিতি এমনিতেও অনেক পড়ার ক্ষতি হয়েছে। ধ্রুব নিয়ে আসবে তো বলেছে কদিন পর।’
তোফাজ্জল শুরুতে মানলেন না। গ্রামে সবাই উনার মেয়ে জামাইর সঙ্গে পরিচিত হতে চায়, সবাই দেখতে চাইছে। কিন্তু ফাহিমার বারবার বলতে উনি শেষ অব্দি রাজি হলেন।
______________________
আজ আকাশ জুড়ে ভীষন বৃষ্টি। কিছুক্ষণ আগে শিলা বৃষ্টি হলো। এখন ঠান্ডা-ঠান্ডা আবহাওয়া, আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।কেন যেন, অদিতির কদিন হয়েছে শরীর ভীষণ দুর্বল। সারাক্ষণ একটা আলসেমি; একঘেয়েমিতা শরীরে লেগেই থাকে। ইদানিং রান্নাঘরের মসলার গন্ধ অব্দি সহ্য করতে পারেনা ও। তাই তৃণাও কখনো ওকে এখন আর রান্না করতে দেননা। তৃণা কয়েকবার বলেছে — কিট দিয়ে টেস্ট করতে: অদিতিই সেটা করেনি। ও পিল নেয় প্রতিবার, এসব হবার চান্স নেই: তাছাড়া ধ্রুবরও ইচ্ছে নেই এখন বেবি নেওয়া। ও অদিতিকেও রাজি করিয়েছে— ওরা কয়েক বছর পর বেবি নিবে। অদিতি নিজেও রাজি ছিলো। কিন্তু এখন এসব সিমটম অদিতি নিজের কাছেও সুবিধার ঠেকছে না। পরমুহূর্তে মাথা ঝাড়া দেয় অদিতি— হতে পারে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। হয়তবা অদিতিই একটু বেশী ভাবছে।
বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশে দিকে চেয়ে ছিলো অদিতি। হঠাৎ পেছন থেকে দুটো শক্তপোক্ত হাত ওকে আকড়ে ধরতেই চমকে উঠে অদিতি। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তেই; অনুভব করে ঘাড়ে মৃদু-মন্দ কোমল একটা স্পর্শ। ওপর পক্ষ তখন থেমে নেই; অস্থির তার স্পর্শ একের পর এক। আদুরে চুমু ঘাড়ে একের পর এক ঝরঝরিয়ে পড়ছেই, যেন স্ত্রীকে আবেশিত করতে চাইছে বড্ড আদুরেভঙ্গিতে।
ওমন স্বামী-স্বামী অনুভূতি ঘাড়ে অনুভব হতেই অদিতি শিহরণে ঘাড় সঙ্কুচিত করে ফেলল; নিজেকে সহাস্যে স্বামীর তরে বিলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল———‘খাবার গরম করে আনব?’
ধ্রুব অদিতির ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে ব্যস্ততা নিয়ে জবাব দিল——-‘উহু, খেয়ে এসেছি।’
অদিতি শুনলো, আকাশ দেখে তাড়াহুড়ো করে বলল——-‘বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা লাগবে; রুমে চলুন।’
ধ্রুব এটা বলামাত্রই দুহাতে প্যাচিয়ে নিলো অদিতির কোমর-থেকে পেট অব্দি। বাহিরে মৃদু-মন্দ বাতাস বইছিল! বাহিরের এমন শান্ত-ঠান্ডা পরিবেশে ধ্রুব হঠাৎ করেই হয়ে উঠল চুড়ান্ত অশান্ত-অস্থির! ও অস্থির ভঙ্গিতে অদিতিকে পাজকোলে তুলে নিতেই চমকে উঠল অদিতি। ধ্রুবর গলা আতঙ্কিত ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল ——-‘ও আল্লাহ; পড়ে যাব আমি; নামান নামান।’
ধ্রুব ওকে নিয়ে বেডের দিকে যেতে যেতে অধৈর্য গলায় বলল———‘লাফালাফি কম করো; এসেই গেছি।’
অদিতির সিল্কের ফিনফিনে শাড়ির আঁচল দুলছে; ও ধ্রুবর টিশার্টের কলার চেপে ধরে আছে; ওর মুখ তখনও ভয়ার্ত! আপাতত লজ্জার অনুভূতির ওর মধ্যে স্থান-টুকুও পাচ্ছে না। ধ্রুব আলগোছে ওকে বেডে শুইয়ে দিতেই; অদিতি এবার আই-ঢাই করে উঠে বলল ——-‘আপনি এতটা পাগল কেন?আপনার অধৈর্য ব্যবহার আমাকে শুরু থেকে জ্বা-/লাচ্ছে।’
ধ্রুব শান্ত চোখে অদিতির উপর সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে; ঠান্ডা গলায় বলল ——-‘আমি জ্বালাচ্ছি তোমাকে? অ্যাই অ্যাম ইরেটেটিং ইউ?’
অদিতি ওই ঠান্ডা গলার স্বর শুনে কিছুটা নিভে এলো। এখন কিছু হলে এই ছেলের মাথা গরম করলে রাত-টুকু তো রেগে পাড় করবেই; কালকে থেকে ওকে ঘরেই পাওয়া যাবে না। অদিতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও দ্রুত ধ্রুবর গলায় জড়িয়ে ধরে বলল ——-‘ন…না; আমি সেটা বলিনি একদম না। আমি বলছিলাম——‘
ধ্রুব হঠাৎ ওর কথার মধ্যেই অদিতির ঠোঁটের আঙুল ছুয়ে ওকে থামিয়ে দিল। আচমকা আক্রমণে বড়বড় চোখে তাকাল অদিতি। ধ্রুব মিটমিট হেসে দুষ্টু ইঙ্গিত দিয়ে বলল ——-‘আজ রাতে আরো জ্বা/লাবো; জ্বা/লিয়ে—পু/ড়িয়ে ছা/রখার করে ফেলব টোটালি, মিসেস ধ্রুব ইয়ামিন। রেডি ফর দিস মাচ ট-র্চার?’
বলেই ধ্রুব অদিতির ঠোঁটে আঙুল চেপে রাখা অবস্থায়; ওই আঙ্গুলের উপরে চুমু খেলো শক্ত ভঙ্গিতে। চমকে উঠল অদিতি; লজ্জায় শিউরে উঠে অন্যপাশে মুখটা ঘুরিয়ে মৃদু গলায় বলল ——-‘লাইটটা নেভান প্লিজ।’
ধ্রুব শাড়ির আঁচলে হাত রেখেছিল সবে! হাতটা সরিয়ে তাকালো; ভ্রু কুচকে বললো——‘কেন? অন্ধকার হয়ে যাবে।আমি কিছু দেখব না?’
অদিতি লজ্জায় বোধহয় ম/রেই যাবে; ও আবারও বলল ——-‘দোহাই আপনার প্লিজ।’
‘এভাবেই থাকবে লাইট; ডোন্ট ডিস্ট্রাব মি ইন রোমান্স; অদিতি।’——ধ্রুব শুনল না, বরং অদিতির ঘাড়ে মুখ গুজার জন্যে মুখটা এগিয়ে আনতেই; হুট করে অদিতির পাশ থেকে ভাজ করে রাখা একটা ওড়না টেনে ধ্রুবর চোখ বাধা শুরু করল।
বাচ্চামো এমন আচরণে থমকে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল ধ্রুব——‘হোয়াট দ্য? কি করছো এসব?’
অদিতি ধ্রুবর চোখ বাঁধতে বাধতে লাজুক গলায় জবাব দিল———-‘অবাধ্য ধ্রুবকে বাধ্য করছি নিজের।’
ধ্রুব অধৈর্য; জোর করে ওড়না চোখ থেকে সরাতে চাইলে অদিতি জোর খাটালো; বলল ——-‘খুলবেন না এটা। সবসময় নিজের মর্জিমত চলেন;আমি এখন বউ আপনার গার্লফ্রেন্ড নই। তাই আজ থেকে বউ যা বলবে হাসবেন্ডকে তাই মানতে হবে।’
ধ্রুব উঠে বসলো, অদিতিও উঠে বসলো সাথে। ধ্রুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে অদিতির কোমর চোখ বাধা রাখা অবস্থায় চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে বলল——-‘রোমান্সের সময় তোমার মর্জিমত চললে; আমার ভোখা মরতে হবে। আমি শুনছি না এসব ফালতু এক্সিকিউজ। তুমি ওড়না চোখ থেকে খুলবে না আমি স্টেপ নেব?’
অদিতি ভ্রু কুঁচকে তাকাল; বলল ——‘কি স্টেপ?’
ধ্রুব রহস্য হাসল; ঠোঁট টিপে দুষ্টু হেসে বলল———‘যেন তুমি যেচে এসে আমাকে সিডিউজ করো।’
অদিতি মহা লজ্জায় পরে গেল; অস্ফুটে বলল——-‘আমার প্রয়োজন নেই ওসবের।’
‘সত্যিই নেই? শিউর?’ ——- ধ্রুব চোখ বাধা অবস্থায় ভ্রু বাকালো! মুখে মিটমিট হাসি। ও চোখ বাধা অবস্থাতেই জানে— অদিতি নিজের নজর লুকাচ্ছে।
অদিতি জবাব দিল না; লজ্জায় উঠে চলে যাবে সেই সময় ধ্রুব ওর হাত একহাতে চেপে ধরলো। অদিতি বাধা পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে অপরহাতে ধ্রুব দ্রুত গায়ের টিশার্ট একটানে খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। অদিতি চমকে উঠে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর নগ্ন বুকের দিকে। ধ্রুব পেটানো বুকটা বরাবরই অদিতির দুর্বলতা। ওমন ম্যানলি ম্যাসাল বডি দেখামাত্রই অদিতি কেন যেন ইদানিং হুঁশে থাকে না। আর ধ্রুব এই দুর্বলতাই কাজে লাগিয়েছে, কত খারাপ এই ছেলে!
অদিতি চোখ বন্ধ করে ফেলল; সে দেখবে না ওসব অশ্লীল দৃশ্য! ও একপ্রকার হাসফাস করে উঠে বলল——-‘আপনি এত চতুর। সব অকাজে আপনার বুদ্ধি বেশি চলে কেন?’
ধ্রুব ওর চেপে ধরা অদিতির হাতটা টেনে নিলো হঠাৎ। অদিতিও আচমকা টানে ঝাঁপিয়ে পরলো ধ্রুবর নগ্ন বুকের উপর। ওর চুল ঝড়ে পড়লো ধ্রুবর নগ্ন বুকের উপর। দুহাত ধ্রুবর বুকে রাখতেই; ধ্রুব চোখ বাধা অবস্থায় অদিতির থুতনি চেপে ওর স্নিগ্ধ মুখ-টুকু আঙুল দিয়ে উঁচু করে ধরলো নিজের দিকে। অদিতির বুক ঢিপঢিপ করছিলো ভীষণ। ধ্রুবর চোখ বাধা ওড়না দিয়ে। অথচ ওই চোখ বাধা অবস্থাতে ধ্রুবকে কি অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছিল। অদিতি চেয়েই রইল, চোখটাও আর ফেলা হলো না ওর। ধ্রুব খুবই চালাক তো, সে বুঝে কাজ হয়ে গেছে। ও তাই হাস্কি স্বরে; লো ভয়েজে বললো——-‘ম্যাডাম,হার্টবিটটা কেন বাড়ছে আপনার? আর ইউ ওকে, না?’
ধ্রুব অদিতিকে টিজ করছে ইচ্ছে করেই। অদিতি ওসব শুনলো না; চেয়েই রইল ধ্রুবর দিকে, ওর নগ্ন বুকের দিকেও। একসময় ধ্রুব যখন অদিতির মেয়েলি বাকানো কোমরের কাছটায় আঙুল চালালো ধীর হাতে, অদিতি নিজের হুশও খোয়ালো তখন। ও আলগোছে মাথাটা নামিয়ে ধ্রুবর নগ্ন বুকে কোমল ভাবে চুমু খেলো, ঠিক বুকের বা-পাশটায়।
ধ্রুব আবেশে চোখ বুজে; আরও শক্তভাবে চেপে ধরল অদিতির কোমর। টেনে আনলো আরো নিজের দিকে। ধ্রুব কিছু বলার আগেই; আলগোছে অদিতি মুখ তুলে ধ্রুবর দিকে স্থির চেয়ে রইল। দুজনের মধ্যে কেউ কথা বলেনি; অথচ চোখে-চোখে যেন হয়ে গেল হাজারো কথা; হাজারো আদর-মায়ার বাক্য! অদিতি আস্তে করে ধ্রুবর গালে হাত বুলাতে বুলাতে চোখ থেকে ধীর হাতে ওড়না খুলে দিল।
ধ্রুব চোখ খুলে স্থির চেয়ে রইল অদিতির দিকে। অদিতি ঢোক গিললো! ধ্রুব আর কিছু বললো না। হয়তবা বলা লাগলও না। ও আলগোছে মুখটা ঝুঁকে এনে চুমু বসালো অদিতির ঠোঁটে! ভেসে গেল আবারও ওরা দুজন! অদিতি ধ্রুবর চুলের পেছনটায় আঙুল চালালো; মুষ্টিতে চেপে ধরলো ঝাকরা চুলের একাংশ!
মাত্র কয়েক সেকেন্ড পাড় হয়েছে সবে, অদিতি হঠাৎ দুহাতে ঠেলে দিল ধ্রুবকে। ধ্রুব ধাক্কা খেয়ে আচমকা পিছিয়ে আহাম্মক ভঙ্গিতে তাকাল অদিতির দিকে। আজ অব্দি অদিতি ধ্রুবকে দরকার ছাড়া বাধা দেয়নি দুজনের ভালোবাসাবাসির সময়। আজকের এই ধাক্কাটা ঠিকঠাক হজম হলো না ধ্রুবর। ধ্রুব কিছু বলার আগেই; অদিতি দৌড়াতে দৌড়াতে ওয়াশরুমে ঢুকে হরহরিয়ে বমি করে বসলো। বমির আওয়াজ পেতেই ধ্রুব নিজেকে সামলে দ্রুত ওয়াশরুমে এসে অদিতিকে ধরলো দুহাতে।
অদিতি বমি করছে; ধ্রুব চুল গুছিয়ে এক হাতের আজলায় পানি নিয়ে ওর মাথায় পানি দিচ্ছে বারবার। যে ধ্রুব অন্যের বমি দেখামাত্র নিজেও বমি করে বসতো; সে এখন কতটা যত্নে অদিতিকে সামলে নিচ্ছে। অদিতি বমি করা শেষ হলে ধ্রুব ওর চোখ-মুখে পানি ছিটিয়ে মুখ ধুয়ে দিল।
অদিতি ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধ্রুবর বুকে মাথাটা হেলিয়ে দিল; সঙ্গে স্বামীর গায়ে ছেড়ে দিল নিজের সমস্ত ভার-টুকুও। ধ্রুব অদিতিকে সঙ্গেসঙ্গে পাজকোলে তুলে নিয়ে বিছানায় নিয়ে শোয়ালো। গ্লাস থেকে পানি নিয়ে খাওয়াল। ধ্রুবর একেকটা আচরণ অস্থির; অশান্ত।পানি গ্লাসে ঢালার সময় কয়েক ফোঁটা পানি টেবিলেও ফেলে দিয়েছে তাড়াহুড়োতে।
অদিতি পানি খেয়ে শান্তি হয়েছে একটু। ধ্রুব ওর এলোমেলো; ভিজে চুল গুছিয়ে দিয়ে অস্থির গলায় বলল——-‘অ্যাই অদিতি, আজকে বাইরের কিছু খেয়েছিলে?’
অদিতি শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত গলায় বলল——‘ধ্রুব, কালকে আমাকে গাইনোকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন একটু।’
ধ্রুব অবাক হলো; বলল——-‘পেটের সমস্যা, তাহলে গাইনি ডাক্তার কেন?’
অদিতি এবার ধ্রুবর হাতটা চেপে ধরল কিছুটা ভয়েই। ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। অদিতি ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে অস্ফুটে বলল——-‘ধ্রুব আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।’
ধ্রুব এখনো বুঝছে না কি কথা বলছে অদিতি। ও অদিতিকে শান্ত করতে দুজনের হাতের উপর হাত রাখল। নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো——‘কি ভুল? বাইরের ফুচকা খেয়ে ফেলেছ? বারবার বলেছি আমি এগুলা খেও না, আনহাইজেনিক ওগুলা।’
ধ্রুব আবার রেগে যাচ্ছে। অদিতি ওকে থামিয়ে দিয়ে আচমকা ঢোক গিলে বলে উঠলো——‘আমি ওইদিন ভুলে পিল নেইনি।’
‘হোয়াট?’ ——- ধ্রুব চুড়ান্ত হতবম্ব হয়ে গেলো!
অদিতি ওর এমন চেচানোতে ভয়ে সেটিয়ে গেল বিছানার সঙ্গে। ধ্রুব চোখ বড়বড় করে ফেলেছে, ও অস্থির হয়ে বলে যায়—-‘তারমানে এসব বমিটিং….এসব ওইটার সিমটম?’
অদিতি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো——-‘মনে হয়।’
ধ্রুব থামল। উঠে দাঁড়াল অদিতির পাশ থেকে। অস্থিরভাবে পায়চারী করল রুম-জুড়ে। তারপর আবার এসে অদিতির পাশে দাড়িয়ে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল———‘অদিতি, তোমার লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল?’
অদিতি অন্যসময় হলে লজ্জায় শেষ হয়ে যেত এই প্রশ্নে। আজ ধ্রুবর ওমন অস্থির একেকটা আচরণ দেখে লজ্জা এলো না; বরং মনে ভয় এলো। ও নিচু গলায় উত্তর দিল———‘আ..আনুমানিক দুমাস পেরিয়ে গেছে।’
ধ্রুব হা করে অদিতির দিকে চেয়ে রইল। পরপর মুখটা কালো করে বলল——-‘আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম অদিতি। এখন কেন এসব? একটু খেয়াল রাখতে পারতে এসব।’
অদিতি ধ্রুবর হাত চাপলো; কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল——-‘সরি, সরি। আমি ওইদিন ব্যস্ততায় ভুলে গেছি। আপনি এমন আচরণ করছেন কেন ধ্রুব? বাচ্চা তো আল্লাহর রহমত।’
ধ্রুব অদিতির চেপে রাখা হাতটা নিজের অপরহাতে চাপল; বলল——-‘সমস্যা আমার এটাতে না অদিতি। তোমার পড়াশোনা বাকি; আমার নিজের লাইফ এখনো আমি গুছাইনি। বাচ্চার লাইফ কিভাবে গোছাবো আমরা? আমি ভালো প্যারেন্টিং লাইফ চাচ্ছি অদিতি। আমার মনে হয়না তুমি-আমি কেউই এসবের জন্যে প্রস্তুত।’
ধ্রুবর চিন্তা দেখে অদিতি সাথেসাথে বলল——‘আমরা পারব। আর বাসায় এত মানুষ; ওরা খেয়াল রাখবে না? টেনশন কেন নিচ্ছেন ধ্রুব?’
ধ্রুব নীরব থাকল এ প্রশ্নে। ও আলগোছে অদিতির হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে ছুড়ে ফেলা টিশার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল——-‘রেডি হও। ডক্টরের কাছে যাব।’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব — ৪২
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ইয়ামিন বাড়িতে একপ্রকার হইচই লেগে গেছে।ওই বাড়ির সবচেয়ে বাঁদর, বখাটে, চুড়ান্ত উশৃঙ্খল ছেলেটা নাকি বাবা হবে। ইলেকশনের ব্যস্ততায় যে সৌরভকে আজকাল বাড়িতে দেখাই যায়না; সেও খবরটা পাওয়া মাত্রই ছুটে এসেছেন ইয়ামিন বাড়িতে। অদিতির গ্রামের বাড়িতেও খবর দেওয়া হয়েছে; উনারাও তৈরি হয়ে গাড়িতে চড়েছেন ঢাকা আসবেন বলে। অদিতির চোখে-মুখে লাজুক আভা টিকরে বেরুচ্ছে; খুশিতে কাঁপছে একপ্রকার।
তবে এত হাসি, এত খুশির মধ্যেও একজনের মনে কিছু একটা বৈরী অনুভূতি চলছে। এতসব সাজ-সাজ রবেও সোফার এক কোণে পরে আছে চুপচাপ। বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছে অদিতির শাড়িতে ঢেকে রাখা পেটের দিকে। ওইখানে…ওই নরম চামড়ার অনেকটা ভেতরে ধ্রুবর বাচ্চা আছে। ধ্রুব যার বাবা হবে; ধ্রুবকে যে বাবা বলে ডাকবে পুরো.…পুরোটাজীবন। ধ্রুব যতবার ওদিকে অদিতির পেটের দিকে তাকাচ্ছে; ততবার বড্ড পিপাসায় বুকটা হুহু করে উঠছে। আজ নিজেকে যতটা অস্থির লাগছে, এক জীবনে ধ্রুবর এতটাও অস্থিরতা অনুভব হয়নি।
ধ্রুব অদিতির পেটের থেকে চোখ সরিয়ে আবারও মেঝের দিকে নিশ্চুপে চেয়ে রইলো। অদিতি এতক্ষণ মেহমানদের আনা মিষ্টি; সৌরভের আনা মিষ্টি খেতে খেতে এখন একটু শান্তিতে বসেছে সোফাতে। তৃণা সাথেসাথে পরিচিত নিউট্রেশনিষ্টের কাছ থেকে ডায়েট চার্ট এনে অদিতির হাতি ধরিয়ে দিয়েছেন। অদিতি সেটাই পরে যাচ্ছে এখন। তৃণাও পাশ থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন চার্টটা।
সবাই যখন অদিতিকে নিয়ে ব্যস্ত—সৌরভ ছেলেকে দেখেন; ধ্রুব চুপ করে অন্য ধ্যানে মগ্ন। সবার এত হইচই, এত আনন্দের ঝলকানি ওকে একটুও ছুতে পারছে না যেমন। সৌরভ চিন্তিত হোন, ছেলে কি খুশি না? সারাজীবন নিসঙ্গতার যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে পুড়েছে ধ্রুব। ও হয়তবা কখনই কাউকেই বলবে না; নিজে ভেতরের কথাগুলো। ওর মা বেচে থাকলে ধ্রুব হয়তো তাঁকে সব বলতো। আজ সৌরভ শুনতে চান ওসব কথা, যা ধ্রুব বলতে চায়—সবটুকু কথা শুনতে চান। ধ্রুব বাবা হিসেবে হয়তোবানিজেকে এখনো তৈরি ভাবতে পারছে না। তবুও সৌরভ জানেন— ধ্রুব একজন চমৎকার বাবা হবে।
সৌরভ এবার একটু কাশলেন; আদ্র কণ্ঠে ডাকলেন ছেলেকে—-‘ধ্রুব?’
ধ্রুব অন্যমনস্ক ছিলো; সৌরভ তাই আবার ডাকেন—-‘ধ্রুব?’
ধ্রুব আচমকা ডাকে হুশে ফিরে যেমন——‘হু; ওহ হা বলো।’
সৌরভ স্বাভাবিক গলায় বললেন——-‘আমার রুমে সেদিনের ফাইলটা নিয়ে এসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
ধ্রুব মাথা নাড়াল, উঠে চলে যায় পাশের লাইব্রেরি রুমে। আজকাল ধ্রুব কাজ বুঝে নিচ্ছে সৌরভের থেকে। সৌরভের যে কটা ফ্যাক্টরি আছে ওসবের ওকালতি ঝামেলা মিটে গেলে সৌরভ ওসবের দায়িত্ব একমাত্র ছেলে ধ্রুবকে হ্যান্ডওভার করবেন। ধ্রুব চলে যেতেই, সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে অদিতির পাশে এসে দাঁড়ান। অদিতি উনাকে দেখে মাথা তুলে উনার দিকে তাকায়। সৌরভ ওর মাথায় আলতো হাত রাখতেই; অদিতি হালকা হাসে।
সৌরভ মৃদু হেসে বড্ড যত্ন কণ্ঠে ঢেলে বললেন——-‘আমি জানিনা তুমি ছেলে দিবে নাকি মেয়ে। একটা সুস্থ বাচ্চার আশা তো আমি রাখি। নিজের খেয়াল রেখো, সঙ্গে আমার গাধাটারও। প্রথম বাপ হচ্ছে; মেইবি হি ইজ ফিলিং লিটল বিট নার্ভাস।’
অদিতি চোখ জুড়িয়ে গেল একজন বাবার কথা শুনে। ওর চোখ-দুটো টলমলিয়ে উঠে, ও মাথা নাড়াল আস্তে করে। সৌরভ হালকা হেসে চলে গেলেন নিজের রুমে।
ধ্রুব ফাইল নিয়ে এসেছে বাবার পাশে, সৌরভের দিকে ফাইল এগুতেই; সৌরভ মাথা তুলে তাকালেন, বললেন——‘ফাইলের জন্যে ডাকিনি আমি তোমাকে।’
ধ্রুব ফাইল হাতে ভ্রু কুচকালো। সৌরভ নিজের পাশটা বসার জন্যে দেখিয়ে বললেন——-‘বসো; বলছি সব।’
ধ্রুব চুপচাপ বসলো। ওর নিঃশ্বাস ভারী। বুকের ভেতর চাপা একটা অস্থিরতা হাত-পা টানটান করে রেখেছে। প্রথমবার বাবা হচ্ছে ও।ধ্রুব ঠিক বুঝতে পারছে না, এটা ওর জন্য আনন্দের নাকি আতঙ্কের খবর।
অদিতির আল্ট্রা রিপোর্ট দেখে যখন ডক্টর বলেছে——‘ ইওর ওয়াইফ ইজ প্রেগন্যান্ট উইথ টু মান্থ ফিটাস।’
ধ্রুব তখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল উনার দিকে। অদিতির চোখে অশ্রু জমে, ও ধ্রুবর হাতটা তখন চেপে রেখেছিল। ধ্রুব অনুভব করেছে— অদিতির হাতও কেপেছে, ঠিক যেমন কেপেছে স্বয়ং ধ্রুবর হাত-টুকুও। ধ্রুব তখন কিছু বলতে পারেনি। শুধু অনুভব করেছে— এই এতদিন, এত বছর বুকের এক কোণে যে খালি অংশ ছিলো, শূন্য অংশ ছিলো— সেটা হঠাৎ; একদম আচমকা ভরে গেছে। বুকটা আর আগের ন্যায় উত্তপ্ত মনে হচ্ছিল না; শান্তি শান্তি অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল ওকে।
তখনও স্বাভাবিক আচরণ করলেও, ধীরে ধীরে ওর ভেতরের কনফিডেন্ট কমে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে— ও কি সত্যিই বাবা হওয়ার জন্য তৈরি? ওর মধ্যে ভালো গুণই নেই; ওর বাচ্চা কি শিখবে ওর থেকে? সিগারেট খাওয়া আর কোকের বোতল খালি করা, এটুকু? বাচ্চাকে যদি ভালোভাবে মানুষ করতে না পারে? ভবিষ্যতে যদি ওদের বাচ্চা ওকে বলে— হোয়াট অ্যা রাবিশ বাবা ইউ আর! কি করবে তখন ধ্রুব? একটা শিশুর দায়িত্ব… ও সামলাতেই পারবে না, অসম্ভব!
একটা নিষ্পাপ মুখ ওর দিকে চেয়ে থাকবে— নির্ভরশীল, নিরাপত্তাহীন। ধ্রুব কি সেই নিরাপত্তার দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে? আর যদি ওর বাচ্চা ওকেই সেই ব্যবহার দেয়; যেটুকু ও দিয়েছে পুরোটা জীবন ওর বাবাকে? সইতে পারবে ও?
অন্যমনস্ক ধ্রুবর পিঠে হাত রাখেন সৌরভ——‘ধ্রুব?’
ধ্রুব মুখ তুলে তাকাল, ওর চোখ অন্যরকম লাগছিল।সৌরভ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন ছেলের দিকে, তারপর আস্তে করে বললেন——-‘নার্ভাস?’
ধ্রুব উত্তর করল না।শুধু নিশ্চুপে মুখটা পায়ের পাতার দিকে নামিয়ে রাখল। সৌরভ আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখলেন, বললেন——-‘ইটস ওকে ধ্রুব! বাবা হওয়াটা ব্লেসিং। প্রথমবার যখন জানলাম আমি বাবা হচ্ছি, আমিও এইরকম ছিলাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কেমন যেন অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি পারব না। আমি তো নিজের জীবনই সামলাতে পারি না, সন্তানের জীবন সামলাব কীভাবে?”
ধ্রুব আস্তে করে বলা শুরু করলো তখন——-‘আমি জানি না আমি বাবা হওয়ার যোগ্য কিনা। ভয় হচ্ছে আমার।’
সৌরভ মৃদু হাসলেন——‘যোগ্যতা দিয়ে বাবা হওয়া যায় না, ধ্রুব। বাবা হওয়া মানে নিখুঁত হওয়া নয়। এই পৃথিবীর সব বাবারাই নিখুঁত নয়। তবে অ্যাই নো; ইউ উইল গিভ ইউর বেস্ট, রাইট?’
ধ্রুব চুপ করে বসে রইল তখনও! সৌরভ ওর কাঁধে হাত রেখে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নীরবতা ভেঙে সৌরভই কথা বলেন——‘অদিতি কিন্তু তোমার অপেক্ষায় আছে। শি নিডস ইউ দি মোস্ট।’
ধ্রুবর চোখে ভেসে উঠে—অদিতির খুশি-খুশি মায়াবী চেহারাটুকু! কতটা খুশি ছিল ও, বাচ্চার কথা শুনে। ধ্রুবর টনক নড়ে তখন। অদিতির ফিলিংসকে অপমান করে বসেছে ধ্রুব! ধ্রুব হুঁশে ফিরেছে যেমন— দ্রুত উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলতে থাকে——‘আ…অ্যাই মাস্ট গো। বাই।’
বলে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল সৌরভের রুম থেকে। সৌরভ চেয়ারে বসে হাসছেন তখন। আসলেই গাধা একটা!
_________________
অদিতি ঘরে বসে আছে। ওর হাত পেটের উপরে চেপে ধরা। হাতে আল্ট্রার রিপোর্ট! চলছে তখন অদিতির বুকের মধ্যে চাপা কাঁপুনি। ধ্রুব বাবা হচ্ছে জানার পর ধ্রুব কেমন বদলে গেছে না? অদিতির মনে তো তাই হচ্ছে। অদ্ভুত আচরণ করছে আসার পর থেকে। ও কি খুশি…পরপর অদিতি নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করল। ধ্রুব এমন নয়। ও নিশ্চয়ই খুশি। ধ্রুব কখনোই ওকে কষ্ট দেবে না। ধ্রুব হয়তবা শকে আছে। বলে না, অধিক সুখে পাথর! অদিতি খিলখিল করে হেসে উঠে। পেটের হাত বুলিয়ে কথা বলে——-‘তোমার বাবাটা আসলেই পাগল! তুমি আসার পর যদি খোদা তাকে বুঝ দেন একটুও।’
অদিতি হাসছে আর কথা বলছে পেটেরটার সঙ্গে! হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো, অদিতি মাথা তুলে তাকাল। ধ্রুব তখন রুমে ঢুকছে। ও ঢুকেই দরজা আটকে সিটকিনি লাগিয়ে দিল। অদিতি উঠে দাঁড়ালো, মুখটা বেজার করে বলল——-‘এত দেরি কেন? আর একটু দেরি হলে আমি ঘুমিয়ে যেতাম।’
অদিতির ফুলো-ফুলো গালটা ধ্রুবকে আরো টানে যেমন। ধ্রুব তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। অদিতি ওর দিকে চেয়ে আছে। ধ্রুবর চোখ অদিতির পেটের দিকে, ঠোঁট শক্ত হয়ে চেপে রেখেছে। ধ্রুবকে চুপ দেখে অদিতি ডাকে আবারও——-‘ধ্রুব?’
তারপর কি হয়েছে? ধ্রুব হঠাৎ এক দৌড়ে এগিয়ে এসে ওর গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে।অদিতি হতভম্ব হয়ে গেল। ধ্রুবর বুকের ভেতর মুখ গুঁজে ওর কাঁধে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে ধ্রুব।
অদিতি চুড়ান্ত অবাক——‘ধ্রুব?
অদিতি টের পেল, ওর ঘাড় ফোঁটা ফোঁটা পানির স্পর্শ! অদিতি আরও অবাক——‘ধ্রুব….আপনি কাঁদছেন?’
ধ্রুব কিছু বলল না। হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে, ওকে ধরে থাকল। ওমন শক্ত স্পর্শ অদিতি ব্যথাত গুঙিয়ে উঠতেই; ধ্রুব ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে থাকে——-‘আমি… আমি সরি অদিতি। আমি বেবিটা নিয়ে খুশি; ট্রাস্ট মি। আমি আসলে… আসলে আমি খুব কনফিউজড ছিলাম।’
অদিতি ধ্রুবর পিঠে হাত রাখল। ধ্রুব মাথা তুলে অদিতির চোখের দিকে তাকাল। ভেজা চোখে ওর মুখটা লালচে হয়ে আছে। নাক টেনে আবারও অদিতির হাত টেনে ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ধরে রাখল।
ধ্রুব অপরাধীর ন্যায় মাথাটা নিচু করে কাঁপা কণ্ঠে বললে থাকে———-‘আমি চাইনি আমার বাচ্চা আমাকে কখনো অপরাধী ভাবুক। আমি চাইনি, আমার মতো কিছু হোক ওর লাইফেও। আমি ভেবেছিলাম, যদি আমি ভালো বাবা না হই… যদি ও আমাকে ঘৃণা করে…?’
অদিতি ধ্রুবর গালে হাত রাখল। ধ্রুবর ঠোঁট কাঁপছে তখনও, অদিতি ধীরে গলায় বলল——-‘তারপর? তারপর কি মনে হয়েছে, যে এভাবে ছুটে এলেন?’
ধ্রুবর মাথাটা নিচু করে হাঁটু গেড়ে বসল অদিতির সামনে। ওর পেটের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে একটা চুমু খেলো স্ত্রীর পেটের নরম ত্বকে, তারপর আরও একটা, তারপর বেশ কটা! অদিতি শিউরে উঠে ধ্রুবর মাথার চুল খামচে ধরল। ধ্রুব মাথা তুলে ওভাবেই হাঁটু গেড়ে অবস্থাতে অদিতির দিকে তাকাল, বড্ড আবেগ নিয়ে বলল——-‘মেইবি আমি পারব। এন্ড তুমি মাস্ট বি হেল্প করবে আমাকে। তুমি এই পেটের জনকে বলবে—ধ্রুব ইজ দ্য বেস্ট বাবা ইন দিস হোল ওয়ার্ল্ড! এন্ড আমিও রোজ ওকে ইমপ্রেস করতেই থাকব কন্টিনাউসলি, আমার ভক্ত না হয়ে যাবেটাই কোথায়?’
অদিতি হেসে ফেলল আচমকা। ধ্রুব উঠে দাড়ালো! আস্তে করে অদিতিকে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে কপালে চুমু খেলো, চোখ বন্ধ করে স্বস্থির শ্বাস ফেলল অদিতি। ধ্রুব লো ভয়েজে মিটমিট হেসে বলল——-‘আমার আদরে ভাগ বসাতে কেউ একজন আসছে তাহলে?’
অদিতিও হাসে——-‘সেই কেউ একজন আমাদের লক্ষ্মী একটা বাচ্চা হবে। আপনাকে এতটাও ভুগাবে না।’
ধ্রুব ভ্রু উচালো——-‘তাহলে বলছো আমি নিয়ম করে আমার আদর-টুকু ভাগে পাব?’
অদিতি লজ্জায় ডুবে যায়, আস্তে করে ধ্রুবর বুকে মাথা এলিয়ে বললো———‘যেই আসুক; আমি চাই ও ধ্রুব হোক! আমার পাগলাটে প্রেমিক ধ্রুব!’
ধ্রুব হেসে উঠে শব্দ করে——‘দু-দুটো ধ্রুব? সামলাতে কষ্ট হবে না তোমার?’
অদিতি ধ্রুবর ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে থামিয়ে দিল ওকে, শাসিয়ে বললো——-‘পারব,আপনি হেল্প করবেন।’
_____
অদিতির বাবার বাড়ি থেকে আজ লোকজন এসেছেন। অদিতির মা ফাহিমা হাসিমুখে ওর পাশে বসে আছেন। ধ্রুবর মা’র সঙ্গে গল্প জমে উঠেছে বেশ। ফাহিমার মুখে প্রশান্তির ছাপ। অদিতির বাবা তোফাজ্জল অবশ্য চুপচাপ। শুরু থেকে মেয়ের থেকে দূরে দূরে থাকার দরুন নিজের খুশি-টুকু প্রকাশ করতেই পারছেন না। মেয়ের সামনে বিশেষ কথা বলেন নি অবশ্য, তবুও এই তো চায়ের কাপ হাতে এখনো মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছেন। অদিতির চোখ পড়তেই, তিনি চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন বারবার।
অদিতি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পুরনো কিছু বই লাইব্রেরিতে রাখতে হবে ওর, কালকে থেকেই রাখা। ও রুমে গিয়ে হাতের বইগুলো গুছিয়ে নিয়ে লাইব্রেরির দিকে গেল।
লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছাতে দেখে দরজা আগে থেকেই খোলা। অদিতি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখল— ধ্রুব একটা টেবিলের সামনে বসে আছে।ওর সামনে টেবিলে কিছু পেপার্স ছড়িয়ে রাখা। অদিতি মুচকি হেসে দরজায় টোকা দিল——-‘হ্যালো মিস্টার ধ্রুব, মিসেস ধ্রুব ভেতরে আসতে চাইছে; আসবে?’
কিছুটা নাটক করেই বললো অদিতি। ধ্রুব পেপারগুলো থেকে মাথা তুলে অদিতির দিকে তাকাল। ধ্রুবর চোখে চশমা এই প্রথম দেখল অদিতি। ধ্রুব চশমা খুলে টেবিলে রেখে উঠে এলো, অদিতির হাত থেকে বই এর স্তূপ নিজের হাতে নিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললো——-‘বইগুলো তুমি বইছ কেন?’
ধ্রুব ভেতরে ঢুকছে বই নিয়ে; অদিতি ওর পিছু পিছু বলতে বলতে এগুলো ——-‘আমি তো এসব রাখতে এসেছি এই রুমে।’
ধ্রুব বইগুলো জায়গামতো রাখতে রাখতে বললো——-‘তুমি প্রেগনেন্ট অদিতি। এখন ভারী জিনিস ওঠানো তোমার জন্য সেইফ না। এখন প্লিজ একটু রেসপন্সিবল হও, টাইমটা তোমার ভালো না এখন।’’
অদিতি শুনলো ওসব নিয়মের কথা বাধ্য মেয়ের ন্যায়! ধ্রুব বই তাকে গুছিয় রাখল। অদিতির দিকে ফিরতেই অদিতি আবার বললো——-‘ধ্রুব, আমার একটা বই লাগবে এখান থেকে। খুঁজে দেবেন কষ্ট করে?’
ধ্রুব টেবিলের উপর অগোছালো পেপারগুলো গোছাতে গোছাতে জবাবে বললো———‘এখানে তো ম্যাথের বই নেই। সব উকিলাতি বই।’
অদিতি হাত তুলে তাকিয়ে দেখাল উঁচু তাকের একটা বইয়ের দিকে———‘উকিলাতি না। তৃণা মা বলেছে ওই ফিলোসফির বইটা পড়তে। এনে দেবেন?’
ধ্রুব গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলল, গোছানো পেপার্স জায়গা মতো রেখে অদিতির দিকে চেয়ে বললো——‘আজকাল বড্ড খাটাচ্ছ না আমাকে? অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছো, না?’
অদিতি হেসে ফেলল! ধ্রুব কথা না বাড়িয়ে তারপর মই টেনে এনে তাক সমান উঁচু হয়ে দাঁড়াল। উঁচু তাক থেকে বইটা বের করতে গিয়েই পাশের একটা বাক্স ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেল। বাক্স খুলে গিয়ে কয়েকটা পুরনো ফাইল ছড়িয়ে গেল মেঝেময়। ধ্রুব মই থেকে বিরক্ত হয়ে তাকাল নিচে। অদিতি সেটা দেখে দ্রুত ব্যস্ত গলায় বললো——-‘আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।’
ধ্রুব মই থেকে নামতে নামতে শাসিয়ে উঠলো———‘ফাইলগুলো থেকে দূরে থাকো। ধুলো আছে ওগুলোতে।’
ওমন ভারি শাসন শুনে অদিতি চুপ করে সরে গেল। ধ্রুব অদিতির দিকে ফিলোসফির বইটা এগিয়ে দিল। অদিতি হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই ধ্রুব নিচু হয়ে মেঝেতে ছড়ানো ফাইল গুছাতে বসল। কিন্তু এতেই ঘটল ইয়ামিন বাড়ির সবচেয়ে বড় বি-স্ফোরণ! ফাইল গুছানোর সময় ধ্রুবর চোখ হঠাৎ-ই একটা পুরনো ফাইলে আটকে গেল, যার ওপরের মলাটে লেখা— ‘নিকাহনামা—সাল ২০১৯’
#চলবে