আমার হয়ে যা _ পর্ব-১৬
.
ঘটনার আকস্মিকতায় আকাশ সাহেব বিমূঢ় হয়ে রইলেন। তিনি জবাব দিতে কিছু সময় নিলেন। তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে বললেন, ‘আচ্ছা বুঝতে পারছি।’
বেয়ারা কফি নিয়ে এলো। তিনজন চুপচাপ চুমুক দিচ্ছি। আমিই নীরবতা ভেঙে বললাম, ‘দেখুন আকাশ সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল। আমি নিজেই আপনাকে বারবার না করেছি। তাও আপনি সাফা আপুকে দিয়ে আম্মুর সঙ্গে কথা বলিয়ে আমাকে একধরনের বিপদেই ফেলেছেন..।’
‘আচ্ছা এগুলো পরে বলা যাবে’ বলে আকাশ সাহেব আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমিও আর কিছু বললাম না। কফি শেষ হতেই তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এখন যাই আমরা।’
নিষাদ ভদ্রতা থেকে দোকানে গিয়ে বসতে বললো। আকাশ সাহেব তাড়া দেখালেন। কফির বিল কাউকে দিতে দিলো না নিষাদ। আমরা ওর থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠলাম। আকাশ সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। আমিও চুপচাপ বসা। লোকটা এবার পিছু হটবে কি-না তাই ভাবছি। তাকে যতদূর বুঝেছি স্রেফ রিলেশন আছে বললেই নিজেকে সরিয়ে নেয়ার মানুষ না। এজন্য ইচ্ছা করেই নিষাদকে চুমুটা খেয়েছি। একজন পুরুষ মানুষের সামনে অন্যকাউকে চুমু খেয়ে নিলে তার কি আর বিয়ে করার স্বাদ থাকবে? থাকার তো কথা না। তবুও আকাশ সাহেবকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যথেষ্ট ছ্যাঁচড়া আর লাজ-লজ্জাহীন মানুষ তিনি। আচ্ছা আমার বাড়িতে আসবেন, আমাকে কি একবারও বলা উচিত ছিল না? আমার মাধ্যমেই তো পরিবারের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু না, তিনি আম্মুর সঙ্গেই কথা বলে সোজা চলে এসেছেন। কারণ জানতেন আমি আগ্রহ দেখাবো না। সবচেয়ে বড়ো কথা, আকাশ সাহেব ভালো করেই জানেন আমার সঙ্গে নিষাদের সম্পর্ক আছে। সবকিছু ঘোষণা দিতে হয় না। কিছু বিষয় মানুষ এমনিই বুঝে যায়। রোজ সন্ধ্যায় নিষাদ লুডু খেলতে আসতো৷ তখন তিনি কল দিতেন প্রায়ই। ‘কি করছিলেন’ জিজ্ঞেস করলে আমি নিষাদের সাথে খেলার কথা বলতাম৷ শেষবার যখন তিনি নিজে আমাকে ঢাকা নিতে চলে এসেছিলেন। আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হই, বিরক্ত হই। তবুও চলে যাই। একদিন নাশতার টেবিলে তিনিই ঘুরতে যেতে বললেন। আম্মু আর সাফা আপুই ঠেলে পাঠালেন আমাকে। আমি শাড়ি পরেই বের হলাম। তিনি একটা পার্কের কথা বললেন। আমি চিনলাম না। উনার সঙ্গে রিকশা দিয়ে গেলাম। বারবারই উনার সঙ্গে রিকশায় বসলে আমার অস্বস্তি হতো। মনে হতো ইচ্ছা করেই আকাশ সাহেব চেপে বসেন। কিন্তু তা এতটাই নিখুঁত যে নিজেই আবার ভাবতাম আমারই মাথায় নেগেটিভ চিন্তা। কিন্তু পার্কে গিয়ে স্পষ্ট হলো। তিনি হাঁটতে হাঁটতে আমার হাত ধরে ফেললেন। প্রথমেই আমি ভাবলাম হাত সরিয়ে নেব। আবার ভাবলাম এভাবে লোকটা অপমানবোধ করবে। আমি খানিকক্ষণ সহ্য করে নিলাম। হেঁটে হেঁটে খানিকটা নির্জন জায়গায় তিনি বসতে বললেন, আমি বসলাম। তিনি বাদামওয়ালাকে ডেকে বাদাম নিলেন। বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আমার হাতে দিলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা ভালোই লাগলো। কিন্তু খানিক পর তিনি এক হাত আমার পিঠের দিকে নিয়ে ঠিক কোমরের ওপরে রাখলেন। আস্তে-আস্তে সেই হাত একপাশে নিয়ে আলতো করে পেটে টিপে ধরে বললেন, ‘ওইদিকের গাছগুলো অনেক সুন্দর তাই না। ওখানে ছবি অনেক সুন্দর উঠবে।’
অস্বস্তিতে আমি হুট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি হাত ধরে টেনে বললেন, ‘আরে বসো, কি হলো?’
– ‘ভালো লাগছে না, বাসায় যাব।’
তিনি হাত ধরে টেনে বসিয়ে ফেললেন। আমি পাশে না বসে সামনে বসলাম। তিনি হেসে বললেন এটুকুতে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন। আমরা তো বিয়েই করছি। লোকটার হাসি তখন খুবই বিশ্রী লাগছিল। আমি রূঢ় গলায় বললাম, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করবো না আগেই বলেছিলাম।’
– ‘কেন?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু সময় নিলাম। তারপর বললাম, ‘আসলে আমি বিয়ে করতেই চাই না। আর করলে নিষাদকেই করবো।’
তিনি ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ‘বলেন কি? এই গাঁইয়া ছেলেকে বিয়ে করবেন কেন?’
নিষাদকে এভাবে অপমান করে কথা বলায় সেদিনই আমার ভীষণ গায়ে লেগেছিল। আমি আস্তে-আস্তে বুঝিয়ে বললাম, ‘আমি বিয়ে করবো না। তবে যদি বিয়ে করেই থাকি, তবে ওকেই করবো।’
– ‘এটা কেমন কথা?’
– ‘আসলে ও আমাকে অনেক পছন্দ করে। প্রথম বিয়ের আগেও প্রস্তাব দিয়েছিল। আজও ছেলেটা আমাকে বিয়ে করতে চায়।’
তিনি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি কি বোকা মিস নূপুর। আপনার জন্য অনেকেই তো পাগল থাকতে পারে। তাই বলে তাদের বিয়ে করতে হবে? এই ছেলের সাথে আপনাকে মানাবে? তাছাড়া আপনার বাবা-মা কি জানেন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তাহলে তারা যে আমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি।’
– ‘ওরা নিষাদের কাছে দিতে রাজি না।’
– ‘দেখলেন তো ওরা ঠিক বুঝেছেন।’
আমার এগুলো নিয়ে তখন কথা বলতে আর ইচ্ছা হয়নি। পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে বলি, ‘বাসায় যাব, আমার ভালো লাগছে না।’
এরপর বাসায় চলে আসি। পরদিনই আম্মুকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি।
আজ রাস্তায় বের হয়ে আকাশ সাহেব নিজেই কেন যেন নিষাদের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। সুযোগটা পেয়ে বাজারে নিয়ে আমিও ‘গাঁইয়া’ ছেলেটির সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা বুঝাতে দ্বিধা করলাম না। বাসার সামনে এসে রিকশা থামে। আকাশ সাহেব রিকশা ভাড়া চুকিয়ে দিলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম উনার মুখ এখনও ম্লান হয়ে আছে। দু’জন বাসায় এলাম। আকাশ সাহেব টিভির রুমে বসলেন। আমি রুমে চলে এলাম। এসে বিছানায় শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখি নিষাদ মেসেজ দিয়েছে, ‘তুই আকাশ সাহেবের সামনে এটা করবি ভাবতেই তো পারিনি আমি। এমন করতে গেলি কেন?’
আমি মুচকি হাসলাম। হেসে মেসেজ দিলাম, ‘ইচ্ছা হয়েছে তাই।’
ওর হাতেই বোধহয় ফোন ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ দিল, ‘বুঝেছি কেন।’
– ‘আচ্ছা তুই আমাকে বল তো আকাশ সাহেব কী এরপরও আমাকে বিয়ে করতে চাইতে পারেন?’
– ‘চাওয়ার তো কথা না।’
– ‘কেন, কত মানুষই তো জেনে-বুঝে অন্যের প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নিতে চায়। অনেক মুভিতেও দেখা যায় নায়ক নায়িকা একে অন্যকে ভালোবাসে। কিন্তু তৃতীয় একজন তাদের কাউকে জেনে-বুঝেও পিছু ছাড়ে না।’
– ‘বুঝতে পারছি না আকাশ সাহেব কি করবেন। কিন্তু আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি শোনা আর উনার সামনে চুমু খাওয়ায় তো অনেক ব্যবধান আছে।’
– ‘সেটাই ভরসা, আসলে হয়েছে কী। আকাশ সাহেবকে পিছু ছাড়াতে পারলেই আমাদের পথটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’
– ‘কীভাবে? আমার আব্বা-আম্মা তো এখনও রাজি হচ্ছেন না।’
আমি মুচকি হাসলাম। ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ও একের পর এক মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও কল দেবে না। মানুষটার পরিমিতিবোধ আজকাল অবাক করে আমাকে। দিন দিন ওর সবকিছুই কেমন অদ্ভুতভাবে আমাকে আকৃষ্ট করছে। আম্মু আচমকা রুমে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘এই নূপুর, আকাশ হঠাৎ করে চলে যাইতে চাইছে কেন? বাইরে নিয়ে তুই কিছু বলেছিস না-কি? রাগ-টাগ করলো নাকি?’
আমি চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলেও নিলাম। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘উনি বলেননি কেন যেতে চাচ্ছেন?’
– ‘বলছে ঢাকায় জরুরি কি যেন কাজ পড়ে গেছে।’
– ‘হ্যাঁ আমাকেও সেটা বলেছিলেন। আমি কত করে বললাম আরও কয়দিন থেকে যান।’
আম্মু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুই কিছু বলিসনি তো?’
– ‘আরে না, উনি এমনিই চলে যেতে চাচ্ছেন। উনার একটা কলও এসেছিল।’
আম্মুকে বিভ্রান্ত দেখালো। তিনি চলে গেলেন রুম থেকে। আমি স্মিত হাসলাম। আকাশ সাহেব রাগ করে চলে গেলেও আমার কিছুই করার নেই। আমি কোনো অন্যায় করিনি৷ আমি আসতেও বলিনি। বরং তিনিই আমার জীবনটাকে জটিল করে তুলেছেন। তবুও আমার একটু বুক কাঁপছিল। আমি রুমে পায়চারি করছি অস্থিরতায়। ক্ষীণ সময় পর সাফা আপু এলেন। এসে বললেন, ‘তুমি এখানে, আমাদের তো আজই চলে যেতে হচ্ছে।’
– ‘হঠাৎ করে কেন?’
– ‘আকাশের না-কি কি জরুরি কাজ।’
– ‘আরও দুএকদিন থাকতে পারতেন।’
– ‘তুমি ঢাকা যেও বেড়াতে।’
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি রেডি হওয়ার জন্য বের হয়ে চলে গেলেন। খানিকটা খারাপ লাগছে আমার। যখন ঢাকা গেলাম, সাফা আপু অনেক আদর-যত্ন করেছিলেন। আমি মনখুলে তা করতে পারিনি। করতে পারিনি বিয়ের ব্যাপারটা মাঝখানে ঢুকে পড়ায়। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল বারোটার দিকে। আমি হাসিমুখে বিদায় দিলাম। আকাশ সাহেবকে একবার একা পেয়ে বলেছি মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিতে। উনিও স্বাভাবিক আচরণ করলেন। আম্মু কিছু টের পেলেন বোধহয়। পুরোটা দিন তাকে ভারী ভারী দেখালো। রাতে নিষাদ দোকান থেকে ফিরে খেয়ে-দেয়ে রোজকার মতো কল দিল। আমি সবকিছু তাকে খুলে বললাম। সে রসিকতা করে বললো, ‘বাবা, একটা চুমুর এত পাওয়ার। বেচারার বিয়ের শখ মিটে গেছে।’
আমি খিলখিল করে হাসলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর সঙ্গে। সে একবার বললো, ‘আচ্ছা, আকাশ সাহেব সরে গেলে তাতে কি হবে? আমার পরিবার তো এখনও রাজি না।’
আমি আবার দুষ্টামি করে কল রেখে দিলাম। ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল দশটায়। আম্মু এসে ডেকে তুললেন। আমি উঠে বিছানায় বসলাম। আম্মু সর্বনাশ হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘আকাশের বোন ফোন দিয়ে বিয়ে ক্যান্সেল করে দিয়েছে।’
আমি ভ্রু-কুঁচকে বললাম, ‘যেখানে বিয়ে ঠিকই করা হয়নি সেখানে ক্যান্সেল করার কি আছে?’
– ‘আরে বান্দি, ওরা তো তোকে নিতে পাগল আছিল। আজ ফোন দিয়েছি। সাফা ভালোমন্দ কথা বললো। তারপর বললো তোকে অন্য জায়গায় বিয়া দিয়া দিতে। আকাশ না-কি এখন বিয়ে করবে না।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘ও আচ্ছা মানে! তুই কি করেছিস? না করলে হঠাৎ কি হইল।’
‘আমি কিছু জানি না আম্মু’ বলে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেলাম। এরপর শুনলাম আব্বুও চিল্লাচিল্লি করছেন। আমি কারও সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে নাশতা করে রুমে চলে এলাম।
দুইদিন আব্বা-আম্মা আমার সঙ্গে রাগারাগি করলেন। এক সময় আকাশ সাহেবের দিক থেকে আর কোনো সাড়া না পেয়ে আম্মুর মধ্যে খানিক চেঞ্জ আসতে শুরু করলো। সবকিছু ম্যাজিকের মতো পালটে যেতে শুরু করলো। একদিন রাতে আম্মু আমার রুমে এসে বসলেন। তারপর শীতল গলায় বললেন, ‘আকাশের জন্য নিষাদের সাথে কত খারাপ আচরণ করলাম। সবই তো তোর ভালোর জন্য।’
আমি টেবিলে বসা ছিলাম। কোনো জবাব দিলাম না। আম্মু পুনরায় বললেন, ‘এলাকায় তোকে আর নিষাদকে নিয়ে যেরকম কথাবার্তা রেটেছে। তোকে আর বিয়ে করবে কে? আকাশ ঢাকার আছিল। ভাবলাম এইগুলা জানবে না, খুঁজবেও না।’
আমি ভেতরে ভেতরে হাসছি। যা ভেবেছিলাম তাইই হচ্ছে। আম্মু ক্ষীণ সময় পর বললেন, ‘নিষাদের সাথে তোর কি কথা হয়?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘না কথা হয় না।’
– ‘দেখ কথাবার্তা বল। একটা বিষয় ভাইবা দেখছি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তোর বিয়া নিষাদের সাথে হইলেই ভালো। ঘরের কাছে থাকবি। আমাদের তো আর সন্তানও নাই।’
– ‘এখন কি করবো আমি?’
– ‘ওকে বলে দেখিস আসে কি-না। এলে আমি না হয় বুঝিয়ে বললাম।’
– ‘কি বলবে? নিজেই তার বাড়িতে গিয়ে নালিশ দিয়ে এসেছো।’
– ‘সেটাই বুঝিয়ে বলবো। নানান মানুষ নানান কথা কয়। তাই এগুলো শুনে মাথা ঠিক আছিল না। এদিকে তার মা-বাপও রাজি না। তাই রেগে গিয়ে এগুলো বলছি।’
– ‘দেখো তোমাদের যা ইচ্ছা।’
– ‘তুই ঢং করবি না এখন। আমারে তুই কি বেয়াক্কল ভাবিস? আমি বুঝি না। আকাশ সাহেবকে তুইই কিছু বলিস। এখন ঢং করবি না। নিষাদের সাথে যা করার তাড়াতাড়ি কর। নাটক বন্ধ কর।’
আমি হেসে ফেললাম। আম্মু চেয়ার থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন ‘আবার হাসে, নাটক শুরু করছে আমাদের সাথে।’
আম্মু চলে গেলেন। আমি নিষাদকে কল দিলাম৷ তখন সবে সাড়ে দশটা। সে সবকিছু শুনে অস্থির হয়ে গেল। এখনই দোকান বন্ধ করে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে সে। আমি হাসলাম। হেসে বললাম তোকে অপমান করে আম্মু বাড়ি থেকে বিদায় করে দিল, বাড়িতে গিয়ে নালিশ দিল, তুই কিছুটা ভাব দেখাবি না?
সেও হেসে বললো কিন্তু আমার তো ভাব নিতে মন চাচ্ছে না। তবুও একটা কাজ কর, তুই চাঁচিকে গিয়ে বল, ‘আমার কথায় তো সে আসবে না বলছে। তুমি বলে দেখো।’ তারপর তার সাথে কথা বলে আমি গেলাম।
আমি ওর কথায় সম্মত হয়ে বললাম আজ থাক, আগামীকাল বলবো। তুই কাল আসিস। ও ইতস্তত করে বললো তাহলে আজ জানালা দিয়ে দেখা করি। আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘কাল থেকে রুমেই আসতে পারবি। থাক, আজ দেখা করা লাগবে না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সম্মত হলো।
পরদিন দুপুরে আমি আম্মুকে কিচেনে গিয়ে বললাম,
– ‘নিষাদকে কল দিয়েছিলাম।’
– ‘কি বলেছে?’
– ‘ও বলে এভাবে তোমার কথায় আসবে কীভাবে। চাঁচি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বাড়িতে এসে আব্বা-আম্মার কাছে নিষেধ দিয়ে গেলেন। তাহলে আমি এখন তোর কথায় কীভাবে যাব?’
আম্মু ক্ষীণ সময় ভেবে বললেন, ‘ওর সাথে না হয় আমি কথা বলে বাড়িতে আনলাম। পরে তুই যদি আবার বিয়া করতে না চাস? ওর মা-বাপ তো রাজি না।’
আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘আব্বু আর তুমি রাজি থাকলে যেভাবে বলবে বিয়ে করে নেব।’
আম্মুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তবুও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘কত নাটক করতেছিস ভাবিস না বুঝি না আমি। তোকে আমি পেটে ধরেছি। দে কল লাগিয়ে দে।’
– ‘আব্বু কি রাজি হবে, আবার আনতে হলে তাকে বুঝে-শুনে আনো।’
– ‘রাজি না হইয়া আর উপায় আছে? কল দে।’
আমি কল দিলাম। ওপাশে একবার রিং হতেই নিষাদ রিসিভ করে নিল। ও ‘হ্যালো’ বলতেই আমি বললাম ‘আম্মুর সাথে কথা বল’ বলেই ফোন লাউডে দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম। আম্মু ফোন কানে তুললেন। নিষাদ ওপাশ থেকে সালাম দিল। আম্মু জবাব দিয়ে বললেন, ‘বাবা নিষাদ, তুমি হয়তো রেগে আছো। কিন্তু মা-বাপ হইলে বুঝতা। আমরা কি করবো বলো? একদিকে তোমার মা-বাপ রাজি নাই। নূপুরও রাজি আছিল না। এলাকার মানুষও কত কথা কয়। মাথা কি ঠিক থাকে বাপ?’
নিষাদ ওপাশ থেকে বললো, ‘সমস্যা নেই চাঁচি, বুঝেছি আমি।’
– ‘এখন দেখতাছি নূপুরও রাজি। তাই তোমার চাচা আর আমি অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম তাইলে ওই কথাই থাক। তোমাদের দুইজনকে বিয়ে দিয়ে দেই। তুমি একবার আসো আমাদের বাড়িতে। তোমার চাচার সাথে কথা বলে যাও।’
নিষাদও কিছু জবাব দিচ্ছিল। কথা বলছিল ওরা। আমি সরে চলে আসলাম। বিছানায় শুয়ে রইলাম। আমারও কেমন কিশোরী মেয়েদের মতো অনুভূতি হচ্ছে। লজ্জা পাচ্ছি। আম্মু এসে ফোন রেখে দিয়ে চলে গেলেন।
৭.
রাত দশটার দিকে নিষাদ এসেছে আমি টের পেয়েছি। তবুও বের না হয়ে টেবিল থেকে বিছানায় এসে শুয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ আব্বুর রুমে ওরা কথা বলছে আমি এখান থেকে শুনতে পাচ্ছি। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর নিষাদ আমার রুমে এলো।
– ‘কিরে ডিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে আছিস। শরীর খারাপ?’
– ‘না।’
– ‘বাতি জ্বালাই?’
– ‘ওকে।’
ও বাতি জ্বালিয়ে এসে বিছানায় বসেছে। আমি শুয়ে আছি। তাকে ভীষণ খুশি-খুশি লাগছে। খানিকটা হাঁপানোর মতো আমার এক হাত নিজের কোলে নিয়ে বললো, ‘আর কোনো চিন্তা নেই নূপুর।’
– ‘কি হয়েছে?’
– ‘পরশুদিন আমরা বিয়ে করে নেব।’
– ‘কিরকম?’
– ‘চাচা-চাঁচি সব ঠিক করে রাখবেন। ওরা তোকে কাজি অফিসে নিয়ে যাবে। আমিও সেখানে গিয়ে বিয়ে করে নেব।’
– ‘এরপর?’
– ‘এরপর তো আমি তোদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসবো, যাব।’
– ‘তোর বাড়ির লোক জানলে?’
– ‘ওরা তো জানবেই। সেসব পরে দেখা যাবে।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘তোর বাড়ির লোক মানলে ব্যাপারটা কত সুন্দরভাবে হতো।’
– ‘মন খারাপ করিস না। ওরা মানে না এখন কি করবি? তাও তো আমরা পালিয়ে বিয়ে করছি না৷ চাচা-চাঁচি সাথে আছে।’
– ‘হুম, এখন বাসায় যা।’
ও ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘চলে যাব এভাবে? একদম খালি মুখে?’
– ‘কেন আম্মু চা-নাশতা কিছু দেয়নি?’
– ‘তা দিয়েছে, কিন্তু তোকে একবার জড়িয়ে না ধরে চলে যাব?’
– ‘আমার বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না।’
নিষাদ দরজার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললো, ‘তোর পাশে শুয়ে যাই? তুই বুকে একবার মাথা রাখবি।’
– ‘তুই বেশি অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস তো, বিদায় হ। দুইদিন পরই তো বিয়ে, তখন সব হবে।’
ও আমার হাতে চুমু খেয়ে, কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে চলে গেল। আমি একা একা ভীষণ হাসলাম। কোনো প্রেমিক হয়তো এরকম প্রেমিকার রুমে আসার মতো সুযোগ পায় না। নিষাদ পায়, তবুও ওর কোনো বাড়াবাড়ি নেই। একদিন মাথায় গন্ডগোলের মতো কিছু হয়েছিল বোধহয়, সেদিনই কেবল বাড়াবাড়ি করেছিল।
ও চলে যাবার পর আম্মু রুমে এলেন। আমি বিছানায় শুয়ে থেকেই বিদায় করে দিলাম। বললাম আমার কথা বলতে মন চাচ্ছে না৷ রাতে খেলামও না। অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে আমার। বুকে ওম ওম ভাব। নিজেকে কিশোরী কিশোরী লাগছে। ওকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগছে।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম