আমার ললিতা পর্ব-১৮+১৯+২০

0
527

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৮
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“জ্বর এসেছে?”

“ভীষণ।”

“কষ্ট হচ্ছে?কীভাবে কমবে এই কষ্ট প্রিয় রজনীগন্ধা?”

পরিচিত এক কণ্ঠে ধীরে ধীরে চোখ খুললো বেলী।অসুখের চোটে তার নেত্রপল্লব গুলো খুলে রাখা ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তবুও যেন দুটো পত্র একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছেদ করতে চায়।দৃষ্টির সীমনা পরিষ্কার হতে বেলী দেখতে পেলো রামীম বসে আছে।তার পরনে গোলাপি রঙের একটি শার্ট।পুরো রুম গোলাপ জলের সুগন্ধে ভরে গিয়েছে।বেলী ধীরে শুধালো,

“রামীম আপনার ট্যুর কেমন কাঁটলো?সিলেট জায়গাটা কেমন?”

“ভালো না রজনীগন্ধা।সেখানে সব কিছু ছিল কিন্তু কিছু একটা ছিলনা।”

“বাহ রে?তবে সবাই যে বলে সিলেট অনেক সুন্দর জায়গা।”

“তারা ভুল বলে না।কিন্তু আমার সেখানে শান্তি নেই।বরং নিজ গন্তব্য খুঁজে পেয়েছি।”

“আপনার গন্তব্য?”

অন্ধকারে রামীম বিমূঢ় হয়ে বাহিরের দিকে তাঁকিয়ে রয়।ভোর হতে শুরু করেছে।তমসা মিটে গিয়ে চারিধার ফর্সা হয়ে উঠছে।রামীম ফিসফিস করে বলল,

“জায়গাটা সংকীর্ণ রজনীগন্ধা।অনেক একা লাগে মাঝেমধ্যে।ভয় হয়।সেখানে ফিসফিস করে আড়ালে কেউ কথা বলে।তাদের পরিচয় জানিনা।যখন তারা আসে একটা একটা…।”

বেলী উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধায়,

“কী রামীম?”

“একটা অনুভূতি হয়।একটা য’ন্ত্র’ণা হয়।এই যে দেখো এখন তোমার সাথে বসে আছি কতো শান্তি।”

“আমার কাছে আপনার শান্তি লাগে রামীম?”

“ভীষণ শান্তি লাগে রজনীগন্ধা।আসছে বৈশাখে আমার সাথে পুরো ঢাকায় রিক্সা দিয়ে ঘুরবে?তোমাকে এক হাত চুড়ি কিনে দিবো।তুমি তো আবার কাব্যিক মানুষ।এসব পছন্দ করো বেশী।যাবে তো আমার সঙ্গে?”

বেলী কিছু জবাব দিতে যাবে তখন জোরে কোথাও শব্দ হলো।যা কানে তালা লাগিয়ে দেয়।বুকে কাঁপন তৈরী করে।অসুস্থ শরীর হলেও সে চমকে উঠে বসলো।শ্বাস দ্রুত হচ্ছে।ঘরে থাকা ছোট্ট বাতায়ণ দিয়ে প্রচুর আলো আসছে।স্মরণে হচ্ছে এক ধ্বংসকারী আগুনের রাজা সমস্তটা জ্বালিয়ে দিয়েছে।বেলী তড়িঘড়ি করে উঠে জানালার সামনে দাঁড়ায়।ওইতো দাঁড়িয়ে আছে অনল!আগুনের রাজা।যার হাতে ছোট একটা চাবুক।শুভ্র আলো যার চারদিক হতে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে।অধরযুগলে মায়াময় হাসি।উন্নত কণ্ঠে চারদিকে ঘোষণার সুরে বলে,

“সর্বনাশিনী আমার ললিতা!আসছে বৈশাখ আমি তোমার সব স্বপ্নকে দা’ফ’ন করে দিবো।মনের সব স্বপ্নকে আমার প্রজারা ধূলিসাৎ করে দিবে।সব ভুলে যাবে।মনে রাগবে শুধু অনলকে।এই আগুনের রাজাকে।এখন নাও আমার মধ্যকার আগুন।ধ্বংস করে দাও প্রেমের সেই গানকে।”

একটি গোলাকার আগুনের ফুল ছুঁড়ে দিলো বেলীর দিকে।আর্তনাদ করে সে পিছিয়ে রামীমের পায়ের কাছে।কিন্তু এ কী?এখানে তো রামীম নেই।বরং শত শত অনল।তার দিকে তাঁকিয়ে হাসছে।কী নিষ্ঠুর সে হাসি।

স্বপ্ন থেকে বের হয়ে এলো বেলী।কিন্তু এখনও মস্তিস্কের ভেতর কেউ হাসছে।কিছু সে ভাবতে পারছেনা।এতোক্ষণ যা দেখলো তা কী সত্যিই স্বপ্ন?নাকী এখনকার পরিস্থিতিটা স্বপ্ন?শরীর কাঁপছে অনবরত।দূর্বল কণ্ঠে উঠে বসে ডাকলো নিজের মা কে।কিন্তু কণ্ঠটা এক হাত দূরে পৌঁছালো কীনা সন্দেহ।মস্তিস্ক এখন কিছু ভাবার মতোন অবস্থাতে নেই।তবে ভাগ্য সহায় ছিল।বিছানাতে হাত দিতে ফোন পেলো।কাঁপা কাঁপা হাতে সিয়ামের নাম্বারটা ডায়াল করলো।সিয়াম তখন পড়তে ব্যস্ত ছিল।ইদানীং সকাল হলেও তার পড়া শেষ হয়না।বোনের ফোন পেয়ে কৌতুহল হয়ে রিসিভ করলো।অস্পষ্ট বেলী কিছু বলছে।

“বেলী কী হয়েছে তোর?এভাবে কথা কেন বলছিস?”

“ভাইয়া ভাইয়া।”

গোঙানির শব্দে সিয়াম ভয় পেয়ে গেলো।তড়িঘড়ি করে ছুটলো বেলীর রুমের দিকে।

বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে পুরো রুম বেলী।অনবরত গা কাঁপছে তার।মানসিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে কখনো দরজা লাগিয়ে ঘুমায় না।এজন্য ঢুকতে সুবিধা হলো সিয়ামের।বোনকে গিয়ে পুরো আগলে নিলো সে।

“বেলী!বেলী!বোন কী হয়েছে দেখি সোজা হয়ে বস।জ্বরে তো শরীর একেবারে শেষ দেখছি।”

বেলীর ততোক্ষণে সব ধরণের হুঁশ চলে যাচ্ছে প্রায়।পুরোপুরি চেতনা হারানোর পূর্বে সে দেখতে পেলো রামীম ও অনল একসাথে দাঁড়িয়ে আছে।দুজনের মুখে কেমন দূর্বেধ্য হাসি।

(***)

রেবেকা মেয়ের মাথায় খুব ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।সকালে যখন সিয়াম এসে বলল বেলী কথা বলছেনা তখন যে ভয়টা পেয়েছিল তা সে সারাজীবনে পায়নি।ভেবেছিল বেলী খুব খারাপ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এই বুঝি মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললো।ডাক্তার বলে গিয়েছে সাধারণ জ্বর থেকে এমন হয়েছে।এছাড়া ইদানীং বেশ চাপ গিয়েছে।রেবেকা এজন্য তোফায়েলের উপর বেজায় চটে গিয়েছে।সে যদি অফিসে কাজ করার জন্য না বলতো তাহলে নিশ্চয় এতোটা অসুস্থ হতো না।

বেলী একটু নড়েচড়ে উঠলো।মায়ের মমতাভরা কণ্ঠে শুনতে পেলো,

“বেলী মা আমার।এখন কেমন লাগছে?”

হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধ একটুও ভালো লাগেনা বেলীর।তবুও মায়ের জন্য ধীরে বলল,”ভালো।”

“রাতে যখন জিজ্ঞেস করলাম জ্বর খুব এসেছে নাকী?তখন কেন জবাব দিলে যে এতোটা জ্বর হয়নি।ঔষধ খেলে সুস্থ হয়ে যাবে।”

“সবসময় সুস্থ হয়ে যাই এভাবে।আজ কী যে হলো।”

“যদি সিয়াম তখন জেগে না থাকতো তবে কী হতো?”

“আব্বু কোথায়?”

“ওনার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“কেন?তুমি কী বাবার সাথে ঝগড়া করেছো?”

“হ্যাঁ।তার জেদের জন্য তোমার এই অবস্থা হয়েছে।”

“আশ্চর্য আম্মু।বাবার কী দোষ এখানে?”

রেবেকা কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার ফোনে কল এলো।রিসিভ করে কথা বলতে বলতে সে বাহিরে চলে গেলো।শূন্য কক্ষে বেলীর মাথায় চট করে ভোরের স্বপ্নটা এলো।অদ্ভূত হলেও সে ভয় পাচ্ছে ভীষণ।শব্দ করে দরজা খুলে গেলো।রেবেকা এসেছে ভেবে সেদিকে তাঁকালো সে।অনল দাঁড়িয়ে আছে।বেলী ঢোক গিলে শুস্ক গলা ভিজিয়ে নিলো।

অনল নামক পুরুষটির সবকিছু সত্যি বড় শৈল্পিক।বড় বড় কদম ফেলে যখন ভূমিতে পড়ে তখন বেলীর মনেও বড় ঝড় উঠে।ভোরের স্বপ্নের জন্যই বোধহয় এখন তাকে খুব ভয় করছে মেয়েটার।অনল একদম তার সামনে এসে থামলো।মুখ বিবরে চির পরিচিত সেই হাসি নেই।বরং সেখানে এক কাঠিন্যতা বিরাজমান।হঠাৎ ঝুঁকে বেলীর চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো।সেখানে মেয়েটা দেখতে পেলো আগ্নেয়গিরির গলিত প্রস্তরাদি ছুটছে।বেলীকে অবাক করে দিয়ে অনল তার কপালে হঠাৎ অধরযুগল ঠেকালো।এটাকে ঠিক চুমো বলা চলেনা।মনে হচ্ছে পুরুষটি তার মধ্যেকার সব মলিনতাকে শুষে নিচ্ছে।সকালে যতোটা তাকে ভয় লাগছিলো বেলীর তা উবে গেলো।সেখানে এসে ভীর করলো একরাশ মায়া।যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে সে চিন্তামুক্ত হলো তখন সরে গেলো অনল।এক মিনিট নীরব হয়ে মেয়েটাকে দেখলো।হুট করে ন’র’কের আগুন জ্ব’লে উঠলো তার চোখে।বেলীর চোয়াল চেপে বলল,

“ডায়রেক্ট ম”” র্গে যাওয়ার চিন্তায় ছিলে মেয়ে?নিজের প্রেমিকের মতোন?তাহলে মনে রাখো অনল তোমাকে মাটির নিচ তুলে এনে ঘরে সাজিয়ে রাখতে জানে।এরপর এমন দেখলে সোজা পুকুরে সারারাত দাঁড়া করিয়ে রাখবো।আমি এতোটা ভালো মানুষ না ললিতা।উল্টো তুমি যা ভাবো এর থেকে বেশী খারাপ।”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

বেলীর অধরযুগলের থেকে কিঞ্চিত দূরত্বে রয়েছে অনল।দুজনের মধ্যে মিষ্টি সমীরণও এখন বয়ে যেতে লজ্জা পাবে বোধহয়।পুরুষটিকে এতো কাছে আসার অনুমতি বেলী দেয়নি।তবে এতো কেন দুঃসাহস?হসপিটালে থাকায় যেকোনো নার্স সহজে রুমের ভেতর প্রবেশ করে ফেলবে।এছাড়া কথা বলা শেষ হলে রেবেকা এক মিনিটও বাহিরে থাকবে না।মা কে কী বলে জবাব দিবে সে?যদি অনলকে নিয়ে প্রশ্ন করে।হাতের তালু দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো সে।অনলের মতোন ভারী দেহের মানুষকে সরানো তার সাধ্য তে নেই।

“বৃথা চেষ্টা করো না ললিতা।আমাকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিতে পারবেনা।এর থেকে বুকের বাম পাশে হাতটা রেখে অনুভব করো।বেশী আরামদায়ক তোমার জন্য তা।”

“ভীষণ কুরুচিপূর্ণ ও অসংলগ্ন কথাবার্তা আপনার।যা শুনতে ভালো লাগেনা।দেখেন এই আমি কানে হাত দিচ্ছি।”

বাক্যের শেষে সত্যি সত্যি কানে হাত দিতে লাগলো বেলী।চট জলদি অনল তার হাত দুটো বিছানাতে চেপে ধরলো।ভীষণ আগ্রাসী কণ্ঠে বলল,

“মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় এতো বেশী বোঝা ঠোঁট দুটোকে শাস্তি দেই।কিন্তু না তখন আমি হয়ে যাবো পা’ভা’র্ট।”

“ভুল।শুধু তা নয়।বরং চরিত্র হীনও বটে।আপনার প্রেমিকারা যদি জানতে পারেন আমার পিছনে ঘুরছেন তখন নিশ্চিত কেঁদেকুটে শেষ হয়ে যাবে।”

“আমার প্রেমিকা? সঙ্গে ‘রা’ যুক্ত আছে।একচুয়েলি সংখ্যাটা আমি বলে দেই।বর্তমানে আমার আটজন প্রেমিকা আছে।তাদের সর্দারনী তুমি ললিতা।”

অনল সরে দাঁড়ালো।গায়ে জড়ানো ব্লেজারটা টেনে ঠিক করে নিলো।এসময় এক ঝলক শার্টের আড়ালে থাকা ফুলে ফেপে ওঠা মাসলগুলো দেখা গেলো।বেলী সন্তপর্ণে গায়ে জড়িয়ে নিলো পাশে রাখা ওড়নাটি।অনল তা দেখে বিদ্রুপসূচক বাক্যতে বলল,

“তোমার তো দেখা যায় চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।এতোক্ষণ ওড়না ছাড়া ছিলে তখন খেয়াল ছিলনা।”

“শুনেন অনল।আপনি ইদানীং খুব বেশী কথা বলেন।আমাকে একটা জবাব দিন রামীমের কথা কীভাবে জানতে পারলেন?”

“সেটা তোমার জানার বিষয় না।তবে এক জায়গায় বাড়ী তৈরী করার সময় পূর্বের ওনার সম্পর্কে তো জানতে হবে।”

“মালিকের ব্যক্তিগত জীবন জানাও নিশ্চই আবশ্যক না।”

“তা নয়।তবে আমি জানি।আরো বহু কিছু জানি।”

“সেসব কী?”

“এমনকি তোমার দরকারেও একটা জিনিসটা জানি।”

অনল মৃদু হাসলো।বেলীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।কান্তিমান,মধু কণ্ঠের এই পুরুষটির মস্তিস্কের প্রত্যেকটি কোষে যে ষড়যন্ত্র উল্লাস রুপে ছোটাছুটি করে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।সেখানে এই হাসিটা বলে দিচ্ছে কিছু একটা ভুল আছে কথার মধ্যিখানে।বেলীর মন থেকে একটা শব্দ উচ্চারিত হলো ‘স্বাবধান!”

“আমার দরকারের জিনিস?সেটা কী?”

“মাই ললিতা, জানার আগে স্বাবধান হও।কারণ সেটা পাওয়ার জন্য ম” রি”য়া হয়ে উঠবে।এবং পাওয়ার পথ মটেও সহজ না।”

“হেয়ালি পছন্দ নয় আমার অনল।”

“রামীমের লিখে যাওয়া তার রজনীগন্ধার জন্য শেষ চিঠিটা নিশ্চয় পছন্দ হবে?কী বলো?”

বেলী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না কিছু সময়ের জন্য।স্থির দৃষ্টিতে অনলের দিকে তাঁকিয়ে থাকে।

“আপনি মিথ্যা বলছেন।এমন কোনো চিঠি নেই।থাকলে সেটা কেন আমার কাছে এলো না?”

“ধরে নাও চিঠিটা পথ ভুলে গিয়েছে।সেটিকে সঠিক দিশাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি এসেছি।”

“আপনি কে আসলে?”

“আমি কে?মাই ললিতা তুমি জিজ্ঞেস করছো আমি কে?”

“হ্যাঁ।”

বেলীর চোখেমুখে আশংকা।অনল আস্তে ধীরে বলল,

“আমি তোমার স্বপ্ন।”

“সুখের?নাকী এঁকেবেঁকে চলা কালচে সাপের মতোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন?”

“তা নির্ভর করবে তোমার উপর।আপাতত জানি চিঠিটা তুমি সহজে পাবেনা।”

“অনল আমাকে চিঠিটা দিয়ে দেন।আমি জানতে চাই সে শেষবার কী বলেছিল?”

“নো।আই সেইড নো ললিতা।”

“সেটা কী তাহলে আমি কখনো পাবো না?”

“পাবে সঠিক সময় এলে।”

বেলীর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।যেন হারানো কোনো বস্তু সে ফিরে পেয়েছে।অনলের মনটা হঠাৎ কেমন করে উঠলো।যে প্রণয় সে এই মেয়ের চোখে রামীমের জন্য দেখছে তা কেন সহ্য হচ্ছে না?অনল হঠাৎ শুধালো,

“তুমি রামীমকে অনেক ভালোবাসো?”

“ভীষণ?”

“কেন?কেন ভালোবাসো?”

অনলের প্রশ্নটা হঠাৎ আ’ক্র’ম’ণাত্বক মনে হলো বেলীর নিকট।কিন্তু সে চিঠির লোভে পাত্তা দিলো না।এহেন অবজ্ঞা গ্রহণ করতে না পেরে অনলের শরীর ঘামতে লাগলো।মুখটা সহজে লাল হয়ে উঠলো।স্মরণে হলো সে যদি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকে তবে বেলীর জন্য তা ভালো হবেনা।কোনো বিদায় সম্ভাষণ না করে দ্রুত রুমের বাহিরে চলে গেলো।

(***)

বেলী সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরেছে আজ চারদিন।তবে মনটা তার ভীষণ অসুস্থ।মাথাতে নানাবিধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।রামীমের চিঠিটা মূখ্য কারণ হলেও প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে অনলকে নিয়ে।হসপিটালে হুট করে আগমন,একটি রহস্যময় চিঠির কথা সব কেমন ধোঁয়াশা।বেলী যে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি তা নয়।তবে অনল তাকে এড়িয়ে চলছে।ভীষণভাবে এড়িয়ে চলছে মানুষটা।আশ্চর্যভাবে বেলী তাকে মনে করছে অনেক বেশী।এইযে যেমন হাতে থাকা রোমিও জুলিয়েট বইটি।মনে করিয়ে দিচ্ছে অনলের হাসিটাকে।একটি ধাক্কা খেয়ে ধ্যান ভাঙলো বেলীর।নীলক্ষেত এমনিতে ভীড়ের জায়গা।আবার আজকে একটু বেশী মানুষ।এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই।দোকানদার ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,

“বই নিবেন?”

“না।এটা আছে আমার কাছে।আমি অন্য একটা বই নিবো।”

একটি ইংলিশ নভেল হাতে তুলে নিলো বেলী।এই বই সম্পর্কে বিশেষ সে জানেনা।দাম মিটিয়ে সে সামনে হাঁটা দিলো।খানিকটা দূরে এগিয়ে গিয়ে থমকে গেলো।অনল দাঁড়িয়ে আছে?বেলী কী তাকে ডাকবে?আচ্ছা,এই পুরুষটির প্রতি ইদানীং কেন সে আকর্ষণ বোধ করে?নিছক বয়সের দোষে শারিরীক চাহিদা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।

“অনল?”

বেলীর ডাকটা অনলের অবধি পৌঁছাতে পারেনি।কারণ পুরুষটি একটি মেয়ের সাথে গভীর আলোচনা তে ব্যস্ত।বেলীর রাগ উঠলো।সবসময় মেয়েদের আশেপাশে থাকবে।তবুও নিজেকে সংযত করে পুনরায় ডাকলো।চিঠিটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার আছে।কিন্তু এবারও নিরাশ হতে হলো।তড়িঘড়ি করে সেদিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো সে।তৎক্ষনাৎ কনুইতে টান খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।হাতের বইটা নিচে পড়ে গেলো।একজন সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বেলীর প্রতি কনসার্ন দেখিয়ে বলল,

“আপনি ঠিক আছেন?”

“জি ধন্যবাদ।আমি আসলে একজনকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করিনি।”

“কাকে ডাকছিলেন?অনলকে?”

“জি।আপনি তাকে চিনেন?”বেলী শুধালো।

ছেলেটি গম্ভীর মুখে জবাব দিলো,

” হ্যাঁ।একজন ক্রিমিন্যালকে পুলিশ অবশ্যই চিনবে।হ্যালো আমি অফিসার সাদাব এনাম চৌধুরী।”

“ক্রিমিন্যাল?উনি…।”

“দেখতে ডিসেন্ট তাইতো?আমাদের চেনাজানা তে অনেক ভুল থাকে বেলী।”

“আপনি আমাকেও চিনেন?”

“কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?ভয় নেই আমি সত্যিই অফিসার।”

বেলী দ্বিধা নিয়ে মাথা দুলালো।সাদাব তাকে হাতের ইশারায় এগিয়ে যেতে বলল।তারা খানিকটা দূরে চলে যাওয়ার পর অনল পিছন ফিরে তাঁকালো।হঠাৎ তার মনে হলো কোথাও কোনো কিছু ভুল ঘটে গেলো।

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:২০
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“অনল ভদ্র সমাজে থাকা সেই এক ছদ্মবেশী ক্রিমিনালের নাম।নারীবাজ,ড্রা”” গ ডিলিং,খু””ন সহ বহু খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত।তার বাবা সিকান্দার সাহেব অবশ্য ছেলের কীর্তি সমন্ধে ঠিকঠাক জানেনা।”

সাদাবকে থামিয়ে দিলো বেলী।আশেপাশে একবার তাঁকিয়ে দেখলো কেউ তাদের দেখছে কীনা।অবশ্য যারা বসে আছে এখানে তারা সকলে কাপল।নিজেদের মধ্যেকার বোঝাপড়া করতে ব্যস্ত।বেলী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,

“আমাকে দেখতে আপনার উচ্চমানের গাঁধা মনে হয়?”

“অবশ্যই না।আপনি সম্পূর্ণ রুপে সুস্থ, সবল ও পরিপূর্ণ একজন মানুষ।”

“না মনে হতে পারে।তা নয় একজন পুলিশ অফিসার বিকেল বেলা এই রাস্তার ধারে গাছতলায় বসে কীনা আমাকে শোনাবে একজন কোন কোন অংশে ক্রিমিনাল?না ঠিক আছে।আমি দেখতে ভীষণ বোকাসোকা।”

সাদাব হেসে ফেললো।বেলীর কথা বলার ধরণ একদম বাচ্চাদের মতোন।এইযে যেমনভাবে এখন ঠোঁট উল্টে কথাগুলো বলল তাতে মনে হচ্ছে মাথাতে হাত বুলিয়ে দেওয়া যাবে।

“দুঃখিত বেলী।কিন্তু এখানে আমি যা বলে চলেছি তা মিথ্যা নয়।অনল কী অনেক বেশী নারী সঙ্গ উপভোগ করেনা?আমি যতোদূর জানি আপনি তার পিএস।”

“করে।সেটা নিজস্ব পার্সোনাল ব্যাপার।আমাকে এটা বলেন যে কোনো মেয়ে তার ব্যাপারে কমপ্লেইন করেছে?করলেও প্রাক্তনরা…।”

“আপনি একটা কথাকে প্রাক্তন ট্যাগ দিয়ে নরমালাইজ করতে চাচ্ছেন।ওনার ব্যাপারে কমপ্লেইন আছে।তা যদিও লিখিত না।”

“মৌখিক ও প্রুফ বিহীন একটা মানুষের উপর এলিগেশন লাগানো উচিত নয়।আমি একটা মানুষের উপর এমনিতে বলা কিছু বাক্য বিশ্বাস করবো না।যদি না নিজে থেকে দেখি।”

“বাহ!দেখা যাচ্ছে অনলকে আপনি অনেক বিশ্বাস করেন।সে আপনার কী হয়?”

চমক ভাঙলো বোধহয় বেলীর।সত্যি সে অনলের ব্যাপারে ঋণাত্বক মন্তব্যগুলোর বিপরীতে আ’ক্র’ম’ণা’ত্ব’ক হয়ে উঠেছে।অথচ সে নিজেও পুরুষটার উপর নারী ঘটিত বিষয় নিয়ে বিরক্ত ছিল।নিজের মধ্যে এতো বড় পরিবর্তন দেখে শংকাবোধ করলো।

“মি.সাদাব এনাম।নিজের কথাকে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়ার স্বভাব থাকলে তা আমার ক্ষেত্রে চলবে না।এছাড়া আমার সাথে কথা বলতে পারছেন কোনো আইনী পারমিশন ব্যতীত এটা কী অনেক নয়?”

“অবশ্যই অবশ্যই।যা বলেছিলাম।মি.অনল নারীদের নিজের স্লেইভ হিসেবে রাখে।এখন আপনি বুদ্ধিমতী।বিস্তারিত বলতে হবেনা নিশ্চয়।প্রমাণ যদি চান তাহলে আমি দিতে পারবো।কিন্তু তা বোধহয় আপনার পছন্দ হবেনা।”

মুখ টিপে হাসলো সাদাব।এসময় তার গালে একটি টোল পড়ে।দেখতে অবশ্য সুন্দর লাগে।বেলী ওদিকে নজর না দিয়ে বলল,

“প্রুফ দেখার ক্ষেত্রে এনাফ স্ট্রং আমি।”

“অবশ্যই।আপনার কাছে ইয়ারবাডস আছে?”

“জি।”

“ওয়েল।গুড।”

সাদাব ফোন বের করলো।ভিডিও অপশনে গিয়ে একটা ভিডিও প্লে করলো।বেলী শুনতে পাচ্ছে সেখানে একটি মেয়ে ভীত কণ্ঠে তার উপর হয়ে যাওয়া অ’ত্যা’চা’র গুলোকে বর্ণনা করছে।কিন্তু আশ্চর্যভাবে কোথাও অনলের নাম নিচ্ছে না।অনেক বিশ্রী বর্ণনা দেখে ফোনটা ফিরিয়ে দিলো বেলী।কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

“আমাকে এসব দেখানোর বিশেষ কারণ?”

“ধারণা করা হচ্ছে নেক্সট টার্গেট আপনি।একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি আপনার প্রতি তার অনেক প্যাশন।”

“ভিডিও তে একবারও মেয়েটি অনলের নাম বলেনি।সেক্ষেত্রে আপনি যা বলেছেন সেসবে আমি ঠিকঠাক ভাবে সায় দিতে পারবো না। দুঃখিত।যদি আপনি সত্যি পুলিশ হোন সেক্ষেত্রে ধন্যবাদ সতর্ক করার জন্য।”

“আমার কথা শুনুন বেলী।আপনি অনেকটা বিপদে পড়ে আছেন এখন।ভবিষ্যতে পস্তাবেন।”

সাদাবের কথাতে বিরক্ত অনুভব হলো বেলীর।সঠিক কোনো প্রমাণ ছাড়া এভাবে কারো উপর দোষারোপ করার মেয়ে সে নয়।উল্টো যে স্ব-ইচ্ছাতে স্লেইভ হয়েছে সেখানে অন্যায়ের প্রশ্ন থাকা উচিত নয়।সাদাব ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো।আশেপাশের মানুষ তাঁকিয়ে আছে।আশ্চর্যভাবে যতোগুলো মেয়েকে সে অনলের বি’রু’দ্ধে স্বাবধান করতে গিয়েছে সকলের প্রতিক্রিয়া এমন ছিল।কেউ কেন বিশ্বাস করছেনা কিছু?

(***)

কিছু মানুষের রাগ হয় পানির মতোন।আবার কিছু মানুষের রাগ জ্বলত অ’গ্নিকুন্ড যেন।সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।অনল ঠিক দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষ।সহজে রাগে না।কিন্তু রেগে কোনো রকমের হুঁশ থাকেনা।সিকান্দার সাহেবের উপর ভীষণ ভাবে চটে গিয়েছে সে।মাতৃভক্তি চিরকাল তার বেশী।পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার কারণ হলো অনলের অতিরিক্ত কহনার প্রতি ভালোবাসা।পুড়ে যাওয়া হাতটাকে অনেক ধীরে ধীরে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে সে।কহনা ব্যাথায় মুখ বিকৃত করছে।রাহিমা পাশ দাঁড়িয়ে আছে মুখটা গোমড়া করে।ঘটনা বিশেষ কিছু নয়।সিকান্দার সাহেব রেগে গিয়ে খেয়াল করেনি যে তার এক ধাক্কায় কহনা গরম পানির উপর গিয়ে পড়েছে।দূর্ভাগ্য হলো তখন অনল বাড়ীতে ছিল।সিকান্দার স্থির কণ্ঠে বলল,

“অনল তোমার মা কে হসপিটালে নিয়ে যাও।ইনফেকশন হয়ে গেলে সমস্যা হবে।”

“আপনি একটা কথাও বলবেন না মি.সিকান্দার।আমার মায়ের ব্যাপারে আমি বুঝবো।”

অনল ঠান্ডা কণ্ঠে বললেও অনেক ভারী শোনালো তা।সিকান্দার নাখোশ সুরে বলল,

“আমি তোমার বাবা।”

“আর এই মহিলা হচ্ছে আমার মা।যাকে আপনি সর্বদা আ’ঘা’ত দিয়ে গিয়েছেন।দেখেন আজ কতোটা কষ্ট পাচ্ছে সে।একটা কথা বলেন এই নারীর উপর এতো রাগ কেন আপনার?ঠিক কোন কারণে?”

“আমার রাগ নেই।সাধারণ তর্ক..।”

“ঠিক সাধারণ তর্ক।যার রেশ ধরে ধাক্কা দিয়েছেন।এই নারী যে আপনার তিন সন্তানের মা সে নিশ্চয় ধাক্কা ডিজার্ভ করেনা।”

কহনা ছেলের হাত ধরে বলল,

“অনল উনি তোমার বাবা।এভাবে বলেনা।”

“বিশ্বাস করো মা।বাবা দেখে অনেক কিছু বলিনা।তা নয় আমি অনল এতো ভালো মানুষ নই।রাহিমা মা কে রুমে নিয়ে যাও।আমি আসছি।কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।এতো রাতে নিয়ে গিয়ে অন্তত সিকান্দার সাহেবের সম্মানে আঘাত করতে চাইনা।”

রাহিমা মাথা দুলিয়ে কহনাকে নিয়ে চলে গেলো।অনল এক মিনিটও বাসায় থাকলো না।এখন সে উদ্দেশ্যহীন রাস্তায় হাঁটবে কিছুক্ষণ।গেটের বাহিরে বের হতেই বেলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।চমকে মেয়েটা অনলকে শুধালো,

“আপনার কাছে দরকার ছিল।ওইযে চিঠি…।”

বাকী কথা শেষ করতে পারেনি মেয়েটা।তাকে টেনে নিয়ে একদিকে চলছে অনল।রাত হওয়াতে তাদের উপর নজর দেওয়ার মানুষ নেই।হাতে বেশ টান অনুভব হচ্ছে বেলীর।অনল কী কিছু নিয়ে রেগে আছে?অবশেষে থামলো নানান রঙের পুরুষটি।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দাঁড়া করালো বেলীকে।সিমেন্টের দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বেলীকে একমনে দেখছে।চোখের দৃষ্টিতে কামনা নাকী বৃষ্টি খুঁজছে পুরুষটি।বেলী নিজেও হেলান দিলো দেয়ালো।ফিসফিস করে শুধালো,

“কী দেখছেন আপনি অনল?”

“দেখছি আমার মনে থাকা শুভ্র নির্মল নিষ্পাপ ফুলটিকে।তোমার রুপে।”

বেলী হেসে ওঠে।আচ্ছা যে এতো সুন্দর করে কথা বলতে জানে সে কী কখনো ক্রিমিনাল হতে পারে?

চলবে।