#আমার_ভূমিকা
#পর্ব-৮ (শেষপর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ইমতিয়াজের বাড়ি থেকে আমি ফিরে আসি দুইদিন পর। মেয়ে বন্ধু হিসেবে বাড়িতে দুইদিন থেকেছি, গ্রামে খবরটা রটে যেতে কিন্তু সময় লাগেনি। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসেনি। ইমতিয়াজের মা খুব বুদ্ধি কাটিয়ে সেটা সামলে নিয়েছিলেন। আমি শুধু ইমতিয়াজের বন্ধুই নই, তার বান্ধবীর মেয়েও। যে কি না হুট করে ইমতিয়াজের বাবার গত হওয়ার খবর শুনে চলে এসেছে।
আমি দুইদিন আনন্দ করেছি সেটা বলবো না। তবে আমি নতুন করে কিছু মানুষকে চিনেছিলাম। আমাদের কোনোরকমই মিলে না, কিন্তু তবুও মানুষ হিসেবে কোথাও একটা যেন মিল। ইমতিয়াজের বাবার সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি। ইমতিয়াজের চেহারা পুরোটা না হলেও কিছু টা ওর বাবার মতোই। ইমতিয়াজের ছোটবেলা নিয়ে ও কথা বলেছি আমি। ওর দুষ্টুমি, কতো কি জেনেছি।
বাসস্ট্যান্ডে আমাকে পৌঁছে দিতে ইমতিয়াজ এসেছিল সাথে। ও হোস্টেলে ফিরে যাবে আরও কয়েকদিন পর। আমি সিলেট থেকে সোজা ঢাকা ফিরে এসেছিলাম। হোস্টেলে দুইরাত কাটিয়ে চেহারা, শরীর মোটামুটি ঠিকঠাক করে তবেই বাড়িতে গেছিলাম।
তারপর আমাদের জীবন নিজ গতিতেই চলছিল। আমাদের কথা হতো ফোনে বা মেসেজে। আমি ইমতিয়াজকে কতো ভাবে যে ইংগিত করেছি। ওকে ভালোবাসার সুত্র শিখিয়েছি৷ মুখে না বলেও বলে দিয়েছি মনের সব কথা। ইমতিয়াজ বুঝে নিয়েছিল, জেনে নিয়েছিল। ব্যস। তারপর তো তোমরা জানোই, লাজুক ছেলেটি আমার জন্য ফুল কিনলো, আমাকে ফুল দিয়েই নতুন পথচলার ইংগিত দিলো। তারপর আমি ট্রেনিংয়ে, ট্রেনিং এর পর জব, জবের ছুটিতে বাড়ি। ইমতিয়াজকে তেমন সময় আমি দিতে পারিনি। ইমতিয়াজের হাতে বোধ করি আমার থেকে সময় বেশিই ছিল। ও চাকরি করতো, আবার বাড়ি ফিরে আসতো। আমার শাশুড়ীমাকে নিয়ে ঢাকায় ফ্ল্যাটে থাকতো।
এখন অবশ্য আমরা দু’জন একসাথে ঢাকাতেই থাকবো। শাশুড়ী মা এখানেও থাকতে পারেন, কিংবা গ্রামে। যেখানে তার ইচ্ছে৷
এই হলো আমাদের গল্প। তোমাদের আমি প্রথমেই স্যরি বলে দিচ্ছি, কাহিনির শুরুটা ইন্টারেস্টিং করার জন্য আমি রাইসার ব্যাপারটা টেনে এনেছি। রাইসা আসলে তেমন কিছুই বলেনি। শুধু আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে একটু বেশিই ইমতিয়াজের প্রতি কেয়ারিং বিহেভ দেখাচ্ছিল, যেটা আমার ভালো লাগে নি। আমি কাউকেই ইমতিয়াজের ভাগ দিতে পারবো না।
‘ ভূমিকা আমার ওয়ালেট কোথায়? ’
ইমতিয়াজ ডাকছে, ওয়ালেট ওর হাতের কাছেই। তবুও আমাকে সেটা ওর হাতে তুলে দিতে হবে। আমি ব্যস্ত মানুষ, যতোদিন ছুটিতে থাকবো স্বামী সেবা করবো বলেই ঠিক করেছি। তোমাদের জন্য আমি মাঝে মধ্যে ডায়েরি লিখবো কেমন?
ভূমিকা ডায়েরি বন্ধ করে ইমতিয়াজের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর নিজের দিকে ঘুরিয়ে ট্রাই বেঁধে দিয়ে বলল,
‘ কোথায় যাওয়া হচ্ছে এখন? ’
‘ জরুরি কাজের ডাক পড়েছে, অফিসেই যাচ্ছি। ’
‘ কিন্তু তোমার ছুটি তো শেষ হয়নি। ’
‘ সেটা তো বাকি আছে, কয়েকঘন্টার জন্য যাচ্ছি। দুপুরে একসাথে খাবার খাবো। কেমন? ’
ইমতিয়াজ চলে গেলো ওর কাজে। ফিরলো দুপুরেই। ভূমিকা ও তার পরিবারের সাথে খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে ওরা নিজেদের সংসারে ফিরলো। ইমতিয়াজের তিন রুমের ফ্ল্যাটেই শুরু হবে ওদের সংসার।
ভূমিকা কোমড়ে আঁচল গুঁজে ইমতিয়াজকে নিয়ে সব পরিষ্কার করলো। নতুন কিছু আসবাবপত্র কিনলো দুজন। ফ্ল্যাটের এক দেয়ালে শুধু ওদের ছবিই রাখলো। যেগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ঢঙে তোলা। ইমতিয়াজের গ্রেজুয়েট হওয়ার ছবি, ভূমিকার ট্রেনিং থেকে ফেরার ছবি, যোগ হলো ওদের বিয়ের ছবিও।
ফ্রেশ হয়ে দু’জন একসাথে রান্না করলো। তারপর খেয়ে দেয়ে একসাথে মুভি দেখতে বসলো। ওদের এই গল্প, এই জীবনযাপন তোমাদের কারো না কারো ইচ্ছে তাই না? গল্পটা আমি সেইসব স্বপ্নবাজ মানুষের জন্যই লিখতে শুরু করেছিলাম। কোনো ট্রাডেজি বা কাহিনি বাড়াতে চেষ্টা করিনি। শুধুই সাবলীলভাবে লিখেছি তোমাদের জন্য।
★
১২ জানুয়ারি ২০২৩
হ্যালো, আমি ভূমিকা রহমান। বর্তমানে আমার বয়স ৩২, এবং আমাদের বিবাহিত জীবনের দুই বছর চলছে৷ আমি তোমাদের জন্য আজ লিখতে বসেছি আমার দুই বছরের সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা। কোথা থেকে শুরু করবো বলো তো? চলো আমাদের বিবাহিত জীবনের চতুর্থ দিন থেকে শুরু করি।
ইমতিয়াজ অনেক কেয়ারিং আমার প্রতি, সেটা তোমাদের আমি দুই বছর আগেই বলেছি ডায়েরিতে। বিয়ের পর ও আরও কেয়ারিং ও সাপোর্টিভ হয়ে গেছে। আমার কি লাগবে না লাগবে সবকিছুর খোঁজখবর ও রাখে। আমাদের সংসার জীবন অনেক ভালো চলছিল। আমরা সকালে একসাথে ফ্রেশ হতাম, নামাজ পড়তাম, হাঁটতে বের হতাম। খেতাম, মুভি দেখতাম, ঘুরতে যেতাম, ঘুমাতাম। তারপর যখন ছুটি শেষ হয়ে যেতো আমরা দু’জন দুজনের কাছে প্রমিজ করতাম যে আমরা আবারও এক হবো, আমাদের আবারও দেখা হবে। আমরা আবারও আনন্দ করবো। তারপর শুরু হতো আমার গম্ভীর সেই সেনাজীবন। ইমতিয়াজ হয়তো নতুন নতুন সব প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কিংবা দেশের জন্য কোনো উড়ো বাহন বানানোর কথা ভাবতো।
আমাদের সংসার জীবনের প্রথম বছরেই আমার হাতে গুলি লাগে। ইমতিয়াজ জানলো যখন আমি ছুটিতে ফিরলাম তখন। সে কি রাগ ওর, নিজেকে আমার পর ভেবে দূরে দূরে থাকতো। কিন্তু আমার খেয়ালও রাখতো। নিব্বা নিব্বির মতো প্রেম কাহিনি মনে হচ্ছে তাই না? কিন্তু এটা আসলেই সিরিয়াস ছিল। আমার উচিত ছিল ওকে জানানো, কিন্তু আমি জানাইনি। ভেবেছিলাম কিছু তো হয়নি, শুধুই চিন্তায় ফেলবো কেন?
তোমরা ভাবছো সংসার জীবনের কথা বলবো বলে আমি তোমাদের একঘেয়েমি এসব শোনাচ্ছি কেন? আসলে সংসার জীবন নিয়ে তেমন কিছু আমার লিখতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা যেমন দেখো, সংসার জীবন তেমনই। তবে আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি যে, প্রিয় মানুষকে পেয়ে যাওয়ার পরও আমার একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয় যদি আমরা এক না হতাম, তবে আমাদের গল্পটা নিশ্চয়ই ভিন্ন হতো। দুঃখের হলেও আমরা অন্যরকম এক জীবনযাপন করতাম।
তোমরা হয়তো ভাবছো, কি বলে পাগল মেয়ে! আসলে আমি এমনই, ইমতিয়াজকে পেয়ে যাওয়ার পর আমার মনে ভয় ঢুকেছে। যদি ওকে আমি না পেতাম তবে ওকে হারানোর কোনো ভয়ই থাকতো না৷ পেয়ে গেছি বলেই কি না নিজের সেনা জীবনে চরম ব্যস্ততার মধ্যেও আমি উদাস হয়ে যাই। শূন্যতা আমায় ঘিরে ধরে, শুধু মনে হয় ওকে আমি আগের মতো ভালোবাসতে পারছি না। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমরা ছুটছি নিজ নিজ চাকরি বা ব্যস্ততায়। অথচ আমাদের উচিত ছিল সব একপাশে রেখে দুজন দুজনকে দেখে যাওয়া।
ইমতিয়াজকে আমার এসব অদ্ভুত ভাবনা বলেছিলাম। এবং বর্তমানে আমি প্রেগন্যান্ট, এবং এখনো আমার সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট চলছে। ডাক্তারের মতে আমি এক কাল্পনিক চরিত্রে ডুবে আছি। যেখানে আমি একা, নিঃস্ব। যেখানে ইমতিয়াজ আমার হয়নি, সেজন্য আমার মন খারাপ হয়। ইমতিয়াজকে পেয়ে যাওয়ার কারণে আমার শুধু কান্না পায়। প্রেগন্যান্ট হওয়ার কারণে ও এটা হয়ে থাকতে পারে৷ কিংবা সব পেয়ে যাওয়ার পর কোনো দুঃখ না থাকলে আমরা নিজ থেকেই দুঃখ বানিয়ে নেই টাইপ কাজ হতে পারে।
তোমাদের আমার এসব আজগুবি কাজ বললাম, কারণ আমি জানি মানুষ হওয়ার কারণে আমাদের সবার মধ্যেই আবুল তাবুল ভাবনা আছে৷ এসব আমার আবুল তাবুল ভাবনাই। যেটা শুধু আমার নিজের৷ আমি আজকাল অনেক ইমোশনালও হয়ে পড়েছি। আমার কিছু হলেই শুধু কান্না পায়। ইমতিয়াজ আমার জন্য এট্ সেটা নিয়ে আসে। কিন্তু তবুও আমার কান্না পায়।
★
৫ আগস্ট ২০২৫
হাই, আমি ভূমিকা রহমান। আমার হাসবেন্ড ও মেয়ে নিয়ে আমার ছোটখাটো সংসার। বর্তমানে আমি মিলিটারি কর্ম শেষ করে বাসায় ফিরেছি। মেয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়ের বাপের সাথে। আমি তোমাদের লিখতে বসেছি ভাত রান্না করার ফাঁকে। অদ্ভুত আমার সাথে সাথে অদ্ভুত লেখা পড়ার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ।
(সমাপ্ত)
( ইহা একটি অদ্ভুত গল্প।)