আমার সংসার পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0
1102

#আমার_সংসার
লেখক:হৃদয় আহমেদ
শেষপর্ব

সকালের স্নিগ্ধ আলোর ছটা মুখশ্রীতে পড়তেই হকচকিয়ে উঠলাম আমি। উঠতে গিয়ে আবারো বিছানায় উবু হয়ে থাকতে হলো। এহেন কান্ডে যেন বুক ছ্যাত করে উঠলো আমার। শক্ত হাতে আমায় আজ জড়িয়ে রেখেছেন উনি। ওনারও ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন ভাইয়া। আমি ছাড়া পেতেই বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে উঠলাম,

‘ এভাবে জড়িয়ে রাখেন কেন? সকালে ওঠার অভ্যেস আমার! ‘

আমার কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না ওনার। একটু একটু করে হাত বাড়াতে লাগলেন উনি। আমি অজানা ভয়ে সরে যাচ্ছি। অনিমেষে বললাম, ‘ ক্ কি করছেন? ‘

খপ করে হাত ধরে নিলো ভাইয়া। হেঁচকা টানে বুকে মিশিয়ে নিলো আমায়। সারা শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো আমার। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে হৃদপিণ্ডের গতি কতটা বাড়ছে তা বুঝতে অক্ষম আমি! উষ্ণ গরম বুকে দামামা’র শব্দ লোমকূপ খাড়া করে তুললো আমার। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম গলা দিয়ে কিছু উচ্চারণ করতে পারছি না। মধ্যে পথে বর্ন আটকে আসছে। উনি আরও মিশিয়ে নিলেন আমায়। নিশ্বাস আটকে আসছে। শুকনো ডোগ গিলে মূর্তির মতো তার বুকে রইলাম তার।

‘ আদর করছি। বুঝলি পাগলি? ‘ শিতল কন্ঠ! সিরদাড়া বেয়ে শিতল কিছু বয়ে গেলো। কেঁপে উঠলাম। উনি খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন,

‘ নড়াচড়া করছিস কেন? ‘

‘ অস্বস্তি হচ্ছে আমার। ‘

‘ হোক। ‘ বলেই জোরে খিচে নিলেন ভাইয়া। অজানা অনুভূতি ঘিরে নিলো আমায়। নাম না জানা অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশ করতে ব্যার্থ আমি। মিনমিন স্বরে বললাম,

‘ ছাড়ুন না! ‘

ছেড়ে দিলেন উনি। মুখচোখ কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। কিছুক্ষণ কাটলো এভাবেই। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। চোখ দুটি নেশাভরা! বড্ড টানছে। মুখের চাপদাড়ি গুলো অদ্ভুত ভাবে বেড়েছে। তবুও সুন্দর! সম্পূর্ণ মানুষ উনি!

‘ কি দেখছিস এভাবে? ‘

টনক নড়লো আমার। চোখ সড়িয়ে নিলাম। কি দেখছিলাম আমি? ইশশ! কে জানে কি ভাবছে লোকটা। কারো ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। কপালে সুদীর্ঘ ছ’সেকেন্ডের গাঢ় চুম্বন করলো ভাইয়া। শরীর অসর হয়ে আসলো আমার। উনি ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। ঠায় বসে রইলাম সেখানে। বাস্তবে আসতে কষ্ট হচ্ছে আমার। প্রথম পুরুষের সংস্পর্শে অন্যজগতের সম্মুখীন হতে হলো আমায়।

কাটলো আরও কিছু মুহুর্ত! বাস্তবে ফিরতে পারলাম না আমি। কেউ মুখের কাছে তুড়ি বাজাতেই সজ্ঞানে ফিরলাম। ভাইয়া মুখ মুছছেন। উনি বাঁকা হেঁসে বললেন,

‘ এখানে বসেই থাকবি, নাকি উঠবি? ‘

উনি ফ্রেশ হয়ে এলেন, আর আমি বসেই ছিলাম এতক্ষণ? এতটুকু আক্কেল পর্যন্ত আমার নেই! খুব জোড়ে উঠে পরলাম বিছানা থেকে। উনি হো হো করে হেঁসে লাগলেন আমার কান্ডে। আর একমুহূর্ত না দাড়িয়ে ছুটে বাথরুমে ডুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। দরজায় ঠেস দিয়ে শ্বাস নিতে লাগলাম। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। কি ছিলো ওই ছয় সেকেন্ড? কেন ছিলো? কি অনুভূতি ছিলো ওগুলো? নাম কি তার? ভাবতেই মুখে লাল আভা ভেসে ওঠে। প্রায় দশ মিনিট ডুবে রইলাম উদ্ভট সব অনুভূতির জালে। এরপর ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখলাম উনি রেডি হয়েছেন। সবুজ শার্টের উপর ব্লেজারে কত সুন্দর লাগছে ওনাকে! মুগ্ধ নয়বে তাকিয়েই রইলাম। উনি রেডি হয়ে হেটে এলেন আমার সামনে। যেন মনে হলো পৃথিবীর সবথেকে সুদর্ষন মানুষটি এসে দাড়ালো আমার সামনে। উনি দু হাত মুখে রেখে বললেন,

‘ আসছি গো। ‘

ঠোঁট টিপে হেঁসে উঠলাম। আমার স্বামী! বললাম,

‘ আল্লাহ’র নাম নিয়ে যেও। ‘

‘ আচ্ছা। আমার বউয়ের লাগবো কিছু্কি? ‘

‘ বড়াই আনবেন আমার জন্যি? ‘

‘ আনুম। ‘

আবারো কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন উনি। সেই একই অনুভূতি অনুভব করলাম। উনি নিজেই আয়নার সামনে নিয়ে গেলেন আমায়। গাল ছুঁয়ে বললেন, ‘ আর কিছু বউ? ‘

‘ আর না। ‘

উনি ছেড়ে দিলেন আমায়। চুলে চিরুনি চালাতে লাগলেন। একটা কথা গলায় এসে বিঁধছে। বলবো? আবার সন্দেহ করবেন কি উনি? অতশত ভাবছি, তখনি উনি বলে উঠলেন,

‘ আমার বউডায় আরও কিছু কয়বার চায় মনে হইতাছে। কেরে? আর কিছু কবি? ‘

তাকালাম ওনার দিকে। শুকনো ডোগ গিলে বলে উঠলাম, ‘ আজ একটু বেরোতে চাই আমি। ‘

‘ কই যাবে? ‘ স্বাভাবিক স্বর। তবুও ভয় হচ্ছে আমার। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

‘ আসলে…ওই সামি…’

‘ যাও। ‘

চমকে উঠলাম আমি। উনি যেতে দিবেন? তা-ও কোন রকম দ্বিধাছাড়া? মুখ ফসকে বলে ফেললাম,

‘ সত্যি? ‘

উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘ তো মিথ্যে বলছি? ‘

‘ সেটা বলছি না। আপনি শুনবেন না কেন যাবো? ‘

‘ না। ‘

বলেই চিরুনীর বিচরণ চালাতে লাগলেন উনি। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার মুখপানে। উনি চুল আঁচড়ে আমার দিকে ফিরলেন। তৃতীয় বারের মতো কপাল ছুঁইয়ে বলে উঠলেন,

‘ আমি তোকে ভালোবাসি! নিজের বউকে ভালোবাসি! ভালোবাসায় অবিশ্বাস থাকেনা। আমারো নেই! তুমি যেতে পারো নিশ্চিন্তে! ‘

বলেই নাকে হাত ছুঁইয়ে বেড়িয়ে গেলো ভাইয়া। হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। যেন অজানা অচেনা পৃথিবীতে আমি। অজানা সব অনুভূতি আমার চারপাশে ঘুরছে!

______

মুখোমুখি বসে আমি আর সামি। কলেজের সেই জাম গাছটার নিচে বসে আছি সবাই। চলছে পিন পতন নীরবতা। মাথা নিচু করে বসে রয়েছে ও। একবারও তাকায়নি এখনো অব্ধি আমার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সামির দিকে। নীরবতা ভেঙে আমিই বললাম,

‘ তোর সমস্যা কি সামি? কাল ওসব উদ্ভট মেসেজ দিয়ে তুই কি প্রমান করতে চাইছিস? ভালোবাসিস আমায়? ‘

অনিমেষে তাকালো সামি। চোখদুটো মরামরা। মুখ শুকিয়ে গেছে আগের থেকে। কিছু না বলে আবারো মাথা নিচু করবে বলে উঠলাম তখনি,

‘ সামি দাড়া। ‘ মাথা উঁচু করলো সামি। ফের বললাম,

‘ এসব পাগলামি বাদ দে। আ’ম ম্যারিড! তুই একবার ভেবে দেখ। আরে জিবনে অনেকে আসবে। ‘

……..

‘ সামি বুঝতে চেষ্টা কর! আমি বিবাহিত, এবং আমার দাম্পত্য জীবনে সুখী আমি! ‘

অশ্রুসিক্ত চোখদুটি মেলে তাকালো সামি। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

‘ পারছি না। বড্ড জ্বলছে বুকটা! ‘

‘ আমার এখন পাগলামি ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না সামি। ‘ বললো প্রিয়। ওর থেকে চোখ সরিয়ে সামির দিকে তাকি একটানে বলে উঠলাম,

‘ তুই যদি আমারি সামনে এমন মনমরা হয়ে থাকিস তাও আমারি জন্য! তাহলে আমার কেমন লাগে বুঝতে পারছিস? সবাই আমায় কেমন ভাবে বুঝতে পারছিস তুই? ‘

নিষ্প্রাণ চাউনিতে তাকিয়েই রইলো সামি। চোখ সরিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলাম,

‘ এমন হলে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব রাখা সম্ভব নয়! ‘

কথাটার পরপরই সামিসহ বাদবাকি সকলে চমকে তাকালো আমার দিকে। সামি বললো,

‘ চেষ্টা করবো! ‘

বলে চলে গেলো সামি। হয়তো চেষ্টা করেছিলো। নাহলে তো সে বিয়ে করতো না!

…★দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরও চারটে বছর! অর্নাস কমপ্লিট হতেই সামি চাকরি পেয়ে যায়। তার একবছর যেতেই বাড়ি থেকে বিয়ের চাপে অবশেষে সে বিয়ে করে। পাত্রপক্ষ হিসেবে আমি নিজেই গিয়েছিলাম। সেদিনের একটি কথাতেই হয়তো খুউব চেষ্টা করেছে ও। আমি জানি, আগের থেকে কতটা পরিবর্তন হয়েছে ও! এদিকেও পাল্টেছে পুরোটা। আজ নিয়ে তিন বছর তিন মাস আব্বু দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। সিয়াম আমায় সব’ই বলেছে। তবে আমি ফিল করি আব্বুর কাজটা অনুচিত ছিলো। নিজের রোগের কথা গোপন করে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে বিয়েটা দিয়ে দেন আব্বু। আমার ভবিষ্যৎ যেন বিপদে না পরে। সিয়াম চাকরি ছেড়ে মামা থুড়ি আব্বুর ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে। তিনবছরের শেষে আমার কোল উজার করে একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হয়। এখন ওর বয়স এগারো মাস! ওকে নিয়েই কাটছে আমার সারাটা বেলা। পরের বছর উনি আমার সপ্ন পূরনের সঙ্গি হবে বলেছেন। আমি অফিসার হবো! যার জন্য এতোকিছু করলো আব্বু, আর আমি সেটা ছেড়ে দেবো? সারাবেলা কাটছে আমার টুনটুনি কে নিয়ে। সিয়াম ওর নাম দিয়েছে হিয়া। আমাদের দুজনের নামের শেষে ‘য়া’ টার যথার্থ ব্যাবহার করেছেন উনি। বাড়িতে এসেই হিয়াকে নিয়ে সে-কি আহ্লাদি তার! আব্বা আর আম্মার সারাবেলা হিয়াকে নিয়েই কাটছে। জুঁই সবটা সময় হিয়ার আশেপাশে! যেন কিছু প্রয়োজন হলেই ও সাহায্য করতে পারে। কেটে গেলো আরও একটা বছর! হিয়া হওয়ার পর সময় কতটা দ্রুত বইছে ভাববার বাইরে! অফিসার পদে দাড়িয়েছি। ভাইভাও দেয়া অলরেডি শেষ! এখন আমার হিয়া’র বয়স দুই বছর দুই মাস! পুরো বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। একপলক এখানে দেখলে আরেকপলকে ওকে পাওয়া যায় না। সবাই হিয়াকে নিয়ে কত খুশি! যেন এক টুকরো প্রানভোমরা এ বাড়ির ও। আমি সিয়ামের বুকে মাথা রেখে বলতে পারি,

‘ আমরা সুখী! আমার সংসারে আমাদের সুখের কমতি নেই। আমার সংসার! আমার নিজের! ‘

#সমাপ্ত…..

[ভুল ত্রুটি মার্জনীয়]