#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
গভীর রাতে খোলা জানলা দিয়ে বাতাস এসে প্রবেশ করছে রুমে। ভূমিকার পড়োনে টাউজার ও টি-শার্ট। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বিয়ের রাতে নতুন বউ এভাবে বসে বসে ডায়েরি লিখছে এবং তার হাসবেন্ড মার খেয়ে ঘুমোচ্ছে, ব্যাপারটা যদি কোনোমতে মিডিয়া জানতে পারতো তবে হয়তো বাংলাদেশের একসপ্তাহের ট্রেন্ডিং খবর হতো এটি। ভূমিকা ভ্রু কুঁচকে ডায়েরি লেখা থামিয়ে দিলো। জানলাটা আরেকটু খুলে দিয়ে পানি খেয়ে আরাম করে আবার চেয়ারে বসলো। ওর নজর বার-বার ঘুমন্ত ইমতিয়াজের উপর যাচ্ছে।
রাইসা ইমতিয়াজের প্রাক্তন। ভার্সিটিতে থাকতে যার জন্য ভূমিকা কষ্ট পেয়ে ছিল। সেই রাইসার চাপ্টার ক্লজ হয়েছিল ভার্সিটিতেই। তারপরই ভূমিকা ও ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে এক হয়েছিল। সেই রাইসা আবারও কেন নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো? তাও যখন ভূমিকা ও ইমতিয়াজ নতুন জীবন সবে শুরু করতে যাচ্ছিল! ভূমিকা শান্তশিষ্ট মেয়ে, এর আগে কখনো ও ইমতিয়াজকে এমন করে মারেনি। বন্ধুত্ব থাকাকালীনও না। আজ যখন ইমতিয়াজ ওর স্বামী তখন ভূমিকা অপরাধ করে বসে আছে। সদ্য বিবাহিত স্বামীকে অসম্মান করার অপরাধবোধে ভূমিকার চোখ টলমল করতে লাগলো। ইমতিয়াজ ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভূমিকা উঠে ওর মাথার কাছে বসলো। কপালে কিছু ছোট ছড়িয়ে থাকা চুল গুছিয়ে দিয়ে কপালে স্পর্শ করে সরে যেতে লাগলো। তখনই ইমতিয়াজ হাত টেনে ধরলো। ভূমিকা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ঘুমাওনি? ’
‘ ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি কাছে এলে তাই জেগে গেলাম। ’
‘ ওহ্ ’
ইমতিয়াজ উঠে বসলো,
‘ তুমি কাঁদছো কেন ভূমি? ’
‘ কই? ’
ইমতিয়াজ হাসলো। সহজ সরল সেই হাসি দেখে ভূমিকা পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো,
‘ আমি খুবই বাজে ওয়াইফ তাই না ইমতিয়াজ? ’
‘ একদমই নয়, তুমি অনেক ভালো ওয়াইফ হবে আমি জানি। ’
ভূমিকা ও ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ বসে রইলো চুপ করে। অনেকক্ষণ পর যখন বাহিরে ঝড় শুরু হলো তখন ইমতিয়াজ আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। ভূমিকা আবারও উঠে গিয়ে চেয়ারে বসলো ডায়েরি খুলে। লিখতে লাগলো, এবং তোমাদের শোনাতে শুরু করলো ওদের প্রেম কাহিনি।
★অতীত –
আমাদের বন্ধুত্ব এভাবেই চলছিল। আমি সবসময়ই ইমতিয়াজের কেয়ার করতাম। সেটা ইমতিয়াজ বন্ধুত্ব ভেবে নিলেও আমি ওকে সবসময়ই বন্ধুত্বের উপরে অন্য কিছু ভাবতাম। রোজ স্বপ্ন দেখতাম আমাদের একটা স্বপ্নের সংসারের। আমি সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকতাম যদি ইমতিয়াজ অন্য কাউকে পছন্দ করে ফেলে? আমার ভয় দিন দিন বেড়েই চলছিল।
ইমতিয়াজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। গ্রামের সহজ-সরল ছেলেটিকে আমি হাজার অনুরোধ করেও শার্ট প্যান্ট কখনো স্টাইলিশ ম্যানদের মতো পড়াতে পারিনি। যে-ই ইমতিয়াজ হলুদ রঙের টি-শার্ট পড়লে লাল রঙের প্যান্ট পড়ে চলে আসতো, সেই ইমতিয়াজ হঠাৎ করে সবকিছুতে কেমন স্মার্ট স্মার্ট ভাব নিয়ে আসলো। চুলে তেলের পরিবর্তে জেল ইউজ করলেও ইমতিয়াজ মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে তেল দিয়ে আসতো। আমার ওকে দেখতে কি যে ভালো লাগতো। কিন্তু আজকাল ইমতিয়াজ ইচ্ছে করে তো দূরে থাক ভুল করেও তেল দিয়ে আসেনা। চোখে স্মার্ট ম্যানদের মতো রোদচশমা লাগানো থাকে সবসময়। তাতে ওকে একদমই মন্দ লাগেনা। বরং একজন সুদর্শন পুরুষ মনে হয়। কিন্তু আমি আগের পুরনো তেল ওয়ালা সেই ইমতিয়াজকে মিস করি। বর্তমানের এই সুদর্শন ইমতিয়াজকে কেন যেনো আমার মনে হয়না। মনে হয় সে অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে। আমার মনের সকল ভয়, দুঃখকে সত্যি করে দিয়ে ইমতিয়াজ একদিন মজার ছলে বলেছিল, ‘ ফাস্ট ইয়ারের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে রাইসাকে দেখেছিস? হেব্বি জোস না দোস্ত? ’
আমি মিনমিন করে বলেছিলাম, ‘হো দোস্ত হেব্বি জোস। ’
ইমতিয়াজ হেসে বলেছিল, ‘তোর ভাবি হলে মন্দ হয়না বল? ’
আমার তখন দুনিয়া থমকে গেছিলো। আমি ও ইমতিয়াজ বর্তমানে অনার্স সেকেন্ড পড়ি। আমার এক বছরের লুকোনো ভালোবাসা লুকোনোই রয়ে গেলো। বর্তমানে ইমতিয়াজ ও রাইসার গভীর প্রেম চলছে। একদা একদিন ইমতিয়াজ আমাকে দিয়ে রাইসাকে চিঠি দিয়ে পাঠালো। সেই চিঠিতে কি ছিলো বুঝতে বাকি ছিলো না আমার। আমারই হাত দিয়ে ইমতিয়াজ আমার লুকোনো হৃদয়কে মে’রে ফেলার এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। মনের দুঃখ মনে গোপন রেখে আমি রাইসার কাছে সেই চিঠি পৌঁছে দিয়েছিলাম। ইমতিয়াজ ও রাইসার সম্পর্কের চারমাস চলছে। আমার লুকোনো প্রেম সারাজীবন লুকোনো রয়ে যাবে তাই না!
ওদের প্রেম তো ভালোই চলছিল। আর আমি গভীররাতে ওকে ভেবে ঘুমাতে পারতাম না৷ ওরা ঘুমাতে পারতো না সম্ভবত ফোনে কথা বলার কারণে। অনেক।
ভূমিকা থামলো। কলমটা ঘুরিয়ে পেচিয়ে তাকালো ঘুমন্ত ইমতিয়াজের দিকে। কি নিষ্পাপ ও সরল মুখশ্রী। কিন্তু এই ইমতিয়াজকে তখন ভূমিকার নিষ্পাপ মনে হয়নি। ভূমিকার মনে হতো ইমতিয়াজ হয়তো বুঝতে পেরেছিল ভূমিকা তাকে পছন্দ করে, কিন্তু বুঝেও পাত্তা দেয়নি কিংবা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ভূমিকাকে অপশন হিসেবে রেখেছিল হয়তো। এইরকমই মনে হতো ভূমিকার৷
হাতের কলম আবারও নিজের কালি ফুরোতে শুরু করলো।
তখন আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে, একদিন মধ্যরাতে আমি তেমনই উদাস বসে। ইমতিয়াজের গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে করছিল খুব। সময় ব্যয় না করে ডায়াল করেছিলাম কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। কিন্তু ওপাশ থেকে বিজি দেখিয়েছিল। আমি সেদিন অনেক হেসেছিলাম। খুশিতে নয়, দুঃখে, কষ্টে ও রাগে। কারণ আমি জানতাম ইমতিয়াজ রাইসার সাথে দীর্ঘ প্রেম আলাপে ব্যস্ত। কিন্তু কিঞ্চিৎ আশা থেকে ডায়াল করেছিলাম। আমার সেই আশাটাও ভেঙে গেলো।
আমার মতো বুঝদার ও ম্যাচিউর মেয়ে তখন ইমতিয়াজের প্রেমে এতো পাগল হয়ে গেছিলাম যে আমি উচিত অনুচিত, নিজের ভালো মন্দ ভুলতে বসেছিলাম। আমার নিজেরই ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে সেই পাগল মেয়েটি আমি! ভূমিকা রহমান।
সেদিন নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। ইমতিয়াজের সাথে কথা বলার পুরনো একটি কল রেকর্ড বের করে কানে চেপে ধরেছিলাম। ভাবছিলাম, কি মিষ্টি একটি স্বর। পুরুষ মানুষের গলার স্বর এতো সুন্দর হয়? ইমতিয়াজকে মায়াবতী বলা উচিত। নাহ্ ছেলে যেহেতু তাহলে মায়াবতা বলা যেতে পারে। একসময় রেকর্ড ফুরিয়ে গেছিল। আমি বারান্দায় বসে বসে তারা গুনতে শুরু করেছিলাম। তারা গুনতে গুনতে সময় তিনটার কাটায় পৌঁছেছিল। ইমতিয়াজের নাম্বারে পুনরায় ডায়াল করে আমি আবারও মর্মাহত হয়েছিলাম। আমার তেল ওয়ালা পুরুষ অন্য নারীর সঙ্গে প্রেমলীলায় ব্যস্ত। সে কি কখনো জানবে তার বিহনে এক নারীর বক্ষ জুড়ে কি নিদারুণ হাহাকার বয়ে যায়?
এসব ভাবতে ভাবতে নিজ মনেই সেদিন ইমতিয়াজকে বলেছিলাম, হয়তো তাছিল্য করেছিলাম।
‘ ইমতিয়াজ তুমি হলে অন্ধ পুরুষ। সোনা রেখে কাঁচকে হীরা ভেবে আঁকড়ে ধরেছো। অথচ তুমি চাইলেই সোনা’কে হীরেতে রুপান্তরিত করতে পারতে। প্রায় সব মানুষই প্রথমবার ভুল মানুষকে ভালোবাসে। তুমিও ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো ইমতিয়াজ। কিন্তু আমি ভুল কাউকে ভালোবাসিনি। আমি তোমাকে আমার করে নিবো। সবসময় পুরুষেরাই ভালোবাসার জন্য খারাপ হয় না কিছু সময় মেয়েরাও খারাপ হয়। আমি খারাপ হবো ইমতিয়াজ। ততোটা খারাপ যতোটা খারাপ হলে তুমি নিজ থেকে আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে। ’
কি আপনারা ভাবছেন এমন কেন বলছি বা লিখছি? আসলে তখনকার ভূমিকা এমনই ছিলো। যেখানে সবাই ভালোবাসার মানুষের ভালো চেয়ে দূরে সরে যায়, সেখানে আমি তাকে হাসিল করার জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম। এবং হাসিল করেই ছেড়েছি, সেটার প্রমাণ আজ আমি তার ঘরে তার টেবিলে বসে এই ডায়েরিতে তোমাদের জন্য লিখে ও তোমাদের সবকিছু বলে প্রমাণ দিচ্ছি৷ তোমরা কি আমাকে খারাপ ভাবছো? স্বার্থপর ভাবছো? ভাবছো, আমি তবে শান্তশিষ্ট ছিলাম কবে?
আমি সবসময়ই শান্তশিষ্ট ছিলাম, শুধু ইমতিয়াজের ব্যাপার হলেই আমি শান্তশিষ্ট থাকতে পারি না আজও। তোমরা তো জানোই, সবকিছুর ভাগ করা গেলেও ভালোবাসার মানুষকে ভাগ করা যায় না। তাকে অন্যকারো সাথে দেখার পর গ্রিন প্ল্যাগ আমি গ্রিন প্ল্যাগ থাকতে পারিনি।
(চলবে)