#আমার_হায়াতি
পর্ব : ২
লেখিকা : #Nahar_Adrita
প্রথম দিন কলেজে পা রাখা। সকালটা ছিলো একটু বেশিই উত্তেজনায় ভরা। জিসানের সাথে কলেজ গেট পার হচ্ছে হায়াত , হঠাৎই ধাক্কা। চোখ তুলে দেখে—ওই তো তিনি! সেই গম্ভীর চেহারার গেস্ট টিচার, যার প্রেমে অজান্তেই পড়ে গিয়েছিলো ভর্তি হওয়ার দিন হায়াত।
লম্বা-সুঠাম গড়ন, কড়া চোখের চাহনি—যেন চুপচাপ থেকেও অনেক কিছু বলে ফেলেন। কলেজের সবাই তাকে চেনে আদিব স্যার নামে, কিন্তু হায়াতের কাছে তিনি ‘প্রথম দৃষ্টির প্রেম’।
ধাক্কা লাগতেই তিনি একপাশে সরে গিয়ে কড়া চোখে তাকালেন। “বললো,
– তুমি নতুন ?
– হু….
– তুমি সেই না… যার সাথে সেদিনও ধাক্কা লেখেছিলো।
হায়াত কিছুটা লজ্জায় পড়েই উত্তর দিলো,বললো,,
– ন্ না মা্ মানে স্যার আব্ আমি ইচ্ছে করে লাগে নি।
আদিব মুখে অস্ফুটস্বরে ‘চ’ শব্দ করে বললো,
– আচ্ছা যাও।
প্রশ্নগুলো ছোট, কিন্তু গলায় এমন টান যেন বুক কাঁপিয়ে দেয়। হায়াত শুধু মাথা নাড়ালো। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয় না।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জিসান ফিসফিস করে বললো,
– তোর মনে আছে ? ভর্তি হওয়ার দিন যার সাথে ধাক্কা খেয়েছিলি, ওইডাই এই আদিব স্যার!
হায়াত তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে, সবকিছু লক্ষ করছিলো। তার চোখে কিছু ছিলো, যা আদিব তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
————–
কলেজ গেট পাড় হওয়ার সময় দুপুরটা ছিল বেশ গরম। রোদের তাপে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। হায়াত একা একাই হেঁটে আসছিল, হাতে বই আর কাঁধে ব্যাগ।জিসান কোচিং করে বাড়ি যাবে, মেয়ে হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা লাজুক হায়াত, মাথায় আঁচলটা ভালো করে গুঁজে সে সামনে হাঁটছিল।
কিন্তু হঠাৎ…
— এই মেয়েটা তো বেশ সুন্দর না রে ?
—আহা… দেখি তো ওড়নাটা ঠিক কতখানি নরম!
দুজন ছেলে পেছন থেকে হঠাৎ করে হায়াতের ওড়নাটা টেনে ধরলো। ভয় পেয়ে থমকে গেলো হায়াত। চোখে পানি চলে এলো, কিন্তু মুখে কোনো কথা আসছিল না।
ঠিক তখনই…
বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছিলো আদিব স্যার। গম্ভীর চেহারার মানুষ হলেও, আজ কিছুটা হাসি মুখে ছিলেন। কিন্তু সেই হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো হায়াতের দিক তাকিয়ে।
এক ঝটকায় সাইকেলের মতো গতি নিয়ে ছুটে এসেছে আদিব স্যার। বন্ধুদের কেউ কিছু বোঝার আগেই তিনি ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
–
—এই, কি হচ্ছে এখানে? এই বলেই একটা ছেলের নাক বরাবর ঘুষি দিলো আদিব।পাশের ছেলেকে বললো,
— তোমরা কোন ক্লাসে পড়ো ?
— স্যার… মানে… আমরা… দুষ্টামি করছিলাম, মাফ করে দেন…
—এটা দুষ্টামি না, এটা শালীনতা ভঙ্গ, এটা অপরাধ। কলেজের সামনে, শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন আচরণ। থাপ্পড় মেরে মেয়েদেরকে বিরক্ত করার ঝাল মিটিয়ে দেবো, bastard.
ছেলেগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আদিব স্যারের গলা নিচু হলেও দৃঢ়, চোখে আগুন।
র্যাগিংয়ের পুরো ঘটনা শেষ হলে কলেজ মাঠটা আবারও আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। হায়াত চুপচাপ ব্যাগটা ধরে বসে আছে বটগাছের ছায়ায়।চোখের কোনে জল জমে আছে। জিসান দাড়িয়ে হায়াতকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, বললো,
– রিলাক্স হায়াত, এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো, কিছু হই নি তো, তার আগেই স্যার এসে গিয়েছিলো।
– ভা্ ভাইয়া ওরা আব আমার ওড়না টান দিয়েছে। বলেই আবার কান্না করছে হায়াত।
– দাড়া আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসছি। এই বলেই জিসান ওঠে পানি আনতে চলে গেলো।
আদিব ধীরে ধীরে বটগাছটার কাছে আসলো,হায়াতকে এভাবে কাঁদতে দেখে আদিবের ভেতরটা কেমন খচখচ করে উঠলো। হায়াতের মুখটা দেখে মনে হচ্ছিলো কিছু বলতে চাইছে, আবার নিজেকে আটকে রাখছে।
আদিব আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না,পাশে থাকা রাজকে বললো,
– জাস্ট পাঁচ সেকেন্ড, পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আমি পুরো মাঠ খালি চাই। কেউ যেনো এখানে আসার সাহস না পায়।
– আচ্ছা দোস্ত।
আদিব ধীরে কিন্তু রাগী গলায় বলেই ফেললো,
– এই মেয়ে , এত সুন্দর হওয়ার কী দরকার ছিল বলো তো? একবার তাকালেই মানুষ ঝামেলায় পড়ে যায়!
হায়াত চমকে তাকালো আদিবের দিকে।চোখে অবাক ভাব, গাল বেয়ে দুফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।মৃদু গলায় উত্তর দিল হায়াত,,,
– আব আমি কী করবো ? আমি তো এমনি!
আদিব মুখ ফিরিয়ে চোখ গুটিয়ে বললো,
– এই ‘এমনি’ এর জন্যই তো র্যাগিং, ঝামেলা, আর মনের ভেতর অশান্তি সব তোমার আশেপাশেই ঘোরে। তুমি জানো না, তুমি যেভাবে তাকাও, সেটা কারো রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে।
এই কথাটা বলে চুপ করে গেলো আদিব। হঠাৎ আদিবের কি হলো বুঝে উঠতে পারলো না—মনে মনে বললো, আমি কি শুধু রেগে বললাম, নাকি নিজের মনে জমে থাকা কথাটাও বেরিয়ে এলো ?
হায়াত এবার কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইলো আদিবের চোখের দিকে।
সে চোখে মুচকি হাসি ছিল, কিন্তু ভেতরে যেন কিছু অন্যরকম কথা—যা মুখে বলা হয় না, শুধু অনুভবে টের পাওয়া যায়।
আদিব গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ,
– আচ্ছা আমি বুঝি না আমার সাথে কথা বললে তোমার এতো কাঁপাকাঁপি শুরু হয় কেনো।
– আব আমি মা্ মানে…..
– আই সোয়ার হায়াতি, আর একবার কাঁপা-কাঁপি করলে আমি তোমাকে কিছু একটা করে ফেলবো।
আদিবের কথা শুনে হায়াতের মুখ হা হয়ে গেলো। বললো,
– আমি তো হায়াত, হায়াতি না,,,,
– শুনো মেয়ে,,,
– হু
– ভালোবাসবে আমায়, তোমার মতো একটা বাচ্চাকেই আমার প্রয়োজন।
হায়াত পাথর হয়ে গেলো, লাইক সিরিয়াসলি, পরিচয় মাত্র দুইদিন হলো,আর ভালোবাসার প্রস্তাব। মিন মিন করে বললো,
– আমার বাবা মা গ্রামে থাকে,,, তারা এসব জানলে আমাকে আর পড়াবে না স্যার।
– উমমমম আমি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছি না, বিয়ের কথা বলছি। আর তোমার বাবা মাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার।
লজ্জায় মিইয়ে গেলো হায়াত, বসা থেকে দাড়িয়ে পা বাড়াবে ঠিক তখনি আদিব হায়াতের হাত ধরে ফেললো,বললো,
– ভালোবেসে ফেলেছি প্রথাম দিনই,,জীবনের কোনো মেয়েকে এতো কাছে থেকে দেখেছিলাম। ওইদিন যখন ভীতু চোখে আমার দিকে তাকিছিলে তখনই আমার ভীতরে প্রেমের দহন শুরু হয়ে গিয়েছিলো,জান আমি জানি এটা হালাল না এই জন্যই বললাম, চলো বিয়ে করে ফেলি।
– আমি তো ভালোবাসতে জানি না।
– আমি শিখিয়ে দেবো।
বলেই হায়াতকে ছেড়ে দিলো আদিব। হায়াত লজ্জায় দৌড়ে চলে গেলো।আদিব ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
__________________
দুপুর দুটো। রোদের তেজ কমলেও আদিবের চোখে মুখে উত্তেজনার ঝলক। সকাল থেকে বাবাকে কত রকম যুক্তি, অনুরোধ, রাগ-অভিমান—সব মিলিয়ে অবশেষে রাজি করিয়েই ফেলেছে সে।
রাকিব চৌধুরী প্রথমে কিছুতেই মানতে চাইছিলেন না—
— “এখনো তো পড়াশোনা করছে মেয়েটা। তুই চিন্তা কর না, এমন মেয়ের অভাব হবে না তোদের ঘরে?”
কিন্তু আদিব সোজা তাকিয়ে বলেছিল,
— “বাবা, ওই মেয়েটাই আমার ঘুম হারাম করে দিছে। আমি ঠিক জানি, ও-ই আমার সোলমেট। আপনি চান বা না চান, আমি হায়াতকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।”
এই একরোখা ছেলের জেদের কাছে রাকিব চৌধুরী অবশেষে নরম হন।
—
হায়াতের খালার বাসা –সাভার,একতলা বাসা।
দরজায় বেল বাজতেই হায়াত নিজেই খুলতে গেল। ভেবেছিল, খালার কোন বান্ধবী হবে হয়তো। কিন্তু দরজার ওপারে দেখে থমকে গেলো—
আদিব স্যার! আর সাথে একজন ভদ্রলোক, যাকে আগেও একবার কলেজে দেখা গেছে— সম্ভবত আদিবের বাবা।
হায়াত চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো,
— “স্যার? আপনি এখানে?”
আদিব মুচকি হেসে বললো,
— “আজ স্যার না, শুধু আদিব। একটু ভেতরে আসতে পারি?”
হায়াত কিছু বলার আগেই খালা এগিয়ে এলেন। রাকিব চৌধুরী ভদ্রভাবে সালাম দিলেন, আর খালা মাথা নাড়লেন সম্মতিসূচক হাসিতে।
—
ড্রইংরুমে বসে চা, বিস্কুট, কিছুক্ষণের হাসি ঠাট্টা, ছোট্ট আলাপের পর হঠাৎ আদিব দাঁড়িয়ে গেল। তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত এক দৃঢ়তা:
— “আমার কথায় অনেকেই হয়তো অবাক হবে, কিন্তু আমি আজ হায়াতের আঙুলে আংটি পরাতে এসেছি। প্রপোজ নয়, প্রতিজ্ঞা। বিয়ে এখনই নয়, তবে এই মেয়ে এখন থেকে আমার হয়ে গেল।”
হায়াত লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো। হঠাৎ যেন গোটা ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আদিব ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট রিংবক্স বের করলো। তার ভেতরে সাদামাটা, কিন্তু সুন্দর একটা সোনার আংটি।
সে হায়াতের দিকে এগিয়ে গেলো।
— “তোমার সম্মতি ছাড়া কিছুই নয়। আমি জোর করবো না। কিন্তু তুমি যদি চাও… আমি আজ, এখানেই এই চিহ্ন রাখতে চাই…”
হায়াত একবার খালার দিকে তাকালো, তারপর আদিবের চোখে। সেই চোখে ছিল না কোনো দম্ভ, ছিল শুধু ভরসা আর ভালোবাসা।
হায়াত মুখ নামিয়ে একটু মাথা নাড়লো।
আদিব ধীরে ধীরে তার ডান হাতটা ধরলো, আর আঙুলে পরিয়ে দিলো আংটি।
দুপুর দুটো দশ।
একটা নতুন গল্পের শুরু হলো—হঠাৎ করেই, সবার অজান্তে, দুটো হৃদয়ের একান্ত সম্মতিতে।
গল্পের পরের অংশ: “স্বপ্নের সম্মতি”
হায়াতের আঙুলে আংটি পরানোর সেই মুহূর্তটা যেন কিছুক্ষণের জন্য সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল।
আদিবের চোখে তখন শান্ত একটা হাসি।
হায়াত এখনো চুপ, কিন্তু তার মুখে সেই না বলা সম্মতির লাজুক রেখা।
তখনই খালা বললেন,
— “ঠিক আছে, এখন ওর মা-বাবাকেও জানিয়ে নেয়া ভালো। যেন তারা কিছু শুনে হঠাৎ কষ্ট না পায়।”
আদিব নিজের ফোনটা বের করলো।
— “আমি নিজে বলি, খালা। হায়াত কার, সেটা ওর বাবা-মা যেন প্রথমে আমার মুখেই শুনে।”
কল দেয়া হলো। ভিডিও কলে প্রথমে ভেসে উঠলো হায়াতের আম্মুর মুখ, কিছুক্ষণ পর আব্বুর।
হালকা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
— কে তুমি বাবা।
_ আমি আদিব আঙ্কেল।
– তুমি কি হায়াতকে চিনো,আমার হায়াত ঠিক আছে তো।
আদিব হালকা হাসি দিয়ে বলল,
— জি আংকেল, আন্টি… হায়াত একদম ভালো আছে। আসলে আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম… আমি হায়াতকে খুব পছন্দ করি। আজ তাকে আংটি পরিয়েছি, তবে সম্মতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আমি আপনাদের মেয়েকে সারা জীবনের জন্য সম্মান দিয়ে পাশে রাখতে চাই। আপনারা যদি অনুমতি দেন…”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। হঠাৎ হায়াতের মা-র চোখে জল।
— “আমরা তো শুধু চাই আমাদের মেয়ে সুখী হোক, নিরাপদে থাকুক…
আর তুমি যদি এমন করে সামনে এসে দাঁড়াও… তাহলে আপত্তি করার আর কি থাকে?”
হায়াতের বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
— “তুমি সাহস করে নিজের পছন্দ আমাদের সামনে এনেছো, এতে তোমার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। তুমি আমাদের মেয়েকে ভালো রাখো, এতেই আমাদের সম্মতি।”
আদিবের মুখে তৃপ্তির হাসি। পাশেই বসা হায়াত এবার চোখ তুলে তাকালো তার দিকে—ভয় নয়, লজ্জা নয়, ছিল এক চিলতে আত্মবিশ্বাস।আজ থেকে সে আর একা নয়।
চলবে….