আমার বধু পর্ব-১৪

0
4

#আমার_বধু!
#আফসানা_ইমরোজ_নুহা
#পর্ব_১৪

ফুপি এলেন দুপুরের কিছুটা আগে। এসেই ভরপেট খাওয়া দাওয়া করেছেন। মুখটাকে কেমন বিকৃত করে রেখেছেন। তন্নী ওনার পাশেও যাচ্ছে না। থাকুক ওনার মতো উনি। মুখ দেখেই বিতৃষ্ণা লাগছে। তেতো খেয়েছে নাকি সকালে? একটা মানুষের চেহারা এমন হবে কেনো? বাড়ির বউ কি ওনার ঘাড়ে বসে নাচছেন? তন্নী আশেপাশে গেলেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন কিভাবে যেনো‌। একটা সম্পূর্ণ নতুন মানুষের সাথে এদের শত্রুতা কিসের? কোথায় মিলেমিশে থাকবে, ভরসা দেবে। তা না করে মাথায় উঠে বসে থাকা। তাদের পা ধুয়ে দেওয়ার জন্য ঘরের বউদের জন্ম হয়। আজকাল তন্নীর সেটাই মনে হয়। তৃনয় বাড়িতে এসেছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে এখন উপরে গেছে সে। তন্নী রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছে। তার বাঁ চোখটা লাফাচ্ছে। দাদী বলতেন, চোখ লাফানো ভালো লক্ষণ না। তন্নী একটু দুশ্চিন্তায় পড়েছে। আবার কি ঘটে কে জানে। এ কয়েক মাস তো খুব ভালোই কেটেছে। উনি এরমধ্যে আর আসেন নি। বাড়ি নাকি অনেক দুরে। এতো জার্নি করতে পারেন না। তৃনয়ের ফুফাতো ভাই দিয়ে গেছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে এখন। সাথে রোজিনাও আছেন। ধোঁয়া থালাটা তন্নী রাখলো সবে, এর মধ্যে ডাক এলো,

“ বউ? ও বউ? ”

মেয়েটা চোখ বুজে ফেললো। তন্নী আবার ততো ভালো না। তাকে পীরদের খাতায় ফেলা যায় না। ভালোর সাথে সে খুব ভালো। যাকে ভালো লাগে তার সাথে মেলামেশা, আড্ডাও বেশ হয়। এমনিতে দেখতে পারে না, কিন্তু উপরে উপরে পুজো করা লোক সে না। দাঁত চেপে হজম করলেও মুখ দেখলেই তার বিরক্তি আন্দাজ করা যায়। সে মাথার ঘোমটা ঠিকঠাক করে এগিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

“ কিছু বলবেন? ”

উনি ব্যস্ত হয়ে আওড়ালেন,

“ না না। কি বলবো? তুমি তো আমার ধারে কাছে আসছো না। বউয়ের বোধহয় মানুষ পছন্দ না! তাই না, ভাবী? ”

রোজিনা বোকার মতো হাসলেন। তন্নী চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মানুষ পছন্দ না হলে তাকে ডাকলো কেনো? সে যেচে এসেছে? তবুও সে কথা বললো না। তৃনয় বলেছে, বড়দের সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলা ভালো না। তন্নী ততটাও অবাধ্য এবং খারাপ না। ফুপি এবারে আস্তে করে বললেন,

“ তোমাদের বাড়ি থেকে সত্যি কিছু দেয় নি? ”

গলায় সতর্কিত ভাব। যেনো, কেউ শুনে ফেললে মস্ত পাপ হবে। তন্নী ততো ভাবলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,

“ আপনাদের ছেলে নাকি না করেছে শুনলাম। ”

“ না করলেই কি? না করলে আরো বেশি দিতে হয়। তোমার বাপ নিয়ম জানে না? কিছু দিলে কি আমরা নিয়ে যেতাম? তোমারই তো থাকতো। ” কথা শেষে উনি মুখ ঝামটি দিলেন। অর্থাৎ তন্নীর জবাব ওনার মনঃপুত হয় নি।

“ সেটা বলতে চাইনি… ”

ফুপি মাঝপথে বলে উঠলেন,

“ আপনার বউ দেখি মুখে মুখে উত্তর দেয়। আমাদের সময় ইট মারলেও কথা বের হতো না। ”

রোজিনা অসহায়ের মত তাকিয়ে। কাকে কি বলবেন তিনি? ছেলেটা বাড়িতে। নিশ্চিত একটা কেলেঙ্কারি বাঁধবে। হতভম্ব তন্নী এবারে বললো,

“ আপনি জিজ্ঞেস করছেন তাই আমি উত্তর দিচ্ছি…. ”

“ তুমি তো ভীষণ বেয়াদব। খালি হাতে শ্বশুর বাড়িতে এলে চুপচাপ থাকতে হয় জানো না? এত অভদ্রতা কোথায় শিখলে? ”

“ আমি তো খালি হাতে শ্বশুর বাড়িতে আসার জন্য পাগল ছিলাম না। আমার আব্বা দিতেই চেয়েছিল। আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেনো? আপনাদের ছেলের যদি আমাকে কয়েকটা ফার্নিচার কিনে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকে তবে বিয়ে করলো কেনো? ”

মহিলা হঠাৎ ফুঁসে উঠলেন,

“ কি বেয়াদব মেয়ে, আল্লাহ। শ্বশুর বাড়ির মানুষের দুয়েকটা কথা শুনতে না পারলে তুমি কিসের মেয়ে, হ্যাঁ? মা শিখিয়ে পাঠায় নি? নাকি মা নিজেও এমন! ”

তন্নীর মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। রাগে তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। বিয়ে হয়ে গেলে বাবা মাকে কিছু বললেও মেনে নিতে হয়? অথচ ছোটবেলা একবার মাকে নিয়ে কটু কথা বলায় সে নিজের সাথের একটার হাতে কলম গেঁথে দিয়েছিল। তন্নী মাথা নামিয়ে নিল। চোখ টলমল করছে। আব্বু কেনো ঘরভর্তি জিনিস তাকে দিল না? তার মুখে কথা আটকে এলো,

“ আমার আম্মাকে কিছু বলবেন না। ”

“ তুমি আমাকে হুকুম দিচ্ছো নাকি? বললাম না কিছু। তোমার মাকে কিছু বলার জন্য বসে আছি আমি? একটু ভদ্রতা শেখো। কথায় কথায় উত্তর দেওয়া থামাও। ”

তন্নী জিজ্ঞেস করলো, “ আমি যদি আমার বাড়ি থেকে সব নিয়ে আসি তবে উত্তর দিতে পারব? ”

ওর চোখগুলো লাল। ফুপি রেগে গেলেন,

“ ভাব দেখাও নাকি? নিয়ে এসো। ”

তন্নী সেখানে আর দাঁড়ায় না। ব্যথিত মন নিয়ে সিঁড়িতে পা দেয় সে। ঠোঁট গুলো ভেঙ্গে আসতে চাইছে। সামান্য হোক। তবুও তো ধমক! এভাবে তন্নীর সাথে কেউ কখনো ধমকে কথা বলে নি। তন্নী ঝগড়া করার মতো মেয়ে না। বেশি কথা বলা, বকবক করা, সবার সাথে মিশে যাওয়ার স্বভাব তাঁকে ঝগরুটে বানাতে পারে নি। আম্মা, আব্বা, দাদী ওকে কোনোদিন এত বাজেভাবে ধমকায় নি। তৃনয় নিজেও আজ পর্যন্ত গলা উঁচু করে কথা বলে নি। তন্নী চোখ মুছে নিল। একটা নিদারুণ সত্য ওর বুকে আঘাত হানলো,

“ মেয়েরা বাঁচে বিয়ের আগ পর্যন্ত! ”

সে ঘরে এলো। আজ চলে যাবে। যেভাবেই হোক। তৃনয় কি যেনো করছিল ঘরে। তন্নী শব্দ করে ঘরে ঢুকলো। চোখের জল তখন নেই। কিন্তু ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। সে ঘরে ঢুকতেই তৃনয় জিজ্ঞেস করলো,

“ কি হয়েছে? ”

তন্নীর রাগ হুড়মুড় করে বাড়লো। চেঁচিয়ে উঠলো সে,

“ আমার মাথা। ছেলে হয়েছে। কোলে নেবে? ”

তৃনয় নিচের সবকিছু শুনেছে। তন্নীর চিৎকারে সে নিয়ন্ত্রণহীন হেসে ফেললো,

“ দাও, নিই। আমার ছেলেকে আমি কোলে নেব না? ”

তন্নীর শরীরে আগুন জ্বললো সে হাসি দেখে। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি নিয়ে ছুঁড়ে মারলো তৃনয়ের দিকে। তৃনয় ধরে ফেললো। সে তখনো হাসছে। তন্নী আশ্চর্য হচ্ছে‌। এমনিতে তো কখনো হাসে না। ওকে দেখে মজা নিচ্ছে? সে একে একে পারফিউমের বোতল, কাজল, তেলের বোতল, শ্যাম্পু সব ছুঁড়ে মারলো। একটাও শরীরে লাগে নি। তৃনয় সবগুলো ক্যাঁচ করছে। ক্রিকেটের বলের মতো। পাক্কা হাত। আয়নার সামনে আর কিছু বাকী নেই। তন্নী একটা বালিশ তুলে এগিয়ে এসে মারতে লাগলো একাধারে। তৃনয় আটকানোর চেষ্টা করছে,

“ কি হয়েছে বলবে তো। আহা! ”

তন্নী মারতে মারতেই নাক টানলো,

“ তোমার ফুপি আমাকে যা নয় তা বলেছে‌। আর তুমি হাসছো? ”

“ আরে আরে। থামবে তো। আফরোজা…. ”

তৃনয় দুটো হাত ধরে ওকে আটকে দিল। এক হাতে ওর দুই হাত পিঠের পিছনে দিয়ে অপর হাতটা গালে রাখলো। তারপর কথাবার্তা ছাড়াই একটা দীর্ঘ চুম্বন করলো তন্নীর ঠোঁটে। তন্নী জমে গেল। শরীর বিবশ হয়ে এলো। তৃনয় ঠোঁট সরায় না। মেয়েটার দম আটকে এলো। ঠোঁটের উপর ঘুর্নিঝড় চলছে। এটা কেমন চুমু? ওকে মুক্তি দেওয়া হলো আরো কিছুক্ষণ পর। ঠোঁট তখন জ্বলছে প্রায়। তৃনয় ওর ঠোঁটটা হাত দিয়ে মুছে দিল। চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“ কি চাই এখন? ”

তন্নী দৃঢ় কন্ঠে বললো,

“ আমি চলে যাবো। ”

“ কোথায়? ”

“ আমার কি বাড়িঘর নেই? ”

তৃনয় মুখটাকে এগিয়ে নিয়ে নাকে নাক ঘষলো,

“ তোমার বাড়িঘর আমি না? ”

তন্নীর ঠোঁট কেঁপে উঠলো, “ জানি না, ছাড়ো। ”

তৃনয় ওকে ছেড়ে দিল। চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রাখলো। শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বললো,

“ যাও। ”

তন্নী ধুপধাপ জামাকাপড় ভাঁজ করতে লাগলো। তৃনয় বললো,

“ একা একা যেতে পারবে? ”

তন্নী চিৎকার করলো, “ একশ’বার পারবো। ”

তৃনয় বহুকষ্টে হাসি লুকিয়ে নিল।

“ আর আসবে না? ”

“ না। ”

“ সত্যি আসবে না? ”

“ না। ”

তৃনয় উঠে দাঁড়িয়ে ফোন, মানিব্যাগ নিল। চলে যেতে যেতে গলা উঁচিয়ে বলে গেল,

“ সবুজ শাড়িটাও নাও। ওটাতে তোমায় আমার লাগে। ”

তন্নীর হাত থেমে, আবার চলতে শুরু করলো। আমার লাগে মানে কি? তন্নী তো তারই। তৃনয় চলে গেল। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই। তন্নী বের হলো কিছুক্ষণ পর। রোজিনা ওকে দেখতে পেলেন। আটকালেন না। ওনার পুত্রবধূ কে ওনার চেনা আছে। শত চেষ্টা করেও এখন আটকানো যাবে না। ফুপি এসে বললেন,

“ ভাবী, বউকে আটকান? ”

উনি ভয় পাচ্ছেন। তৃনয়কে তো চেনা আছে। তুলকালাম ঘটবে। তন্নী বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলো তৃনয় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। সে ভেবেছিল চলে গেছে। তৃনয় হাতের ব্যাগটা নিয়ে ওকে সামনে দেখালো,

“ চলো। আমি দিয়ে আসি। এনেছিলাম আমি। একা যাবে কেনো? ”

নেকাবের আড়ালে তন্নীর চোখমুখ বোঝা গেল না। বটতলা থেকে তৃনয় ওকে অটোতে উঠিয়ে দিল। ভাড়া দিয়ে ড্রাইভার কে বললো,

“ আর কোনো যাত্রী তুলবেন না। কাঁটাবাড়িয়ার স্কুলের সামনে নামাবেন। ”

তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে তন্নীকে ফের বললো,

“ লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি। সত্যিই আসবে না, বউ? ”

তন্নীর হঠাৎ কেমন যেনো লাগে। সে মুখ ঝামটা মেরে সরিয়ে নিল, “ নাহ। তোমার ফুপিকে বলবে, আমি ঘরের সবকিছু নিয়ে আসবো। ”

তৃনয় হেঁসে ফেললো, “ সবে মাত্র বললে আসবে না। ”

তন্নী আর কথা বললো না। আসবে না কেনো? হাজারবার আসবে। জামাই তো ওর। তার এতো ভালো জামাইয়ের সাথে অন্য কেউ থাকবে নাকি? তৃনয় মাথা বের করলো।
অটো ছেড়ে দিলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। রাতে ঘুমোতে পারবে না। তবুও সে হাসলো। তার বউকে কিছু বলার মজা দেখুক। ফুপি গিয়ে না আনলে তৃনয় যাবে না। সে ফোন বের করলো। আসমা রিসিভ করলেন,

“ হ্যাঁ বাবা? ”

“ দাদী কোথায়, মা? ”

নুরজাহান কানে তুললেন ফোন,

“ কিরে গোলাম, আজকে নুরজাহান রে মনে পড়ছে? জীবনেও তো মনে করো না। ”

তৃনয় রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,

“ তোমার নাতনী যাচ্ছে। ”

“ ক্যান? ঝগড়া করেছিস নাকি? ”

“ সেটা তোমার নাতীকে জিজ্ঞেস করো‌। দাদাকেও গোলাম ডাকতে নাকি? ”

“ হুন মাঙ্গের নাতী, মরা মানুষ নিয়ে কিছু কইস না রে, কইস না। গজব পড়বো। ”

“ তোমার নাতী আমার উপরে পড়লেই আমি শ্বাস নিতে পারি না। গজবের কাজ কি? ”

নুরজাহান মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“ বউয়ের ওজন সহ্য করবার পারো না। তুমি আমার বা*লের জামাই। ”

তৃনয় আস্তে করে উচ্চারণ করলো, “ আমি তোমার নাতনীর জামাই। তন্নী আফরোজার স্বামী তৃনয় সিদ্দিকী। ”

নুরজাহান মুখের পানের রস ফেললেন শব্দ করে,

“ তুই আইলি না কেরে, জামাই? ”

“ তোমাদের মেয়ে আমাকে একবার সাধলো না পর্যন্ত। কিভাবে যাবো? ”

“ ওরে বলদ। তোর হশুর বাড়িত তুই আইবি। ওর কওয়া না কওয়ায় কি আসে যায়? ”

তৃনয় পথের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,

“ সব আসে যায়। ”

তারপর ফোন কেটে বিরবির করলো, “ আমার ঘরের রানী সে‌। তাকে দাসীর মতো ট্রিট করা এতো সহজ? তাও তৃনয় বেঁচে থাকতে? ”

চলবে….!