আমার হয়ে যা পর্ব-০২

0
691

আমার হয়ে যা_পর্ব- ২
.
ঘুমিয়েছিলাম রাত চারটার দিকে। সকাল দশটায় আম্মু আমাকে ডেকে তুললেন। এত দেরিতে সাধারণত আমি ঘুম থেকে উঠি না। হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করে দোকানে গেলাম। কর্মচারী তিনজন আছে। ওরা আগেই এসে দোকান খুলেছে। আমি না থাকলেও ওরা সবকিছু সামলে নেয়। ক্যাশবাক্সের সামনে গিয়ে বসলাম। ঘণ্টা দুয়েক পরেই আমার ‘হাই’ উঠতে শুরু করলো। রাতে ঘুম না হওয়ার যন্ত্রণা আজ সহ্য করতে হবে। একটার দিকে বাড়িতে এলাম। গোসল করে খেলাম। তারপর দোকানে না গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো তিনটার দিকে। উঠে মোবাইল হাতে ফেইসবুকে ঢুকে দেখি নূপুরের পেইজে পোস্ট, আজ রাত সন্ধ্যা সাতটায় সে ফেইসবুক লাইভে আসবে। যতদূর বুঝলাম সে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফেইসবুক অডিও লাইভে আসে। ওর লাইভ দেখার জন্য ভেতর থেকে কেমন তাড়া পেলাম। গতকাল পুরাতন লাইভ শুনেছি। আজ সরাসরি শুনবো। বিছানা ছেড়ে বাইরে আসতেই আম্মু কিচেন থেকে বের হয়ে বললেন, ‘কিরে তুই কি কাল সন্ধ্যায় নূপুরদের বাড়িতে গিয়েছিলি না-কি?’

আমি থমথমে খেয়ে বললাম, ‘কেন? তোমাকে কে বললো?’

– ‘ওর মা এসেছিল, কথায় কথায় বললো অনেকদিন পর তুই তাদের বাড়ি গিয়েছিলি।’

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ, ভাবলাম কতদিন যাই না ওদিকে। গিয়ে দেখে আসি।’

আপু কোত্থেকে এসে বললো, ‘গতকাল আমি ওর ডিভোর্স হয়েছে বললাম আর সঙ্গে সঙ্গে তুই ওদের বাড়িতে চলে গেলি?’

আম্মু যুক্ত করে বললো, ‘কারণ কী খুলে বল তো নিষাদ, তোর কি বিয়াত্তা ডিভোর্সি এই মেয়ের জন্য প্রেম উথলে উঠলো না-কি?’

‘কি যা-তা বলছো তোমরা, আমি এখন দোকানে যাচ্ছি’ বলে রীতিমতো পালিয়ে এলাম বাইরে। বাইক স্টার্ট দিয়ে দোকানে চলে এলাম। আপু বা আম্মুর এসব কথা আমি গায়ে মাখাইনি। আগে নূপুরের ভাবভঙ্গি আমার বুঝতে হবে। ও রাজি হলে যেভাবে হোক বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াবো। সবে ডিভোর্স হয়েছে, তাই তাড়াহুড়ো করারও কিছু নেই। আমি সন্ধ্যা সাতটায় ওর লাইভ শোনা নিয়ে অস্থির হয়ে আছি। কাস্টমার আসছে, কাপড় নিচ্ছে, আমি টাকা ক্যাশবাক্সে রাখছি। এভাবেই দিন চলে গেল।
সন্ধ্যা সাতটায় ফেইসবুকে গিয়ে দেখি ও লাইভে আসেনি। ইয়ারফোন কানে গুঁজে দোকানে বসে ফেইসবুকে স্ক্রল করছি। সাতটা দশে ও লাইভে এলো। ভালোমন্দ কথা বলে সে নিজের বইয়ের কবিতা আবৃত্তি শুরু করলো। ভীষণ সুন্দর করে কবিতা পড়ে সে। ওর কণ্ঠ এমনিতেই খুব সুন্দর। আবৃত্তি শেষে বলে দিল এই বই কোথায় পাওয়া যাবে। আমি মনে রাখলাম। ওর বইগুলো সংগ্রহ করবো। হয়তো তাতে সে বুঝবে আমি আগের ওর বরের মতো না। তার এগুলো নিয়ে ঝামেলা করবো না। লাইভের একপর্যায়ে নূপুর সবার নাম সহ কমেন্ট পড়তে শুরু করেছে। ওর মুখে এভাবে নিজের নাম শুনতে ইচ্ছা হলো। আমি সাথে সাথে কমেন্ট করলাম, ‘তোর কবিতা আবৃত্তি শুনলাম, কবিতা এবং পাঠ অনেক ভালো লেগেছে। বইটাও সংগ্রহ করবো।’
কমেন্টে করে অপেক্ষায় আছি। কিন্তু ও হতাশ করে দিয়ে আমার কমেন্ট পড়লো না। আমার ইচ্ছা করছে এখনই ওদের বাড়িতে চলে যাই। গিয়ে আজ লাইভ বিষয়ক কথাবার্তা বলি। কে কি কমেন্ট করেছে। কোন লাইন সুন্দর হলো, কোন কবিতা ভালো হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু গতকাল যাওয়াটাই তো ভুল ছিল, আজ আবার যাই কি করে? নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রাখলাম। লাইভ শেষ হতেই বইটা গিয়ে আমি অর্ডার দিয়ে রাখলাম। বই পাওয়ার পর দুয়েকটা কবিতা পরে ওর বাসায় যাব। তাতে গল্প করা যাবে এসব নিয়ে। আমি পরের দুইদিন ওদের বাড়ি যাইনি। তিনদিন পর বিকালে কল পেয়ে বইটি রিসিভ করলাম চাঁদগাও বাজারের কুরিয়ার থেকে। নূপুরদের বাসায় যাওয়ার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে আছে, আজ সন্ধ্যায়ই যেতে চাই। তাই দোকানের সবকিছু ওদের বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিশটা কবিতা পড়ে নিলাম আমি। কিছুই মাথায় ঢুকলো না আমার। তবুও কবিতার নাম সহ সবকিছু মনে রাখলাম। বই হাতে একটা সেল্ফিও তুললাম। সন্ধ্যার দিকে গেলাম নূপুরদের বাড়িতে। চাচিই খুলে দিলেন দরজা। হাসি-খুশি মুখে কথাবার্তা বললেন। চাচার সাথেও আজ দেখা হলো। আমি সামনের রুমে বসে হাসি-হাসি মুখে বললাম, ‘নূপুর কই চাচি। সে তো খুব ভালো কবিতা লিখে।’

চাচি মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমি পড়েছো নাকি বাবা?’

– ‘হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে ওর লাইভে কবিতা শুনে ভালো লাগায় বই অর্ডার দিয়েছিলাম। ও কোথায় কথা বলি।’

‘রুমেই আছে, আসো তুমি’ বলে চাচি আমাকে ওর রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। দরজার সামনে বেগুনি রঙের পর্দা ঝুলছে। একপাশে সেল্ফ ভর্তি বই। ও শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে।
‘দেখ নিষাদ এসেছে’ বলতেই ও উঠে বসলো। ‘তুমি এই চেয়ারে বসো’ বলে চাচি চলে গেলেন। ওর মুখটা খানিক ফোলা ফোলা লাগছে। আজ পরনে কামিজ। ওড়না কাঁধে ঝুলে আছে।
নূপুর বইটা বালিশের পাশে রেখে বললো, ‘কেমন আছিস।’

– ‘এইতো, ভালোই। তোর পেইজে অনেক কবিতা শুনেছি, পড়েছি। অনেক ভালো লাগে।’

সে নির্লিপ্ত চেহারায় বললো, ‘আচ্ছা।’

আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। ও সংক্ষিপ্ত করে উত্তর দিচ্ছে। হয়তো এতদিন আসিনি। এখন সপ্তাহের ভেতরে দু’বার আসাকে সে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। আমি পুনরায় বললাম, ‘গত বৃহস্পতিবারে তোর অডিও লাইভে কবিতা শুনে ভালো লাগায়, পরে কিনলাম তোর বই, আজই হাতে পেলাম সেটা।’

– ‘কি বলিস, তাই না-কি?’

‘পড়েও ফেলেছি অনেকগুলো’ বলে আমি মোবাইলে ছবি বের করে বললাম, ‘এইযে সেল্ফি তুলেছি বইয়ের সাথে।’ নূপুর মুচকি হেসে বললো, ‘তুমি কবিতাও পড়ো না-কি আজকাল। আমি লাজুক হেসে বললাম ‘অনলাইনে পড়ি। আর বেশি ইউটিউবে শুনি কবিতা। ভালো লাগে।’

– ‘আগে তো পড়তে না।’

আমার হঠাৎ মাথায় এলো একটা সুযোগের কথা। আসতেই আমি চালটা দিয়ে দিলাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘জানি না, গত দুই বছর থেকে এগুলো ভালোই লাগে। রাতে কবিতা শুনি, গান শুনি। আজ তোর কবিতার বইও পড়লাম৷ মনে হয় নিজেরই মনের কথা সব’ তারপর চুপ থেকে বললাম ‘হয়তো মানুষ বড়ো কোনো কষ্ট পেলে কবিতা বুঝতে শিখে যায়।’

নূপুরের চেহারা কেমন মলিন হয়ে গেল। বোধহয় কাজে লেগেছে। সে ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছে নিশ্চয়। আমি মেয়ে পটানোতে মোটেও দক্ষ না। হলে আগেই নূপুরকে বশে এনে বিয়ে করার কথা। কিন্তু এবার কেমন পারবো মনে হচ্ছে, আমি পুনরায় বললাম, ‘তুই তো সেলিব্রিটি মানুষ হয়ে গেছিস। পেইজ ঘুরে তাই মনে হলো। আজ ভেবেছিলাম বই নিয়েই আসবো, তুই অটোগ্রাফ দিবি। পরে ভাবলাম থাক, এটা ইয়ার্কির মতো ব্যাপার হয়ে যাবে।’

– ‘তুই আবার অটোগ্রাফ নিবি কেন। আর আমি বিখ্যাত হলেই কী তোদের কাছে সেলিব্রিটি না-কি। বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে আমি আগের সেই নূপুরই থাকতে চাই।’

আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘তোর এখনকার নাম্বার নেই রে, হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দে তাহলে তোর থেকে ভালো কবিতার বইয়ের নাম পেলাম। আমিও কবিতা শুনলে লিঙ্ক দেবো। তাছাড়া…’ বলে আমি থেমে আমতা-আমতা করে বললাম, ‘তুই যেহেতু এখানেই থাকবি দরকার-অদরকার কাজে লাগতে পারে।’

নূপুর কী ভেবে যেন ক্ষীণ সময় পর নাম্বার দিল, আমি সেভ করে নিলাম। খানিক পর চাচি চা নিয়ে এলেন। আমাদের দু’জনকে চা দিলেন। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘তুই তো দেখি বাসা থেকে বেরই হস না। আমাদের বাড়িতেও তো যেতে পারিস।’
নূপুর সহজ স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘মানুষের প্যারা খাওয়ার ইচ্ছা নাই আমার। ডিভোর্স হয়েছে তো জানিস মনে হয়। এখন এজন্য যাই না বাইরে। সবাই এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে।’

ওর সোজাসাপটা ডিভোর্সের কথা শুনে আমি মোটেও অবাক হইনি। নূপুর আগে থেকেই স্পষ্টভাষী মেয়ে। ওর এই কথায় আমার বরং সুবিধাই হলো। আমি চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে নিয়ে মুখে দিয়ে বললাম, ‘তোর বান্ধবী সবারও বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বাসায় আসবেও এই সুযোগ নেই।’

– ‘হ্যাঁ, অবশ্য আমার একাই ভালো লাগে।’

– ‘তুই বাড়িতে আছিস যেহেতু আমিও মাঝেমধ্যে আসবো।’

নূপুর কোনো জবাব দিল না। আমি পুনরায় বললাম ‘আহা আগে সারাদিন তোদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি লাইন থাকতো। তোরা যেতি, আমরা আসতাম।’

‘হ্যাঁ’ বলে নূপুর চায়ে চুমুক দিল। ওর সংক্ষিপ্ত জবাবগুলোতে মনে হচ্ছে আমি চলে গেলেই খুশি হবে। বিরক্ত হচ্ছে সে। হোক, আমারও তাড়া নেই। ধীরে ধীরে এগুবো। চা শেষ করে বললাম, ‘এখন যাই তাহলে নূপুর, তোকে বিরক্ত করলাম মনে হচ্ছে এসে।’

‘আরে না, সারাদিন তো একাই থাকি’ বললো সে, কিন্তু বসতে বললো না। আমি দরজার কাছে এসে আবার ফিরে ওর দিকে তাকালাম। সে কপালের চুল কানে গুঁজে আবার বই হাতে নিল। আমি আস্তে-আস্তে বললাম, ‘তোকে শাড়িতে বেশি সুন্দর লাগে নূপুর।’

ও মাথা তুলে তাকিয়ে কেন যেন হেসে ফেললো। আমার মনটা কেমন ভালো হয়ে গেল। ওকে ভীষণ সহজ লাগলো হেসে ফেলায়। ওর হাসি ভীষণ সুন্দর, বুকে লাগে হাসি। চাচি আর চাচার থেকে বিদায় নিলাম। ওরা বলে দিলেন মাঝে মাঝে আসতে। আমার তাও ভীষণ ভালো লাগলো। আমি অবশ্যই আসবো, এ বাসায় নূপুর আছে।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম