আমার বাহুডোরে আবদ্ধ তুমি পর্ব-১১

0
442

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ১১

সূর্যাস্ত গেছে খানিক আগেই। ধরনীর বুকে এখন নেমে এসেছে আঁধার। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে আদ্রিশের। এসে পৌঁছেছে সবেমাত্র। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে দ্রুত পদে প্রবেশ করে নিজ বাড়িতে। পুরো বাড়িটা কেমন অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আজ সন্ধ্যের বাতিটাও জ্বলেনি! বুকটা ধক করে উঠল আদ্রিশের। কারো কিছু হলো না তো আবার! ধুপধাপ পা ফেলে নিজের কক্ষে চলে যায় সে। পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার বিরাজ করছে। আরেক দফা চমকায় আদ্রিশ। মেহরুনের কিছু হয়নি তো! মস্তিষ্কের করোটির মাঝে ঘুরতে থাকা নানান চিন্তা ভাবনা গুলোকে মাটি চাপা দিয়ে তাই সুইচ হাতড়ে লাইট জ্বালায় আদ্রিশ।

বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে মেহরুন। এলোমেলো হয়ে আছে চুলগুলো। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। আদ্রিশ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মেহরুনের কাছে। আস্তে আস্তে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু মেহরুনের সাড়া মেলে না। আদ্রিশ এবার টেনে তোলে মেহরুনকে। হকচকিয়ে ওঠে মেহরুন। দ্রুত উঠে নিজেকে ঠিক করে নেয় সে।

মেহরুনের গালে একটা হাত রেখে আদ্রিশ চিন্তিত সুরে বলল

-‘ এই অসময়ে ঘুমাচ্ছো যে, কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?

মেহরুন না সূচক মাথা নাড়ায়। আদ্রিশ এবার মেহরুনের কপালে হাত ঠেকায়। শরীরটা একটু গরম গরম। চিন্তায় পড়ে যায় আদ্রিশ। চিন্তিত কন্ঠে বলল

-‘ তোমার শরীর তো বেশ গরম হয়ে আসছে। জ্বর আসবে বোধ হয়। দাঁড়াও, জ্বরের ওষুধ দিচ্ছি। খেয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে। সিজেন চেঞ্জ হলে একটু আধটু ওমন হয়।

এবার মুখ খোলে মেহরুন। গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ তার কোনো প্রয়োজন নেই। ঠিক আছি আমি।

-‘ কিন্তু তুমি তো…

আদ্রিশকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মেহরুন বলে উঠল

-‘ বললাম তো ঠিক আছি আমি। কিছু হয়নি আমার।

কথাটা বলেই আদ্রিশ হতে ছিটকে দূরে সরে যায় মেহরুন। তা দেখে মলিন হাসে আদ্রিশ। মনে মনে বলল, ‘যার জন্য আমি পুরো দুনিয়া ছাড়তে প্রস্তুত, আফসোস সে আমায় ভালোবাসল না।’ বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আদ্রিশের। এই মেয়েটা তার বুকে সেই প্রথম দিন থেকে যে আগুন জ্বালিয়েছে, সে আগুন আর নিভল না। প্রতিনিয়ত পুড়ে ছাঁই হচ্ছে সে। এ অন্তর্দহন নিভবে কবে তার? কবে মেহরুনের শীতল ছোয়ায় উজার করবে নিজেকে? নির্দয় হৃদয়কে কবে সে জানান দিবে তার আধ মরা অনুভুতিগুলোর! এসব ভেবে আদ্রিশের চোখের কার্নিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল গরিয়ে পড়ে শুষ্ক কপোলে।

এ দৃশ্য নজর এড়ায় না মেহরুনের। মেহরুনের বুক ধুকপুক করছে। দ্বিধায় পড়ছে বারেবার। এ মানুষটাকে দেখলে তার সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগে। মনে হয় অনুভূতিগুলো যেন দলবেঁধে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে!

মেহরুনের গলা কাখারীতে ভাবনার ছেদ ঘটে আদ্রিশের। গলা ঝেড়ে বেশ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে মেহরুন বলল

-‘ আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।

আদ্রিশ মাথা নেড়ে সায় জানায়। তা দেখে মেহরুন ঝটপট বলে ফেলল

-‘ অরনী আপুকে কাঁদতে দেখলাম আজ। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি রেগে গেলেন। উনি কি কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট? জানেন কিছু আপনি?

আদ্রিশের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। অরনী হচ্ছে আদ্রিশের পুরো দুনিয়া। অরনীর কিছু হলে আদ্রিশের পক্ষে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে। মেহরুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আদ্রিশ তড়িঘড়ি করে বলল

-‘ তোমায় পরে সব বলব মেহরুন। কিন্তু এখন নয়…

বলেই দ্রুত বেরিয়ে পড়ে আদ্রিশ। অরনীর রুমে গিয়ে দেখে ফ্লোরে পড়ে আছে অরনী। বুকটা ধক করে ওঠে আদ্রিশের। দ্রুত পদে এগিয়ে যায় অরনীর কাছে। নিজের কোলে অরনীর মাথাটা রেখে বেশ কয়েকবার ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ মেলে না। উত্তেজিত হয়ে পড়ে আদ্রিশ। কি করবে ভেবে পায় না। পাশে থাকা জগটা হঠাৎ নজরে আসতেই উঠে গিয়ে জগটা নিয়ে আসে। জগে থাকা পানিটুকু ছিটিয়ে দেয় অরনীর চোখে মুখে। অরনী আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। বেশি স্ট্রেস নিতে পারে না অরনী। অতিরিক্ত কান্না এবং চাপের ফলে তাই জ্ঞান হারিয়েছিল সে।

চোখের সামনে আদ্রিশকে দেখে কান্না আর ধরে রাখতে পারেনি অরনী। আদ্রিশকে জড়িয়ে ধরে তাই অবশেষে কেঁদেই ফেলে সে। আদ্রিশ কিছুটা আঁচ করতে পারে। অরনীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিছুটা শান্ত হয় অরনী। তবুও কিছুক্ষণ পর পর হেঁচকি তুলেছে সে।

আদ্রিশ শান্ত কন্ঠে বলল

-‘ অনেক তো কান্নাকাটি করলি, আপু। এবার কি হয়েছে, সবটা বল আমায়।

অরনী চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল

-‘ এবারও চাকরিটা হলো না আরাভের। ও বাড়ির লোকজন আর মেনে নিবে না আমায়, বলে দিয়েছে। কথা ছিল আরাভ চাকরিটা পেলেই ও বাড়িতে তুলবে আমায়, নইলে না।

ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে আদ্রিশ বলল

-‘ তো আরাভ ভাইয়া কিছু বলল না?

-‘ আরাভ তো সারাদিনে একটা বারের জন্যও আমার ফোনটা রিসিভ করল না। ও ফোন ধরলে তো তাও ভরসা পেতাম। হয়তো ও এবার ওর পরিবারের কথাই মেনে নিবে।

কথাটা বলেই কেঁদে ওঠে অরনী। আদ্রিশ রেগে যায় প্রচন্ড। গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ তোর ফোন দে, আপু। ওর গোষ্ঠীর শ্রাদ্ধ পড়াব আজ।

আঁতকে ওঠে অরনী। চোখ মুখ মুছে আতংকিত গলায় বলল

-‘ না, না ওসব করতে যাস না, ভাই আমার।

দ্বিগুন তেজে চিৎকার করে বলে উঠল আদ্রিশ।

-‘ ওদের সাহস হয় কিভাবে আমার বোনের সাথে এভাবে কথা বলার? লুকিয়ে বিয়ে করার সময় পরিবারের কথা মনে ছিল না তার? এখন যখন চাপে পড়েছে তখন পরিবারই সব? আমি এবার এর হেস্তনেস্ত করেই তবে ছাড়ব। তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগে না আমার, আপু।

অরনী নাক টানে কয়েকবার। তাচ্ছিল্য হেসে বলল

-‘ সবই আমার কপালের ফের!

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আদ্রিশ। অরনীর হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই বলল

-‘ একটু আগে আমার রুমে মেহরুন এসেছিল। রাগের মাথায় কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে ফেলেছি মেয়েটাকে। ও হয়তো কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গিয়েছিল।

আদ্রিশ এবার বুঝতে পারে, মেহরুনের চোখ মুখ ফুলে থাকার কারণ। গম্ভীর কণ্ঠে অরনীকে বলল

-‘ মেহরুনের সাথে তোর ওমন ব্যবহার করাটা ঠিক হয়নি, আপু।

অরনী অসহায় কণ্ঠে বলল

-‘ সরি রে ভাই। আমি তখন আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না।

আদ্রিশ এবার মেহরুনকে ডাক দেয়। ডাক শুনে মেহরুন দৌড়ে আসে অরনীর রুমে। মেহরুনকে দেখে অরনী হালকা হেসে মেহরুনকে নিজের কাছে টেনে বলল

-‘ তখনের ব্যবহারের জন্য সরি বোন। আমি তখন আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না।

মেহরুন মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরে বলল

-‘ আমি তো কিছু মনে করিনি আপু। তুমি আমার বড়, তুমি আমাকে শাসন করতেই পারো।

দুজনেই হেসে ফেলে। হঠাৎ অরনীর ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই থমকে যায় সে। ‘আরাভ’ নামটা স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে। অরনীর বুক ধুকপুক করছে। অজানা আশঙ্কায় গ্রাস করে ফেলে তাকে। অরনী আদ্রিশের দিকে তাকায়। আদ্রিশ ইশারায় তাকে ফোন রিসিভ করতে বলে, সেইসাথে লাউড স্পিকারে দিতে বলে, অরনী তা-ই করে।

ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে জোড়ালো কণ্ঠে বলে ওঠে

-‘ আমি এবারও ব্যর্থ হলাম। আসলে আমি তোমায় কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। কোন মুখে তোমার সামনে দাঁড়াব আমি, তা ভেবে পাচ্ছি না। আচ্ছা ওরা কিছু বলেনি তো তোমায়?

অরনী কোনো কথা বলে না। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। অরনীর কান্নার অর্থ বুঝে ফেলে অপর পাশের মানুষটি। গম্ভীর কণ্ঠে তাই বলল

-‘ আমি চাকরিটা পাইনি, এটা আমার দোষ, তোমার নয়। যে বা যারা তোমায় দোষারোপ করছে, তাদের কথা মাথাতে নিও না, ঝেড়ে ফেল। আমি যতদিন না চাকরি পাব, ততদিন আমি আমার মুখও দেখাব না তোমায়। যেদিন আমি সফল হতে পারব, সেদিনই আমি তোমার সামনে আসব।

কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয় অপর পাশের মানুষটি। অরনীর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। আদ্রিশ স্বযত্নে মুছে দেয় তা। আদ্রিশ দৃঢ় গলায় বলল

-‘ একদম কাঁদবি না, ছিছকাদুনির মতো। ভাইয়া কি বলল শুনিস নি?

মেহরুন এতোক্ষণ বসে সবটাই শুনছিল। তবে বোধগম্য হয় না। মেহরুনকে উসখুস করতে দেখে আদ্রিশ বুঝে ফেলে, তাই নিজে থেকেই বলল

-‘ আপুর হাসবেন্ড ফোন দিয়েছিল।

মেহরুনের চোখে মুখে বিষ্ময় ছড়িয়ে পড়ে যেন। বিষ্ময়কর চাহনিতে তাকিয়ে কন্ঠে অবাকতা নিয়ে বলল

-‘ কিহ্, অরনী আপু বিবাহিত?

আদ্রিশ ঠোঁট চেপে হেসে মাথা নাড়ায়। মেহরুন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে দুই ভাই বোনের দিকে। অরনী যে বিবাহিত, সেটা সে বিন্দুমাত্রও বুঝতে পারেনি।

#চলবে ~