আমার ললিতা পর্ব-২৪

0
372

#আমার_ললিতা
#পর্ব:২৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“প্রেমে পাগল হওয়া মানুষকে এ কথা জিজ্ঞেস করতে নেই তটিনী।ললিতাকে আমি তখন থেকে চিনি যখন সে দূরন্ত কিশোরী ছিল।দূর্ভাগ্য তোমার স্বামীর সাথে সম্পর্ক হওয়া।আমি ভেবেছিলাম সবটা শেষ হয়ে গিয়েছে আমার।কোনো পথ নেই ললিতাকে আর নিজের করার।তবে ললাটের রেখা ভিন্নভাবে টানা হয়েছিল।যার দরুণ আজকে বেলীর উপর একমাত্র অধিকার অনলের।”

“অধিকার?কিন্তু সেটা তো এখনও আপনি পাননি।”

“আমি যা দেখি তোমরা সেটা দেখতে পাওনা।ললিতার মাথাতে ইতিমধ্যে শুধু অনলের বসবাস।তবে ওর বারে যাওয়ার কারণটা ধোঁয়াশা।”

শেষের বাক্যটি তটিনী এতোটা স্পষ্ট শুনতে পায়নি।অনল দ্রুত গাড়ী চালিয়ে একটি পাঁচ তারকা রেস্তোরার সামনে থামালো।আপাতত দৃষ্টিতে তাদের দেখে মনে হবে বোধহয় সাধারণ মিটআপের জন্য এসেছে।অথচ নেপথ্যে ঘটনা আরো গভীর।

“অনল স্যার?”

“ইয়েস।”

“আমার ছেলেকে এখানে নিয়ে আসা ঠিক হলো?ও সাধারণ একটা বাচ্চা।আমরা জানিনা সেখানে কী বিপদ আছে।”

“বিলিভ মি তটিনী।আমরা বড় ধরণের কোনো মিশনে আসিনি।বা আমি মাসুদ রানাও নই।এখানে এক বাঘিনীকে খাঁচাতে ভরতে এসেছি।”

“বাঘিনী!কে সে?”

অনলের অধরযুগলে তার চিরচেনা সেই শয়তানের রাজার হাসিটা ফুটে উঠলো।ধীর,স্থির তবে চতুরতা যেখানে মিশে আছে।লিফট বাটনে প্রেস করতে মুহুর্তে তাদের টপ ফ্লোরে নিয়ে গেলো।শীতল মেটালিকা দরজা খুলে যেতে কালো স্যুট পরা কয়েকজন কঠিন চেহারার পুরুষের দৃষ্টিগোচর হলো।তটিনী নিজের ছেলের হাতটা ভালোভাবে চেপে ধরলো।

“মি.অনল সৈয়দ কাশফ!আপনার অপেক্ষা করছিলেন ম্যাডাম।অনুগ্রহপূর্বক আমার সঙ্গে চলুন।”

লোকটার মুখে মস্ত বড় একটা পো”ড়া দাগ।রাশভারি কণ্ঠে অনললে বাক্যগুলো বলল।অধিকাংশ যারা সুরক্ষা সেবাতে নিয়োজিত থাকে তাদের কী এমন একটা না একটা ক্ষ”ত থাকে?তটিনীর মনে প্রশ্ন জাগলো।তাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি স্বচ্ছ কাঁচঘেরা কক্ষে।ভেতরে শুভ্র পোশাক পরিধানে এক রমণী বসে আছে।আয়েশা জিন্নাহ নাম।জন্ম থেকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হলেও বড় হয়ে ওঠা আমেরিকাতে।বর্তমানে অনেক প্রথম সাড়ির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই আটাশ বছরের যুবতীর নাম নেওয়া হয়।পুরোদস্তুর করপোরেট একজন মানুষ।

“ম্যাম তারা এসেছে।”

আয়েশার সচরাচর কোনো পুরুষের উপর আগ্রহবোধ হয়না।কিন্তু অনল নামক ব্যক্তিটার দুটো কথা তাকে আর্কষণ করেছে।এর মধ্যে প্রধান হলো যে নারী এই পুরুষের সঙ্গ পাঁচ মিনিট পাবে সে নিজেকে ভুলে যাবে।শুনে হেসেছিল আয়েশা।সেসব নারীদের চরিত্রহীন বলে আখ্যায়িত করেছিল।কিন্তু কোথায় আছে না?নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত মাঝেমধ্যে ভীষণ ভয়ংকর হেরে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে আসে।এখানেও বোধহয় তাই ঘটে গেলো।অনলের হেঁটে আসার ধরণ।কার্পেটের উপর মৃদু ঝংকার তোলা শৈল্পিক পদধ্বনি সব তাকে ক্ষণকালের জন্য আত্মবিমোহিত করলো।কিছু মানবের হয়তো জন্মলগ্ন থেকে এমন গুণ থাকে।মানুষের আত্মা অবধি পৌঁছানোর গুণ।

“মিস.আয়েশা?”

চমক ভাঙলো আয়েশার।সে বিব্রতবোধ থেকে বাঁচতে মুখে লম্বা একটি হাসি টেনে নিলো।নিজের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে হাত এগিয়ে দিলো।সরু,চিকন উজ্জ্বলতা ছড়ানো হাত।অনল স্পর্শ করে অনুধাবন করলো ভীষণ নরম!

“হ্যালো মি.কাশফ।কেমন আছেন আপনি?”

“গুড।”

আয়েশা ভেবেছিল অনল উল্টো তাকেও জিজ্ঞেস করবে।এটা তো স্বাভাবিক কার্টেসীর মধ্যে পড়ে।

“হ্যাভ এ সীট।”

ডিভানের দিকে নির্দেশ করে বলল আয়েশা।অনল বসে সরাসরি বলল,

“আমার ফর্মুলা ফেরত দেওয়ার জন্য কী চাওয়া আপনার আয়েশা?”

“সরাসরি মোদ্দাকথায় চলে এলেন দেখছি।একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আশা করেছিলাম।”

“ব্যবসাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে কোনো শব্দ নেই।যারা কথা আড়াল করার অভিপ্রায়ে থাকা তারা মূলত রাজনীতিবিদ।”

“ব্যবসা তো সবার সামনে করা হয়।আপনার সাথে না হয়।”

অনল সরাসরি আয়েশার চোখের উপর দৃষ্টিপাত করলো।অকস্মাৎ সকলকে চমকে দিয়ে শুধালো,

“বিয়ে করবেন?”

হকচকিয়ে উঠলো আয়েশা।যা তার চেহারা তে ফুঁটে উঠলো।পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার বডিগার্ডের কপাল কুঞ্চিত হলো।অনুধাবন করতে চাচ্ছে তার মনিবের প্রতিক্রিয়া।অন্যদিকে তটিনী!সে হেসে ফেললো।তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলেও নিলো।

“বিয়ে কেন করবো আপনাকে মি.কাশফ অনল?”

“আপনি তো এইমাত্র বললেন ব্যবসা করবেন না আমার সাথে। তাহলে নিশ্চয় বিয়ে করতে চাচ্ছেন।বাই দ্য ওয়ে আমার নাম অনল সৈয়দ কাশফ।আমার পিতা প্রদত্ত নামের উপর নিজ মর্জি চালাবেন না।”

“না বিয়ে করার অভিপ্রায়ে নেই।বরং এটির থেকে দূরবর্তী সম্পর্ক বন্ধুত্ব পাততে পারি।”

“নারী-পুরুষ কখনো বন্ধু হতে পারেনা।অথবা চুরি করা ফর্মুলা যে ক্রয় করে নিজের নামে পেটেন্ট করিয়ে নেয় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়।”

“কী বলতে চাচ্ছেন?”

“আমার বন্ধু আপনার নিকট যে ফর্মুলা গুলো বিক্রি করেছে সেগুলো চুরির।বিশ্বাসঘাতকতার।”

“আমি ব্যবসায়ী।এতো বিস্তারিত…।”

“ইয়েস!ব্যবসায়ী।যার ধর্ম লাভ করা।আমিও তাই।কিন্তু এই বলে নিজের নীতি বিসর্জন দেওয়া কেমন কাজ নারী?”

অনলকে কঠিন হতে দেখে তটিনী অবাক হলো।সে কখনো দেখেনি এ লোকটা তুচ্ছ কারণে রেগেছে।নিচু সুরে বলল,

“স্যার,শান্ত হোন।”

আয়েশা তাদের কথার মাঝে বলল,

“আইডিয়াটা সুন্দর।আমি উচ্চমূল্যতে ক্রয় করে নিয়েছি।তবে কোনোভাবে ফাইনাল অয়েলটা তৈরী করা সম্ভব হচ্ছে না।যা আপনার হাতে আছে অনল।আমি আপনাকে বিশাল অঙ্কের টাকা..। ”

“মিস.আয়েশা!অনল বিক্রিত হয়না।আমার কথা গুলো অনুধাবন করতে পারেননি।”

“যদি ফেরত না দেই?কী করবেন?”

“আপনার রাতের ঘুম কেঁড়ে নিবো।”

আয়েশা হেসে উঠলো।আভিজাত্যপূর্ণ এই নারীর হাসিটা দেখতে মাধুর্যময়।

“এতো সহজ?”

“কঠিনও নয়।”

“একবার পরীক্ষা করে দেখুন।আমার রাতের ঘুম কেঁড়ে নেওয়া এতো সহজ কীনা।সামনের মাসে ফেরত চলে যাবো ইউএসএ তে।ততোদিন সময় আছে।”

“তাগড়া ঘোড়াকে রেইস করতে বললে আখেরে আপনার বিপদ আয়েশা।”

“আমি বিপদ পছন্দ করি।আপনার সাথে কনভারসেশন আরো ভয়ানক হতো।কিন্তু সঙ্গে বাচ্চাটা থাকার জন্য হলো না।আমি বাচ্চাদের সামনে ভা’য়ো’লে’ন্স করিনা।”

“একটু বুদ্ধি খাটিয়ে দেখুন।আমি তাহলে আপনার ব্যাপারে কতটা জানি।আজ আসি মিস.আয়েশা।দেখা হবে খুব শীঘ্রই।তটিনী উঠে আসুন।”

অনলের পিছন পিছন উঠে এলো তটিনী।হঠাৎ পুরুষটি থেমে গেলো।পিছন ফিরে বলল,

“আয়েশা!মির্জা গালিবের শায়েরী।আপনাকে সাদাতে মানায় না।কখনো লাল পরে দেখবেন।”

(***)

পুরুষটির কোমড়ের বাঁকানোর অংশে দৃষ্টি আঁটকে গেলো বেলীর।নগ্নবক্ষা দেখে শুকনো ঢোক গিললো।কাপড়ের আড়ালে স্মরণে হয় এক মস্ত বড় পাহাড় লুকিয়ে রাখে অনল।বেলী থমকালো।আশ্চর্য ভাবে অনলকে পূর্বেও সে শার্টলেস দেখেছে।কিন্তু এতোটা সন্নিকটে থেকে নয়।সে যা কাজে এসেছিল মুহুর্তে ভুলে গেলো।তবে অনলের থেকে চোখ সরে গিয়ে তার রুমে পড়তে সময় লাগলো না।এতোটা গুছানো ঘর সঙ্গে সাজানো অবাক করার বিষয়।কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অনল পিছন ফিরে তাঁকালো।বেলীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কী চাই?”

“বন্ধুত্ব!”

কোমড় থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অনল।বিস্মিত সে।চোখের দৃষ্টিতে প্রশ্ন ভিজিয়ে শুধায়,

“বন্ধুত্ব?কে করবে?তুমি ললিতা?”

“জি।”

“অসম্ভব?আমার সাথে তুমি স্বজ্ঞানে মটেও বন্ধুত্ব করতে চাইবেনা।এমন কিছু হয়নি আমাদের মধ্যে।”

“কেন আমি বন্ধুত্ব পাতানোর মতোন যোগ্য নই বলতে চাচ্ছেন?”

“তেমন নয়।কিন্তু…। ”

অনল কিছু বলতে যাবে এর পূর্বে বেলী কেঁদে দিলো।সেটাকে অভিনয় বলা যাবেনা।অনল কখনো বেলীর চোখের পানি সহ্য করতে পারেনা।দ্রুত কাছে এসে মুখটা উঁচু করে বলল,

“কাঁদছো কেন মাই ললিতা?”

“একটু আগে ঘুমিয়ে ছিলাম।স্বপ্নে দেখেছি এই পুরো বাড়ীতে একশ একটা রামীম ঘুরে বেড়াচ্ছে।আমার পালানোর কোনো পথ নেই।শেষে আপনি এলেন আগুনের শিকল নিয়ে।প্রত্যেকটা রামীমকে ধরার জন্য।সেই থেকে মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।আপনি আমাকে সাহায্য করবেন অনল?অতীত ভুলতে?”

বেলীর সহজ সরল আবদারে ভুলে যায় অনল।বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা চোখের কার্ণিশ থেকে জল মুছে নেয়।নোনতা স্বাদ তার জিহবায় লাগে।প্রিয়তমার প্রতি মায়া জন্মায় অনলের।অথচ একদিন এই মায়া তার সফলতা বন্দি হয়ে যাবে।

চলবে।