আমার হয়ে যা_পর্ব-৪
.
নূপুরদের বাড়ি থেকে আমি বাইক নিয়ে সোজা দোকানে চলে যাই। এগারোটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরি।
আমার ভেতরে আজকাল একধরনের কিশোর কিশোর ভাব চলে এসেছে৷ নতুন প্রেমে পড়ার মতো ভেতরে কেমন চঞ্চলতা অনুভব করি। রাতে খাবার শেষে বাতি বন্ধ করে শুয়ে থেকে ওর কথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। মাঝে মাঝে কল্পনা করি আমার পাশেই শুয়ে আছে নূপুর, ওকে ভেবে তখন পাশ ফিরে শক্ত করে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি। নাক-মুখ চেপে ধরে বালিশে উষ্ণ শ্বাস ছাড়ি। পলকেই গা কাটা দিয়ে উঠে আমার। সারাক্ষণ ইচ্ছা করে ওদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি, ওকে সামনে থেকে দেখি, গল্প করি। কিন্তু সে বরাবরের মতোই দূরত্ব বজায় রাখে। আজও আমি ওর কথা ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে যাই৷ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়লো আজ সন্ধ্যায় লুডু নিয়ে যাব, ওর পাশে বসে খেলবো। ভাবতেই মনটা কেমন চনমনে হয়ে উঠলো। নাশতা-টাশতা করে দোকানে চলে গেলাম।
ঠিক সন্ধ্যায় আমি একটা দোকানে গিয়ে বড়ো দেখে লুডু নিলাম। নুডুলস, ড্রিংকস আর বিস্কিটও নিলাম। ওরা কিছু বললে বলবো খেলবো যেহেতু আড্ডা দিতে দিতে খেতে হবে তো না-কি- তাই এগুলো আনলাম। একটা ব্যাপার হঠাৎ মাথায় এলো, খেলতে বসলে একদম নূপুরের কাছাকাছি বসা হবে। পারফিউম দেয়া দরকার। সোজা ওদের বাড়িতে যাব তাই একটা পকেট পারফিউম নিয়ে গায়ে দিলাম। তারপর সেটা পকেটে পুরে, সবকিছু নিয়ে বাইকে উঠে টান দিলাম। ওদের উঠোনে একপাশে বাইক রাখলাম, যেখানে রাখলে বাইরে থেকে সহজে কারও চোখে পড়বে না। তারপর দরজায় গিয়ে নক করলাম। আজ খুলে দিল স্বয়ং নূপুরই। আমার যে কী ভীষণ ভালো লাগলো ব্যাপারটা। নূপুর দরজা খুলে দিচ্ছে আমি ভেতরে যাচ্ছি, কী মিষ্টি একটা দৃশ্য। ও সরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ও তুই, আমি ভেবেছি আব্বু এসেছে।’
– ‘কেন আমি জানলে বুঝি না খুলে বাইরেই রেখে দিতি?’
সে লাজুক হেসে বললো, ‘ধ্যাৎ কি যে বলিস তুই, আয় ভেতরে আয়।’
আমি ভেতরে গেলাম। সে দরজা ভেজিয়ে নিল। চাচি কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ও নিষাদ বাবা এসেছে।’
‘হ্যাঁ চাচি, আজ লুডু নিয়ে এসেছি’ বলে লুডু হাতে রেখে আমি বিস্কিটের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘এগুলো নিন চাচি।’
‘কী এটা’ বলে চাচি ব্যাগ নিয়ে দেখে বললেন ‘এসব কি বাবা, এইটা তুমি কি করলে? আমাদের বাড়িতে আসতে তুমি নুডলস, বিস্কিট, ড্রিংকস আনতে হবে না-কি? তুমি কি মেহমান না-কি।’
চাচি ভদ্রতা করে বললেও নূপুর মুখ কালো করে রূঢ় গলায় বললো, ‘বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তোর’ বলে সে হনহন করে রুমে চলে গেল। আমি চাচিকে রেখে ব্যস্ত হয়ে ওর রুমের দিকে গিয়ে বললাম, ‘রাগ করছিস কেন নূপুর।’
সে কোনো জবাব না দিয়ে বিছানায় বসে রইল। তারপর ক্ষীণ সময় পর উঠে এসে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে নিয়ে নিচু গলায় বললো, ‘তুই কোনোকিছুর স্বপ্ন দেখা শুরু করলে ভুল করবি নিষাদ, আমি আর এসবে জড়াবো না। আমি চাই না পরে তোর মন ভাঙুক।’
ওর সরাসরি এমন কথায় আমি ভীষণ অবাক হলান। আমাকে যেন ও চপেটাঘা*ত করে সাবধান করে দিচ্ছে। তবুও আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আরে কি বুঝাতে চাচ্ছিস তুই, এসব কিছু না। তোর লেখা-টেখা পড়ে আরকি ভালো লাগে। এজন্যই আসি আর কিছু না’ কথাটি নিজের কাছেই খোঁ*ড়া যুক্তি মনে হলো আমার। নূপুর ক্ষীণ সময় তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুইই জানিস তোর মনের খবর। তবে আরেকটা কথা বলি রাখি তোকে, বুঝিসই তো মা-বাবার মন, আমার আম্মু চায় আবার যেন পাঁচ-ছয় মাসের ভেতরে বিয়ে করে নিই। ওদের প্রশ্রয় বা কথাবার্তা থেকে ভাবিস না আমিও বিয়ে বসবো এখন। আমার আসলে এগুলোর আর ইচ্ছা নেই।’
আমি আ*ঘাত পেলেও আশা ছাড়ি না। মানুষের মন পালটে, সিদ্ধান্ত পালটে। চার-পাঁচ মাস আমি এভাবে লেগে থাকলে নূপুরের মনও পালটে যাবে না তার গ্যারান্টি কী? আমি হেসে বললাম, ‘ধ্যাৎ এগুলো কী বলছিস, আজেবাজে কথাবার্তা।’
‘আমার ভাই সোজাসাপটা কথা। তোকে আগেই বলে দিলাম। এখন আমার সাথে খেলো, সারাদিন এসে আড্ডা দাও তাতে লোকে খারাপ কথা বললেও আমি পাত্তা দেবো না৷ শুধু পরে তুমি না বললেই হলো, আমি কোনো আশা দিয়েছি।’
ওর কথাবার্তায় আমার খানিক অপমানবোধ হলো। ভাবলাম ওকে একটু আঘাত করি। দেখি ওর ভেতরে কোনো দূর্বলতা আছে কি-না। আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘তুই নিজেকে কী ভাবিস বলতো নূপুর, আগে না হয় আমি তোর পাগল ছিলাম। তাই বলে এখনও থাকবো কীভাবে ভাবলি?’
সে হেসে বললো, ‘এটা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। তুই কেন আমার মতো ডিভোর্সি মেয়ের পেছনে ঘুরতে যাবি। এটার কোনো যুক্তি নেই’ তারপর ইয়ার্কির সুরে বললো, ‘আমরা কচি মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো তোকে।’
বুঝলাম ও নিজের বিচ্ছেদকে দূর্বলতার চোখেই দেখছে।
তবুও এই বিরক্তিকর আলাপ এড়াতে আমি বললাম, ‘বাদ দে এসব, লুডু খেলি চল।’
সে সম্মত হয়ে লুডু হাতে নিয়ে বিছানার মাঝখানে বিছিয়ে বললো ‘আয় বস।’
আমি গিয়ে বসলাম। সে ছক্কা গুটতে গুটতে বললো, ‘আসলে এখানে এসেছি দুই মাস হয়ে গেছে। আব্বু-আম্মু বলে লোকে এটা-ওটা বলে। প্রশ্ন করে। এসব শুনে আমিই বের হই না, কারও সাথে মিশি না। তুই লুডু খেলার কথা বলায় তাই না করিনি। আমারও আড্ডা দিতে, গল্প-টল্প করতে ভালোই তো লাগে। কিন্তু ওই এক দ্বিধা, এজন্য আজ ক্লিয়ার বলে দিলাম তোকে৷ তুই মনে হয় রাগ করেছিস তাই না?’
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর কণ্ঠ অনেক কোমল মনে হলো। আমি অভয় দিয়ে বললাম, ‘আমি রাগও করিনি আর তোর দ্বিধারও কিছু নেই। তুই মন খুলে আমার সাথে আড্ডা দে, গল্প কর।’
সে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হলো। ছক্কা গুটে মারতেই ওর শুরুতেই ছয় উঠে গেল ওর। সে সবুজ গুটি নিয়ে হেসে ‘তুই লাল নে। লাল কুফা আছে’ বলে আমার ঘরে লালগুলো ঠেলে দিল। আমি প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়ে ওর আঙুলগুলো দেখছি। কী সুন্দর আঙুলগুলো, ফরসা সুগঠিত আঙুল, নখগুলো ঈষৎ লম্বা। আমি এনে ছক্কা গুটে মারলাম, চার উঠলো। দু’জন আরও তিনবার গুটে কারও ছয় উঠলো না। সে একটা গুটিকে ঘোরাচ্ছে। ছয়বারের সময় পুনরায় ওর ছয় উঠলো, সাথে সাথে হেসে উঠে বললো, ‘তোর আর গুটি তোলা লাগবে না আজ, আমি একাই ঘুরিয়ে আনবো।’
আমিও হাসিতে সঙ্গ দিয়ে বললাম, ‘বুঝলাম না, সত্যিই লাল কুফা না-কি। তুই লাল নিয়ে নে।’
সে ভীষণ মজা পাচ্ছে মনে হলো। কিশোরীদের মতো বললো,
– ‘নাচতে না পারলে উঠান বাঁকা বলতে একটা কথা আছে না। তুই এখন লাল গুটিরই দো*ষ দিবি।’
আমিও ওকে আনন্দ দিতে তর্কে লিপ্ত হয়ে বললাম, ‘তুই তো সবদিকেই কথা বলিস। নিজেই লাল গুটি কুফা বলে আমাকে দিলি। এখন আমি বলতেই পল্টি মারলি।’
ওর আবার ছয় উঠে গেল৷ আনন্দে ওর চোখ-মুখ ঝলমল করছে। হেসে বললো, ‘এই হেরে গেলে আবার বলিস না লাল গুটির জন্য হেরেছি।’
হাসলে মানুষের মুখে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় বলে কি-না কে জানে, আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখ খানিক রক্তাভ হয়ে গেছে।
আমি ছক্কা গুটে মারতেই এখন ছয় উঠলো আমার। ওর গুটি আমার তিনের ঘরে আছে। ‘এখন কোথায় যাবি?’ বলে আমি ফিচেল হাসি দিয়ে গুটি গুটছি। ও মেকি কান্নার ভঙ্গিতে বলছে ‘আল্লাহ আল্লাহ বাঁচাও’। কিন্তু প্রার্থনা কবুল হলো না। আমার তিন উঠে গেল। ও দাঁত কটমট করে কপট রাগ দেখিয়ে বললো ‘কু*ত্তা এতক্ষণে একটা ছয় তুলেই গুটিটা খেয়ে দিছে।’
ওর মুখে গা*লিটাও ভীষণ মিষ্টি লাগে আমার। আমি পুনরায় গুটে মারতেই ছয় উঠলো। তাকিয়ে দেখি ওর মুখ ম্লান হয়ে গেছে। ও খেলায় ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে বুঝা যাচ্ছে। আমি আরেকটা গুটি তুলে বললাম গান ছাড়। গান শুনতে শুনতে খেলি।
‘হ্যাঁ ভালোই বলেছিস’ বলে সে রবীন্দ্র সংগীত ছাড়লো। আমার এসব ধীর গান ভালো লাগে না। তবুও বললাম ‘গানটা অনেক সুন্দর।’ চাচি চা আর নুডলস নিয়ে এলেন।
তিনিও বসলেন বিছানায়। কিন্তু চা আর নুডলস শেষ হতেই ট্রে-তে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। আমার কেন যেন মনে হয় চাচি চান নূপুর আমার সাথে মিশুক, তাতে ওর ভালো লাগা তৈরি হতে পারে। না হলে এত প্রশ্রয় দেয়ার কথা না।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বেচারির সব গুটি আবার ঘরে চলে যাচ্ছে। আমার লাল গুটিগুলো বীরদর্পে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ওর শেষ গুটিটাও ঘরে পাঠিয়ে ইয়ার্কির চোখে তাকিয়ে হাসছি। সে কপালে আসা অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে মুখ ভেংচি কেটে ছক্কা গুটতে শুরু করেছে। মুখ ভেংচি কাটার মুহূর্তে ওকে এত মিষ্টি লেগেছে। আমার ইচ্ছা করছিল ওর থুতনি ধরে মুখ তুলে চুমু দিয়ে দেই। ক্রমশই খেলায় অমনোযোগী হয়ে উঠলাম। ও শেষ অবধি জিতুক এটাও চাচ্ছি। কিন্তু দীর্ঘ লড়াইয়ের পর শেষপর্যন্ত সে হেরে গেল। ও মুখ কালো করে বললো, ‘কাল আসিস, দেখবো কে জিতে।’
‘কাল তুই লাল গুটি নিবি, জিততে পারবি।’
সে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘মজা নিচ্ছিস না? ভাগ্যের জোরে জিতেছিস।’
আমি বিছানা থেকে নেমে বললাম, ‘আচ্ছা আজ না হয় ভাগ্যের জোরে জিতলাম। কাল দেখা যাবে।’
সেও বললো, ‘আচ্ছা আসিস, আজই খেলতাম। কিন্তু আজ একটু কাজ আছে।’
আমি চলে আসার জন্য দরজার কাছে আসতেই মন কেমন খারাপ হয়ে গেল। ওর সঙ্গে একই রুমে ছিলাম। এখন চলে যাব? ভাবতেই খারাপ লাগছে। ফিরে তাকালাম ওর দিকে। ও আয়নার সামনে গিয়ে চুল খোঁপা বাঁধছে। আমার তাকানো দেখে বললো, ‘কিরে, কিছু বলবি?’
– ‘তোকে দূর থেকে যতটা কঠিন লাগে তেমন না।’
– ‘মানে?’
– ‘ভেতরে ভেতরে কেমন কিশোরী রয়ে গেছিস।’
– ‘তাই না-কি, কেন বললি?’
– ‘এত ব্যখ্যা করতে পারবো না।’
– ‘কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিশোরী মানে কী? বাইরে কী বুড়ি লাগে?’
ব্যস্ত হয়ে বললাম ‘মোটেও না, তোকে এখন আগে থেকেও আরও বেশি মায়া লাগে।’
সে ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘মায়া লাগে মানে কী?’
‘মানে এখন আরও বেশি সুন্দর হয়েছিস, সেটাই বুঝাতে চাইছি। আচ্ছা যাই এখন’ বলে আমি বাইরে চলে এলাম। আমার মাথায় ভিন্ন কিছু চলছে এখন। ও যেহেতু সারাদিন বাদায় থেকে বোর হয়। ওকে আমি কয়েকদিনের ভেতরে বেড়াতে যাবার অফার করবো। আন্টি নিশ্চয় যেতে দেবেন। সে একা একা রিকশা নিয়ে চাঁদগাও পার হয়ে গেলে। বাকিটা আমার বাইকে করেও যেতে পারবে, কেউ টেরই পাবে না। আমি হেলমেট পরে নিলাম, সে বোরকা-নিকাব, কেউ আর চিনবেও না। কে জানে নূপুর যাবে কি-না। গেলে ভীষণ ভালো লাগতো।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম