#আমার_বধু।
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১২
পরেরদিন শুক্রবার। তৃনয় কাজে যাবে না। সে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে খাটে বসে আছে। তন্নীর খোঁজখবর নেই। তৃনয় ক্ষনে ক্ষনে আশ্চর্য হচ্ছে। একটু কি শুয়ে বসে থাকা যায় না? একটা মানুষ এতটা চঞ্চল কিভাবে হয়? বিশ্রামেরও কি দরকার পড়ে না? তার পাশের ঘরটা জুঁইয়ের। তন্নী সেখান থেকে এলো হাসতে হাসতে। ঘরে ঢুকে গম্ভীর বসে থাকা তৃনয়কে দেখে হাসি থামিয়ে ফেললো। কোমড়ের কিছুটা জায়গা দেখা যাচ্ছে। ফর্সা শরীরের জায়গাটা একটু বেশি উজ্জ্বল। তৃনয়ের চোখ আগে সেখানেই গেছে। ঠিকঠাক শাড়িটা পর্যন্ত পড়তে পারে না। ঘর থেকে বের হলে পেঁচিয়ে, গুছিয়ে মাথায় ঘোমটা টানে। বস্তার মতো। তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,
“ এতো হাসাহাসি কেনো? ”
তন্নী মাথার কাপড় ফেলে দিল। সকাল সকাল ভেজা চুল খোঁপা করে রেখেছিল। সেগুলোও উন্মুক্ত করলো দুই হাতে। হেঁটে গিয়ে চিরুনি হাতে নিয়ে বললো,
“ তোমার জন্য কি হাসতেও পারব না? জুঁইয়ের ঘরে ছিলাম। ও কলেজের একটা ঘটনা বলছিল তাই হাসছিলাম। ”
তৃনয় চোখ জড়ো করলো। এর মধ্যে ননদ ভাবী মিলেও গেছে? সে বসে থেকেই পুনরায় গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ ঘরে আমি আছি তোমার খেয়াল নেই? ”
তন্নী হতভম্ব আওড়ায়, “ তো কি করবো? ”
“ প্রশ্ন, প্রশ্ন আর প্রশ্ন। খারাপ লাগছে? ”
লম্বা চুলে বিশাল জট বেঁধেছে। তন্নী বিরক্ত মুখে জবাব দিল,
“ খারাপ? ” তারপর মনে পড়তেই একটু ইতস্তত করলো, “ হ্যাঁ। একটু একটু। আমার মনে হয় জ্বর আসবে! জানো, আজ সকালে শরীর কাঁপছিল। ”
তৃনয়ের সামনে তার কোনো গোপনীয়তা নেই। কি সুন্দর সরাসরি সব বলা যায়। তৃনয়কে তন্নীর এজন্য আরো বেশি ভালো লাগে। তৃনয় উঠে দাঁড়াল, “ তবুও তো টই টই কমছে না। ”
“ কোথায় যাচ্ছো? ”
“ ঔষধ আনতে। খেয়ে নিলে আর জ্বর আসবে না! ”
তন্নী আয়নায় ঠোঁট বাকায়। অদ্ভুত তার কন্ঠস্বর, “ তোমার কপাল কি কখনো সোজা হয় না? ”
তৃনয় ফোন পকেটে রাখা বাদে ওর দিকে তাকালো। ফল স্বরুপ আরো কয়েকটা ভাঁজ পড়লো কপালে। জিজ্ঞেস করল,
“ কেনো? কপালে কি হয়েছে? ”
তন্নী আয়নার সামনে থেকে এসে তৃনয়ের সামনে দাঁড়াল। পা উঁচু করে কপালটা স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হতেই তৃনয় তার কোমড় জড়িয়ে ধরে উঁচু করলো। সে কপালটা ছুঁয়ে বললো,
“ সবসময় এতগুলো ভাঁজ থাকে। আমার এটা পছন্দ না। এভাবে সোজা রাখবে। ”
সেদিকে তৃনয়ের খেয়াল নেই। সে একধ্যানে গলার লাল জায়গাটায় তাকিয়ে থেকে মুখ এগিয়ে নিল সেখানে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেতেই তন্নী গলা জড়িয়ে ধরলো। হেসে উঠলো সে। চুল খামচে বললো,
“ সুড়সুড়ি লাগছে আমার! ”
তৃনয় মাথা উঠালো। বিরক্ত হয়েছে নাকি রাগ করেছে বোঝা গেল না। তার মতিগতি টের পেয়েই ঠোঁট গুলো হাত দিয়ে চেপে ধরলো তন্নী। বাইরে দেখিয়ে বললো,
“ দরজা খোলা আছে। জবা এসে পড়বে। ছাড়ো। ”
তৃনয় ফের কোমড়ে চাপ দিতেই তন্নী খিলখিল করে হেসে উঠলো। বললো,
“ ভর্তা হয়ে যাচ্ছি তো! ”
তৃনয় ওকে নামিয়ে দিল। কপালে চুমু খেল।
“ বাইরে যাচ্ছি। কিছু লাগবে তোমার? ”
তন্নী আবদার করলো,
“ আমাকেও একটু বাইরে নিয়ে যাবে? একঘেয়েমি লাগছে। ”
“ আজ যাবে? ”
তন্নী মুখ ঘুরিয়ে নিল, “ তাছাড়া আর কোনদিন? কাল থেকে তো কলেজ শুরু। ”
তৃনয় একটু ভেবে বললো,
“ আচ্ছা। বিকেলে। ”
তন্নী খুশি হয়ে গেল। তৃনয় বের হয়ে গেলে সে চুলে মনোযোগ দিল পুনরায়। একা থাকলে বাড়ির কথা মনে পড়ে। মায়ের কথা, দাদীর কথা! পুকুর পাড়ের কথা। তন্নীর তখন কি যে খারাপ লাগে। সে কাউকে বলতে পারে না। তৃনয়কে বললে তৃনয় একটু আধটু স্বান্তনা দেয়। তাতে কেবল সাময়িক কষ্ট লাঘব হয়। দুঃখ কি আর ভোলা যায়? মেয়েদের জীবনটা কত কষ্টের। তন্নীর বর ভালো বলে। নইলে তন্নী কষ্টে দুঃখে কবেই মরে যেত। এতদিন পর্যন্ত সংসার করতে হতো না। এত আহ্লাদ পাওয়ার কথাই ছিল না। রান্নাবান্না সে করে না। সে কাজের মেয়েটাকে টুকটাক সাহায্য করে। তার ঘাড়ে সবাইকে খাওয়ানোর আর রান্নাবান্নার তদারকির দায়িত্ব। রোজিনা, জুঁই ভীষণ ভালো ব্যবহার করে। জবা খুব মিশুকে। তৃনয় না থাকলেই সে এখানে এসে বসে থাকা। চুল আঁচড়ানো শেষ হলে তন্নী শুয়ে পড়লো। এতক্ষণ টের পায় নি। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। সকালে আরো খারাপ লাগছিল। তন্নী তাড়াহুড়ো করে কতগুলো ভাত খেয়েছে। খাওয়ার উপরে কথা নেই। ভাত খেতেই শরীর চাঙা হয়ে গেছে। শুয়েই সে ঘুমিয়ে পড়লো। দাদী বলেছিলেন, “ বিয়ের বছর বেশি ঘুম পাবে। ” কথাটা সত্য। কিন্তু রাতে সজাগ থাকার ফলে ঘুম পাবে এটা সে জানত না। দাদী তো এটা বললেন না।
***
তন্নী তৃনয়ের কথামতো বিকেলে তৈরি হলো। চুল আঁচড়ে খোঁপা করলো। মস্ত খোপাটা ঢিলে হয়ে পড়লো ঘাড়ের উপর। সিঁথির দু পাশে কয়েকটা চুল বের করা। আকাশী রঙের শাড়িটার পাড় গাড় নীল। বিয়েতে পেয়েছিল শাড়িটা। সে চোখে কাজল পড়লো, ঠোঁটে লিপস্টিক। কানে একজোড়া ঝুমকা। তন্নী আয়নায় তাকালো। সুন্দর লাগছে। তৃনয় দেখে কি বলবে? সুন্দরী নাকি রুপবতী? অবশ্য তৃনয় সেভাবে কিছু বলেই না। মাথার খোঁপা টা খালি খালি লাগছে। তন্নী উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল মেলে ধরলো। আয়নার সামনে আরেকটু ঢং করে তারপর বের হলো ঘর থেকে। তৃনয় নিচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
তন্নী জানালা দিয়ে উঁকি দিল। তৃনয় দরজাটা খুলে দিল। মেয়েটা হা করে ওকে দেখতে দেখতে ভেতরে বসলো। তৃনয়ের শরীরেও আকাশী রঙা শার্ট। কালো প্যান্টের সাথে সেটা ইন করা। হাতের কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা শার্টের হাতা। কব্জিতে কালো বেল্টের ঘড়ি, গোছানো চুল। তন্নী নড়েচড়ে বসলো। নিজের মুগ্ধতা একপাশে রেখে জিজ্ঞেস করল,
“ আমাকে কেমন লাগছে? ”
তৃনয় সামনে তাকিয়ে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে উত্তর দিল ছোট করে,
“ সুন্দর। ”
তন্নী মুখ গোমড়া করলো। সুন্দর তো সেদিনও বলেছিল। আর কিছু জানে না বোধহয়। ও কানের পাশে চুল গুজলো,
“ তুমি আমার দিকে তাকাও নি। শুধু সুন্দর বাদে আর কিছু নেই? ”
তৃনয় মিররে ওর অভিমানী, গাল ফোলানো মুখটা দেখলো। চোখ ভর্তি কালো কাজল। তৃনয়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় অচিরাৎ। সে ঢোক গেলে। তারপর ধীম আওয়াজে আওড়ায়,
“ প্রাণ-নাশিনী! ”
তন্নী চোখ ছোট করে ওর দিকে তাকালো। বুঝলো না কথাটা। স্পষ্ট করে বললে তো! গাড়িটা শোলাকিয়া পাড় হয়ে, মসজিদের সামনে দিয়ে গুরু দয়ালের সামনে পর্যন্ত পৌঁছালো। মুক্ত মঞ্চের সামনে একটা ফুলের দোকান। সেখানে কয়েকটা বেলি ফুলের গাজরা ঝুলছে। তৃনয় দোকান থেকে চোখ সরিয়ে তন্নীর দিকে তাকালো। খোঁপা খালি। তৃনয় কি করবে বুঝতে পারল না। তন্নী বড়বড় চোখে আশপাশ দেখছে। কত কত ছেলেমেয়ে। কাঁধে মাথা রেখে বসেছে কেউ, কেউ কেউ ফুচকা খাচ্ছে। তৃনয় ডাকলো,
“ আফরোজা? ”
তন্নীর ধ্যান ভঙ্গ হয়, “ হু? হ্যাঁ বলো। ”
“ ফুল কিনবে? ”
তন্নী আশপাশ দেখে বলে,
“ কোথায়? ” তারপর দোকানটা দেখতে পেয়ে খুশি হয়। উৎফুল্ল আননে বলে,
“ হ্যাঁ। একটা বেলি ফুলের মালা আনবে। খোঁপায় দেব। ”
তৃনয় বের হয়ে যায় গাড়ি থেকে। তন্নী নিজেও বের হলো। তবে সেখান থেকে নড়লো না। চুপচাপ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তৃনয় কতগুলো গোলাপ এনেছে। টকটকে লাল গোলাপ। একটা বেলীর গাজরা। সেগুলো পেয়ে তন্নী খুব খুশি হলো। বুকে চেপে ঘ্রাণ শুঁকে নিল। তারপর বললো,
“ এটা তো মাথায় দেয়। খোঁপায় পড়িয়ে দাও। ”
তৃনয় ইতস্তত করে, “ আমি? ”
“ আর কেউ আছে? দাও। ”
তন্নী ওর দিকে পিঠ করে দাঁড়াল। তৃনয় বেশ সময় নিয়ে বহু কষ্টে সেটা খোঁপায় প্যাঁচিয়ে দিল। তন্নী গোলাপ গুলো দেখছে। পড়ানো শেষ হলে তৃনয় বললো,
“ নাও পারফেক্ট। ফুচকা খাবে? ”
তন্নী মাথা নাড়ে। তৃনয় গিয়ে ফুচকা আনলো। তন্নী বেশ কতগুলো খেল। খাওয়ার সময় সামনের চুলগুলো ওকে বেশ বিরক্ত করলো। তৃনয় মায়া হাতে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়েছে। তারপর গাড়িটা পুনরায় পুরাতন বই বাজার পার হয়ে আখড়া বাজার যেতেই সে পেট চেপে ধরলো। ব্যথা করছে। তৃনয় উদ্বিগ্ন হলো। বাড়িতে চলে যেতে চাইলে তন্নী না করলো। আকাশটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বোধহয় বৃষ্টি আসবে। তন্নীর বহুদিনের শখ বরের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার। সে নিজের পেটব্যথা ভুলে গেল। জানালা দিয়ে মাথা বের করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাস্তার লোকজন কমে যাচ্ছে। সবাই নিজেদের বাইরের দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। তন্নী বইয়ে পড়েছে এমন বৃষ্টিকে বলে ইলশেগুঁড়ি। সে মুখটাকে উঁচু করলো। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিল তার সুশ্রী মুখটা। গৌড়াঙ্গ বাজার পৌঁছতেই জোরে বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। খুশিতে তন্নী চিৎকার দিল। মুখ, হাত ভেতরে এনে তৃনয়ের বাহু জড়িয়ে ধরলো,
“ চলো না বৃষ্টিতে ভিজি! ”
তৃনয় আকাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“ অসময়ের বৃষ্টিতে জ্বর আসবে। ”
“ আসবে না। চলো… আচ্ছা আমি একা যাই? ”
তৃনয় তাকালো তার দিকে। এমন আকুল নয়নে তাকিয়ে থাকলে না করা যায়? সে আস্তে করে মাথা নাড়লো। তন্নী চটপট বের হয়ে গেল। দু কদম গিয়ে ফিরে এসে সিটের সামনে রাখা ফুলগুলো তুলে নিল। জানালা দিয়ে পুনরায় বললো,
“ চলো না? ”
তৃনয় এক ভ্রু উচু করলো, “ তোমার কাছে কে বেশি প্রিয়? আমি নাকি বৃষ্টি? ”
তন্নী লাজুক হাসে। বড় বড় জলকণা তার মুখ, গাল বেয়ে ঠোঁটে পড়ে,
“ তুমি! তুমি পাশে বলেই তো বৃষ্টি সুন্দর। ”
তৃনয় কিভাবে যেনো হাসে। তন্নীর চোখ জুড়িয়ে যায়। সে গাড়ির সামনে ফুলগুলো হাতে নিয়ে দু হাত মেলে দাঁড়ায়। আকাশের পানে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। চোখগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তৃনয় থুতনিতে হাত রেখে ওকে দেখলো বহুক্ষণ। একটা বৃষ্টি কন্যার বৃষ্টি বিলাস তাকে পুনরায় ডুবিয়ে মারলো। ভিজে ঠোঁটে মিশে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছে ওকে আক্রমণ করলো। সে ফোন বের করলো। মাথায় বেলি, বুকে গোলাপ জড়িয়ে ঝুম বৃষ্টির নিচে শাড়ি পড়া ভেজা কায়ার মেয়েটার একটা ছবি তুললো সময় নিয়ে। তারপর সেটা ফোনের হোম মেনুতে ওয়াল পেপার হিসেবে সেট করলো। থুতনিতে আঙ্গুল রেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তারপর সে বের হয়ে এলো। দরজা লাগিয়ে সেখানে হেলান দিল। অসময়ের, অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি তাকেও ভিজিয়ে দিল। আকাশ রঙের শার্টটা জড়িয়ে পড়লো গায়ে। একটু আগে বলেছে পেট ব্যথা করছে। এখন দেখো? কীভাবে হাসছে? এ মেয়ের বুঝি কোনো কষ্ট নেই? তৃনয়ের মনে হলো তন্নী ওকে কানে কানে বলছে, “ তুমি পাশে থাকলে আমার কোনো কষ্ট নেই। ”
তারপর সে একধ্যানে দেখে গেল তন্নী কে। মুগ্ধ, অপলক দৃষ্টিতে। বৃষ্টির সুরে সুরে গান বাজলো,
“ এই ভালো এই খারাপ
প্রেম মানে মিষ্টি পাপ।
চলো মানে মানে দিয়ে ফেলি ডুব,
তুমি আমি মিলে।
দু’জনেই মনটাকে,
বেঁধে ফেলি সাতপাকে।
চলো ছোটখাটো করি ভুলচুক,
তুমি আমি মিলে।
সাজিয়েছি ছোট্ট একফালি সুখ,
রাজি আছি আজকে বৃষ্টি নামুক।
তুমি আমি ভিজবো দু’জনে খুব,
ভরসা দিলে। ”
চলবে…!