আমার বধু পর্ব-০৬

0
1

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_০৬

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর তন্নী কে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আজ ওদের বৌভাত। তাঁদের বাড়ি থেকে সবাই আসবে। রাতে তেমন কেউ আসে নি। বিয়ে মানেই তো বউ দেখা! তাই মহল্লার মহিলারা দলে দলে বউ দেখতে আসছে। তন্নীর পড়নে একটা জামদানীর সাদামাটা শাড়ি। কিছুক্ষণ পর ওকে সাজানো হবে। মেয়েটার শরীরের রঙটা আরেকটু উজ্জ্বল হয়েছে। একজন দেখে বললো,

“ সুন্দরী বউ। রোজিনা এটাকে কোথায় পেলে? ”

তন্নী নিজেও সবার মুখ দেখছে। বাকীরা বউয়ের কান্ডে অবাক হচ্ছে বটে! নতুন বউ এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কেনো? কেউ অবশ্য মুখে কিছু বললো না। শেষমেষ একজন ভদ্রমহিলা এলেন। পোশাক আর সাজগোজে সম্ভ্রান্ত চেহারা। বেশ শৌখিন এবং বড় ঘরের মহিলা। শরীরের গয়নাগুলো তার সচক্ষ প্রমান।
উনি থুতনি চেপে মুখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। এপাশ ওপাশ পরোখ করলেন। তারপর চোখদুটো কুঁচকে বললেন,

“ সবই ঠিক আছে‌। সুন্দরও তো মাশাআল্লাহ। শুধু নাকটা একটু বোচা। ”

তন্নীও ওনাকে দেখছে। নতুন বউ সে‌। কন্ট্রোল, কন্ট্রোল। কিচ্ছু বলা যাবে না। কিচ্ছু না। দাদী বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা থেমে থাকলেন না। মনে হচ্ছে ওনার প্রধান কাজ, সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টির খুঁত বের করা। তিনি আবারও বললেন,

“ এই যে এদিকটায়। এখানে একটু উঁচু হলে একদম খাপে খাপ। কিরে রোজিনা। মেয়ের নাক দেখিস নি? ”

তন্নী আর চুপ থাকলো না। সহ্য হলো না বোধহয়। এভাবে কারো চেহারা খুঁটতে হবে কেনো? চেহারায় বড়লোক অথচ মন মানসিকতা নিম্ন! নাক দেখে আনবে মানে? একটা মানুষের হাড়গোড়ের খোঁজ নিয়েও কি বিয়ে হয়? সে মুখে মুখে বলে বসল,

“ আপনার তো নাকই নেই, আন্টি! সবার সবকিছু সুন্দর হবে কিভাবে? মুখের নকশা কি হাতে আঁকা যায়? ”

তৃনয় তখন সিঁড়ির মাথায় এসে থেমেছে। ভদ্রমহিলা শুনতে পেয়েই হায় হায় করে উঠলেন,

“ ও রোজিনা? নতুন বউয়ের আচরন এমন কেনো? ”

তন্নী জিভে কামড় বসালো, নাউজুবিল্লাহ, নাইজুবিল্লাহ! ও আল্লাহ। মুখটা কেনো এতো দ্রুত চলে? তৃনয় এগিয়ে এলো। তন্নী তাঁকে একপলক দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। মহিলা তৃনয়কে দেখে বললেন,

“ দুইদিন হয় নি বউ এসেছে। তোর বউ কিভাবে তর্ক করে দেখেছিস? ”

তৃনয় ওর দিকে তাকালো। তন্নী মাথা নামিয়ে রেখেছে। কিছু বাদে তার কানে এলো একটা ভীষণ গম্ভীর কন্ঠ,

“ শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আদবের সাথে কথা বলবে। ঘরে যাও। সোজা আমার ঘরে। জুঁই? ওকে আমার ঘরে নিয়ে যা। ”

“ ভাইয়া, ভাবীকে সাজাতে হবে… ”

“ আমার ঘরেই। ”

এত কঠোর স্বর! ধমকে বলছে কথাগুলো সে। তন্নীর চোখ ছলছল করছে। এ বাড়িতে তৃনয় ছাড়া ওর আপন আর কেউ আছে? জুঁই ওকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

“ বলেছিলাম না? ভাইয়া একটু রাগী! ”

তন্নী আর কথা বললো না। দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। মহিলা ওকে এভাবে নিন্দে করলো সেটা শুনলো না? ওকেই একা বললো? বাড়িতে চলে যেতে মন চাইছে।
ওঁরা সেখান থেকে চলে আসার পর তৃনয় পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা বোধহয় সন্তোষ হয়েছেন। নতুন বউয়ের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তিনি উপরে তাকিয়ে ছিলেন। তৃনয়ের চোখটা সিঁড়ি থেকে ঘুরে এলো। গলার স্বর আগের থেকেও কঠিন, কাটকাট হলো,

“ আপনি বলুন, আন্টি! তর্ক কাকে বলে? ”

তিনি থতমত খেলেন,

“ তোমার বউ আমার সাথে সাথে কথা বলেছে! ”

“ আমি জিজ্ঞেস করলাম, তর্ক বলতে কি বোঝায়? ”

“ বারবার উত্তর করা! ”

তৃনয়ের কন্ঠ আরো শক্ত হলো,

“ ও আপনার সাথে কয়বার উত্তর দিয়েছে? ”

উনি আমতা আমতা করলেন,

“ এক… একবার! ”

তৃনয়ের চোখমুখ শক্ত। মোহনা সেখানে দাঁড়িয়ে। সবগুলো মহিলাও আছে। রোজিনা বেগম ভয় পাচ্ছেন। ছেলে কি বলতে কি বলে বসে? তৃনয় গম্ভীর গলায় বললো,

“ একবার বললে সেটাকে তর্ক বলে না। ভুল ধরিয়ে দেওয়া বলে। আপনি ওর সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলার কে? ও আপনার খায়? আপনার টা পড়ে? আপনার বাড়ির বউ? বউ আমার, বিয়ে করেছি আমি! আপনাদের জন্য নতুন বউদের মুখ ফোটে। আমি সবাইকে সাবধান করছি। কেউ কোনোরকম নেগেটিভ মন্তব্য করার আগে এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন। এসেছেন, বসবেন, কথা বলবেন। ব্যাস চলে যাবেন। আমার বউ, আমার মায়ের পুত্রবধূ কে নিয়ে নাক গলাবেন না। ”

একজন মিনমিন করলেন, “ বউকে দেখানো শাসন করেছে। ”

তৃনয় জবাব দিল,

“ হ্যাঁ, অবশ্যই। যতটুকু বলেছি সেটাই যথেষ্ট। ও আপনাদের সাথে আর কোনোদিন কথাই বলবে না। আপনারা কি চাইছেন আমার স্ত্রী আমাকে ভয় পাক? যাস্ট ইরিটেটিং। অসহ্য। এবং লাস্ট ওয়ার্নিং, ওকে নিয়ে কেউ কিছু, আই রিপিট বিন্দুতুল্য মন্তব্যও করবেন না। আপনাদের বাড়িতে গিয়ে আমার স্ত্রী বসে থাকবে না। ”

চোখের পাশের শিরাগুলো ভাসমান হয়েছে। তারপর সে গটগট পায়ে চলে গেল। ভদ্রমহিলা বললেন,

“ কি অভদ্র তোমার ছেলে। ”

রোজিনার মুখ কালো হয়ে গেল। জুঁই এসেছে তখন‌। সে বললো,

“ অভদ্র বলেই অভদ্র ভাষায় বুঝিয়েছে। ভদ্র হলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলতো সরাসরি। ”

তারা সবাই চুপসে আছে। লজ্জা, শরম থাকলে আর কোনোদিন কিছু বলবে না। বাপরে! কি সাংঘাতিক ছেলে। বড়দেরকে আদব দিতে জানে না। একদিনেই বউ চিনে ফেলেছে। আজকালের ছেলে! অসভ্য, অসভ্য বিরবির করতে করতে ওনারা চলে গেলেন।

***
তন্নীর বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। নুরজাহান এসেছেন আগে আগে‌। তিনি এসেই তৃনয়ের ঘরে ঢুকেছেন। তন্নী কে আজ কালো জামদানি পড়ানো হয়েছে‌। হালকা ঘিয়ে রঙা শাড়ির পাড়। জুঁই সাজিয়েছে ওকে। ঠোঁটে শুকনো হালকা খয়েরি লিপস্টিক। তন্নীর মন ভালো নেই সকাল থেকেই। কালবৈশাখী ঝড়ের ন্যায় আঁধার সেখানে। মুখটাও কেমন পানসে, ফ্যাকাশে। তৃনয়ের ধমক এখনো সে ভুলতে পারছে না। নতুন বউকে এভাবে বলা যায়? এতটা রুডলি? তবুও তন্নী কাউকে দেখায় না। তার মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটলো নুরজাহান কে দেখে। মোহনাও এসে বসেছে পাশে। নুরজাহান এসেই সবটা শুনেছেন। সকাল সকাল নববধূকে নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেছে একদফা। তিনি নাতনীর চোখমুখ দেখে বুঝে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

“ জামাই তোকে কিছু বলেছে? ”

তন্নী মুখও খুলতে পারলো না। মোহনা খাটের উপর উঠে এলো। ভীষণ ছটফটে গলায় বললো,

“ আপাকে বকেছে সেটা বাদ দাও, দাদু! আপা যখন সেখান থেকে এলো? বাপরে! ভাইয়া জানো কি রাগ! ভাইয়াকে দেখে আমিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। এই যে এখানটায়… ” কপালের বা পাশটা দেখালো সে, “ এখানের রগ ফুলে গিয়েছিল। এত রাগী! আপা জীবনেও ঝগড়া করো না! ”

নুরজাহান মিটিমিটি হাসলেন। বউকে মুঠোয় রাখার কৌশলও জানা আছে‌। বলেছে, কিন্তু বউয়ের অগোচরে। তন্নী কথা বললো না। সে বুঝলো না তার অভিমান হয়েছে। ভীষণ গাড় অভিমান। প্রথম দিনেই বউকে এভাবে শক্ত কথা বলা তাঁর উচিত হয় নি। অভিমান না ভাঙলে সে কথা বলবে না। তারপর রাগে সারাদিন তৃনয় ঘরের ভেতর এলো না।
তখন বিকেল। সবার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। তৃনয়ের ঘরে বাকীরা সবাই বসে আছে। ঘরটা বেশ বড়সড়। একটা ব্যালকনি, বিছানা থেকে কিছুটা দূরে জানালা, জানালার পাশে ছোট সোফা। অপরপাশে আলনা, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ারড্রোব! বিছানার মাঝখানে তন্নী বসে আছে। সে সবার সাথে কথা বলছে হেসে হেসে। জবা ওকে একটা আপেল দিয়েছে। সেটা খাচ্ছে এখন। দরজার পাশে তখন তৃনয়কে দেখা গেল। ওকে দেখে একে একে সবাই বের হয়ে যেতে লাগলো। তন্নী বোকার মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে তৃনয়কে দেখে জায়গায় জমে গেল। মুখের ভেতরের আপেল চিবানো ভুলে গেল। অসহায় চোখে সবাই কে দেখলো। দাদী কোথায়? এরা ওকে কোথায় ছেড়ে যাচ্ছে, বাবা? তন্নীর কান্না পায়, ভয় লাগে। ঘরটা তখন খালি হয়ে গেছে। তৃনয় ঢুকলো। দেখলো, পাথরের ভাস্কর্যের মতো একটা পুতুল বসে আছে খাটে। সাদা শরীরে কালো আস্তরণ। তন্নীর শরীর কাঁপছে। সে আড়চোখে তৃনয়কে দেখছে। তৃনয় ঘরে ঢুকে পড়নের কালো শেরওয়ানী টা একটানে খুলে ফেললো। তন্নী হাঁসফাঁস করে অন্যদিকে ফিরে গেল। তৃনয় কাবার্ড খুলে টি শার্ট বের করলো। তন্নী তখনো আড়ে আড়ে দেখছে। লোভনীয় জিনিসের মতো। তারপর নিজের মনের বেলেহাজ চিন্তাভাবনায় নিজেই মিশে গেল। টিশার্টটা পড়ার সময় পিঠের হাড়গুলো কিভাবে যেনো ভেসে উঠলো। তৃনয় চুল ব্যাকব্রাশ করলো হাতে। তারপর ডাকলো,

“ আফরোজা? ”

তন্নী ঢোক গেলে, “ হু? ”

তৃনয় ওর দিকে তাকালো না। আয়না দিয়ে দেখা যাচ্ছে। সে বললো,

“ সকালের ব্যবহারের জন্য মন খারাপ তোমার? থাকতে পারে। অস্বাভাবিক না। কিন্তু আমার বাড়ির, আমার এলাকার কারো সাথে কখনো এভাবে কথা বলবে না। আমি এটা ভালো চোখে দেখি না। বড়দের সাথে তর্ক করা উচিত না। ”

তন্নী নাক ফুলিয়ে প্রশ্ন করলো, “ উনি বারবার আমাকে খুঁটছিলেন। নিজে তো কিছু বললো না। শুধু আমাকে পেয়েছে! ”

“ চোরে কখনো চোরের বাণী শোনে? তোমাকে তর্ক করতে না করে আমি তর্ক করবো? আমি যাতে আর কখনো না শুনি কেউ কিছু বলার সাথে সাথে উত্তর দিয়েছো! কেউ আমার বউকে নিয়ে আলোচনা করুক, নিন্দে করুক তা আমি চাই না! ”

আমার বউ? তন্নীর অনুভূতি গুলো নিজের কাছেই অজানা অজানা লাগে। সে কথা বলতে পারে না। চুপচাপ মেনে নেয়‌। একা একা লোকটার সাথে আছে, চিন্তা করলেও শ্বাস আটকে আসে। তৃনয় বের হওয়ার সময় দরজার কাছে জুঁই কে দেখলো‌। শেষেরটা শুনেছে কিছু। চলে যেতেই চাচ্ছিল। তৃনয়কে বের হতে দেখে গেল না। তৃনয় কাছাকাছি যেতেই বললো,

“ তোমার বউ তর্ক করবে? কেউ তোমার বউকে আর কখনো কিছু বলবে না। ”

তৃনয় যেতে যেতে আদেশ দিল,

“ ওকে কেউ কিছু বলবে না সেটা যেনো ও না জানে! ”

জুঁই ভাইয়ের বেশ প্রশংসা করলো। দারুন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। তার কিছুক্ষণ পর নুরজাহান তৃনয়কে সাথে নিয়ে ঘরে এলেন। তন্নী তখন একা বসে আছে। সে দেখলো, নুরজাহান তৃনয়ের হাতটা দু হাতে চেপে ঘরে আসছে। তন্নী কথা বললো না। দুজন এসে খাটে বসলো। মাঝে নুরজাহান। একপাশে তন্নী, অপরপাশে তৃনয়। তিনি তন্নীর হাতটা তৃনয়ের হাতে রাখলেন। তৃনয় তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে ওকে। নুরজাহান বললেন,

“ নাতী আমার বড় আদরের। তুই ওরে আদরে আদরে রাখিস! ”

তন্নীর লজ্জা বাড়ছে। নুরজাহান কখন কি বলে বসে ঠিকানা নেই, গ্যারান্টি নেই। তৃনয়ের হাতের উপর তন্নীর হাত। সে সেখানে জোরে চাপ দিল। তন্নী হকচকিয়ে গুটিয়ে গেল। আঙুলে আঙুল নাড়াচ্ছে। ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতি। কি শয়তান। সে হাতটাকে ছাড়াতে চাইছে। তৃনয় বললো,

“ তোমার নাতী আদর বোঝে? ”

নুরজাহান হেসে ফেললেন, “ সব বুঝে। আর হুন আরেকটা কথা…. ”

তৃনয় মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। উনি ফিসফিস করে বললেন,

“ রয়েসয়ে, রয়ে সয়ে! ”

তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,

“ কেনো? ”

“ ধুর বা*লডা। আমার নাতী ছোট না? ”

“ ছোটটাকে বিয়ে দিলে কেনো? ”

নুরজাহান ফুঁসে উঠলেন। ওনার রাগটা আবার বাড়ছে। ছেলেটা এমন ত্যাদর কেনো? উনি রেগে গিয়েই বললেন,

“ তোরে কি এমনিতে আমি মা*ঙ্গের নাতী ডাকি? খাটাস একটা! ”

তন্নী বা হাতটা নিয়ে কপালে একটা থাপ্পর মারলো। নিজের কপালেই। তারপর নুরজাহানের কানে কানে বললো,

“ বুড়ি, শয়তান, কুটনি তুমি এমন তুই তোকারি করো কেন? আর এতো গালি? ভালো হয়ে যাও। ”

নুরজাহান মাথা দোলালেন,

“ তোর ঘরে একটা বাবু হইলে ভালো হয়ে যামু। ”

তন্নী চোখ উল্টিয়ে তৃনয়ের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি। মিটিমিটি হাসি। তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। সে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে নিল। চোখমুখ দেখা যায় না। আল্লাহ তুমি রহম করো। নুরজাহান তারপর তৃনয়কে আবারও বললেন,

“ যা কইছি মনে রাখিস। নাইলে ….. ”

তৃনয় কথা কেড়ে নিল,

“ পারবো না। তুমি থাকো নইলে আজকে রাতে। ”

নুরজাহান শয়তানের মতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

“ পুরুষ মানুষের প্রথম শত্রু কি জানিস? ”

“ কি? ”

“ ওদের…. ”

তৃনয় এবারে তন্নীর হাত ছেড়ে মুখ আটকে ধরলো, “ থামো, থামো। জানি! ”

নুরজাহান হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলেন। ওর দিকে তাকিয়ে নাকটাকে উঁচু করলেন,

“ তুই খালি আমাকে ছুঁতে চাস ক্যান? ”

তৃনয় কাঁধ উঁচু করলো,

“ তুমিই তো সেদিন বললে, পুরুষ মানেই লু… মানে তাই আর কি! ”

নুরজাহান ওকে ঠেলে দিলেন,

“ যা দুরে গিয়ে মর। যা, ঘরতে বাইর হ। ”

“ কেনো? ”

“ আমার নাতীর সাথে কথা আছে‌। যা তুই। ”

তৃনয় দুটো হাত বিছানায় ভর করলো‌। বললো,

“ আমার সামনেই বলো। ”

নুরজাহান ওকে পেছন থেকে ঠেলে দিলেন। তৃনয় বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,

“ তোমার নাতীকে এখন একটু ঘুমিয়ে নিতে বলো। ”

তন্নী অবুঝের মতো তাকালো। নুরজাহান কে গুঁতো দিল জিজ্ঞেস করতে। নুরজাহান জিজ্ঞেস করলেন,

“ ক্যান? ”

তৃনয় স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

“ সারারাত সজাগ থাকতে হবে না? ”

তন্নী প্রকট চোখে তাকালো। কি লজ্জাজনক কথাবার্তা! ছিঃ ছিঃ! কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। রাতে সজাগ থাকার মানে কি সে একটুও বোঝে না? তন্নী কি এতই বোকা? নুরজাহান শাড়িতে মুখ ঢেকে ফেললেন। তন্নী হাঁসফাঁস করছে। অবস্থা দুর্বিষহ। কিছু বললো না সে। চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। তৃনয় কথা বলেই চলে গেছে। নুরজাহান ওর হাতে হাত রাখলেন,

“ মানিয়ে বুঝিয়ে চলবি তন্নী। এডা তোর বাপের বাড়ি না। জামাইয়ের বাড়িতে থাকতে গেলে বোবা হইয়া থাকতে হয়। মনে থাকবো? ”

তন্নী বীতস্পৃহায় মাথা নাড়ে। কাকে কি বলবে সে? তবুও সে বললো,

“ কেউ আমাকে কিছু বললে আমি চুপ থাকবো কেনো? ”

“ মা*গী, লাঙ্গের ঘর করলে চুপ থাকতে হয়। কেউ কিছু কইলে প্রথমে জামাইরে কবি। তোর জামাইয়ের জ্ঞান বুদ্ধি ভালো আছে। তোর মতো গাধা না। ”

তন্নী মেনে নিল। কথা বললো না। নুরজাহান শরীর ঘেঁষে বসলেন‌। আস্তে করে বললেন,

“ জামাই রাতে যা চাইবো সব দিবি! ”

তন্নীর চোখদুটো কুঁচকে আসে। সে নিজের হাত দুটো প্রসারিত করলো। নিজেকে দেখিয়ে বললো,

“ কি আছে? কি আছে আমার কাছে? কি দেবো? ”

নুরজাহান মৃদু ধমক দিলেন,

“ চুপ। বুঝিস না কিছু? না বুঝলে চুপচাপ থাকবি। আজাইরা ভয় পাবি না। আর চিৎকার চেঁচামেচি করিস না। ”

তন্নী উল্টে ওনার হাত ধরলো, “ তুমি থাকো, সুন্দরী! আমার একলা একলা লাগে। এখানে কেউ আমার আপন নেই। ”

নুরজাহান আশ্বাস দিলেন,

“ আছে। জামাইয়ের বাড়িতে জামাই ছাড়া আপন নাই। জামাইয়ের মতো আপন কেউ নাই‌। মনে রাখবি, জামাই তোর। জামাই তোর সব। আজকে রাত গেলেই বুঝবি। ভয় পায় না দাদু। তুমি মন দিয়া সংসার করবা। বাপের বাড়ি যাতে কোনো অভিযোগ না যায়। রেশমির বিয়ে হয়েছে কখন মনে নাই? তোর থেকেও ছোট থাকতে বিয়ে হয়েছে। কি সুন্দর ঘর করতাছে। আমার বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। আমার কথা মনে রাখবা, দাদু! ”

তন্নী হঠাৎ ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেললো। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,

“ এখানে ভালো লাগছে না। আমার দমবন্ধ লাগছে। একটু বাইরে যাবো। ”

নুরজাহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,

“ কাঁদে না, বু। ভালো, খারাপ সব তিনয় রে বলবি। রাতে বলিস বাইরে যাওয়ার কথা। নিয়ে যাবে। জামাইয়ের মতে মতে চললেই সোহাগী হবি। ”

তারপর নিয়ম করে রাত নামলো। আকাশের কোনে সুর্য অস্ত গেল। তন্নীর জীবনে নতুন রাত এলো। ভিন্ন, অন্যরকম। জীবনের দ্বিতীয় স্তর। তন্নী ভীষণ অগোছালো, চঞ্চলা রমনী। তৃনয় তাহার বিপরীত। নুরজাহান দেখে গেলেন। ভবিষ্যত বানী করে গেলেন, ওদের খুব সুন্দর একটা সংসার হবে। টক, ঝাল, মিষ্টি একটা সংসার। মইনুল মেয়ের জন্য উপযোগী পাত্র খুঁজেছে। সেটা উনি আজকের ঘটনাতেই বুঝে গেছেন। প্রথম বাক সুন্দর হলেই রাস্তা মানসম্মত হয়। হাঁড়ির ভাত একটা ধরলেই বোঝা যায়। সবগুলো খুঁটতে হয় না।
গল্পটা একটা ভীষণ চঞ্চল, অবুঝ, বকবক করা বধু, আর গম্ভীর, বুঝদার, কথা কম বলা বরের।
মানবের আজন্ম আর্কষন বিপরীতে। ওদের সংসার আদুরে না হয়ে যাবে কোথায়?

চলবে…!