#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১১
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। তন্নী সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে। কি এক অভ্যাস হয়েছে! জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে না। শুধু এতটুকুই হলে মানা যেত। কিন্তু লোকটা তার সাথে কথাই বলছে না! কি আশ্চর্য! তন্নী কি করবে, কাকে বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। গোমড়া মুখো লোকের সাথে যেচে গিয়ে কথা বলা যায়? তাও আবার রেগে বোম হয়ে আছে! তৃনয় তার সাথে সকালেও কথা বললো না। নিজের মতো ওঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। তন্নী খাবার দেওয়ার পর চুপচাপ খেল। দিতে হবে না, কিংবা আরেকটু দাও এমন কথাও বললো না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে জুঁই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে ডেকে উঠলো,
“ দাঁড়া! ”
জুঁই দাঁড়িয়ে পড়লো। তন্নী একপলক তাদেরকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। এদেরকে কলিজা কেটে খাওয়ালেও লাভ নেই। দিনশেষে ঠিক দোষ বের করবে। যা খুশি করুক। তার কি? নিজের জ্বালাতেই বাঁচা যায় না। সে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে এলো। একবার তাকালো না পর্যন্ত। তৃনয় জুঁই কে বললো,
“ তোকে আমি দিয়ে আসব! ”
জুঁই আর কথা বললো না। চুপচাপ এতটুকু রাস্তা ভাইয়ের সাথেই এলো সে। কলেজের গেটের সামনে তৃনয় নিজেও নেমে দাঁড়াল। জুঁই ভাইকে দেখে আর ভেতরে গেল না। আশেপাশে কতশত শিক্ষার্থী। তৃনয় জিজ্ঞেস করল,
“ কাল তোর ভাবীকে কি বলেছিস? ”
মেয়েটা মনে মনে একটু রেগে গেল। এটাও বলে দিয়েছে? সে মাথা নামিয়ে নিল। উত্তর দেওয়ার মতো কথা খুঁজে পেল না। তৃনয় আশেপাশে তাকালো। গলা খাঁকারি দিল। শান্ত থাকতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। সে খুব কষ্টে ভালোভাবে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“ আফরোজা তোর থেকে ছোট তাই না? কিন্তু সম্পর্কে? ”
জুঁই আস্তে করে উচ্চারণ করলো, “ সম্পর্কে বড়! ”
“ ভাবী কে মায়ের সাথে তুলনা করা হয় জানিস? ”
জুঁই মাথা দোলায়। জানে সে। তৃনয় তীক্ষ্ণ স্বরে ফের জানতে চায়,
“ তোর ভাবী আগে তোকে কিছু বলেছে? ”
জুঁই আবারও চুপ! ঠোঁটে কথা নেই। প্রথমে সে বলেছে। তৃনয়ের কন্ঠটা আরেকটু ভারী হলো,
“ তুই ওকে বলেছিস, তারপর ও তোকে বলেছে। আমি শুধু জানতে চাইছি এতো বড় সাহসটা তুই ওকে দিলি কেনো? আমার বোনের মুখে মুখে তর্ক করার স্পর্ধা ও পেল কেনো? আমি আফরোজা কে বিয়ে করেছি। শ খানেক লোক, কাবিননামা, দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেছি। ওর উচিত আমাকে সম্মান দেওয়া! সাথে আমার সম্পুর্ন গোষ্ঠী কে সম্মান দেওয়া ওর কর্তব্য! তুই কেনো নিজের সম্মান নিজে নষ্ট করলি? আমার স্ত্রী আমারই বোনকে এখন থেকে সম্মান দেবে না। কেনো? ”
জুঁই হতভম্ব হলো। এখন তো নিজের প্রতি নিজের রাগ লাগছে! তৃনয় কিভাবে বললো কথাগুলো? সত্যিই তো! সে যেচে নিজের সম্মান নিজে নষ্ট করেছে! এ বাবা! ওর মাথাটা ঘুরছে। তৃনয় কি কথা বলতে বলতে ওকে বশ করে ফেললো নাকি? বরের বোন হিসেবে তন্নীর কাছে তার একটা আলাদা জায়গা থাকার কথা। নিজের জায়গা নিজেই নড়বড়ে করেছে সে। তার মানে কখনো কিছু না বললে, মিলেমিশে থাকলে তার সম্মান ঠিক থাকবে? সব এলোমেলো লাগছে। জুঁই বোকার মতো পাশে তাকালো। তৃনয় ওর দিকে তখনো তাকিয়ে আছে। কলেজের গেটের পাশের উঁচু রাস্তায় অনেক মেয়েরা বসে আছে। পাশে কয়েকটা ঝালমুড়িওয়ালা। তৃনয় ওর হাত চেপে সেখানে বসলো। শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“ নতুন বউ সে। কিছু হলে কাকে বলবে প্রথমে? ”
জুঁই বললো, “ তোমাকে! ”
তৃনয় পাল্টা ওকে বললো,
“ আমার বোনের ব্যাপারে আমার কাছে অভিযোগ করলে আমার মান-সম্মান কতটুকু থাকবে তাঁর কাছে? আমি কখনো ওকে কিছু বললে ও বলবে না, আগে নিজের বোনকে শাসন করো! বলবে কিনা? ”
জুঁই বোকার মতো শুনছে, “ বলবে। ”
“ তুই ওর ননদ। বোনের মতো। তুই ওকে উল্টাপাল্টা কথা বললে, ঝগড়া করলে বিপদে আপদে তোর কাছে আসবে সে? তোকে কখনো বোন হিসেবে মানবে? ”
“ নাহ! ”
তৃনয় ফের জিজ্ঞেস করল,
“ আমি আর কখনো শুনবো, তোর ভাবীকে বাজে কথা বলেছিস? ”
জুঁই সাথে সাথে উত্তর দিল,
“ না। সরি ভাইয়া। কাল একটু রেগে ছিলাম। ভাবীও তো বলেছে। ”
“ সেটা তুই বলার পর। ”
জুঁই মাথা নাড়ায়। আচ্ছা! সমস্যা নেই। একটু মিলেমিশে থাকলে তো আর জাত যাবে না। ওদের নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কে সে কেনো আলোচনার বিষয়বস্তু হবে?
সে মনে মনে পণ করলো, বাড়িতে গিয়েই ভাবীর সাথে কথা বলবে। এখন থেকে আর তর্ক করার প্রশ্নই আসে না। তবুও যদি তন্নী উল্টাপাল্টা কিছু বলে তাহলে সে ভাইয়ার কাছে বিচার দিয়ে দেব। নালিশ! তখন তো আর তার দোষ নেই। থাকবেও না।
***
তখন বেশি রাত না। তৃনয় বেশিরভাগ সময় রাতে খায় না। সে বসেছে টেবিলের চেয়ারে। সামনে কতগুলো পরিক্ষার খাতা। তন্নী ইতস্তত করে ঘরে এলো। তারপর শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল। তৃনয় এদিকে তাকায় না। তার সম্পুর্ন মনোযোগ খাতায়। তন্নী পড়েছে মহা মুশকিলে। কথা বললে কি সমস্যা? এমন গোমড়া মুখো হয়ে থাকার কোনো মানে আছে? এর থেকে দু চারটে থাপ্পড় দিয়ে দেওয়া তো বেশি ভালো মনে হচ্ছে! কথা কিভাবে বলবে? কি দিয়ে শুরু করবে? সে তৃনয়ের ফোনটা হাতে নিল। কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো,
“ আম্মার সাথে কথা বলবো। ফোন দিয়ে দাও! ”
তৃনয় ফোনটা হেঁচকা টানে হাত থেকে নিল। কল দিয়ে পুনরায় ঠাস করে হাতে রেখে দিল। তন্নী কেঁপে উঠলো। সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে এলো ব্যালকনিতে। প্রথমে কতক্ষন আসমার সাথে কথা বলে নুরজাহান কানে নিলেন ফোনটা। জিজ্ঞেস করলেন,
“ ভালা আছস, বু? ”
তন্নী ন্যাকা স্বরে নাক টানে,
“ না। তোমাদের জামাই আমার সাথে কথা বলে না! ”
“ ক্যান? ঝগড়া করেছিস নাকি, মা*গী? ”
“ আরে না। ওর বোনের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। কি করবো? ”
তন্নী বুকের অস্থিরতায় কেঁদে ফেললো। দ্রুত হাতে চোখ মুছলো। কি মুশকিল। পৃথিবীর কোনো মেয়ে এরুপ পরিস্থিতিতে না পড়ুক। নুরজাহান অপর পাশ থেকে বলতে লাগলেন,
“ কাঁদিস না, বু। হুন তোরে একটা বুদ্ধি দেই! একটু সাইজগোজ কর। বেডা মাইনষের মন বেশি কঠিন না। বল, আর কখনো করবো না। তাইলেই তো হয়। ”
তন্নী ধমক দিল,
“ তাকাচ্ছেই তো না। সাজলে কি হবে? বুড়ি, ভালো কিছু বলো! ”
নুরজাহান জিজ্ঞেস করলেন, “ তোরে বকাঝকা করছে? ”
“ না। ”
নুরজাহান হেসে ফেললেন শব্দ করে। তন্নী ভ্রু কুঁচকে তাকালো এপাশে। চোখের জল গালে দাগ ফেলেছে। তিনি হাসির মধ্যেই বললেন,
“ বলদ। তাইলে ভয় পাইস না। করবো না কিছু। কাছে যা। গিয়ে জড়ায়া-টরায়া ধর। রাগ কমে যাবে। ”
তন্নী ফোনটা কেটে দিল। কতক্ষন ঘুটঘুটে আকাশটা দেখলো। তারপর ফিরে এলো ধীর পায়ে। তৃনয়ের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিল,
“ তোমার ফোন। ”
তৃনয় গমগমে গলায় বললো, “ যেখানে ছিল সেখানে রাখো! ”
তন্নী সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো। তারপর দিকবিদিক না পেয়ে তৃনয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। বললো,
“ আর কখনো কারো সাথে ঝগড়া করবো না। সত্যি! ”
তৃনয় ওকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো,
“ ছাড়ো! খাতা দেখছি আমি! ”
“ পরিক্ষার খাতা? ”
“ হ্যাঁ! ”
তন্নী এক হাতে খাতাটা বন্ধ করে দিল। সেটার উপর হাত চেপে তৃনয়ের চোখে তাকালো,
“ গরম মেজাজে খাতা দেখলে ঠিকঠাক নাম্বার দিতে পারবে না। ”
তৃনয় ভ্রু কুঁচকে নিল,
“ তুমি সরবে নাকি? ”
“ না। তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেনো? ”
সে কান্না করার ভাণ ধরলো। চোখগুলো পিটপিট করলো। তৃনয় কতক্ষন মুখটা দেখলো। সেদিনের মতো আজকেও তার ভীষণ গরম লাগছে। ও তন্নী কে ধরে চেয়ারটা পেছনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। সে বসলো মুখোমুখি হয়ে। তন্নী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃনয় জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি এ বাড়িতে কিসের পরিচয়ে এসেছো? ”
“ তোমার বউ! বাড়ির বড় বউ! ”
“ বাড়ির বড় বউ না। একমাত্র বউ। তোমাকে কেউ কিছু বললে তুমি আমাকে বলবে। আর তোমাকে কেউ কিছু বলার সাহস কখনোই পাবে না। অন্তত আমি থাকতে তোমাকে কটু কথা বলার সাহস আমি কাউকে দেব না। ঠিক তোমার ক্ষেত্রেও তাই। ঘর ঠিক না থাকলে লোক ঘরের মানুষের কথা শুনবে না। তর্ক করাটাই মুখ্য নয়। ভালোভাবেও তো বোঝানো যায়। তুমি কোথায় পুরো সংসার আগলে রাখবে তা না করে নিজেই প্যাঁচ লাগিয়ে দিচ্ছো! ”
তন্নী নাক টানলো দুঃখে, “ আমি একা একটা সংসার কিভাবে সামলাবো? ”
তৃনয় ওর হাতে হাত রাখলো,
“ আমি আছি না? তুমি তোমার পাশে সবসময় আমাকে কল্পনা করবে। যেকোনো সমস্যায় আমাকে স্মরণ করবে। আমি কি তোমাকে ছেড়ে যাব? ”
“ যাবে না? ”
“ কখনো না। ”
“ আচ্ছা! আর হবে না। ”
“ সংসার জীবন বড্ড কঠিন, আফরোজা। তোমাকে বুঝতে হবে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে জবাব দেওয়া উচিত। এবং সঠিক জবাব অবশ্যই বড়দেরকে দিতে হয়। ছোটদেরকে বোঝাতে হয়। বুঝিয়ে বলতে হয়। ছোটদের সাথে মান, অভিমান, অসম্মান বিষয়টা খাঁটে না। ছোটকে স্নেহ করতে হয়। তাঁদের ভুল হাতে ধরিয়ে, শুধরে দিতে হয়। ওদের সাথে তর্ক করতে হয় না। তারপরও অসম্মান টের পেলে চুপচাপ ফিরে আসতে হয়। তর্কটা মুখ্য নয়। ”
তন্নী বোকা, নিষ্পাপ কন্ঠে আওড়ালো, “ বড়দেরকে বললেও তো সেটা অসম্মান হয়। বেয়াদবি হয়! ”
তৃনয় অতিষ্ঠ হয় না। ওর মুখটাকে দেখে গভীর চোখে, “ আমি বলেছি সঠিক জবাব। অবশ্যই যা তা নয়। ”
“ বুঝেছি। ”
তন্নী এদিকে তাকালো। তৃনয় আর জবাব দিল না। তখন থেকেই এভাবে তাকিয়ে আছে। কেমন ভাবে যেনো পরিমাপ করতে লাগলো সে তন্নী কে। ঘন ভ্রুয়ের নিচে তলোয়ার শানিত দুটি আঁখি দেখে তন্নী ঘাবড়ে গেল। চোখের দৃষ্টিতে মাদক মেশানো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ঝটকায় তৃনয় বসে থাকা চেয়ারটা সরিয়ে দিল। এগিয়ে এলো তন্নীর দিকে। তন্নী পা তুলে পিছিয়ে যেতে লাগলো ভয়ে। হুট করে ঘরের আলো নিভে এলো। তন্নী ভীষণ চমকালো। অন্ধকার আঁধারে সে টের পেল লোকটা বিছানায় উঠেছে। তারপর কথাবার্তা ছাড়াই তৃনয় তন্নী কে কাছে টেনে নিল। ভীষণ কাছে, সম্পর্কের অতল গভীরে। তন্নীর শরীরে লজ্জার আকাশ নামলো। সে কাঁপতে কাঁপতে গুটিয়ে গেল একপ্রকার। জড়তায়, হাঁসফাঁসে বাকী সময় সে আর চোখ খুললো না। উন্মুক্ত গলায় তৃনয়ের বেসামাল ঠোঁটের স্পর্শে, লাগাম ছাড়া হাতের ছোঁয়ায় আগাম ঘুর্নিঝড়ের পুর্বাভাস তন্নী কে সুস্থ থাকতে দিল না। সে রাতে তন্নী প্রথমবারের মতো ঘুমোতে পারলো না। নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অস্থিরতা, ভিন্ন উৎপীড়নের জ্বালা ওকে ঘুমোতে দিল না।
চলবে….!