#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১৩
বিয়ের জীবন ভালোই কাটছে। ঝগড়া, খুনসুটি, আদরে আদরে তন্নীর বিবাহিত জীবন দারুন উপভোগ্য। সেদিন রাতে তৃনয় ল্যাপটপের সামনে বসেছে। কথা বলতে গেলে তো একটা টপিক লাগবে। তন্নীর এখন ঝগড়া করতে মন চাইছে। সে চুলে বেনি করতে করতে আয়নায় তাকালো। কি মনে করে যেনো হেসে ফেললো। তারপর তৃনয়কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
“ সেদিন যে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল তার কোনো প্রেমিকা ছিল বুঝি! ”
তৃনয়ের হাতটা কিছু মুহুর্তের জন্য থামলো। পুনরায় চলতে শুরু করলো। উত্তর এলো,
“ নাহ। ”
ধুর! হলো না। তন্নী পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“ বিয়ের আগে তোমার সত্যিই কোনো পছন্দ ছিল না? প্রেমিকা ছিল না? ”
তৃনয় চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। একজন খাটের এপাশে, আরেকজন ওপাশে। তৃনয় ঠোঁট কামড়ে ছেড়ে দিল,
“ তোমার তো প্রেমিক ছিল। তা আমি জানি। ”
তন্নী আঁতকে উঠলো, “ মোটেই না। আমি এসব হারাম কাজকর্ম জীবনেও করি নি। কসম…. ”
“ উহু। কসম কাটতে হবে না। সত্যি জানি আমি। ”
তন্নী হাতের চিরুনী উঁচিয়ে ধরলো,
“ একদম বাজে অপবাদ দেবে না। আমি কখনো প্রেম করি নি। ”
তৃনয়ের চোখদুটো ধুর্ত। সে কপট হেসে বললো,
“ তাহলে রবিউল কে ছিল? ”
নামটা শুনে তন্নীর একটু আজব লাগলো প্রথমে। তারপর নিজের মনোভাব মনে আসতেই ঠোঁট উল্টে বমি এলো। মুখটা হতভম্ব হলো। ওর নাম তৃনয় জানল কিভাবে? সে প্রতিবাদ করলো মিনমিন করলো,
“ ওকে দেখলে সবার মতো লাগত না। আমি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারি নি। বোধহয় একটু আধটু পছন্দ ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো, একদম কসম করে বলছি, এখন ওর কথা ভাবলেও বমি পায়। আমার তো তুমি আছো। কোথায় বাঘ আর কোথায় রাম ছাগল। ইশশ! ”
শেষের দুটি লাইন তন্নী লজ্জা লজ্জা ভাব করে বললো। তৃনয় ভ্রু দুটো কুঁচকে রাখলো। উঠে বিছানায় বসলো। তন্নী কে পাশে ইশারা করলো বসার জন্য। তন্নী বেনীর শেষপ্রান্তে ফিতে বাঁধতে বাঁধতে জানতে চায়,
“ কেনো? ”
“ বসো। তোমার সাথে কথা বলি। ”
তন্নী বসলো না। উল্টো বললো,
“ তোমার ফোনটা দাও। শিলার সাথে একটু কথা বলবো। ”
নাম্বার বলে দেওয়ার পর তৃনয় ফোন দিয়ে দিল। শিলার মা ফোন ধরলো। তন্নী ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। শিলা ফোন কানে নিয়েই উচ্ছসিত হলো,
“ আমি আরো ভাবছিলাম জামাই পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছিস! ”
তন্নী হেঁসে ফেললো, “ না রে। বাপের বাড়ির কাউকে ভোলা যায় না। ”
শিলা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“ তুই ভালো আছিস, তন্নী? ভাইয়া কেমন? ”
তন্নী আড়ে আড়ে সেদিকে তাকায়। তারপর মুগ্ধতায় উপচে পড়া চোখ নিয়ে পুনরায় হেসে ফেলে। উত্তর দেয়,
“ হ্যাঁ। অনেক ভালো। তোর ভাইয়া ভালো না থাকলে আমার আর ভালো থাকা হতো না। ”
“ ভালো হলেই তো ভালো। ”
তন্নী ঠোঁট কামড়ে বললো,
“ রবিউলের কি খবর রে? ”
শিলা বোকা বনে গেল। একটু চুপ থেকে ফুঁসে উঠলো,
“ তোকে জুতা দিয়ে পেটানো দরকার। বিয়ের পরেও এসব জিজ্ঞেস করছিস? ”
তন্নী উল্টো ধমক দিল, “ হোপ! বেশি বুঝিস? আমি আমার জামাইকে ভালোবাসি। জান, প্রাণ এবং কলিজা দিয়ে। ঐ মদনটার কথা হঠাৎ মনে পড়লো। নিজের উপর নিজের রাগ লাগছে! ”
শিলা দমে গেল। স্বাভাবিক হলো তার কন্ঠস্বর,
“ ওর কথা জানি না এখন। ক’দিন আগে কোন মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। শালা কি ভালো ছিল? ”
“ কি সুন্দর সুন্দর কথা বলতো মনে আছে তোর? ”
“ থাকবে না কেনো? এ্যাই তন্নী? সুখবর কবে শুনবো? ”
তন্নী লজ্জা পেল।
“ ধ্যাত। বছর খানিক যাক। তারপর। আচ্ছা রাখি। ও বসে আছে। ”
শিলা ঢং করে বললো, “ আচ্ছা যাও। ”
ফোনটা রেখে তন্নী বসলো তৃনয়ের পাশে। তৃনয় বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করল,
“ তোমার কোনো ফিউচার প্ল্যান নেই? ”
“ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? ”
“ হ্যাঁ। ”
“ আছে তো। ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছাড়া মানুষ আছে নাকি? ”
তৃনয় জানতে চাইলো, “ শুনি তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা! ”
তন্নী হাসলো। পা দুটো তুলে বিছানায় গোল বাবু হয়ে বসলো। আঁচলের উপর বসেছে টের পেয়ে সেটা সরিয়ে দিল। তারপর হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
“ আমাদের চারটা বাবু হবে। ”
তৃনয় ভ্রু তুললো, “ চারটা? ”
“ হুম। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে। যাতে ওদের ছেলেমেয়েদের ফুফু থাকে, খালা থাকে, চাচা থাকে আবার মামাও থাকে। এই যে তোমার একটা ভাই নেই। আমার ছেলেমেয়ে চাচা পাবে? আমার একটা ভাই নেই। আমার সন্তানরা মামা পাবে? তাই দু’টো ছেলে দুটো মেয়ে। ”
তৃনয় মাথা দুলিয়ে স্বায় জানায়, “ ঠিক। উত্তম বুদ্ধি। ” তারপর জানতে চায়, “ যদি এমন মিলিয়ে না হয়? ”
তন্নীর কাছে উত্তর আছে,
“ হবে। হবে না কেনো? আগেভাগে অলুক্ষনে কথাবার্তা বলো না তো। যতদিন মিলিয়ে না হবে ততদিন বাচ্চা নিতেই থাকবো। প্রথমেই পাঁচটা ছেলে হয়ে গেলে পুনরায় মেয়ের জন্য নেব। চলতেই থাকবে…. ”
কথা শেষ হলো না। তৃনয় আটকে দিল,
“ তোমার শরীরে কুলোবে? মরে যাবে। ”
“ তুমি খরচাপাতি দিতে পারবে কিনা বলো! ”
“ সেটা বাদ দাও। ছেলেমেয়ের সংখ্যা হিসেব করেছো? তোমার ঘরেই তো ফুটবল টিম হয়ে যাবে। ”
তন্নী নিজের হাতে নিজে চাপড় দিল, খুশি হলো কিছু একটা ভেবে, “ এটা তো ভেবে দেখি নি। তুমি জানো আমার ফেবারিট খেলা ফুটবল? একটা দলে থাকে এগারো জন। আমাদের যদি বাইশটা ছেলেমেয়ে হয়, তাহলে ওরা নিজেরা নিজেরাই খেলতে পারবে। উফফ! একদম জমে যাবে। তাই না বলো! ”
তৃনয় অতিষ্ঠ চোখেমুখে আওড়ালো,
“ আমার উচিত ছিল একটা সুস্থ মেয়েকে বিয়ে করা। ”
“ কোনো সুস্থ মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতো? ”
“ তার মানে তুমি পাগল? তাই না? ”
তন্নী থতমত খেল। কি বলেছে নিজেরই বোধগম্য হলো না। তৃনয় উঠে পড়লো। ল্যাপটপ গুছিয়ে রাখতে লাগলো। তন্নী পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি কোন বিষয়ের মাস্টার? ”
তৃনয় বিরক্ত হয়ে চোখ বুজে ফেললো, “ মাস্টার কি শব্দ? ”
তন্নী মুখ ভেটকায়, “ ঐ একটা হলেই হলো। বলো না। ”
“ ম্যাথমেটিক্স অর্থাৎ গনিত। ”
“ ওহ হো। এর জন্যই মুখটা এতো বাঁদর মুখো… ” বলতে বলতে সে মুখে হাত চাপলো, “ সরি সরি। ভুল হয়ে গেছে। ”
তৃনয় ওর সাথে আর কথা বললো না। চুপচাপ ঘরের লাইট নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। তন্নী ঠোঁট কামড়ে বসে থেকে শুয়ে পড়লো। তৃনয় শুয়েছে সটান হয়ে। সে কতক্ষন এপাশ ওপাশ করে তৃনয়ের টি শার্ট টেনে ধরলো,
“ এ্যাই মাস্টার? ”
কন্ঠে আকুতি। তৃনয় বুঝতে পেরে শরীরের উপর আধশোয়া হলো। গালে হাত রেখে ঠোঁটে সময় নিয়ে চুমু খেল। সরে আসতে গেলেই বুকের কাছটা তন্নী আঁকড়ে ধরলো। হালকা আলোতে তৃনয় ওর চোখের দিকে তাকালো। প্রশ্ন নিয়ে। তন্নী হাসলো। তারপর নিজের শরীরটা তৃনয়ের উপর উঠিয়ে দিতে দিতে গাল আঁকড়ে দুষ্টুমি করলো,
“ মাস্টার আমার ইঙ্গিত বুঝে না! ”
পুনরায় সেদিনের মতো ঘরটা অন্ধকার হয়ে এলো।
***
ডাইনিং টেবিলে বসে কথাবার্তা তৃনয়ের তেমন পছন্দ না। জুঁই জবা বের হয়ে গেছে। রান্নাঘরে রোজিনা। তন্নী তৃনয়কে খাবার দিচ্ছে। তৃনয় হাতের পরোটা শেষ করার পর তন্নী আরেকটা তুলে দিল। ও থামাতে চাইলো,
“ আরে আর খাবো না। ”
তন্নী চোখ রাঙায়, “ শেষ করো। দিয়েছি না? ”
তৃনয় দুই ভ্রু উচু করে তাকালো,
“ তুমি আমাকে শাসন করছো? ”
“ কিসের শাসন? শাসনও বোঝে না, আদরও বোঝে না। ”
তৃনয় মুখটা নামিয়ে আস্তে করে বললো,
“ আদর? আদর বুঝি না কিভাবে? সারারাত না করলাম। ”
তন্নী লজ্জা পেলেও প্রকাশ করে না, “ অসভ্য! ”
তৃনয় আরো কিছু বলার আগে সেখানে রোজিনা হাজির হলেন। তার মুখের কথা মুখেই আটকে রইলো। তিনি তরকারির বাটিটা রাখতে রাখতে বললেন,
“ তোর চাচাতো ভাই বউকে মেরেছে শুনেছিস? ”
তৃনয় জিজ্ঞেস করলো, “ কেনো? ”
উনি চেয়ারে বসলেন,
“ বউ কথা শোনে না। বউকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ”
তৃনয় মুখে পরোটা তুলতে তুলতে বিরবির করলো,
“ বউকে শায়েস্তা করতে মারতে হয় নাকি? ”
পাশে তন্নী দাঁড়িয়ে থাকায় সে শুনতে পেল। সে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
“ মারতে হবে কেনো? তোমার মতো কথা না বললেই তো হলো। ”
তৃনয় মাথা তুলে ওর দিকে কিভাবে যেনো তাকালো। চোখদুটোতে দৃঢ়তা। তন্নী ঘাবড়ে গেল। সে এঁটো বাসন গুলো তুলে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল। ঠিকই তো বলেছে। রেগে বোম হয়ে থাকলে আর কথা না বললে বউ কেনো, বউয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী সিধে হয়ে যাবে। সে যেতেই রোজিনা ফের বললেন,
“ তোর ফুপি আসবেন। বড়জন। ”
“ আসুক। এখানে আসবে? ”
“ হ্যাঁ। আমার বাবা ভয় করে। ”
“ কেনো? ”
“ ওনার মুখ ভালো? বেফাঁস কথা বলে। তোর বউটাও ঠাসঠুস উত্তর দেয়। বিয়েতে কিছু নিলি না বলে তোর ফুপির রাগ। তন্নী কে কিছু না বললেই হলো। ”
তৃনয় চুপচাপ খেল। জবাব দিল না। কিছু বললে ওনাকে দিয়েই শুধরাবে সে। মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করলে, সেই বমি খাওয়ানোর জন্য তৃনয় আছে। সেটা তন্নী হোক কিংবা ফুপি। ছাড় দিলেই পেয়ে বসে। মানবজাতির বদ অভ্যাস। ওদের জন্য এটাই ঠিক।
চলবে….!