আমার হয়ে যা _পর্ব-১৫
.
নিষাদ দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে গেল। আমি খেয়াল করলাম আমার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে। আলগোছে চোখ মুছে নিয়ে জানালা আর বাতি বন্ধ করে বিছানায় আসলাম। ওর প্রতি আমার ভালো লাগা যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওকে পাওয়ার পথ ততটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেদিন রাতে আম্মু আমার রুমে এসে বললেন, ‘কিরে, তুই তো কিছু বললি না। সুফিয়া এসে বইলা গেল আমরা বাড়ি থেকে যাওয়ার পরই না-কি নিষাদ এসেছিল?’
আমার বুক কেঁপে উঠলো। এলাকার একজন দেখা মানে সবাই জেনে যাওয়া। আমি শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলে বললাম, ‘সুফিয়া আন্টি কোত্থেকে জানলো আর সে এসে তোমাকে এগুলো বলার কি আছে?’
আম্মু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানুষ সবই জানে, তাই খেয়াল করে, তুই সত্যি করে বলতো ও এসেছিল না-কি?’
– ‘হ্যাঁ এসেছিল, আমি বিদায় করে দিয়েছি। বলেছি বাসায় কেউ নেই।’
আম্মু যেন বিশ্বাস করলো না৷ সে সংশয়ের গলায় বললো, ‘কিন্তু ওরা বললো নিষাদ বাসায় ঢুকে না-কি অনেক পরে বাইর হইয়া গেছে। ওরা রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেও গেছিল।’
আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে বললাম, ‘ওদের এত গোয়েন্দাগিরির কি আছে এখানে?’
– ‘বান্দি তুই কি বুঝবি এগুলার? মানুষ তো সারাদিন তোদের নিয়েই আলাপচারিতায় থাকে এখন।’
আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘এরজন্য তো দোষ তোমার৷ তুমি ওকে আসতে দিয়েছিলে, আমিই বরং না করতাম।’
– ‘কুতর্ক করবি না। ওই একটা পাইছিস আমি প্রশ্রয় দিছিলাম। আমি যখন দিছি কিছু হয় নাই। এখন ঝামেলা হইতেই আমি ওরে আর প্রশ্রয় দেই না। ওইদিন নিজেই তাড়িয়ে দিছিলাম। আর আসেও নাই। তাইলে আমরা বাড়ি থেকে যাইতেই আসলো কেন?’
– ‘আমি কি জানি।’
– ‘তুই বিদায় করে দিতি। দুই-তিন ঘণ্টা বাড়িতে কি করলো?’
আমি ক্ষীণ সময় আম্মুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘আমি এত জবাব দিতে পারবো না। তুমি এখন রুম থেকে যাও।’
আম্মু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘তুই কি নতুন কোনো নাটক শুরু করলি না-কি। এইগুলা তোর বাপ শুনলে তো হার্ট আ*ট্যাক করবো। তুই দুই ঘণ্টা ওরে একা বাসায় রাইখা কি করলি? গতরের গরম বাইড়া গেছে না-কি? মহিলাগুলা তো এইসব রা*ষ্ট্র করবো এখন।’
কথাগুলো শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি ক্ষুব্ধ গলায় বললাম,
– ‘তুমি কি রুম থেকে যাবে আম্মু? না-কি আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাব?’
আম্মু সাময়িক সময়ের জন্য গিয়েছিল। কিন্তু সারারাত শুধু এটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করলো। মেজাজ খারাপ তাই সেদিন অডিও লাইভেও যাইনি। ভেবেছিলাম নিষাদকে শুনিয়ে অকারণ তাকে দুশ্চিন্তা দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু ভোরে দেখি আম্মু নিজেই আমাকে শুনিয়ে বলছে, আমি বদমাইশটার মা-বাপের কাছে নালিশ দিতে যাইতেছি। তাদের ছেলেকে তারা আঁটকে রাখুক। আমার মান-সম্মান নষ্ট করবে কেন’ বলে সে চলে গেল।
আমার বুকটা কেঁপ উঠে। এরপর নিষাদকে না পারতে সতর্ক করে দেই।
তবুও ওকে সব বলিনি। ঘটনাটা ব্যাপক ঝামেলায় ফেলেছে আমাকে। আব্বু-আম্মু দু’জনই সারাদিন বকাঝকা করেন। লোকে না-কি সেদিনের ঘটনাকে নিয়ে নানান কথা কাহিনি রটিয়েছে। এখন তারা কোনোভাবে আকাশ সাহেবের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই বাঁচেন। আমি এগুলো সহ্য করতে না পেরে খাবার টেবিলে একদিন আব্বা-আম্মাকে ঠান্ডা মাথায় বললাম, ‘দেখো, আমি বিয়ে করতেই চাইতাম না। নিষাদকে তোমরাই প্রশ্রয় দিয়েছিলে। সে একটা আশা থেকেই আসতো। আমার সঙ্গে ঢাকাও গিয়েছিল। যখন-তখন দরকার পড়লে ছুটে আসতো। কতদিন আমাদের বাজার করেও এনে দিয়েছে ইয়াত্তা নেই। আম্মুর পায়ে পড়েও আমার জন্য কেঁদেছিল। এই অবস্থায় আমি যদি বিয়ে করতেই হয়, তাকে ছাড়া করতে পারি না।
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে আব্বুকে বললেন, ‘দেখেছো তোমার বলদ মাইয়ার কথা? আগে প্রশ্রয় দিছি তো কি হইছে? তখন কি আকাশ সাহেবের মতো পাত্র আছিল?’
– ‘আম্মু তাই বলে একজনকে আশা দিয়ে এভাবে তো আরেকজনকে বিয়ে করা যায় না।’
আব্বু তখন বললেন, ‘কীসের আশা? ওর সঙ্গে বিয়া দিতে রাজি হইছিলাম। তার মা-বাপ মানেনি। এইতো শেষ। আর ওকে নিয়া কথা কি থাকলো?’
আমি স্বরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কিন্তু তুমি আর আম্মু একদিন বলেছিলে, ওর বাবা-মা মানবে না। আমাদের দু’জনকে তোমরা বিয়ে পড়িয়ে দেবে।’
আব্বু রূঢ় গলায় বললেন, ‘বেশি তর্ক করবে না। তখন বলছিলাম তুমি নিজেই মানো নাই। এইগুলা তো শেষ। তাইলে এখন পেছনে পইড়া আছো কেন? আকাশ সাহেবকে বিয়া করতে তোমার আপত্তি কি?’
আমি খাবার রেখেই উঠে গিয়ে বললাম, ‘আমি বিয়েই করবো না আর করলে নিষাদকেই করবো।’
আম্মু পিছু পিছু এসে বললেন, ‘এত নিষাদ নিষাদ করিস, নিষাদের মা-বাপ তো রাজি না। তোর হঠাৎ ওর জন্য এত প্রেম উথলে উঠলো কেন?’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে নিলাম। নিষাদকে এসব ঝামেলা আমি শুনাই না। অকারণ ওকে দুশ্চিন্তায় রাখতে ইচ্ছা করে না আমার। ও তো আট-দশটা ছেলের মতো না। ওকে যখন-যেভাবে বলবো বিয়ে করে নেবে আমায়। অকারণ তাকে দুশ্চিন্তা দিয়ে লাভ কী? বরং উলটো বলবে পালিয়ে বিয়ে করে নিতে। গতকাল আম্মা-আব্বা দু’জনই আমার রুমে এলেন। আম্মু আমাকে বললেন, আকাশ সাহেব আর তার বোন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। আমি রাগান্বিত গলায় বললাম, ‘ওরা কেন এসে থাকবে? ওদের সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক? আমারও তো বইয়ের ব্যাপার ছাড়া যোগাযোগ নেই। অকারণ কেন এসে থাকবে?’
আব্বু তখন বললেন, ‘আমিই চাই আসুক। আকাশ সাহেবের সাথে তুমি কিছু সময় কাটাও, দেখবে ভালো লাগতেছে। তাকে নিয়া এইখান থাইকা কোথাও ঘুরতেও যাইতে পারো।’
– ‘আমার এগুলোর দরকার নেই।’
আম্মু তখন বললেন, ‘শোন নূপুর, তুই নিষাদকে সহ্য করতে পারতি না৷ এখন পারিস, কেন পারিস? কারণ ও এসেছে, মিশেছে, খেলেছে। এইজন্য কইতাছি, আকাশ সাহেবের সাথে মিশলে আস্তে-ধীরে ভালো লাগবো। ওরা আসুক। তুই ভালো ব্যবহার করলেই হইব।’
– ‘তোমাদের যা ইচ্ছা করো, আমি এখনও বলছি আকাশ সাহেবকে বিয়ে করবো না। সারাদিন এসে বসে থাকলেও তাইই বলবো।’
আম্মু তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ‘এসব কথা নিষাদকে নিয়েও বলতি’ বলে ওরা চলে যায় সেদিন।
নিষাদকে আজ এই ঘটনাও বলিনি। এমনও হতে পারে ওরা আসলো না। আগে ওকে না বলাই ভালো। সংসার করতে গিয়ে এগুলো বেশ বুঝেছি, পুরুষ মানুষদের সবকিছু বলতে হয় না। নিষাদ বাড়িতে গিয়ে মেসেজ দিয়েছে। আমি সিন করে ওকে ঘুমিয়ে পড়তে তাগাদা দিলাম।
নিজের মাথা থেকেও সকল জঞ্জাল সরিয়ে পাশ ফিরলাম। আমার পাগলটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ওকে নিয়ে ভাবলে আজকাল মন ভীষণ শান্ত হয়ে যায়। ভীষণ ভালো লাগে। ওকে কেমন পবিত্র মনের পুরুষ মনে হয় আমার কাছে। ওর কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠলাম আম্মুর ডাক শুনে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আটটা বেজে গেছে।
– ‘এই তোকে রাতে আর ডাকি নাই। আজই আসতেছে ওরা।’
আমি ভ্রু-কুঁচকে বললাম, ‘কারা?’
– ‘আকাশ আর তার বোন।’
– ‘হুট করে আজ কেন?’
– ‘হুট কইরা কই। আগেই তো কথা হইছিল। আর আজ আসতেছে ছুটির দিন থাকায়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় বসে রইলাম। আম্মু পুনরায় বললেন, ‘শোন, আকাশকে আবার নিষাদের কথা কিছু বলবি না।’
আমি সুযোগ একটা পেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘তুমি নিজেই বলো এলাকার মানুষ সব জানে। সারাক্ষণ আমাদের নিয়ে আলোচনা করে। আবার আকাশ সাহেব আর তার বোনকে এখানে আনছো। ওরা তো এমনিতেই তখন জেনে যাবে।’
– ‘এলাকার মানুষ ওদের পাইবেই না তেমন। বলবে কীভাবে? আর শোন, আকাশ একটা ক্যারামবোর্ড নিয়ে আসবে। তোরা বাসায় খেলতে পারবি।’
আমি ভ্রু-কুঁচকে বললাম, ‘এটা তো তোমরা না বললে আকাশ সাহেবের মাথায় আসার কথা না।’
– ‘আমি আকাশ সাহেবের বোনকে কথায় কথায় বলেছিলাম একটা ক্যারামবোর্ড আনবো। তাহলে তোমরা আসলে বাসায় খেলতে পারবে। তখন সেইই বললো আপনার তাহলে আনতে হবে না। আমরাই নিয়ে যেতে পারবো।’
আমি কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। আম্মু পিছু থেকে বললো, ‘গোসল করে আইজ একটা শাড়ি পইরা নিস।’
‘তুমিই পরো তোমার মনে যেহেতু আনন্দ লেগেছে’ বলে আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে নাশতা করতে না গিয়ে বিছানায় বসে রইলাম। আম্মু রুমে এনে নাশতা দিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ নাশতা করতে করতে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ও অনেকগুলো মেসেজ দিয়েছে। আমি রিপ্লাই দিলাম সেসবের।
বিকাল তিনটার দিকে আমাদের উঠোনে গাড়ি এসে থামলো। ওরা এসে গেছেন। আকাশ সাহেব আর উনার বোন সাফা আপু গাড়ি থেকে নামলেন। আম্মা-আব্বা উঠানে গিয়ে এগিয়ে আনছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মেহমান এলে তো মোটামুটি একটা ভদ্রতা দেখাতে হয়। সাফা আপু বারান্দায় এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললেন, ‘কেমন আছো তুমি?’
– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু, বাসার সবাই ভালো আছে তো?’
– ‘হ্যাঁ, তুমি গিয়ে সবাইকে পাগল করে এলে। ওরা সারাক্ষণ তোমার কথা বলে।’
আমি লাজুক হাসলাম। আকাশ সাহেব এগিয়ে এলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। ড্রাইভার গাড়ির ওপর থেকে ক্যারামবোর্ড নামিয়ে বারান্দায় এনে দিল। আব্বা-আম্মা তাদের ভেতরে নিয়ে আসলো। আমরা নাশতা এনে দিলাম। দেখলাম ড্রাইভার নাশতা করে বিদায় নিচ্ছে। বুঝতে পারলাম ওরা কয়েকদিন থাকবে৷ তাই ড্রাইভারকে বিদায় করে দিচ্ছে। সাফা আপু আমাকে টেনে কাছে বসালেন।
– ‘তোমার চোখের নিচে কিছুটা কালি পড়ে গেছে। ঘুম কম হয় না-কি?’
‘ওই একটু লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ততার জন্য’ বলে লাজুক হাসলাম আমি। আকাশ সাহেব সোজা সামনে থেকে তাকিয়ে আছেন। আব্বু পাশে বসা। আমার আকাশ সাহেবকে আজকাল বিরক্ত লাগে। উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিয়ে করবো না বলার পরও পিছু ছাড়ছেন না। এখানে বসে দীর্ঘ সময় থাকতে হলো। ভেতরে ভেতরে আমি বিরক্ত হয়ে উঠলেও হেসে হেসে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হচ্ছে। সন্ধ্যায় সবার থেকে কোনোভাবে নিজের রুমে চলে এলাম। আম্মু আকাশ সাহেবকে রুমে নিয়ে এসে বললেন, ‘উনি একা বইসা আছে। তুই গল্প কর, পারলে লুডু খেল।’
আমি একবার ভেবেছিলাম, বলবো মাথা ব্যথা করছে। পরে ভাবলাম থাক, শত হোক বাসার মেহমান। বিছানায় উঠে বসলাম। লুডুর ব্যাপারটা আর না তুলে এটা-ওটা নিয়ে গল্প করলাম। উনি নিজেই একবার বলে ফেললো। চলুন লুডু খেলি না হয় আপনি কবিতা পড়ে শোনান। আমি বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে না পারতে মুচকি হেসে বললাম, ‘আসলে আমার একটু মাথা ব্যথা করছে। আপনি একটু আব্বুর সাথে গিয়ে গল্প করুন।’
‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে সমস্যা নেই’ বলে তিনি চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলেন।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি নিষাদ অনেকগুলো মেসেজ দিয়েছে। জেনে গেছে ওরা এসেছে। আমি রিপ্লাইয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, ওরা এসেছে, তুই চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক আছে, আমিও তোর আছি।’
ওকে রিপ্লাই দিয়ে মোবাইল পাশে রেখে আমি সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুয়েক পর কপালে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি সাফা আপু।
– ‘তোমার না-কি মাথা ব্যথা করছে?’
– ‘হ্যাঁ আপু।’
– ‘আসো, আন্টি খেতে ডাকছেন। খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।’
– ‘আমি খাব না আপু, আপনারা খেয়ে নিন।’
– ‘আরে আসো, মাথা ব্যথা কমে যাবে, আসো।’
আমি না পারতে উঠে তাদের সাথে খেয়ে পুনরায় এসে চুপচাপ ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝ রাতে একবার ঘুম ভাঙলো আমার। তাকিয়ে দেখি সাফা আপু আমার বিছানায় ঘুমে। আমি বাথরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে দেখি রাত তিনটা। ডাটা অন করতেই নিষাদের অনেকগুলো মেসেজ। একটায় বলছে, ‘ওরা আসবে বলিসনি তো আগে।’
আমি মুচকি হেসে মেসেজ দিলাম, ‘এত ভাববি না বলছি না। তাছাড়া ওরা হুট করেই এসেছে। এসব নিয়ে ভাবিস না।’
তারপর মোবাইল রেখে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ভোরে ঘুম ভাঙলেও আমি অকারণ ভান ধরে শুয়ে রইলাম। সাফা আপু উঠে চলে গেছেন। আম্মু এসে নাশতার জন্য ডাকলেন। আমি আস্তে-আস্তে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে গেলাম। আকাশ সাহেব দেখেই বললেন, ‘মাথা ব্যথা কমছে আপনার?’
– ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি আমি।’
সবাই একসাথে বসে নাশতা করলাম। আম্মু নাশতা শেষে বললেন, ‘আকাশ সাহেবের একা একা বাসায় ভালো লাগতেছে না হয়তো। তুই একটু বাইরে নিয়ে আমাদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাইতে তো পারিস।’
আব্বু সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ যা নিয়ে।’
আমি ক্ষীণ সময় কিছু একটা ভেবে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাব।’
দশটার দিকে আকাশ সাহেবকে নিয়ে আমি বের হলাম। আকাশ সাহেব বকবক করছেন। আমি মনে মনে একটা রিকশার অপেক্ষা করছি। আকাশ সাহেবই হঠাৎ বললেন, ‘নিষাদকে তো দেখি না। উনি না আপনার চাচাতো ভাই।’
‘সে তো ব্যস্ত থাকে’ বলে তাকিয়ে দেখি একটা রিকশাও চলে এসেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘চলুন, ওর সাথে দেখা করে আসি।’
– ‘কোথায়?’
রিকশাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে বললাম, ‘চলুন আগে।’
উনি আর বাঁধা না দিয়ে নিচু গলায় রসিকতা করে বললেন, ‘একজন সুন্দরীর সাথে একই রিকশায় যাওয়ার সুযোগ তো আর হাত ছাড়া করা যায় না।’
আমি হাসলাম। দু’জন রিকশায় উঠে বসলাম। নিষাদের দোকানের সামনে এসে নেমেছি। আকাশ সাহেব ভাড়া দিলেন। আমার সঙ্গে টাকা নেই তাই নাও করিনি। নিষাদ আমাদের দেখেই এগিয়ে এলো, ‘আরে নূপুর এখানে কি মনে করে আর আকাশ সাহেব কেমন আছেন।’
ওরা হ্যান্ডশেক করলো। নিষাদ আমাদের দোকানে বসিয়ে কর্মচারীকে চা আনতে বললো। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘নিষাদ এক কাজ করি, আমরা গিয়ে কোনো রেস্তোরাঁয় বসি। এখানে চা লাগবে না।’
সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হয়ে মোবাইল মানিব্যাগ পকেটে পুরে বললো, ‘চল।’
দোকান থেকে বাইরে এসে ওকে আমি বললাম যে রেস্তোরাঁয় আলাদা কেবিন আছে সেখানে যেতে। নিষাদ খানিকদূরে এরকম একটি রেস্তোরাঁয়ই নিয়ে আসলো। আমি আকাশ সাহেবকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে নিষাদের পাশে বসলাম। নিষাদ আমাদের জিজ্ঞেস করলো কি খাব। আকাশ সাহেব কফির কথা বললেন। নিষাদ বেয়ারাকে কফিই আনতে বললো। আমি আর দেরি না করে কোনো ভূমিকায় না গিয়ে বললাম, ‘আকাশ সাহেব, আপনাকে আমি একদিন ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলাম বিয়ে করবো না, তা কি মনে আছে?’
তিনি হকচকিয়ে বললেন, ‘এখানে এসব কেন বলছেন?’
– ‘বলুন বলেছি কি-না।’
– ‘হ্যাঁ তো?’
– ‘তারপরও এরকম করা কি আপনার ঠিক হচ্ছে?’
তিনি ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি কি ভুল কিছু করেছি।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিষাদের হাত ধরে বললাম, ‘এত কথা বলতে চাই না, শুনুন। আমি নিষাদকে ভালোবাসি বলেই আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।’
তিনি অবাক নয়নে তাকিয়ে বললেন, ‘সিরিয়াসলি! আর ইউ কিডিং উইথ মি?’
আমি মুচকি হাসলাম। তারপর উনার সামনেই নিষাদের দিকে ফিরে ওর গালে চুমু খেলাম। আকাশ সাহেব বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছেন। নিষাদ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ওর মুখে লিপস্টিকের দাগ লেগে যাওয়ায় ওড়না দিয়ে মুছে নিজের চেয়ারে ভালোভাবে বসে আকাশ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আই থিংক, এবার সবকিছু আপনার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেছে?’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম