~ আমার হয়ে যা_ ১ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম
১.
নূপুরের ডিভোর্স হয়েছে শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। পৃথিবী যেন থমকে গেল আমার। আমি বসে আছি কাপড়ের দোকানে। আমার কর্মচারীরা কাস্টমারদের সঙ্গে দাম-দর করছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে এখন। আমার চেতনা ফিরে পেলাম যেন। আজ অবশ্যই মসজিদে যাওয়া জরুরি। আল্লাহ তায়ালা নূপুরকে নিশ্চয় আমার কপালে রেখেছেন, নয়তো যাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম- সে আবার ফিরে এলো কীভাবে? কারও ডিভোর্স হলে খুশি হওয়া উচিত না জানি, তবুও আমি খুশি হয়েছি।
নূপুরের ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে সে জলে পড়ে যায়নি যে দুঃখ পেতে হবে, ওকে ডাঙায় রাখার জন্য তো আমি আছি।
বড়ো আপুই কল দিয়ে খবরটা দিল আমাকে। কেন দিল কে জানে! আমি তো এতদিন কাউকে বুঝতে দেইনি নূপুরের জন্য আজও আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মাত্র গতকাল আপু শ্বশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে এসেছে। কয়েক বাড়ি পরেই নূপুরদের বাড়ি। আপু গিয়েছিল আজ। গিয়ে এই ঘটনাটা জেনেছে। দুই বছর আগে আমি নিজে দাঁড়িয়ে নূপুরকে বিয়ে দিয়েছিলাম।
ওর বিয়ে ঠিক হচ্ছে শুনে আমি আমার পরিবারকে দিয়ে বিয়ের আলাপ দেই, বেকার বলে ওর পরিবার রাজি হয়নি। আমার পরিবারও আমার বিয়ে নিয়ে আর মাথা ঘামাতে যায়নি। আমি নূপুরকেও গিয়ে বলেছিলাম, আমি তোকে ভীষণ পছন্দ করি, বিয়ে করতে চাই, বিয়েটা ভেঙে দে। সে জবাবে বলেছিল ‘তোকে আমি এভাবে কখনও দেখিনি নিষাদ, তাছাড়া আমার পরিবারও মানছে না, এগুলো মন থেকে বাদ দে, আমাদের দুই পরিবারের ভালো সম্পর্ক তুই পা*গলামি করে নষ্ট করিস না।’ আমি আর বাড়াবাড়ি করিনি। মানুষেন অনিষ্ট হয় এমন কাজ আমি কোনোকালেই করিনি। বরং প্রতিবেশী হিসাবে আমি বিয়ের সমস্ত আয়োজনে সহযোগিতা করেছি। চেষ্টা করেছিলাম কাউকে বুঝতে দেবো না আমার মনের ব্যথাটা। তবুও যখন সে কবুল বলেছিল আমার বুক দুমড়ে-মুচড়ে উঠে। আমি কমিউনিটি সেন্টারের বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ একা একা কেঁদে চোখ মুছে এসেছিলাম। যখন কনে বিদায় হবে, সে ভীষণ কাঁদছিল। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। ওর কান্না দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠে। আমি খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সবার থেকে নূপুর বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। একবার বোধহয় আমার দিকেও তাকিয়েছিল। ভ্রম না-কি সত্য কে জানে। এরপর সে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। দুই বছরের বেশি ওর বিয়ে টিকলো না কেন কে জানে! সপ্তাহ দুয়েক থেকে ও চাঁদগাও আছে এটা শুধু জানতাম। আমি যাইনি ওদিকে। কেমন যেন কষ্ট হয় দেখলে। পুরনো ক্ষ*ততে ঘা লাগিয়ে লাভ কী? তাছাড়া নিজের ব্যস্ততাও আছে। ভুলে থাকাও জরুরি ছিল। এমন ভালো, সুন্দরী মেয়ের ডিভোর্সই বা কেন হলো আপুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমি আর নূপুর সমবয়সী ছিলাম। একসাথেই পড়ালেখা করেছি। ওর ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে গেল। আমি ডিগ্রি শেষ না করে ব্যবসা শুরু করলাম। দু’জনের জীবন দু’দিকে চলতে থাকলো। ওকে আমার ভালো লাগে হাইস্কুলের জীবন থেকেই। ওদের বাড়িতে যাওয়া-আসাও ছিল। ওর বই পড়ার নেশা ছিল। ঢাকা যাওয়া পড়লে আমাকে বইয়ের লিস্ট দিতো। কতবার বই এনে দিয়েছি। এখন স্যেশাল মিডিয়ায় কবিতা লিখে না-কি সে। বইও বের হয় শুনেছি। আমার কোনোকালেই এসবে আগ্রহ ছিল না। তাই বলে অবজ্ঞাও করি না। ওকে খুঁজে খুঁজে বই এনে দিতাম। এখন আমার কী করা উচিত? আবার ওকে বিয়ের আলাপ দেবো আমি। বাবা-মা মানবেন না হয়তো, একটা ডিভোর্সি মেয়েকে কেন বিয়ে করবো? যেখানে আগে বেকার বলে বিয়ে দেয়নি ওরা। আমার পরিবার এগুলো অবশ্যই বলবে। তবুও আমি যেভাবে হোক রাজি করিয়ে ওকে নিজের করে নেব। এক্ষুণি ওদের বাড়িতে যাব আমি। প্রতিবেশীর বাড়িতে যেতেই পারি। এটা তো আশ্চর্যের কিছু না। আমি বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর বাইক নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে এলাম। এসে দেখি ভাগ্নী কাঁদছে। আপু তাকে নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে দেখে বললো ‘তুই অসময়ে বাড়িতে ফিরলি যে?’
আমি তাকে হাত ধরে টেনে আমার রুমে আনলাম। আম্মু পিছু পিছু চলে এসে বললেন, ‘কি হইছে? তুই ব্যস্ত হইয়া আইসা ওরে টানছিস কেন?’
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘এখান থেকে যাও তো আম্মু। আপুর সাথে দরকার আছে।’
‘তোদের কত ঢং বলে’ আম্মু চলে গেলেন। আপু ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কি হয়েছে?’
– ‘নূপুরের ডিভোর্স হলো কেন আপু?’
– ‘তুই এগুলো জানতে বাজার থেকে এলি?’
– ‘তুমিই তো কল দিয়ে জানালে।’
– ‘জানালাম কারণ তর সইছিল না। নবাবের বেটিকে ওরা তোর কাছে বিয়ে দেয়নি। এখন মুখ পুড়লো যে সেটা তোকে জানাতে হবে না?’
আমি বুঝতে পারলাম আগে আমার সুযোগের কথা ভেবে আপু কল দেয়নি, দিয়েছে নূপুরের ক্ষ*তিতে আনন্দিত হয়ে। আমি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে বললাম, ‘কিন্তু ডিভোর্স কেন হলো?’
– ‘ওরা তো বললো ও যে লেখালেখি করে। এগুলো নিয়ে রোজ ঝামেলা হয়। সে না-কি ফেইসবুকে লাইভে যায়। কবিতা পড়ে নেটে ছাড়ে। একা একা যেখানে-সেখানে যায়। এসব ওরা পছন্দ করে না।’
– ‘এগুলোর জন্য ডিভোর্স হয়ে গেল?’
– ‘এগুলো নিয়ে রোজ তর্ক-বিতর্ক হয়ে কত ডালাপালা মেলতে পারে তুই কী বুঝবি?’
– ‘ও আচ্ছা বুঝেছি, আম্মা শুনে কী বললো আপু?’
– ‘খুশি হইছে আর কি বলবে? এবার দেখুক ওরা, তুই ব্যবসা করে দুই হাতে টাকা কামাচ্ছিস। এদিকে তাদের মেয়ে ঘাড়ে এসে চেপেছে।’
– ‘ও তো বেশ কিছুদিন থেকে এখানে থাকে তাই না?’
– ‘হ্যাঁ, ওদের ঝামেলা অনেক আগে থেকেই ছিল।’
‘ও বুঝেছি’ বলে আমি বাইরে চলে এলাম। বহুদিন আমি ওকে ভুলে থেকেছি। ওর সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। আমি কারও জন্য নিজের ক্ষ*তি করার মতো লোক না। তাই হাত কা*টা, আত্মহ*ত্যা, পা*গল হয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আজ যে সুযোগ এলো। এটার জন্য পুরনো প্রেম যেন মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। হেঁটে হেঁটে রাস্তায় চলে এলাম। একটা সিগারেট ধরলাম। চারধার অন্ধকার। নূপুর লাইভে গিয়ে কবিতা আবৃত্তি করবে। কবিতা লিখবে। যা ইচ্ছা করবে। সব করতে দেবো আমি। কু*কুরের পেটে ঘি হজম হয় না। নূপুরকে ওর বরের হয়নি। আমার হবে। আমি লজ্জা-শরম ভুলে ওর বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। নূপুরের খারাপ সময়ে আমি লজ্জা পেয়ে দূরে দূরে থাকলে তো হবে না। আমি ওদের দরজায় গিয়ে নক দিলাম। খুলে দিলেন এসে চাচি। আমাকে দেখে যেন অবাকই হলেন। স্মিত হেসে বললেন, ‘আরে নিষাদ আসছো, বাবা তোমারে তো আজকাল দেখাই যায় না।’
– ‘বুঝেনই তো চাচি, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’
– ‘হ্যাঁ তা বুঝতে পারছি।’
আমি চাচির সঙ্গে সামনের রুমে গিয়ে বসলাম। ‘তোমার জন্য চা বসাই’ বলে চাচি চলে গেলেন। চাচা বাইরে, তাই আমি একা বসে আছি। তাদের একমাত্র মেয়েই নূপুর। এখানে আগে এলে ওর সঙ্গেই কথাবার্তা হতো। চাচির গলা শোনা গেল ‘নূপুর, এই নূপুর, সামনের রুমে যা, নিষাদ এসেছে, একা বসে আছে।’
আমার মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠলো। ও আসবে, ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছি। ক্ষীণ সময় পর দরজার কাছে এসে নূপুর মিষ্টি গলায় বললো, ‘কিরে নিষাদ, তুই এসেছিস। তোর তো দেখাই মিলে না।’
আমি বুঁদ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে একদম পরিণত বিবাহিত নারীই লাগছে। যেন আমার থেকে বয়সে কত বড়ো সে। এখন সব সময় মনে হয় শাড়িই পরে। চোখে চশমাও আছে। খানিকটা মোটা হয়েছে। কিন্তু সেই আগের সৌন্দর্য ঠিকই আছে। সে লীলায়িত ভঙ্গিমায় সামনের সোফায় বসে বললো ‘তুই হঠাৎ কী মনে করে।’
আমতা-আমতা করে বললাম, ‘আসলে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি তো। তাই আসা হয় না। আজ হঠাৎ মনে হলো তোদের দেখে যাই।’
– ‘নাহার আপু এসেছিল বিকালে।’
আমি বুঝতে পারলাম আজ আমার আসা বোকামি হয়েছে। মাথায় এগুলো আসেনি তখন। নূপুর ভাববে আপু গিয়ে সব বলেছে, তাই এসেছি। ভাবলে ভাবুক, সত্যিই তো তাই এসেছি। আর নূপুরকে একটুও নার্ভাস মনে হচ্ছে না। একদম স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমি নিজেকে সামলে বললাম, ‘হ্যাঁ জানি, তা কেমন আছিস তুই।’
– ‘আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর কী অবস্থা।’
– ‘আর কী, ওই ব্যবসা নিয়ে আছি।’
– ‘ব্যবসা তো ভালোই হচ্ছে শুনি। এবার বিয়ে-শাদি কর।’
আমি মুচকি হাসলাম। কোনো জবাব দিলাম না। ক্ষীণ সময় পর বললাম, ‘তুই তো শুনলাম আজকাল বই-টই লেখিস।’
– ‘হ্যাঁ।’
আমি ওর সঙ্গে মেশার জন্যই মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘ফেইসবুক-টেইসবুকে কম থাকি তো। তোর ফেইসবুকের আইডিটা বের করে দে দেখি।’
ও গাঁইগুঁই করে মোবাইল হাতে নিল। যেন অনিচ্ছায় ওর পেইজে লাইক দিয়ে দেখিয়ে বললো, ‘এটা আমার পেইজ।’
প্রফাইল দেয়নি দেখে হতাশ হলাম। তবু আমি দেখে রাখলাম পেইজটা। ইংলিশে নাম দেয়া ‘নূপুরের ডায়েরি।’
কিন্তু পেইজে তো আর ওর সাথে কথা বলা যাবে না। ওর বর্তমান নাম্বার নেই আমার কাছে। এখন চাইতেও পারছি না। তবে সেটা চাইবো কয়েকদিন পর। যেখানে পুরো ওকেই চাই আমার, সেখানে নাম্বার চাইতে ভয় পেলে কী চলে? চাচি চা নিয়ে এলেন। আমাদের চা দিয়ে নিজেও বসলেন সোফায়। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। আজ আমাকে যেন চাচি আরেকটু বেশি খাতির করছেন৷ এটার কারণ কী? আমার বর্তমান পজিশন না-কি আবার আমি যেন বিয়ের প্রস্তাব দেই সেই অপেক্ষায়? কিন্তু নূপুরকে তা মনে হলো না, তার চোখে আলাদা কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। কেবলই ভদ্রতা থেকেই যেন সামনে বসে আছে। এরকমই থাকুক, আমার নূপুরের ডিভোর্স হয়েছে বলে এত গায়েপড়া হলে মানাবেও না। আমি চাই সে এরকমই থাকুক, আমিই গায়ে পড়ে থাকবো। শুধু আমাকে বিয়ে করলেই হবে। আমার তাকে কাছে পেলেই হবে। চা শেষ করে নূপুর উঠে বললো ‘তুই বস নিষাদ, আম্মুর সাথে গল্প কর’ বলে উঠে চলে গেল সে। আমি আরও কিছু সময় চাচির সাথে গল্প করে উঠে গেলাম। চাচি বারবার বলে দিলেন মাঝে মাঝে আসতে। আমি তো তাইই চাই। কথা দিয়ে এলাম আসবো। বাইক নিয়ে দোকানে চলে এলাম। কেমন ঘোরের ভেতর আছি আমি। রাত এগারোটায় দোকান বন্ধ করে চলে এলাম বাসায়। খেয়ে-দেয়ে বিছানায় এসে ফেইসবুকে গেলাম। নূপুরের পেইজ ভিজিট করতে শুরু করলাম। একে একে ওর লাইভ শুনছি, কবিতা আবৃত্তি শুনছি। ভক্তদের কমেন্ট পড়ছি। এসব দেখতে দেখতে আমার ভয় লাগতে শুরু করলো। ও অনেক খ্যাতি পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে, আমাকে বিয়ে করবে তো? কে জানে। ডিভোর্স হয়েছে শুনে যে আশার আলো জ্বলেছিল। তা যেন খানিকটা ম্লান হয়ে গেল। তবুও আমার এতদিনের সুপ্ত প্রেম যে জেগে উঠেছে। বুকে যে আগুনের শিখা জ্বলে উঠেছে, তা আর নিভছে না। ওর কবিতা আর লাইভ শুনে শুনে রাত তিনটা বেজে গেল। ওর পেইজের ছবিগুলো তখন দেখতে গেলাম। নূপুর একটা বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছে। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে ওকে। আরেকটি ছবিতে ওর পেছনে অনেক বই, হাতে কলম। সে মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ওর পরনে নীল শাড়ি। খোলা চুল। কপালের মাঝখানে টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। হাতে চুড়ি। এত মায়াবী লাগছে দেখতে। আমি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। নিজের অজান্তেই যেন ছবিটি জুম করে চুমু খেলাম পুরো মুখে। বুকে জড়িয়ে ধরলাম মোবাইল। আমার গা কাটা দিয়ে উঠে। আমি চোখবুজে অস্ফুটে বলি, ‘নূপুর, আমার নূপুর, এবার তো আমি আর বেকার না। প্লিজ তুই আমার হয়ে যা।’
__চলবে…