আমার হায়াতি পর্ব-১৬

0
7

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১৬
লেখিকা : #Nahar_Adrita

( ১৮+ এলার্ট, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য উন্মুক্ত 🚫)

রাত নয়টা, সকলে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আলোটা হালকা হলদে, একটা ভারী নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে ঘরে। মিসেস অরোরার পাশে আদিব আর হায়াত পাশাপাশি বসে আছে, তাদের মুখে একরকম চিন্তার ছাপ। তাদের উল্টো পাশে গম্ভীর মুখে বসে আছে আদনান, চোখ দুটো ঘোলাটে — যেন কিছু অনুভূতি লুকিয়ে রাখছে।আদিব মিন মিন করে বললো,

– আম্মু নেহার কি আসতে দেরি হবে ?

– কেনো বাজান,কি হয়েছে।

– হায়াতের খুব ঘুম পাচ্ছে।
সবাই হায়াতের দিকে তাকালো,হায়াত হতভম্ব হয়ে গেলো, আদিবের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,

– মিথ্যা বলছেন কেনো আমি কখন বললাম…

ঠিক তখনই, দড়জা দিয়ে দৌড়ে এলো নেহা। হাতে একটা ছোট ব্যাগ, শাড়ির আঁচল একটু পিছলে পড়েছে কাঁধ থেকে, শ্বাসটা হাঁপানো। ঘরের মধ্যে ঢুকে হঠাৎ থমকে গেলো। চোখ পড়লো সোজা আদনানের দিকে। মুহূর্তেই চারপাশের শব্দ হারিয়ে গেলো ওর কানে, কেবল দু’জনার চোখে চোখ আটকে গেলো — যেন কেউ একটা হারিয়ে যাওয়া পরিচিত নাম চিৎকার করে ডেকে উঠেছে নীরবতার মাঝখানে।

মিসেস অরোরা একটু এগিয়ে বললেন,

– নেহা, আয় মা, বস এখানে।

কিন্তু নেহা নড়লো না। চোখ দুটো ছায়াময় হয়ে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে, আর হাতে ধরা ব্যাগটা যেন ওর অনুভবহীন আঙুল থেকে পড়ে যাবে যে কোনো মুহূর্তে।

এই থমকে যাওয়া মুহূর্তের মধ্যেই যেন পুরো ঘরে কিছু একটা বদলে গেলো। হায়াত চুপ করে আদিবের দিকে তাকালো, আর আদিব নিজের অজান্তেই নেহা আর আদনানের মাঝখানে এক অদৃশ্য দেয়াল টানতে চাইলো মনে মনে।

নেহার গলা কাঁপছিল, তবুও তাতে ছিল বিষিয়ে ওঠা অভিমান আর দুঃখের কঠোরতা। সে সামনের দিকে এক পা এগিয়ে এসে বললো—

– খালামনি, এই কাপুরুষটা এখানে কেনো ?

তার চোখ এখনো আদনানের উপর ঠায় আটকে আছে। ঘরে মুহূর্তেই যেন শীতলতা নেমে এলো। সবাই চুপচাপ। মিসেস অরোরা থমকে গেলেন, একবার নেহার দিকে, একবার আদনানের দিকে তাকালেন।

হায়াত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো। আদিব একটু কেশে উঠে বললো,

– নেহা, একটু শান্ত হও,আমি ওনাকে আসতে বলেছি।

কিন্তু নেহা থামেনি। ব্যাগটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বললো,

– খালামনি চার বছর!,ঠিক চারটা বছর সে মুখ দেখায়নি। আজ হঠাৎ এসে আমার সামনে বসে থাকবে ? কিছু হয়নি এমন ভান করে ?আর আমি….আমি সব মেনে নেবো।

আদনান এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার ধীরে মাথা নিচু করে বললো,
– আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু কথা বলার একটা সুযোগ তো পাওনা আমারও…

নেহা হেসে উঠলো, সেই হাসিতে ছিল বিষ আর ব্যথার ছায়া,
– তোমার কথা আমি অনেক শুনেছি আদনান। এখন সময় এসেছে, আমার কথা শোনার।

ঘরে চাপা উত্তেজনা জমাট বাঁধছে। মিসেস অরোরা এবার বললেন,
– নেহা, যা কিছু বলার, আজ বলো। কিন্তু রাগ নয়, সত্যটা থাকুক।

নেহা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, মুখে অভিমানের আলো, আর চোখে জমে থাকা কান্নার ঝড়। এই রাতটা বদলে দেবে অনেক কিছু।

নেহার চোখে তখন আগুন, ঠোঁট কাঁপছে রাগে। ঠিক তখনই আদিব শান্ত গলায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বললো—

– নেহা, আমার আর হায়াতের বিয়ে হয়ে গেছে। দয়া করে এখনো আমাকে নিয়ে পড়ে থেকো না। আদনান এখানে এসেছে, ভালো করেই জানো কেনো এসেছে। তোমাদের মাঝে যা হয়েছিল, সেটা তোমরা দু’জনেই জানো। সময় এসেছে সব মিটমাট করার। কথা বলো, ঝগড়া করো, কাঁদো — কিন্তু এবার সব ঝামেলা শেষ করো।

নেহা যেন চমকে উঠলো। মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিলো আদিবের দিক থেকে। সেই কিশোরী ভালোবাসার সমস্ত অব্যক্ত টান যেন এক ঝটকায় ছিঁড়ে গেলো।

হায়াত নিচু স্বরে বললো,
– নেহা আপু, আপনি চাইলে আমি উঠে যাই, আপনারা কথা বলুন…

কিন্তু নেহা হাত তুলে হায়াতকে থামিয়ে দিলো। চোখের কোনে জমে থাকা জল মুছে ফেললো হাতের পিঠ দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে আদনানের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ঠিক আছে,কথা হবে। কিন্তু এবার তুমি পালিয়ে যেতে পারবে না, আদনান। একটাও প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে না।

আদনান মৃদু মাথা নেড়ে বললো,
– আমি পালাতে আসিনি, নেহা। ফিরে এসেছি — সব শুনতে, সব বলতে।

ঘরটা নিঃশব্দ। পুরনো প্রেম, নতুন সম্পর্ক, অভিমান আর সাহস — একসাথে খেলা করছে ড্রয়িংরুমের প্রতিটি কোণে।

নেহা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আদনানের চোখে, ঠোঁট কাঁপছে রাগে, চোখে কান্না জমে আছে— ঠিক তখনই আদনান ধীরে ধীরে উঠে এল নেহার সামনে।

এক মুহূর্তের দ্বিধার পর, হঠাৎ করেই সে নেহাকে জড়িয়ে ধরলো।

নেহা প্রথমে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু আদনানের কণ্ঠে তখন কান্না মেশানো অনুতাপের ভার—

– সরি সোনা… আর একটাবার, প্লিজ… একটা শেষ সুযোগ দাও।

তার কণ্ঠটা ভেঙে আসছে।

– আমি জানি, আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি… অনেক ভুল করেছি। কিন্তু তুমি ছাড়া আমি কিছু না, নেহা। আমি বদলে গেছি, সত্যিই বদলে গেছি। শুধু একবার… আর একবার ভালোবাসার সুযোগ দাও…

নেহা স্থির দাঁড়িয়ে আছে, আদনানের বাহুবন্ধে। তার শরীর শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু চোখে ভিজে কিছু একটা গড়িয়ে পড়লো—

চুপচাপ।

আদিব মুখ ঘুরিয়ে হায়াতের দিকে তাকালো। হায়াত একটু বেদনামাখা হাসি দিয়ে মাথা নিচু করলো।

মিসেস অরোরা উঠে এসে ধীরে বললেন,

– ভালোবাসা কখনো কখনো ঘুরে ফিরে আসে… কিন্তু ক্ষমা পেতে হলে সত্যি অনুতাপ থাকতে হয়, আর সাহসও।

নেহা ধীরে আদনানের বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
– তোমার শেষ সুযোগটা শুরু হবে সত্য বলার মাধ্যমে, আদনান। কিছুই চাপা থাকবে না। আমার সামনে না… আমার পাশে এসে দাঁড়াতে চাইলে, সব খুলে বলতে হবে।

আদনান চোখ মুছে চুপচাপ মাথা নেড়ে বললো—

– শুরু থেকে বলবো। কিছুই লুকাবো না, সোনা। আমি সত্যিই এবার হারাতে চাই না তোমাকে।

ঘরের বাতাস ভারী, কিন্তু তাতে একটা নতুন আশা মিশে আছে — নতুন করে শুরু করার, একসাথে হবার।

নেহার কণ্ঠ এবার থেমে থেমে কাঁপছিলো, কিন্তু তাতে এক ফোঁটা দুর্বলতা ছিল না—
বরং ছিল জমে থাকা যন্ত্রণা আর উত্তর চাওয়ার দাবি।

সে ধীরে আদনানের সামনে দাঁড়িয়ে, তার চোখে চোখ রেখে বললো:
– তুমি কেনো আমাকে রেখে আদনীনকে বেছে নিয়েছিলে বলো? আমাদের তো এনগেজমেন্টও হয়েছিলো। তুমি জানো আমি কতো ভেঙে পড়েছিলাম? প্রতিদিন ঘুম ভেঙে উঠতাম চোখ ভেজা বালিশে… আমি তো কিছু চাইনি, শুধু তোমার সাথেই একটা জীবন। সেটাও তোমার কাছে বেশী ছিলো?”

ঘর নিঃশব্দ হয়ে গেলো। কারো নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে যেন।

আদনান কাঁধ ঝুলিয়ে ফেলে ধীরে বসে পড়লো সোফার এক কোণে। মুখে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর কণ্ঠটা ভারী করে বললো:

– আমি ভয় পেয়েছিলাম, নেহা। পরিবার, দায়িত্ব, ক্যারিয়ার… আর তখন আদনীন… ওর পরিবার আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল, আমি বোকা ছিলাম। বুঝতে পারিনি ভালোবাসা মানে হিসেব না, সাহস। আমি শুধু পালিয়েছিলাম… নিজেকে, আর তোমাকে।

নেহার চোখে জল টলমল করছে, তবুও সে স্থির।
সে ফিসফিস করে বললো,
– তুমি পালিয়েছিলে, কিন্তু আমাকে পড়ে থাকতে হয়েছিলো ভাঙা স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপে।

আদনান উঠে এসে বললো,
– আমি জানি, আমার ক্ষমা চাওয়া যথেষ্ট না। কিন্তু আমি এখন পালাতে আসিনি। আমি তোমাকে হারিয়ে বুঝেছি, আমার সব কিছুই ছিলে তুমি। যদি আজ তুমি না বলো, আমি মেনে নেবো। কিন্তু আজ মিথ্যে বলবো না। আমি ভালোবাসি তোমায়, নেহা। সত্যিকারের ভালোবাসি।

হঠাৎ করে নেহার চোখে একটা দ্বিধা খেলে গেলো। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন বুকের ভেতর যুদ্ধ চলছে— অভিমান আর হৃদয়ের টান।

ঘরের বাতাস যেন দাঁড়িয়ে আছে, একটা উত্তর শোনার অপেক্ষায়…

নেহা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের জল শুকিয়ে গেছে, কিন্তু চোখদুটোতে জমে আছে শত গল্প—বেদনার, অভিমানের, আর এক অদ্ভুত মুক্তির।

তারপর ধীরে, শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো:
– জানো আদনান… আদিব আমাকে মন থেকে ভালোবাসত। সত্যি ভালোবাসত। বিনিময়ে কিছু চায়নি। শুধু আমার পাশে থাকতো, যখন আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম… যখন তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে।

তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো, কিন্তু মুখে তৃপ্তির এক টুকরো ছায়া।
-ও আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছে, বিচার করেনি। আমি চুপ থাকলে পাশে বসে থেকেছে। আমি কাঁদলে কিছু না বলে আমার হাতটা ধরেছিল। জানো, সেটাই ভালোবাসা, আদনান। নির্ভরতা… সম্মান… নীরব সঙ্গ।”

আদনান স্তব্ধ। তার চোখের দৃষ্টি নেমে গেলো নিচে। সে যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ খুঁজে পায় না।

নেহা ধীরে বললো,
– তুমি আমাকে চাও, আমি জানি। কিন্তু তুমি কোনোদিন আমাকে বুঝতে চাওনি। তুমি নিজের ভয়কে বড় করেছিলে, ভালোবাসাকে নয়।

তারপর একটু থেমে সংযত স্বরে বললো:
– তুমি যদি সত্যিই ভালোবাসো, তাহলে এবার আমার সিদ্ধান্তকেও সম্মান করতে শিখো। যা হারিয়ে গেছে, সেটা জোর করে ফিরে আনা যায় না। আমি আর সেই পুরনো নেহা নেই।

ঘরে নেমে এলো এক নিস্তব্ধ, তীক্ষ্ণ নিঃশ্বাসের সময়।

হায়াত দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো, আর আদিব… সে নিচু চোখে, বিস্ময়ের ছায়া নিয়ে, শুধু একবার নেহার দিকে তাকালো— যেন তার হৃদয় এক নতুনভাবে বুঝলো পুরনো কোনো ঋণের শেষ বাক্য।

নেহার কথাগুলো যেন বুকের ভেতর ঘুষির মতো লাগছিল আদনানের। তার চোখে লজ্জা, অনুশোচনা আর হারানোর ভয় মিশে একাকার।

হঠাৎ সে ধীরে নেমে এল নেহার পায়ের কাছে। তার চোখে জল, গলা কাঁপছে। মাটিতে বসে, নিচু গলায় বললো:

– আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম, নেহা… একদম শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। দুনিয়াটা তখন আমার জন্যে অন্ধকার ছিল। আর ঠিক তখনই তুমি… তুমি হয়ে গিয়েছিলে অন্য মানুষ। সাইকোর মতো আচরণ করছিলে।

নেহার চোখ কপাল ছুঁইয়ে ফেললো।

– কি বললে তুমি?” — সে চেঁচিয়ে উঠলো, — আমি সাইকো হয়ে গিয়েছিলাম? আমি যাকে ভালোবেসে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম, সেই যখন আমাকে ছেড়ে গেলো, বিশ্বাসঘাতকতা করলো… আমি একটু কাঁদলে, প্রশ্ন করলে, নিজের যন্ত্রণার কথা বললে আমি সাইকো হয়ে যাই ?

তার গলা কাঁপছে— তীব্র অভিমানে।

– তুমি ভেঙে পড়েছিলে? আমিও তো মা-বাবাহীন, আদনান! আমি তো দিন-রাত প্রার্থনা করতাম, তুমি ফিরে আসো! তুমি শুনলে না, বুঝলে না… বরং আমার ব্যথাকেই দোষ বানিয়ে দিলে ?

আদনান কাঁপা গলায় বললো:
– আমি ভয় পেতাম… তুমি খুব আবেগী হয়ে পড়েছিলে… আমি তখন নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না—

– আর তাই পালিয়ে গেলে?” নেহা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো। “একটা আসল পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষকে দোষ দেয় না, পাশে দাঁড়ায়। তুমি সেটা পারোনি। এখন দয়া করে আমায় দোষ দিয়ে নিজের অপরাধ ঢাকো না।

আদনান চোখ মুছে, ফিসফিস করে বললো:
– আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি বুঝো… আমি তখন একা ছিলাম।

নেহা শান্ত গলায় বললো—
– আমিও একা ছিলাম। কিন্তু আমি ভালোবাসার মর্যাদা দিয়েছিলাম, তুমি দিয়েছিলে ব্যাখ্যা আর পালানোর যুক্তি।

তারপর সে এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো:
– উঠে দাঁড়াও, আদনান। আজ আমি তোমাকে মাফ করলাম… কিন্তু ফিরছি না। আমি কাউকে প্রমাণ দিতে চাই না, আমি এখন নিজের জন্য বাঁচি।

এইবার সত্যিই নেহা মুক্ত হলো— নিজের যন্ত্রণার শেকল থেকে, পুরনো ভালোবাসার ভাঙা প্রতিমা থেকে।

ঘরের উত্তেজনা তখনো কাটেনি। নেহা চুপ করে দাঁড়িয়ে, আদনান মাটিতে বসা, আর বাকিরা থম মেরে গেছে এই বিস্ফোরক কথোপকথনের পর।

ঠিক তখনই মিসেস অরোরা দাঁড়িয়ে উঠে গলা খানিকটা কঠিন করে বললেন—
– হয়েছে, এখন ঝগড়া থামাও।

তার গলায় ছিল কর্তৃত্বের রেশ, চোখে অনড় সিদ্ধান্ত।

– আজ থেকে আদনান আমার কোম্পানিতে জব করবে। ওকে আমি নিজে গাইড করবো। তোমরা দু’জন অনেক কিছু বললে একে-অপরকে, কিন্তু এখন সময় এসেছে নতুন করে শুরু করার। আমি তোমাদের বিয়ে দেবো… আর নেহা, তুমি এখানেই থাকবে। এই বাড়িতে।

ঘর মুহূর্তে থমকে গেলো।

নেহা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো—

– কি বললে তুমি ? খালামনি… আমি কখনোই রাজি হইনি…

আদিব এবার উঠে দাঁড়ালো, গলায় একরকম গোপন উত্তেজনা:
– মা কী বলছো, নেহা স্পষ্ট করে বলেছে ওর সিদ্ধান্ত…

কিন্তু মিসেস অরোরা ঠাণ্ডা গলায় থামিয়ে দিলেন,
– আমি সব শুনেছি, আদিব। কিন্তু কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়, কিছু সম্পর্ক ঠেলে নিতে হয়, বুঝলে? আমি জানি নেহা আর আদনানের সম্পর্কের গভীরতা, একটুখানি ভুল বোঝাবুঝিতে এমন কিছু হারানো উচিত না। আমি ভুলতে বলছি না, কিন্তু একটা সুযোগ দিতে বলছি—আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

নেহার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বললো—
– মনি তুমি কি আমার মতামত ছাড়া আমার জীবন ঠিক করে ফেললে ?

হায়াত ধীরে উঠে এসে পাশে দাঁড়ালো নেহার, তার হাতটা চেপে ধরলো।
– আপু, আপনি যা চাইবেন, আমরা সেটাই পাশে থেকে করবো।

নেহা চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য… তারপর ধীরে বললো—
– খালামনি, আমি তোমাকে সম্মান করি… কিন্তু আমি পণ্য না, যে কেউ চাইলেই জোর করে ফিরিয়ে নিতে পারবে। আমি কারও করুণা করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাই না।

তার কণ্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট:
– আমাকে এখানেই থাকতে হলে, আমার শর্তে থাকতে হবে। আর বিয়ের সিদ্ধান্ত আমার হবে… কারও চাপিয়ে দেওয়া না।

মিসেস অরোরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে চুপ করে গেলেন। এই মেয়েটা আর আগের নেহা নেই — সেটুকু তার চোখেই স্পষ্ট।

ড্রয়িংরুমের টান টান পরিবেশে হঠাৎ দরজার দিকে নজর গেল সবার। ধীর, ভারী পায়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন মিস্টার রাকিব চৌধুরী— সম্মানিত, রাশভারি, কিন্তু সবার প্রতি অদ্ভুত এক নরম স্বভাবের মানুষ।
তার মুখে চিন্তার রেখা, চোখে বোঝার চেষ্টা। তিনি সোজা নেহার কাছে এলেন। ঘরের মাঝে যেন কিছুটা ভার হালকা হয়ে গেলো তার উপস্থিতিতে।

নেহার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন—
– আম্মু… একবার, শুধু একবার শেষ সুযোগ দাও ওকে। আমি জানি, আদনান ভুল করেছে, কিন্তু এবার আমি নিজে দেখবো সবকিছু। যদি আবার কষ্ট দিতেই চায়… আমি নিজেই তোমাদের ডিভোর্স করিয়ে দেবো। কথা দিচ্ছি।

ঘরে নীরবতা। নেহা হতচকিত চোখে তাকিয়ে রইলো এই মানুষটার দিকে, যিনি কোনোদিন কিছু চাপিয়ে দেননি, বরং সবসময় পাশে থেকেছেন ছায়ার মতো।

আদনান উঠে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো—
– আঙ্কেল, আমি… আমি সত্যিই পালাতে আসিনি। আমি ঠিক করে নিতে চাই, নিজেকে… আর আমাদের।

মিস্টার চৌধুরী এবার তাকে কঠিনভাবে দেখলেন,
– তোমার শেষ সুযোগ এটা, বুঝেছো? ভালোবাসা কেবল পাওয়া নয়, সেটা ধরে রাখার যোগ্যতাও লাগে।

নেহার চোখে তখনো দ্বিধা। হৃদয়ের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল—অভিমান বনাম বিশ্বাস।

সে নিচু গলায় বললো,
– আপনি থাকেন আমার বাবার জায়গায়। তাই আপনার কথা ফেলতে পারি না। কিন্তু আমি কিছু বলার আগে সময় চাই… নিজের সঙ্গে, নিজের ভাঙা বিশ্বাসের সঙ্গে। একটা জীবন ফের ঠিক করার আগে একটু জিজ্ঞেস করতেই হবে—আমি নিজে ঠিক আছি তো ?

মিস্টার চৌধুরী মাথা নেড়ে বললেন—
– ঠিক আছে মা, সময় নাও। কিন্তু জানবে, কেউ যদি সত্যি তোমায় ভালোবাসে, সে অপেক্ষা করবেই।”

ঘরের বাতাস এবার কিছুটা শান্ত। উত্তপ্ত আবেগের পরে এক রকম ভারসাম্য ফিরলো—যেখানে সম্পর্কের চেয়েও বড় হলো নিজের সম্মান আর সিদ্ধান্তের অধিকার।একটু থেমে, একটু ভেবে… অনেক আবেগের যুদ্ধের পর, নেহা ধীরে মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলো। চোখে জল ছিল, কিন্তু সেই জলে ছিলো বোঝাপড়ার আলো, পুরনোটা ছেড়ে নতুনভাবে শুরু করার সাহস।

মিস্টার রাকিব চৌধুরী হালকা হাসলেন তৃপ্তির ছায়ায়, আর মিসেস অরোরা হাঁফ ছেড়ে বললেন,
– এই তো, আমার মেয়েটা ঠিক বুঝেছে।

আদনান কিছু বলার আগেই হঠাৎ আদিব হালকা দুষ্টু সুরে বললো,
– এই যে আদনান ভাই… আমার প্রাক্তনকে দেখে রাখবেন, ভালো করে !

ঘরের ভেতর তখন মুহূর্তে হালকা হাওয়া বয়ে গেলো।

হায়াত মুখ ঢেকে হেসে ফেললো, মিসেস অরোরা মুখে হাত দিয়ে বললেন,
– আদিব তুইও না !

নেহা একটু লাজুক হেসে মাথা চুলকালো, আর আদনান হেসে বললো—
– তোমার মতো আত্মীয় থাকলে কেউই একঘেয়ে জীবন পাবে না, বুঝেছো ?

আদিব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
– আমি তো থাকবই, আবার দুলাভাইও হয়ে যাচ্ছেন দেখি !

সবাই হেসে উঠলো।
কখন যেন কান্না, রাগ, অভিমান সব গলে গিয়ে জায়গা করে দিলো একটা নতুন গল্পের শুরুতে।

এটা ছিল সম্পর্ক ভাঙার পর গড়ার গল্প — যেখানে ক্ষমা শুধু একটা শব্দ নয়, বরং ভালোবাসার সবচেয়ে সাহসী রূপ।
আদিব হায়াতের দিকে একটু হাসি মিশিয়ে তাকালো, আর হায়াতের ঠোঁটের কোণে জমে থাকা ছোট্ট স্মিত হাসিটা যেন পুরো ঘরটাই উজ্জ্বল করে দিলো।

তারপর আদিব সবাইকে বললো,
– একটু চোখ বন্ধ করো সবাই।

সকলে অল্প অবাক হয়ে চোখ বন্ধ করলো। ঘরে একটা খুশির প্রত্যাশার নীরবতা নেমে এলো।
সেই সুযোগে আদিব দ্রুত হায়াতকে কোলে তুলে নিলো। হায়াত হালকা চমকে গেলো, কিন্তু চোখ বন্ধ রেখে হাসি ধরে রাখলো।

আদিব হায়াতকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। সিঁড়ি ধরে উঠে যেতে যেতে আদিব হালকা হাসি দিয়ে বললো,
— দেখি, ওদের কতক্ষণ চোখ বন্ধ রাখা যায়,চলো বউ।
– কোথায়।
আদিব কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো,
– রোমাঞ্চ করবো।
হায়াত পা ছুড়াছুড়ি করতে লাগলো,বললো,
– নামান আমাকে, প্লিজ নামান আমি এখন গোসল করতে পারবো না, ছাড়ুন আমাকে।
– হুসসস মার খাবা বেশি নড়াচড়া করবে তো ফেলে দেবো।
– উহু নড়বো না,কিন্তু নিচে নামান।
– না জান।
– আমার না জ্বর এসেছে দেখুন।
আদিব চমকিয়ে ওঠলো, হায়াতের কপালে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
– কোথায় পাখি,তোমার শরীর তো স্বাভাবিক।
– পেটে ব্যাথা খুববব।
– চলো কোনো রোমাঞ্চ করবো না,তুমি চুপ করে শুয়ে থাকবে,আমি গরম তেল আনছি মালিশ করে দেবো একটু পর।
– উহু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। হায়াত মনে মনে বললো,গোলামের পুত আমার তো কোনো ব্যাথায় নেই, তুই যেভাবে আদর করিস আমার তো মরে যাওয়ার দশা হয়, এই জন্যই বাধা দিলাম,হুহ।

এরই মাঝে আদিব আস্তেধীরে হায়াতকে শুইয়ে দিয়ে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিলো।কিছুক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল। মিনিট দশেক পর মুচকি হেসে লেপটপ অন করে ডিভানে বসলো। হায়াতও স্মিত হেসে ফেসবুক স্ক্রোল করলে। আরাবির সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করছিলো হায়াত।
aru baby : baby ki korchish… Romance sesh.🫣
Hayat : hoppp bedi,ami to suye asi. 😎
aru baby : keno dulur ota ki damage hoye giyeche, 🤧
Hayat : mair khabi,ami iccha korei bolechi amr pet betha, tai se amake rest nite boleche, 🫢
aru baby : awww tui o na🌝🌚
Hayat : he he😝😝

হায়াত খাটের এক কোণে শোয়ে, ফোনটা হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে, আবার কখনো কখনো চোখ কুঁচকে কিছু টাইপ করছে। আর ঠিক পাশের ডিভানে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো আদিব। সে মাঝে মাঝে হায়াতের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিলো, যেন বুঝতে চাইছে কী নিয়ে এত হাসাহাসি।

একবার হায়াত একটু গম্ভীর হয়ে গেলো। আদিব চোখ সরিয়ে ল্যাপটপে মন দিলো, কিন্তু একটু পর আবার বললো,

– আরাবি নাকি ?

হায়াত চমকে তাকিয়ে বললো,
– হু।
– নাকি অন্য কেউ।
– উহু দেখুন।
– না জান আমি তোমাকে বিশ্বাস করি,একটু ঘুমাও তারপর এগারোটার দিকে পড়তে বসাবো।
– আচ্ছা।
————

রাত এগারোটা। ঘরজুড়ে নীরবতা, শুধু ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। হায়াত ঘুমিয়ে আছে গভীর নিদ্রায়, মুখে প্রশান্তির ছায়া। ডান পাশে সজাগ ডিভানে বসে আদিব, ল্যাপটপে চোখ রেখে অফিসের কাজ দেখছে, চোখে কিছুটা ক্লান্তি, তবু মনোযোগী।

এই সময় হঠাৎ করেই দরজায় হালকা টোকা। আদিব তাকালো, দরজা খুলে গেলো, ভিতরে ঢুকলো নেহা আর আদনান।

নেহা হাসতে হাসতে বললো,
– তোমাদের বিরক্ত করলাম জানি, কিন্তু কিছু কথা এখনই বলা দরকার।
আদনান সাথেই যোগ করলো,
– বিয়ের সব অ্যারেঞ্জমেন্ট একেবারে পারফেক্ট করতে চাই। সময় খুব কম।

আদিব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো, চোখ সরিয়ে ঘুমন্ত হায়াতের দিকে একবার তাকালো যেন নিশ্চিন্ত হচ্ছে, তারপর বললো,

– এসো, বসো। কথা বলি। তোমাদের প্ল্যান শুনি।

ঘরের আলো একটু বাড়িয়ে দিলো আদিব, চারজনের চোখে তখন একসাথে ভাসছিল ভবিষ্যতের এক সুন্দর পরিকল্পনার ছায়া।

আদিব হালকা হেসে বললো,

– এই রাতে এসে এমন দাবি ?

নেহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– অ্যাই, এটা দাবি না, আমাদের বিয়েতে চমক! তুমি আর হায়াত স্টেজে কাপল ডান্স করবে, পুরো ফ্যামিলি সেটা দেখবে।

আদনান পাশে বসে মুচকি হেসে বললো,

– ভাই, রাজি হয়ে যাও। হায়াত তো লাজুক, তুমি না বললে ও রাজিই হবে না।

আদিব হেসে ঘুমন্ত হায়াতের দিকে তাকালো। ওর মুখে এখনও প্রশান্তি, ঠোঁটে হালকা হাসি। তারপর নিচু স্বরে বললো,
– ওকে জিজ্ঞেস না করেই রাজি হওয়া যাবে না। তবে আমি আপত্তি করবো না, যদি সে চায়।

নেহা বললো,
– তাহলে এখনই ওকে উঠিয়ে দিই ?

আদিব মুচকি হেসে হাত তুললো,

– আরে না না, ঘুমোতে দাও। কাল সকালে উঠেই ওকে বোঝাবো।

নেহা মজা করে বললো,
– তোমরা তো এমনিতেই সিনেমার মতো কপল, একটু নাচ দেখলে কি আর ক্ষতি!

ঠিক তখনই বারান্দা দিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে এলেন মিসেস অরোরা। হাতে একটি বড় ট্রে, যার ওপর ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার—পরোটা, চিকেন কারি, আর পাশে মিষ্টি সেমাইয়ের বাটি।

একগাল হাসি নিয়ে বললেন,
– রাত অনেক হয়ে গেছে, তোমরা গল্পে মগ্ন, কিন্তু পেট তো বোঝে না গল্প! আগে এটা শেষ করো।

নেহা উঠে গিয়ে মিসেস অরোরার হাত থেকে ট্রেটা নিলো,
– ওহ্ ওয়াও, তুমি না আসলে তো আমরা খেয়ালই করতাম না কত রাত হয়ে গেছে!

আদনান কৃতজ্ঞতা নিয়ে বললো,
– থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি, আপনি না থাকলে আমাদের তো উপোসেই রাত যেতো।

আদিব মিষ্টি হেসে বললো,
– মা সব সময় ঠিক সময়ে এসে হাজির হন, যেন জানেন আমরা কখন ক্ষুধার্ত।

মিসেস অরোরা হেসে ঘুমন্ত হায়াতের দিকে তাকালেন,
– আর আমার ছোট্ট পুতুলটা ঘুমাচ্ছে এখনও ? ওর জন্য খাবার আলাদা করে রেখে দিচ্ছি, জেগে উঠলে খেতে দিও।

তারপর সবার মাথায় স্নেহভরা চোখ বুলিয়ে বললেন,
– তোমাদের হাসি দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। থাকো একসাথে এভাবেই, আল্লাহ্‌ রাখেন তোমাদের।

মিসেস অরোরা দরজার দিকে পা বাড়িয়েই ছিলেন, হঠাৎ নেহার কথায় থেমে গেলেন।
নেহা ভ্রু কুঁচকে, চোখে একটু দুষ্টু অভিমান নিয়ে বললো,
– হ্যা খালামনি, হায়াত তো পুতুল… আর আমি? আমি সুন্দর না?

ঘরে এক মুহূর্ত নরম হাসির বাতাস বয়ে গেল।

মিসেস অরোরা ধীরে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন,
– ওহ্ মা! নেহা তুমি তো আমাদের রাজকন্যা! সুন্দর তো এমনভাবে যে, যার গালে রাগও টুকটুকে গোলাপি হয়ে ওঠে।

আদনান হেসে ফেলে বললো,
– এই জন্যেই বলি, খালামনি সবার কথা জানেন, আর সবার মন বুঝেন।

নেহা একটু ভিজে চোখে, একটু হেসে বললো,

– তোমার মুখে এসব শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।

মিসেস অরোরা কাছে এসে নেহার গালে হাত রাখলেন,

– তোমরা সব আমার সন্তান। হায়াত, তুমি, আদিব, আদনান—একজনও কম নয়। আর তুমি সুন্দর না বললে তো আয়নার ওপরই অভিযোগ উঠবে!

সবাই হেসে উঠলো। নেহা একটু হেসে চোখ নামিয়ে বললো,
– হিহি, তাহলে আমি রেগে ছিলাম না… হালকা রাগ ছিলো কেবল।

আদিব মজা করে বললো,
– এই ‘হালকা রাগ’ তো কখনো কখনো ঝড় হয়!

নেহা তৎক্ষণাৎ একটা কুশন ছুঁড়ে মারলো আদিবের দিকে—ঘরজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল।সকলের হাসি-ঠাট্টা আর গল্প শেষে একসময় ঘরটা আবার নিঃশব্দ হয়ে এলো। নেহা, আদনান, আর মিসেস অরোরা বিদায় নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজার খট করে লাগা শব্দে ঘরটা আবার শান্ত।

আদিব ধীরে ধীরে ল্যাপটপ বন্ধ করলো। চোখে-মুখে এখন ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু তাতে মিশে আছে একরাশ মমতা।

সে উঠে হায়াতের দিকে এগিয়ে গেলো। ঘুমন্ত হায়াত, মাথার একপাশে চুল এলোমেলো, ঠোঁটে হালকা হাসি—যেন কোনো স্বপ্নে ডুবে আছে। আদিব হালকা হেসে উঠে পড়লো, লাইট অফ করে ধীরে পাশে শুয়ে পড়লো। অন্ধকার ঘরে শুধু নিঃশ্বাসের সুর… আর তাদের ভালোবাসার নিরব উপস্থিতি।
আদিব চুপিচুপি পাশে বসে কপালের ভাঁজে একটা হাত রাখলো, তারপর মাথা নিচু করে হায়াতের কপালে একটা নরম চুমু দিলো।

নরম গলায় বললো,
– তোমার জন্যই তো সব কিছু সহজ হয়ে যায়… শুধু তুমি এমন নিঃশব্দে পাশে থেকো, ব্যাস।
আচমকা ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল।

আদিবের চোখ আধোঘুমে ছিল, হঠাৎই পাশে টের পেলো কিছু একটা অস্বাভাবিক।

হায়াত ধড়মড় করে উঠে বসেছে। চোখে জল, কাঁধ কাঁপছে—মুখটা থমথমে। নিঃশব্দে কান্না করছে সে, যেন ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।

আদিব সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে পাশে হাত রাখলো, ভয় আর চিন্তায় গলা কেঁপে গেলো তার—
– হায়াত ! কি হয়েছে জান ?

আদিব হায়াতকে বুকের কাছ থেকে একটু সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো, গম্ভীর কিন্তু নরম গলায় বললো,

– কি স্বপ্নে দেখেছ বলো আমাকে, হায়াত। এমন কাঁদলে আমারও কষ্ট হয়।

হায়াত মুখ নিচু করে চোখ মুছে বললো, কণ্ঠটা কাঁপছে,

– আ আব্ আপনি… আপনি আমাকে কিছু না বলেই কোথাও গিয়েছিলেন… আমি খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মতো ঘুরছিলাম… তারপর হঠাৎ দেখি, আপনি একটা মেয়ের সাথে… ওর হাত ধরে ঘুরছেন… হাসছেন… আমি দাঁড়িয়ে আছি একটু দূরে, আপনি একবারও ফিরে তাকালেন না।

কথা বলতে বলতেই গলা রুদ্ধ হয়ে এলো তার, চোখ দিয়ে আবার জল ঝরলো।

আদিব স্তব্ধ হয়ে গেলো কিছুক্ষণ, তারপর গভীর শ্বাস নিয়ে হায়াতের গাল দুটো হাতে ধরে বললো,

– তুমি জানো, আমি কী স্বপ্নে আসলেও করতাম ? আমি ওই মেয়েকে বলতাম—দেখো, আমার একটা লাজুকপাখি আছে, যার কান্না দেখলে আমার ভেতরটা কাঁপে। আমি তাকে একা রেখে কোথাও যাই না। আমি তো তোমার, হায়াত। আর তুৃমি…. #আমার_হায়াতি।

হায়াত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
– কিন্তু এতটা বাস্তব ছিলো স্বপ্নটা… আমি সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম..

আদিব হালকা চুমু দিলো তার কপালে, তারপর বললো,

– তোমার ভয়টাকে ভালোবাসা দিয়ে মুছে ফেলবো আমি।

চলো, এই বলে হায়াতের চুলের ভেতর হাত গুজে ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল আদিব। হায়াতও রেসপন্স করতে লাগলো। দুজনের মাঝেই উত্তেজনা বাড়তে লাগলো।আদিব আস্তে আস্তে পড়নের টি-শার্ট খুলতে লাগলো,হায়াত লাজুক মুখে আদিবের টাউজার খুলে দিলো,আদিব বাঁকা হাসলো, এরপর আস্তে আস্তে হায়াতের গলা জুড়ে ঠোঁট ছুইয়ে দিতে লাগলো।হায়াত মিন মিন করে বললো,

– আস্তে , ছিড়ে যাবে পড়ে।
_ ……….

কে শুনে কার কথা, আদিব আনমনে তার কাজ চালাচ্ছে।

বারোটা বিশ…..

আদিব হায়াতকে ওপরে বসালো,হায়াত কাপা কাপা গলায় বললো,
– আমি কিভাবে পারবো….
– পারবে আমি শেখাবো।

এরপর আদিব একটু ওঠে হায়াতকে আদিবের ওপর ঠিক করে বসালো,আস্তে করে প্রাণ শিখাটা হায়াতের রতি কুঞ্জে বসিয়ে দিলো,হাস্কি স্বরে বললো,
– বউ শুরু করো।
হায়াত আস্তে করে চোখ বন্ধ করে কাজ শুরু করলো।ঘন্টা দুয়েক পর আদিব হায়াতের ওপরে ওঠে ভালোবাসার সুধা-সিঞ্চয় শুরু করলো,তাদরের মিলন ছিলো আগুনে ঘনিয়ে ওঠা এক মৌন সঙ্গিত,এই রাতটা ছিলো যেনো শরীরীী তৃষ্ণায় ভেজা রাত।

———
সকাল আটটা। ফরয গোসল সেরে একতলায় নেমে এল হায়াত। ভেজা চুলে আলতো কাঁধ ছুঁয়ে আছে পানির ফোঁটা। চোখে মুখে একধরনের প্রশান্তি, ঠোঁটে মুচকি হাসি—যেন নতুন দিনের শুরুতে নিজের ভেতরের আলো নিয়েই নেমে এসেছে।

কিচেন রুমে ঢুকে চারপাশটা একবার চোখ বোলালো। চায়ের কেটলি ফোটার শব্দ, ছাঁকা রোদের মতো হালকা ভাপ, আর মাটির কাপের মতো পরিচিত গন্ধে দিনটা যেন একটু বেশি আপন লাগছিল।মিসেস অরোরা কিচেনের দরজায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হায়াতকে ভেজা চুলে, হাসিমুখে ঢুকতে দেখে একগাল হেসে বললেন,
— আহা, এই তো আমার আদরের হায়াত বুড়ি । সকাল সকাল যেন ফুল ফুটে উঠেছে মুখে।

হায়াত একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো, চুলের ভেজা কোঁকড়ানো অংশটা গাল ছুঁয়ে গেলো।

মিসেস অরোরা এগিয়ে এসে বললেন,
— চা বসিয়ে দিছো ? আজ তোমার হাতের আদা চা খেলে আমার সকালটা ভালো যাবে।

হায়াত হেসে জানালো,
— আজ আমি একাই রান্না করবো, আপনি শুধু বসে বসে দেখবেন আম্মু।
– পারবে তো।
– হ্যা আগে টুকটাক করেছি।

শাশুড়ী বৌমার কথা আর খুনসুটির মাঝেই নেহা আসলো,চোখে হালকা ঘুমের রেশ,হায়াতের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বললো,

– হায়াতি মেডাম আজ আদিবকে একটু বেশিই আদর করে দিও, রাতে তোমাকে ও ঘুমোতে দেয়নি মনে হয়!

হায়াত লজ্জায় হেসে বললো,
– নেহা আপু…

আর মিসেস অরোরা হাসতে হাসতে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করতে লাগলেন।নেহা হেসে ডইংরুমে চলে গেলো।
মিসেস অরোরা নরম গলায় বললেন,
– বউমা, একটু সেমাইটা রান্না করো তো। বাকি সব আমি করে ফেলি। আজ আদনান আর নেহার বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে নেহার দাদু-দাদি সিলেট থেকে আসবেন।

হায়াত চমকে তাকালো,
– সত্যি ? আজই ?

মিসেস অরোরা হেসে মাথা নেড়ে বললেন,

– হ্যাঁ, আজই। সকালেই ফোন দিলেন, বললেন দুপুরের মধ্যেই পৌঁছাবেন। তাদের জন্য কিছু ভালো-মন্দ বানাবো, আর একটু মিষ্টিমুখ না হলে চলে?

হায়াত বুঝে গেলো দিনটা কতোটা বিশেষ। হালকা একটা উত্তেজনা আর দায়িত্বের ছায়া নেমে এলো তার চোখে মুখে। সে বললো,
—ঠিক আছে আম্মু , আমি সেমাই বানিয়ে দিচ্ছি। এলাচ-দুধ সব আছে তো ?

মিসেস অরোরা মজা করে বললেন,
— সবই আছে, শুধু তোমার সেই জাদু হাতটাই লাগবে আম্মু।

হায়াত হেসে চুলটা পেছনে গুঁজে কিচেনে কাজে নেমে পড়লো।

মিসেস অরোরা একটু দরজার বাইরে গেলেন কারো ফোন ধরতে। এদিকে হায়াত কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলো। একহাতে চামচ নেড়ে দিচ্ছিল, আর অন্য হাতে এলাচ থেঁতো করছিলো।
মনটা একটু আনমনা ছিল… হয়তো আদিবের কথা মনে পড়ছিলো, কিংবা আজকের এই বিশেষ দিনের উত্তেজনায় একটু বেশি মগ্ন হয়ে গিয়েছিল।

হঠাৎ কড়াইয়ের নিচ থেকে জ্বলে ওঠা গ্যাসের তাপে দুধ উথলে উঠলো, আর মিনিট খানেকের মধ্যেই নিচে ধরে গেলো।

হঠাৎই একটা পোড়া গন্ধ ভেসে এল বাতাসে।

হায়াত চমকে উঠে দ্রুত চুলা বন্ধ করলো, কিন্তু ততক্ষণে কড়াইয়ের তলায় পুরু একটা পোড়া স্তর পড়ে গেছে। দুধের সাদা বাষ্পের ভেতরেও কালচে ছোপগুলো স্পষ্ট।হায়াত মাথায় হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

– হায় আল্লাহ আমার দুধ,ইস পুড়ে গেলো,আল্লাহ কি হয়ে গেলো,আম্মু ভাববে আমি কোনো কাজই জানি না,আমার বেলায়-ই কেন এমন হই, ইস এতোগুলা দুধ আমার।

ঘুম থেকে ওঠেই লাজুকপাখিকে রুমে না পেয়ে নিচে আসে আদিব,নেহার কাছে শুনে হায়াত রান্না করছে,রান্না ঘরের কাছে আসতেই হায়াতের আহাজারি কানে আসলো আদিবের। দ্রুত গতিতে হায়াতের কাছে এসে, তার বক্ষঃস্থলে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বললো,

– কোথায় পুড়েছে, দেখি জান কোথায় পুড়েছে দেখাও।

হায়াত হতবাক হয়ে আদিবের পানে চেয়ে আছে,আর আদিব…সে হায়াতের বক্ষঃস্থলে হাত দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে কোথায় পুড়ে গেলো।

আবারও বললো,

– জামা খুলো,দেখি কতোটুকু পুড়েছে।

– বা”লললললললললল,আমার না চুলোয় দুধ,সেগুলো পুড়ে গিয়েছি।

#চলবে,,,,,