#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৩
লাল কৌটো হাতে করে উপরে চলে আসলাম দুজনে। অনেকদিন পর এতগুলো বাদাম পেয়েছি। ঠান্ডাটা আর ঠিক গায়ে লাগছে না। আমি আর সিয়াম ভাইয়া বেশ সাবধানে রুমে এলাম। বিছানায় বসে চাদর জড়িয়ে নিলাম গায়ে। উনিও এসে বসলেন পাশে। বালিশের পাশ থেকে সোয়েটার পড়ে নিলেন। কৌটাটা খুললাম। এরপর কৌটার মুখ পাশে রাখলাম কারন সমস্ত খোসা এটায় রাখবো। আমার আগেই উনি একটা বাদাম তুলে নিলেন। কিড়মিড় শব্দে খোসা ভেঙে মুখে পুড়ে দিলেন দুটো বাদাম। আমিও খেতে লাগলাম। খাওয়ার আওয়াজে আমাদের রুম মুখরিত! রাতের জন্য তা গাঢ় হয়ে কানে বাজছে। তখন বেলকনির পর্দা আর লাগানো হয়নি। চাঁদের মিষ্টি আলো এসে ঘরে ডুকেছে। আর সেই আলোয় চোখ বুজে বাদাম চিবুচ্ছি। কি শান্তি! হঠাৎ চোখ খুলে দেখলাম উনি অপলকভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করতেই উনি বাদাম তুলে খেতে লাগলেন। দেখতে দেখতে অর্ধেক বাদাম শেষ! পেট ভরে গেছে আমার। আমি খেয়ালও করিনি উনি কতগুলো খেয়েছেন। তবে আমি যে খুব একটা কম খাইনি তা বুঝছি। পেট ভরতেই আর একটাও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শান্তির ঢেকুর তুলে পাশের টেবিলে রাখা একগ্লাস পানি ডগডগ করে খেয়ে নিলাম। এরপর একপাশে শুয়ে পড়লাম। উনি ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর রাগান্বিত গলায় বললেন,
‘ শুয়ে পড়ছিস যে? এগুলো কে সরাবে? ‘
ঘুমে চোখ লেগে আসছে। হাই তুলতে তুলতে বললাম,’ কে আবার? আপনি! ‘
‘ আমি পারবো না। ‘
‘ তাহলে আর কি? থাকুক ওগুলো বিছানায়। আপনি বরং পাউচে শুয়ে পরুন। ‘
‘ এই ছিলো তোর পেটে? ‘
‘ ইয়েস! ‘
বলেই চোখ বুজলাম। এরপর বেশ কিছুক্ষণ কাটলো। হঠাৎ অনুভব করলাম উনি পাশে এসে শুয়েছেন কেবল। একটু পর বলে উঠলেন,
‘ সিয়া! ‘
ক্ষিন স্বরে বললাম, ‘ জ্বি! ‘
‘ ঘুমিয়ে গেছিস একেবারে? ‘
একবার চেষ্টা করলাম চোখ খোলার। পারলাম না! মিনমিনিয়ে বললাম,
‘ না। ‘
‘ তোর চোখে কতটা খারাপ আমি? ‘
ওনার কথা মস্তিষ্কে পৌছালো না। অকপটে বললাম,
‘ জানিনা। ‘
‘ যখন সবটা জানবি তখন যদি খুব দেড়ি হয়ে যায়? কেউ মিথ্যে বললে কি তুই বিশ্বাস করে নিবি? জানিস? ত্রিধার সবটা জানার পর যখন সিদ্ধান্ত নেই, যে করেই হোক হতেই হবে এ বিয়ে, তখনি ভেবেছি। যাকে বিয়ে করবো তাকে সবটা দিয়ে আগলে রাখবো। খুব ভালোবাসবো। নিজের মন গহিনে রাখবো। জিবনে হয়তো ঝড়’ই বেশি। তাই তো তুই কতটা দূরে আমার থেকে। সত্যিই বলছি, ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। ‘
ঘুমে তলিয়ে গেছি আমি। আর কিছু মনে নেই।
_____
সকালে ঘুম ভাঙলো চেচাঁমেচির আওয়াজে। আজও কারো বাহুডোরে আবদ্ধ আমি। ওনার ঠোঁট কপাল ছুঁয়ে রয়েছে! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে গেলো। ট্রেনের গতিতে ছোটা হৃদপিণ্ড আর তার দ্রিম দ্রিম শব্দে হাত পা অসর করে তুললো। কথা বলতে গিয়েও আটকে গেলাম। কথা বলতে পারছি না আমি। কাটার মতো গলায় কিছু বিঁধছে। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলাম,
‘ শুনছেন? ‘
সাথেসাথে চোখ মেলে তাকান উনি। হাত ছেড়ে উঠে বসেন। উনি ছাড়তেই জোরে শ্বাস নিলাম। আড়মোড়া ভেঙে বসে বিদ্রুপ কন্ঠে বললাম,
‘ এভাবে জড়িয়ে ধরবেন না। অস্বস্তি হয় আমার। ‘
উনি কিছু বললেন না। নিচে আবারো চেঁচামেচির আওয়াজ। উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,
‘ নিচে কেওয়াজ কিসের? ‘
বিছানা থেকে একলাফে উঠলাম। বিরক্ত ভঙ্গিতে বললাম,’ আপনিও যেখানে আমিও সেখানে। নিচে গেলেই জানা যাবে সবটা! ‘
বলেই বেড়িয়ে গেলাম রুম থেকে। সিঁড়ি দিয়ে হাই তুলতে তুলতে নামতেই অবাক আমি। সিনথি, সায়েমকে অপরাধীদের মতো দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মামীর হাতে কাঠের স্কেল। মামী শাসিত স্বরে বলছেন,
‘ ঠিকঠিক বল, এতোগুলো বাদাম কি করেছিস? ‘
ওরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। অর্থাৎ ওরা খায়নি! আর সত্যিই তো বাদামগুলো ওরা খায়নি। আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে এগোতেই মামী আমার কাছে এলেন। রাগি স্বরে বললেন,
‘ সিয়া জানিস? কাল ভাজা বাদামের অর্ধেকই নেই! সকালে উঠে সিঁড়িতে অনেকগুলো বাদামের খোসা পেয়েছি। আমি নিশ্চিত এইগুলো রাতে ওরা খেয়েছে। এখন বলছে দুটোতে নাকি জানেনা। ‘
আমি শুকনো ডোগ গিলে সিঁড়ির দিকে তাকালাম। সত্যিই সিঁড়িতে বাদামের খোল পড়ে আছে। কালকে তো আমিই ওনাকে বাদামের খোসাগুলো ফেলতে বলেছিলাম। একটা কাজও ওনার দ্বারা হবে না। আবারো শুকনো ডোগ গিলে সিনথি আর সায়েমের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। একটু কাঠিন্য স্বরে বললাম,
‘ তোমরা কি সত্যিই রাতে বাদাম চুরি করে খেয়েছো? ‘
সায়েম জোর গলায় বললো, ‘ আরে না সিয়া আপু। আমরা জানিই না এ ব্যাপারে। ‘
ভয়ে বুক আৎকে উঠলো। ধুকপুক করছে বুকটা! জানাজানি হলে মান সন্মান সব শেষ হয়ে যাবে। কি করি? ওদের উপর দোষ চাপালে মামী নির্ঘাত মারবে। কিছু একটা করতে হবে। কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর গলায় বললাম,
‘ তোমরা সত্যিই খাওনি? ‘
সিনথি ছলছল চোখে তাকালো আমার দিকে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’ না গো সিয়া আপু। আমরা খাইনি। ‘
মায়া হচ্ছে ওদের জন্য। কিন্তু কি করবো? উপরে তাকাতেই দেখলাম সিয়াম ভাইয়া একপ্রকার দৌড়ে ঘরে ডুকলো। কই এখানে এসে বাঁচাবে তা না করে ঘরে চলে গেলো? নিষ্ঠুর লোক একটা। আমাকেই এই বিপদ থেকে ওতরাতে হবে। আমি মামীর কাছে গিয়ে শিতল গলায় বললাম,
‘ থাক, তুমি ওদের কিছু বলো না। ছোট মানুষ না বুঝে খেয়ে ফেলেছে। ‘
সায়েম গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমরা খাইনি! ‘
মামী কড়া দৃষ্টিতে তাকাতেই ও মাথা নিচু করে নিলো। আমায় বললো,
‘ যদি পেটের সমস্যা দেখা দিত? ‘
‘ আরে কিছু হবে না। সায়েম, সিনথি তোমরা উপরে যাও। ‘
ওরা চলে গেলো। আমি মামীকে বললাম, ‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘
মামী হাসলো। আমি উপরে উঠবো,তখনি নেমে এলেন সিয়াম ভাইয়া। এসেই মামীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘ কি হয়েছে? ‘ আমি জানি! এখন ন্যাকার মতো সবটা শুনবেন উনি। ভারি চতুর লোক। ফুঁসতে ফুঁসতে উপরে চলে এলাম। এখন কি ত্রিধার ঘুম ভাঙেনি? দেখবো একবার ফোন দিয়ে?
যেই ভাবা সেই কাজ! টেবিল থেকে ফোন তুলে দিলাম কল। একটু রিং হতেই ত্রিধা আপু ফোন রিসিভ করে বললো,
‘ কে বলছেন? ‘
‘ সিয়া, চেনেন আমায়? ‘
‘ আমি চিনি না। রাখছি! ‘
সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘ আপু ওয়েট! সিয়াম ভাইয়ার ব্যাপারে একটু জানার ছিলো! ‘
ত্রিধা ফোন কাটলো না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
‘ কি জানবে? ‘
‘ একটু দেখা করতে পারবেন আপনি? বেশিক্ষণ নেব না, শুধু কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে। ‘
‘ কখন আসবে আর কোথায়? ‘
ভাবিনি আপু রাজি হবে। অনিমেষে বললাম, ‘ দুপুরে একটা কফি সপে দেখা করি? ‘
‘ ওকে! ‘
ফোন কেটে দিলো ত্রিধা। তারমানে আমি সিয়া বলার পর আমায় চিনেছিলো। তাহলে প্রথমে চিনিনা কেন বললো? না চিনলে এখন রাজিই বা হলো কেন? আর সিয়াম ভাইয়ার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলো? নিশ্চই কিছু জানতে পারবো। জানতে আমাকে হবেই!
____
দুপুরে বাড়িতে কেউ থাকে না। সিয়াম ভাইয়া অফিসে চলে গেছেন। মামীকে কিছু কেনার প্রয়োজন বলে বেড়িয়ে এলাম বাড়ি থেকে। কফিসপে গিয়ে দেখি ত্রিধা আপু আসেনি। বসে পড়লাম একটা টেবিলে। খানিক বাদেই আসলো চলে এলো ত্রিধা। অবাক হলাম কারন সরাসরি আমার পাশেই এসে বসলো। সর্বাঙ্গে তার আধুনিকতার ছোঁয়া। তার লাল টুকটুকে গাল, অধর লম্বা তবে সরু, চুলগুলো রং করা! চিবুকে লাল লিপস্টিক। ঠিক যেন নাইকা সামনে বসে আমার। আমার ঠিক সামনের চেয়ারটাতে বসলো ও। নিজেকে শক্ত করে নিলাম। কোন কথায় ভেঙে পড়লে চলবে না!
‘ কেমন আছো? ‘ বললো ত্রিধা। প্রতিত্তোরে হেঁসে বলে উঠলাম,
‘ সে ভালোই আছি! আপনিও ভালো নিশ্চই? ‘
‘ এইতো। ‘
একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘ আমায় কিভাবে চিনলেন? ‘
উনি স্বাভাবিক হাসলো। গাঢ় লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটদুটি প্রসারিত করে হেঁসে উত্তর দিলো,
‘ ওর সব কাজিন দের দেখিয়েছিলো একবার। আর তোমাকে স্পেশাল ভাবে। ‘
চমকে উঠলাম। আমায় স্পেশাল ভাবে কেন? নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,
‘ আমায় স্পেশাল ভাবে মানে? ‘
‘ তুমি নাকি ওকে ভয় পেতে? তাই আলাদা করে তোমার ব্যাপারে বলেছিলো। ‘
‘ এবার মূল বিষয়ে আসা যাক? ‘
ত্রিধা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ সেটা কি? ‘
‘ চিঠিতে বলা সবটা কেন লিখেছিলেন আপনি? ‘
উনি অবাক হওয়ার ভান ধরলেন। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলে উঠেন,
‘ কেন চিঠির কথা বলছো? ‘
‘ কেন? বিয়ের আগে যেটা দিয়েছিলেন? ভুলে গেছেন? ‘ স্বাভাবিকের গলায় বললাম। তার হাসি মুখ মুহুর্তে পালটে জড়তা দেখা দেয়। চুপচাপ উনি কফির কাপের দিকে তাকিয়ে আছেন। আবারো বললাম,
‘ এসব সত্য? ‘
তবুও চুপ ত্রিধা। তাহলে কি আমিই ভুল? আন্দাজে ঠিল ছোড়া উচিত হয়নি আমার? কিন্তু আমায় সম্পূর্ণ অবাক করে বললো ত্রিধা,
‘ কাল আরেকবার আসতে পারবে? সব প্রমান সমেত তুলে দিবো! ‘
ভূমন্ডল কেঁপে উঠলো আমার। সব প্রমান দিবে মানে? মানে উনি আসলেই খুনি? নাকি আমায় ভুল বোঝানো হচ্ছে। নাকি আমিই সঠিক! আড়ষ্ঠ গলায় বললাম,
‘ তাহলে চিঠি আপনিই দিয়েছিলেন? ‘
‘ হুম। আর ওই সন্তান আমার আর সিয়ামের! ‘
#চলবে……