আমার বধু পর্ব-০৩

0
1

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_০৩

একদিন হুট করে পাত্রের বাড়ি থেকে কল এলো। মইনুল ইসলাম বেশ সচেতন লোক। গ্রামের মোড়ে মোড়ে ওনার সম্মান। চিন্তাভাবনা বেশ উন্নত ওনার। তন্নী ওনার মেয়ে। আর ঘরের মেয়ে হলো লক্ষী। সম্মানিত নারী। বাজারের কিংবা হাঁটের গরু নয় যে উনি খদ্দের ডেকে ডেকে মেয়েকে দেখাবেন। পাত্রের সবকিছু পছন্দ হয়েছিল বলেই তিনি দেখতে আসায় রাজি হয়েছিলেন। এক জায়গায় মেয়েকে দেখবে এবং সেখানেই বিয়ে হবে। ঘরের রাজকন্যা হাতের পুতুল না। এতে ওনার মেয়ের সম্মান ক্ষুন্ন হবে। হঠাৎ তাই কলটা দেখে তিনি বিচলিত হলেন। গম্ভীর মুখটা চিন্তায় ফ্যাকাশে হয়ে এলো। তিনি কল কানে তুলে সালাম টানলেন বড় গলায়,

“ আসসালামুয়ালাইকুম! ”

তৃনয়ের বাবা নিয়াজ মোর্শেদ সিদ্দিকী। তিনি সালামের জবাব নিয়ে বেশ ফুর্ত কন্ঠে বললেন,

“ আপনি বেয়াইন এখনো আসার দিন তারিখ বললেন না। আমি তো বিপদে পড়লাম। ছেলের পছন্দ হয়েছে‌। আমার ছেলেটা একটু একরোখা। একবার মেয়ে দেখতে গেছে। সেখানেই বিয়ে করবে। ঘুরা ঘুরি ওর পছন্দ না। আপনারা আসার একটা তারিখ বলুন! ”

মইনুল বড় করে শ্বাস ছাড়লেন। এতক্ষণ ওনার দমটা আটকে ছিল গলাতে। দুই পাশে ওনার দুইজন দাঁড়িয়েছে। আসমা আর নুরজাহান। মইনুল হেসে উত্তর দিলেন,

“ আমরা সামনের মাসের এক তারিখে আসি? আর তো তিনদিন! ”

নিয়াজ মোর্শেদ মেনে নিলেন,

“ আচ্ছা আচ্ছা। ”

নুরজাহান ফোনের সাথে কান লাগিয়ে রেখেছেন। অভ্যাসবশত। কুটনামী করতে হবে না? তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন,

“ পোলা কই জিগা! ”

মইনুল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“ তৃনয় বাবা কোথায়? ”

“ এখানেই। কথা বলবেন? ”

বলতে বলতে তিনি ফোনটা তৃনয়ের হাতে দিলেন। নুরজাহান খপ করে এদিকের ফোনটা টেনে নিলেন। কানে নিয়ে বললেন,

“ আসসালামুয়ালাইকুম বাবা…. ”

কথাটা অর্ধসমাপ্ত রইলো। ওপাশের কাঠকাঠ কন্ঠটা জানালো,

“ আমি তৃনয়! ”

“ ওও মাঙ্গের নাতী তুমি? ভালা আছো? ”

“ ভালো না থাকলে ঔষধ নিয়ে আসবে? ”

নুরজাহান ফুঁসে উঠলেন, “ সবসময় ত্যাড়া কথা কস ক্যান বাপ! তোর কাছে তো নাতী দিমু না। ”

তৃনয় বললো, “ তুমি আছো না? সংসারের অভিজ্ঞতা আছে। আমার চলবে! ”

তিনি পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসলেন। টিপ্পনী কাটলেন,

“ সবকিছু চলবো না! আমি পুরান! ”

তৃনয় আর সামলাতে পারলো না। সে হুট করে কেশে উঠলো। বুড়ো লোকদের সাথে কথা বলার সবথেকে বড় ঝামেলা হলো, এরা উল্টাপাল্টা ইঙ্গিতে কথা বেশি বলে। দশটা কথা বললে সেখানে আটটাই হবে ভেতরের গল্প। সে নিজের হতভম্ব ভাব প্রকাশ করলো না। জিজ্ঞেস করলো,

“ তোমার নাতী কোথায়? ”

“ আমার কোলে‌। বিয়ের পরে তো তুই-ই নিবি…. ”

তৃনয় সাথে সাথে উত্তর দিল, “ রাখছি রাখছি। অযু করতে হবে আমার। ”

নুরজাহান ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বোকার মতো চেয়ে রইলেন। আঙুলের সমান ছেলে ওনার সাথে কথা বলতে চাইছে না? এতো বড় অপমান? উনি সইবেন না। আরেকবার এলে রজুদের বাড়ির লাল গাভীর গোবর দিয়ে শরবত খাওয়াবেন। এই ওনার প্রতিজ্ঞা। খাটটা সাক্ষী থাকলো।

***
মাসের তিনদিন শেষ। সময় ঘনিয়ে এসেছে ওখানে যাওয়ার। এর ভেতরে আর কোনো কথাবার্তা হয় নি। আজ এক তারিখ। এখান থেকে মোট বারোজন পাত্রের বাড়িতে গেছে পাকা কথা বলার জন্য। তন্নীর সেসব নিয়ে মোটেও মাথা ব্যথা নেই। একটা মাথা। অতকিছু ভাবার সময় কোথায়? ভীষণ গরম পড়েছে। পাত্রের বাড়িতে সবার আদর আপ্যায়ন করা হলো। দোতলা বাড়িটায় মোট বারোটা রুম। তৃনয়ের রুম উপরে‌। ওটা বিশাল বড়। তন্নীর মামাতো ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। ঘরের মধ্যে সবকিছু আছে। কিছু দিতে হবে না। অবশ্য তৃনয়কে দেখে যতটুকু বোঝা গেল, সে এসব নেবেও না। চোখমুখেই ঘাড়ত্যরা ভাব স্পষ্ট। বাড়ির ভেতরের ড্রয়িংরুম টাও বিশাল। পাশে রান্নাঘর। এককথায় সবার পছন্দ হলো। কথাবার্তা শুরু হলো দেওয়া নেওয়া নিয়ে। মইনুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলেন,

“ আপনারা কিছু চাইছেন? আমার দুটো মেয়েই। আর এটা যেহেতু প্রথম। আমার কোনো আপত্তি নেই। ”

তৃনয়ের বাবা কিছু বললেন না। বলবে তৃনয় নিজেই‌। সে জিজ্ঞেস করলো,

“ চাওয়া বলতে? ”

“ মানে ঘরের কোনো জিনিসপত্র…. ”

ওনার কথা শেষ হলো না। তার আগেই তৃনয় ভীষণ দৃঢ় বাক্য গুলো আওড়াল,

“ আমার ঘরে সব আছে। না থাকলেও নিজের স্ত্রীর যাবতীয় জিনিসপত্র এনে দেওয়ার সামর্থ্য আছে। আমাকে ছোটলোক প্রমাণ করবেন না। আপনার বাড়ির জিনিস আমার স্ত্রী ব্যবহার করবে বিষয়টা আমার কাছে দৃষ্টিকটু। ”

সকলে বেশ মুগ্ধ হলো‌। প্রশংসাও করলো। মইনুল একটা জামাই খুঁজেছে। কথাবার্তায় রত্ন। শিক্ষিত। এখনের যুগে এমন ছেলে পাওয়া যায়? ওদের গ্রামের একটা মেয়েকেও কিছু ছাড়া তুলে দেওয়া যায় নি। অন্তত খাট, আলমারি, তোশক, ডাইনিং টেবিল এগুলো তো দিতে হয়। তৃনয় কিছু নেবে না। সে বিয়ের আগেই বাবা মাকে জানিয়েছে, “ কিছু নিয়ে বিয়ে করাতে চাইলে তোমার আব্বু কে কবর থেকে তুলে এনে করাও। আমার পক্ষে সম্ভব না। ” তৃনয়ের ফুফুটা একটু অন্যরকম। উনি রেগে আছেন। আরে বাবা কিছু দিলে তো মেয়েরই থাকবে। ওনারা কি নিয়ে যাবেন নাকি? দৃষ্টিকটু? দৃষ্টিকটুর মানে বোঝে ছেলেটা? তারপর কথা হলো দেনমোহরের। তন্নী কে যাবতীয় গয়না এখনই দেয়া হবে। আপাতত এই বাড়ির জন্য সিদ্দীক পরিবারের একমাত্র বউ সে। কোনোকিছুর অভাব নেই। গয়না গাটি সব তৃনয়ের মা দেবেন। বউয়ের জন্য শখ করে বানিয়েছেন তিনি। দেনমোহরের টাকা একলাখ দশ। এটা তৃনয় বিয়ের দিন দেবে। ব্যাস। কথাবার্তা সেখানেই শেষ। এবারে বিয়ের তারিখ। তারিখটাও ছেলে পছন্দ করবে। তৃনয় বললো,

“ আপনার মেয়ের হাতে ফোন আছে? ”

তন্নীর মামাতো ভাই আরাফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “ কেনো? ”

তৃনয় বেশ শান্তস্বরে বললো,

“ আমি কথা বলতে চাইছি। ওর মতামত নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ে জীবনে একবারই হয়। ”

তন্নীর হাতে ফোন নেই। ফোন তো কারোর হাতেই নেই। একটা ফোন আসমার হাতে, আরেকটা মইনুলের হাতে। তাও বাটন ফোন। স্মার্টফোনের প্রচলন এদিকটায় এখনো আসে নি। তিনি আসমার ফোনেই কল দিলেন। ছেলে বলেছে‌। এখানে আর কথা নেই। রিসিভ হলে বললেন,

“ তন্নী রে একটু দাও। ছেলে কথা বলবে। ”

আসমা আশেপাশে তাকালেন। তন্নী ঘাটপাড়ে আছে। তিনি এগিয়ে যেতে যেতে সচেতন কন্ঠে ফিসফিস করলেন,

“ ছেলে সেদিনও মেয়ের সাথে আলাদা কথা বললো। আজকেও। মানুষ জানলে কি বলবে? ”

“ আরে শহরের ছেলে। ওরা গ্রাম সম্পর্কে জানে? বাদ দাও। মেয়ে কোথায়? ”

“ আপনার মেয়ে গাছে। দাঁড়ান। ”

উনি ফোনটা হাতে চেপে ডাকলেন,

“ তন্নীইই! কিরে তন্নী? ”

তন্নী আমগাছের পাতা সরিয়ে উঁকি দিল, “ বলো! ”

উনি ধমকে উঠলেন মৃদু স্বরে,

“ ছেলে তোর সাথে কথা বলবে। নেমে আয়। ”

পুকুরের সিঁড়িতে বসে কাপড় কাচছেন নুরজাহান। উনি বুড়ো হলেও বেশ শৌখিন। শরীরে শক্তিও আছে। এখনো নিজের কাপড় নিজেই ধুয়ে দেন। তন্নী তড়িঘড়ি করে নামছে। নুরজাহান রোদের কারণে চোখ কুঁচকে বললেন,

“ ছেলে খালি মেয়ের সাথে কথা কইবার চায় ক্যান? ব্যাপারটা তো বুঝলাম না! ”

আসমা শাশুড়ির সামনে কিছু বললেন না। তন্নীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। নুরজাহান হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন। তন্নী গিয়ে সেখানে বসলো। কি ভীষণ অন্যরকম অনুভূতি। শরীরের অজানা কাঁপন। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। অপর পাশের কন্ঠটা ওকে জিজ্ঞেস করল,

“ আফরোজা? ”

তন্নী মৃদু স্বরে বলে,

“ জ্বি? ”

তারপর তৃনয় আর সময় নেয় না। বলে,

“ এখানে সবাই বিয়ের তারিখের জন্য বসে আছে। তুমি বলো একটা তারিখ। যেদিন তুমি চাইছো। ”

নুরজাহান হেসে উঠলেন। কারনটা তন্নী বুঝলো না বলেই বেশ আশ্চর্য হলো। তারপর উনি ফোনটা তন্নীর কান থেকে কেড়ে নিলেন। বললেন,

“ বুঝি বুঝি। সব বুঝি। লুচ্চামি ছাইড়া দেও। ঘরের গোলায় ধান থাকলে আস্তেধীরেও খাওয়া যায়। তাড়াতাড়ি খাইলে তাড়াতাড়ি শেষ। ”

তন্নী মুখ বিকৃত করলো। কি বলছে বুড়ি? অপরপাশের তৃনয় বুঝতে পারলো। খাইস্টা বুড়ি। ওর জীবনটা তামা তামা করবে। সে বললো,

“ আমার ধান। আমার গোলা। আমি একদিনে খাই কিংবা দশদিনে। তোমার কি? ”

“ ভালো হ, ভালো হ। তুই খালি আমার নাতীর সাথে কথা কইবার চাস ক্যান? ”

“ তোমার নাতী আমাকে একদিনেই কালো জাদু করেছে। রাতে স্বপ্নে দেখলাম। ”

“ স্বপ্নে কি দেখলি? ”

“ বুড়ি শুধু অন্যদিকে যাও কেনো? বুড়োর কথা মনে পড়ে নাকি? আমাকে বুড়োর জায়গায় বসাচ্ছো কেনো? আমি তোমার প্রতি আগ্রহী নই! ”

নুরজাহান হায় হায় করে উঠলেন। মরা স্বামী নিয়ে এমন কথা শোনাও পাপ। ওনার লাগাম ছাড়া মুখটা আরেকটু ছুটে গেল,

“ তোরা বেডা জাত আজীবন লুইচ্চা। রাখ রাখ। বালের পোলাপান। ”

তন্নী দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরলো। ছিঃ ছিঃ। ওর মান ইজ্জত আর রইলো না। ও খোদা! তুমি মাটি ফাঁক করো। তন্নী ঢুকে যাক। নুরজাহান ফোনটা ওকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তন্নী হাঁসফাঁস করে উঠলো,

“ আসলে..ওই… দাদী একটু…. ”

তৃনয় থামিয়ে দিল, “ বাদ দাও। যেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম সেটার উত্তর দাও। ”

তন্নী জোরে জোরে কথা বলছে। পানিতে পা দিয়ে ঢেউ তুলছে,

“ বড়রা যা বলে তাই। ”

“ তাহলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম? ”

তন্নী অনেকক্ষণ ভাবলো‌। লোকটা এমন কেনো? মেয়েদেরকে বুঝি লজ্জা পেতে নেই? এমন বিরাট ভরা গলার কন্ঠস্বর শুনেই তো তার ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। গালগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর একঘরে থাকবে কিভাবে? এ আল্লাহ! তুমি একটু রহম করো। তন্নীর মনে জোর দাও। তার হঠাৎ মনে পড়লো কয়েকদিন বাদে ওর জন্মদিন। সে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো,

“ এই মাসের দশ তারিখ আমার সতেরো বছর হবে। জন্মদিন। সেদিন রাখলে ভালো হবে। ”

“ সতেরো বছর হলে বিয়ে পড়বে কিভাবে? ”

তন্নী বুঝতে পারলো। উৎফুল্ল গলাটা একটু চুপসে গেল,

“ আরে চিন্তা নেই। জন্মনিবন্ধনে আমার একবছর বাড়িয়ে দেওয়া। কত মেয়ের এভাবে বিয়ে হয়। ”

তৃনয় মেনে নিল‌। সবাইকে কথাটা জানালো। তন্নীর ভালোলাগা আরো বাড়ে। কি সুন্দর ওর মতামত নিল। ইশশ!
অতঃপর ওদের বিয়ের তারিখ দশ তারিখে রাখা হলো। সুন্দর একটা তারিখ। অক্টোবরের দশ তারিখ। ২০১০ সাল।

***
বিয়ে ঠিক হওয়ায় পর থেকে তন্নী চিন্তায় পড়েছে ভীষণ। তার আবার চিন্তা না করলে রাতে ঘুম হয় না। জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় ঘুমখানা না হলে দুঃখে মরে যাওয়া ভালো। তাই চিন্তা করা ওর রোগ। জাতীয় রোগ। সেটা সারাদিন ভেবে ভেবে একে ওকে জিজ্ঞেস করে নির্মুল করার আগ পর্যন্ত তার মাথার তার সোজা হয় না। লোকে ওকে এমনি এমনি পাগল ডাকে না। কিছুটা তো আছে। মাথার ছিট। আজকের চিন্তার কারণ টা হলো, নতুন সম্বোধন। তন্নীর স্বভাব সে কাউকে আপনি বলতে পারে না। প্রথম দিকেই কিংবা এক দেখাতেই সবাইকে তুমি করে ডাকা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। তুমি ডাকটা সহজ। মারপ্যাঁচ নেই, ঘুরানো, প্যাঁচানো ঝামেলা নেই। ঝামেলা হলো আপনিতে। এত কঠিন ডাক জীবনে আর কিছু হয় না। তন্নীর জিভ কখনো তুমি ডাকে আটকায় না। কিন্তু ওই বাড়ির সবাই ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন। আর তাদের ছোট গ্রামের সবাই শ্বশুর বাড়ির কুকুরকেও আপনি বলে ডাকে। ননদ এবং দেবরকেও। বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও। এটা দিয়ে নাকি আলাদাভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তন্নী অবশ্যই কাউকে অসম্মান করবে না! সে প্রথমে গেল নুরজাহানের কক্ষে। কেবল তৃনয়ের সাথে কথা বলা বাদে হবু নববধূর কোনো চিহ্ন পর্যন্ত তার মধ্যে দেখা যায় না। সে চেঁচিয়ে উঠলো,

“ সুন্দরী? ও সুন্দরী? ”

নুরজাহান বিছানায় বসে পান সাজাচ্ছেন। উনি তন্নী কে এগিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন নিজেও,

“ সতীনের সতীন রে। মা*গী দুইদিন পর তোর বিয়া হইবো। একটু তো শরম রাখ। বেহায়া। ”

এক দেশের গালি; আরেক দেশের বুলি! নুরজাহানের স্বভাব। এই একটা বিশ্রী গালি না দিলে ওনার শান্তি লাগে না। তন্নী এসে বিছানায় বসলো। একটা পান হাতে তুলে সেটা শুঁকেই মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় পড়ে গেল। চোখমুখ উল্টে এলো। শুধু একটু ঘ্রানেই। নুরজাহান দেখছেন সবটা। তন্নী হাত পা ছেড়ে দিল,

“ সতীন ডাকবা না। আমার জামাইয়ের এক ভাগও তোমারে দেব না। ”

“ পানের গন্ধেই অজ্ঞান হয়ে যাও? বাসর ঘরে পান খাইবা ক্যামনে? ”

তন্নী লাফিয়ে উঠে বসলো, “ পান খেতে হয়? ”

“ জ্বে! ”

“ আমি খাব না। ”

নুরজাহান মুখের রস ফেলে দিয়ে ঠোঁট বাকালেন,

“ জামাইরে বলিস। ”

তন্নী আবারও কতক্ষন চুপচাপ ভাবতে বসলো। তারপর মাথা নামিয়ে নিল নিচে। পান একটা মারাত্মক জিনিস। গন্ধ শুঁকেই তার বুকের শ্বাস থেমে যায়। খাবে কিভাবে? আচ্ছা থাক। সেসব অনেক দুরের ব্যাপার। আপাতত যেটার জন্য এসেছে সেটা সমাধান হোক। সে জিজ্ঞেস করলো,

“ বুড়ি? তুমি দাদাকে কি ডাকতে? ”

নুরজাহান সদ্য ষোড়শীর ন্যায় লজ্জা পেলেন। মাথাটা নামিয়ে মিনমিন করে বললেন,

“ বুইড়া! ”

তন্নী রেগে গেল কথা শুনে, “ আরে বা*ল। এটা বলি নি। আপনি করে বলতে নাকি তুমি করে?

ওনার লজ্জা শেষ‌। তিনি সব ভুলে হতভম্ব হয়ে আওড়ালো,

“ মুখের ভাষা ঠিক কর, মা*গী। ”

বিষয়টা এমন হলো, এক চোর আরেক চোরকে বলছে, চুরি করিস না। অবশ্য তন্নী কখনো খারাপ ভাষা বলে না। আজকে বের হয়ে গেছে‌। ওটা আর ফেরত নেওয়া যাবে না। সে মনে মনে তওবা করলো। তারপর মুখ ভেঙচি কাটলো,

“ ওরে ফেরেশতা আমার। যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও। ”

“ শ্বশুর বাড়ির সবাইকে আপনি করেই ডাকতে হয়, বলদি। আমি তোর দাদার নয় বছরের ছোট ভাইকেও আপনি ডাকতাম। ভাইজান ডাকতাম। ”

“ অতো ছোট ছেলেকে? ” তন্নীর গলায় আশ্চর্যতা।

নুরজাহান বললেন,

“ হ্যাঁ। তোর দাদারেও আপনি বলেই ডাকতাম। সাথের বাড়িতে পাড়া প্রতিবেশীর এক ননদ ছিল। ছয় বছর বয়স। ওই মরিচের মতো পিচ্চি কে পর্যন্ত আফা ডাকতাম। বলতাম, আপা আসেন। ”

“ ধুর! ” বলেই তন্নী সেখান থেকে চলে এলো। তার মাও আজীবন বাবাকে আপনি বলেই ডাকে। বাকী আছে এখন শিলা। তন্নী ডাকে, ”মোহনা? ”
মোহনা এসে একবাক্যে হাজির। ও আদেশ করলো,

“ শিলা কে গিয়ে বলবি আপা ডাকে। যাহ। ”

শিলা এলো আরো পঁচিশ মিনিট পর। তখন তন্নীর মুড চলে গেছে। রাগ এসে পড়েছে গায়ের আনাতে কানাচে। ওরা দুজন মিলে বসলো বিশাল জাম্বুরা গাছের শিকড়ে। বিশাল লম্বা লম্বা শিকড় গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আশপাশ পর্যন্ত। শিলা জিজ্ঞেস করে,

“ ডাকলি কেনো? ”

তন্নী প্রশ্ন করলো উল্টে,

“ তোদের তো বাগদান শেষ। তুই তোর জামাইরে কি বলে ডাকিস? ”

বিনিময়ে শিলাও হঠাৎ লজ্জা পায়। মুখটা নামিয়ে নিতেই তন্নী খাবলে ধরলো। চোখ কুঁচকে বললো,

“ লজ্জা পরে। আগে বল আপনি না তুমি? ”

শিলা ভেঙচি কাটলো।

“ এটা আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? আপনি করে ডাকি। শোন, আপনি ডাকে সম্মান বেশি। ”

“ তাহলে কি তুমি ডাকে ভালোবাসা বেশি? ”

শিলা নিজেও উত্তর জানে না। ওরা মুলত ঠিকঠাক কথাবার্তাই জানে না। তন্নী ঠিক করলো, সে ওর বরকে জিজ্ঞেস করবে। তাহলেই হবে। ওনার অনেক বয়স। নিশ্চয়ই সব জানেন। তন্নী শিলার কাঁধে মাথা রাখলো। তৃনয়ের কথা ভাবতেই লজ্জা লজ্জা লাগছে। ইশশ! কেমন অদ্ভুত অনুভূতি। সদ্য জন্মানো কচুরিপানার মতো তার অনুভূতি হাওয়ায় দোল খায়। তারপর বাতাসের তালে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের আনাচে কানাচে। বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয় বুকটায়। হুটহাট থেমে যায় সেটা। তন্নী হাসে। আস্তে করে বলে,

“ আমার হবু জামাইটা খুব সুন্দর। না রে শিলা? ”

জাম্বুরা গাছের মগডালে বসে থাকা শালিক টা জানায়, “ হ্যাঁ। তোর চোখে তোর জামাই আজীবন সুদর্শন থাকুক। তোদের একটা সুখ দুঃখের সংসার হোক। ”
তারপর দিঘির শান্ত জলের উপর বিশাল একটা কাঁঠাল পাতা পড়লে সেখানে ঢেউ ওঠে। সেই খেলানো ঢেউ সারা দিঘী জুড়ে ছড়িয়ে যায়। তন্নীর ভালোলাগার মতো। বিয়ে কথাটায় এতো মাধুর্য্য কেনো? কেনো এতো ভালোলাগা? কেউ সেখানে মধু মাখিয়েছে বুঝি? নাকি অপরিচিত দুটো আত্মা এক হয় বলেই এতো মিষ্টতা সেখানে?

চলবে…..!