#আমার_ললিতা
#পর্ব:৪৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“তোর সেই অন্তহীন আকাশের মতো গভীর পুরুষ অনলের কথা মনে পড়ে বেলী?সে কী তোকে খুঁজে বেড়ায়?”
“মন বলে সে আমাকে সর্বদা খুঁজে বেড়ায়।খুব শীঘ্রই আমার কাছে পৌঁছে যাবে।”
রাঙামাটির বুক চিরে নির্জন পাহাড়ের কোলে একটি পুরোনো বাড়ি। টালির ছাদের উপরে শীতল জোছনা ঝরে পড়ছে। যেন আকাশ থেকে ছলছল করে দুধের ধারা নেমে এসেছে। সেই বাড়ির বারান্দায় বসে আছে বেলী। তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে নরম চাঁদের আলো। তাকে দূর থেকে দেখলে বোধ হবে স্বর্গের কোনো দেবীর মায়াবী অবয়ব।চারপাশের নৈঃশব্দ্য যেন কানে কানে মুগ্ধতার গান গাইছে। দূরের পাহাড়গুলো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। তবুও সাদা আলোয় তাদের অবয়ব স্পষ্ট।বেলী চুপ করে বসে আছে।তার চোখে সেই চাঁদের মায়া আর হৃদয়ে যেন সময় থেমে থাকা এক গোপন বেদনার স্পর্শ।রাতের এই নিস্তব্ধতা তাকে নিয়ে যাচ্ছে দূর কোনো স্বপ্নের দেশে।যেখানে পৃথিবীর সমস্ত কলরব থেমে আছে। শুধু আছে জোছনার মায়ায় আচ্ছন্ন এক অনন্ত নীরবতা।পুনরায় বেলীর ভেতরে থাকা অনলের ললিতা শুধায়,
“অনলের থেকে দূরে এসে কী লাভ হলো?”
বেলী নরম কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আমি তো অনলের থেকে দূরে আসিনি।বরং সবার থেকে পালিয়ে চলে এসেছি।এখানে কতোটা শান্তি।”
সমীরণ এসে বেলীর চুলগুলো মৃদু উড়িয়ে নিলো।সেদিন বাড়ী থেকে বের হওয়ার পর সে স্কুলের এক বান্ধুবীর বাসায় চলে এসেছে রাঙামাটি।এখানে তাকে কেউ যে খুঁজে পাবে সেটা দুস্কর।কফির কাপে চুমুক বসালো।জীবনটা সিনেমা নয় আবার এর থেকেও কম বা কীসে?বেলী কখনো ভাবেনি যে সে বাড়ী থেকে পালিয়ে বেড়াবে।
“বেলী।তুই এখানে? আর আমি সারা বাড়ী খুঁজে চলেছি।তোর ছাত্র এসেছে পড়তে।”
“এই সময়?ও না বিয়েতে যাবে বলল।”
মাহিয়া মুখ টিপে হাসলো।তার পাশে বসতে বসতে বলল,
“জনাবের ভীষণ মুড খারাপ।কারণ যে বিয়েতে যাবে বলে ঠিক করেছিলো সেখানকার পাত্রী পালিয়ে গেছে।”
“সে-কী?কেন?”
“রিলেশন ছিল।এবং সাথে বিয়েতে রাজী ছিলনা।তাই বিয়েটা বাদ।”
“ইশ!বেচারা কতো আশা করে ছিলো।আমি কফি শেষ করে যাচ্ছি।”
মাহিয়া তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“হাসলে তোকে মন্দ লাগেনা।আমাকে একটা কথা বল তো।ঝগড়া সব পরিবারে হয়।কেন তুই বাড়ী ছেড়ে এখানে এসে কষ্ট করে চলেছিস?এটা তো নিজের জীবন নষ্ট করা হলো।”
“যারা জীবনটা দিয়েছে তারা তো চায়না আমাকে।”
“ভুল।আন্টি তোকে অনেক ভালোবাসে।না হলে এতো বড় বিষয়ে ডিভোর্স দেওয়ার চিন্তা করতো না।তাছাড়া তোর অনল তো আছে।”
“আমার মা আমাকে ভালোবাসে?”বেলীর মুখে বিদ্রুপমাখা হাসি ফুঁটে উঠলো।সে সামনের টেবিল থেকে ফোনটা ওঠালো।আগের ফোনটা সে বিক্রি করে দিয়েছে।কম দামে নতুন এটা কিনেছে।এতে করে কেউ যেন ফোনের মাধ্যমেও খুঁজে না পায়।দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুকলো সে।সার্চ লিস্টে সিয়াম ও শশীর আইডি।শশীর আইডিতে ক্লিক করতেই নানান রঙের ছবির দেখা মিললো।মাহিয়া মুখ কালো করে বলল,
“শশী আপুর বিয়ে ছিল?”
“হুম দশ দিন আগে।খেয়াল করে দেখ বিয়েটা যেমনভাবে ধুমধামে করতে চেয়েছিলো ঠিক তেমনভাবে করেছে।এর উপর সবার মুখে কতো চওড়া হাসি।অথচ আমাকে খুঁজে পাওয়া যায়না মাত্র চারমাস ধরে।পরিবারের সদস্য হারালে এভাবে বিয়ের আনন্দ করা যায়?আমি কেউ না তাদের।”
কথাগুলো বলার সময় বেলীর কণ্ঠ কেঁপে উঠলো।স্বীয় বান্ধুবীর কষ্টটা সে অনুধাবন করতে পারছে।কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর যতোদিন মন চায় আমার বাড়ীতে থাকবি।এখন চল তা নয় তোর ছাত্র অজ্ঞান হয়ে যাবে।”
“হুম।”
বেলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।নিচে নেমে দেখে রুহাব মুখটা গোমড়া করে বসে আছে।ছেলেটা মারাত্মক মিষ্টি দেখতে।সবেমাত্র দশ বছর।বেলীর কাছে রোজ পড়তে আসে।বেলী হালকা কেশে বলল,
“তোমার মন খারাপ রুহাব?”
“ম্যাডাম আমার বিয়ে খাওয়া হলো না।”
“ব্যাপার না।আমি আগামীকাল তোমাকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যাবো।ঠিক আছে?”
“ইয়েস।কিন্তু আমার ভাই কেঁদেছে জানেন।বউটার জন্য।আম্মু বলে মেয়েটা ভালো না।”
“ভালো মন্দের খবর আমরা কীভাবে জানি বলো?বড়দের সব কথা শুনতে হয়না।”
হঠাৎ বেলীর নজর পাশে থাকা বড় চকলেটের প্যাকেটগুলোর উপর পড়লো।এতোগুলো টাকা দিয়ে রুহাবকে চকলেট কিনে দিয়েছে ওর বাবা মা বিষয়টা হজম হলো না বেলীর।কারণ ওরা মধ্যবিত্ত।অহেতুক খরচ করার মানুষ নয়।তবুও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলো না।
(***)
এক ঘন্টা পড়ার পর রুহাবের মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে।বেলী ম্যাডামের কাছে পড়তে যেতে বেশ ভালো লাগে তার।এখন রাত নয়টা বাজে।প্রতিবেশী হওয়ায় বাড়ীতে পৌঁছাতে সমস্যা হবেনা তার।পিছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখলো বেলী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।রুহাবকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো।যেন না পৌঁছানো অবধি মেয়েটির শান্তি নেই।তবে রুহাব এখন বাড়ীতে যাবেনা।একজনের কাছে যাবে।যে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছিলো।বেলীর চোখের আড়াল হয়ে মুহুর্তে গাড়ীর কাছটায় চলে এলো রুহাব।মোটাসোটা হওয়ায় শ্বাস ভারী হয়ে গেছে।অনল তখন আকাশ পানে তাঁকিয়ে ছিল।রুহাবের উপস্থিতি টের পেয়ে মৃদু হাসলো।
“যা আনতে বলেছিলাম এনেছো?”
“হ্যাঁ।এইযে ফোন।”
পকেট থেকে ফোনটা বের করে অনলের হাতে দিলো রুহাব।লক স্ক্রিন খুলতে বেলীর নানান ভঙিতে ছবিগুলো ভেসে উঠলো।অনল লম্বা শ্বাস ছাড়লো।অবশেষে এই শয়তান মেয়েটাকে সে খুঁজে পেয়েছে।ভাগ্যিস রুহাবের বাবার সঙ্গে তার এক বন্ধুর পরিচয় ছিল।সেখান থেকে এরকম অচেনা মেয়ের কথা শুনে বুঝেছিলো সে বেলী হতে পারে।অনল চাইলে কাল সকালে বিষয়টির নিশ্চয়তা নিতে পারতো।কিন্তু এতোদিনের বিচ্ছেদের পর সে অপেক্ষা করতে নারাজ।রুহাব অবাক হয়ে অনলকে দেখছে।তার ম্যাডামের ছবির জন্য লোকটা এতো চকলেট দিলো?রুহাবের চুলগুলো এলেমেলো করে দিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি অনেকগুলো খেলনা কিনে দিবো।ঠিক আছে?”
“ম্যাডামের ছবি দিয়ে কী করবেন?”
“ও তোমার ম্যাডাম হলেও আমার ললিতা।”
“না ওনার নাম তো বেলী।”
“উহু সে অনলের ললিতা।যাক তোমাকে দেওয়া চকলেট থেকে কী ম্যাডামকে দিয়েছো?”
রুহাব লজ্জা পেয়ে মাথা ঋণাত্বক দুলালো।অনল পুনরায় হেসে বলল,
“ভালো করেছো।শয়তান মেয়েদের চকলেট দিতে হয়না।এখন বাসায় যাও।আমি খেলনা তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিবো।”
“থ্যাংক ইউ আঙকেল।”
রুহাব দৌড়ে বাসার দিকে চলে গেলো।অনল নিজের রাগগুলোকে অনেক কষ্টে সংবরণ করলো।গাড়ীটা ভালোভাবে লক করে মাহিয়াদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।কলিং বেল বাজাবে কীনা তা নিয়ে অনেকটা দ্বিধা তে ছিল।বেলীকে দেখলে সে কী করবে?একটা চ””ড় দিবে?বকবে?জানেনা সেটা অনল।অবশেষে নিজেকে সামলে কলিং বেল চাপলো।সে অনেক করে চাচ্ছে বেলী যেন দরজাটা না খুলে।কারণ সে কিছু একটা করে ফেলবে না হয়।কিন্তু এবার ভাগ্য সদয় ছিলনা তার।দরজাটা বেলী খুলেছে।অনলকে দেখে সে অনেকটা চমকে উঠলো।অবশেষে মানুষটা তাকে খুঁজে বের করেছে?তৎক্ষনাৎ হাত দুই গালে চলে গেলো।নিশ্চয় ভাগ্যতে এখন চড় আছে।তবে হঠাৎ করে অনল তাকে বাহিরে টেনে মুখোমুখি আনলো।কোনো প্রতিক্রিয়া দিবে এর পূর্বে উঁচু করে দেয়ালে ঠেকিয়ে গভীর চুমো খেলো ঠোঁটে।রুক্ষ এক জোড়া ঠোঁটের আঘাতে বেলী দিশেহারা। সে কী প্রতিক্রিয়া দিবে?নাকী এটা স্বপ্ন?এক তিক্ত মধুর স্বপ্ন।ধীরে ধীরে তার মস্তিস্ক শূন্য হয়ে আসছে।বেলীর হৃদপিণ্ড দ্রুত গতি পাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির মিশ্রণ তৈরি হচ্ছে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসে সারা শরীরের মাঝে এক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। সে নিজেকে হারিয়ে যেতে শুরু করছে এখন। যেমন করে মাঝেমধ্যে কোনো দুঃস্বপ্নে বন্দি হয়ে পড়ে সে।কিন্তু তারপর এক মুহূর্তে সে অনুভব করে কিছুটা শান্তি।এক অদ্ভুত শান্তি। যেন সেই ঠোঁটের স্পর্শ তার গভীরতম ক্ষতগুলোকে মূহূর্তের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে আর কিছুই চায় না।শুধু এই মুহূর্তটি স্থায়ী হোক।অনলকে নিয়ে তার ভিতরে কি এখনও বিভ্রান্তি?হয়তোবা না। তবে তার স্বপ্ন আর বাস্তবতা এখন এক অদ্ভুত মেলবন্ধনে পরিণত হয়েছে তার কাছে।
চলবে।
#আমার_ললিতা
#পর্ব:৪৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
বেলী এখনও অনলের খুব কাছে।এতোটা কাছে যে তার উষ্ণ নিঃশ্বাস গালের পাশে স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। চুমোটা ভেঙে যাওয়ার পরও একটা অনিশ্চিত নৈশব্দ তাদের জড়িয়ে ধরেছে।মেয়েটা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। অনলের চোখ তীব্র, গভীর, ঠিক আগের মতোই।কিন্তু তার মধ্যে এখন একধরনের দাবি, এক অনিবার্য দখলদারিত্ব।সে পেছাতে চাইলো কিন্তু অনল তাট আঙুল দ্বারা বেলীর কপালের পাশে ছোট ছোট চুলগুলো স্পর্শ করলো।সে তো আর কোথাও তার ললিতাকে যেতে দিবেনা।অনল নরম,শক্তিশালী কণ্ঠস্বরে বলল,
“তুমি চুপ করে আছো কেন?”
বেলী কিছু বলল না। ঠোঁটের কোণে এখনও সেই স্পর্শের তাপ লেগে আছে।শরীরের কোথাও একটা ঝড় বয়ে চলেছে।
অনল আরেকটু ঝুঁকে এলো।গলা নামিয়ে বলল,
“আমাকে কিছু বলবে না?”
বেলীর দৃষ্টি নিচে নেমে এলো। তার শরীর জানে, তার মন জানে এই মুহূর্তের অর্থ কী। কিন্তু সে নিজেকে বুঝতে পারছে না।প্রেমিক পুরুষের প্রথম স্পর্শ এতো মধুর হয়?অবশেষে সে এক নি:শ্বাসে ফিসফিস করে বলল,
“আপনি থামাতে পারতেন।”
“তুমি চেয়েছিলে আমি থামি ললিতা?”
বেলী নিশ্চুপ রইলো।তার চোখের ভাষাতে ধরা পড়ে গেলো যে সে চায়নি এ মুহুর্ত ভাঙুক।বরং চেয়েছে অনন্তকাল এই চুমো চলুক।অনল তার চিবুক ছুঁয়ে উঠালো। আস্তে করে বলল,
“তাহলে পালিয়ে যেও না আমার ললিতা।আমি ভীষণ দূর্বল তোমাকে ছাড়া।জানো এই সময়গুলো আমার কেমন গিয়েছে?”
বেলী তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।এতোটা সময় আবেগে ভেসে গেলেও এখন সে বাস্তবতায় পা রেখেছে।চোখের কোণে একটুখানি জল জমেছিলো তার।সেটা আঙুলের ডগা দিয়ে মুছে নিলো।অনেকক্ষণ বেলীর খবর না পেয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালো মাহিয়া।সে অনলের পানে অবাক হয়ে বলল,
“এটা কে?”
“অনল।যার কথা তোকে বলেছিলাম।”
মাহিয়ার মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো।সে অনলকে উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
“আপনি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ভেতরে আসুন।আমি মাহিয়া।বেলীর বান্ধুবী।”
অনল ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমি জানি।ইনফ্যাক্ট আপনাদের সবার ইনফরমেশন আমার কাছে আছে।এই মেয়েটাকে খুঁজতে গিয়ে আমি হয়তো পুরো বাংলাদেশ ঘুরেছি।মানে লোক লাগিয়েছিলাম।”
“অবশেষে পেলেন।ভেতরে আসুন।”
বেলী এগিয়ে গেলো কিছু না বলে।ক্ষণপূর্বের উত্তেজনা সমীরণে মিলিয়ে গেছে যেন।মাহিয়ার এই বাসাটা তার শ্বশুরের দেওয়া।সে আর স্বামী ব্যতীত কেউ থাকেনা।তবুও কেউ বলতে পারবেনা যে এই বাড়ীতে শুধু দুটো প্রাণ থাকে।অনল গিয়ে সোফাতে বসলো।বেলী সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যেতে লাগলে পুরুষটি ধমকের সুরে বলল,
“এখন যদি উপরে যাও তাহলে মটেও ভালো হবেনা ললিতা।আমি সব শুনতে চাই।সব মানে সব।”
বেলী সিঁড়ির মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল।হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ওড়নায় মুঠো করে ধরলো সে। অনলের কণ্ঠে এমন এক দাবি, এমন এক অনিবার্য অধিকার যার সামনে দাঁড়িয়ে সে বারংবার কেঁপে ওঠে।মাহিয়া তার উদ্দেশ্যে বলল,
“আচ্ছা বেলী, তুই বস না।একটু সময় দে না ওনাকে।জীবন তো চালাতে হবে নাকী?”
অনল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।মেয়েটি ধীরে ধীরে ফিরে অনলের পাশে বসলো। চোখ নামিয়ে রেখেছে।কিন্তু তার মনে হচ্ছে অনলের দৃষ্টি যেন মনের গভীরতম জায়গাগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে।তার আত্মাকে শেষ করে দিচ্ছে।
“কেন এমন করলে?তোমাকে খুঁজতে গিয়ে আমার দিন কেটেছে, রাত কেটেছে। কিন্তু তুমি কী জানতে না যে আমি ঠিক তোমাকে কতোটা ভালোবাসি?আমার পাগলামি কী কিছু কম ছিল?”
বেলী ফিসফিস করে বলল,
” আমি জানি না আমি কী বলবো।”
অনল একটু ঝুঁকে এলো তার দিকে।হাত বাড়িয়ে বেলীর চিবুক ছুঁয়ে বলল,
“তোমার চোখ বলে দিচ্ছেে তুমি বলতে চাও। ভয় পেওনা ললিতা, আমি আছি। সবসময় থাকবো।”
মাহিয়া একটু অস্বস্তি বোধ করলো। দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত মেলবন্ধন দেখা যাচ্ছে।এখানে থাকা উচিত না দেখে সে কেঁশে উঠল,
“আমি চা নিয়ে আসছি।”
মাহিয়া চলে গেলে ঘরজুড়ে একটা নীরবতা নেমে এলো। শুধু দু’জন মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।অনল হঠাৎ বলল,
“আমাকে বলবে না কেন পালিয়ে গিয়েছিলে?”
“আমি ভয় পেয়েছিলাম, অনল।”
অনলের চোখ টিকে রইল তার মুখে। সে ধীরে ধীরে বলল,
“আমার থেকে?”
বেলী চুপ করে থাকলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
“আচ্ছা বাবার মুখে যদি নিজ জন্মপরিচয় নিয়ে শুনতে হয় ঠিক কেমন লাগে বলেন তো?যেদিন বাড়ী ছেড়ে চলে এলাম সেদিন ঝগড়ার মাঝে বাবা একথা মা কে বলে।তাছাড়া আমার জন্য মা বাবাকে ডিভোর্স দিতে চাইলো।আমি ভয় পেলাম।ভীষণ ভয়।”
“আমি তো ছিলাম তোমার সাথে। তাহলে কেন এভাবে অচেনা জায়গায় চলে এলে?আর এখানে থাকা কী নিরাপদ?”
“হ্যাঁ নিরাপদ।মাহিয়া আমার বান্ধুবী।ও একা থাকে দেখে আগে থেকেই অনেক মেয়ে স্টুডেন্ট ভাড়া থাকতো।তাই আমার থাকা ওতো বেশী সমস্যা তৈরী করেনি।”
অনল বেলীর হাত ধরে বলল,
“আমি আসলে এসব কিছু জানতাম।তোমার মা আমাকে সব জানিয়েছেন।কিন্তু তুমি যা করেছে সেটা অনেক বাজে।হ্যা মানছি তোমার বাবা দোষী।কিন্তু একজন ইয়াং মেয়ে হয়ে বাড়ী থেকে এভাবে পালিয়ে আসা কী উচিত হয়েছে? মানুষ জানলে তোমার চরিত্রে দাগ লাগাতো না?আর আমি কীভাবে তা সহ্য করতাম?তোমার অভিভাবকের অভাব নেই দুনিয়াতে সত্য বলতে।তাছাড়া সবথেকে বড় কথা তোমার মা!ওই নারীটার উপর ঠিক কী হয়েছে জানো?”
“দেখেছি।এজন্য আমাকে না খুঁজে আপুর বিয়ে হলো ধুমধামে।”
“এটা তোমার বাবা করেছে।একটা তথ্য দেই।যা হয়তো তোমার ভালো লাগবেনা।”
অনলের মুখ দেখে কিছু একটা অনুমান করতে পারলো বেলী।কম্পমান কণ্ঠতে বলল,
“আম্মু কী সত্যিই আব্বুকে ডিভোর্স দিয়েছে?”
“হ্যাঁ।উনি এতো বছরের সব অপমান, যন্ত্রণা মেনে নিতে পারেনি।তাছাড়া এবার প্রশ্ন তার চরিত্রে এসেছে।”
বেলী চুপ করে রইলো। তার চোখে জল জমেছে। কিন্তু সে কাঁদতে চাইছে না। ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে অনলের চোখের দিকে তাকালো।
“আম্মু কষ্ট পেয়েছে, তাই না?”
অনল দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“পেয়েছে। তবে সে এখন মুক্ত, ললিতা। তোমার মা একজন শক্ত নারী। কিন্তু তুমি? তুমি তো জানো তোমার মা তোমার জন্য সব কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে তাহলে তুমি কেন নিজেকে দুর্বল ভাবছো?”
“আমি আর শক্ত হতে চাই না, অনল। আমি আর কিছুই চাই না।আমার এই ভয় কাঁটছেনা।কোনোভাবে না।”
অনল বুঝতে পারলো বেলীর মানসিক অবস্থা ভালো না।সে আস্তে করে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শব্দে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।এ যেন আগুনের কাছে এসে প্রেমের মোম গলে যাওয়ার ঘটনা।মেয়েটার কান্না বাড়তে থাকছে সময়ের গতিতে।অনল থামালো না।সে কাঁদতে দিলো।আজ কাঁদুক তার ললিতা মন ভরে।এরপর সে সর্বদা থাকবে তার পাশে সামলানোর জন্য।
চলবে।