আমার হায়াতি পর্ব-০৭

0
5

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ৭
লেখিকা : #Nahar_Adrita

সকাল বেলা। হালকা রোদ্দুর জানালার পর্দা ভেদ করে ঘরে ঢুকছে। হায়াত তখন আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে আদিব এসে হাত দুটো তার কাঁধে রাখে। একটু রহস্যময় হাসি নিয়ে আদিব বলল,

— লাজুকপাখি,একটু বসো তো আমার সামনে।

হায়াত অবাক হয়ে বলল,
— কেন ? কী হয়েছে ?

আদিব মোবাইলটা সামনে ধরে দেখালো—একটা ভিডিও, যেখানে একজন স্বামী খুব যত্ন করে তার স্ত্রীর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে।আদিব বললো,

— আমি কাল রাতে এটা দেখছিলাম… খুব ভালো লেগেছে। ভাবলাম, আমি তো কখনো তোমার হাতে মেহেদি দেইনি। আজকে আমার ইচ্ছে করছে তোমার হাতে নিজে মেহেদি পরাতে।

হায়াত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর একটু হাসে।
— আপনি মেহেদি পরাতে পারেন নাকি ?

— পারবো না তো কী হয়েছে, শিখে নেবো। তুমি শুধু হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দাও।

হায়াত হাত বাড়িয়ে দিল।
আদিব ধীরে ধীরে তার কনুই পর্যন্ত হাতটা নিজের কোলের ওপর রাখে, একটা নতুন টিউব মেহেদি বের করে।আদিব চুপ করে আছে বলে হায়াত বললো,
— কি হলো শুরু করুন।

আদিব হায়াতের দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল। হায়াত সরানোর চেষ্টা করেও পারছে না বলে নিজেও রেসপন্স করলো।মিনিট দশেক পর ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর…..
আদিব সিরিয়াস মুখ করে হায়াতের হাত ধরে বসেছে। নতুন মেহেদির টিউব খুলে সে মনে মনে ভাবে,
– অনলাইনে তো সহজ দেখাচ্ছিল, আমি তো একেবারে আদর্শ বর হবো আজ !

হায়াত হাসতে হাসতে বলে,
– ভালো করে দিন , নাহলে আমি কিন্তু মারবো আপনাকে !
– হুস কথা বললে ডিজাইন পঁচা হয়ে যাবে।

আদিব ফোকাস করে, জোর করে একটা ডিজাইন শুরু করে। কিন্তু কয়েকটা পাতা-ফুল আঁকার পর দেখা গেল, পুরো একটা দাগ কেবল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এক কিম্ভুত আকার ধারণ করেছে।
তার ওপর ভুল করে মেহেদির ঢাকনা চেপে ধরে দেয়, আর সব বেরিয়ে হাত ভাসিয়ে ফেলে।

হায়াত চেয়ে দেখে—একটা হাত পুরো নষ্ট, এলোমেলো রং, কুৎসিত ডিজাইন! সে চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

– কী করেছেন এটা, আমি কার হাতে মেহেদি পড়তে গিয়েছি।

আদিব কেমন শিশু মুখ করে বলল,

– বউ তুমাকে তো না নড়তে বলেছিলাম
– তো।
– আমি খুব চেষ্টা করছিলাম।
– বা’লের চেষ্টা সরুন তো,
– আরে সোনা রাগ করে না।

হায়াত রাগে ফুসতে থাকলো, বললো,,,
– আপনার চেষ্টা থাকুক আপনার হাতেই,আমি আর থাকছি না,
এই বলে সে এক হাতে ওড়না টেনে কাঁধে ফেলে দৌড় দেয় বারান্দার দিকে।

আদিব পেছন পেছন দৌড়ে চেঁচিয়ে বললো,
– এই দাঁড়াও। আমি অন্য হাতে সুন্দর করে দিবো, প্লিজ,হায়াতি।

– আপনি মেহেদি নয়, গজব পড়ান !

হায়াত দৌড়াতে দৌড়াতে বলে।

সারা বাড়ি শুরু হয়,দৌড় প্রতিযোগিতা—আদিব এক হাতে মেহেদির টিউব নিয়ে, আর হায়াত তার খারাপ হয়ে যাওয়া হাত লুকাতে লুকাতে দৌড়াচ্ছে।

অবশেষে হায়াত ধরা পড়ে রান্নাঘরের পাশে।

আদিব তার চোখে চোখ রেখে হেসে বলে,

– চলো এবার ঠিক করে দেই।
– উহু, লাগবে না,,,, আমি এটার পিক তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিবো নে,
– দাও আরেকটু সুন্দর করে দিই..

আদিব থমকে দাঁড়ায়, তাকায় তার দিকে।
তার চোখ দুটো হঠাৎ খুব কোমল হয়ে যায়। সারা সকাল হুলস্থুল কাণ্ডের পরেও হায়াতের মুখে এখনো একটা মিষ্টি জেদি ভাব—যেটা আদিব পাগলের মতো ভালোবাসে।

সে ধীরে হাত বাড়িয়ে হায়াতের এলোমেলো হয়ে যাওয়া ওড়নাটার দিকে। খপ করে ওড়নাটা ধরে ফ্লোরে ফেলে দিলো,হায়াত লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো,আদিব হায়াতের দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল। লাজুকপাখির রেসপন্স না পেয়ে খানিক বিরক্ত হলো আদিব। বললো,
– এই বউ রেসপন্স নেই কেনো।
এরপর হায়াতও ঠোঁটের খেলায়া মেতে গেলো । হায়াতকে কুলে করে সিড়ি দিয়ে নিচে এসে সোফায় বসিয়ে দিলো। হায়াতের মুখে লাজুকতায় ভরপুর৷ আদিব পড়ে থাকা ওড়নাটা দিয়ে হায়াতের হাত দুটো বেধে ফেললো,হায়াত হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
– কি হয়েছে বাঁধছেন কেনো।
– তুমি আমাকে প্রচুর বিরক্ত করো,রোমাঞ্চ করবো যখন তখন এতো ছটফট করলে আর ভালো লাগে বলো।
– তাই বলে এভাবে বেধে রাখবেন।
– হুস কোনো কথা নই।
এই বলেই ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল। হায়াতের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো,আচমকা আদিবের ঠোঁটে কামড় দিলো। আদিব ছিটকে দূরে সরে গেলো,হায়াত দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো। ফ্রিজের পিছনে গিয়ে লুকাতেই আদিব এসে হায়াতের কোমড় ধরলো।

ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে আস্তে করে হায়াতের গলায় রাখলো,ঠান্ডার ছোঁয়া লাগাতে হায়াত স্মিত কেঁপে ওঠে। হালকা ঠোঁট দিয়ে চেপে চেপে খেতে লাগলো আদিব। কোলে নিয়ে আদিব তাকে পুনরায় সোফায় শুইয়ে দিলো,তার বেল্ট এনে হায়াতের পা বাঁধলো, এরপর ওড়না দিয়ে শক্ত করে হাত বেধে নিলো। হায়াত চুপচাপ আদিবের পাগলামি গুলো দেখছে।

ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা দুধ এনে হায়াতের পেটে ঢেলে দিয়ে রসনা দিয়ে লেহন করতে লাগলো। পড়নের শার্ট খুলে ফেললো। হায়াত বাকা হেসে বললো,

– যত যায় করেন না কেনো আজ আমি রেসপন্স করবো না।

– তবে রে পিচ্চি।
এই বলেই হায়াতের ওপর ওঠে বসলো আদিব।

কামিজটা খুলে নিচে ফেলে দিলো।ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল। হায়াতও আস্তে আস্তে রেসপন্স করতে লাগলো। টেবিলের ওপর রাখা পায়েশ টুকু ঢেলে দিলো নাভির ওপর,সযত্নে খেতে লাগলো আদিব। পরম সুখে চুল খামচে ধরলো হায়াত।

ড্রইং রুমে হায়াত আর আদিব একে অপরের চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে কথা বলছিল। হালকা হাসি, মিষ্টি উত্তেজনা… ঠিক তখনই—

টিং টং!

কলিং বেলের আওয়াজে যেন পুরো ঘর থমকে গেল।

আদিব চমকে উঠলো, হায়াত দ্রুত জামাটা পড়ে, ওড়নাটা ঠিক করলো।
আদিব ধীর পায়ে শার্টের বোতাম লাগিয়ে,দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগী মুখের এক নারী।
কপালে ভাঁজ, ঠোঁট শক্ত করে চেপে রেখেছেন।

আদিব মুখে হাসি আনার চেষ্টা করলো,

– মা, তুমি ? এইতো…

তার মায়ের চোখ তখন হায়াতের দিকে।
হায়াত ভদ্রভাবে মাথা নিচু করে সালাম দিলো।

– এইভাবে ? ড্রইং রুমে একা ? আদিব তোমার বোনেরাও তো নেই বাসায়,তাহলে এই মেয়ে এখানে,,,

– মা ও হায়াত, মিসেস আফরা চৌধুরী হায়াত, আমার বিয়ে করা বউ।

মিসেস অরোরা রাগে ফুসতে থাকলো। চোখ দুটো রক্তিম, ঠোঁট কাঁপছে ক্রোধে। গলার স্বরও কাঁপা-কাঁপা, যেন কোনো মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হবেন। তিনি চিৎকার করে বললেন—

– তুমি কী বললে আদিব ? এই মেয়েটা তোমার বউ ? আমাদের কিছু না জানিয়ে, না বলেই বিয়ে করেছো ? এত বড় সাহস,

তিনি হায়াতের দিকে এক ঝলক তাকালেন, তারপর আবার আদিবের দিকে।

– এই মেয়েটাই তাহলে এতদিন ধরে আমাদের ছেলের মাথা ঘুরিয়ে রেখেছিলো।

– মা আমি হায়াতকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি।

মিসেস অরোরা আরও রেগে গিয়ে বললেন—

– ভালোবাসা ? এই বয়সে ভালোবাসা ?মেয়েটার বয়সই বা কতো, হায়াতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি পরিবার নেই? শিক্ষা নেই? আর তুই আদিব, আমি তোকে এত কষ্ট করে মানুষ করলাম, আর তুই এক নিমিষে সব উড়িয়ে দিলি ?

ঘরের ভেতর যেন একটা বিস্ফোরণের পর নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

আদিব এবার এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বললো—

– মা, আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো, রাগও করেছো, কিন্তু আমি হায়াতকে ছাড়তে পারবো না। আমি ওকে বিয়ে করেছি, দায়িত্ব নিয়ে, সম্মানের সঙ্গে। তুমি না মানলে আমি কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো…

এই কথা শুনে মিসেস অরোরা থমকে গেলেন…

হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে । ওর চোখ দুটো ভেজা, ঠোঁট কাঁপছে—কিন্তু কোনো শব্দ নেই। ভয় আর অপমানে গলা যেন শুকিয়ে গেছে। চোখের পানি টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। মাথা নিচু, দুটো হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে ওড়নার কোণা।

মিসেস অরোরা আবার চিৎকার করে উঠলেন—

– এখন তো দেখছি, কান্নার অভিনয়ও শুরু করে দিয়েছে, আদিব, এই মেয়ে একদমই আমাদের ঘরের উপযুক্ত না! তুমি ভুল করেছো !

হায়াত নিজের চোখ মোছার সাহসও পাচ্ছে না। ওর কান্না নিঃশব্দ, কিন্তু বুকের ভেতরে এক একটা ঢেউ উঠছে… যেন নিজেকে খুব ছোট, খুব একা মনে হচ্ছে।

ঠিক তখনই আদিব ধীরে ধীরে হায়াতের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো—

– মা, ওকে আর কিছু বলো না। হায়াত ভয় পেয়েছে। ও কোনো ভুল করেনি। আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, সম্মান দিয়ে। তুমি রাগ করো ঠিক আছে, কিন্তু দয়া করে হায়াতকে দোষ দিও না।

মিসেস অরোরা রাগে ঠোঁট কামড়ে বললেন—

– তোমার বাবা চুপচাপ এই কাজটা করলো, এখন সবাই জানুক! আদিব, ফোন তুলে তোমার বাবা, চাচা, চাচী, যাকে পারো—সবাইকে কল দাও! আজকেই এই বিয়ের বিচার হবে।

আদিব একটু থমকে গেল, কিন্তু হায়াতের কাঁপা মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল—

– ঠিক আছে মা, ডাকছি। আজই সব বলবো।

সে ফোন বের করে একে একে কল দিতে লাগল।

প্রথমে বাবাকে ফোন করল—
– আব্বু, একটু বাসায় আসো… এখনই… মা সব জেনে গেছে…

তারপর চাচাকে—
– চাচ্চু, একটু আসবেন? খুব জরুরি…

আর চাচী, ফুপু— সবাইকে খবর দেওয়া হলো।

বাড়িতে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল।
হায়াত পেছনে সরে গিয়ে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, চোখে জল আটকে রেখেছে যেন কিছু ভেঙে না পড়ে।
মিসেস অরোরা তখনই এক কাজের মেয়েকে বললেন—

– চা বসাও, সবাই আসবে। আজ যদি আমি মুখ বুজে থাকি, তাহলে কাল এরা আমার ছেলেকে নিয়ে নাচবে!

একটু পরেই দরজায় একের পর এক কড়া।
একজন করে ঘরে ঢুকতে লাগল—
চাচা, চাচী, জেঠু, খালাম্মা… সবাই যেন এক নাটকের সাক্ষী হতে এসেছে।

আদিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একহাতে হায়াতের হাত শক্ত করে ধরে আছে।
হায়াত একটু কেঁপে উঠলেও ওর চোখে এখন সাহসের আলো।

মিসেস অরোরা দাঁড়িয়ে গিয়ে সবার সামনে বললেন—

– এই মেয়ে হচ্ছে আমার ছেলের বউ! আর এই বিয়ে হয়েছে আমার অনুপস্থিতিতে! এখন তোমরাই বলো—আমি এটা মানবো ?

ঘরে থমথমে পরিবেশ।আদিবের বাবা মিসেস অরোরাকে শান্ত করে বললেন,

– অরোরা, বুঝো তো, ছেলের আরজি না মানলে কী করতাম ? আর হায়াতও এত সুন্দর মেয়ে, তাকে তো আমরা ভালোবেসেই নিয়েছি। তার জন্য কিছুটা বুঝদার হোও।

কিন্তু মিসেস অরোরা রাগে ফুসফুস বাঁচাতে না পেরে বললেন,

– সুন্দর ? আরে, সে তো আমার ছেলের জন্য উপযুক্ত নয় ! এত ছোট মেয়েকে কিভাবে এই পরিবারের জন্য মান্য করবো ?

এই কথায় আদিবের বাবা একটু দুঃখ পেলেও শান্ত স্বরে বললেন,

– অরোরা, আমরা সবাই চাই আদিব সুখী হোক। হায়াতকে একটু সময় দাও, সে নিজেই তোমাদের ভালো লাগবে।

মিসেস অরোরা রাগে ফুসতে থাকলেন। চোখের রক্তিমতা যেন আগুন হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবকে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলেন।
ঠাসসসসসসসসসসসস

চড়টা ছিল হঠাৎ, জোরালো আর মায়ের অভিমানভরা।

– তুই আমার সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা করলি, আদিব ?– গর্জে উঠলেন মিসেস অরোরা।
আমাকে কিছু না জানিয়ে, নিজের ইচ্ছেমতো বিয়ে করে বসে আছিস? তোর বাবার সায় ছিল, কিন্তু আমার কিছুই জানা ছিল না!

আদিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, চোখে জলরেখা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

– মা, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি শুধু হায়াতকে ভালোবাসি… ও-ই আমার জীবন।

মিসেস অরোরা তখনও কাঁপছিলেন রাগে।

– ভালোবাসা? এখন তোর জন্য সংসারের নিয়ম, সমাজের নিয়ম সব ভুলে যেতে হবে ? এতদিন যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তুই এক লহমায় তাকে ভেঙে দিলে ?

আদিবের বাবা তখন এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন,

– অরো, ওরা এখন স্বামী-স্ত্রী। আমরা রাগ করে যদি দূরত্ব বাড়াই, তাহলে শুধু পরিবারটাই ভেঙে যাবে। সময় দাও, ছেলেটা খারাপ কিছু করেনি।

মিসেস অরোরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চোখের জল মোছে নিয়ে বললেন,

– আমি কিছু বলছি না এখন… কিন্তু হায়াতকে যদি একটুও অযোগ্য মনে হয়, তবে আমার চুপ থাকা কঠিন হবে।

ঘরজুড়ে নেমে এলো এক ভারী নীরবতা…আদিবের চাচী এগিয়ে এসে মিসেস অরোরার কাঁধে হাত রাখলেন, কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

– আপা, আমি জানি আপনার খুব রাগ হচ্ছে, খুব কষ্টও পেয়েছেন… কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। ওরা তো এখন স্বামী-স্ত্রী। হায়াতের গায়ে তো আদিবের নাম উঠেছে… আপনি যদি এখন রাগ ধরে রাখেন, তাহলে ঘরটাই ভেঙে যাবে।

এই কথা শুনে মিসেস অরোরা যেন আরো জ্বলে উঠলেন।

তিনি হাতটা ঝটকে সরিয়ে বললেন,
– তুমি আমাকে শেখাও না, চাচী হয়ে শুধু স্বার্থ বোঝো! আমার ছেলে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে, আর আমি মাথা নিচু করে মেনে নেবো?
তার চোখে পানি, তবু মুখে কঠিনতা।
আমি কি এই দিন দেখার জন্য আদিবকে মানুষ করেছি? যে ছেলেকে শিখিয়েছি– আগে মা, তারপর দুনিয়া… সেই ছেলে আজ আমাকে উপেক্ষা করে একা সিদ্ধান্ত নেয়!

আদিব কাঁপা গলায় বলল,

– মা… আমি ভুল করেছি, স্বীকার করছি। কিন্তু হায়াতকে দোষ দিবে না, প্লিজ। ওর কোনো দোষ নেই… সব সিদ্ধান্ত আমার।

হায়াত চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। মিসেস অরোরার চিৎকার, আদিবের চোখের জল, চাচীর মিনতি—সবকিছু তার কাঁপা বুক ভেদ করে যাচ্ছিল।

তার মুখ ধবধবে ফ্যাকাসে, চোখ দুটো জলে ভরে উঠছিলো। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রেখেছিলো… যতক্ষণ না মিসেস অরোরা বললেন:

– দেখি সেই হায়াত কোন সাহসে আমার ঘরের বউ হওয়ার দাবি রাখে!

এই কথাটা যেন বুক চিরে ছুরি চালালো হায়াতের ভেতরে।
সে আর থাকতে পারল না। ধীরে সামনে এসে কাঁপা গলায় বলল,

– আম্মু, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার জন্য আপনাদের মা-ছেলের মধ্যে ঝগড়া করতে হবে না। আমি… আমি থাকলেই যদি এই ঘরে অশান্তি আসে, তবে আমি সরে যাচ্ছি।

চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারল না সে।
আদিব বললো,
– জান….
– আমি ঠিক আছি।
বলেই হায়াত দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলো, তার ওড়নাটা পেছনে হাওয়ায় ভেসে রইলো কিছুক্ষণ… আর পেছনে রইলো থমথমে এক শোকাবহ নীরবতা।

আদিব চিৎকার করে উঠলো,

– হায়াত! দাঁড়াও! প্লিজ… আমার কথা শোনো!

ঘরের ভেতর অন্ধকার। বাতাস ভারী। কান্নায় হায়াতের চোখ ফুলে উঠেছে। দরজার আড়ালে বসে একা-একাই কাঁদতে কাঁদতে তার বুকটা ধকধক করছিলো। সে নিজেকেই দোষ দিচ্ছিলো, মনে হচ্ছিল – তার জন্যই আজ এই বাড়িতে অশান্তি।

একটা মুহূর্তে হায়াত উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের পাশে রাখা ওড়নাটা হাতে নিলো। চোখে জল, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক শূন্যতা।

যদি আমি না থাকি… তাহলে আর কেউ কষ্ট পাবে না।
— এই ভেবে সে পাখার দিকে তাকালো।

ঠিক তখনই দরজার বাইরে আবার আদিবের গলা শোনা গেলো –

– হায়াত! প্লিজ, দরজা খোলো! আমি জানি তুমি কষ্টে আছো, কিন্তু এমন কিছু কোরো না যেটা কখনো ফিরিয়ে আনা যাবে না!

চাচী কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
– বউমা, মা হিসেবে বলছি… মা রাগ করে, কিন্তু বুকের ভেতর ভালোবাসাই থাকে। তুই যা ভাবছিস, সেটা ঠিক না রে!

হঠাৎ ভেতরে একটা শব্দ হলো – একটা চেয়ার টানানোর।

মিসেস অরোরা দৌড়ে দরজায় এসে কান পেতে শুনলেন, চোখ ছলছল করছিলো তাঁরও।

– হায়াত! প্লিজ, মা… আমি… আমি ভুল করেছি! তুই দরজা খুল, আমি তোকে মেনে নেবো, শুধু দরজা খুল মা!

আদিব এবার আর সহ্য করতে পারলো না।
সে জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করতে লাগলো।

– হায়াত!! আমি ভালোবাসি তোমায়! প্লিজ…!

একবার… দুইবার… ধাড়াম!

দরজা খুলে যেতেই সবার চোখ স্থির হয়ে গেল।

হায়াত… ফ্যানের সঙ্গে ওড়না বেঁধে ঝুলে আছে।
চেয়ারটা নিচে উল্টে পড়ে আছে, ঘরের বাতাস ভারী, নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।

“হায়াত!!

আদিব চিৎকার করে ছুটে গেল।

মুহূর্তের মধ্যে সে লাফ দিয়ে হায়াতকে ধরে ফ্যান থেকে নামিয়ে আনলো।
চাচী, মিসেস অরোরা আর সবাই ছুটে এলো। কেউ ওড়না খুলছে, কেউ তার মুখে পানি দিচ্ছে, কেউ কাঁদছে…

হায়াতের চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস ধরা-ধরা।

আদিব কাঁপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো:

– ও শ্বাস নিচ্ছে! একটু নড়ছে! অ্যাম্বুলেন্স ডাকো! জল আনো! ও মরেনি… ও মরবে না…#আমার_হায়াতি,আমার প্রাণ, আমি কিছুতেই ওকে হারাবো না!

বলেই সারা মুখে কাঁদতে কাঁদতে চুমু খেলো আদিব।

আদিব নিজের কোলে হায়াতের মাথা রেখে বসে আছে, বারবার কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
“তুমি কিচ্ছু করবে না, তুমি কথা দিয়েছিলে, হায়াত… আমি তোমায় ভালোবাসি… প্লিজ ফিরে আসো…”

হায়াতের নিঃশ্বাস খুব ধীর… খুব কষ্ট করে চলছে। তার গলায় দাগ, মুখে নিস্তেজ ভাব।

হাসপাতালের গেট পৌঁছতেই নার্স আর ডাক্তাররা স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেলো তাকে।

সবাই দোয়া আর কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মিসেস অরোরা এক কোণে বসে কাঁপতে কাঁপতে বিড়বিড় করছিলেন,
“হায়াত মা, প্লিজ ফিরে আয়… আমি তোকে মা বলিনি, কিন্তু তোকে হারাতে পারবো না… আমি মাফ চাইছি…”

আদিব বারবার ডাক্তারদের দিকে তাকাচ্ছিল, চোখে পানি আর প্রার্থনার ছায়া।
চাচী তসবি হাতে দোয়া পড়ে যাচ্ছিলেন:
“ইয়া আল্লাহ… মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও… বাকি জীবনটা এই সংসারে আলো হয়ে থাকুক সে…”

সময় যেন থেমে গেছে…

অবশেষে ডাক্তারের দরজা খুলে গেল। ডাক্তার মাস্ক খুলে ক্লান্ত গলায় বললেন,

– আলহামদুলিল্লাহ… সময়মতো এনে ফেলায় ওকে বাঁচানো গেছে। এখনো দুর্বল, তবে আশঙ্কামুক্ত।

সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।

আদিব হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে— কান্না আর শুকরিয়া একসাথে।
“ধন্যবাদ আল্লাহ… আমার হায়াত বেঁচে গেছে…”

মিসেস অরোরা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন, ডাক্তারকে বললেন,
– আমি কি ওকে একবার দেখতে পারি… একটু আদর করতে পারি?

ডাক্তার একটু হাসলেন,

– দেখতে পারবেন। কিন্তু আস্তে কথা বলবেন, ও এখনো খুব দুর্বল।

#চলবে,,,,,,,