আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
25

#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব — শেষ পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

সৌরভ-তোফাজ্জল ট্যারেসে গল্পে মশগুল। ঠিক তখনই ধ্রুব এসে সোজা সৌরভের সামনে দাঁড়াল। তার চোখ রক্তাভ। শ্যামলা মুখ-টুকু রেগে রক্তিম, সারা শরীরে যেন একটা চাপা আগুনের ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়ছে। হাতটায় শক্ত করে মুঠো করে রেখেছে নিকাহনামার ফাইল।

সৌরভের সামনে দাঁড়াতেই সৌরভ ওকে দেখে বললেন——-‘তুমি এখানে?’

ধ্রুব তোফাজ্জলের দিকে একবার চেয়ে আবার সৌরভের দিকে তাকাল, সরাসরি, স্পষ্ট গলায় বলল——‘উই নিড টু টক।’

সৌরভ ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ধ্রুবর স্বরের এই অদ্ভুত ঠান্ডা টোন তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। তোফাজ্জলের চোখ ধ্রুবর হাতে ধরা কাগজটার দিকে গেল। তিনি স্পষ্টই নিকাহনামার শিরোনামটা পড়তে পারলেন। চোখ ঠান্ডা হয়ে এল তার নিজেরও।

ধ্রুব সৌরভের কথার ধার ধারলো না, কোনো উত্তরও দিল না, হাতের কাগজটা সোজা ছুঁড়ে ফেলল টেবিলের ওপর। কাগজটা টেবিলের ওপর পড়ে সশব্দে খুলে গেল। ঝাপসা আলোর নিচে নিকাহনামার লেখাগুলো স্পষ্ট, সৌরভ কাগজটার দিকে তাকিয়েই ভড়কে গেলেন। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার, আমতা-আমতা করে বললেন——‘এটা..এটা তুমি কিভাবে পে…’

ধ্রুব এবার চেঁচিয়ে উঠলো——-‘তাহলে এই তোমার প্ল্যান, রাইট? আমিও তো বলি— অদিতির বাবা কি করে, জাস্ট কি করে আমাদের বিয়েতে মত দিয়ে ফেললেন? হাউ ইজ দিস পসিবল? এই গেইম খেলছিলে আমার সঙ্গে তোমরা?’

সৌরভ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, ভরকে যাওয়া গলায় বলতে চাইলেন——-‘ধ্রুব! আমি সব খুলে বলব। আগে আমার কথা শোনো। আমি তোমার ক্ষতি চাইনি, আমি…’

ধ্রুব আবারও চেঁচিয়ে উঠে——-‘আমি ধ্রুব, অদিতিকে বিয়ে করার জন্যে সাফার করছিলাম, ওকে নিজের করার জন্যে যেখানে একপ্রকার যুদ্ধ করছিলাম; সেখানে আমরা আগে থেকেই ম্যারেড ছিলাম। ও আমার জন্যে হালাল ছিলো, আগে থেকেই? আমি ওকে পেয়ে গেছি যখন আমার বয়স মাত্র ২১ বছর? এত্ত বড় কথা তুমি আমার থেকে লুকিয়েছো? আমাকে উত্তর দাও কেন? অ্যাই নিড দ্য ফাকিং আনসার!’

সৌরভ কিছু বলার আগেই ধ্রুব রাগের মাথায় উঠে ফুলের টব তুলে আছাড় মারল ট্যারেসে। সৌরভ চমকে উঠেন, ধ্রুব আবার চেঁচিয় উঠে——‘আমাকে পুতুল পেয়েছিলে, ইয়ামিন সাহেব?’

তোফাজ্জল এবার ধ্রুবর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর গলা শান্ত, উনি বললেন——-‘বসো, ধ্রুব। কথা বলব আমরা।’

ধ্রুব তোফাজ্জলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তোফাজ্জলের চোখে, কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। ধ্রুব আর চুপ থাকতে পারল না। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। হাতটা চুলের ভেতর চালিয়ে মাথা নিচু করল। গভীর শ্বাস নিচ্ছে, বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে। সৌরভও ধীরে ধীরে বসলেন। ধ্রুবর দৃষ্টি এখনো নিকাহনামার দিকে।

তোফাজ্জল ধীরে ধীরে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলেন গম্ভীরভাবে:———‘তখন তোমার বয়স পাঁচ বছর। অদিতির তখন সবে জন্ম। তোমার বাবা-মা আমাদের বাড়িতে আসেন অদিতিকে দেখতে। তুমি অদিতির সাথে ভীষণ খেলছিলে সেদিন। কারিশমা ভাবী হুট করে তোমাদের দেখে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন— ‘উনার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন।’ সময় চাইলেন আমাদের থেকে, যেন আমরা অদিতিকে বিয়ে দেওয়ার আগে তোমাদের সঙ্গে একবার হলেও কথা বলি। সৌরভের সাথে আমার বোঝাপড়া ভালো থাকায় আমি রাজি হই। এসব আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে; তোমার শাশুড়ি সেটার কিছুই জানতেন না।”

ধ্রুব চুপ করে থাকে।তোফাজ্জল আবার বললেন——-‘তারপর কারিশমা ভাবী মারা যান। তোমার মায়ের মারা যাওয়ার আগে থেকে সৌরভের ব্যবসা তখন লস যাচ্ছিল। প্রচুর টাকা দরকার ছিল তার। তৃণা ভাবী ছিলেন তোমার মায়ের খালাতো বোন, যার বাচ্চা হবে না কখনও, আর তাই বিয়ে হচ্ছিল না। ঠিক তখন তোমার মায়ের খালু প্রস্তাব দিয়ে বসেন সৌরভকে। তৃণাকে বিয়ে করলে, সৌরভের বিজেনেসের পুরো টাকা উনি দিবেন— বলে বসেন। সৌরভ তখন একদিকে বিজনেস আরেকদিকে তার পাঁচ বছরের জেদী বাচ্চা। সব মিলিয়ে পাগলপ্রায়। আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করলে হয়তবা তার না খেয়ে পথে বসা লাগবে; তেমনি ঋণ জমেছিল তার। তাছাড়া তৃণা তোমাকে ভীষণ আদর করত। তাই সৌরভের মনে হয়েছে— বোনের সংসারকে যত্ন করতে আরেকটা বোনই পারে। তাই না চেয়েও বিয়ে করতে হয়েছে তৃণাকে।’

ধ্রুব অবাক হয়ে নিজের বাবার দিকে তাকালো। সৌরভ চুপ করে বসে আছেন। তোফাজ্জল আবার বলা শুরু করে——-‘ তৃণার বাবার বিনিময়ে তোমরা আজ এই পর্যন্ত আসতে পেরেছো। তৃণা ভাবী শুরু থেকেই তোমাকে মায়ের মতো ভালোবেসেছে। তার বাচ্চা ছিল না, তোমাকেই নিজের সন্তান মনে করেছিল। কিন্তু তুমি ধীরে ধীরে তার প্রতি রাগ ধরে রাখতে রাখতে একদিন ফুলদানি দিয়ে তৃণা ভাবির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলে। তখনও সৌরভ-তৃণার বোঝাপড়ার সংসার ছিল, সে সংসারে ভালোবাসা ছিল না। তুমি এই কাজ করার পর সৌরভ অনেক ভয় পেয়ে যান। তোমাকে কিছু বলতেই তুমি তাকেও যা-তা বলে অপমান কর।

সৌরভ ধীরে ধীরে বুঝেন— তৃণা এ বাড়িতে থাকলে তুমি একদিন তাকে মেরেই ফেলবে। তাই দ্রুত তৃণাকে বদলি করেন আরেক বাড়িতে। তুমি থেকে যাও তোমার বাবার সাথে ইয়ামিন বাড়িতে।’

ধ্রুব শ্বাস ফেলল। সব কিছু যেন একে একে খুলে যাচ্ছে তার সামনে! তোফাজ্জল বলেন——‘আমাদের জীবনেও তখন উত্থাল-পাত্থাল হয়। আমার মেঝো মেয়ে পালিয়ে যায় একটা বখাটে, উগ্র ছেলের সাথে। একই ভার্সিটিতে পড়ত ওরা। ওই মেয়ের জন্যে গ্রামের মানুষ আমাদের ছি-ছি করতে শুরু করেছিলো। আমরা তাই ওই গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে এই গ্রামে আসি। তারপর থেকেই আমি গ্রামে নতুন নিয়ম বানাই, যেটা তুমি জানো।’

তোফাজ্জল একটু চুপ করে যান। তারপর আবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন——‘তুমি বড় হতে থাকো। ধীরে ধীরে চুড়ান্ত উগ্র, বখাটে; খারাপ ছেলে হতে শুরু করো। বাপের কথা পরোয়া করতে থাকো না। সৌরভ ভয় পেয়ে যান তোমার এসব কাজ দেখে। অদিতি তখন খুব ছোট। সৌরভ তখন হুট করে সিদ্ধান্ত নিলেন— বিয়ে করিয়ে ফেলতে।’

ধ্রুব ভ্রু কুচকে তাকাল! তোফাজ্জল বলেন——‘আমি তখন তোমার এসব ব্যবহারে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলাম। চাইনি অদিতিকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে। তবে সৌরভ রাজি করিয়েছে আমাকে।তার অনেক কষ্ট হয়েছে সেবার আমাকে রাজি করাতে। ফাহিমাকে লুকিয়ে, একদিন অদিতির স্বাক্ষর নেই আমি নিকাহনামাতে। অদিতি ছোট, সবে ১৬ বছর বয়স। তাই আমাকে এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করেনি। কিন্তু তুমি বড় ছিলে। তোমার স্বাক্ষর নেওয়া সহজ ছিলো না। মনে আছে তোমার ২১ বছর বার্থডেতে একদিন তুমি সৌরভের কাছ থেকে বাইক চেয়েছিলে। বিনিময়ে একটা শর্তে রাজি হয়েছিলে? শর্ত ছিলো খালি পেপারে সাইন করা? মনে আছে বোধহয় তোমার। ওই পেপার নিকাহনমার পেপার ছিলো।’

ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে যায়, অবাক হয়ে তাকাল সৌরভের দিকে। সৌরভ কেশে উঠে মুখ অন্যদিকে ঘুরান। তোফাজ্জল গভীর শ্বাস নেন, তারপর ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলেন—-‘তারপর কেটে যায় অনেকদিক! সৌরভের কথা মতো আমি অদিতিকে শহরে পড়তে পাঠাই। তোমার অদিতিকে ভালো লাগবে এটা আমরা কেউই আশা করিনি। আমরা ভেবেছিলাম— তোমার অদিতির দেখা হোক, একে অপরকে জানো, তারপর নিকাহের কথা তোমাকে বলব। কিন্তু হয়তো তোমার কাবিনের জোর ছিল।তুমি অদিতির জন্যে পাগল হয়ে যাও, তারপর আমার গ্রামে গিয়েছিলে; সেদিন আমি তোমাকে দেখি। একটা পাগল প্রেমিক আমার সামনে ছলচাতুরি করছে আমার মেয়ের হাত চাইবার জন্যে— যে হাত সে বহুবছর আগেই পেয়ে গেছে।”

ধ্রুব বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তোফাজ্জল তাকেথামান——‘অদিতির পাত্র পক্ষ দেখতে আসা এসব তোমার বাবার প্ল্যান ছিল। তোমার বাবা চেয়েছিলেন তুমি উনাকে যেন অদিতির কথা বলো। কিন্তু তুমি বলো নি।’

ধ্রুব কিছু বলতে চায়——-‘সুমনের ওই ছবি..’

তোফাজ্জল হালকা হেসে বললেন——-‘সেটাও তোমার বাবার প্ল্যান। তোমাদের ছবি উনার কাছে ছিলো; তার লোক দিয়ে তোলা। সেটাই সুমনের কাছে পাঠানো হয়। সুমন সেটা আমাকে দেখায়; আমি বের করে দেই তোমাকে। আমরা দুজন কেউই চাইনি, তোমাদের বিয়ে হোক ওইসময়।’

সৌরভ বলেন এবার——‘তারপর তোমাকে আমি শোনাই আমার আর তোফাজ্জলের বন্ধুত্বের কথা। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে তখন বলবে সাহায্যের কথা। তুমি তখন বলো নি। তাই তোফাজ্জলের কথামতে আমরা অদিতির আবার বিয়ের প্ল্যান সাজাই। ঠিক তখন তোমার টনক নড়ে, আমার কাছে আসো সাহায্যের জন্যে। তারপরের কাহিনি তোমার জানা!’

ধ্রুব মাথাটা নামিয়ে রেখেছে। কি ভাবছে, কে জানে? সৌরভ কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই ধ্রুবর বাহুতে হাত রাখলেন——‘ধ্রুব; আমি তোমার ভালো ভেবেছি—-‘

ধ্রুব আচমকা রক্তলাল চোখে পাশ ফিরে তাকাল, সৌরভ ভয়ে নিজের হাত গুটিয়ে নিলেন। ধ্রুব দাঁত দাঁত পিষে বলল——-‘আমি চেয়েছি?হু? আমি বলেছি তুমি আমার ভালো চাও? আমি ধ্রুব মরে যাচ্ছিলাম তোমার ভালো চাওয়ার জন্যে?’

সৌরভ কিছু বলার আগে; তোফাজ্জল কিছুটা ভ্রু কুচকেই জিজ্ঞেস করলেন——-‘এখন তুমি কি চাইছ? সংসার করার ইচ্ছে এসব শোনার পর চলে গেছে?’

ধ্রুব আহাম্মক হয়ে তাকাল তোফাজ্জলের দিকে; তাজ্জব হয়ে বললো——-‘হোয়াট? আমার স্ত্রী; যাকে আমার অজান্তে ছোট বয়সে বিয়ে করেছিলাম, সে আমার বাচ্চার মা এখন। আমি আগেও চাইনি; এখন তো আরো চাইব না সেটা।’

তোফাজ্জল হাসলেন; বললেন——‘তাহলে যা হয়েছে মেনে নাও। মনে করো; তুমি এতদিন নিজেই এই সত্যটি শোনার জন্যে যোগ্য ছিলে না। তুমি ধ্রুব আজ যদি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ না দিতে; তবে ওই ছোটবেলার বিয়ে হয়তবা আমার ভোলা লাগতো। তাই আমরা কেউই জানাইনি এসব; কারণ আমরা নিজেরাও দ্বিধাতে ছিলাম।’

ধ্রুব ঢোক গিলে; তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে নিজের গলার স্বর নরম করার চেষ্টা করে বলল——-‘তাহলে এতদিন কেন জানান নি? আমাদের বিয়ের আজ প্রায় দেড় বছর।’

তোফাজ্জল হাসলেন; সৌরভের দিকে তাকালে সৌরভ মৃদু হেসে বললেন——-‘এই ফাইল এতদিন আমার আলমারিতে ছিলো। আজ হুট করে লাইব্রেরিতে কিভাবে গেল? কিছু সন্দেহ হচ্ছে না?’

ধ্রুব ভ্রু কুচকে ফেলল তাৎক্ষণিক! সৌরভ মৃদু হাসেন; ধ্রুবর কাঁধে হাত দিয়ে চাপড় দিয়ে বললেন——-‘যাও; ঘরে তোমার স্ত্রী একা। ওকে টাইম দাও; বাবা হচ্ছো; রেসপন্সিবিলিটি বেড়ে গেছে তোমার। শ্বশুরকে আবার দ্বিধাতে ফেলে দিয়ো না; কেমন?’

ধ্রুব তবুও বসে রইল সেভাবেই; ওর চোখ নিকাহনামার দিকে! হুট করে ওর ফোনে মেসেজ আসে; ধ্রুব পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে অদিতির মেসেজ। একটা বাবুর ছবি দিয়ে নিচে লেখা——-‘I’m waiting!’

ধ্রুব হঠাৎ মেসেজটা দেখে হেসে ফেলে নিঃশব্দে! পরপর মাথা তুলে আড়চোখে সামনে বসা দুজন মুরব্বিকে দেখতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। ওরা দুইজনেই ভ্রু কুচকে ব্লাসিং করা ধ্রুবকে দেখে যাচ্ছেন। ধ্রুব চোখ নামিয়ে কেশে উঠে বলল——-‘অব…আসি আমি।’

বলে থতমত ভঙ্গিতে উঠে দাড়িয়ে বেরিয়ে যাবে বলে দু কদম আগালো। পরপর থেমে গিয়ে পিছিয়ে এসে আবার টেবিলের উপর থেকে নিকাহনামার ফাইল নিলো কঠোর মুখ-ভঙ্গি করে। দুজনের দিকে রাগান্নিত চোখ চেয়ে বেরিয়ে গেল ট্যারেস থেকে। ও যেতেই বাকি দুজন হেসে উঠলেন শব্দ করে!
____________________
অদিতি বারবার এপাশ-অপাশ ফিরছে। ধ্রুব ওর পাশে শুয়ে আপাতত বাচ্চাদের জন্যে কিভাবে ফিডার বানানো লাগে সেটা দেখছে। অদিতি ভীষণ বিরক্ত লাগছে এসব। ধ্রুব হঠাৎ একটা ভিডিও দেখে আগ্রহ নিয়ে সেটা অদিতিকে দেখিয়ে বলল——-‘দেখো না; এ ধরনের ফিডার বাচ্চাদের জন্যে ভালো অনেক। অ্যামাজন থেকে অর্ডার দেওয়া লাগবে এটা, দিয়ে দেই?’

অদিতি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল; ধ্রুব তখনও ফোনের দিকে চেয়ে। অদিতি এবার উঠে বসে ধ্রুবর হাত থেকে ফোন টেনে নিয়ে ছুড়ে ফেলল সোফার উপর। ধ্রুব আহাম্মক হয়ে তাকাল অদিতির দিকে——-‘কি হলো?’

অদিতি ঠোঁট ফুলিয়ে; অভিমান নিয়ে বলল——-‘ফোন না, এখন আমাকে দেখুন।’

ধ্রুব অদিতিকে আপাদমস্তক দেখল; একটা ঢিলে ম্যাক্সি গায়ে; ফুলো-ফুলো পেটটা ঢেকে রাখা, মুখটায় তৈলাক্ত ভাব— এতেই কি অসম্ভব মোহনীয় দেখাচ্ছে। ধ্রুব ওকে টেনে আনল নিজের বাহুতে, নরম গলায় বলল———‘দেখেছি; পবিত্র লাগছে দেখে।’

অদিতি ধ্রুবর বাহুতে সেঁটে গেল একপ্রকার, গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে শুলো। ধ্রুবর বুকে আঙুল দিয়ে নকশা করতে করতে অস্ফুটে বলল——-‘শার্টটা খুলুন না?’

ধ্রুব দুষ্টু হেসে তাকালো অদিতির মুখের দিকে——-‘আর ইউ শিউর? পরে লজ্জা পাবে না তো?’

অদিতি চোখ রাঙাতেই; ধ্রুব ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে শার্টের নিচের বোতাম খুলতে খুলতে বলল——-‘আরে খুলছি তো; এমন লুক দেওয়ার কি আছে?’

অদিতি তাকিয়েই রইল। ধ্রুব শার্ট খুলতেই অদিতি ওটা ছুড়ে ফেলল মেঝেতে! ধ্রুব ওসব দেখে; হাসিহাসি মুখ ওর! অদিতি ধ্রুবর নগ্ন বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে; কামনা নিয়ে অস্ফুটে বলে বসে———‘হাগ মি স্ট্রংলি; প্লিজ!’

ধ্রুব আলতো করে জড়িয়ে ধরে; পেটে ব্যথা লাগবে তাই। অদিতির ওতে হয়না! ও আরও যেন ঢুকে যেতে ছয় ধ্রুবর বুকের ভেতর, বিরক্তি দেখিয়ে বলে———‘হয়নি; আরও ডিপ্লি!’

ধ্রুব এবারের যাত্রায় দুষ্টুমি ছেড়ে সিরিয়াস হয়ে বলল——-‘তুমি কি চাইছো অদিতি? এসব এখন পসিবল না; বেবির প্রবলেম হবে।’

অদিতি জেদ দেখিয়ে বলল———‘হবে না কিছু। আমি চাইছি, প্লিজ!’

ধ্রুব ওর চুলে হাত বুলিয়ে আরো নরম গলায় বলে——-‘রিস্ক নিবে? ওর কিছু হয়ে গেলে? আমি সারাজীবন গিলটি ফিল করব অদিতি। প্লিজ বুঝো।’

অদিতি ভ্রু কুচকে তাকাল ধ্রুবর বুক থেকে মাথা তুলে। পরপর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ধ্রুবকে; রাগ দেখিয়ে বললো———‘ফাইন! বেবি হওয়ার পর আমার কাছে এলে খবর আছে আপনার। কিছু পাবেন না, আগেই বলে দিলাম।’

অদিতি কথাটা বলে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল! ধ্রুব পড়ল মহা বিপাকে। অদিতির রাগ হয়েছে। ওদের মিলমিশ হয়নি আজ প্রায় নয় মাস! ও নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে বহু কষ্টে এ ক মাস। অদিতি খারাপ লাগা সেখানে স্বাভাবিক। ধ্রুবর মাথা ধরে আছে। অদিতির ব্যবহার আজ অনেকটাই ভিন্ন। বিয়ের পর অদিতি আজ অব্দি কখনো এসবে সরাসরি আমন্ত্রণ করেনি। ইশারা-ইঙ্গিতে বোঝাত ধ্রুবকে। আজ কি হয়ে গেল ওর? অবশ্য ডক্টর বলেছে হরমোনাল চেঞ্জ আসে এ সময়ে। ধ্রুবর পুরো ব্যাপারটা খটকা লাগে। ও বিছানা থেকে উঠে ফোন নিয়ে বারান্দায় গিয়ে ডক্টর প্রত্যাশা হোসেন তুলিকে কল করে।

ধ্রুব বিছানা থেকে উঠতেই দু চোখ বেয়ে জল গড়ায় অদিতির। ধ্রুব ওকে রিজেক্ট করল? কেন করল? সবসময় তো ওই হ্যাদিয়ে মরে একটুখানি কাছে আসার জন্যে। আর আজ যখন অদিতি নিজে বলল; তখন ও মুখ ফিরিয়ে নিলো? অদিতি কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। জেদ চাপলো তীক্ষ্ণই ওর মনে। ও উঠে দাড়িয়ে ড্রয়ার থেকে নাইটি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল; কাছে না এসে যাবেটা কোথায়? আজ কাছে না এলেও সারারাত তরপাবে; সেই ব্যবস্থাই করবে অদিতি। ধ্রুব ফোনে কথা বলেছে; ডক্টর তুলি জানিয়েছেন—— এই মুহূর্তে ইন্টিমেসি পরবর্তী সময়ের ডেলিভারির জন্যে পজিটিভ হবে। করা যেতেই পারে তবে সাবধানতা অবলম্বন করে।

ধ্রুব অদিতির হরমোনাল চেঞ্জের কথা জিজ্ঞেস করতেই তুলি হেসে বললেন———‘এগুলো হয়ই। হরমোনাল চেঞ্জের কারণে মেন্টালি অনেক চেঞ্জ আসে। আপনার স্ত্রীর মনে হয়তবা ভয় ঢুকেছে-যে আপনি ওকে ছেড়ে দিবেন। সমস্যা নেই; কাছে যান; বোঝান— ঠিক হয়ে যাবে।

ধ্রুব নিশ্চিন্তে হয়ে বারান্দা থেকে রুমে আসতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অদিতি একটা সুন্দর ফিনফিনে নাইটি পরে শুয়ে আছে। উদোম ধবধবে পা; ফুলো পেট; মায়াবী ওই মুখ— ধ্রুবকে দুর্বল করে দিল মুহূর্তের মধ্যেই। ম্যাডাম ক্ষেপেছে বোঝাই যাচ্ছে। আজ এত সহজে কিছু মিলবে না জানে; কসরত করতে হবে এজন্য!

ধ্রুব একটা ঢোক গিলে নিজেকে স্থির করে সামনে এগিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল। অদিতি তখন চোখ বুজে পরে আছে। ধ্রুব অদিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই; অদিতি ঠান্ডা গলায় বলল——-‘ঘুমাব আমি; ঠান্ডা লাগছে, এসিটা বাড়িয়ে দিন।’

ধ্রুব মুখ ভোতা করে হাত বাড়িয়ে এসির ট্যামপেরেচার বাড়িয়ে দিয়ে আবার অদিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে চুমু খেতেই অদিতির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পেল না। অন্যবার হলে হাত খামচে ধরে একাকার করে ফেলে; আজ তেমন কিছুই করল না। ধ্রুব অদিতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। অদিতি ওভাবেই রোবটের মতো পরে রইল; তাকিয়ে আছে ওর চোখ-দুটো! ধ্রুব ওর পেটে চাদর দিয়ে ঢেকে, কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল———‘বেবি এসব দেখলে সমস্যা হবে, তাই চাদর দিয়ে ওর চোখ ঢেকে দিয়েছি।’

অদিতি হাসি পেল ভীষন; তবুও ও ওভাবেই পরে রইল। ধ্রুব মাথা নামিয়ে নিল; চোখ নামিয়ে বলল——-‘সরি! তোমাকে কষ্ট দেবো বলে ফিরিয়ে দেইনি; তোমার ভালোর জন্যে——‘

‘তো এখন কি চাইছেন? এখন যদি আমার খারাপ হয়? আপনার আদরের বেবি কষ্ট পায়?’ —— অদিতির ঠান্ডা গলার স্বর!

ধ্রুব জবাবে মৃদু স্বরে বলল———‘বেবির সঙ্গে ডিল করেছি একটা। বেবি বলেছে সে তার বাবার সঙ্গে ওর মা-কে সেইফলি শেয়ার করতে ইচ্ছুক।’

অদিতির হাসি আসছে; ধ্রুব অদিতির পুরো মুখে ছোটছোট চুমু দিতে দিতে বলল———‘প্লিজ হাগ মি স্ট্রংলি, মিসেস ধ্রুব!’

অদিতি শুরুতে জড়িয়ে ধরল না। কিন্তু ধ্রুবর পাগলামি এতই বাড়ছে; একপর্যায়ে চুড়ান্ত মুহূর্তে আবেশিত হয়ে দুহাতে ধ্রুবর গলাটা জড়িয়ে ধরে সায় দিল দুজনের ভালোবাসাবাসিতে!
____________________________
ধ্রুব-অদিতির একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে; নাম ধীর ইয়ামিন! অদিতি এই মুহূর্তে ধ্রুবকে শিখিয়ে দিচ্ছে— কিভাবে একটা দু-মাসের বাচ্চাকে কোলে নেওয়া লাগে। ধ্রুব ভীষন আগ্রহ নিয়ে শিখছেও সেটা। কারণ একটু আগেই ধ্রুব ধীরের হতে ব্যথা দিয়ে ফেলেছে কোলে নেওয়ার সময়। বেচারা এটার জন্যেই এতক্ষণ অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ধীরের মা ভীষন যত্ন নিয়ে ধীরের বাবাকে এই ব্যাপারে ট্রেনিং দিচ্ছে।

ধ্রুব সব শিখে ফেলেছে; ভয়ে-ভয়ে বলল——‘ট্রাই করি একবার?’

অদিতি সায় দিয়ে বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ধ্রুবর হাত কাপছে, ওর বড্ড পিপাসা পেয়ে যাচ্ছে। অদিতির এসবে বিরক্ত; বলল——-‘নিচ্ছেন না কেন কোলে?’

ধ্রুব কম্পিত গলায় বলল——-‘ইয়াহ; আম ট্রায়িং! তাড়াহুড়ো দিচ্ছে কেন?’

বলে আবার হাত বাড়াল; তারপর আস্তে করে কোলে নিলো নিজের ছেলেকে। পরপর দ্রুত আতঙ্কিত গলায় অদিতির দিকে চেয়ে বলল——-‘হয়েছে এবার?’

অদিতি মৃদু হাসল; বলল——-‘হু; শুধু হাতটা ওদিকে ঝুলিয়ে রাখবেন না। ওর দুহাত আপনার বাহুর মধ্যে থাকে যেন।’

ধ্রুব মাথা নাড়াল। অদিতি শাড়ি পাল্টে আসলো; ধ্রুব বর্তমানে রুম জুড়ে হেঁটে ধীরকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। অদিতি শাড়ি পাল্টে এসে বলল——-‘নিচে ইমন ভাইরা এসেছে। আমি কিছু রান্না করবো ওদের জন্যে। আপনি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দোলনায় রেখে নিচে আসেন।’

ধ্রুব মাথা নাড়াল বাধ্য ছেলের ন্যায়। অদিতির যাওয়ার আগে ধ্রুব আবার ডাকল——-‘অদিতি? ওর অ্যামাজন থেকে অর্ডার করে আনা ফিডার কই? ওকে এটাতে খাওয়াও না কেন?’

অদিতি বিরক্ত হলো আবারও; এই এক কথার উত্তর হাজারবার দিয়েছে ও। অদিতি তাই হাসার চেষ্টা করে জবাবে বলল——‘আপনার ছেলের সবে দু মাস। ও ফর্মুলা মিল্ক খাবে এখন? ডক্টর নিষেধ করেছে জানেন না?’

ধ্রুবর মনে পড়ে এ কথা; ও সঙ্গেসঙ্গে মাথা নাড়ায়——‘ওহ! ওকে যাও।’

অদিতি চলে যায় নিচে। ধ্রুব ছেলেকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ফিসফিস করে বলে যায়——-‘আব্বু, আল্লাহ, আল্লাহ!’
__________
ধ্রুব ধীরকে শুইয়ে নিচে আসে। ইমনরা টিভিতে কিছু সিডি সেট করছে! ধ্রুব সোফায় বসতে বসতে বলল——-‘ মুভি দেখবি নাকি?’

ইমন কাজে ব্যস্ত; জবাবে বলল——‘হু; তোর জীবনের মুভি! চল একসঙ্গে দেখি।’

ধ্রুব ভ্রু কুচকালো——-‘মানে?’

ইমন জবাব দিল না। রাজন; সুমন পপকর্ন কিনে এনেছে, ওটাই সোফায় বসে খাচ্ছে এখন। ধ্রুব ওদের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না। টিভি সেট হয়েছে। ধ্রুব ইমনকে আবার জিজ্ঞেস করে——‘ছাগলামি কিছু হইলে তোর খবর আছে।’

ইমন ভ্যাবলার মতো হাসল! মুভি শুরু হয়েছে। টিভিতে সৌরভ ইয়ামিনের সঙ্গে তৃণার বাবাকে দেখে ধ্রুব চমকালো! ইমনের দিকে তাকাতেই ইমন পপকর্ন এগিয়ে দিয়ে বলল——-‘নে খা।’

ধ্রুব পাপকর্ম হাতে তুলল না। ওর চোখ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে টিভির দিকে। তৃণার বাবা তৌহিদ বলছে সৌরভকে;——-‘এই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এক কোটি টাকা আছে। আমার সম্পদের একাংশ। আমি হাতজোড় করছি তোমাকে সৌরভ; এটা নিয়ে নাও তুমি। তার বদলে আমার বন্ধ্যা মেয়েটাকে বিয়ে করো।’

সৌরভ থতমত খেয়ে গেছেন; জবাবে বললেন——-‘কারিশমা ইন্তেকালের দু মাস হয়নি খালুজান। এখন এসব?’

তৌহিদ কান্নারত মুখে বললেন——‘আমার থার্ড স্টেজ ক্যান্সার। আমি মরলে আমার মেয়ের কেউ নেই সৌরভ। তোমার যা লাগে আমি দেব, তুমি একবার মুখ দিয়ে আমাকে বলো,কি লাগে তোমার?’

সৌরভ তাজ্জব ভঙ্গিতে বললেন——-‘টাকা দিয়ে আমাকে কিনতে চাইছেন?’

তৌহিদ জবাবে বললেন——-‘আমি টাকা দিয়ে আমার মেয়ের একটা সংসার কিনতে চাইছি।’

সৌরভ উঠে দাড়িয়ে গেলেন; ঠান্ডা গলায় বললেন——-‘আমার ছেলে জন্যে সৎ মা আনা আমার পক্ষে সম্ভব না। মাফ করবেন। ও বড় হোক; তখন ভাবব।’

তৌহির এটা শোনামাত্রই পায়ে ধরে ফেললেন সৌরভের, সৌরভ চমকে উঠে দু কদম সরে গেল——-‘কি করছেন আপনি? খালুজান…’

তৌহিদ কেদে কেদে বললেন——-‘তৃনা সৎ মা হবে না; ও ধ্রুবর আপন মায়ের মতোই ওকে ভালোবাসবে। তোমার যেদিন মনে হবে তৃণা ধ্রুবর প্রতি অবিচার করেছে; তুমি ওকে তালাক দিয়ো। আমি অনমুতি দিলাম তোমাকে।’

এই ভিডিও এইপর্যায়ে শেষ। আরেকটা শুরু হয়েছে। ধ্রুব তাকাল ইমনের দিকে; ওর চোখে-মুখে বিস্ময়! ইমন ঠোঁট উলটিয়ে তাকাল; ইশারায় টিভি দেখতে বলল। ধ্রুব আবারও টিভির দিকে তাকালো! সৌরভ একটা লোককে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন অন্ধকার ঘরে। এই লোককে ধ্রুব চেনে। ওর পাঁচ বছরের জন্মদিনে এই লোক সবার সামনে ধ্রুবকে ছোট করে তামাশা করেছিল। সৌরভ ওকে পেটাতে পেটাতে কিছু বলছেন; লোকটা ক্ষমা চাইছে বারবার। শেষে এসে একটা কথা শোনা যায়——-‘আমার ছেলের কাছে মাফ চাইবি কাল। নাইলে তোর পা ভেঙ্গে তোর বউ-বাচ্চার কাছে পার্সেল করব আমি।’

ধ্রুবর মনে পড়ে; ওর পরবর্তী জন্মদিনে এই লোক ওকে একটা দামি কার গিফট করে ধ্রুবর কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। এই হচ্ছে তাহার কারণ? ধ্রুব মাথা নামিয়ে ফেলল; ওর চোখ-দুটি ছলছল করে উঠেছে। একটা ভিডিওতে সৌরভ উনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিখে দিচ্ছেন ধ্রুবর নামে। পাশ থেকে রাহুল বাঁধ সাধছে; ——-‘স্যার এখুনি এসব?’

সৌরভ সাইন করতে করতে হেসে বলছেন——‘আমার ছেলে বাপ হচ্ছে রাহুল। ওর একটা ভবিষ্যত আছে না? কোনদিন মরে-টরে যাই আমি।’

আরেকটা ভিডিওতে ধ্রুবর ঘরে দুধের গ্লাস নিয়ে ঢুকেছেন সৌরভ। ক্যামরার ওপাশে কারিশমার হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে, ভিডিওটা উনার করা মনেহয়।

ভিডিও শেষ! ইমন টিভি বন্ধ করে ধ্রুবর দিকে——‘এই ভিডিও কিছু রাহুলের করা; কিছু তোর মায়ের। অবশ্যই তোর বাবার থেকে লুকিয়ে এসভ করা হয়েছে। এই ভিডিও দেখার পর তোর কিছু বলার আছে?’

ধ্রুব মাথাটা নিচু করে বসে আছে চুপচাপ। ওর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই দ্রুত ও চোখ জল মুছে হঠাৎ সোফা থেকে উঠে বড়-বড় পায়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। রুমে অদিতির কোলে ধীর; অদিতি ওকে আবার ঘুম পাড়াচ্ছে। ধ্রুবর চোখ-মুখ লাল দেখে অদিতি হতবাক। ধীরকে কোলে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলো———‘আপনি ঠিক আছেন ধ্রুব?’

ধ্রুব একদৃষ্টিতে ধীরের দিকে তাকিয়ে রইল। ধীর মায়ের কোলে শুয়ে বড়বড় চোখ করে বাবাকে দেখছে। ধ্রুব ওর হাতটা একটু করে ছুয়ে দিল। অদিতি অনুভব করে ধ্রুব ভয়াবহভাবে কাঁপছে। অদিতি ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল; ওর চোখে পানি চিকচিক করছে। অদিতি আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইল: ধ্রুব ধীরের এক হাত ছুয়ে; ওপর হাতে ওর সারা মুখ ছুয়ে দিতে লাগল! ধীর বাবার হাতটা টেনে মুখ ঢুকিয়ে চোষা শুরু করেছে। ধ্রুব ওকে আলগোছে অদিতির কোল থেকে নিজের কোলে নিলো। ধীরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল———‘আমি সরি বাবা। আমার উপর অভিশাপ রেখো না; হু? অ্যাই লাভ ইউ; আব্বু!’

অদিতি ভেবেছে ওসব কথা ও ধীরকে বলছে। অদিতি চিন্তিত গলায় বলল——- ‘কি হয়েছে আপনার? এসব কথা ওকে কেন বলছেন?’

ধ্রুব জবাব দিল না। অদিতিকে একহাতে টেনে ওকেও জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে! ধ্রুবর এক হাতে ধীর; অপর হাতে অদিতির কাধ জড়িয়ে ধরেছে! ওর নিঃশ্বাস আজ অশান্ত; অস্থির! অদিতির ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে বলল——‘বাবার কাছে মাফ চাইবেন আজ?’

ধ্রুব উত্তর দিল না; অদিতি মৃদু হেসে বলল——-‘বাবাকে কল করেছিলাম। বাড়িতে আসছেন আধা ঘণ্টা পর।’

ধ্রুব এবারেও জবাব দিল না। অদিতিও আর কিছু বললো না।
____________________
সৌরভ ইয়ানিন ট্যারেসে বসে সিগারেট ফুকছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসল——-‘আব্বু!’

এত বছর পর ওই একটা ডাক শুনে চমকে পেছন গিরে তাকালেন সৌরভ! তার সামনে ভঙ্গুর এক ধ্রুব ইয়ানিন দাড়িয়ে যার চোখে আজ নেই কোনো জেদ; রাগ; হিংসা! শুধুই আছে কাতরতা, অপরাধবোধ!! সৌরভ ইয়ামিনের হাত থেকে সিগারেট পরে গেল। উনি তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ধীর পেয়ে এগুচ্ছে; হাঁটতেও পারছে না যেমন, হাঁটু ভেঙে ভেঙে হাঁটছে। সৌরভের সামনে দাঁড়াতেই; সৌরভ অস্ফুটে বললেন——-‘ঠিক আছো তুমি?’

ধ্রুব নিশ্চুপে চেয়ে রইলো! সৌরভ ইয়ামিন ওর কাঁধে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত রাখতেই ধ্রুব ভাঙা ভাঙা স্বরে স্রেফ বললো————-‘আ…আমাকে একবার তুই বলে ডাকবে, আ…আব্বু? সেই ছোটবেলার মতো?’

সৌরভ চুড়ান্ত অবাক! ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটে এলো; উনি আচমকা ঝাঁপিয়ে ধ্রুবকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন। ধ্রুব তার কাঁধের মাথা রেখে তাকে জরিয়ে ধরে চোখের জল ফেলে দিল। সৌরভ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন——-‘আমি সরি আব্বু; আমার যা যা আচরণ তোকে কষ্ট দিয়েছে সবকিছুর জন্যে। আমার ছেলেটা; আমার ধ্রুব! আমার রত্ন!’

ধ্রুব বাবার পিঠ আকড়ে ধরে; সেই বহু বছর আগের ন্যায়! ট্যারেসের দরজায় দাড়িয়ে থাকেন তৃণা; পাশে ধীর কোলে অদিতি! তৃণা কেদে আঁচলে চোখ মুছে । অদিতি উনাকেও একহাতে জড়িয়ে ধরে। তৃণা অদিতিকে বলেন——-‘শেষ পর্যন্ত উনার ক্ষমা মিলল। এই লোক ভুল ছিলো না কখনোই অদিতি। আমি জানতাম আল্লাহ উনার প্রতি সদয় থাকবেন। বিশ্বাস কর; উনি দোষী না; যে দোষের শাস্তি উনি এতটা বছর পেয়ে এলেন।’

ধ্রুব বাবাকে ছেড়ে দিল। দুজনের ঠোঁটেই আজ হাসি; ওটাকে তৃপ্তির হাসি বলে সম্ভবত। ধ্রুব পেছনে ফিরে অদিতির থেকে ধীরকে কোলে নিয়ে সৌরভের কাছে এলো। সৌরভের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল——-‘এতদিন ওকে কোলে নিতে তোমার সঙ্কোচ হত না? আজ ওকে একজন দাদা হিসেবে কোলে নাও।’

সৌরভ ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। পরপর চোখের পানি ছেড়ে ধীরকে কোলে নিয়ে ওর পুরো মুখে ছোটছোট চুমু দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে ফেলতে কান্নায় ভেঙে পরে বলতে থাকেন——‘দাদুভাই; ধীর ভাই আমার।’

ধ্রুব পাশেই দাড়িয়ে আছে দুজনের। অদিতি-তৃণা এগিয়ে আসতেই ধ্রুব ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অদিতিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখলো নিজের বাহুতে। অপর হাতটা আলতো করে তৃণার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। তৃণা অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে মাথা তুলে তাকালেন। ধ্রুব উনার দিকে তাকালোও না; বরং সৌরভ-ধীরের দিকে চেয়ে শান্ত স্বরে বলল——-‘আপনি আমার মা হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করেছেন ফাইনালি।’

তৃণা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। অদিতি হেসে ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে একদৃষ্টিতে দাদু-নাতির দিকে চেয়ে রইলো! ওদের পরিবার আজ পূর্ণ! ইয়ামিন ফ্যামিলি শেষ অব্দি সত্যিকার অর্থে ‘ইয়ামিন ফ্যামিলিতে’— পরিণত হয়ছে!

তৃণা গিয়ে সৌরভের পাশে দাঁড়ালেন; দুজন মাইল নাতিকে আদর করছেন। আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে; যে পূর্ণিমা ধ্রুব-অদিতি নিজেদের চোখে দেখেছিল বহু বছর আগে ভার্সিটির মাঠে!

ধ্রুব মৃদু হেসে ফিসফিস করে অদিতির কানের কাছে বললো———-‘তো? এখন? খাদ্য মন্ত্রীর বখাটে ছেলের সঙ্গে প্রেম চলছে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের ভীতু মেয়ে অদিতির, এন্ড দেন?’

অদিতিও হেসে নিচু স্বরে ভয় ভয় নিয়ে অ্যাকটিং করে ফিসফিসাল———-‘প্লিজ কিছু করুন। আমার নাম মেলানো হচ্ছে আপনার নামের সঙ্গে। আমাকে বাবা মেরে ফেলবেন। প্লিজ ওদের বলে দিন আমাদের মধ্যে——‘

অদিতিকে থামিয়ে দিয়ে ধ্রুব দুষ্টু হেসে ফিসফিসালো——-‘ওকে আমি ওদের বলে দেব আমাদের মধ্যে হেব্বি প্রেম চলছে। তোফাজ্জল হায়াতের ভদ্র কন্যা অদিতি হায়াত ইজ নাও ম্যাই ওয়াইফ, অ্যা লাভলি ওয়াইফ!’

ধ্রুব-অদিতি একসঙ্গে হেসে ফেলল! তারপর দুজনে আবার তাকাল ওদের ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকা দাদু-দিদার দিকে! সৌরভ তখনও ধীরের মুখ ছুয়ে ছুয়ে কৌতুক করছেন! তৃণা হেসে ওর মুখে চুমু খেয়ে বললেন——

‘ইয়ামিন বাড়ির উত্তরসূরি— আমাদের ধীর ইয়ামিন!’

#সমাপ্ত