আমার স্নিগ্ধপরী পর্ব-১৮

0
12

#আমার_স্নিগ্ধপরী
#পর্ব_১৮
#লেখা: #নীল_মালতীলতা

কপি নিষিদ্ধ ❌❌❌

আপন ভাবা মানুষগুলো যখন হঠাৎ করে বদলে যায় এরচেয়ে কষ্টের অনুভূতি আর কিছু হতে পারে না। বন্ধুত্ব হচ্ছে ভরসার একটা স্থান, সেই স্থান ভেঙ্গে গেলে মানুষের দুনিয়া অন্ধকার লাগতে শুরু করে। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, যেটাকে মানুষ নিজের সত্ত্বা ভাবে আর সবকিছু সেখানে উজাড় করে দেয়। সেই সম্পর্কের পরিণতি যখন বিশ্বাসঘাতকতা আসে তখন তাদের চারপাশে হাজারো ভালোবাসার মানুষ থাকতেও নিজেকে বড্ড একা লাগে।

স্নিগ্ধার মনে হলো তার কাধটা ভিজে যাচ্ছে। অদ্ভুত ফাইয়াজ কি কান্না করছে নাকি? পুরুষ মানুষ আবার কান্না করে নাকি? স্নিগ্ধা এতক্ষণ যেনো কোন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, হুস ফিরে আসতে সে ফাইয়াজের পিঠে হাত রাখে।

ফাইয়াজ স্নিগ্ধাকে ছেড়ে দুই হাত দিয়ে তার মুখটা ধরে সারা মুখে আদরে ভরিয়ে দিয়ে আবারো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন ছেড়ে দিলেই আবার হারিয়ে যাবে।

রাহাত সবটাই দেখছে তার চোখ জোড়া রাগে লাল হয়ে আসছে, হাত দুটো নিজে থেকেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল, দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ হচ্ছে তার।
রাহি রাগে নিজের চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে নিল ।

স্নিগ্ধা অবাক হয়ে গেলো, মানুষটা কখন তাকে এত ভালবেসে ফেলল,, পরিপাটি মানুষটা এতটা এলোমেলো হয়ে গেল,, ফাইয়াজের গায়েও এখনো সেই কালকের শেরওয়ানি।

রাহাত আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, পিছন থেকে ফাইয়াজের শেরওয়ানির কলার ধরে আচমকা টান দিয়ে স্নিগ্ধার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এতে স্নিগ্ধা পিছনের দিকে হেলে পড়ে যায়,

রাহাত ফাইয়াজকে টেনে দাড় করিয়ে ফাঁকা জায়গায় ছুড়ে মারে, এমন আক্রমের জন্য ফাইয়াজ মোটেও প্রস্তুত ছিল না, স্নিগ্ধাকে কাছে পেয়ে তো সে সব ভুলেই বসেছিল, দেহটা কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, সে তো ভুলেই গিয়েছিল তার বন্ধু রাহাতকে সে হারিয়ে ফেলেছে।

স্নিগ্ধা রাহাতের এমন আচরণে যেন স্তব্ধ, ফারজানা তালুকদারের কাছে স্নিগ্ধা রাহাত আর ফাইয়াজের বন্ধুত্বের অনেক গল্প শুনেছে, যার সাথে এই রাহাতের কোন মিল নেই।

আচমকাই রাহাত স্নিগ্ধার হাতটা ধরে দাড় করিয়ে উল্টো ঘুরিয়ে ফেললো, রাহাতের বুক বরাবর স্নিগ্ধার পিঠ এসে ঠেকল,

এমন আচরণের স্নিগ্ধার কেমন গা গুলি উঠলো,

রাহাত এবার আরো আশ্চর্যজনক একটা কাজ করলো, স্নিগ্ধার গলা বরাবর একটা ধারালো ছুরি ধরল, যা দেখে স্নিগ্ধার চোখ বড় বড় হয়ে গেল সে হতভঙ্গ হয়ে গেল, কিছুক্ষণ আগেও সে এই লোকটারকে সাহায্যের দূত ভেবেছিল।

ফাইয়াজ এবং অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠলো, রাহাত, কি করছিস ভাই তুই ছেড়ে দে ওকে, প্লিজ ভাই তুই তো আমার ভাই, তুই আমার সঙ্গে এমনটা করিস না প্লিজ, তোর সব ভুল আমি ক্ষমা করে দেবো তুই ওকে ছেড়ে দে,

রাহাত এবার হিংস্র চোখে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, তোর কাছে কি আমি ক্ষমা চেয়েছি? বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করার চেষ্টাও করবি না তাহলে এখানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। রাহি,,

জ্বি ভাইয়া,,

তোর কাছে যেই পেপার দিয়েছিলাম সেটা, আর একটা কলম ফাইয়াজের দিকে এগিয়ে দে, আর আমার মোবাইল থেকে রনি নামে সেভ করা নাম্বারে ফোন দিয়ে বল ভাই এখনই ডাকছে,

রাহি তার ভাইয়ের কথামত রনির নাম্বারে ফোন দেয়, এরপর একটা কাগজ আর কলম এগিয়ে দেয় ফাইয়াজের দিকে।

ফাইয়াজ যন্ত্র মানবের ন্যায় সবকিছু দেখছে, কাগজটা হাতে নেয়, কাগজের ভাজটা মেলে চোখ বোলায় কাগজটায় সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা তার নিজের অস্তিত্বকে ফিরে পাওয়া সব মিলিয়ে খানিক বিধ্বস্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তারমানে এই নয় যে সে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।
তার হাতে ডিভোর্স পেপার, যা দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়, পেপারটা হাতের মধ্যে দুমড়ে মুছড়ে যাচ্ছে। সে পেপারটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে । চিৎকার করে বলে বিশ্বাসঘাতক নেমকহারাম তোর সাহস কি করে হয় আমার কলিজায় হাত দেওয়ার, তোর মত বিশ্বাসঘাতকের বেঁচে থাকা কোন অধিকার নেই তোকে আমি শেষ করে ফেলব, এই বলে রাহাতের দিকে এগোতে নেয় কিন্তু তাৎক্ষণিক পেছন থেকে তাকে কয়েকজন চেপে ধরে।

রনি রাহাতের ভাড়া করা গুন্ডা। রাহাত তাদেরকে বলেছিল সে যতদিন না এই দেশ ছাড়ে ততদিন যেন তার আশেপাশেই থাকে। তাই ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হাজির হয়। তারা এই ফ্ল্যাটের নিচেই অবস্থান করছিল। তাই খুব একটা সময় লাগে না এখানে আসতে।

ফাইয়াজ নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে, আর বলছে, ছিহ তুই এতটা জঘন্য, তোর মত কিছু বন্ধুদের জন্য বন্ধু সমাজ কলঙ্কিত হয় ছিহ থু,

রাহাত এবার মুখ বাকিয়ে হেসে বলে, নিজের করে কিছু পেতে হলে মাঝেমধ্যে স্বার্থপর হতে হয়, যাইহোক রাহি কাগজটা আবার নিয়ে এসো,

ফাইয়াজ নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু এতগুলো ছেলের সঙ্গে পেরে উঠছে না, তুই যতই চেষ্টা করিস আমি কিছুতেই আমার স্নিগ্ধপরীকে ছাড়বো না, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেবো তবুও না,

তাই নাকি! তাহলে ছুড়িটা চালিয়ে দেই তোর স্নিগ্ধপরীর গলায়?

খবরদার রাহাত ওর গায়ে যেন একটা টোকাও না পড়ে,

স্নিগ্ধার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছে, ভাবছে বন্ধুত্বের এ কি রূপ। স্নিগ্ধা ছটফট করে উঠলো রাহাতের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।

রাহাত বলল, এত ছটফট করে না সুস্মিতা তোমার লেগে যাবে,

শয়তার ছাড় আমাকে, আমি কোন সুস্মিতা নয় আমি স্নিগ্ধা।

তুমি আমার সুস্মিতা,

রাহাত ভাই এমন করছিস কেনো ওকে ছেড়ে দে প্লিজ,

রাহাত এবার বেশ শব্দ করেই হাসলো বলল,, ছেড়ে দেবো, যার জন্য এত আয়োজন তাকেই ছেড়ে দেব হাহাহা

এমন কিভাবে করতে পারিস তুই আমার সাথে,

তোর জন্য আমার বোন কষ্ট পেয়েছে সে পর্যন্ত মেনে নিলাম, কিন্তু দেখ তুই শেষ পর্যন্ত আমারও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালি। তোর একার জন্য আমরা দুজনে একই কষ্ট পাব তা তো আর হয় না তাই না? এর থেকে ভালো হয় তুই ডিভোর্স পেপারটা সই করে দে তারপর তুই রাহিকে বিয়ে করে নে আর আমি আমার সুস্মিতাকে ব্যাস সমস্যা সমাধান।

স্নিগ্ধা রাহাতের কথা শুনে একদলা থু ফেললো রাহাতের মুখের উপর, এমন আক্রমনের জন্য রাহাত মোটেও প্রস্তুত ছিল না, রাহাত রাগে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। স্নিগ্ধার উপরে রাগ দেখাতে চায় না।
রাহির ঘৃণায় গা গুলি উঠল ইচ্ছে করছে, স্নিগ্ধার মাথা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু ভাইয়ের সামনে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার ভালোবাসার মানুষের জীবনে। রাহি আরো সময় নিয়ে ঠিকই মানিয়ে নিতো তার ভালোবাসার মানুষকে কিন্তু এই মেয়েটার জন্য তা আর সম্ভব হলো না।

রাহত শান্ত গলায় বলল খবরদার সুস্মিতা আমার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবে না তাহলে তোমার ভালোবাসার মানুষের লাশ তোমার চোখের সামনেই পড়বে, যেখানে আমি নিজের ভালোবাসার মানুষের গলা চুরি ধরে আছি সেখানে তোমার ভালোবাসার মানুষকে মারতে আমার বিন্দুমাত্র হাত কাঁপবে না, এই বলে স্নিগ্ধার হাত ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে নিজের মুখটা মুছে নিল রাহাত।

স্নিগ্ধা তাচ্ছিল্য করে বলল, শয়তান তোর মুখে ভালোবাসার শব্দটা উচ্চারণ করে ভালবাসার অসম্মান করিস না,

ফাইয়াজ বলল, তুই ভাবলি কি করে তুই বলবি আর আমি আমার স্নিগ্ধপরীকে ছেড়ে দিব।
কম তো চেষ্টা করলি না, আর তোর মুখে ভালোবাসা শব্দ ছিঃ, কাউকে ভালবাসলে বুঝি তাকে নিয়ে অমন বিচ্ছিরি ছবি তৈরি করা যায়? ভালবাসায় সম্মান থাকে। আর তুই সেই সম্মানে কি আঘাতটাই না করলি। ছবিগুলো আবার আমার বাবা-মা, স্নিগ্ধার বাবা-মাকে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলি ছি,

হ্যাঁ দিয়েছিলাম তো ছবি, তোকেও দিয়েছিলাম সুস্মিতা কেও দিয়েছিলাম, কিন্তু তোদের বিশ্বাস দেখে আমি অবাক, আমি তো ভেবেছিলাম তুই ছবিগুলো দেখে স্নিগ্ধাকে ছেড়ে দিবি ব্যাস আমি ওকে নিয়ে চলে যাব। আবার স্নিগ্ধাও ছবিগুলো দেখে তোকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাই তো আমাকে এরকম পথটাই বেছে নিতে হল। বাবা মার ভালোবাসা হারিয়েছি। অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। তোকে পাওয়ার পর বেশ ভালোই ছিল আমার দিনগুলো। কিন্তু আবার সেই দেখ ভালবাসার একজন মানুষ তুই আমার থেকে কেড়ে নিলি,

তুই বড় স্বার্থপর , তুই কখনোই আমাকে বন্ধু হিসেবে ভালোবাসিস নি, তাহলে ও তুই অন্তত আমার জন্য হলেও তুই এমন কাজ কখনো করতিস না, আর স্নিগ্ধাকেও তুই ভালোবাসিস নি তোর ভালো লেগেছিল, সেই ভালোলাগা যখন আমার ঘরে দেখলি যখন তোর আসল রূপটা বেরিয়ে এলো, জিদ ধরে সব কিছু শেষ করে দিলি এমনকি ভালোলাগার মানুষটার সম্মানটুকুও শেষ করে দিয়েছিস ছি,

অনেক কথা হয়ে গেছে, রনি ওকে এখান থেকে নিয়ে যা ওকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আয়।

এমন কথা শুনে আৎকে উঠলো স্নিগ্ধার হৃদয়,

রাহিও খানিক আৎকে উঠলো, ভাইয়া,

আমি নির্দয় স্বার্থপর বোন, ঠিক তোর মত, তোকে আমি এত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখি অথচ তুই আমার ভালবাসাকে আঘাত করেছিস, তাই তোর ভালবাসাকেও আমি খানিক আঘাত করতে একটুও ভাবছি না,

ভাইয়া ও তো তোমার বন্ধু,

ছিল, তবে এখন সে আমার এক এবং একমাত্র শত্রু।

ফাইয়াজকে রনি আর তার লোকেরা মিলে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ফাইয়াজ এতগুলো মানুষের সঙ্গে পেরে উঠছে না,

স্নিগ্ধা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে আর চিৎকার করছে, প্লিজ তোমরা ওনাকে ছেড়ে দাও, তোমাদের কারো ভালো হবে না বলে দিচ্ছি ছেড়ে দাও বলছি,

রাহাত বলল, ছেড়ে দিব কাগজটাই তোমরা দুজনে সই করে দাও তাহলে ছেড়ে দেবো একেবারে বাসায় সুস্থভাবে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

ফাইয়াজ চিৎকার করে বলল, কখোনা, আমরা একে অপরকে যে কোন অবস্থায় ছাড়বো না সেটার প্রমাণ আগেই পেয়েছিস,

হঠাৎ স্নিগ্ধার চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠলো, সেই কাল সকালে কিছু খেয়েছিল এরপর আর কিছু খাওয়া হয়নি আজকে বেলা প্রায় শেষ হতে চলল, আর তার ওপরে এত এত কাহিনী হজম করতে হচ্ছে

ফাইয়াজ স্নিগ্ধার দিকেই তাকিয়ে ছিল, সে দেখছিল স্নিগ্ধার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে মাথাটা হেলে পড়ছে রাহাত এখনো স্নিগ্ধার গলায় ছুরিটা ধরা যেটা ফাইয়াজের দুর্বলতা নইলে সে এতক্ষণে কিছু একটা করে ফেলত। তার মনে হচ্ছে স্নিগ্ধার মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে আর এতেই কোন একটা বিপদ হয়ে যাবে, চিৎকার দিয়ে উঠলো স্নিগ্ধপরী প্লিজ চোখ বন্ধ করো না,

রাহাত এবার স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলো, তাড়াতাড়ি ছুড়িটা সরিয়ে ফেলল, ততক্ষণে স্নিগ্ধ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, মাথাটা হেলে পড়তেই রাহাত দুই হাত দিয়ে স্নিগ্ধাকে ধরে রাখলো, এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে গালে চাপড় মারতে মারতে ডাকল এই এই সুস্মিতা কি হল তোমার চোখখোলো, এই কি হলো,,

এদিকে ফাইয়াজ অস্থির হয়ে উঠলো স্নিগ্ধার কাছে যাওয়ার জন্য,,

চলবে??