আমার হয়ে যা পর্ব-১১

0
290

আমার হয়ে যা _পর্ব-১১
.
বৃষ্টিতে ভিজে আবার আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। এখনও আমার বুক কাঁপছে। আমি এটা কী করলাম? নূপুরকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে গেলাম কেন? এখন আমার কী হবে? ও কী খুব রাগ করেছে? আমি মাথা-মোথা না মুছেই বিছানায় গিয়ে পড়লাম। নিজেকে শান্ত করে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে একের পর এক মেসেজ দিতে থাকলাম ওকে৷ নিজের কাজটার জন্য হাজাররকম ক্ষমা চাইলাম। ও মেসেজ সিন করে না। খানিক পর কলও দিয়ে বসলাম। ও কেটে দিয়ে ব্লক দিয়ে দিল আমার নাম্বার। আমি মোবাইল রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুয়ে রইলাম৷ আপু রুমে এলো তখন। সে গতকাল এসেছে এখানে। আমাকে বুঝানোর জন্যই আম্মু ওকে এনেছেন এটা আমি বুঝি। আপু বিছানায় বসে বললো, ‘বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় গিয়েছিলি?’

আমি চুপ করে রইলাম। সে পুনরায় বললো, ‘চেহারা-সুরত তো গাঁজাখোরের মতো করে ফেলেছিস। কি পেয়েছিস এই মেয়ের মধ্যে? বিয়াত্তা মেয়ে। তোকে এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখে আমরা বিয়ে করাবো।’

আমি এতক্ষণ পর ওর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললাম, ‘আপু একটা কথা স্পষ্ট জেনে রাখো, আমি নূপুরকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।’

– ‘কেন, ও যে এর আগেরবার তোকে রেখে বিয়ে বসে গিয়েছিল মনে নাই? তখন তো ভালোই ছিলি।’

– ‘এর আগেরবার ও নিজেই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এবার সে বলেছে তোমরা রাজি হলে আমাকে বিয়ে করবে।’

– ‘আমরা রাজি হতে যাব কেন? আগে তো তুই পছন্দ করিস শুনেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা, দেয়নি কেন তখন?’

– ‘আমি বেকার ছিলাম তাই।’

– ‘তো বেকার থাকলে কি না খেয়ে মরতো? তুই বেকার থাকতে আমরা না খেয়ে ছিলাম না-কি। আসল হলো এখন ডিভোর্স হওয়ায় তোর পিছু নিয়েছে।’

– ‘আম্মুর মতো তুমিও বাজে কথা বলো না আপু। নূপুর এরকম মেয়ে না। ও কখনও আমার পিছু নেয়নি।’

‘তাহলে তুই নিয়েছিস? তোকে কি আল্লাহ বিন্দুমাত্র লাজ-লজ্জা দেয়নি? বিবাহিত একটা মেয়ের পিছু নিয়েছিস? আর এই মেয়ে দুই বছর সংসার করার পরও বাচ্চা-কাচ্চা নেই। ওর তো মনে হয় সমস্যাও আছে।’

আর সহ্য হলো না আমার, আমি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ‘বাচ্চা থাকলে তখন আবার বলতে বাচ্চার মা’ বলে শার্ট আর বাইকের চাবি নিয়ে আবার বাইরে চলে আসলাম। বাইক নিয়ে চলে গেলাম দোকানে। সারাদিন বাড়িতে সবাই ঘ্যানঘ্যান করে। তাও নূপুরকে নিয়ে যতসব আজেবাজে কথা। এগুলো শুনলে আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। নূপুরের বিয়ে হয়েছিল তাতে কি হয়েছে? সে কি এখন আর নূপুর নেই? অন্য কেউ হয়ে গেছে? ফুল গাছে থাকলেও ফুল, ছিঁড়ে ফেললেও ফুল। পুকুরের পানিও পানি, নদীর পানিও পানি। আমার নূপুর, নূপুরই আছে। আমি দোকানে গিয়ে কাজে মনযোগ দিলাম। সন্ধ্যায় বাজারে নাশতা করে একেবারে রাত এগারোটায় ফিরলাম বাসায়। খাবার টেবিলে গেলে আব্বা বকা-ঝকা শুরু করলেন। নানান লোকে না-কি নানান কথা বলছে। আমি মান-সম্মান সবকিছু খুইয়ে ফেলছি। সবাই মিলে চারদিক থেকে এটা-ওটা বলে যাচ্ছেন। আমার যেন মগজ টগবগ করতে শুরু করেছে। প্লেটে খাবার রেখে উঠে বললাম, ‘মান-ইজ্জত মতো তোমরা তাকে ঘরে তুলে নিলেই তো হয়। তা না করে সারাদিন শুধু প্যানপ্যানানি।’

কথাটি বলে আমি রুমে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেই। ফেইসবুকে গিয়ে দেখি পেইজ থেকে নূপুর অডিও লাইভে এসেছে। আমি ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখবুজে ওর লাইভ শুনতে শুরু করি। এত মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম যে দুই ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল আমি টেরই পাইনি। লাইভ শেষ হতেই মনটা হাহাকার করে উঠলো। মনে হলো যেন এতক্ষণ নূপুর আমার সাথেই ছিল, এভাবে অনন্তকাল থাকলে ভালো হতো। আমি ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। পরদিনও আমি আর ওদের বাড়িতে ভয়ে যাইনি। জড়িয়ে ধরেছি, চুমু খেয়েছি ভাবতে ভালোই লাগে, পাশাপাশি ওর শীতল গলা আর মুখের অভিব্যক্তির কথা মনে পড়লেই কলিজা কেঁপে উঠে আমার।
দুইদিন পর আমাদের বাসার কাজের মেয়ে লতিফাকে আমি ধরলাম। ও এলাকার সকল খবরই রাখে। আমার রুম ঝাড়ু দেয়ার সময় বললাম, ‘কিরে, তুই যে বলেছিলি নূপুরের আকাশ সাহেবের সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আর কিছু জানালি না?’

সে লাজুক হেসে বললো, ‘হ, নূপুর আপা রাজি আছিল না৷ তাও চাচি আর চাচা ওদের দেখে যেতে বলেছিল। কথাবার্তা চলতেছে, আপা মনে হয় রাজি হইলেই বিয়া। আকাশ সাহেবের পরিবার রাজি।’

আমার কলিজা কেউ যেন মুঠোয় নিয়ে মোচড়ে ধরেছে। এখন আমার জীবনটা কেবলই নূপুরের হাতে। বোধহয় ও রাজি না বলেই এখনও বিয়ের পাকা কথা হয়নি। কিন্তু নূপুরের সহযোগিতা ছাড়া চাচা-চাচিই বা কীভাবে আকাশ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলেন? তাছাড়া সেদিনের ঘটনার পর যদি আমাকে ভুল বুঝে, খারাপ ছেলে ভেবে বিয়েতে রাজি হয়ে যায় নূপুর? না, আমি সেদিনের জন্য নূপুরের কাছে মাফ চাইতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, চাচা-চাচি তো আমার কাছে ওকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন, ছিল না উল্টো নূপুর। এখন ওরা কেন নূপুরের অমতেও আকাশ সাহেবের কাছেই বিয়ে দিতে তোড়জোড় করছে? আমি লতিফাকে একশো টাকার নোট দিয়ে বললাম, ‘কিছু খেয়ে নিস।’
সে খুশি হয়ে চলে গেল। আমি রুমে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে নূপুরদের বাড়ির দিকে ছুটলাম। ভোরবেলা ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছি দেখে লোকজন তাকাচ্ছে। সত্যি বলতে পুরো এলাকার মানুষ এসব নিয়ে বহু আগে থেকে কানাঘুঁষা করছে। তাতে আমার কী? কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা আমি নূপুরদের বাড়িতে চলে গেলাম। চাচি বারান্দায় ছিলেন। আমি সেখানে পা রাখতেই তিনি রূঢ় গলায় বলে উঠলেন, ‘এই তুমি কেন আসতেছো? দরকারটা কি তোমার এই বাড়িতে?’

আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। চাচি এভাবে কথা বলছেন কেন? তিনিই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘কি হয়েছে চাচি? আমি ভেতরে আসি? বলো কি হয়েছে হঠাৎ।’

– ‘কি হয়েছে মানে? তোমার জন্য আমার মেয়ের বদনাম লেগেছে। তুমি রোজ রোজ কেন আসো?’

আমি বারান্দায় গিয়ে বললাম, ‘চাচি কেন আসি তুমি তো সবই জানো। তাছাড়া তোমার সাথে তো আমার কথাও হয়েছিল নূপুরকে বিয়ে দেবে।’

– ‘সেসব কথা শেষ, যখন বলেছিলাম তখন তোমার পরিবার মানেনি।’

চাচির এমন রূপ পরিবর্তন দেখে আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। ইতস্তত করে বললাম, ‘চাচি নূপুরের ক্ষতি হোক, বদনাম লাগুক আমি তা চাই না। তবে আজ আমি ওর সাথে দেখা করতেই হবে৷ একটা কাজে এসেছি আমি। তাছাড়া সেও তো আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি হয়েছিল।’

– ‘এসব কথা মুখে আনবে না তুমি। ও কখনও রাজি ছিল না। শেষদিকে তোমার অবস্থা দেখে বলেছিল তোমার পরিবার মানলে রাজি হবে। মানেনি, তাই সব কথা শেষ।’

– ‘চাচি তাই বলে আমি আর আসতে পারবো না কেন?’

– ‘কারণ আমার মেয়ের বদনাম রটুক তা চাই না। আর নূপুর নিজে বলেছে তোমাকে আর বাড়িতে ঢুকতে না দিতে।’

আমার চোখ ছলছল করে উঠে। আমি ধরা গলায় বলি, ‘নূপুর বলেছে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে?’

– ‘হ্যাঁ।’

আমি ক্ষীণ সময় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নূপুর এটা না বললেও সে এখন তো বের হয়ে আমাকে বলছে না ভেতরে যেতে। ও তো সবকিছুই রুম থেকে শুনছে। নিশ্চয় সেদিনের ব্যবহারে ভীষণ রাগ করেছে। আমি পুনরায় বললাম, ‘চাচি ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে, আমি কথা বলেই চলে যাব’ বলে ভেতরের দিকে যেতে পা বাড়াতেই চাচি তেড়ে এসে আমার শার্ট টেনে ধরে বললেন, ‘কি বলেছি কান দিয়ে যায় না তোমার? নূপুর কোনো কথাই তোমার সাথে বলতে চায় না। তুমি বিদায় হও আমার বাড়ি থেকে।’

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। ক্ষীণ সময় পর আস্তে-আস্তে তাদের বারান্দা থেকে নেমে আসি। অবুঝ অভিমানে আমার বুকটা ফেটে যায়, অন্তত নূপুর তো দরজা খুলে ডাকতে পারতো, ও ডাকেনি আমায়।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম