#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-০৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ভূমিকার মা বাবা ও কাজিন মহল এলো বৌভাতে। সবসময়কার চ্যুজি ভূমিকা গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করেছে, নিশ্চয়ই সবকিছু বুঝে শুনেই করেছে। সেটা তারা প্রমাণ ফেলো আজ এখানে এসে। ভূমিকার শ্বশুরবাড়ির সবার অমায়িক ব্যবহার ওর কাজিনমহলকে মুগ্ধ করেছে। চ্যুজি ভূমিকা অবশ্য মা বাবাকে ইমতিয়াজকে মেনে নিতে রাজি করানোতেও নিজের সর্বোচ্চ দিয়েছিল।
বৌভাতের আনুষ্ঠানিকতার পর রাতে ওরা রুমে একান্তে যখন পাশাপাশি বসলো তখনই ইমতিয়াজ জিজ্ঞেস করলো,
‘ রাইসা কি বলেছে তোমায়? ’
ভূমিকা মুচকি হেসে বলল,
‘ ওসব বাদ দাও। ও যাই বলুক আমি তো জানি তুমি কেমন। গতকালের মতো আজকের রাতটাও বরবাদ করতে চাও নাকি? ’
ইমতিয়াজও হাসলো,
‘ আমার বয়স কতো বলো তো? ’
‘ ত্রিশ? ’
‘ হ্যাঁ, জীবনের ত্রিশটা বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে কারো কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে। সেজন্য আমি একটু নার্ভাস। ’
‘ আমি তোমার থেকে দুই মাসের বড়ো, তোমার থেকে বেশি আমিই তো কাটিয়েছি। ’
ইমতিয়াজ শব্দ করে হেসে ফেললো।
‘ ভার্সিটিতে থাকতে বলেছিলাম চলো বিয়ে করে নেই। করলে না কেন বলো তো? ’
‘ বিয়ে করে নিলে তোমাকে ছেড়ে দূরদূরান্তে তখন যেতে পারতাম না ইমতিয়াজ। তাছাড়া বাবা আমাদের সম্পর্ক সহজে যাতে মেনে নেন সেটার জন্য আমার ক্যারিয়ার গড়াটা জরুরি ছিল। ’
‘ ভূমিকা, আমি কি তোমার ঠোঁট স্পর্শ করতে পারি? বহু বছর হলো আমি তোমাকে একটা চুমু খাওয়ার সুযোগের অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার পালা কি শেষ হয়নি? ’
ভূমিকা থমকে গেলো। হুট করে ইমতিয়াজ এমন আবদার করবে সে বুঝতে পারেনি।
‘ তোমাকে সবকিছু করার পারমিশন তো দিয়ে দিয়েছি ইমতিয়াজ৷ ’
ইমতিয়াজ এগিয়ে এলো কাছে। অনেক বছরের অপেক্ষার ফল আজকের এই রাত। ঠোঁট ছেড়ে ইমতিয়াজ যখন ভূমিকার মধ্যে হারিয়ে গেলো তখনই ভূমি ভদ্র সভ্য ইমতিয়াজকে চূড়ান্ত লজ্জায় ফেলে দিতে বললো,
‘ তুমি তো একটা চুমুই শুধু দিতে চেয়েছিলে ইমতিয়াজ।’
ইমতিয়াজ হেসে ফেললো শব্দ করে। ওর সাথে তাল মিলিয়ে ভূমিকা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। ইমতিয়াজ মুগ্ধ হয়ে অন্ধকারেও সেই হাসি দেখলো। ভূমিকা এমন করে সচরাচর হাসে না।
রাত তখন তিনটা। ঘুমন্ত ইমতিয়াজকে ছেড়ে ভূমিকা বসে পড়লো টেবিলে। হাতে তুলে নিলো কলম। ডায়েরিতে ও লিখতে শুরু করলো তোমাদের জন্য।
★অতীত-
ইমতিয়াজ ও রাইসার সম্পর্ক ভালোই চলছিল। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ারে। রিলেশনে যাওয়ার পর থেকে ইমতিয়াজের সাথে আমার খুব কমই দেখা হতো। অবশ্য দেখা হলেও ইমতিয়াজ সে-ই এক রাইসার কথাই বলতো বারবার। যেন এই পৃথিবীতে রাইসা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই, কিংবা রাইসাই একমাত্র যাকে ছাড়া ও কিছুই ভাবতে পারে না। ইমতিয়াজের কথা গুলো আমি অনেক কষ্টে হজম করতাম। ভালোবাসার মানুষের মুখে যখন তারই ভালোবাসার মানুষের গুণগান শুনতে হয় তখন ঠিক কেমন লাগে সেটা তোমাদের মধ্যে তারাই বুঝবে যারা আমার মতো করে একতরফা ভালোবেসেছো।
তোমাদের আমি তো বলেছিলামই আমি ইমতিয়াজকে কতোটা পছন্দ করি। না আমি বিশ্বাস করি না যে কেউ কাউকে না পেলে মরে যায়। কিন্তু তবুও আমি ডেস্পারেট হয়ে গেছিলাম। একবার রাইসাকে মেনহোলে ফেলে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। শুধুই চেষ্টা করেছি, সুযোগ থাকা সত্যেও ফেলে দেইনি কিন্তু। কারণ ভালোবাসায় অন্ধ ভূমিকা ডেস্পারেট হলেও আমি ভূমিকার বুঝদার সত্তাটি আমাকে আটকে দিতো। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় সেটার লড়াই করতাম একা একাই। তাই অনেক ভেবেও আমি রাইসার কোনো ক্ষতি করতে পারিনি। কিন্তু আমি দমে যাইনি। মিলিটারির অন্তর্ভুক্ত ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে আমি নানান ভাবে রাইসা ও ইমতিয়াজের সম্পর্ক ভাঙতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেন যেন পারিনি। তারপর আমি টিসি নিলাম। চলে গেলাম সিলেট থেকে এবং ইমতিয়াজের জীবন থেকে নিজের সেই জীবনে যেখানে আমি চ্যুজি এবং বুঝদার। যেখানে আমি পা ফেললেই সবাই আগ্রহ নিয়ে ঘিরে ধরে আমাকে।
তোমরা ভাবছো হয়তো আমার কি কোনো কষ্ট হয়নি? হয়েছে, অনেক হয়েছে। আমি ওই সময়টা অনেক কষ্ট পেয়ে পাড় করেছি। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি, বুঝাতে পারিনি আমারও কষ্ট হয়।
ইমতিয়াজের সাথে টুকটাক যোগাযোগ ছিল। ভালো মন্দ কথা হতো আমাদের। ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে একদিন রাতে আমার ইমতিয়াজকে অনেক মনে পড়ছিল। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ওর সাথে কথা না বলতে পারলে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। এমন পাগল হয়ে ভালোবাসার পরেও আমি ইমতিয়াজকে পাবো না সেটা মাথায় আসতেই সেদিন আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। ইমতিয়াজকে সেদিন ফোন দেওয়ার পরও ও আমার ফোন ধরেনি। নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছিল বারবার। আমার তখন পরীক্ষা চলছিল সেটা তো বললামই। ইচ্ছে করছিল সব ছেড়ে ছুটে যাই সিলেটে। কিন্তু পারিনি, আমি সেবারও পারিনি নিজের শক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। রোবটের মতো একের পর এক পরীক্ষা দিলাম। তারপর ছুটে গেলাম সিলেটে। সেই ক্যাম্পাসে, যেখানে ওর আর আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস খুঁজেও আমি ইমতিয়াজকে পাইনি। ওর ক্লাসমেইট এর সাহায্যে ম্যাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ম্যাসের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ইমতিয়াজ কয়েকদিন হলো গ্রামে গেছে এখনো ফিরেনি। সাথে এটাও জানলাম ও সেদিন ভোর রাতে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছিল। চিন্তায় সেদিন আমার পাগল পাগল অবস্থা হয়ে গেছিল। জীবনে প্রথমবার আমি রাইসাকে ফোন করেছিলাম। কল দিয়ে যা জানলাম তা শুনে আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারছিলাম না। রাইসার সাথে ইমতিয়াজের ব্রেকআপ হয়ে গেছে আরও ছয়মাস আগে! ভাবছিলাম সেজন্যেই কি ইমতিয়াজ কষ্ট পেয়ে গ্রামে চলে গেছে? কিংবা প্রেমিকা হারানোর কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে পড়াশোনা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে? তারপরই মাথায় এলো, না ইমতিয়াজ ওই ধরনের ছেলে নয়। ইমোশনাল হলেও বাস্তববাদী ছেলে। ব্রেকআপের জন্য পড়াশোনা ফেলে গ্রামে যাবে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে। সেটা কি তা আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। নাহলে আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছিল, যবে থেকে আমি রাইসা আর ইমতিয়াজকে একা ছেড়ে দিয়েছি তবে থেকে আমি শুধু একটা জিনিসই চেয়েছি। ইমতিয়াজ ভালো থাকুক।
কিন্তু ইমতিয়াজ ভালো ছিলো না। দূর শহরে থাকা আমি সেটা বুঝতেও পারিনি। ইমতিয়াজ সব আমাকে বললেও কি বুঝে যেনো ওর ব্রেকআপের বিষয়টা গোপন করে রেখেছিল। সব চিন্তা ভাবনা যখন একসাথে আমার মাথায় জট পাকাচ্ছিল তখন আমি আরও অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় আমি ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা তেমন স্পষ্ট করে জানতাম না। রাইসাকে জিজ্ঞেস করে তেমন স্পষ্ট করে জানাও গেলো না। অর্থাৎ গ্রামের নাম জানলেও এলাকা জানে না এমন টাইপ। আমি তবুও রিস্কটা নিয়েছিলাম। এমন না যে আমি ইমতিয়াজের ঠিকানা জানি না, জানতাম। কিন্তু ভুল বসেছিলাম। বিকালের বাসে চড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম।তারপর বাসে বসে মনে করতে শুরু করেছিলাম ফেলে আসা দিনগুলো।
ইমতিয়াজ একবার আমাকে ভুল করে জড়িয়ে ধরেছিল। তোমরা আবার ভেবো না আমার ইমতিয়াজ গায়ে পড়া কেউ। উঁহু, সে সহজ সরল টাইপ ভদ্র ছেলে।সেটার প্রমাণ তোমরা ইতিমধ্যে পেয়েছো। এতো বছরের সম্পর্কে সে আমাকে কখনো মাঝে মধ্যে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কিছু করতে চেষ্টা করেনি।
ইমতিয়াজ সেদিন দারুণ এক্সাইটেড ছিল। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেটি ফাস্ট ইয়ারে সিজিপিএ ৪ পেয়েছিল। তোমাদের তো বলেছিলামই ওর ভাইয়ের সেক্রিফাইসের কথা। সেদিন, হ্যাঁ সেদিনই ইমতিয়াজ এক্সাইটেড হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে লাফিয়েছিল৷ তারপর বুঝতে পেরে ওর আমাকে ছেড়ে কাচুমাচু করা মুখটা আমি এখনো ভুলতে পারিনি। ওহ হ্যাঁ সেদিন কিন্তু ওর মাথায় ঝপঝপ করে তেল দেওয়া ছিল৷ আমি সেদিন কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকা তেলওয়ালা শেখ ইমতিয়াজ আলীর প্রেমে নতুন করে পড়েছিলাম৷
(চলবে)