আমার হায়াতি পর্ব-১২

0
6

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১২
লেখিকা : #Nahar_Adrita

সকালবেলা। গ্রামের বাতাসে হালকা ঠান্ডা, মাটির গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার আগেই উঠানে নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে। রান্নাঘরের পাশে বড় হাঁড়িতে চাল ধোয়ার শব্দ, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকে বিয়ের গানের আওয়াজ —
“আজ মধুর লগন, আজ বিয়ের সময়…”

দুয়ারে বসে প্রতিবেশীরা আদা-রসুন ছোলছে। আবার কেউ কেউ সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। বাড়ির পুরুষরা সবাই রান্নার তদারকি করছে। এখন ক’টা বাজে, সবে মাত্র সাড়ে ছয়টা। বিয়ে বাড়ির মজাই অন্যরকম, সকলেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাসি ঠাট্টায় মজে ওঠেছে। মিসেস আলিয়া কাঁচা হলুদ বাটছেন জাহীনের গোসলের জন্য।লামিয়া চোখ কচলাতে কচলাতে ওঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। সকলেই যেনো বিয়ের উৎসবে নিজেকে মাতিয়ে নিয়েছে।বাইরে উঠানে গামছা বেঁধে কাজ করছে জাহিনের মামারা, কারো হাতে গাঁদাফুলের মালা, কেউবা প্যান্ডেল বাঁধছে। হালিমের হাড়ি চুলায় চাপা, ধোঁয়া উঠছে, কচুপাতার মতো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

তিন কক্ষের টিনের ঘরের এক কোণে হায়াত আর আদিব এখনো ঘুমিয়ে। হায়াত মুখ গুঁজে আছে আদিবের বুকে, চুল এলোমেলো। আদিবের হাতে এখনো ঘুমের আলস্য, কিন্তু বাইরে গমগম আওয়াজে সে খানিকটা কুঁচকে উঠলো। পিট পিট করে চোখ খুলেই নজর পড়লো হায়াতের দিকে। ইসস কি মায়াবি মুখ। যে কেউ দেখলেই মুখে মাশাআল্লাহ আওড়াবে। আদিব কিছু একটা ভেবেই একটু থুতু ছিটিয়ে দিলো হায়াতের মুখে। হায়াত কপাল কুচঁকে চোখ খুললো, মুখ কালো করে বললো,

– আপনি আমাকে থুতু দিলেন কেনো,এ্যাাাাআাাাা। বলেই ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করতে লাগলো।

– কোথায় জান,আমি থুতু দেই নি।

– এই যে আমার গালে থুতু। ছিহহহহহহহহহহ।

– বউ তুমি অনেক সুন্দর….

– এর জন্য আমাকে হিংসা করে থুতু দিলেন,এ্যাাাআাাাা।

– আরে পাখি কান্না করে না, আমি মুছে দিচ্ছি আসো।

– না, এ্যাাাা এ্যাাা আপ্ ইইই ইই আপনি পঁচা।

– তোমার নজর লাগবে বলে একটু থুতু দিয়েছি আহ্লাদী।

– ওইই ইইইই এ্যাাাা এ্যাাা আমি কালো হয়ে যা আ আচ ববো যাবো।

– উফ কি মুশকিল, থুতু দিলে কেউ কালো হয় না বউ।

– আমার যদি ব্রন ওঠে এ্যাাাা আাাাা।

– ওয়েট প্রবলেম সলভ করছি আমি।
এই বলেই হায়াতের সাড়া মুখে চুমু খেলো আদিব। হায়াত মিনমিন করে বললো,

– আমি সুন্দর হয়ে যাবো তো।

– হু জান,আমি প্রতিদিন তোমার মুখে থুতু দিয়ে চুমু খাবো,এতে আরো সুন্দর হবা।

হায়াত আড়মোড়া ভেঙে বসলো, আদিব ওঠে দাঁড়াতেই লুঙ্গি খুলে নিচে পড়ে গেলো। হায়াত হো হো করে হেসে দিলো। হতবাক হয়ে বউয়ের দিকে তাকালো আদিব। বললো,
– জান এটা কিন্তু ঠিক না। তোমার স্বামীর লুঙ্গিটা যদি এখানে না পরে দুয়ারে সবার সামনে পরতো তাহলে তোমারই মান- ইজ্জত চলে যেতো।
– হি হি হি, হাহহাহাহাহা আপনি উঠলেন হাহাহা আপনি ওঠলেন আর লুঙ্গি পড়ে গেলো।
– থাপ্পড় মারবো ফাজিল।
– ওকে ওকে।
এরপর দু’জন বাইরে গিয়ে সকলের সাথে টুকটাক কাজ করলো।

দুপুর বারোটা। সূর্যের তাপ একটু কম, কিন্তু গরম এখনো বেশ রয়ে গেছে। আদিব আর হায়াত গোসল সেরে সাদা-পরিচ্ছন্ন জামা পরে নিলো।

হায়াত একটা হালকা গোলাপি কামিজ পরে চুল ভেজা রেখেই বারান্দায় এলো। আদিব তার পাশে এসে দাঁড়াতেই আফরা হালকা হেসে বলল,
– আমি যাই হ্যা, জাহীন আপুকে সাজিয়ে আসি।
– ওকে আমিও শশুর আব্বুদের সাথে কাজ করবো, যাও তুমি।
———–
টিনের ঘরটায় বিকেলের আলো যেন একটু বেশি উজ্জ্বল হয়ে জাহীনকে ঘিরে রেখেছে। লাল বেনারসি শাড়িটা পরেই আয়নার সামনে চুপ করে বসে আছে জাহীন। শাড়ির পাড়ে সোনালি জরি চিকচিক করছে, আর মুখে একরাশ অনাবিল লজ্জা আর উত্তেজনা।

হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকলো লামিয়া আর হায়াত। দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি ঝুলে আছে, যেন তারা চোখে দেখছে একদম সত্যিকারের কনে।

হায়াত এগিয়ে গিয়ে বললো,
– মাশাল্লাহ বনু, না সেজেই তো একদম অপূর্ব লাগছে! চল, এবার আমরা সাজিয়ে দেই, তারপর তোকে আর কেউ চোখই তুলে তাকাতে পারবে না।

লামিয়া পাশে বসে চুড়ির বক্স খুলতে খুলতে হেসে বলল,
– এই বেনারসির সাথে লাল টিপ আর কপালের মাঝখানে টিকলি হলে জমে যাবে!”

জাহীন হালকা হেসে বললো,
– তোমরা না, এমন করো না… আর লজ্জা পাচ্ছি।

হায়াত তার গালে আদুরে একটা চাপড় মেরে বললো,
– লজ্জা পাবি তো রাতেই! এখন আয় আয় আয়, আমার কনে বানিয়ে দিই তোকে!

ঘরের ভেতর তখন সাজগোজের উৎসব—চুড়ির ঝুনঝুন, টিকলির ঝকমক, আর মেয়েলি হাসির এক মায়াবী আবহ। বাইরের দাওয়ায় তখন হালকা বাতাস বইছে, যেন গোটা পরিবেশটাই জাহীনের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে গেছে।

বাড়ির উঠোনজুড়ে তখন বিয়ের রঙিন ব্যস্ততা। এক কোণে চেয়ার সাজানো, অন্যদিকে রান্নার হাঁড়ি বসছে, আর মাঝখানে জোড় হাতে দৌড়ঝাঁপ করছে আদিব। মুখে ঘাম, হাতে তালিকা, চোখে তবু প্রশান্তি—একদম গৃহস্থের মতো দায়িত্ব নিয়ে যেন নিজের বোনের বিয়ের আয়োজন করছে।

শশুর বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। কখনো রাধুনিদের বলে রান্নার তদারকি করছে, কখনো চেয়ার কম হলে নিজেই টেনে নিয়ে এসে সাজিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা দেখলেই তৎক্ষণাৎ সামলে নিচ্ছে।

একজন মেহমান চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চাচাকে বললেন,
– মাশাল্লাহ! মেয়ের জামাইটা দেখি একদম গৃহস্থ ঘরের ছেলে। সব কিছু এমনভাবে দেখভাল করছে, যেন বাড়ির আপনজন।কে বলবে কতো বড় কোম্পানির মালিক সে।

আরেকজন বলে উঠলো,
-আমাদের সময় এমন জামাই পাওয়া স্বপ্ন ছিলো… ভাগ্যবতী পরিবার ওরা!

শশুর সাহেব একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখে স্নেহের ছায়া। পেছন থেকে হালকা কণ্ঠে বললেন,
– আদিব আসার পর থেকেই বুঝেছি, আমার মেয়েকে ভালো হাতে দিয়েছি।

আদিব তখনও থেমে নেই। কোথাও মাইক কম বাজছে, কোথাও কুলার বন্ধ হয়ে গেছে—সব জায়গায় তার উপস্থিতি। বিয়ের আনন্দে সে যেন নিজের অস্তিত্বই ভুলে গিয়ে অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত।

হায়াত দরজার আড়াল থেকে চুপচাপ উঁকি দিচ্ছিলো। ওর চোখে মায়া, ঠোঁটে লুকোনো হাসি। গোটা বাড়ির হুলস্থুলের মাঝে আদিবকে এভাবে দায়িত্বে ডুবে থাকতে দেখে তার মনে একরাশ গর্বের ঢেউ উঠলো।

ঠিক তখনই আদিব দূর থেকে চোখ মেলেই দেখে ফেললো ওকে। মাথা তুলেই হালকা চিৎকার করে বললো,
– বউজান টুকি।

চারপাশে যারা ছিলো, হেসে উঠলো একযোগে।

হায়াত লজ্জায় গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে ভেতরে চলে যেতে গেলো, তখন আদিব আবার বলে উঠলো,

– এই যে বউ আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম, তাই বলে উঁকি দিয়ে দেখবে আর আমি ধরবো না—তুমি এমনটা ভাবলে কিভাবে ?

হায়াত থেমে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকালো, চোখে চ্যালেঞ্জ আর ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– আপনি তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ভেবেছিলাম আমাকে আর চোখেই পড়বে না!

আদিব এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললো,
– তুমি থাকলে শত কাজের মাঝেও চোখ তো শুধু তোমাকেই খোঁজে।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। প্যান্ডেলের নিচে সারি সারি চেয়ারে বসে অতিথিরা প্লেট হাতে খেতে ব্যস্ত। গরম ভাতে ধোঁয়া উঠছে, পাশেই গরুর মাংসের ঝোল, রসগোল্লা, কোল্ড ড্রিংক—সব কিছুতে জমজমাট পরিবেশ।

আদিব এক কোণে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে মেহমানদের সার্ভ করছে। হঠাৎ হায়াত তার পেছনে এসে দাঁড়ালো, হাতে গরুর মাংসের একটা বড় ঝোলভরা বাটি।

– এই ধরুন তো, আমার হাত ফসকে যাচ্ছে।

আদিব একটু হেলিয়ে বাটিটা ধরতেই হঠাৎ করে হায়াতের হাত হড়কে গেল। টুপ করে গরুর মাংসের গরম ঝোলটা সোজা গিয়ে পড়লো আদিবের সাদা পাঞ্জাবিতে!

এক সেকেন্ডের জন্য সব থেমে গেল।

আদিব নিচের দিকে তাকিয়ে অবাক, পাঞ্জাবির সাদা কাপড়জুড়ে লালচে তেলের দাগ ছড়িয়ে গেছে।

হায়াত মুখে হাত চেপে রাখলো, চোখ ছানাবড়া—
– এ্যাাা ! আমি… আমি মানে… ইচ্ছা করে হয়নি সত্যি বলছি।

আদিব একটু তাকিয়ে রাগের ভান করে বললো,
– তুমি কি ঠিক করেইছিলে, আজকেই আমার সাদা পাঞ্জাবির জানাজা পড়াবা।

হায়াত ফিক করে হেসে ফেললো,
– আমি ভেবেছি আপনার পাঞ্জাবি ঝোল খেতে পছন্দ করে।

দুজনের কথায় আশেপাশের কয়েকজন খাওয়া থামিয়ে হেসে ফেললো।

আদিব মাথা নাড়িয়ে বললো,
– আচ্ছা বউ,অনেক ঝোল খাওয়ালে এখন তুমিই ধুয়ে দিবে, চলো তো দেখি।

হায়াত চোখ গোল করে বললো,
– না না আমি এখন যাবো না, কালকে বাড়ি গিয়ে ধুয়ে দিবো।
——-

সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত, হায়াত আর আদিবের সেই “ঝোলকাণ্ড” নিয়ে এখনো লোকজন হেসে কথা বলছে, ঠিক তখনই আদিবের পকেটের মোবাইলটা কাঁপতে শুরু করলো।

আদিব মোবাইলটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠ—মিসেস অরোরা, তার মা।

– হ্যালো মা, সব ঠিক আছে তো ?খালামনি সুস্থ হয়েছে।

ওপাশ থেকে মিসেস অরোরা কড়া গলায় বললেন,

– তুই কোথায়,

– বিয়েবাড়ি মা, হায়াতের চাচাতো বোনের বিয়ে …

এক মুহূর্ত নীরবতা, তারপর মিসেস অরোরা বললেন,

– শোন, আমি আমেরিকা থেকে রওনা হয়েছি,রাত্রেই ঢাকায় ল্যান্ড করবো,সাথে নেহাও আসছে।

এই কথাটা শুনেই আদিব যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলো।

– নেহা… আসছে ?

– হ্যাঁ বাসায় থাকবে কয়েকদিন। তোর খালামনির ট্রিটমেন্ট চলবে কিছুদিন। আমি চাই, তুই ওকে সময় দিবি, বুঝলি?

– জ্বি, মা,,,,ঠিক আছে।

ফোন কেটে গেলো।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হায়াত আদিবের মুখের ভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললো কিছু একটা অস্বাভাবিক।

– কিছু হয়েছে, আম্মু আসছে।

আদিব হালকা গলা নামিয়ে বললো,
– হু মা আসছেন…আজ রাতেই। সঙ্গে আমার খালাতো বোন নেহাও আসছে।খালামনি অসুস্থ তাই আরকি,,,,,,,আমাদের বাসায় যেতে হবে,
– আচ্ছা চলুন আব্বু আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হই।
– হু।
——–

সন্ধ্যা ছয়টা। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ, হাসি আর আনন্দের রেশ কাটিয়ে আদিব আর হায়াত সবাইকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলো। গাড়ির দরজা বন্ধ হতে না হতেই হায়াত শেষবারের মতো জানালার ফাঁক দিয়ে পেছনে তাকালো—আলোকিত উঠোন, হাত নাড়ানো আত্মীয়স্বজন, আর হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়ায় মাখা গাছপালা।

হায়াত গাড়িতে ওঠার আগে শেষবারের মতো পেছনে তাকালো। উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে হায়াতের মা, বাবা আর ছোট ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখের কোনা ভেজা, তিনি আঁচলের প্রান্ত দিয়ে চুপিচুপি চোখ মুছছেন। বাবার মুখ শক্ত, কিন্তু চোখের ভেতরে কষ্ট স্পষ্ট। আর ভাইটা—যার চোখে প্রথমবার সত্যিকারের বিষণ্নতা—চোখ নামিয়ে ফেলেছে যেন কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে।

হায়াত নেমে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো, মায়ের বুক কেঁপে উঠলো কান্নায়। বাবা শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– ভালো থেকো মা, কেউ কিছু বললে তর্ক করবে না একদম।
– আব আচ্ছা আব্বু।

ভাইটা এগিয়ে এসে বললো,
– আপাইরে মাঝে মাঝে ফোন দিবি, ঠিক আছে?

আদিব পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে সব দেখছিলো। তার নিজের চোখেও যেন এক অদৃশ্য ভার নেমে এসেছে। হায়াত চোখের পানি মুছে গাড়িতে উঠলো, জানালা দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো আপন মানুষগুলোকে। গাড়ি চলতে শুরু করলো—নিরব কান্না ফেলে রেখে, নতুন জীবনের দিকে।

গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই শহরের দিকে রওনা দিলো তারা। পিচ ঢালাই রাস্তায় গাড়ির চাকা মসৃণ গতিতে ঘুরছে, পাশে পেছনে পড়ছে একের পর এক গাছ, দোকান আর ছোট ছোট ঘরবাড়ি। রাস্তায় হালকা বাতি জ্বলতে শুরু করেছে, দূরে শহরের আলো আর ব্যস্ততা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে।

গাড়ির ভেতরে নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে বায়ুর কাঁচে হাত রাখে হায়াত, জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা বাতাস চুলগুলো উড়িয়ে দেয়। আদিব এক চোখে রাস্তা দেখে, এক চোখে হায়াতের মুখ। যেন দুজনেই কিছু বলতে চায়, কিন্তু থেমে থাকে—এই সন্ধ্যার নরম আলোতে কথাগুলোও যেন ধীর হয়ে গেছে।আদিব গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– জান কিছু খাবে,আইসক্রিম কিনি৷
– উহু।
– কেনো পাখি,কি হয়েছে, খারাপ লাগছে বাড়ির জন্য আমি প্রমিজ করছি কিছুদিন পর আবার নিয়ে আসবো।
– আচ্ছা।
আদিব একটা দোকানের সামনে গাড়ি থামালো,সেখান থেকে কিছু চিপস, আইসক্রিম কিনে নিলো, হায়াত আনমনে খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে আদিবকেও খাইয়ে দিচ্ছে।

দুই ঘন্টা পর গাড়িটা এসে পৌছালো সাভারের রাস্তায়। আদিব হুট করেই কেমন হাসফাস করছে। হায়াত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,
– কি হয়েছে, খারাপ লাগছে অনেকটা তো চালিয়ে আসলেন, একটু জিড়িয়ে নিন।
– I need you. I don’t want to hear anything right now—I just want you close to me. Please.

হতবাক হয়ে গেলো হায়াত, মিনমিন করে বললো,

– মানে……. এখনই,,আর দশ মিনিট পরই বাড়ি পৌঁছে যাবো তো।

– Not another word. I need you right now. I can’t take it anymore.

এই বলেই হায়াতের দিকে ঝুঁকে পরলো আদিব। জুড়ে জুড়ে ঠোঁট চুষতে লাগলো। হায়াত এতো গরমে পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছে। উমমমম উমমমমন করে আদিবকে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বোরকা খুলে পেছনের সিটে রেখে দিলো। জুড়ে জুড়ে বক্ষঃস্থল কচলাতে শুরু করলো। হায়াত ব্যাথায় আহহহ মূলক শব্দ করে ওঠলো। আদিবের কান অব্দি যেনো তা পৌঁছালো না। আদিব ধৈর্য্যহীন হয়ে একটানে হায়াতের কামিজ খুলে ফেললো, হায়াতও আদিবের শার্ট প্যান্ট খুলে ফেললো, আদিব জুড়ে জুড়ে গলায় ঘাড়ে চুমু খেতে লাগলো,হায়াত কেঁপে কেঁপে ওঠে। আদিব হাস্কি স্বরে বললো,
– ধরো।
– হু৷
– শক্ত করে ধরো প্লিজ,পারলে মুখে নাও।

হায়াত উত্তেজিত স্বরে বললো,

– প্লিজ একটু আস্তে। আহহহহহহ
– হুসসসসসসস,বেবি।বিসমিল্লাহ বলে জুড়ে জুড়ে চাপ দিতে লাগলো,
– আহহহহহহহহহ।ওমাগো ব্যাথা। আহহহহহহহহ।

দুই ঘন্টা পর………

দু’জনেই হাঁপ ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে আছে। হায়াত ধীরে ধীরে গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিলো। আদিব টিসু দিয়ে সিট মুছে নিলো। এমন সময় ফোন বেজে ওঠলো, মিসেস অরোরা….. আদিব কল রিসিভ করলো,
– হ্যা মা বলো।
– তোরা কি বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিস।
– না মা সাভার এনামের মাঠের কাছে।
– আমি তো একটু তোর চাচ্চুর বাসায় যাবো,তুই নেহা নিয়ে যা।
– আচ্ছা মা, আমরা ওয়েট করছি।

কল কেটে দিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে কপালে স্লাইড করলো আদিব। হায়াত বোরকাটা পরে বললো,
– আম্মু কি বাড়ি এসে গিয়েছে নেহা আপু কে নিয়ে।
– হুম এখান থেকে নেহাকে ড্রপ করতে হবে।
– কেনো আম্মু।
– কয়েকদিন চাচ্চুর বাড়ি থাকবে,চাচী অসুস্থ ।

——-
রাত নয়টা। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু তারারা ঝিমিয়ে আছে নিঃশব্দে। এনামের মাঠ ঘিরে একটা চাপা নীরবতা, মাঝে মাঝে দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ—আর গাড়ির ভেতরে আলো নিভিয়ে বসে আছে আদিব আর হায়াত।হায়াত চুপচাপ বসে আছে পাশের সিটে, দুই হাত জড়োসড়ো। আদিবের চোখ সামনের মাঠে স্থির, যেন কিছু একটা অপেক্ষায়। গায়ে হালকা সাদা শার্ট , চোখে থেমে থাকা ক্লান্তি।

একটু পরই দূর থেকে একটা সাদা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ঢুকলো মাঠের কিনারে। ধুলো উড়িয়ে থামলো তারা থেকে কয়েক গজ দূরে। দরজাটা খুললো ধীরে, আর নামলো নেহা।নেহা—আধুনিক পোশাকের দ্যুতি নিয়ে, যেন পুরো রাতের অন্ধকার ভেদ করে এসেছে। পরনে স্লিম-ফিট ব্ল্যাক প্যান্ট, সাদা টপ, কাঁধে ঝুলছে একপাশে ছোট চামড়ার ব্যাগ। ঠোঁটে গাঢ় রঙ, চোখে একধরনের আত্মবিশ্বাস।

সে হাঁটছে ধীরে ধীরে, হাই হিলের টুকটাক শব্দে রাতটা আরও ভারী হয়ে উঠছে।

হায়াত কিছুটা কুঁচকে গেলো, দৃষ্টি সরিয়ে নিলো জানালা থেকে।

আদিব গ্লানিভরা কণ্ঠে বললো,
– তুমি নামো, আমিও নামছি….

হায়াত একটু তাকালো, কিছু না বলে দরজা খুলে নামলো। তারপর আদিবও বের হলো গাড়ি থেকে।

নেহা চারপাশে এক ঝলক তাকিয়ে দেখলো, তারপর চোখে পড়লো আদিবকে। তার মুখে হাসি ছুটলো, সেই পুরনো, চঞ্চল উচ্ছ্বাস নিয়ে। আধুনিক পোশাক, খোলা চুল, ঠোঁটে লালটুকু রঙ — তার আত্মবিশ্বাস যেন বাতাসে কাঁপন তোলে।

না কিছু না বলেই দৌড়ে এলো আদিবের দিকে।
– আদিব।

চোখের পলকে গিয়ে আদিবকে জড়িয়ে ধরলো। গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমি ভাবিনি এতো গুলো দিন পর তোমাকে দেখবো,আর তুমি আসবে!

আদিব হতচকিত, পেছন থেকে হায়াত সব দেখছে—দাঁড়িয়ে আছে ঠিক কয়েক কদম দূরে। ওড়নার কোণটা শক্ত করে ধরেছে, ঠোঁট কামড়ে দিচ্ছে, কিছু একটা যেন গলায় আটকে গেছে।

নেহা তখনো জানে না… এই আদিব এখন হায়াতের স্বামী।

আদিব ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নেহার আলিঙ্গন থেকে।
তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখে দ্বিধা।

হায়াত কিছু না বলে ফিরে দাঁড়ালো, যেন চলে যাবে। আর তখনই নেহা অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে।

– এই মেয়ে কে .?

আদিব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, তারপর ধীরে ধীরে বলে…

– আমার স্ত্রী।

নেহার মুখ মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল।বললো,

– ওহ বিয়েও করে ফেল্লে, আর আমি…. ,

– Neha, please stop. This isn’t the place — you can talk about all this at home. Hayat is really tired.

– ওহ, আর আমি….আমি যে আমেরিকা থেকে আসলাম, আমি বুঝি tired না।

– আমি এতো কথা বলতে চাই না, চলো।

নেহা গাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। বাতাসে ওর পারফিউমের গন্ধ হালকা ছড়িয়ে পড়লো। তারপর হঠাৎ করেই সে চোখ সরিয়ে নিলো আদিব থেকে, এগিয়ে এলো হায়াতের দিকে।

হালকা একটা হাসি ঠোঁটে এনে, একটু অবজ্ঞা মেশানো স্বরে বললো,
– তুমি খুব ভাগ্যবান, হায়াত।
একটু থেমে কাঁধ ঝাঁকিয়ে যোগ করলো,
— “যাক, ভালোই তো।”

হায়াত কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। চোখে না রাগ, না দুর্বলতা—শুধু একরাশ ক্লান্তি। সে কিছু বললো না, শুধু চোখ ফিরিয়ে নিলো।

নেহার ঠোঁটে তখনো সেই জয়ের মতো হালকা হাসি, কিন্তু চোখে যেন হেরে যাওয়া ঝিলিক।
নেহার কথার পর হায়াত একটু থেমে নিলো নিজেকে, যেন কিছু বলার চেষ্টা করেও থেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে আদিবের পাশে বসতে চাইল—ড্রাইভারের ঠিক পাশে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই নেহা এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে, কণ্ঠে স্পষ্ট জেদ, চোখে পুরনো এক দাবি নিয়ে বললো:

— না, আমি বসবো আদিবের পাশে। হায়াত, তুমি পেছনে বসো।

আবহাওয়া যেন হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হায়াত থেমে গেল দরজার পাশে। তার মুখটা সাদা হয়ে এলো, এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল যেন।

আদিব গভীরভাবে তাকালো নেহার দিকে। তার কণ্ঠ ভারী, চোখে বিরক্তি মেশানো ক্লান্তি:

— নেহা, এটা জেদ করার সময় না। ও আমার স্ত্রী। ও আমার পাশে বসবে।

নেহার মুখ থমকে গেল, চোখে অভিমান আর অপমানের ছায়া।

হায়াত তখন আস্তে করে দরজা খুলে বসল আদিবের পাশে, কোনো শব্দ না করে। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলো—কঠিন কিছু গিলে ফেলছে মনে হলো।

নেহা একটু দাঁড়িয়ে থেকে, ঠোঁট কামড়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বসল, গায়ের রেশটা যেন গাড়ির ভেতরে জমে রইলো।

গাড়ির ভেতরে চাপা নীরবতা। শুধু ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার শব্দ, আর অজানা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা তিনটি মানুষ।সারা রাস্তা কেউ কোনো কথা বললো না।

★★★★

গাড়িটি ধীরে ধীরে এসে চৌধুরী বাড়ির সামনে থামলো।

বাড়িটা আধো আলো-আঁধারিতে ঢাকা, জানালায় হালকা আলো জ্বলছে। গেটের সামনে পুরনো লোহার রেলিং, দেয়ালের একপাশে ভিজে মাটির গন্ধ। চারদিকে যেন একটা নীরবতা জমে আছে—কোনো উৎসব নেই, কোনো উচ্ছ্বাস নেই—শুধু অপেক্ষা।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হলো। তীক্ষ্ণ নীরবতায় কেবল দরজার ‘টক’ শব্দ—হায়াত প্রথমে নামলো গাড়ি থেকে। মুখ থমথমে, চোখে জমে থাকা বিষণ্নতা। পেছনের দরজা খুলে নামলো নেহা, মুখে অভিমানী গর্ব, আর একবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়লো।

সব শেষে আদিব গাড়ি থেকে নামলো। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো তিনজন।

হঠাৎ চৌধুরী বাড়ির প্রধান দরজা খুলে গেলো। আলো ছড়ালো সামনের উঠোনে। দাঁড়িয়ে আছেন কাজের মহিলা। হায়াত মিষ্টি করে হাসি দিয়ে সিড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেলো। আদিবও পেছন পেছন যেতে লাগলো।

বাঁকা হাসলো নেহা…..

#চলবে……