#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১০
আকাশে জুড়ে আজ অর্ধ গোলাকার চাঁদ। কৃষকের হাতের ধান কাটার কাঁচির ন্যায় দেখতে। নিশুতি রাত আশেপাশে। বাড়ির পেছনে কতগুলো বড় বড় গাছ। কাঁঠালের, মেহগনির। ছাদ থেকে কিশোরগঞ্জের সদর দেখা যায় একটু আধটু। দোতলা বাড়ির উচ্চতা বেশি না। ফলে গুরু দয়ালের মাঠ দেখা যায় না। কেবল কয়েকটা ব্রিজ চোখে পড়ে। তন্নীর পড়নে একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি। তৃনয় পড়েছে কালো টিশার্ট। দুজন যখন ছাদে এলো, তখন এগারোটার বেশি সময়। বাড়ির কেউ জেগে নেই। চারপাশটা বড্ড নিরব। ছাদের উত্তর পাশে বসার জন্য একটা দোলনা। তন্নী চুপচাপ আশপাশ দেখছে। এ কয়েকদিনে ছাদে বেশি একটা আসা হয় নি। ঝুমঝুম করছে সবকিছু। তন্নী তবুও ভয় পায় না। পাশে তৃনয় আছে যে! তৃনয় দোলনায় বসলো না। তন্নী কে বাহুতে জড়িয়ে ছাদের একপাশে দাঁড়াল। কানের কাছে ফিসফিস করলো,
“ এবার চাঁদ দেখো! ”
কথা শুনে তন্নী উপরে তাকাল। শরীরটা সে তৃনয়ের বাহুতে ছেড়েছে। আকাশ জুড়ে মিটিমিটি তারা, নক্ষত্রের মেলা বসেছে। তার নিচে খেলছে অনেক গুলো জোনাকি পোকা। চারপাশে তরতর করে আলো ছড়াচ্ছে! ডোবার পাশ থেকে কুহুকের ডাক ভেসে আসছে। তন্নী কেমন করে যেনো তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় চুপ হয়ে যায় সে। চাঁদ টাকে দেখে যায় একধ্যানে, এক দৃষ্টিতে। তারপর হারিয়ে যায়! বহুক্ষণ কাটলে মনে পড়ে কিছু স্পষ্ট স্মৃতি! তাঁদের গ্রামেই কত দেখেছে! বিয়ের দু’দিন পর এটা নিয়ে ঝামেলা, ওটা নিয়ে ঝামেলা। শাশুড়ির সাথে ঝগড়া! পুরুষদের বউদের শরীরে হাত তোলা! কত কি দেখেছে সে! এসব বিষয়ে তন্নীর ভীষণ ভয় ছিল। ও ভয় পেত বিয়ে জিনিসটাকে। তবে সবসময় বিয়ে ভয়ের হয় না! তৃনয়ের মতো স্বামী হলে বিয়ে ভয়ের হয় না! তন্নী হাসে না। হুট করে মুখটা মলিন হয়ে গেলে সে কেঁদে উঠলো শব্দ করে! তার মনে হয়, সে তৃনয়কে তৃনয়ের মতো ভালোবাসতে পারছে না। কান্নার শব্দ শুনে তৃনয় আচমকা ভরকে গেল। আবারও গাল আঁকড়ে ধরলো,
“ কাঁদছো কেনো? ”
তন্নী নাক টেনে জবাব দিল,
“ তোমার সঙ্গে থাকলেই আমার কান্না পায়! ”
“ কেনো? আমি ভালো না? ”
তন্নী বুকে মৃদু কিল বসালো,
“ ভালো বলেই তো! তুমি সারাজীবন এভাবেই থাকবে। মনে থাকবে? ”
তৃনয় মাথার সিঁথিতে চুমু খেল, “ বউ যা বলে তাই! ”
“ আমাদের একটা সোনালী, স্বপ্নের সংসার হবে! মনে থাকবে? ”
“ থাকবে। ”
“ তুমি আমায় ভীষণ ভালোবাসবে? ”
তৃনয় আরেকটু হাসে। শব্দহীন হাসি। ওকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে,
“ চাঁদের মতো ভালোবাসব। ”
“ তুমি চাঁদকে ভালোবাসো? ”
“ সেদিন না বললাম, তুমিই আমার চাঁদ! ”
কি সুন্দর কথোপকথন! রাত জাগা নিশাচর পাখিগুলো গান শুরু করলো খুশিতে। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার আলাপে স্বয়ং ফেরেশতারা পর্যন্ত খুশি হয়। তন্নী বুক থেকে মাথা তুললো। থুতনি বুকে রেখে তৃনয়ের কোমড় জড়িয়ে রাখলো। দুজন বহুক্ষণ দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। চাঁদের নিভু আলোতে একে অপরকে দেখে গেল। কি এক অজানা তৃষ্ণায় দুজনের বুক ভার হয়ে এলো। তৃনয়ের একটা হাত ধীরে ধীরে উঠে এলো ওর থুতনিতে। সে মুখটাকে উঁচু করে ঠোঁট জোড়া দখল করলো। তন্নী প্রথমবারের মতো পাল্টা স্বায় জানালো। স্বীয় হাতটা দিয়ে খামচে ধরলো তৃনয়ের মাথার পেছনের ঘন চুলগুলো!
রাতের গভীরতায়, চাঁদের আলোতে রচিত হলো, ওদের নতুন সম্পর্কের, নতুন ভালোবাসার সুখের মুহুর্ত! মিষ্টি মুহুর্ত! দুরের ভবন থেকে ভেসে এলো প্রেমের গান। নব্য ভালোবাসার গান।
***
তন্নী কখনো সরাসরি তৃনয়ের রাগ দেখে নি। রাগী তৃনয়ের চেহারাটা ওর কাছে অস্পষ্ট। সে শুনেছে, এবং নিজেও অনুধাবন করতে পেরেছে। কেননা, তৃনয় খুব একটা হাসে না। তার মুখটা সবসময় ভোঁতা হয়ে থাকে! তবে আজ তন্নী ভীষণ ভয়ে আছে। সে সিঁড়ির দেরগোঁড়ায় গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তৃনয় এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসে না! রোজিনা বেগম নিজেও ভয়ে আছেন! জুঁই কে কোন ছেলের সাথে দেখেছে সে। তারপর থেকেই ওর মাথা গরম হয়ে আছে। অপেক্ষা করছে, কখন আসবে জুঁই! কিছুক্ষণ আগে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে এসেছে বাড়িতে। নিশ্চুপতা ঝড়ের পূর্বাভাস।
তৃনয় মাথা এলিয়ে রেখেছে সোফায়। খুব দ্রুত হাতে নিজের কপাল ঘষছে সে। সদর দরজা খুলে রাখা। তখন জুঁই এলো! তন্নীর সিঁড়ির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়েই জিভে কামড় বসায়। আহারে! বেচারি আজকে নিশ্চিত মার খাবে! জুঁই বাড়িতে ঢুকলো ভ্রু কুঁচকে। মা, ভাবী এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? সে আরেকটু অবাক হলো তৃনয়কে দেখে! এমন সময় ভাইয়া বাড়িতে থাকার কথা না। ও ভয়ে ভয়ে এলো ঘরের ঠিক মাঝখানে! তন্মধ্যে তৃনয় ডেকে উঠলো,
“ দাঁড়া! ”
জুঁই দাঁড়িয়ে পড়লো। তৃনয়কে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো সে। তন্নী মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ছে। তৃনয় আর কোনো কথা বললো না। এগিয়ে গিয়ে শব্দ করে একটা থাপ্পড় দিল গালে! তন্নী আঁতকে উঠলো সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই। রোজিনা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। মেয়েটা কি করবে বুঝতে পারছে না। এগিয়ে যাবে নাকি? তৃনয় গর্জে উঠলো,
“ তোকে মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়েছি ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি করার জন্য? আমি কি তোর উপর নজর রাখি না? ”
জুঁই গাল চেপে ধরেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে চাইলো,
“ ভাইয়া…. ”
তার আগেই তৃনয় ধমকে উঠলো, “ চুপ! একদম চুপ। লাই দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছি? এখন কফিশপে, ক্যাফেতে তোমার মুখ দেখা যায়? আদর বেশি করে ফেলেছি আমি? ”
আরেকবার এগিয়ে যাওয়ার আগেই তন্নী গেল হুড়মুড় করে। তৃনয়ের বাহু জড়িয়ে ধরলো,
“ মেয়েদের গায়ে কেউ হাত তোলে? তুমি…. ”
তৃনয় বাহু ছাড়িয়ে নিল ঝটকা দিয়ে। ওর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে গেল,
“ ওকে শোধরাতে বলবে। ঠিকমতো বুঝিয়ে বলে দেবে। নয়তো একদিন ঠিক মেরে ফেলবো। ছেলেদের সাথে ঘুরা ঘুরির শখ থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দেব। ”
কথাটুকু বলে সে চলে গেল। তন্নী ঢোক গিললো। মনে হচ্ছিল কাঁচা খেয়ে ফেলবে। রোজিনা এগিয়ে গেলেন না। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন,
“ মনটার ভিতরে একটু ভয়ডর নেই তোর, জুঁই? তৃনয়কে তুই চিনিস না? আরো কয়েকটা দিলে শান্তি পেতাম! ”
অবশ্য ওনার চোখেও খানিক জল। ছেলেমেয়ে দুজনই ওনার আদরের। বড় ভাইয়ের শাসনের উপর মায়ের কথা খাটে না। তন্নী জুঁই কে ধরলো। সে ফোপাচ্ছে। ওকে নিয়ে সে ঘরে গেল। বিছানায় বসিয়ে বললো,
“ দিনকাল কি ভালো, জুঁই? তোমার ভাইয়া কিন্তু সত্যি রেগে গেছে! ”
জুঁই কাঁধের ব্যগটা ফেলে দিল বিছানায়। খ্যাক করে ধমকে উঠলো,
“ তুমি প্লিজ কথা বলো না। ভালো লাগছে না। ”
তন্নী চোখ বুঁজে সেই ধমক সহ্য করে নিল। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! বড়দেরকে সম্মান দিতে জানে না। ভালো মতো বলার পরেও এত কঠোর গলার স্বর? দিনদিনই তন্নী আশ্চর্য হচ্ছে। দুনিয়াতে কি কেউ ভালো নেই? প্রথম প্রথম তাহলে এরা এতো ভালো সাজে কিসের আশায়? সে পাশে বসলো। অপমান গিলে নিল স্বামীর আদেশে। কাঁধে হাত রাখলো,
“ বিয়ের আগে সম্পর্ক ভালো না… ”
জুঁই চেঁচিয়ে উঠলো,
“ তোমার থেকে জ্ঞান নেব আমি? তোমার থেকে? ”
তন্নী হতভম্ব হলো। এখানে ওর কি দোষ? সে বললো,
“ আমি তোমার বড়… ”
জুঁই মাঝপথেই থামিয়ে দিল,
“ তুমি আমার বড় না। কোথায় গিয়ে ভাইয়াকে বোঝাবে তা না করে আমাকে বোঝাতে এসেছো। তুমি কি চাইছো, তোমার মতো আমাকেও এত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিক? ”
তন্নী রেগে গেল খানিক। কথা হজম ততক্ষন করা যায় যতক্ষণ সহ্যের সীমার মধ্যে থাকে। সে বললো,
“ তোমাকে তোমার ভাইয়া মেরেছে। আমার সাথে চেঁচাচ্ছো কেনো? তোমার ভাইয়া আমাকে বললো তোমাকে বোঝাতে। নইলে ঠেকা পড়েছে আমার? তুমি সেদিনও এই কথাটা বললে। তোমার কি মনে হয়? আমার বাবা আমাকে খাওয়াতে, পড়াতে পারে না বলে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে? মানুষ হিসেবে ভালো মানুষ হও। ”
জুঁই থাপ্পড় ভুলে গেল। কয়েকদিন ধরে ভাইয়ের আহ্লাদে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ঘরের বউকে এত আদরে রাখতে হবে? দাসীর মত রাখা উচিত এদের। নয়তো এভাবেই তো কথা বলবে! জুঁই ওর দিকে তাকালো,
“ আমি ভালোই আছি। তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও। অসহ্য কোথাকার! পারলে ভাইয়াকে এগুলোও লাগাবে। খাওয়ানো, পড়ানো? খাওয়াতে পড়াতে না পারলেই লোকে আঠারো হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়। ”
“ তোমার যে বিয়ে হচ্ছে না তা আমি জানি! ”
সে সেখান থেকে চলে এলো। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এত খারাপ! এত খারাপ মন মানসিকতা। লোক বাড়ির বউদের কে সহ্য করতে পারে না কেনো? তারা কি উড়ে এসে জুড়ে বসে? নাকি যেচে এসে খাওয়ার জন্য পড়ে থাকে? তাঁদের বাড়িতে কি ভাতের অভাব ছিল?
তৃনয় পরেরবার বাড়িতে ঢুকলো বিকেলে। তন্নী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ভার, গোমড়া। তৃনয় ঘরে ঢুকে মানিব্যাগ, ফোন বিছানায় রাখলো। তন্নী প্রতিদিনের মত এগিয়ে এলো না। তৃনয় ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হাত ঘড়ি খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওকে জিজ্ঞেস করে,
“ কি হয়েছে? ”
বেখেয়ালে তন্নী শুনলো না। সে আবার ডাকে,
“ আফরোজা? ”
নাম শুনে তন্নী চমকে তাকালো। পিছু ফিরলো। উত্তর দিল,
“ হুম? ”
“ কি হয়েছে? মনমরা কেনো? ”
তন্নী মলিন হাসে। এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। তৃনয় বোতাম থেকে হাত সরালো। তন্নী একে একে খুলতে লাগলো বোতামগুলো। তৃনয় একহাত দিয়ে থুতনি চেপে ধরে ঘুরিয়ে দেখলো মুখটাকে। তারপর চলন্ত হাতটা অপর হাত দিয়ে থামিয়ে দিল। বাঁধা পেয়ে তন্নী তাকালো। চোখে চোখ পড়লে তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,
“ জুঁই কিছু বলেছে? ”
তন্নী আঁতকে উঠলো, “ না না। ”
“ ছাড়ো আমাকে! ”
তন্নী চেপে ধরার চেষ্টা করলো। এবারে গিয়ে যদি আবার মারে? সে বললো,
“ আমিও বলেছি। কাটাকাটি। দুজন সমান সমান। ”
তৃনয় চোখ ছোট ছোট করলো। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল। রেগে গেছে। তন্নী ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তৃনয় শরীরের শার্ট ছুড়ে ফেলে দিল বিছানায়। কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে বললো,
“ কিছু পারো আর না পারো। তর্ক ঠিক পারো। করো তর্ক। আমার কাছে এসো না। ”
তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো সে। শব্দ করে দরজা লাগালো। তন্নী বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। যা বাবা! এখন সব দোষ ওর? এদেরকে আর জীবনে তন্নী কিছু বলবেই না। তৃনয় শুধু ওকেই শাসন করতে জানে। সে নতুন তো। তাই!
যাক গে সব গোল্লায়। এখন থেকে তন্নী বোবা। একটা জামাই তার। তাকে নিয়ে সংসার করতে পারলেই হলো। জামাইয়ের মা বোন দিয়ে ওর কাজ নেই। ওরা তাকে আপন করতে না জানলে সে করবে কোন দুঃখে? আরো স্বামীর মন নষ্ট।
সে রাতে তন্নী আর তৃনয়ের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেল না। তন্নী হাঁসফাঁস করেছে সম্পুর্ন সময়। লোকটা এমন কেনো? হঠাৎ হঠাৎ মুড পাল্টে যায়। ধ্যাত্তেরী!
বিয়ে হওয়া কি শুধুই আনন্দের? যে তন্নী বিয়ের আগে নিজেই রেগেমেগে বোম হয়ে থাকতো; সে এখন স্বামীর রাগ সহ্য করছে। ভাবা যায়?
চলবে….!