আমার ললিতা পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
267

#আমার_ললিতা
#পর্ব:২৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“মি.অনল কাশফ!আমাদের দেখা হচ্ছে খুব শীঘ্রই।আপনার জন্য একটি উপহার আছে।যা খুব পছন্দ করতে যাচ্ছেন আপনি।”

জ্বলে ওঠা স্ক্রিনটার দিকে খানিকটা সময় তাঁকিয়ে রইলো অনল।আয়েশার এমন রহস্যময় ম্যাসেজ তার সুদর্শন কপালে ভাঁজ ফেলল।এমনিতে ভীষণ মন খারাপ। এর উপর যদি অপছন্দীয় কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয় তবে খারাপ লাগবে।বিষয়টি থেকে আপাতত মনোযোগ সরিয়ে নিলো।দরজায় শব্দ হলে দেখতে পেলো সিকান্দার ভেতরে ঢুকছে।অনল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

“আমার ঝগড়া করার এনার্জি নেই।”

সিকান্দার ঈষৎ নাখোশ হয়ে জবাব দিলো,

“তুমি আমার ছেলে।সবসময় কেন মনে করো যে তোমার সঙ্গে বাক বিতন্ডাতে জড়ানো আমার জীবনের একমাত্র বিষয়?আমি গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলতে এসেছি।”

“হুম।”

“শুনলাম বেলী নাকী রিজাইন করেছে।হঠাৎ কেন?”

“সে আগে থেকে জবটা করতে চায়নি।সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছি আমি।”

সিকান্দার একটু উশখুশ করছে।বারংবার নিজের গলার টাই ও হাতের ঘড়ি ঠিক করছে।বাঁকা চোখ দিয়ে বাবার মনের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে অনল বলল,

“কিছু বলবেন?”

“শশীকে তো চিনো।”

“জি।বেলীর বোন।”

“তোমার সরফরাজ আঙকেল বিয়ের প্রস্তাব এনেছে।পাত্রী শশী।মি.তোফায়েলকেও বিষয়টা জানিয়েছে।আপত্তি নেই তার।এজন্য তোমার কাছে মতামত নিতে এলাম।”

“তোফায়েল আঙকেলের সাথে কথা হয়েছে আপনার?”

“হ্যাঁ।আজ সকালে মর্নিং ওয়াক করার সময় হয়েছে।”

“আপনি জানেন আমার কী সিদ্ধান্ত।”

“শশী মেয়ে হিসেবে খারাপ নয়।”

“আমি তা বলিনি।বরং সবার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে।আমি কাকে স্ত্রী হিসেবে জীবনে মানতে পারবো সেটা নিশ্চয় অন্য কেউ ঠিক করে দিবেনা।আপনি নিজের জীবন দেখেও কী বুঝতে পারছেন না মতামতবিহীন বিয়ে একটা অভিশাপ।”

অনলের একটি দারুণ গুণ আছে।আর তা হলো সে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে।এবং মনে কোনো সংশয় রাখেনা।সিকান্দার মাথা দুলিয়ে বলল,

“আমি তাহলে না করে দিচ্ছি।কিন্তু ভ্যালিড রিজন ছাড়া বিষয়টি দৃষ্টিকটূ হবে।”

“এই সংশয়ের উত্তরও জানেন আপনি।”

“বেলী!”

অনল প্রহেলিকা করে বলল,

“আপনি ভালো জানেন।”

“তবে বড় বোনকে রিজেক্ট করে ছোট বোনকে বিয়ে করাও কিন্তু ট্রু জেন্টাল ম্যানের কাজ নয়।”

“আমি তা নই।বরং অনল কাশফ অনেক মন্দ একজন মানুষ।সাধু হতে পারেনি সে।”

“ওকে। তুমি তবে বিষয়টি হ্যান্ডেল করো।কারণ ভবিষ্যত এখানে যখন জড়িত।তবে চাইলে বেলীর কথা আমি বলে দেখতে পারি।”

“সঠিক সময় নয় এখন।আমার বহু কাজ বাকী।”

ফোনে টুংটাং শব্দ বেজে উঠলো।ম্যাসেজ ওপেন করতেই অনলের মুখবিবর উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।বেলী ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।মেয়েটা অবশেষে তার বইগুলো চুরি করতে সক্ষম হয়েছে।আবার বড় মুখ করে ম্যাসেজে বলেছে চড়ের প্রতিশোধ!অনল গা ছেঁড়ে দিলো চেয়ারে।প্রতিশোধ কতো প্রকার কী কী তা সে বেলীকে দেখাবে।

(***)

দোলনা মৃদু ছন্দে দুলছে।সেই সঙ্গে ঈষৎ শব্দে নূপুরের আওয়াজে চারদিকে মুখরিত হয়ে আছে।বেলীর হাত জোড়ার মাঝে মির্জা গালিবের রুবাইৎ বইটি শোভা পাচ্ছে।কিন্তু তার কোনো মনোযোগ নেই।অনল এখনও তাকে ম্যাসেজের জবাব দিলো না।ভীষণ অন্যায় সিন করে কাওকে জবাব না দেওয়া।ক্ষণে ক্ষণে অনলের ললিতার মনে বৃষ্টি নামছে।এক ধরণের উৎকণ্ঠা যেন শূন্যতায় মোড়ানো হৃদয়ের চারপাশে।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে বইটা বন্ধ করলো।শশী এতো সময় তার সামনে বেতের সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজে মগ্ন ছিল।

“কী হলো বেলী?তোর বই পড়তে ভালো লাগছেনা।এমন দিন দেখার ছিল নাকী।”

“সবার সবসময় মুড ভালো থাকেনা আপু।মজা নিওনা।”

“মজা নেইনি।বাহিরে যাবি?ঘুরে আসবো না হয়।”

“দেখি।”

তাদের কথার মাঝে গেটের বাহিরে গাড়ী থামার শব্দ হলো।দারোয়ান লোকটা গেইট খুলে দিলে অনল ভেতরে প্রবেশ করলো।অমায়িক লাগছে তাকে পড়ন্ত বিকেলের পানসে রোদে।বেলীর মন কেমন করে উঠলো আবার।অনল কী তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে?বেলীর ভুল ভাঙলো তখন যখন অনল এসে সরাসরি শশীর সঙ্গে কথা বলল।

“কেমন আছো শশী?আমি তোমার জন্য এসেছি।ভালো হলো এখানে পেয়ে গেলাম।কিন্তু কথা আছে তোমার সঙ্গে।”

“বসো।বেলী ভেতরে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আয়।”

“ওর চা বানানো ভালো হয়না।খুব বিস্বাদ।এর থেকে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি বরফ দিয়ে আনতে পারে।ভালো লাগবে।”

বেলী মুখের উপর এতো বড় অপমান সহ্য করতে পারলো না।নেহাৎ শশী আছে সামনে দেখে কিছু বলল না।অনলকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালো।অবশ্য পিছন থেকে ডেকে শশী বলল,

“তুই তো ভালো স্মুদি বানাতে পারিস।নিয়ে আসিস অনলের জন্য।”

বিদ্রুপ করে বেলী বলল,

“আরো কিছু ম্যাডাম?স্যার?”

“যা তো এখন বেলী।তো বলো অনল।কোনো জরুরি কথা আছে নাকী?”

বেলী অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার পর অনল বলল,

“আমি তোমাকে বিয়েটা করতে পারবো না।”

“কেন?আমার মধ্যে কী সমস্যা?”

“আমি ওভাবে তোমাকে স্ত্রী হিসেবে কখনো কল্পণা করিনি।”

“দেখো হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই।বড়রা মিলে যখন বলছে…।”

অনল মাঝপথে থামিয়ে বলল,

“শশী কিছু বিষয় ভবিষ্যতে তুমি নিজ থেকে জানতে পারবে।”

শশী মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও মনে ঝড় বয়ে চলেছে।একে তো তার প্রেমিক ফাহিমের সাথে সম্পর্কটা ভাঙলো।অন্যদিকে অনল নিজ থেকে তাকে বিয়ে করতে চায়না।আচ্ছা সে কী মেয়ে হিসেবে খুব খারাপ?অনল বিচক্ষণ পুরুষ।মেয়েটির মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনের কথা অনুমান করলো।সে একটু সামনে এগিয়ে এসে শশীর হাতটা ধরলো।তাকে শান্ত সুরে বলল,

“আমরা জীবনে খারাপ মানুষদের বেশী পছন্দ করি।যারা আমাদের মূল্যায়ণ করেনা।ভালোবাসাকে অপমান করে।অনুভূতি তে আঘাত দেয়।তবুও আমরা তাদের ভালোবাসি।এটা হিউম্যান নেচার।অতীতের জন্য তোমার কোনো দোষ নেই।মনের কষ্ট গুলো ভুলে এগিয়ে যাও।সামনে তাঁকাও দেখবে প্রচুর সম্ভাবনা জীবনে অপেক্ষা করছে।”

ব্যস এতোটুকু কথার দরকার ছিল।শশী গলে গিয়ে কেঁদে ফেললো।অনল হেসে হাতটা ছেড়ে দিলো।বেলী ফিরে এলে এমন পরিস্থিতি দেখে শুধালো,

“কী হয়েছে? আপু কাঁদছে কেন?”

“ছোট মানুষদের সব শুনতে হয়না।যাও শশী হাত মুখ ধুয়ে এসো।তোমার সাথে আজকের বিকেল কাঁটাবো।”

শশী উঠে গেলে বেলী সেই চেয়ারটাতে বসলো।অনলকে কড়া সুরে শুধালো,

“আপুকে কী বলেছেন?”

“বিয়েটা হচ্ছে না তাই বলেছি।”

“সত্যি!”

আবেগে বেলীর অধরযুগল চওড়া হয়ে গিয়েছিল।অনল ঠান্ডা পানির গ্লাসটা হাতে তুলে বলল,

“এতে তুমি এতো খুশি কেন ললিতা?”

“কোথায়?”

“এইমাত্র যে হাসলে।”

“ভুল দেখেছেন আপনি।বানিয়ে কথা বলবেন না।”

বেলীর নিজের উপর লজ্জা লাগছে।সে কেন হাসলো?সে কথা ঘুরানোর জন্য কিছু বলবে এর পূর্বে পুনরায় অনল বলল,

“আমার ললিতা!তুমি বড্ড মিথ্যাবাদী।”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:৩০
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমি মিথ্যাবাদী নই।আপনার একটা সমস্যা আছে অনল।নিজেকে নিয়ে প্রচন্ড আত্নঅহমিকাতে বেঁচে আছেন।মনে করেন সব মেয়ে আপনার জন্য পাগল হয়ে যাবে।”

অনল হাসলো।চেয়ারে হেলান দিয়ে ললাটে আঙুল ঘষতে ঘষতে শুধালো,

“নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছো?তা নয় এসব কথা কেন?”

“বাদ দেন।আপুকে বিয়ে করবেন না কেন সেটা বলেন।”

“তোমার কী মনে হয় আমি এতোটা হোপলেস পার্সন যে এক মেয়েকে ভালোবাসি বলবো।এরপর ঠিক তার বড় বোনকে বিয়ে করবো?হ্যাঁ বললাম ধরো।ওয়েল!এরপর কী হতে পারে আমি বলি।শশীকে আমি বিয়ে করতে চাইবো আর তুমি বিয়েতে কাঁদতে কাঁদতে নাচবে গাইবে প্রিয়াংকা চোপড়ার মতোন?গানটা যেন কী?হুম মনে পড়েছে

‘মানা কী মুশকিল বড়ি হ্যে
এ ইমতেহান কী ঘড়ি হ্যে
পল ম্যে বিখার যাউঙ্গি ম্যে
হাদ্ স্যে গ্যুজার যাউঙ্গি ম্যে’

বেলীর স্মরণে হলো সে যদি হিটলারের মতোন শক্তিশালী হতো তাহলে সর্বপ্রথম অনল কাশফের নামে যুদ্ধের ঘোষণা করে দিতো।হাসতে হাসতে এতো বাজেভাবে অপমান সে খুব কম হয়েছে জীবনে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনকে বোঝালো।পৃথিবীতে সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।তাদের কথার মাঝে শশী চলে এলো।বেলীর সঙ্গে এরপর অনলের আর কোনো কথা হলো।নিজের বোনের জন্য মায়া হলো বেলীর। কিন্তু সে নিরুপায়।কারণ কিছু সিদ্ধান্ত সৃষ্টিকর্তা নিজে নেন।

সন্ধ্যার সময় যেন স্নিগ্ধ এক বাতাস বয়ে যায় বাতাবরণে।অনলের শরীরে ক্লান্তিভর করেছে।আজকে অফিসে অনেকটা দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।এদিকে বেলীর কাছাকাছি থাকার ইচ্ছাটাও দমন করতে পারছেনা।

” আপনি অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছেন?”

অনলকে চট করে শুধালো বেলী।এক ধরণের শংকা তার কণ্ঠে,

“অফিস থেকে এসেছি।মূলত নিজের সিদ্ধান্ত জানানো দরকার ছিল।বিয়ে অনেক সেন্সিটিভ বিষয়।”

“তবে অনেক ক্লান্ত নিশ্চয়।”

“বেলী তুই কী অনলকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছিস?ওনার যখন কোনো সমস্যা নেই।”

শশী অসহিষ্ণু হয়ে কথাটা বলল।বেলী অবশ্য চুপ হয়ে গেলো।অনল হেসে বলল,

“বেলী অবশ্য ঠিক বলেছে।আমি ক্লান্ত হয়ে আছি।তোমার সাথে শীঘ্রই আবার একদিন বসবো শশী।ভালো থেকো।”

হ্যান্ড শেইক করে অনল গেটের দিকে পা বাড়ালো।ঈষৎ অন্ধকারে পিছন থেকে তাকে রহস্যময় লাগছে।যেন কঠিন দূূর্বেধ্য দেয়াল।বেলীর মনটা খারাপ হয়ে একটা বিষয়ে।অনল তাকে কেন বেলী বলে ডাকলো?এই প্রথম বোধহয় পুরুষটির মুখে নিজের নামখানা শুনলো।এছাড়া সবসময় ললিতা ললিতা ডাকে তার মন বাগানে গানের সুর বসিয়েছে।শশী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

“ভেতরে চল।অন্ধকারে বসে থাকতে হবে।”

“আপু।”

“কিছু বলবি?”

বেলী কিছু না বলে শশীকে জড়িয়ে ধরলো।বোনের জন্য খুব কষ্ট লাগছে তার।

“মন খারাপ করো না।”

“নেই।যে আমাকে পছন্দ করেনা তার জন্য চিন্তাভাবনা করা বৃথা।”

“ফাহিম ভাই সব ঝামেলা লাগিয়েছে।যদি সম্পর্কের পরিণতি না চায় তাহলে জড়ায় কেন মানুষ?”

“আমরা অনেক কথার ব্যাখা করতে পারিনা।কিছু মানুষ অতি তাড়াতাড়ি মুভ অন করতে পারে।তুই বুঝবিনা বেলী।ঠিক কতোটা কষ্ট হয় আমার।”

বেলী বেনকে ছেড়ে দেয়।মনে মনে নিজের উপর বিদ্রুপ হাসে।সে রামীম নামক এমন এক ধাঁধায় জর্জরিত হয়েছে যে অন্য কাওকে চোখের সীমানা তে রাখতে রাজী নয়।তবে বেলীর মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে।নতুন কাওকে মনের বাগানে ঠাঁয় দিতে।তবে ভয় হয়।ঠকে যাওয়ার ভীষণ ভয়।

“চল বাবাকে সব জানাতে হবে।”

“উনি ভালোভাবে নিবেন না বিষয়টা।”বেলী উদাস কণ্ঠে বলল।

“সবাই বাবার কথামতোন চলবেনা।এই সত্য মেনে নিতে হবে বাবাকে।তবে অনুরোধ বেলী।যাই হোক তুই কোনো কথা বলবিনা।”

(***)

আয়েশা ফাইলে দৃষ্টি রেখেই রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলো।তীব্র কোলনের সুবাসটা ঠিক কোন ব্রান্ডের তা সে ধরতে পারেনা।তবে মনে হয় এই রহস্যময় সুবাসটা অনলের নিজস্ব।তার আ্যাপেলোর মতোন দেহখানা থেকে ছড়িয়ে যায় বাতাবরণে।আয়েশার ইদানীং হিংসে হয়।কেন অন্য কেউ অনলের এই সুবাসটা পাবে?ফাইল থেকে মুখ উঠিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।ফর্সা গালটায় ঈষৎ ভাঁজ যেন পদ্মা নদীর পাড়ের মতোন সুন্দর।

“আপনি আসবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তাতে ছিলাম।”

“আমি প্রফেশনালিজম মেইন্টেইন করতে পছন্দ করি।কোনো জরুরি বিষয় আছে?কীযেন উপহারের কথা বলেছিলেন।”

“উহু।আমি ডেকে উপহার দেওয়াকে পছন্দ করিনা।সময় হোক তা আমি নিজে দিয়ে আসবো আপনার অফিসে আজকে ডেকেছি আমি ঢাকার কাছে নতুন একটা রিসোর্ট ওপেন করেছি।আজকে সেখানে যাবো।আপনি আমাকে সঙ্গ দিবেন?”

অনলের প্রচন্ড বিরক্তবোধ হলো।সে নিজের অফিসের কাজ ফেলে এসেছে।অথচ পরোক্ষভাবে মেয়েটা ডেট করার প্রস্তাব দিচ্ছে।অনল মেয়েদের কখনো অসম্মান করেনা।এজন্য হেসে বলল,

“আমি আপনার চেষ্টাকে সম্মান করি।তবে আজ সময় হবেনা।”

“পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর বাহানা।অথচ মানুষ চাইলে সময় বানিয়ে নিতে পারে।”

“আমি চাইনা।”

সোজাসাপটা জবাব পুরুষটির।ভেতরে সে উষ্ণ হয়ে উঠছে।কিন্তু যথাসম্ভব নিজের সেই অনুভূতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।আয়েশা বলল,

“শুনলাম আপনার সেক্রেটারি জব ছেড়ে দিয়েছে।মেয়েটা ভালো ছিল।”

“এখনও ভালো আছে।ললিতা আমার প্রতিবেশী।আমার রুমের বারান্দা থেকে সরাসরি দেখা যায়।আজ সকালেও দেখলাম।এইতো ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিলে চলে গিয়েছে।চোখেমুখে ভীষণ বিতৃষ্ণা ছিল।পড়াশোনার জন্য বোধহয়।”

আয়েশা খেয়াল করলো অনলের চোখে মুখে এক ধরণের প্রশান্তি বিরাজমান। সে সঠিক ছিল।অনল মেয়েটাকে ভালোবাসে।কিন্তু অপর পক্ষ?আয়েশা প্রসঙ্গ বদলানোর নিমিত্তে বলল,

“আপনি অনেক খেয়াল করে দেখছি।মি.কাশফ খেয়াল করে দেখেছেন আমি অনেক বই প্রেমী?”

“ইউ আর এ স্যা” ডি”স্ট আয়েশা।”

চমকে সোজা হয়ে বসলো আয়েশা।অনল খুব শান্তভাবে কথাটা বলল।নারীটি ভেতর থেকে শীতলতা অনুভব করলো।সে সত্যিই এমন।কিন্তু অনল তা জানলো কীভাবে?

“গোপনে আমার বাসায় ক্যামেরা লাগিয়েছেন?”

“না।বরং আপনার বুক টেস্ট দেখে অনুমান করলাম।বাকী এখন নিজে স্বীকার করে নিলেন।তবে আপনার সঙ্গে এ ধরণের সেন্সিটিভ বিষয় নিয়ে কথা বলতে বোধহয় আমি ইচ্ছুক নই।”

এমন চতুর বুদ্ধি আয়েশা খুব কম পুরুষের দেখেছে।ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুঁটে উঠলো।

“মি.কাশফ।আমি আপনার উপর আগ্রহ পাচ্ছি।”

অনল সরাসরি আয়েশার দিকে তাঁকিয়ে বলল,

“আমি নাচাতে ভালোবাসি আয়েশা।আপনার স্বভাবের পরিপন্থী।অথচ আমি জানি আপনি ইতিমধ্যে আমার ইশারায় নাচার জন্য প্রস্তুত।”

“মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসেন?”

“বেলী।মেয়েটা নয়।”

“আমাকে প্রত্যাখান করার ফল ভালো হবেনা মি.কাশফ।”

“চেষ্টা করুন দেখুন আয়েশা।যদি পারেন তো অভিনন্দন।কিন্তু না পারলে স্বাবধান।আপনাকে বাঁদর বানিয়ে মাঝ রাস্তায় নাচাবো।আপনি আমার ভালোবাসা ও সাধনা দুটোতেই হাত দিয়েছেন।”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:৩১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“হ্যালো। কে বলছেন?”

“ললিতা!যদি আর এক কদম এগিয়ে যাও।তাহলে সাত দিনের জন্য কিডন্যাপ করে চিলেকোঠায় বন্দি করে রাখবো।”

বেলী ফোনটা কানে থেকে সরিয়ে স্ক্রিন পানে ভুরু কুঁচকে তাঁকিয়ে রইলো।অচেনা নাম্বার দেখে রিসিভ করেছিলো।অনল তো এই নাম্বার ব্যবহার করেনা।পুনরায় কানে রাখলো ফোনটা।

“আপনি এসব বলছেন কেন অনল?”

“দেখো মেয়ে একটা বিষয় ভালোভাবে শুনে নাও।আমি পজেসিভ।মানে মাত্রাটা স্বাভাবিক নয়।”

“তো?”

“তোমার ছেলে ফ্রেন্ডের বাইকে উঠে কেন কনসার্টে যেতে হবে?তাছাড়া ভীষণ নাজুক তুমি।অস্থির লাগবে গরমে।যেতে হবেনা।”

“আমি বুঝবো তা।আমার প্রিয় গায়ক আসছে।এই দিনের জন্য কতো গুলো সময় ধরে অপেক্ষা করেছি জানেন?”

“সেসব আমার দেখার দরকার নেই।সিয়াম বা আঙকেল তোমাকে পারমিশন দিলো কীভাবে? কনসার্টে এক ধরণের নোংরামি হয়।”

“হাহা!হাসলাম আপনার মুখে এই ওয়ার্ড শুনে।সবার সাথে ফ্লার্টিং করা পুরুষ আমাকে কনসার্টে যেতে নিষেধ করছে।”

“বিশ্বাস করো।এটা তোমার সবথেকে জঘন্য হাসি ছিল।তাছাড়া হেলদি ফ্লার্টিং মানসিক শান্তির জন্য ভালো।”

“আমার লেট হচ্ছে।রাখুন ফোন।”

“কথা শুনবেনা?”

“শোনার মতোন হলে অবশ্যই শুনতাম।তাছাড়া আমি এখন আর আপনার অফিসের এমপ্লয়ই না।তাই হুকুম দিবেন না।রাখছি।”

বেলী ফোনটা রেখে দিলো।অনলের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এতে।এখন বিকেল চারটা বাজে।কনসার্ট শুরু হবে ছয়টায়।ভাগ্যিস দুটো টিকেট সে আগেই সংগ্রহ করেছিলো।বেলীর এই গায়কের উপর মারাত্মক ক্রাশ আছে।বিষয়টা ভাবতেই অনলের বিরক্তবোধ হলো।দ্রুত সে রেডি হয়ে নিলো।এখন না বের হলে বেলীর আশেপাশে থাকতে পারবেনা।বাইকের চাবি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অর্ধেক পথে থেমে গেলো।ভূত দেখার মতোন চমকে উঠলো সে।আয়েশা বসে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়।অনলের মায়ের সাথে।

“হ্যালো মি.কাশফ।আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে এসে গেলাম।”

অনল একটুও বিভ্রান্ত হলো না।বরং তার চিরপরিচিত হাসি হেসে বলল,

“আমি এজন্যই ভাবছিলাম মি.সিকান্দারের এই জেলখানা হঠাৎ এতো আলোকিত কেন লাগছিলো?ঠিকই আছে বলে আসে পর মানুষেরা।আর হুট করে সারপ্রাইজ দেয় কাছের মানুষজন।”

অনলের মা করুণা অনুধাবণ করতে পারলো তার ছেলে আয়েশা নামের মেয়েটাকে ভীষণ কঠিনভাবে খোঁচা দিলো।চোখ রাঙিয়ে ছেলেকে শাসালো।অনলের যদিও যাওয়ার তাড়া ছিলো।কিন্তু মায়ের পাশে বসে বলল,

“মিস.আয়েশা।আপনার কী এখানে আসার কোনো গুরুতর কারণ ছিল?”

“একচুয়েলি আমি নিজের মা কে মিস করছিলাম।আপনার মুখে একবার আন্টির প্রশংসা শুনে ভাবলাম দেখা করে যাই।”

“ভীষণ ভালো কাজ করেছেন।আজকে ডিনার আমাদের সাথে করবেন।”

“না আমি কিছু সময়ের জন্য থাকবো।”

“মা আয়েশাকে রেখে দিবেন।আমি নয়টার মধ্যে ফিরবো।আজকে সবাই একসাথে ডিনার করবো।”

করুণা সায় দিয়ে বলল,

“অবশ্যই।আয়েশা তুমি থাকবে।”

অনলের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলো আয়েশা।একবারও মনে হয়নি এই পুরুষটা দুদিন আগেও তাকে বাঁদর নাচ নাচাতে চেয়েছে।অনল তার কাছে ইদানীং অবসেশনে পরিণত হয়েছে।যাকে যেকোনো মূল্যতে সে চায়।

(***)

প্রচন্ড মানুষের ভীড়ে পা ফেলা দায় হয়ে গিয়েছে বেলীর।সে ইন্ট্রোভার্ট।এখানে আসার জন্য পরিবারের অনুমতির থেকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধটা মূখ্য ছিল।প্রথম সারির একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালো সে।এখান থেকে বেশ ভালো দেখা যাবে।অবশ্য গায়কের থেকে তার কাছে মূখ্য হলো গান।একদম এতো কাছ থেকে শুনতে পাবে।শরীরে এক ধরণের উত্তেজনা বোধ করলো।তার বন্ধুরা সকলে নিজেদের পার্টনার নিয়ে এসেছে।একমাত্র বেলী একা।এতে অবশ্য সমস্যা নেই তার।হুট করে ভীড়ের পরিমাণ বাড়লো।সংবদ্ধ ভীড়ে সে বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে গেলো।ঠিক তখুনি স্টেজে উঠলো সবার আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি।মুহুর্তে সূরের মূর্ছনায় সবাইকে মাতিয়ে নিলো।বেলী চোখ বন্ধ করে শুনছে।এখন যে গানটা চলছে সেটা রামীমেরও অনেক প্রিয় ছিল।কিছু মানুষ বোধহয় প্রাক্তনকে কখনো ভুলতে পারেনা।দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো মেয়েটির বুক চিঁড়ে। তবে হঠাৎ অতি পরিচিত এক অনুভূতি হলো।বেলী চোখ খুলে দেখলো তার আশেপাশে হঠাৎ ভীড় কমে গেছে।পাশে একটা বট গাছের মতোন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।ঈষৎ আলোতে পিটপিট করে তাঁকালো বেলী।

“অনল!আপনি এখানে?”

আশেপাশে অনেক শব্দ।অনল অলস ভঙিতে মেয়েটির দিকে ঝু্কে এলো।

“তোমার জন্য আসতে হলো ফাজিল।একা একা এখানে এসেছে।”

“বেশী অভিভাবক সাজতে যাবেন না।”

“ইচ্ছাও নেই।শুধু ভালোবাসি দেখে কেয়ার করি।তা না হলে আমার জন্য বাড়ীতে সুন্দরী আয়েশা বসে আছে।এই গরমে আবার ভীড়ে আসার প্রশ্নই ছিলনা।”

বেলীর মুখবিবরে বাদলা দিনের বিবর্ণ মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো।শুকনো ঢোক গিললো সে।অস্পষ্ট সুরে বলল,

“আয়েশা আপনার বাড়ীতে কেন?ঢুকতেও দিলেন কেন?প্রফেশনালিজম ধরে রাখতে জানেন না।এখন চুপ থাকেন।আমাকে গান শুনতে দেন।”

অনল স্মিত হাসলো।মেয়েটা নিজের অনুভূতি আড়াল করতে পারছেনা।অনল জানে এই গায়ক রামীমের অনেক পছন্দ ছিল।বিশেষ করে এর কণ্ঠে পুরোনো ক্ল্যাসিক্যাল গানগুলো বেলী বা রামীম দুজনেই পছন্দ করতো।অনলের সবথেকে বেশী খারাপ লাগে এটা ভেবে যে মেয়েটা তাকে পছন্দ করে।কিন্তু তা স্বীকার করতে ভয় পায়।

বেলীর মুখটা বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে গিয়েছে।সে অনলের থেকে দূরে সরে গেলো একটু।অনল তা তোয়াক্কা না করে নিজে ললিতার গা ঘেষে দাঁড়ালো।

“লাফাবেনা। এদিক ওদিক অনেক মানুষ আছে।”

“ভালো না লাগলে চলে যান।”

অনল কিছু না বলে বেলীর চুলে নাক ঘষলো।লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

“মাই ললিতা!চুলে শ্যাম্পু করবে রোজ।”

“আশ্চর্য!আপনাকে কাছে আসতে বলেছে কে?তাছাড়া আমি যথেষ্ট হাইজিন মেইন্টেইন করি।”

“উহু।দেখি আমি আরেকবার নেই।”

অনলের মেয়েটির কাছাকাছি আসার জন্য এটা বাহানা ছিল।পুনরায় মেয়েটির সন্নিকটে এলো সে।যেখানে দুজনের শ্বাস প্রশ্বাস একত্রিত হয়।বেলী কোনো অধিকার দেয়নি।তবুও যেন অনল বুঝে নেয় সে তার ললিতার অনেক কাছের।এতোটা কাছের যেখানে হৃদয়েরা একত্রে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরী করে।লম্বা শ্বাস নিয়ে অনল বলল,

“এই সময়টাকে ভালোভাবে অনুভব করো ললিতা।এই গানের সাথে এরপর থেকে আমাকে মনে করবে।শুধু আমাকে।”

বেলী যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।সে অনুভূতি শূন্য।অনলের শরীরের উষ্ণতায় কীনা এমন এক ধরণের মাদকতা তৈরী হলো মনে যে সে চোখ বন্ধ করে ফেললো।সত্যিই এই গায়কের সুরের সাথে রামীমকে আর স্মরণ হচ্ছে না তার।বরং অনলের হাসিমাখা মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে।বেলীর মনে হলো বাস্তবেও অনল হাসছে।চোখ খুলে দেখলো সত্যিই পুরুষটার অধরযুগল বিস্তৃত হয়ে আছে।বেলী ভয় পেয়ে গেলো।মনের ভেতর যে অনুভূতি হচ্ছে সেটাকে তো ভালোবাসা বলে।সে এই অনুভূতি চায়না।তবে হচ্ছে কেন?

চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।সকল পাঠক রেসপন্স করবেন।