আমার মা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
3

#আমার_মা (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মা আমাকে নিয়ে ফুপু বাড়ি থেকে চলে আসলো। অথচ ফুপু একবারের জন্য আটকালো না। সেই ঘটনার পর বহু সময় কেটে যায়। বাবার ব্যবসা প্রথম দিকে লসে যায়। বাবা ভেঙে পড়লেও মা পড়ে না। মা বাবাকে সবসময়ের মতো সাহস দেয়। আমার মা অনেক শিক্ষিত ছিলো। তাই সে গ্রামে টিউশনি নেয়। তার পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজও শুরু করে। সেই টাকা দিয়ে সংসারটা কোনভাবে চলে যায়। অন্যদিকে বাবাও ব্যবসার প্রতি অনেক মনোযোগ দিতে শুরু করে। মায়ের অনুপ্রেরনা বাবার কঠোর পরিশ্রমে ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাবার ব্যবসায় উন্নতি হতে শুরু করে। এই পুরো সময়টা জুড়ে আমার মা বাবাকে আর্থিক, মানসিক সবভাবে সাহায্য করে গেছে। তার পাশে শক্ত খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই সময়ে আমার বাবাও মাকে খুব ভালোবাসতো। বাবা, মায়ের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করতো।

ধীরে ধীরে আমি বড় হই। আমার বাবা ব্যবসায় উন্নতি করে। আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। গ্রামের টিনের বাড়ি ভেঙে সেখানে পাকা বাড়ি উঠে। সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিলো। ইতিমধ্যে ফুপুরাও বাবার এই অবস্থার কথা জানতে পারে। তারাও আমাদের বাড়ি আসতে শুরু করে। অথচ খারাপ সময়ে এরা একবার ফোন করেও জিজ্ঞেস করেনি। ফুপুদের সেই খারাপ ব্যবহার ভুলতে না পারলেও তারা আমাদের বাড়ি আসলে আমরা খারাপ আচরণ করতাম না। বরং তাদের আমাদের সোফাসহ সবকিছু এমনভাবে ব্যবহার করতে দিতাম যাতে সেগুলো ব্যবহার করে তারা অনুভব করে অতীতে তারা কত ভুল করেছি।

আমাদের সুখের সংসার এভাবেই চলছিলো। হঠাৎ একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার লিউকেমিয়া হয়েছে। এটা শোনার পর আমি যতটা না ভেঙে পড়েছিলাম তারচেয়ে বেশি আমার বাবা ভেঙে পড়েছিলো। হ্যাঁ আমার বাবা। অথচ আজ আমার মা তার কাছে বোঝা। যাই হোক মায়ের অসুস্থতা ধরা পড়লে তার চিকিৎসা করানো হয়। রেগুলার কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। যার ফলে কিছুটা সুস্থবোধ করে। মা শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে। যার ফলে শরীর যতটা সুস্থ হয় তারচেয়ে বেশি আবার খারাপ হয়।

মায়ের মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণ হলো বাবা। হ্যাঁ বাবার জন্য মায়ের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বাবার আচরণে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। দিবে নাই বা কেন? সারাক্ষণ ফুপুরা কানের কাছে বলতো,“একটা অসুস্থ বউকে কতদিন পালবি? তোর একটা জীবন আছে না? জীবন নিয়ে ভাব?”
এসব কথার প্ররোচনায় নাকি অন্য সঙ্গী পেয়ে বাবা বদলে গেল জানা নেই। তবে ইদানীং মায়ের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করতে শুরু করেছে।

বর্তমানে,
এসব কথা ভেবে মা মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সেদিন রাতে বাবা মায়ের কাছে আসলে মা তার হাতটি আলতো করে ধরে। বাবা চমকে যায়। মা শান্তগলায় বলে,“কাউকে মনে ধরেছে?”
বাবা সেই কথার জবাব দেয় না। সে কঠিন চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মা ম্লান হাসে। অতঃপর বলে,“তোমার যদি কাউকে মনে ধরে তবে তাকে তুমি বিয়ে করো। কিন্তু আপাতত তাকে এই ঘরে নিয়ে এসো না। অন্যত্র রাখো। আমি কোন আপত্তি জানাবো না।”

”কি!”
আমার মায়ের কথায় বাবা খুব অবাক হয়। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে মা একই কথা বারবার বলে। মায়ের এমন সম্মতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন কষ্টটা বাবা অনুভব করতে পারেনি। একদমই অনুভব করতে পারেনি। বরং খুশি হয়েছিলো। আপনমনে বলে,“তোমার মারাত্নক অসুখ হয়েছে। তুমি আর কয়দিন বাঁচবে। কিন্তু আমার তো একটা জীবন আছে। চাহিদা আছে। সবটা তো বোঝ।”

“তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমার জায়গা অন্যকেউ থাকলেও হয়তো সেটাই করতো।”
মায়ের এই অভিযোগ নেই কথার মাঝে যে কত অভিযোগ আছে তা বাবা বুঝতে পারেনি।বলা যায় বোঝার চেষ্টা করেনি। যাই হোক মা বাবার হাত ধরে অনুরোধ করে বলে,“একটা কথা রাখবে?”

“বলো?”
বাবা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে। মাও শান্ত গলায় বলে,“আমি ম রে গেলে আমার মেয়েটার কেউ থাকবে না। ওর বিয়ের ব্যবস্থাটা করবে। ওর একটা গতি হলে আমি ম রেও শান্তি পাবো।”
মায়ের কথা রাখে বাবা। সে আমার ভালো জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করে। আমি তখন সবে কলেজে পা রেখেছি। বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে রাজি হই। মা মৃ ত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও আমার কথাটা ভাবছে, আর আমি তার সুখের জন্য এটা করতে পারবো না?

আমার ভালো জায়গায় বিয়ে হয়। তবে আমি বেশিরভাগ সময় বাবার বাড়ি থাকি। মায়ের দেখাশোনা করতে। এরমাঝে খবর আসে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়েছে৷ বাবা যাকে বিয়ে করেছে তার সঙ্গে কয়েক মাসের সম্পর্ক বাবার। মা বাবার বিয়ের কথা শুনে সেদিন নিরবে কান্না করছিলো। আমি অবশ্য মাকে বাবাকে আটকাতে বলেছিলাম। কিন্তু মা আটকায়নি। মা বলেছিলো,“যাকে ভালোবাসায় বাধা যায় না তাকে কোনভাবে আটকে রাখা যায় না। তাছাড়া তোর বাবা যা করেছে ভালোই করেছে। যেটা আমার ম রার পর হতো সেটা আগে হয়েছে। সমস্যা কই? তবে হ্যাঁ, আমার ম রার পর হলে হয়তো আমি কিছুটা সুখ নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে পারতাম।”

মায়ের মুখে এই কথা শোনার পর আমি তাকে বুকে জড়িয়ে সেদিন হাউমাউ করে কান্না করেছিলাম। মা পুরোটা সময় মন শক্ত করে আমার কান্না থামানোর চেষ্টা করে। এরপর একদিন মা অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই সময়ে মা বারবার বাবার কথা বলছিলো। তাকে দেখতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তার চাওয়া পূরণ হয় না। আমার বাবা সেদিন ফোন ধরেনি। হয়তো নতুন বউয়ের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলো।

বাবা যখন আমার অনেকটা কল দেখে কলব্যাক করে তখন আমার মা চিরতরে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।জন্ম নিলে মৃ ত্যু হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। তাই আমার মায়ের মৃ ত্যু আমাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তারচেয়ে হাজার গুন বেশি কষ্ট দিয়েছে এটা যে আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমার মা মৃ ত্যুর সময় বুকে এক আকাশ সমান কষ্ট নিয়ে মা রা গিয়েছে। বাবার ফোনটা ধরে আমি শান্ত গলায় বললাম,“তোমার আর তোমার বউয়ের গলার কাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছে হলে শেষ দেখা করতে এসো।”

আমার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে বাবা বোধহয় হতভম্ব হয়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ ছুটে আসলো। বাবা সেদিন মায়ের মৃ তদেহ জড়িয়ে অনেক কান্না করছিলো। কিন্তু তার কান্না দেখে আমার হাসি পাচ্ছিলো। যে মানুষটিকে বেঁচে থাকার সময় দাম দিলো না। সেই মানুষটির মৃ ত্যুর পর ভালোবাসা দেখাচ্ছে। আর এখান থেকে আমাদের বাবা, মেয়ের সম্পর্কের ভাঙন হলো। মায়ের মৃ ত্যুর পর আমি আর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলাম না। বাবা যদিও চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমি করিনি। কারণ আমার মা। আমার মায়ের যন্ত্রণা আমি সন্তান হয়ে ঠিক বুঝেছি। বাবা স্বামী হয়ে না বুঝলেও। এখন শুনেছি বাবা তার দ্বিতীয় বউ নিয়ে আমাদের ঘরে উঠেছে। ফুপুরাও এই ভাবীকে পেয়ে মহা খুশি। অথচ আমার মাকে কত জ্বালাতন করতো?

আমি মানছি বাবা পুরুষ মানুষ। তার চাহিদা থাকতে পারে। তার চাওয়ায় হয়তো ভুল নেই। কিন্তু! সেটা কি আমার মায়ের মৃ ত্যুর পর হতে পারতো না? আমার মা অনুমতি দিলো ওমনি বিয়ে করে নিলো। কেন? যে মানুষটি তার জন্য, তার সংসারে এতটা বছর ছিলো তার খুশির জন্য বলতে পারতো না সে কারো সাথে সম্পর্কে নেই। সে বিয়ের কথা ভাবছে না। এতটুকু মিথ্যে ভালোবাসা আমার বাবা আমার মাকে দেখাতে পারতো না? এসব কথা ভাবলেই আমার বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়। সেই রাগের জন্যই সারাজীবন বাবার সঙ্গে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব নিয়ে অবশ্য আমার স্বামী আমাকে বাবার সঙ্গে সব মিটিয়ে নিতে বলতে আসতো। তবে আমি তার বুকে মাথা রেখে যখন আমার মায়ের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের জার্নি বলেছি তখন থেকে সে আর এই বিষয় নিয়ে কখনো কথা বলতো না।

এই দিক দিয়ে মানুষটি অনেক ভালো। আমাকে অনেক বুঝতো। আমাকে খুব ভালোও বাসতো৷ তবে বাবা, মায়ের পরিনতি দেখলে মাঝে মাঝে ভয় হয়। তাই তো নিজের স্বামীর বুকে মাথা রেখে প্রায়ই বলি,“আমি আমার মায়ের মতো অসুস্থ হয়ে পড়লে তুমি আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করো না। প্লীজ করো না। প্রয়োজন পড়লে আমাকে নাহয় মে রে ফেলো। তারপর বিয়ে করো। তাও আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় করো না।”
আমি এই কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়তাম। কারণ আমার চোখের সামনে আমার মায়ের স্মৃতি ভেসে উঠতো। আর সেই সময়ে আমার স্বামী আমাকে বুকে জড়িয়ে শান্তভাবে বোঝাতো, সবাই এক না। সে আমাকে খুব ভালোবাসে। সে কখনো এমন করবে না।

(সমাপ্ত)