আমার হয়ে যা পর্ব-০৩

0
458

আমার হয়ে যা_পর্ব-৩
.
রোজকার মতো পরদিন দুপুরে আমি দোকান থেকে বাড়িতে আসলাম। গোসল করে খাবার টেবিলে যেতেই আপু আর আম্মু আমাকে ধরলো। আব্বু বাসায় না থাকায় ওরা চড়া গলায় কথা বলতেও দ্বিধা করলো না। আপুই প্রথমে বললো, ‘তোর টেবিলে একটা কবিতার বই দেখলাম, এটা তো নূপুরের বই মনে হয়।’

আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘হ্যাঁ নূপুরের বইই।’

আম্মু রূঢ় গলায় বললো, ‘তুই ভালো করে বলতো নিষাদ, তোর মতলবটা কি? ওরা আগে বিয়ে দেয় নাই তোর কাছে। এখন এই মাইয়া ডিভোর্সি। তুই ওদের বাসায় যাস, আবার বইও পড়িস, তোর মতলবটাকি বল তো। তোর কী হায়া-শরম নেই?’

আমি বিরক্তির সুরে বললাম, ‘তোমরা সামান্য বিষয় নিয়ে এত ঘ্যানঘ্যান করো কেন? ওরা কি আমাদের পর না-কি? পরিচিত একজন বই লিখে, পড়ে দেখতে পারি না? আর এত ডিভোর্সি ডিভোর্সি করো কেন? ওর জামাই ভালো ছিল না। বনিবনা হয়নি, তাই ডিভোর্স হইছে।’

– ‘দেখলি তো নাহার? শুনলি তো ওর কথা? ওর তো দেখি প্রেম উথলে উঠতেছে ওই মাইয়ার জন্য।’

– ‘ওর জন্য পাত্রী দেখো আম্মু, বিয়ে করিয়ে দাও। তুমি একা আর কতদিন সংসার সামলাবে।’

– ‘একদম ঠিক কথা বলেছিস। তাই করতে হবে। আজই তোর বাপকে আমি বলবো, আসুক বাসায় সে।’

আমি হেসে ওদের কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে দোকানে চলে এলাম। আজ আর নূপুরদের বাড়ির দিকে গেলাম না। কিন্তু রাতে দোকান থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানায় এসে নূপুরকে মেসেজ দিয়ে বসলাম। দুইটা চিহ্ন দেখালেও সে রিপ্লাই দিল না। আমি ওর পেইজে গেলাম। স্ক্রল করছি আর ওর অপেক্ষায় আছি। রিপ্লাই দেয় না কেন? কেন এখনও নূপুর আমাকে এড়িয়ে চলছে? আমি ব্যবসা করি, টাকাও ভালো আয় করি। সে বিবাহিত, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার দূর্বলতা আছে। তবুও নূপুর কেন আমাকে এড়িয়ে চলবে? আমি বুঝতে পারি না। আমি জানি না মেয়েরা কীরকম ছেলে পছন্দ করে। কীভাবে মেয়েদের পটাতে হয়। কিন্তু আমার ভালোবাসা কী নূপুর বুঝবে না? এটা ঠিক যে ওর ডিভোর্স না হলে আমি অপেক্ষা করে থাকতাম না, পরিবারের পছন্দমতো বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েই তো আমি ওকে ইঙ্গিত দিয়েছি। আর কী করার আছে আমার? আমি ওর বই নিয়ে তোলা সেল্ফি প্রফাইলে দিলাম। ক্যাপশনে ওকে খুশি করার জন্য কতকিছু লিখলাম। এলাকার গর্ব, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কতকি। কবিতাগুলোও টাইমলাইনে শেয়ার দিতে শুরু করলাম। ওর রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করলাম রাত একটা অবধি। সিনই করছে না দেখে ওর একটা কবিতার লিঙ্ক দিয়ে বললাম, ‘এটা অনেক সুন্দর পাঠ করেছিস। বারবার শুনতে মন চায়।’

ইউটিউবে গিয়ে খুঁজে খুঁজে ভালো ভালো কবিতার চ্যানেল থেকে কবিতা পাঠিয়ে বললাম এগুলোতে আমি রোজ কবিতা শুনি। ওর কোনো রিপ্লাই এলো না। আমার রাগ, অভিমান সবই হলো। ওর কী বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার প্রতি? কেন নেই? না-কি আরও সময় প্রয়োজন। এটাই বোধহয়। আমি স্থির করলাম মাস পাঁচেক পর সরাসরি ওকে বলবো বিয়ে করতে চাই কিংবা আমার পরিবারকে দিয়ে আবার প্রস্তাব দেবো। এতদিন আমি ওর সকল উপেক্ষা সহ্য করে নেব।
তিনদিন ওর রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করে চারদিনের দিন সন্ধ্যায় ওদের বাসায় গেলাম। আন্টি এবারও আমাকে স্নেহের সহিত গ্রহণ করলেন। আমি সোজা নূপুরের রুমে গিয়ে নক করলাম। ও টেবিলে বসে ল্যাপটপে টাইপ করছে। আমাকে বসিয়ে রেখে আন্টি চলে গেলেন।
কী মিষ্টি এক ঘ্রাণ ওর রুমে। ও চুলগুলো কানে গুঁজে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিরে, কি অবস্থা।’

– ‘এইতো ভালোইই, কয়েকদিন আসিনি, ভাবলাম দেখে যাই তোকে।’

– ‘ওহ।’

– ‘আমি তো এখন রোজ তোর কবিতা শুনি, পড়ি। খুব ভালো লাগে।’

সে মিষ্টি হেসে ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে বললো, ‘ধন্যবাদ।’

আমার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ওর জন্য শাড়ি এনেছি৷ দেবার সাহস হচ্ছে না কিন্তু যুক্তি আছে। গত দুইদিন আগে ওর পেইজ থেকে আরও অনেক লেখক-লেখিকাদের পেয়েছি। একজনের পোস্ট দেখলাম তাকে একজন ভক্ত পাঞ্জাবি গিফট করেছে। তখনই মাথায় এলো ওকে তাহলে এভাবে গিফট করলে গ্রহণ করতে পারে। তবুও আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আমি অস্বস্তি কাটিয়ে চেয়ার থেকে উঠে ওর টেবিলের কাছে গিয়ে বললাম, ‘তোর জন্য একটা শাড়ি এনেছি।’

সে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে বললো, ‘তা কেন নিষাদ? আমি তো এই শাড়ি নেব না।’

– ‘কেন নিবি না?’

– ‘তোর কাছ থেকে কেন আমি শাড়ি নেব? তাছাড়া এমন না যে আমার জন্মদিনে তোকে দাওয়াত দিলাম, তুই শাড়ি গিফট দিচ্ছিস।’

আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম, ‘তুই একজন লেখিকা, তোকে ভক্তরা তো গিফট করতে পারে তাই না? আমি তো তোর বই পড়ি, কবিতা শুনি। ভালো লাগে। আমি কী প্রিয় লেখিকাকে গিফট দিতে পারি না।’

– ‘না না তোর থেকে শাড়ি নেব না।’

‘তুই নে শাড়িটা, আমি তো কাউকে বলতেও যাচ্ছি না’ বলে আমি শাড়িটা বের করে ওর টেবিলে রাখলাম৷ জাম কালার জামদানি শাড়ি। ও তাকিয়ে হাতে নিয়ে বললো ‘বাহ অনেক সুন্দর তো শাড়িটা, তবুও রাখতে পারবো না।’

আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে শাড়িটা কাগজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বললাম, ‘তুই অনেক শক্ত মেয়ে নূপুর, তুই মানুষকে খুব সহজে না করে দিতে পারিস।’

ও আমার দিকে তাকালো। তাকিয়ে কী ভেবে নিয়ে ক্ষীণ সময় পর বললো, ‘আচ্ছা রাখ টেবিলে শাড়ি, কাউকে বলিস না কিন্তু। কবিতার ভক্ত বলে গিফট দিলাম এসব কেউ বিশ্বাস করবে না।’

‘না না আমি বলতে যাব কেন’ বলে শাড়িটি রেখে এসে চেয়ারে বসলাম। ও টাইপ করতে করতেই আমাকে বললো, ‘তুই আমার তিনদিনের বড়ো তাই না?’

– ‘হ্যাঁ, ছোটবেলায় চাচি আর আম্মু বলতো আমি হয়েছিলাম শুক্রবার ভোরে, তুই হয়েছিলে সোমবার সন্ধ্যায়।’

‘অথচ তোকে আমার ছোট মনে হয় এখন’ বলে স্মিত হাসলো নূপুর। আমি যুক্ত করে বললাম, ‘মেয়েদের এরকমই হয়, কিন্তু আমার বয়স সাতাশ, সেটা তো দেখেও বুঝা যায় তাই না?’

– ‘হ্যাঁ তা বুঝা যায়।’

ওর সহজ কথাবার্তায় আমিও কিছুটা সহজ হলাম। ওর সামনে আসলে নিজেকে আমার ভীষণ তুচ্ছ লাগে। ওর চেহারা, চালচলন সবকিছুতে কেমন আভিজাত্য ভাব আছে। পরিবেশ খানিকটা সহজ হওয়ায় আমি বললাম, ‘তোকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছি, দেখিসনি কেন?’

ও ল্যাপটপে চোখ রেখেই বললো, ‘ব্যস্ততারে অনেক, বইমেলাও সামনে, লিখতে হচ্ছে।’

– ‘ও আচ্ছা, তোকে অনেক ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্ক পাঠিয়েছি। আমি সব সময় এগুলোতে কবিতা শুনি।’

– ‘দেখবো আমি।’

ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর শুরু হয়ে গেছে। চলে গেলেই খুশি হবে যেন। তবুও আমি বললাম, ‘তুই সারাদিন বাসায় থাকিস, এভাবে তুই তো অসুস্থ হয়ে যাবি।’

– ‘কি আর করবো বল।’

– ‘তুই বললে আমি লুডু আনতে পারি, দু’জন মাঝে মাঝে খেললাম।’

ও হেসে বললো, ‘সেটা ভালো বলেছিস, তবে আমরা কি সেই আগের বয়সে আছি? লোকে কী বলবে?’

– ‘লোকে কী দেখবে না-কি? তাছাড়া বলাবলির কিছু নেই। আন্টি তো কিছু বলছে না।’

– ‘আসলে ঠিকই বলেছিস, খেললে তো ভালোই লাগতো। আনিস লুডু, আম্মুও খেলবে’ তারপর হেসে বললো, ‘কিন্তু তুই ব্যাটা মানুষ, এসব খেলা কি আর তোর ভালো লাগবে?’

আমার ইচ্ছা করছে বলতে তোর সাথে খেললে তো ভালো লাগবেই নূপুর। তুই খেলবি, মাঝেমধ্যে কপালে আসা চুল কানে গুঁজবি। আচমকা হাসবি। এগুলো দেখলেই তো আমার ভালো লাগবে। তোর কাছাকাছি থাকাই তো আমার জন্য পৃথিবীর সব খেলা থেকেও বেশি আনন্দের। এতকিছু আমি বলতে পারলাম না। আমি বাকপটু মানুষও না। হেসে কেবল বললাম, ‘ভালো তো লাগবেই, তাছাড়া তুই লেখিকা মানুষ, তার সাথে খেলাও তো ভাগ্যের ব্যাপার।’

সে মুচকি হাসলো আমার কথা শুনে। এভাবে সব সময় কথা বলতে পারলে ভালো হতো। ওকে হাসাতে পারতাম। আমার সেন্স অফ হিউমারও কম। মানুষকে হাসানোর ক্ষমতাটাও আমার কম। চাচি চা নিয়ে এলেন। আমি চা হাতে নিয়ে বললাম, ‘প্রতিদিন এসে চা খাই, নিজেকে মেহমান মেহমান লাগে, কাল থেকে বিস্কিট নিয়ে আসতে হবে।’

চাচি নূপুরকে চায়ের কাপ দিয়ে বললেন, ‘কি যে বলো বাবা, তুমি কি আর আগের সেই বাচ্চা ছেলে নাকি যে এলে চাও দেবো না।’

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চাচি, কাল আমি লুডু নিয়ে আসব। নূপুর একা একা সারাদিন বাসায় থাকে। আপনি আর সে খেলতে পারবেন। আমিও মাঝে মাঝে খেললাম আপনাদের সাথে।’

তিনি হেসে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে চলে গেলেন চাচাকে চা দিতে। নূপুর চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা আমার নতুন পান্ডুলিপি থেকে তোকে কবিতা শুনাই। বলিস কেমন হয়েছে।’

ওর প্রস্তাবে আমি ভীষণ খুশি হলাম। আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে আমার নূপুর। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিজ্ঞের মতো বললাম, ‘হ্যাঁ তা ভালো হবে, এরকম করলে বুঝতে পারবি কেমন হচ্ছে তোর লেখা। তুই পড় আমি শুনি।’

ও চায়ে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা কবিতা এনে একটু দেখে আমার দিকে তাকিয়ে পাঠ করতে শুরু করলো। আমি কবিতা শোনার সুযোগে বুঁদ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর গোলাপি ঠোঁট নড়ছে, মাঝে মাঝে চুল কপাল থেকে সরাচ্ছে। আমি ওর চোখ দেখছি, গাল দেখছি, ফরসা গলা দেখছি। কবিতার কিছুই মাথায় ঢুকছে৷ কবিতা বুঝার মতো উঁচু শ্রেণির মানুষ আমি না। আমি নিতান্তই একজন কাপড় ব্যবসায়ী। আমার বিশেষত্ব কেবল নূপুরের মতো মেয়েকে ভালোবাসি। ওর কবিতা শেষ হওয়ার পর আমি অনেক প্রশংসা করলাম। সবই আসলে কবিতার নামে ওর সৌন্দর্যের প্রশংসা। আমার ভীষণ শান্তি লাগছে সরাসরি এমন প্রশংসা করতে পেরে।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম