#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_০৫
তারপরের দিন রবিবার। দশ তারিখ। যথারীতি তন্নীর বিয়ের দিন। চারপাশ মানুষ জনে গমগম করছে। পাত্রের বাড়ি থেকে সকালে বিয়ের সাজগোজ পাঠানো হয়েছে। আনিকা সুন্দর করে সাজাতে জানে। তন্নী কে খুব ভোরে সকাল সকাল গোসল করানো হলো। ভাবীরা সবাই মিলে করিয়েছে। তখন একদফা কাঁদা ছোড়াছুড়ি খেলাও শেষ হয়েছে। তারপর সবাই গোসল করে খিচুড়ি খেতে খেতে সময় চলে গেছে। তখন দুপুর বারোটা। রবিবারে বিয়ে কিছুটা বেমানান সবার কাছেই। বিয়ে হবে মুলত শুক্রবারে। সুন্দর একটা বার। সেখানে রবিবার কেনো? উদ্ভট! তন্নী বলেছে সেটা কেউ তখনো জানে না। তাঁকে সাজাতে বসানো হলো।
টুকটুকে একটা গাড় লাল রঙ্গের শাড়ি। পাড়টা ঘন কালো গাড় সবুজ। সেখানে সোনালী সুতোর কাজ। লাল শাড়িটা জুড়েও সোনালী কাজ ছড়িয়ে। ঘরের সাদা আলোতে সম্পুর্ন শাড়ি ঝলমল করছে। ওদের সবার ভীষণ পছন্দ হলো। দোপাট্টা টাও টুকটুকে লাল। শাড়িটা তন্নী কে বেশ সুন্দর করে সময় নিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হলো। মাথার লম্বা, ঘন চুলগুলো খোঁপা করা হয়েছে। খোঁপার মধ্যে কয়েকটা লাল তরতাজা গোলাপ গেঁথে দেওয়া। রংতুলি দিয়ে আঁকা দৃশ্যের মতো সুন্দর বড়বড় দুটি চোখ আইলাইনারের জাদুতে আরো ফুটে উঠেছে। চোখের নিচটাও কাজলে আবৃত। কপালে ছোট্ট টিকলি, নাকে কান পর্যন্ত টানা নাকফুল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। বিয়ে একবারই হয়। তাই সাজগোজটাও স্পেশাল। হাত ভর্তি লাল চুড়ি, গলায় ছোট বড় দুটি হার। তাঁকে পুরোপুরি সাজাতে গিয়ে একঘন্টার বেশি লেগেছে। তমা বলেছিল চুলগুলো ছেড়ে রাখতে। তন্নী রাজি হলো না। এত বড় চুল। এমনিতেও লোকজন দেখে ওর মাথা ঘুরছে। দরকার নেই। শেষমেষ ঝুমা ওর মাথার অর্ধেক টা পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দিল। ওর মুখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো সবাই। বলাবলি করলো, সোহাগীর সৌন্দর্য্য বেড়েছে। হাত ভর্তি মেহেদীর রঙটাও লাল হয়েছে।
নুরজাহান ঘর থেকে বের হন নি সকাল থেকে । গতকাল থেকেই তিনি চুপচাপ। ভীষণ আশ্চর্যজনক ঘটনা। বাড়িটা সম্পুর্ন হয়েও অসম্পূর্ণ। নুরজাহানের কথা ছাড়া এটাকে বাড়ি বলা দুষ্কর। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন কিছুটা।
একপাশ থেকে লাঠিটা নিয়ে উনি এগিয়ে এলেন। সবাই জায়গা করে দিল। তন্নী হাসছে তখনো। নুরজাহান কে দেখে বললো,
“ দাদু, এখানে বসো। আমার পাশে। ”
হাত দিয়ে নিজের পাশে ইঙ্গিত করলো সে। বহুদিন বাদে তার কন্ঠে দাদু ডাক নুরজাহানের বুকে ঢেউ তুলে দিল। তন্নী ওনাকে সুন্দরী ডাকে। ওনার চোখদুটো পিটপিট করছে। লোকে বলে, কান্না দেখলে কান্না পায়। মেয়েটা এতো সুন্দর সেজেছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। পুতুলের মত চেহারা। উনি কাঁদলে মেয়েটাও না বুঝে কাঁদবে। তিনি তন্নীর হাত দুটো আঁকড়ে ধরলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন,
“ জামাই ভালোবাসবে। মেহেদীর রং উঠছে। তোর কপাল ভালো। ”
তন্নী লজ্জা পেল। বধুরুপী মেয়েটার হাসিটাও দারুন। তার আজকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। ওরও বিয়ে হবে, একটা জামাই হবে। মেয়েরা বিয়ের দিন এতো কাঁদে কেনো? তার তো ততো কান্না পাচ্ছে না। শুধু মোহনা, মা, বাবা আর দাদীর মুখটা দেখলে কান্না পাচ্ছে। সবাই ভীষণ আনন্দ করছে। কোথা থেকে আসমা দৌড়ে এলেন। দরজার পাশে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বিছানার মধ্যমনিতে এটা ওনার মেয়ে? তন্নী কবে এতটুকু বড় হলো? বিয়ের শাড়িতে তাঁকে একবিন্দুও ছোট লাগছে না। দিনের আলোতেও ওনার ঘরে জোৎস্নার আলো নেমেছে। তিনি ঘরে ঢুকলেন না। হাসি হাসি মুখটা দেখতে দেখতে পিছিয়ে গেলেন। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে হয়। এত দারুন সত্যটা এমন নিদারুণ ব্যথায় মোড়ানো কেনো?
***
চারপাশে রব উঠলো, বর এসেছে, বর এসেছে। তন্নী কে একা একা রেখে একে একে সবাই বের হয়ে গেল। অনেকে তৃনয় সিদ্দিকী কে দেখে চলে আসবে। ঘরটা পুরোপুরি খালি হয়ে নিস্তব্ধ পুরীর মতো রুপ ধারণ করলো। তন্নী চুপচাপ বসে থেকে বাইরে তাকালো। পুকুরের মাঝখানে রোদ পড়েছে। চারপাশে ফলের গাছ গাছালির বাহার। তন্নী পেয়ারা গাছটার দিকে তাকালো। তারপর একে একে জামরুল, জাম্বুরা, আম। সবগুলো গাছ ও চষে খেয়েছে দুদিন আগেও। গাছগুলোর নকশা দারুন। উঠতে গেলে আনন্দ হয় বেশ। তন্নী সেগুলো দেখতে দেখতে হুট করে হেসে ফেললো। একবার ডাল ভেঙ্গে দিঘীতে পড়েছিল সে। সেসব দেখতে দেখতে ছোট তন্নী আনমোনা হয়ে গেল। তার মনে পড়লো সে এখান থেকে চলে যাবে। তারপর কারো বাড়ির আদর্শ বউ হতে হবে। উড়নচণ্ডী পানা কমাতে হবে। এমা! এ বাড়িতে তো সে আর কখনোই মেয়ে হিসেবে আসতে পারবে না।
এটা তো মনে ছিল না! তারপর এতগুলো গাছ? গাছের ফলগুলো? পুকুর সাঁতরে গোসল করা? দাদীর সাথে ঝগড়া? ওর আরামের বিছানাটা? তন্নী সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে ভাত খায়। এতদিনের অভ্যাস, স্বভাব? তার থেকেও বড় কথা, সে এবাড়িতে আগের মতো হৈচৈ করতে পারবে না। আজ থেকে সব শেষ? সব শেষ? সর্বনাশ! তন্নীর বুক ধুকপুক করে, কাঁপে থরথর করে। এ কেমন সত্য, এ কেমন আইন? নিজের বাড়িতে নিজেই মেহমান? হাত পা তার অবশ হয়ে যায়। আসমা বেগম খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তন্নী অথৈ সাগরে পড়া নাবিকের ন্যায় মায়ের কোমড় আঁকড়ে ধরে। আসমা চোখ মুছলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তন্নী ফুঁপিয়ে উঠলো,
“ আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা! কষ্ট হচ্ছে! ”
কথার ধরনে আসমা ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি হয়েছে আম্মু? মাথা ব্যথা করছে? ”
তন্নী প্রকাশ করতে পারে না। সে ছটফট করে। ভীষণ বড় বড় করে শ্বাস ফেলে। নিজের বুকে নিজে হাত দিয়ে মালিশ করে। ধরা গলায় আওড়ায়,
“ আমার অস্থির অস্থির লাগছে। আম্মা, ভালো লাগছে না। এই বাড়ি কি আর আমার থাকবে না? আমি আর পুকুরে গোসল করবো না? আমি…..আমি গাছে উঠে পেয়ারা…. আম্মা। ”
আসমা বেগম কুল কিনারা পেলেন না। কি করবেন না করবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। অসহায় হয়ে বাইরে তাকালেন। আরাফ কে দেখে ডাক দিলেন,
“ আরাফ? বাবা? ”
আরাফ ঘরে ঢুকলো প্রশ্ন করতে করতে, “ কি হয়েছে ফুপি? ”
“ দেখ তন্নী কেমন করছে? ”
আরাফ আরেকটু দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। ওকে জিজ্ঞেস করল,
“ কি হয়েছে? কেমন লাগছে? ”
তন্নী উত্তর দিল,
“ জানি না। সবার কথা ভাবতে ভাবতে কেমন লাগছে। ”
আরাফ শ্বাস ফেললো। একগ্লাস জল এগিয়ে দিল। আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ কিছু হয় নি। প্যানিক এ্যাটাক। এসব ভাবিস না আর। দেখ তোর কাজল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে দেখেছিস? পুতুলের মতো। ”
আসমা দুর থেকে দেখেন। কি যত্ন! এত যত্ন আর কারো চোখে এখনও দেখেন নি তিনি। কিছুটা অন্যরকম না ছেলেটার দৃষ্টি? শুধু ভাই হিসেবে? উনি হিসাব মেলাতে পারেন না। ধীর পায়ে বের হয়ে যান ঘর ছেড়ে।
***
বরের গেট আটকে দাঁড়িয়েছে তন্নীর সমস্ত কাজিন। মেয়েরা সবাই পড়েছে লেহেঙ্গা। ছেলেরা কালো পাঞ্জাবি। একজোটে ওদেরকে দেখতে দারুন লাগে। তাদের গেটে কেবল চাওয়া আপাতত পাঁচ হাজার। বাকীটা হাত ধোয়ানোর সময়, আর বউয়ের মুখ দেখার সময়। তৃনয়ের ঝামেলা ভালো লাগে না। সে একবার চাইতেই পকেটে হাত পুড়লো। তাঁকে পাশ থেকে থামিয়ে দিল ওর মামা। মেয়েরা সবাই বেশ বিরক্ত। তুই মামা; তুই কেনো বরের সাথে থাকবি? ভাল্লাগে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ টাকা কে নেবে? ”
সবার মধ্যে থেকে আনিকা জবাব দিল,
“ আমি! ”
“ তাহলে বাকীরা ভীড় কমাও, কমাও। আমার বাবার মাথা ব্যথা করবে। ”
“ ওলে লে। তাহলে বাবা কে বাসায় রেখে আসতেন। আপনি কে? ”
তিনি ফুঁসে উঠলেন,
“ তোমরা কেউ চেনো আমাকে? হ্যাঁ? ”
আকসা ততক্ষণাৎ জবাব দিল,
“ নাহ। মামা আপনার নাম কি? ”
পাশ থেকে কে উত্তর দিল কে জানে? বললো,
“ মোহাম্মদ আজম সারোয়ার উদ্দিন ভুঁইয়া বল্টু! ”
নাম শুনে সবগুলো শব্দ করে হেঁসে উঠলো। যেহেতু মামা তাই সবাই মুখ চেপে ধরলো। খুব শীঘ্রই একটা বড়সড় ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা। তৃনয় তাই টাকা দিয়ে দিল। মুখে রুমাল নেই বরের। কি আজব বর। মেয়েরা সবাই দৌড়ে এলো। তন্নীর পাশে তখন শিলা। সবাই একযোগে বললো,
“ তোর জামাই সুন্দর আছে, তন্নী। হ্যান্ডু হ্যান্ডু। ”
তন্নী লজ্জা পেল। সে ঘরের বাইরে মহিলাদের গুঞ্জন শুনেছে। সবাই বলাবলি করছে, জামাইটা সুন্দর। তারা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছে। তন্নী আস্তে আস্তে শিলাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ কেমন রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে? ”
“ দেখলাম সাদা। ভালো মানিয়েছে। তোর জামাই কালো পড়লে মেয়েরা আজকে মরেই যেত। ”
“ একদম নজর দিবি না। ”
তারপর বেশ সময় কাটলো। ছেলেপক্ষ কে খাওয়া দাওয়া করানো হলো। গ্রামের বিয়েতে ঝামেলা হবেই। কিন্তু আজকে তেমন শোরগোল হলো না। কাজী এসে তন্নীকে কবুল বলতে বলার পর সে দ্বিধাবোধ ছাড়াই কবুল বললো। সাক্ষরটা বাকী তখনো। তন্নীকে স্টেজে নেওয়া হবে। তখন ছবি তোলা হবে দুজনের সাইনের। তাই খানিক সময়ের জন্য অফ। তন্নীর মাথার ঘোমটাটা তখন পুরোপুরি টেনে দেওয়া হলো। বর আসবে ঘরে। মেয়েরা দাঁড়াল চাদর টানিয়ে। গুঞ্জন আর হৈ হৈ শুরু হলে তন্নীর শরীরে কাঁপুনি সৃষ্টি হলো। আরেক দফা ঝামেলা শেষে মেয়েরা সরে দাঁড়াল। তন্নী টের পেল ওর সামনে একজন বসেছে। সে চিনতে পেরেছে। পেছন থেকে বোধহয় কেউ ঘোমটা টেনে দিল। উন্মুক্ত হলো তার সুশ্রী চেহারাটা। তৃনয় তৃপ্তিতে, খুশিতে ঢোক গিললো। মনে মনে আওড়ালো,
“ মাশাআল্লাহ! ”
তন্নী তাকালো না। দুজনকে একসাথে বসিয়ে আয়না দেখানোর পালা তখন। আয়না ধরলো নুরজাহান। সামনে কাঁচের বস্তুটা এলে তখন তন্নী তাকালো। তারপর হুট করে পুনরায় চোখে চোখ পড়লো। আজকে কপালে বিরক্তি নেই। ভাঁজও নেই। সে মুগ্ধতায় উপচে গিয়ে ততক্ষণাৎ আয়না থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তাকালো ঘাড় বাঁকিয়ে। তৃনয়ের দৃষ্টি আয়নাতেই। নুরজাহান ধমক দিলেন,
“ আয়নায় দেখ। সারাজীবন পড়ে আছে। ”
বাকীরা হেসে দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ আয়নায় কাকে দেখো, জামাই? ”
সবাই উৎসুক। তন্নী লাজ লজ্জা ভুলে তাকিয়ে আছে। পাশাপাশি বসার ফলে কাঁধে স্পর্শ লাগছে। সে আরেকটু অপেক্ষা করলো। তৃনয় দম ফেললো। ওর দিকে ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা চোখদুটো পরিমাপ করলো অদক্ষ চোখে। তারপর বেহায়া নজর নিয়ে গেল রাঙা ঠোঁটে। সমস্ত মুখ মন্ডল নিপুণ চোখে অবলোকন করে সে শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“ আমার বধু! আমার অর্ধাঙ্গিনীকে! ”
বেশ হাসির রোল পড়লো ঘরে। তন্নী চোখ সরিয়ে নিল। কি অদ্ভুত দৃষ্টি লোকটার। তন্নী ভাবতে পারে না সে বিবাহিত। তৃনয়ের বউ। স্টেজে যাওয়ার সময় তৃনয় নিজেই ওর হাতটা আঁকড়ে ধরলো সবার সামনে। ভারী শাড়ি নিয়ে তন্নী এগিয়ে গেল। আরো কতক্ষন ছবি তোলা হলো দুজনের। কার্ডে দুজনের নাম সোনালী অক্ষরে লেখা।
তৃনয় সিদ্দিকী ~ তন্নী আফরোজা।
তখন বিদায়ের সময়। তন্নী হুট করেই কাঁদছে ভীষণ। তাও জোরে জোরে। আশপাশ ভুলে। আসমা আর মইনুল যখন তৃনয়ের হাতে হাত রাখলো তার, তখন থেকেই। একবার বাবাকে জড়িয়ে, আরেকবার মাকে জড়িয়ে। তন্নীর সাথে আপাতত ওর বোন যাবে। বরের আগে অন্য গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। মোহনা সেখানে বসেছে।
তন্নী কাঁদতে কাঁদতেই গাড়িতে উঠে বসলো। বেশ চিৎকার করে কাঁদছে সে। তৃনয় সিদ্দিকী কপালে হাত চেপে রেখেছে। ঘ্যান ঘ্যান কান্নার শব্দে তার মাথাব্যথা করছে। আসমা মইনুলের পাঞ্জাবি আঁকড়ে রেখেছেন। দুরে দরজার শিকে মাথা ছেড়ে দিয়ে নুরজাহান কাঁদছেন। বুড়ো মানুষ। ঠিকমতো আওয়াজও করতে পারছেন না। শিলা দাঁড়িয়েছে গাড়ির সামনে। গাড়িটা ছাড়ার আগেই তন্নী ফের চিৎকার করে উঠলো। বললো,
“ জানালাটা একটু খুলে দাও! ”
তৃনয় বিরক্তি সমেত এগিয়ে এসে ওর গা ছুঁই ছুঁই হলো। তন্নীর ভাবান্তর নেই। জানালাটা খুলে যাওয়ার পর সে মাথা বের করলো। কাজলে চোখটোক লেপ্টে একাকার হয়ে আছে। সে শিলার দিকে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ যে পেয়ারা গুলোর ভেতরে লাল হয় সেগুলো কাউকে দিবি না। আমি এসে খাবো। ওগুলো আমার পছন্দের। ”
ড্রাইভার বোকা বনে হতভম্ব হয়ে পিছনে তাকালো। গ্রামের মহিলারা যারা আঁচলে মুখ চেপে রেখেছিলেন তারা লুকিয়ে হেসে ফেললো। শিলা দাঁত কিড়মিড় করলো, “ রাখবো। তুই যা। ”
তৃনয় মাথা ঘামালো না। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো,
“ জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ”
তন্নী চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো,
“ আমাকে কিছু বলেছো? ”
“ না। তুমি যদি একটু কান্নাটা থামাও তাহলে আমি একটু শান্তি পেতাম। মাথা ব্যথা করছে। ”
তন্নী ঠোঁট উল্টে বললো,
“ কান্না তো থামছে না। আমি কখনো আম্মা, আব্বা আর দাদী কে ছাড়া থাকি নি। দাদীর সাথে ঝগড়া না করলে আমার দিন কাটে না। আমার না কেমন যেনো লাগছে। মনে হচ্ছে, সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি আমি। সারাজীবনের জন্যই তো। এখন তো আমি নিজের বাড়িরই অতিথি। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আল্লাহ! ”
তৃনয় কি করবে বুঝতে পারলো না। স্বান্তনা দিতে সে পারে না। কিভাবে দিতে হয় জানে না। অভিজ্ঞতা নেই। তাঁকে কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রাখতে দেখা গেল। ভাবছে। তারপর শুধু আস্তে করে বললো,
“ কাঁধে মাথা রাখো। ভালো লাগতে পারে। ”
তন্নীর খুব ভালো লাগলো কথাটা। সে চুপচাপ মাথা এলিয়ে দিল তৃনয়ের কাঁধে। তৃনয়ের মেরুদন্ড সোজা হয়ে আসে। ও মুর্তির মতো বসে থাকে। কথা বলে না।
বাড়িতে রব উঠলো, বউ এসেছে, বউ এসেছে। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। রোজিনা বেগম জা’দেরকে নিয়ে বউ বরণ করলেন। ঘরে তুললেন। তৃনয় নিজের ঘরে চলে গেছে। তন্নী কে বোধহয় তৃনয় সিদ্দিকীর বোনের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। রাতে কেউ আর এলো না। তৃনয়ের দুই বোনের নাম জুঁই, জবা। জুঁই বড় দুজনের মধ্যে। সে ঘরে এসে বললো,
“ ভাবী, শাড়ি পাল্টে নাও। ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার ঘুম পাচ্ছে? ”
কাঁদলে চোখ মুখ ফুলে যায়। তখন ঘুমটা একটু বেশিই পায়। সে মাথার ঘোমটাটা ফেলে বললো,
“ হ্যাঁ। আমার বোন কোথায়? ”
জুঁই এগিয়ে এসে মাথার ক্লিপে হাত দিল। খুলে দিতে দিতে বললো,
“ তোমার বোন আমার বোনের সাথে। ওরা দুজন বান্ধবী হয়ে গেছে। ”
তন্নী হেঁসে দিতে চাইলো। তার পুর্বেই দরজার সামনে কেউ দাঁড়াল। লম্বা শরীর। তন্নী তাকালো। সাদা টিশার্ট, কালো ট্রাউজার পড়ে তৃনয় দাঁড়িয়ে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে। তন্নী গুটিয়ে গেল অস্বস্তিতে। মিনমিন করে বললো,
“ এখানে থাকবে নাকি? ”
জুঁই চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“ কে? ”
তারপর সামনে তাকালো। হেসে হেসে উত্তর দিল,
“ আজকে না। এটা আমার ঘর। ”
তন্নী হাঁফ ছাড়লো। জুঁই জিজ্ঞেস করলো,
“ ভাইয়া, কিছু বলবে? ”
তন্নী কিছুটা আড়াল হয়ে আছে। যাতে দেখা না যায়। জুঁইয়ের এদিকে মনোযোগ নেই। সে মন দিয়ে মাথার ক্লিপ খুলছে। তৃনয় দেয়ালে হাত রেখে একটু বেঁকে গেল। তন্নী কে দেখা গেল। তন্নীও দেখলো। সে তারপর আরেকটু চেপে এলো এদিকে। দাদী ঠিকই বলেছেন। এই ছেলের নজর ভালো না। কিভাবে তাকায়? তৃনয় সেভাবে দাঁড়িয়েই বললো,
“ ওর কিছু লাগলে বলিস। ”
তন্নী ভীষণ আস্তে বিরবির করলো, “ আমার আবার কি লাগবে? ”
জুঁই সেটা শুনতে পেল,
“ তোমার বউয়ের কিছু লাগবে না…. ”
তন্নী সোজা বসা থেকে হাঁটু গেড়ে উঠে ওর মুখ চেপে ধরলো। তৃনয় একটু হাসলো বোধহয়। বোঝা গেল না। তারপর চলে গেল। জুঁই মিটিমিটি হাসছে, “ ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছো নাকি? ”
“ শোনো। তোমাকে ভাইয়া সম্পর্কে বলি। ভাইয়া ভীষণ ভীষণ রাগী। কথা না শুনলে মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে পারে। আবার মনে করো, একটু অবাধ্য হলে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিতে পারে। মুখে মুখে তর্ক করলে সোজা তোমাকে বাপের বাড়িতে রেখে আসতে পারে। ”
প্রথম কথাগুলো তন্নীর মনে তলোয়ারের ন্যায় ঢুকে গেল। সে এসব জীবনেও ভুলবে না। প্রথম প্রথম বাক্যগুলো তো একটু বিশেষ। তার মনের ভেতর ভয় জেকে বসলো শক্তপোক্ত ভাবে। এমন সাংঘাতিক পুরুষের সাথে একঘরে থাকা কিভাবে সম্ভব? তাকানোর ধরন, কথা বলার ধরন সবার থেকে আলাদা। তন্নী এমন কাঠখোট্টা লোক জীবনেও দেখে নি। সংসারও তো করতে হবে আজকের পর থেকে! তন্নী কি ভয় পাচ্ছে? তন্নী সাহসী মেয়ে। ও ভয় পায় না। এখন একটু ভয় লাগছে।
একঘরে থাকার বিষয়টা বেশ বিপদজনক! অন্তত ওর কাছে।
চলবে….!