#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#সুচনা।
“ তোর হাত্তির লাহান ছেড়ি গাছে উঠছে! ও তন্নীর মা! এ্যাই অলক্ষী মা*গী। নাম! গাছের তেনে নাম! ”
নুরজাহান বেগম সারা উঠোনময় হাঁটছেন আর চেঁচামেচি করছেন। পৃথিবীর আয়তন বিশাল। আর সমগ্র পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা কেবল ওনার। বাড়ির বউটা মেয়েটাকে শাসন করে না। বাপে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। তুলবেই তো! প্রথম সন্তান। আর মানুষের তো প্রথম সন্তান হয় না! বাইরে রোদের কারণে কিছু দেখা যায় না। অতো কড়া রোদে শরীরের রং পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে না? আজকে মেয়ে কে দেখতে আসবে। অথচ মেয়ের কোনো খোঁজ খবর আছে? বাবা গো বাবা! ওনাকে যখন দেখতে গিয়েছিল, উনি তো তিনদিন ঘর থেকেই বের হন নি। বেলাহাজ, বেশরম মাইয়া মানুষ! এখনকার মেয়েদের লাজ লজ্জা বলতে নেই। নুরজাহান খুঁজে খুঁজে এবার একটা লম্বা লাঠি নিলেন। তারপর পেয়ারা গাছের আগায় বসে থাকা তন্নীর পিঠে ঠাস করে একটা দিলেন। তন্নী কুঁজো হয়ে জোরে বকে উঠলো,
“ বুড়িইই! ”
ওর চিৎকার বাড়ি পর্যন্ত গেল না। বান্ধবীকে মারতে দেখে শিলা তড়িঘড়ি নেমে এলো। তন্নীর দাদির বিশ্বাস নেই। ওকেও একটা দিয়ে দেবে। কথার আগে হাত চলে। নুরজাহান ফের ফুঁসে উঠলেন,
“ মা*গী! তোরে আজকে লাংগের বাড়ি থেকে দেখতে আইবো। তুই একটু সাজ গোসল করবি। ড্যাং ড্যাং কইরা গাছে উঠছছ ক্যান? ”
তন্নী গাছে থেকেই কটমট করে জবাব দিল,
“ তোমার অতো শখ। তুমিই করো বিয়া। আমি বিয়া করতাম না। ”
“ তওবা তওবা। ও মইনুল রে! তোর মাইয়া পাগল হইয়া গেছে। ”
শিলা আহাম্মক চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর উপরে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বললো,
“ তোর দাদি কেঁদে দিয়েছে। কিরে? বুড়ি এমন ছিঁচকাদুনে কেন? ”
তন্নী দাদির গমন পথে চেয়ে রইলো। পিঠটা জ্বলছে বেশ। বুড়ির হাতের এতো জোর! বাড়ির বাম পাশে বিরাট পুকুর। শ্যাওলা পড়া সবুজ দিঘীর জল। একপাশে বেড়ে উঠা কচুরিপানার স্তুপ। পুকুরের পাড় জুড়ে ফলের গাছ গাছালির বাহার। সেখানে বেশ কয়েকটা পেয়ারা গাছও আছে। গরম পড়লেই ডাসা ডাসা পেয়ারায় গাছ ভরে যায়। এলাকার সারা মানুষ খেলেও শেষ হয় না। তন্নীর পছন্দের ফল পেয়ারা। এই গাছটা একটু বেশিই প্রিয় তার। আর তাই দিনের অর্ধেক সময় গাছেই কাটে তার। বাকী সময় অন্য গাছে উঠতে উঠতেই চলে যায়। সে নেমে এলো। বললো,
“ এখন গিয়ে আব্বার কাছে আমার নামে বিচার দেবে। বুড়ি শয়তান! তুই কি চিনিস! এই মহিলা হাড়ে বজ্জাত। ”
শিলা বুঝতে পেরেছে এমনভাবে মাথা দোলালো। দুপুর হয়ে এসেছে। দিঘির জলেও কড়া রোদের ছায়া পড়েছে। রোদের তোপে পাকা হলুদ ধানের শিষগুলো চকচক করছে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“ গোসল করবি না? আজ তোকে দেখতে আসবে? ”
বিয়েশাদী তন্নীর ভালো লাগে না। তবুও সে হঠাৎ লজ্জা পেল। মৃদু স্বরে বললো,
“ হ। তোগো সবার আগে আমার বিয়া হইবো। ”
“ আমার বিয়াও ঠিক। আয় একসাথে সাঁতার কাটি। ”
“ তুই গিয়ে জামাকাপড় নিয়ে আয়। আমিও আনি! ”
শিলা চলে গেলে তন্নী বাড়িতে ঢুকলো পা টিপে টিপে। আজকে আব্বা বাড়িতে। আম্মা সকাল থেকে রান্নাবান্না করছেন। তার ছোট বোনটার খোঁজ নেই। ওটা ওর মতোই বানর। সারা পাড়া চষে খায়। তন্নীর হঠাৎ লাজ লজ্জা আকাশের সাথে মিশে গেছে। বাড়িটা একতলা। উপরে ছাঁদ। মোটে পাঁচটা রুম সারা বাড়ি জুড়ে। মাঝখানে একটা উঠোন। তন্নী নিজের ঘরে যাওয়ার আগে মইনুল ইসলামের ডাক শুনতে পেল। ওকে ডাকছে,
“ তন্নী? ”
ডাক শুনে তন্নী দাঁত কিড়মিড় করলো। হাতের বাম পাশে বাবা মায়ের ঘর। সেদিকে গেল চুপচাপ। আব্বার সামনে সে হৈ চৈ বেশি করে। এমনিতে অতি চঞ্চল কিশোরী হিসেবে সারা গাঁয়ে পরিচিত সে। গিয়ে দেখলো সেখানে নুরজাহান নিজেও দাঁড়িয়ে আছে। তন্নী বুঝতে পারলো সবটা। মইনুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলেন,
“ আম্মাকে কি বলেছো? ”
তন্নী দমে যাবার পাত্রী নয়। নুরজাহান শয়তানের মতো হাসছেন কাপড়ের আড়ালে। মুখ ঢেকেছেন আঁচল দিয়ে। তন্নী বললো,
“ আজ বাদে কাল আমারে বিয়া দিবা। তোমার আম্মা আমারে পিঠে বারি দিছে। ব্যথা পাই নাই আমি? আমি কি হাতি? তোমার আম্মা আমারে হাতি ডাকে। আমার জামাই যদি আমার পিঠ দেখে? দাগটা দেখবো না? ”
মইনুল ইসলাম কেশে উঠলেন। মেয়েটা ওনার এতো অবুঝ, চঞ্চল। তবুও তিনি মাকে বললেন,
“ আম্মা, তুমি আমার মেয়েটার সাথে এমন করো কেনো? সবসময় দুজনে লেগে থাকো কেনো? ”
আসমা বেগম ঘরে এলেন। রান্নাবান্নার ঝামেলায় ওনার শরীর ঘেমে উঠেছে। পাক্কা গৃহিণীর রুপটা ওনার সাথে বেশ মানিয়ে যায়। গালগুলো আগুনের আঁচে লাল হয়ে আছে। বাম পাশের গালে কয়েকটা কালো মেসতা পড়েছে। তিনি হাত মুছতে মুছতে বললেন,
“ ওরা দুইজন সতীন। ”
তন্নী মুখ বাকালো, “ এখন কথা কও না ক্যান? বোবা হইছো? শয়তান বুড়িইই! ”
নুরজাহান দাঁতে দাঁত চেপে চলে গেলেন। ফুসফুস করলেন,
“ ঘর ক্যামনে করবি মা*গী? হাওড়ি একদিক দিয়া নিবো আরেক দিক দিয়া বাইর করবো। ”
মা তন্নীর দিকে এগিয়ে এলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ গোসল কর গিয়ে। একটু ক্রিম আর কাজল দিস চোখে। আমি তোর দাদী কে দিয়ে শাড়ি পাঠাচ্ছি! ”
তন্নী কথা বললো না আর। মাথার বেনিটা হাত দিয়ে খেলতে খেলতে বের হলো। ওঠানে নুরজাহান বসে আছেন মুখ গোমড়া করে। ঠোঁট গুলো টকটকে লাল। গাল দুটো বয়সের ভাঁড়ে কুঁচকে গেছে। সাদা শরীরের রং! একসময় ভীষণ রুপবতী ছিলেন বোঝা যায়। তন্নী দেখতে দেখতে একবার ঠোঁট মুচড়ে দিল। নুরজাহান মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তন্নী ঘরে এলো। গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তাঁদের স্কুলে একটা ছেলে ছিল। নাম রবিউল। দেখতে হ্যান্ডসাম। ওর জামাইটা এমন হলেই হলো। নইলে তন্নী বিয়ে করবেই না।
গোসলের পর তখন বিকেল হয়েছে। তন্নী আর ঘর থেকে বের হয় নি। তার পড়নে এখন সুতির কামিজ। একটু পর ছেলের বাড়ি থেকে মানুষ আসবে। পছন্দ হলে তারপর বিয়ে। তন্নীর বুক, গলাসহ সব কাঁপছে। জলের তেষ্টায় জীবন তেনা তেনা হয়ে যাচ্ছে। সেই দুপুর থেকে নুরজাহান এমুখী হন নি। করুক গোস্বা। তার কি? সে এখন বিয়ে করবে তারপর জামাইয়ের সাথে আরামে দিন কাটাবে। শান্তি! কোথা থেকে দৌড়ে শিলা ঘরে ঢুকলো। তন্নী ওকে দেখে বললো,
“ আয়। এখানে বোস! ”
শিলা হাঁপিয়ে উঠে বললো,
“ কি শুনেছি জানিস? তোর জামাইয়ের বয়স আঠাশ। ”
তন্নী কতক্ষন বোকার মতো তাকিয়ে থেকে হাতে হিসেব গুনলো। গোনা শেষ হলে বিস্মিত চোখে আকাশ থেকে পড়লো,
“ হায় আল্লাহ! আমার থেকে বারো বছরের বড়? আম্মা? আম্মা? ”
তারপর হুট করে বিলাপ জুড়ালো সে। এত বড় বয়সের বুড়ো বেটাকে সে বিয়ে করবে না। কিছুতেই না। ওমা মাগো! দামড়া কোথাকার। ঐ ছেলেকে দেখলে তো তন্নী ডরেই মরে যাবে! দাদি দৌড়ে ঘরে এলেন। তন্নী মেঝেতে বসেছে। শিলা এক মুহুর্তের জন্য বোকা হয়ে গেছে। নুরজাহান পাশে বসতেই তন্নী জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“ আমি বিয়া করতাম না! করতাম না। ”
“ ক্যান কি হয়েছে? ওরে বলদ। কথা ক। হইছে কি? ”
তন্নী আরেকটু জোরে কাঁদল,
“ ও দাদী গো! এতো বুইড়া বেডা গো! আমি অতো বুইড়া ব্যাডার কাছে বিয়া বমু না। ”
আসমা বেগম নিজেও দৌড়ে এলেন। মেয়েটাকে নিয়ে উনি কিছুতেই পারেন না। এই তো দুপুরে সুন্দর মতো গোসল করলো। মুখে ক্রিম মাখলো। লজ্জা পেল। এখন আবার কি হয়েছে? তিনি হতাশ শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি হয়েছে? ”
নুরজাহান বললেন,
“ জামাইয়ের নাকি বয়স বেশি! ”
তন্নীর কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেল,
“ এতো বড়ো পুরুষ যদি আমাকে জড়িয়ে ধরে তাহলে তো আমি ভর্তা হয়ে যাবো!! ”
নুরজাহান কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
“ ভর্তা হইলেই তো মজা! ”
“ সরো তুমি! ”
নুরজাহান কে সরিয়ে দিয়ে তন্নী আবার কাঁদতে লাগলো। বিয়ে সে করবে না। তাদের স্কুলের তার বয়সী ছেলেটা কি সুন্দর কথা বলে। তন্নীর একটুও ভয় লাগে না। আঠাশ বছরের পুরুষ সম্পর্কে তার ধারনা আছে। তার বিশ্বাস, এসব পুরুষদের সাথে কথা বলার আগেই শরীর কাঁপে। আবার, একটা ধমক দিলেই তন্নী শেষ। আয়হায়! তন্নীর কপালে কেনো এতো দুঃখ? সে কাঁদতেই থাকলো। মা চলে গেলেন। একটু পর ঠিক কান্না থেমে যাবে। উনি জানেন।
আরো কিছুক্ষণ গুনগুন করে কেঁদে তন্নী শান্ত হলো। চোখ ফুলে গেছে। শিলা বোকার মতো তখন থেকেই বিছানায় বসে আছে। তার কপালে আজকে দুঃখ আছে। নুরজাহান সাংঘাতিক মহিলা। সারা পাড়া টইটই করে। এখানের-ওখানের খবর রাখে। বয়সটা শিলা জানিয়েছে জানলে ওর আব্বা আম্মার কাছে গিয়ে হাজারটা কানপড়া দেবে। বুড়ো হয়েছে তো কি হয়েছে? দিনে দিনে কুটনামী কমে না! আর শুধু আজকেই না। শিলা গতকালও একটা কান্ড করেছে। সে বলেছিল,
“ সুন্দরী মেয়েদের জামাই হয় কালো! ”
তারপর তন্নী সারাদিন বাইরের লাকড়ির ঘরের চাঙ্গে উঠে বসেছিল। মরে গেলেও কালো ছেলে সে বিয়ে করবে না। সারাদিন কিছু খায় নি। তারপর মইনুল ইসলাম এসে বললেন, ছেলে সুন্দর। উনি নিজে দেখেছেন। সে কথা শোনার পর রাতে সেখান থেকে নেমেছে তন্নী। শিলার ভয় আরো বাড়লো।
নুরজাহান নাতনীর মাথায় হাত চালালেন। বললেন,
“ ছোট ছেলেরা সোহাগ করতে জানে না। বয়স একটু বেশি হলে সোহাগ পাবি! ”
তন্নী ফুঁপিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ সোহাগ দিয়ে কি করবো? ”
“ ওরে পাগল। মাইয়া মানুষ তো জামাইয়ের সোহাগেই সুখী! পাগল ছেড়ি। যা এবার কলপাড়ে যা। একটু মুখটা ধুয়ে আয়। কাঁদলে চোখমুখ সুন্দর হয় রে। তোর গালগুলা লাল হইছে। ”
তন্নী ফোলা চোখমুখ নিয়ে বাইরে কলপাড়ে এলো। শিলার মন চাইছে এই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে। পৃথিবীর বুকে একটা জাদু এই মুহূর্তে হলে মন্দ হয় না। কিন্তু সেটা সম্ভব না এখন। বিছানায় তুলে রাখা পা গুলো সে আরেকটু গুটিয়ে নিল। নুরজাহান উঠে এগিয়ে এলেন। শিলা আগেভাগেই বলে ফেললো,
“ তোমার নাতি কাঁদবে জানলে বলতাম না। সত্যি! ”
নুরজাহান চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলেন,
“ তন্নী কেউরে পছন্দ করে? ”
শিলা বললো,
“ আমাদের ক্লাসের রবিউলের সাথে ওর খুব মিল ছিল। ”
“ ঐ পোলা এখন কই? ”
“ পরিক্ষা দিয়া ঢাকা চলে গেছে। গার্মেন্টসে ঢুকেছে। ”
“ তোর কপালে দুঃখ আছে। ”
নুরজাহান আর কিছু বললেন না। মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলেন। শিলা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দমটা লটকে গলায় এসে পড়েছিল। সে এখান থেকে যাবে না। তন্নীর মা তার মাকে বলে দিয়েছে তন্নীর সাথে সাথে থাকতে। কিন্তু বুড়ি যে হুমকি দিয়েছে!
তন্নী একটা শাড়ি পড়েছে। গোলাপী তাঁতের শাড়ি। মাথার মাঝ বরাবর একটা লম্বা সিঁথি। পেছনে চুল খোঁপা করা। মুখে বেশি সাজ নেই। একটু ফেয়ার এন্ড লাভলী আর চোখে একটু কাজল। ঠোঁটে সামান্য গোলাপী লিপস্টিক। নুরজাহান কানের পেছনে কালি লাগিয়ে দিলেন। এতো সুন্দর মেয়েটা। প্রতিদিন সম্বন্ধ আসে এখান-ওখান থেকে। এবারে বিয়েটা হয়েই যাবে। ফোলা ফোলা গালগুলো রোদে পড়লে লাল টকটকে হয়ে যায়। তন্নী এখন বসে আছে। একদম চুপচাপ। মেয়েটা কথা ছাড়া থাকতে পারে না একদন্ড। আজকে পেট ফুলে যাচ্ছে। সে উদাস চোখে দিঘীর জলে তাকিয়ে রইলো। বিয়ে হয়ে গেলে পুকুরটার কথা খুব মনে পড়বে। শুনেছে, জামাইয়ের বাড়িতে পুকুর নেই। হালকা পাতলা শহরের মতো। তন্নীর ভাষ্যমতে, কিশোরগঞ্জ শহরই।
বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। নুরজাহান বেগম বের হয়ে গেলেন। তন্নীর হাঁসফাঁস লাগছে। গরম লাগছে হুট করে। পাশে শিলা বসে আছে। সে কোনো কথা বলবে না। আবার কি না কি হয়? পাত্রের বাড়ি থেকে পাঁচজন এসেছে। পাত্র, পাত্রের মা, বাবা, মামা আর একটা বোন। আসমা বেগম তাড়াতাড়ি পায়ে ঘরে ঢুকলেন। পাত্রের বাড়ির সবাই আগে মেয়ে দেখবে। খাওয়া দাওয়া তারপর। তিনি মেয়েকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। উনি কাছে এসে খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে বললেন,
“ আম্মা! ওখানে গিয়ে কোনো কথা বলিস না। বেশি কথা বললে ছেলে তোকে পছন্দ করবে না। ”
তন্নী আশ্বাস দিল, “ আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। ”
শিলা বিড়বিড় করে বললো, “ ভুতের মুখে রাম নাম। ”
বসার ঘরের সোফায় অতিথি বসেছে। আসমার এক ভাই এসেছে এখানে। মইনুল ইসলামের ভাই নেই। তাছাড়াও এলাকার দুইজন মুরুব্বি। দরজার আড়ালে আসমা দাঁড়িয়েছেন। উনি ভেতরে যেতে পারবেন না। নুরজাহান একটা বড় করে ঘোমটা দিলেন তন্নীর মাথায়। সেটা বুক পর্যন্ত এসে থেমেছে। কিছু দেখা যায় না। উনি বললেন,
“ কারো চোখে মুখে তাকাবি না। নিচের দিকে চোখ রাখবি! ”
তন্নী আজকে রোবটের মতো সব কথা মেনে নিচ্ছে। পৃথিবীর বুকে আজকে জোৎস্নার মতো আশ্চর্য নেমেছে। আর এই আশ্চর্য কতক্ষন থাকবে তা বলা মুশকিল। সে বললো, “ আচ্ছা! ”
এদিকে তার শরীর কাঁপছে থরথরিয়ে। ওকে এনে বসানো হলো একটা চেয়ারে। পাশে নুরজাহান দাঁড়িয়েছেন কাঁধে হাত রেখে। তন্নী কিছু দেখতে পারছে না। মোটা শাড়ি। কিন্তু নিচ দিয়ে সব দেখা যায়। সে দেখলো তার বরাবর সামনে দুটি পা। কালো বুট পড়া দুটি পা। আবার কালো প্যান্ট পড়েছে। তন্নীর বুক কাঁপছে। মোটা ধান গাছের মাথায় বাতাস লাগলে গাছটা যেভাবে দোলে, ঠিক সেভাবে ওর পা কাঁপছে। নুরজাহান ঘোমটা তুললেন। মেয়েটা নিচে তাকিয়ে। তারপর ওর মুখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হলো। তন্নী স্পষ্ট টের পাচ্ছে সামনের পুরুষটা ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। একটা হাত থুতনিতে রেখে আঙুল বুলাচ্ছে থুতনিতে। ভীষণ দাম্ভিকতার সহীত। তারপর আবারো ঘোমটা টেনে দেওয়া হলো। ওর পাশে একটা মহিলা বসেছেন। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ তোমার নাম কি, মা? ”
কত শুদ্ধ ভাষা! বাপ রে! তন্নী জবাব দেয় না। সে ভীষণ বাধ্য মেয়ে। মায়ের কথা অমান্য করার প্রশ্নই আসে না। উনি আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন। আসমা বেগম মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে। পাত্রের মামা অতিষ্ঠ হয়ে বললেন,
“ মেয়ে বোবা নাকি? ”
তন্নীর মামা উত্তর দিলেন,
“ বোবা হলে কান কেটে ফেলে দেব! ”
উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো শুধু একজন ছাড়া। আঠাশ বছর বয়সী যুবকটা বাদে। পাত্রের মা আবারও বললেন,
“ কথা বলছো না কেনো? ”
নুরজাহান কাঁধে চিমটি দিলেন। হাসিমুখে বললেন,
“ বল দাদু! ”
তন্নী রাখঢাক রাখলো না। বলে বসলো,
“ আমার আম্মা না করেছে কথা বলার জন্য! ”
আসমা বেগম ঠাস করে কপাল চাপড়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিলেন। নুরজাহান কাঁধে আরেকটা চিমটি কাটলেন। ছেলেটা এদিকে তাকিয়ে। সরাসরি চিমটি দেওয়া হাতটাও দেখলো সে। তারপর নুরজাহানের মুখে তাকালো চোখ তুলে। বুড়ি থতমত খেল। হাত সরিয়ে নিল। বিয়ে তো এখনো হয় নি। এই ছেলে এভাবে তাকায় কেনো? বাকীরা আরেকটু হেসে শান্ত হলো। পাত্রের মামা বললেন,
“ বোকা কিন্তু বোবা না। ”
আরেকজন বললেন,
“ একটু দাঁড়াও মা। চুলগুলো দেখি! ”
নুরজাহান ওকে দাড় করালো। তারপর ঘোমটায় হাত রাখলো। তন্নীর ভালো লাগছে না। চুলগুলো বহু কষ্টে বেঁধেছে সে। এখন আবার খুলবে? সমস্ত আয়োজন শেষ। ঘোমটা টা কপাল পর্যন্ত উঠে গেল। তার মধ্যেই একটা হাড় হিম করা, শীতল, গম্ভীর কন্ঠে এসে ওর কর্নকুহরের লাগলো,
“ চুল দেখতে হবে না। আমার বউয়ের চুল আমি ব্যতিত অন্য কেউ দেখুক সেটা আমি চাইছি না! ”
তন্নীর সারা শরীর বেয়ে স্রোত বয়ে গেল। সে দুই হাতে খামচে ধরলো শাড়িটা। পুরুষের গলা এতো ভয়ানক কেনো? কি আছে তন্নীর কপালে?
চলবে….