#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_০৪
বিয়ের বাকী মাত্র দশদিন। মইনুল ইসলাম বিরাট বড় করে অনুষ্ঠান করবেন। প্রথম মেয়ে ওনার। ভীষণ শখের, অতি আদরের। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা। পুকুরের পাড়েও বেশ খালি জমিন পড়ে আছে। সেখানের একজায়গায় স্টেজ করা হবে। আসমার ইচ্ছে ওনার মেয়ের বিয়েতে ছবি তোলা হবে। মইনুল ইসলাম তাই বাজারের একজন ফটোগ্রাফার কে বলে রেখেছেন। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হবে। তিনি এখন এখানে সেখানে দাওয়াত করছেন। গ্রামের মুরুব্বিদের সাথেও তো আলোচনা আছে। বিয়েতে তন্নীর খালাতো ভাইবোন, ফুফাতো আর মামাতো ভাই-বোন নাচবে। ওরা আসবে গায়ে হলুদের আগের দিন। মার্কেটে যাওয়া দরকার। কিন্তু তন্নী আজ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ সেভাবে যায় নি। গিয়েছে, কিন্তু মার্কেট করতে যায় নি। এখন তো আরও যেতে পারবে না। কেউ দেখে ফেললে ওখানের? বলবে, নতুন বউ বাজারে এসেছে। মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। আসমা কল দিয়েছেন নিজের ভাইয়ের বউদের কে।
ওরাই করুক গায়ে হলুদের মার্কেট। কিন্তু বেঁকে বসেছে তন্নী। সে যাবে। তার গায়ে হলুদের শাড়ি, গয়না সে নিজ হাতে কিনবে। বিয়েটা তো তার। তৃনয় বলেছে, সব তোমার ইচ্ছে মতোই হবে। এখানে আর কোনো কথা আছে? উঠোনে সবাই বসা। তন্নীর বোন মোহনা পাথরের গুটি দিয়ে খেলছে। আসমা বেগম তরকারি কুটছেন। নুরজাহান বসে বসে কুলোর চাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। শিলা আর তন্নী বয়ামের আচার খাচ্ছে। তার বায়না শুনে নুরজাহান মুখ বাকালেন,
“ এমনিতেই নাচুনে বুড়ি। আরো দেও ঢোলের বারি। জামাইটা বুঝছে না। নইলে তোরে মাথায় তুলতো না লো! ”
তন্নী আচার খাওয়া রেখে ক্ষিপ্ত চোখে তাকালো,
“ বিয়া আমার। জামাই আমার। তোমার অতো মাথা ব্যথা কেনো? আমিই যাবো! ”
“ জীবনে দেখছস কোনো বউ নিজের গায়ে হলুদের মার্কেট নিজে করে? এই গেরামের কেউ গেছে আইজ পয্যন্ত? ”
“ কেউ না যাক। আমি যাবো। যেতে না দিলে বিয়ের দিন লুকিয়ে বসে থাকবো। ”
বাকীরা নিরব স্রোতা সেজেছে। তন্নী ভীষন জেদি ছোট থেকে। যা বলে তাই! আসমা রেগে যাচ্ছেন। বিয়ে ঠিক হলে মেয়েরা বাড়ি থেকে বের হয় না। মেয়েটা কেনো বুঝতে চাইছে না? তিনি হাতের টমেটো টা রেখে দিলেন। মুখ ঘুরিয়ে বসলেন ওর দিকে। একপাশে বসে খাতায় মেহমানদের নাম লিখছেন মইনুল।
“ তন্নী শোন। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে মেয়েদেরকে বাড়ি থেকে বের হতে হয় না। আর তুই যে ওখানে যাবি? জামাইয়ের বাড়ির সবার আনাগোনা কিশোরগঞ্জ জুড়ে। তোকে দেখে ফেললে? ”
তন্নী একবাক্যে বললো,
“ বোরকা পড়ে যাবো। দেখলেও চিনবে না। ”
মইনুল কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন,
“ আহ। তন্নীর মা রাখো এসব। তুই যা মা। তোর বড় মামীকে আর শিলাকে নিয়ে যা। আম্মা যাবে? ”
নুরজাহান উত্তর দেওয়ার আগেই তন্নী ফুঁসে উঠলো,
“ তোমার মাকে নেব না। বুড়ি বজ্জাত। সব লন্ডভন্ড করে দেবে। ”
“ তোর সাথে যাওয়ার জন্য আমি কানতাছি নাকি? যা যা। বিয়ে আমারো হইছিল। ”
নুরজাহান বেগম বেশ অভিনয় জানেন। না যাক। করুক অভিনয়। তন্নী সেখান থেকে উঠে পড়লো। শিলার হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে নিলেন। ফুঁপিয়ে উঠলেন,
“ আমার কি কেউ আছে? আমার কেউ নাই। ”
তন্নী জায়গায় থেমে গেল। ভীষণ দুরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ওর মুখটা চমকালো। কাঁদছে কেনো? মইনুল আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কাঁদো কেন, আম্মা? ”
“ পঞ্চাশটা বছরের বেশি হইছে সংসার করি। তোর বাপ কোনোদিন কোনো খানে নিয়ে যায় নাই। তুইও যাস নাই। আজকে বললি একটু, আর তোর মাইয়া আমাকে দেখতেই পারে না। ”
তন্নী এগিয়ে এলো। বুঝেছে ব্যাপারটা। মহিলার ইগো আছে। বাপ গো। সে কেটে রাখা একটা টমেটোর কুঁচি মুখে নিয়ে বললো,
“ কাঁদো কেনো? বললেই তো হয়, আমিও যাবো। ”
“ তুই কথা কইস না মা*গী! একটা শ*য়তান পয়দা করছে আমার বউয়ে। ”
আসমা আড়ালে ভেঙচি কাটলেন। এত খাইস্টা মানুষ হয়? তাও বয়স্ক? মইনুল মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর কাছে ডাকলেন। তন্নী গিয়ে বসলো। উনি কানের কাছে ফিসফিস করলেন,
“ বয়স্ক মানুষ, আম্মা। কোনোদিন মার্কেট যায় নি। তোকে কিন্তু আদর করে, তন্নী। যা একটু নিয়ে। আম্মা মন খারাপ করলে তোর বিয়েতে আমি শান্তি পাবো না। ”
তন্নীর নাকের পাটা ফুলে উঠলো রাগে। কেঁদে মামলা জিতে ফেলেছে। সে উঠে দাড়িয়ে নুরজাহানের কাছে এলো,
“ আচ্ছা যাবো নিয়ে। যেভাবে যাওয়ার ভাগ চাইলে সেভাবে বিয়ের পর আমার জামাইয়ের ভাগ চাইবে না। ”
নুরজাহান মুখ ঝামটা মেরে উত্তর করলেন,
“ দুনিয়াতে তোরই একটা জামাই হবে। তোর জামাইয়ের শা*উয়ার আদর তুই-ই খা। আমি আদর খাইছি। কি সোহাগী গো! ”
“ তুমি কথায় কথায় মুখ খারাপ করো কেনো? ”
“ তুমি অতো পু**কি পোড়া আলাপ করো কেনো? ”
শিলা ওকে টেনে নিল,
“ ছিঃ ছিঃ রে তন্নী। আয় আয়। তোর দাদীর মুখ বেরিং পাগলার মতো। চালু হলে আর থামে না। আর কথা বলিস না। ”
তন্নী হাতটা ছাড়িয়ে নিল। শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
“ একবার বিয়ে হোক। তোমার সামনে জামাইয়ের আদর খাবো। দেখবা আর জ্বলবা। ”
নুরজাহান নিজেও বললেন,
“ যা যা। পাঠার মতোন চেহারা। আদর? আদর করবো আরও কত কি করবো। পিটিয়ে সোজা বানাবে তোর মতো পাগল রে। ”
আসমা বললেন,
“ আম্মা আপনি সবসময় ওর সাথে লেগে থাকেন। এত খুচাখচি করেন কেনো? ”
“ তুই আর কথা কইস না। তুই ছিলি এক পাগল। হইছে আরেক পাগল। ”
আসমা আর কথা বললেন না। যত বয়স হচ্ছে তত মতিছাড়া হচ্ছে। হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। যা মন চায় তাই বলে। তন্নীর তো মাঝেমধ্যে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। এত খারাপ, এত ভয়ঙ্কর মুখের ভাষা। তন্নীর মন চায় বধির হয়ে যেতে। তারপর ঘরদোর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে অদুরে। লোকে বলে, বোবার শত্রু নেই। তন্নীর মতে, বধিরের কোনো শত্রু নেই। না শুনলে জবাব দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। শুনলে তো আরো ঝামেলা। কিছু বলাও যায় না, সয়াও যায় না। তাই বধির হওয়া ভালো। শুনলাম না, বুঝলাম না, কিছু বললামও না।
***
তন্নীর হলুদ সন্ধ্যা। পেছনে বেশ বড় করে নাম টাঙানো হয়েছে। স্টেজে আগামীকাল বর বসবে। আজকে রাতটার জন্য এখানে সম্পন্ন হবে গায়ে হলুদ। সামনে অনেকটা উন্মুক্ত জায়গা। চারদিকে মাগরিবের আজান পড়ছে। বউকে সাজানো হচ্ছে। সেখানে শিলা আর তন্নীর কাজিন মহলের সবাই। তন্নীর ফুফাতো ভাই দুইজন। ফাহিম, ফয়সাল। একটা ফুফাতো বোন ফারজানা। ছোট ফুপির দুই মেয়ে। আনিকা, আকসা। মামাতো ভাই আরাফ, সাগর। দুটো বোন তমা, ঝুমা। আরো খালাতো বোনেরা আছে। ওরা বিয়ে খেয়েই সবাই চলে যাবে। সবগুলো শহরের বাসিন্দা। তাঁদের নাকি গ্রাম ভালো লাগে না। তন্নীর ভাষায় সবগুলো খেত। এরা কি বুঝবে গ্রামের সৌন্দর্য? বলদ ছেলেমেয়ে। তন্নী সাজপাগল। সে খুব সাজবে বিয়েতে। গায়ে হলুদের শাড়িটা ওর কলাপাতা রঙের। ছোট মামি বারবার বলেছেন, হলুদ শাড়ি নেওয়ার কথা। তন্নী নেবে না। বাকীরা নিক হলুদ শাড়ি। ওকে একটু অন্যরকম লাগতে হবে তো। সে নতুন বউ না? তাকে অবশ্যই সবার থেকে আলাদা লাগতে হবে। সাদা ফুটফুটে শরীরে কলাপাতা রঙের সুতির শাড়িটা দুর থেকে চকমক করছে। ফাহিম, ফয়সাল দুজনে গিয়ে লাল গোলাপ আর গাঁদা ফুল এনেছে। তমা সেগুলো দিয়ে মালা বানিয়েছে সুন্দর করে। কানে, গলায়, হাতে, মাথায় কাঁচা ফুলের গহনা। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। চোখ ভর্তি কালো কাজল। আনিকা শহরের জিনিসপত্র দিয়ে ওকে সাজিয়েছে। গালগুলো এমনিতেই লাল। সেখানে আরেকটু ব্লাশ মাখায় টুকটুক করছে। সারা ঘর উজ্জ্বল তন্নীর সাজের কারনে। যেই দেখছে সেই বারবার মাশাআল্লাহ বলছে। নুরজাহান দুর থেকেই নাতনীর হাসি মুখটা দেখলেন। তারপর চোখদুটো লুকিয়ে নিলেন আঁচলের তলায়। পুতুলটা ঘরে না থাকলে সারা বাড়ি আন্ধার হয়ে যাবে। কে খাবে গাছের ফলফাকর? তিনি সেখানে দাঁড়ান না। ওনাকে দেখলে তন্নী কেঁদে ফেলতে পারে। সাগরের হাতে স্মার্টফোন। সে এসে দাড়িয়ে বললো,
“ তোর একটা ছবি তুলি। ভালো হয়ে বোস। ”
মামাতো বোনেরা বিভিন্ন স্টাইল শিখিয়ে দিল। তন্নী হেঁসে হেসে ছবি তুললো। আয়নায় সে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃনয় দেখলে খুব খুশি হতো। তন্নী কে আজ সত্যি সত্যি সুন্দর লাগছে। অপরুপ চাঁদের রুপ তার। অঢেল সৌন্দর্য্য। টানা আঁখি, গোলাপী ঠোঁট, হালকা ফোলা ফোলা গাল। হরিনী ব্যাকুল নজর। চোখের পাপড়ি গুলো ঘন। বেশ লম্বা চুল। গ্রামের মেয়েদের আর যাই হোক, চুল লম্বা থাকে। ওকে বাইরে নিতে হবে। নিয়ম অনুসারে কনে বিয়ের আগের দিন থেকে নিজের ছায়ায় পা দিতে পারবে না। অর্থাৎ ওকে কোলে করে নিতে হবে। ছেলেদের মধ্যে সবথেকে বড় আরাফ। ওকে ডাকা হলো। আরাফ ঘরে এসে থমকে দাঁড়াল। তারপর বুকে হাত দিয়ে বললো,
“ তোকে পরীর মতো লাগছে, তন্নী। তৃনয় সিদ্দিকী তোকে এখন দেখলে নিশ্চিত মরে যেতো। ”
তন্নী বললো, “ তোমার কাছে তো ফোন আছে। ওনাকে একটা ভিডিও কল দাও। ”
সবাই হেসে ফেললো। সাগর জানালো, সে ছবি দিয়ে দেবে। ওখানেই দেখতে পারবে। আরাফ কোলে নেবে না। থাকুক গ্রামের নিয়ম। ছেলে হয়ে মেয়েকে কোলে নিবে কিভাবে? তার যুক্তির কাছে কারো কথা টিকলো না। তন্নী কে তাই হেঁটে হেঁটেই যেতে হলো। মেয়েরা মাথার উপর উড়না ধরেছে। লাল উড়না। তারপর সেখানে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ছবি তোলা হলো। বাকী সব মেয়েরা ভারী সাজগোজের সাথে হলুদ শাড়ি পড়েছে। ওদের গায়ে আর্টিফিশিয়াল ফুলের গয়না। সবাই তন্নীর সাথে বসে বসে ছবি তুললো। এবারে গায়ে হলুদের পালা। বড়রা একে একে ওকে হলুদ ছুঁইয়ে দিল। তন্নী বেশ হাসছে। সাদা গালগুলো হলুদের ছোঁয়ায় হলুদ হয়ে গেছে। মা বাবা যখন এলো তখন সব নিরব। আশেপাশে কোথাও নুরজাহান নেই। ওনাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখা যাচ্ছে না। তন্নী আসমা আর মইনুলের চেহারা দেখে কেঁদে ফেললো। সাজগোজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে বেশি কাঁদল না। সবকিছু থমথম করছে। ফয়সাল গিয়ে কোথা থেকে টেনে নুরজাহান কে নিয়ে এলো। উনি এসে দাঁড়িয়েই ছোটদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। বাকীরা স্তব্ধ হয়ে গেছে। সব উল্লাসে হঠাৎ বাঁধা পড়লো। আনন্দের রেশটা আর নেই। তন্নী শব্দ করে কেঁদে উঠলো নিজেও। দাদীকে কাছে ডাকলো দুই হাতে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তন্নী কে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ বু। আমার বুবু। তোরে ছাড়া আমি কেমনে থাকমু? ও মইনুল রে আমার পুতুল ডারে তুই আটকা। আমার পুতুল! ”
দুর থেকে জড়িয়ে রাখা দুজনকে কি ভীষণ সুন্দর দেখায়! লিখে বর্ননা করা যায় না। প্রচলিত একটা বহুল ব্যবহৃত বাক্য আছে, “ সন্তান হয় পেট থেকে। নাতি হয় কলিজার থেকে! ”
কি অপরুপ উপমা! তন্নীর শরীরটা ভীষণ কাঁপে। নুরজাহানের কান্না দেখে তার ভয় জাগে! বিয়ে কি এতটাই ভয়ের? কি আছে বিয়েতে? তন্নী আরো জোরে কাঁদল। কান্নার কারণে সে কথা বলতে পারছে না। কিন্তু তার হঠাৎ কেনো কান্না পাচ্ছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। বুকটা কেমন চিড়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। সে টেনেটুনে গয়না খুলে ফেলতে চাইলো। তার আগেই ওদেরকে আলাদা করে নিল সবাই। মেয়েটা ছটফট করছে একপ্রকার। নুরজাহান কে ঘরে নিয়ে এলো মহিলারা। তন্নীর কাজিনরা বললো,
“ কাঁদিস না তন্নী। তুই কাঁদলে আঙ্কেল আন্টিও তো কষ্ট পাবে। ”
তন্নী শান্ত হয়ে চোখের জল মুছে নিল। শিলা বসেছে পাশে। সেও কেঁদেছে। ও বান্ধবীর মাথাটা নিজের কাঁধে তুলে নিল। আবারও হৈচৈ শুরু হয়েছে। সবাই নাচবে এখন। প্রথমে মেয়েরা মিলে নাচলো। গান বাজলো,
“ লীলাবালী লীলাবালী বড় যুবতী সই গো,
বড় যুবতী সই গো।
কি দিয়া সাজাইমু তোরে। ”
তারপর হিন্দি গান ছেড়ে দেওয়া হলো। ছেলেরা মেয়েরা সবাই উল্লাস করে নাচলো। তন্নীরও নাচতে মন চাইলো। কিন্তু নববধূর নাচ দেখলে মুরুব্বিরা ছিঃ ছিঃ করবে। তাই সে স্টেজের উপরেই পা তুলে বাবু হয়ে বসে রইলো। অর্ধেক রাত পর্যন্ত নাচগান শেষ করে সবাই মেহেদী দিতে বসলো। তন্নীর দুই হাতের দুই পাশেই কনুই পর্যন্ত মেহেদী দেওয়া হলো। হাতের নখেও। আবার শিলা একটু পায়েও দিয়ে দিল। মইনুল ইসলাম দিঘীর পাড় হতে দেখলেন। গালে হলুদ মেখে, শাড়ি জড়িয়ে, গহনা পড়ে বিছানার মধ্যমনিতে চাঁদ বসে আছে। ওনার ঘরের চাঁদ। ছোট্ট মেয়েটা কয়েকদিনেই কেমন হুট করে বড় হয়ে গেল। সেদিনও বাড়ি জুড়ে ছোটাছুটি করেছে। দুদিন আগেও জামরুল গাছের মগডাল থেকে মা বকতে বকতে নামিয়েছেন। বছর আগেও পুতুল বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে মেয়েটা। মইনুল মার্কেট থেকে খুঁজে খুঁজে গোলাপী রঙের বড় পুতুল আনতেন। সেটা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়েটা আজকে জীবন্ত পুতুল সেজেছে। বুকটা ধুকপুক করে, ভীষণ ব্যথায় জর্জরিত হয়ে যায়। পুরুষ মানুষ কাঁদে না। কাঁদতে পারে না। উনি একবার ভাবলেন, বাড়িতে ঢুকতেই ‘আব্বা’ বলে ডাক দেওয়ার মানুষটা আর থাকবে না। মোহনা তন্নীর মতো না। কেউ কারো মতো হয় না। এত কঠিন জগত সংসার। আল্লাহ ভীষণ নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন পৃথিবীর এতটুকু নিয়মে! এত আদরে, বুকে জড়িয়ে, মুখে মুখে খাইয়ে বড় করা কলিজার টুকরো কেও পরের ঘরে যেতে হয়! মইনুল ইসলামের চোখগুলো লাল হয়ে আসে। দু’টো রাত ধরে কাঁদেন আসমা। রাত জাগেন। তন্নী এখনই বুঝতে পারছে না। মানুষের এমন কষ্ট হওয়া উচিত না, যেটা প্রকাশ করা যায় না। যেটা বুকে জমে পাহাড় হয়ে যায়। মইনুল টের পেলেন উনার বুকটায় ক্ষত হয়েছে। যেই ক্ষত কখনো পুরন হবে না। কখনো না।
কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মেয়েটা! ওনার মেয়েটা এতো সুন্দর কবে হলো? উনি এর আগে সেভাবে খেয়াল করেন নি তো! মেয়েকে বধুর সাজে এত পরিপক্ক লাগার কথা না। তবুও লাগছে। বিয়ের পানিতে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়ে। নইলে এতো এতো মেয়ের ভীড়ে কেবল ওকেই কেনো ফুটবে? কেনো চোখ সরানো যাবে না? মইনুল চোখ ফিরিয়ে নিলেন। নজর না লেগে যায়!!
আনন্দ উল্লাসে কাটলো তন্নীর গায়ে হলুদ। তন্নী আফরোজার নতুন জীবনের সুচনা লগ্নের খানিক অংশ।
চলবে….!