আমার হয়ে যা _পর্ব-৯
.
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে নূপুর আলাদা রিকশা নিয়ে চলে যেতে চাইল। আমার কেন যেন ওকে ছাড়তে মন চাইছে না। আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘চল না, কোথাও গিয়ে বসি, ঘুরি, ঢাকা শহরে তো অনেক কিছুই আছে।’
সে মাছি তাড়ানোর মতো বললো, ‘ধ্যাৎ সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তুই হোটেলে চলে যা। আমি এখান থেকে বাসায় চলে যেতে পারব।’
আর কথা না বাড়িয়ে ওর জন্য রিকশা ডেকে দিলাম। ও রিকশায় উঠে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ‘যাই’ বলে চলে গেল। আমি আরেকটা রিকশা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। রাত দশটার দিকে আকাশ সাহেবের ভাগ্নে খাবার নিয়ে এলো। আমি ওকে আজ ভেতরে এসে বসতে বললে কি ভেবে যেন এসে বসলো। কীসে পড়ে, কী করে এসব জিজ্ঞেস করে বললাম, ‘নূপুর তো তোমাদের বাসায়?’
– ‘হ্যাঁ, আন্টি আমাদের বাসায়ই থাকেন।’
– ‘আন্টি ডাকো না-কি?’
– ‘হ্যাঁ আকাশ মামার ফ্রেন্ড তো তাই।’
– ‘ওরা ফ্রেন্ড হবে কেন? তোমার আকাশ মামা থেকে অনেক ছোট হবে নূপুর।’
– ‘তাও তারা অনেক ক্লোজ এজন্য ফ্রেন্ডই মনে হয়।’
“ক্লোজ” শব্দটা কেমন কানে লাগে আমার। আমি খানিক চুপ থেকে বললাম, ‘বাসার সবার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে?’
– ‘না আমরা খাব পরে।’
– ‘আমার জন্য খেয়েই নিয়ে আসতে পারতে।’
– ‘গ্রামের মানুষ না-কি রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে অভ্যস্ত। আকাশ মামা আর নূপুর আন্টি বাইরে যাওয়ার সময় বলে গেল আপনাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে যেতে।’
আমার কলিজাটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। ওরা এই রাতে বাইরে কেন গেল? কোথায় গেল? আমি যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘ওরা বাইরে গেছে?’
– ‘হ্যাঁ, বাইরে খেয়েও আসবে বলছে।’
– ‘কোথায় গেছে জানো?’
– ‘না তা জানি না, আচ্ছা আমি যাই, বাসায় অপেক্ষা করবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাও।’
ছেলেটি চলে গেল। আমি চুপ করে বসে রইলাম। নূপুরের আকাশ সাহেবের সাথে কি কোনো সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে? হলে আমার কী হবে? আমি তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ দিলাম, ‘কি করছিস নূপুর?’
ও কোনো রিপ্লাই দিল না। দুইটা চিহ্ন দেখাচ্ছে তবে তা সবুজ হচ্ছে না। একবার ভাবলাম কল দেই, আবার মনে হলো দিয়ে কি বলবো? এগুলো ভাবতে ভাবতেই সে রিপ্লাই দিয়ে দিল, ‘কিছু না, তোকে খাবার দিয়ে দিয়েছে?’
– ‘হ্যাঁ, তুই খেয়েছিস?’
– ‘না এইতো খাব। তুই খেয়ে নে।’
আমি আর কিছু বললাম না। নূপুর নিজ থেকে বাইরে আছে সেটা বলতে চাচ্ছে না। আমি খাবার রেখে বিছানায় চুপ করে শুয়ে রইলাম। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেল। বারোটার দিকে খেয়ে বাতি বন্ধ করি। বিছানায় এসে শুয়ে নূপুরের পেইজে গিয়ে একটা কমেন্টে আকাশ সাহেবের আইডি পেয়ে গেলাম। সেদিন সরাসরি দেখায় চিনতে অসুবিধা হয়নি। উনার আইডিতে গিয়ে পোস্টগুলো দেখে আমার শরীর জ্বলতে শুরু করলো। সন্ধ্যায় দু’জন একটা রেস্তোরাঁয় বসে সেল্ফি তুলেছে। গতকালের পোস্টে দেখি সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে গেছে নূপুর, আকাশ সাহেব সহ আরও কয়েকজন। নূপুর এটাও আমাকে বলেনি, কেবল বলেছে রাতে আড্ডা দিয়ে দেরি হয়ে গেছে। ও কেন এসব আঁড়াল রাখলো? পুরো রাত আমার অশান্তিতে কেটে গেল। পরেরদিন ঠিক আড়াইটার দিকে আমাকে মেলায় নিয়ে গেল আমি চুপ করে রইলাম, ওর ছবি তুললাম। স্টলের আশেপাশে থাকলাম। নিজেকে কেমন ভীষণ তুচ্ছ মনে হতে লাগলো আমার। আমি কি তাহলে নূপুরের কাছে কিছুই না? কেবলই পাশের বাড়ির ছেলে হিসাবে কি আমি নিজের ব্যবসা ফেলে ঢাকা চলে এসেছি? ও কি এসব কিছুই বুঝে না? সে কি আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারতো না? এত অবহেলা কেন করে? নিজের এই গোপন কষ্ট নিয়ে আমি আরও দুইদিন ঢাকা থাকলাম। ওর যতটুকু সহযোগিতা দরকার তাই করলাম। মাঝে মাঝে ও জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তোর মন খারাপ না-কি? কি সমস্যা?’
প্রতিবার দক্ষ অভিনেতার মতো মুচকি হেসে বললাম, ‘না কিছু না। আমি ঠিক আছি।’
দুইদিন পর সোমবারে আকাশ সাহেব আমাদের এগিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ডে এলেন। আজও ওরা সিএনজিতে পাশাপাশি বসলো। আমি ম্লানমুখে একপাশে বসে রইলাম। বাসে উঠার আগে আকাশ সাহেব আমার সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন। আজও আমাদের সিট মাঝখানে পড়লো। নূপুর জানালার পাশে বসেছে। আমি ওর পাশে। বাস চলতে শুরু করেছে। ঢাকার বাইরে আসার পর ও হঠাৎ ফোন টিপা বন্ধ রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে কোমল গলায় বললো, ‘কিরে? তুই এত চুপচাপ কেন? লাস্ট দুইদিন থেকে এত মনমরা কেন?’
ও হাত ধরে এত যত্ন করে কথা বলছে দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি ফ্যাকাসে মুখে হেসে বললাম, ‘আরে না তেমন কিছু না, তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না।’
– ‘তোর অনেক কষ্ট হয়েছে আমার সাথে এসে।’
– ‘কীসের কষ্ট, তুই যে কী বলিস।’
তারপর দু’জন আবার চুপ। আমি ভাবছি এবার আর দেরি করা ঠিক হবে না। বাড়িতে গিয়ে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে। নূপুরকে কিছু না বলে ওর চাচা-চাচির সাথেই সরাসরি কথা বলতে হবে। তাতে হয়তো সেও বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। আমি ক্ষীণ সময় পর ইতস্তত করে বললাম, ‘আকাশ সাহেবের সাথে তোর অনেক ভালো সম্পর্ক তাই না?’
ও মাথা তুলে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘আরে তেমন কিছু না, বুঝিসই তো প্রফেশনের জন্য অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয়।’
আমার এই কথাটা এত ভালো লাগলো। সত্যিই তো আমার নূপুর কেবল প্রফেশনের জন্যই আকাশ সাহেবের সাথে মিশছে, আর কিছুই নেই এখানে। এটা বিশ্বাস করে নিতে মন চাচ্ছে। তবুও যেন ভেতরে খচখচানি যায় না আমার। আমি ভেতরের সন্দেহকে প্রশ্রয় না দিয়ে নূপুরকে বললাম, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছিস।’
নূপুর ‘হাই’ তুলে বললো, ‘ঘুম পাচ্ছে, কাল আকাশ সাহেবের অনেক বন্ধু এসেছিল। একজন গান গায়, আরেকজন কবিতা আবৃত্তি করে। এসব আড্ডায় রাত শেষ।’
– ‘তাহলে ঘুমিয়ে যা।’
– ‘সত্যিই ঘুমাচ্ছি। যদি তোর দিকে পড়ে যাই তাহলে লজ্জায় মরে যাবি না। ঘুম থেকেও তুলবি না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমা।’
নূপুর সত্যিই চোখবুজে নিল। আমার ভেতরে অন্যরকম অনুভূতি হতে শুরু করলো। ও আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালে কি যে ভীষণ ভালো লাগতো। ভাবতেই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মিনিট বিশেক পর তাকিয়ে দেখি ও সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু আমার দিকে হেলে পড়ছে না। পড়লে ভালো হতো, নূপুর তো বলেই দিয়েছে আমার দিকে হেলে পড়লে লজ্জা না পেতে। একটু হেলে পড়লে ওকে আমি আরাম করে কাঁধে ঘুমোতে দিতাম। নয়তো বুকের সাথে জড়িয়েই ধরে ফেলতাম। আমি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। কী মায়াবি ঠোঁট, গাল এমনকি হাতও। কয়েক গোছা চুল কপালে চলে এসেছে। উড়ছে সেগুলো। হাত দিয়ে কানে গুঁজে দিতে পারলে ভালো হতো। হঠাৎ আমার মাথায় এলো, ওকে নিজেই জড়িয়ে ধরে নিলে কেমন হয়? সে তো ভাববে হেলে পড়েছিল। আমি বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম, তাতে ওর ঘুমও ভালো হবে। হাতটা ওর পিঠের দিকে নিতে চাইলাম, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। হাত কাঁপে, থেমে যায়, যেন কেউ টেনে আঁটকে রাখে হাত। ক্ষীণ সময় পর ভাবলাম আচ্ছা জড়িয়ে না ধরে অন্তত ওর মাথা নিজের কাঁধে আনি। তাতে একটুও বুঝতে পারবে না ও। আমি কাঁধ বাড়িয়ে রেখে আঙুল দিয়ে মাথায় খানিক ইশারা করতেই কাজ হয়ে গেল। ওর মাথা আমার কাঁধে চলে এলো। নূপুর কাঁপলো খানিকটা। তারপর ঘুমের ঘোরেই আমার হাত জড়িয়ে ধরে আরও নিকটে চলে এলো। আমি বুকভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। আমার পুরো শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। কেমন যেন ভীষণ আদর করতে মন চাচ্ছে। আমি নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ওর মাথায় হাত রাখি। হাত কাঁপে আমার। কিছু সময় পর সাহস আসে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। দীর্ঘ সময় ওর মাথায় বুলিয়ে দিয়ে একবার মনে হয় ওর গালটা একবার ছুঁয়ে দেবো? বাসে কেউ দেখবেও না, দেখলেও সমস্যা নেই। আমি আস্তে-ধীরে কাঁপা কাঁপা হাতটি ওর গালে নিয়ে আসলে, আমার গলা যেন শুকিয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলে আমি ভীষণ মায়া নিয়ে, আদর নিয়ে ওর গালে হাত বুলিয়ে দিলাম। এত মসৃণ গাল, যেন মোমের ওপর হাত রেখেছি আমি। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। গালে হাত রেখেই আমি নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। গালটা চেপে রাখলাম ওর মাথায়। ও খানিকটা যেন ঘুমের ভেতর কাঁপলো। আমি ভয় পেয়ে গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। আচমকা এক ঝাঁকুনিতে ও কাঁধ থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ধরলামও, তবুও ওর ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসলো সে। ‘হাই’ তুলে বললো, ‘বাস থামিয়েছিল?’
– ‘না।’
– ‘যাক তাহলে চা খাওয়া যাবে বিরতিতে।’
– ‘হ্যাঁ।’
বাস থামালো মিনিট ত্রিশেক পর। সবার সাথে আমরাও নেমে গেলাম। চা খেলাম দু’জন। ও চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘মাথা ব্যথা করছে ভীষণ।’
– ‘তা কেন?’
– ‘গাড়িতে ঘুমানোর কারণে বোধহয় ঘাড়ের ব্যথা থেকে এমন হচ্ছে।’
– ‘হ্যাঁ সেটাই হবে, এখানে ফার্মিসিও নেই যে ওষুধ এবে দেবো।’
– ‘না তা লাগবে না। শুধু পলিথিনের ব্যাগ নিতে হবে। বমি আসবে মনে হচ্ছে।’
আমরা চা-নাশতা করে আবার এসে বাসে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। ক্ষীণ সময় পর নূপুর নিজেই ওর কপাল টিপছে দেখে আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘তুই কিছু মনে না করলে আমি মাথা টিপে দেই, দেখবি ভালো লাগবে।’
– ‘না থাক, তোকে দিয়ে মাথা টিপাবো কেমন দেখায়।’
আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আমি নিজেই তো বলছি, খারাপ লাগার কিছু নেই।’ তারপর ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে এক হাত ওর ঘাড়ে রেখে আরেক হাতে কপালে টিপে দিতে থাকলাম। আমার কীযে ভালো লাগছে। ও চোখবুজে আছে। আমি ওর মাথা, কপাল, ভ্রু টিপে দিতে দিতে ঘাড়ও টিপে দিলাম। ওর গা-টা কেমন উষ্ণ। কপালের মতো রুক্ষ স্থানও কেমন কোমল। কিন্তু মিনিট কয়েক পর নূপুর চোখ খুলে বললো পলিথিনের ব্যাগটা দে। আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ বাড়িয়ে দিলাম। ও হাতে নিয়ে ব্যাগে মুখ ঢুকিয়ে বমি করে ফেললো। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। পিঠে তো আর হাত বুলিয়ে দিতে পারি না। ওর বমি শেষ হতেই পানির ছিপি খুলে বোতল বাড়িয়ে দিলাম। ও জল খেয়ে নিয়ে বললো, ‘ব্যাগ কি করবো?’
– ‘পাশে কোনো ড্রেন বা কিছু দেখলে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে অপেক্ষা কর।’
ও অপেক্ষা করে একবার ফেলে দিল ব্যাগটা। মিনিট দশেক পর ধীরে ধীরে ও স্বাভাবিক হতে শুরু করলো।
– ‘এখন ঠিক আছিস নূপুর?’
– ‘হ্যাঁ মাথা ব্যথাটাও চলে গেছে, তোর কি খারাপ লাগছে?’
– ‘না আমার খারাপ লাগবে কেন?’
– ‘কেউ বমি করতে দেখলে তো ঘেন্না লাগে।’
– ‘আমার মোটেও লাগছে না।’
নূপুর আমার দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো ‘কেউ একজন ছিল যে একবার আমাকে গাড়িতে বমি করতে দেখে বলছিল ‘এগুলো কেমন বাজে অভ্যাস, জীবনে কি গাড়ি চড়ো নাই’ আমি তখন নিজেই বমি শেষে বোতল খুলে জল খেয়েছিলাম।’
বুঝতে পারছি ও কার কথা বলেছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না নূপুর। এগুলো ভেবে মন খারাপ করিস না। আর তুই তো গাড়িতে সব সময় বমি করিস না৷ যাওয়ার সময় তো করিসনি।’
– ‘না না সব সময় করি না।’
কথার মাঝখানে ওর ফোন বেজে উঠলো। ও তাকিয়ে বললো আকাশ সাহেব কল দিয়েছেন। আমি মাথা নাড়লাম। নূপুর কথা বলো শুরু করলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। আকাশ সাহেব কিছু বলেছেন, নূপুর সেটা শুনে খিলখিল করে হাসছে। ওর এই মিষ্টি হাসিটা আমার কেমন তিক্ত লাগে।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম