আমার হায়াতি পর্ব-২৩

0
6

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ২৩
লেখিকা : #Nahar_Adrita

গাড়িটা চালিয়ে গেটের সামনে আসলো আদিব। হায়াত ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালো আদিবের দিকে,আদিব মুচকি হেসে আলতো করে পরশ একে দিলো হায়াতের গালে। হায়াত সামান্য হেসে গাড়ি থেকে নামলো,ড্রইংরুমে বসে আছে মিসেস অরোরা এবং রাকিব চৌধুরী। হায়াতকে দেখেই মিসেস অরোরা এগিয়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

” – মারে আর ভুলেও রাগ করে চলে যাওয়ার কথা ভাববি না।
– আম্মু আমার কোনো দোষ নেই, ওনিই আমাকে চলে যেতে বলেছি।

মিসেস অরোরা হায়াতের গালে হাত রেখে,
– আমার ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে, ওর রাগের মাঝেই তোর জন্য অনেক ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, বুঝলি।
– হু……
রাকিব চৌধুরীও হায়াতকে কিছুক্ষণ বুঝালেন,আদিবের প্রজেক্টের কাজে কানাডা যাওয়া কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট, হায়াত মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে গেলো,এমন সময় দরজা খুলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো আদিব। রাকিব চৌধুরী কড়া গলায় বললেন,
– হায়াতকে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলে কোন সাহসে,ও এই বাড়ির বউ নয় বরং।
– বাবা আমি রাগের মাথায় বলেছিলাম আর ও সেটা সিরিয়াস নিয়ে ফেলেছে।

মিসেস অরোরা আদিবের কান মোলে দিয়ে বললো,
– আদিব তুই কখনো আমার মেয়েকে চলে যেতে বলবি না।
– আচ্ছা মা কান-টা ছাড়ো ব্যথা লাগছে।
– অরো হয়েছে ওর ফ্লাইট ১২ টাই এখন ছাড়ো খাবার দাও।
– হ্যা খাবার নিয়ে যা তোর আর হায়াতের।
– হুম…

এদিকে হায়াত আদিবের জন্য বেছে বেছে টিশার্ট শার্ট প্যান্ট সব ভাজ করে লাগেজে রাখছে। আদিব এসে হায়াতকে সব গুছিয়ে রাখতে দেখে প্রশান্তি পেলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– ম্যাডাম সব গুছিয়ে দিচ্ছেন।
– হু, আর কি কি লাগবে বলুন আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
– আর কিচ্ছু লাগবে না পাখি,এখন আপনাকে লাগবে,খুব কাছে চাই।

আদিব আলতো হাতে হায়াতের উদরে হাত রাখলো,হায়াত তখনি চোখ বন্ধ করে আদিবকে থামিয়ে দিলো।
– কি হলো জান।
– বাথরুম থেকে আসি…..
– চলো আমিও যাবো৷
– ছ্যাহহ, লজ্জা শরম বলতে কিচ্ছু নেই আপনার।
– ধুর বউয়ের সাথে আবার কিসের লজ্জা।
– হয়েছে সরুন আমার লাগামহীন পুরুষ।



হায়াত আসতেই আদিব তাকে কোলে নিয়ে লাইট অফ করে দিলো,হায়াত একটু ঘাবড়িয়ে গেলো
– একি লাইট অফ করলেন কেনো, আর এক ঘন্টা পরই তো আপনার যেতে হবে।
– হু এর জন্যই বউকে শেষ বারের মতো আদর করছি…

হায়াত ডুকরে কেঁদে উঠে,
– আপনি চলে গেলে আমি কিভাবে নিজেকে সামলাবো।
– আমারে পড়লে মনে, তুমিও কাইন্দো গোপনে….সুখে থেকো প্রাণের প্রিয়, আমার ভালোবাসা নিও।

বেশ কিছুক্ষণ হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো সে,যেন ছেড়ে দিলেই কোথাও হারিয়ে যাবে। হায়াতের কান্নার বেগ বাড়তে শুরু করলো, লাজুকপাখির সাড়া মুখে পরশ একে দিতে লাগলো আদিব। চোখ মুছে দিয়ে বললো,
– জান কথা দিচ্ছি কাজ শেষ না হলেও মাঝখানে একবার আসবো।
– সত্যি !
– হুম পাখি।


রাত এগারোটা। সবাই জড়ো হয়েছে আদিবের ঘরে। আর ঘণ্টা খানেক পরই তার ফ্লাইট। একটু আগেই আদিবের চাচি চাচ্চুরা এসেছে। মিনহাজা আর নুপুর প্রাণপণ চেষ্টা করছে হায়াতের কান্না থামাতে। রাকিব চৌধুরী ধৈর্য ধরে ছেলেকে সব বুঝিয়ে বলছে।আর চাচা আরিফ চৌধুরী সম্মতি জানাচ্ছে।
মিসেস অরোরা ইশারায় সকলকে রুম থেকে বাইরে যেতে, কেননা হায়াত আর আদিবকে আলাদা ভাবে কিছু সময় কাটাতে দেওয়া উচিৎ। সকলে বেড়িয়ে যেতেই আদিব দরজা লাগিয়ে দিলো। হায়াত তখনো মুখ গুজে কান্না করছে। আদিব হায়াতের পাশে বসলো। আদিবের বুকে ঠায় পেয়ে হায়াত আরো জুড়ে জুড়ে কান্না করছে।

আদিব আস্তে করে হায়াতের অধরে নিজের অধর পুড়ে নিলো, দুজনই সমান রেসপন্স করতে লাগলো। হায়াতের হেঁচকি কিছুটা কমে এসেছে। দুই হাত দিয়ে লাজুকপাখির মুখ ধরলো,হায়াতের দিকে তাকিয়ে আদিবের কলিজা ছ্যাত করে ওঠলো,বুকের বা পাশটা কেমন যেনো করে ওঠলো,হায়াতের চোখ ফুলে গিয়েছে আর নাক গাল লাল হয়ে গিয়েছে কান্না করে। আদিব কাঁপা গলায় বললো,
– পাখি এতো কান্না করলে আমি কিভাবে থাকবো বলো তো।
– আপনি আমাকে কতোখানি ভালোবাসেন…
– আমি তোমায় ভালোবাসি লবণের মতো,
যেমন লবণ ছাড়া কোনো রান্নায় স্বাদ আসে না,
ঠিক তেমনি তোমাকে ছাড়া আমার জীবনে নেই কোনো আস্বাদ, নেই কোনো পূর্ণতা।
– খুব ভালোবাসি…. অনেক গুলা ভালোবাসি, সবটুকু আপনাকেই বাসি ভালো।
– আমিও জান। এখন কান্না থামাও আমাকে অনেক গুলো হাম্মি দাও তো।
– কোথায়…
– বউ তুমি দেখছি এখন দুষ্টু হয়েছো। আচ্ছা যেখানে বলবো সব জায়গায় দিবে তো।
– হু আমার স্বামী যেখানে বলবে সেখানেই দেব।

হায়াত আদিবের সঙ্গে নিচে আসলো। সকলের কুশল বিনিময় করে আদিব লাগেজ হাতে নিল৷ হায়াত চুপচাপ সোফায় বসে আছে, মিনহাজা আর নুপুর হায়াতের বসলো,হায়াত স্মিথ হাসলো। যে হাসির হাসির আড়ালে ছিলো একরাশ কষ্ট। সকলে আদিবকে এগিয়ে দিতে বাহির অব্দি গেলো, কিন্তু হায়াত সোওায় ঠায় হয়ে বসে রইলো। আদিবের সাথে রাকিব চৌধুরী এবং আরিফ চৌধুরী এয়ারপোর্ট অব্দি যাবে, দুজনেই আদিবের পাশে বসলো,আদিব গেটের আশে পাশে তাকালো কিন্তু হায়াতকে দেখতে পেলো না, মনটা ভিষণ ছটফট করতে লাগলো, সহ্য করতে না পেরে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। রাকিব চৌধুরী পিছু ডাকলেন,
– আদিব নামছো কেনো ফ্লাইট মিস হবে তো দেরী হলে।

আদিব দৌড়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো, সকলে তার পেছন পেছন যেতে লাগলো। হায়াত এখনো মুখ গুজে ড্রইংরুমে বসে আছে, আদিবকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে দাড়িয়ে গেলো। সে এক দৌড়ে এসে তার লাজুকপাখিকে কোলে তুলে সাড়া মুখে চুমু দিতে লাগলো,আদিবের চাচি এদের ভালেবাসা দেখে চোখ মুছলেন, সকলের চোখের কোনে জল।

” হোক না ছয়মাসের দূরত্ব, কিন্তু যে যাকে ভালোবাসে সেই একমাত্র জানে, ছয়মাস তার কাছে ছয় বছরের সমতুল্য। ”

হায়াত পরম যত্নে আদিবের চোখ মুছে দিলো। কাঁপা গলায় বললো,
– দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, যাচ্ছেন না কেনো।
– খুব মিস করবো তোমাকে পাখি, খুব।

হায়াত একটু কড়া গলায় বললো,
– এতো নাটক করলে বিজনেসের ক্ষতি হবে, আপনি কি চান আপনার জন্য চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির বদনাম হোক।
– না…..
– তাহলে যান,আমি আর কাঁদবো না, কান্না আসলেও গোপনে কাঁদব, আপনার সামনে আর দূর্বল হবো না।
– লাভ ইউ লাজুকপাখি।
– লাভ ইউ টু জান।
হায়াত আর আদিবের পবিত্র ভালেবাসার সাক্ষী উপস্থিত সকলেই হলো।সত্যিই আল্লাহ তাআলা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কতোই না মহব্বত তৈরি করে দেন।

গাড়িটি চলতে শুরু করলো, আদিব হায়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো আর হায়াতও যতো দূর অব্দি কালো গাড়িটি দেখা গেলো গেটের সামনে দাড়িয়ে রইলো। নুপুর মিষ্টি করে হেসে হায়াতকে ধরে নিয়ে আসলো। আদিবের কড়া আদেশ সকলের যতোই কাজ থাকুক না কেনো হায়াতকে একা রেখে এই বাড়ি থেকে এক চুলও কেউ নড়তে পারবে না। তাই মিনহাজা নুপুর চাচা চাচী সকলেই চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে।

রুমে এসে হাউ মাউ করে কাদতে লাগলো হায়াত। যে মানুষটাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও দূরে থাকে না আজ থেকে ছয় মাস অথবা এক বছর তাকে ছাড়াই একা থাকবো। মাথা প্রচুর ভারী লাগছে হায়াতের, গোসল করলে হালকা লাগবে। ঝর্ণা ছেড়ে তার নিচে বসে পড়লো। শরীরটা বেশ গরম হয়ে যাচ্ছে মনে হলো জ্বর এসে পড়বে।


এদিকে আদিব প্লেনে সিটে বসে আছে, একটুপরই ছাড়বে। মনে মনে ভাবছে হায়াতকে নিয়ে হাজারো কথা। কিছু একটা ভেবে ফোনটা হাতে নিলো,হায়াতকে সব জায়গায়ই আজকে সন্ধ্যার পর আর লাইনে দেখাচ্ছে না। সাত পাঁচ না ভেবে একটা কল করলো। কিন্তু রিং হওয়ার পরও ধরলো না।

হায়াত রুমে আসলো ভেজা শরীরেই। হঠাৎই ফোনের স্ক্রিনে জল জল করছে আদিবের নাম্বার, এক মিনিট আগে কল করেছিলো। হায়াত তাড়াতাড়ি জামা চেঞ্জ করে ফোনটা হাতে নিলো। মেসেঞ্জারে ঢুকেহ আদিবকে কল দিলো।
– হ্যা কল করেছিলেন….
– তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো বউ।
– এমনিই কান্না করেছিলাম না, তাই গলা বসে গিয়েছে।
– একটা ঔষধ খেয়ে নাও, নাহলে জ্বর আসবে।
– আচ্ছা। আপনি পৌঁছে আমাকে জানাবেন…
– আর….!
– আব্ আমি…অপেক্ষা করবো।
– চড় দেব চুপচাপ ঘুমাবা, কোনো রাত জাগা নেই ওকে,আমি এসে যেনো দেখি না চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে।
– হু…
– কি হু…
– হুম…..
– কি হুম বলো আচ্ছা ঠিক আছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে ……
– বউজান এখন ঘুমান অনেক রাত হয়েছে সকালে পৌঁছে আপনাকে সময় মতো কল দিব।
– আচ্ছা।

হায়াত চোখ বুঁজে বিছানায় শুইয়ে পড়লো, যাকে বলে জুড় করে ঘুমানোর চেষ্টা।

>

সকাল আটটা পঁচিশে, দীর্ঘ ভ্রমণের অবসান ঘটিয়ে আদিব এসে পৌঁছাল কানাডার এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে মৃদু জমে থাকা সকালের কুয়াশা আর নরম সোনালি আলো যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো, টানা ছয় ঘন্টা জার্নি করে শরীর আর চলছে না।

ঘুম থেকে ওঠেই হায়াতের ভীষণ মনে পড়ছে আদিবকে। ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে, ভাবছে পৌঁছে গিয়েছে নাকি। মিনিট পাঁচেক পর সাহস করে কল করলো আদিবকে।

এদিকে লাজুকপাখি কল করেছে দেখে খুশিতে আত্নহারা আদিব। রিসিভ করতেই যাবে এমন সময় দরজায় নক পড়লো,কলটা কেটে দিয়ে আদিব দরজা খুলে দিলো, দেখলো কিছু গার্ডস আর ক্লায়েন্ট এসেছে, মুচকি হেসে তাদের বসতে বললো।

আদিব কল কেটে দিতেই হায়াতের মনে খারাপ লাগা শুরু হতে লাগলো। কিছু না ভেবে একের পর এক কল দিতেই লাগলো। আদিবের রাগে গা জ্বলে উঠে, এতো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের ব্যাপারে কথা বলছে আর হায়াত কিনা বিরক্ত করছে। ফোন্টা বন্ধ করে ফেললো আদিব,এরপর কথা বলতে লাগলো।

হায়াতের বুকের মাঝে ছ্যাত করে ওঠলো, সে বাড়ে বাড়ে কল দিচ্ছে বলে আদিব ফোন বন্ধ করে ফেললো,রাগে দুঃখে ফোনটা নিজেও বন্ধ করে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলো, এক সপ্তাহ পরেই তার পরীক্ষা। ফোনটা রেখেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মিসেস অরোরা জোড় করে একটু পাস্তা খাইয়ে দিলো। বাড়ির গাড়ি নিয়েই রওনা হলো হায়াত।

কথা শেষ হতেই সকলে চলে গেলো, আদিব কপাল স্লাইড করে ডিভানে গা এলিয়ে দিলো। ফোনটা অন করলো, কিন্তু হায়াতকে কল করতেই দেখে হায়াতের ফোন বন্ধ। মাকে ভিডিও কল দিয়ে সবার সাথে কথা বলে জানতে পারলো হায়াত ঘন্টা খানেক হবে কলেজ চলে গিয়েছে। বুঝতে আর বাকি রইলো না তার বউ রাগ করেছে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফুঁকে চোখ বন্ধ করলো, কিন্তু নাহ কিছুতেই আদিবের ঘুম আসছে না, এতো টায়ার্ড তবুও ঘুম আসছে না কেনো, কিছু না ভেবে আরাবির আইডিতে ঢুকলো, হ্যা আরাবিকে একটিভ দেখাচ্ছে।

এখন দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট, ক্লাসে স্যার নেই, হায়াতের মুড ঠিক করার জন্য ফেসবুকে ফানি ভিডিও দেখছিলো দুজন। হঠাৎ করেই সাদাদ আদিব চৌধুরী আইডি থেকে মেসেজ আসলো …..

– স্যার না থাকলে কল দাও।

হায়াত মেসেজটা দেখে মুখ কুচকে ফেললো,আরাবি মুচকি হেসে ভিডিও কল দিয়ে ওপাশে ক্যামেরা ঘুরালো,হায়াতের কুঁচকানো মুখ দেখে আদিব হাসবে না রাগ করবে বুঝতে পারলো না। আরাবিকে বলল হায়াতের হাতে ফোনটা দিতে।

হায়াতের ঠোঁট কাপঁছে কিন্তু চোখে এক রাশ অভিমান। আদিব ডাকতে লাগলো,
– ওই বউজান রাগ করে না প্লিজ,লক্ষীটি।
_………
– বউ কথা বলো,দেখো না জান আমার ঘুম প্রয়োজন একটু ভালোবেসে কথা বলো নাহলে আমার ঘুম আসবে না প্লিজ,মরেই যাবো একটু কথা বলো,ক্লায়েন্ট এসেছিলো স্যরি জান।
– হয়েছে আর নাটক করতে হবে না ঘুমান।
– ছিহ আফরা ছিহ, আমার ভালোবাসাকে তুমি নাটক বলছো।

হায়াত এবার আরাবির দিকে তাকালো দুজনই হো হো করে হেসে ফেললো,আদিব যেনো এবার একটু শান্তি পেলো,দম্পতিকে আলাদা স্পেস দিতে আরাবি ওঠে ক্লাসের বাইরে চলে গেলো।

আদিব হায়াতের দিকে একটু রাগী চোখে তাকালে,হায়াত ভেঙচি কাটলো। চুল গুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করতে করতে বললো,

– বউ ফোন বন্ধ কেনো।
– এমনি আমার ইচ্ছা….
– তোর ইচ্ছাকে আমি কচুর লতি বানাবো,ছাগল একটা।এভাবে কেউ ভয় দেখায়, আমি আর একদিন তোর মোবাইল অফ দেখবো তো তোকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিব।
– হ্যা মেরে ফেলুন, আমাকে তো একটুও ভালোবাসেন না।
– আচ্ছা পাখি রাগ করে না, গালটা একটু সামনে আনো তো।
– কেনো ?
আদিব একটু ইশারা করলো,হায়াত ফোনের একটু কাছে গাল এগিয়ে দিলে,আদিব এক সাথে অনেক গুলো চুমু দিতে লাগলো হায়াতকে।হায়াত মুখে প্রশান্তির এক অজানা হাসি ফুটলো। কল কেটে দিয়ে হায়াত ক্লাসে মন দিলো। আদ আদিবও ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

——

বিকেল সাড়ে চারটা হায়াত কলেজ শেষে বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। গোসল করে ডিভানে বসে আদিবের সব গুলো জামা কাপড় ভাজ করে রাখছে,এমন সময় আদিব কল করলো,
– জান আলমারি থেকে ল্যাপটপ বের করো।
– কেনো ?
– এতো প্রশ্ন করে না যাও, যা বলছি তাই করো।
– হু।

ল্যাপটপ বের করতেই আদিব বললো ল্যাপেটপ অন করতে, এই বলেই কল কেটে দিলো,হায়াত ল্যাপটপ অন করলো,আদিব হায়াতকে দেখে নিজেকে হালকা করলো,হায়াতও আদিবের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফুঁকে হায়াত চোখ নামিয়ে ফেললো,আদিব দুষ্টু হেসে বললো,
– বউ দরজা লাগিয়ে আসুন…
আদিবের কথা মতো হায়াত রুমের দরজা লাগিয়ে ফেললো,আদিব নেশালো কন্ঠে বললো,
– খুলে ফেলো সব, আমি ভিডিও কল দিলে দরজা লাগিয়ে তারপর ওড়না ছাড়া সব কিছু ছাড়া থাকবে।
– হু।

আদিব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হায়াতের দিকে,আর হায়াত চুল গুলো সামনে দিয়ে চোখ নিচু করে ক্যামেরার সামনে বসে আছে। আদিবও নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেললো,হাস্কি স্বরে বললো,
– উফ তোমাকে ছাড়া আমি কিছাবে থাকছি একমাত্র আমিই জানি,চুল সরাও পাখি।

আদিবের কথা অনুযায়ী হায়াত লজ্জা মিশ্রিত মুখ নিয়ে সামনে দেয়া লম্বা চুল গুলো পেছনে দিয়ে ফেললো,আদিব আস্তে আস্তে হায়াতের চোখে চোখ রেখে হাতের কোমল স্পর্শে ক্রমশ আন্দোলিত করছিলো,হায়াত হা হয়ে তাকিয়ে রইলো,এক পর্যায়ে তাদের দেহের গভীর আবেগে কয়েক বিন্দু সাদা স্রোতে ভেসে এলো…….

আদিব স্ক্রিনে সময় দেখে নিলো আর দশমিনিট পরই মিটিংয়ে যেতে হবে। আদিব স্ক্রিনে কিছু জুড়ে জুড়ে শব্দ করে চুমু খেলো হায়াতকে। হায়াত মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো,আদিব ভ্রু কুচকে বললো,
– কি হলো মেডাম আপনি কি আপনার স্বামীকে ভালোবাসেন না ?
– বাসি তো অনেক গুলা….
– তাহলে চুমু দিন জুড়ে।

আদিবের কথা মতো হায়াত জুড়ে জুড়ে চুমু দিল।আদিব মুচকি হাসলো, মাথার চুল ঝাঁকিয়ে,
– যাও গোসল করে নামাজ পড়ে একটু ঘুমাবে, আমি এখন মিটিং এটেন্ড করবো।
– আচ্ছা, খেয়ে নিবেন।
– হুম জান, আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।

হায়াত গোসল করতে যাবে এমন সময় আদিবের আইডি থেকে মেসেজ আসলো,
– ফোন নিয়ে যাও ওয়াশরুমে।

হায়াত কপাল স্লাইড করে ফোন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, দুজন একসাথেই গোসল করলো।হায়াত চুল ভালো করে মুছে আসরের সালাত আদায় করে নিলো।এখন একটু ঘুম প্রয়োজন। তাই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো হায়াত।

আদিবও স্যুট পড়ে রেডি হয়ে অফিসে চলে গেলো। মনে মনে হাসলো,তার বউটা দিন দিন তার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে,কবে যে বাড়ি যাবো বউটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবো।



এভাবেই এক মাস পাড়ি হলো,হায়াতের এক্সাম কিছু কারণে পিছিয়ে গেলো,মন দিয়ে পড়াশোনা করছে সে।

একদিন সন্ধ্যা ছয়টা…..
হায়াত ঘুমের মধ্যেই কেমন করে ওঠলো।ধরপরিয়ে ওঠে বসে পড়লো,মুখে আওড়ালো ‘ আমার আব্বু, আব্ আব্বু আব্ আব্বু তো তোহ তোমার কিচ্ছু হবে না ‘ বলেই হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আদিবে মিটিং শেষ করে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়েছে, এখন ওঠে পর পর নয়টা কল দিলো হায়াতকে, কিন্তু হায়াত রিসিভ করছে না। চিন্তা হতে লাগলো খুব। নুপুরকে কল দিলো হায়াতকে ফোনটা দিতে, কিন্তু নুপুর জানালো হায়াত দরজা খুলছে না, কান্নার আওয়াজ আসছে শুধু। আদিবের ভেতরটা অস্থির হয়ে গেলো। পর পর আবারো এগারোটা কল দিতেই হায়াত রিসিভ করলো কিন্তু……
– আব্ আমার আমাহ্ আমার আব্বু, আমার আব্বুকে ও ও ওর্ ওরর ওরা নিয়ে গেলো,আমার আব্বু কই,আম্ আমার আব্বু কল রিসিভ করলো না কেনো। আমার আব্বু কোথায়,সিম বন্ধ কেন।

আদিব যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে, হায়াত কি বলছে এসব। ও এমন করছে কেনো,ততক্ষণে মিসেস অরোরা আদিবকে কল দিয়ে জানালো হায়াতের বাবা খানিকক্ষণ আগেই মারা গিয়েছেন,ওকে বলার সাহস পাচ্ছি না কেউ, বাপ ওকে আমরা কিভাবে সামলাবো, ও জানলে সহ্য করতে পারবে না। আদিব যেনো আবারও স্তব্ধ হয়ে গেলো, চোখের সামনে ভেসে ওঠলো হায়াতের বাবার মায়া ভরা মুখটা।

হায়াতকে কল দিলো আদিব।

হায়াত ততক্ষণে রুমের দরজা খুলে দিয়েছে নুপুর এসে দুধ দিয়ে গিয়েছে।

হায়াতের বার বার ওই স্বপ্নটার কথায় মনে পড়ছে, কিন্তু কেউ কল রিসিভ করছে না কেনো,আদিব ও কল কেটে দিলো কেনো। হায়াতের মাথায় ব্যাথা করতে লাগলো।আদিবের নাম্বারটা দেখে কল রিসিভ করলো,আদিব কাঁপা গলায় বললো,
– জান আমি তোমাকে একটা কথা বলবো প্লিজ ভেঙে পড়বে না…. খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,তোমার আব্বু আর দুনিয়াতে নেই,ওনি মারা গিয়েছেন,একটুপরই তার জানাযা।

কথাটা যেন হায়াতের রুহু জ্বালিয়ে দিলো,ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো….ততক্ষণে রুমে এসে পড়লো মিসেস অরোরা নুপুর মিনহাজা সহ সকলে, হায়াত….. আমার আব্বু বলেই জ্ঞান হারালো। সকলে কান্না শুরু করে দিলো,আদিব নুপুরকে কল দিলো, নুপুর চোখ মুছে বললো, ভাইয়া ভাবি জ্ঞান হারালো এইমাত্র৷

আদিব ফোনটা অভাবে রেখেই নিচে বসে চোখের পানি মুছলো।ইমারজেন্সি ফ্লাইটের টিকেট কাটলো,কল করে সব ব্যবস্থা করে নিলো।যাতে মাস খানিক পর এসেও আবার কাজ শুরু করা যায়।

এদিকে হায়াতের মাথায় পানি ঠালছে সকলে,তবুও জ্ঞান ফিরে না। হাত পায়ের তালু ঘষছে সকলে, বিশ মিনিট পর হায়াত চোখ খুলেই কান্না শুরু করলো,

– আমার বাবা,আম্মু…. মিসেস অরোরাকে জড়িয়ে ধরে বললো,… আম্মু আমার আব্ আব্বু আমার আব্বুর কাছে নিয়ে যাও না কেউ প্লিজ,আমার বাবা আমার বাবাকে আমি দেখবো,আমার আ্ আম্ আব্ আমার বাবাকে দেখবো কিছু হবে না তার।
– হ্যা মা যাবো তো আমরা চলো।

হায়াত যেন জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে, সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দুইবার হোটচ খেলো, পা কেটে রক্ত বের হলো, তাতে কোনো হুস নেই, হায়াতের পেছনে সকলে ছুটছে। গাড়ি স্টার্ট করলো রামু কাকা,রাস্তা যেন আজ শেষ হয় না।
হায়াতকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সকলে, হায়াতের মুখে এক বুলিই আমার বাবা বেঁচে আছে, আমার বাবার কিচ্ছু হয় নি।

সকলের চোখে পানি এসে গেলো হায়াতকে কিভাবে সামলাবে তারা।

গাড়িটি এসে থামলো উলাইল।টিনের গেটের ভেতরে থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।

হায়াত দৌড়ে ভেতরে গেলো,হায়াতের চাচা দোয়ারে শুয়ে কাঁদছে,সকলে তাকে সামাল দিচ্ছে,বাড়ির ওঠানে হায়াতের মা আলিয়া বেগম আকাশ কাঁপিয়ে কান্না করছে। হায়াতের ছোট্ট ভাই আমার আব্বু কই বলে কান্না করছে। হায়াত দৌড়ে মার কাছে গিয়ে দাপিয়ে কান্না করতে শুরু করলো,

ও মা মা গো আমার আব্বা কই,আমার বাজান কই গেলো,আল্লাহ আমার আব্বারে কেন নিলো,আমার বাপটা সুখের মুখ দেখি,কে মারলো আমার আব্বুরে,আমার বাবা, আমার বাব বাবা ও বাবা তুমি কই গেলা,তোমার আফরা কিভাবে থাকবে।

হায়াতের মা জ্ঞান হারালো মেয়ের আহাজারিতে। সকলে তাকে ধরাধরি করে আবার মাথায় পানি দিচ্ছে, হায়াতের মাথায় চাপ পড়তে শুরু করলো……

সাদা কাফনের পাশে শুয়ে আছেন হায়াতের বাবা। শীতল পানির ধারা বয়ে যাচ্ছে তাঁর নিথর দেহে। কাঁপা হাতে নিজের ছোট ভাইকে গোসল করাচ্ছে মোতালেব সিকদার—প্রতিটি স্পর্শে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।

এদিকে হঠাৎ বুকের ভেতর জমে থাকা কান্না আর কষ্টের চাপ সামলাতে না পেরে হায়াতের নাক দিয়ে টুপটাপ রক্ত ঝরে পড়ল, পানির সাথে মিশে ধুয়ে গেল বাবার নিথর মুখমণ্ডল।

মিসেস অরোরা হায়াতকে সামলাচ্ছে,নুপুর নিজের ভাকির নাকের রক্ত ওড়না দিয়ে মুছে দিচ্ছে। হায়াতের বুক ফাটা আর্তনাদ গ্রামের সকলকে কাঁদাচ্ছে। মিস্টার রাকিব চৌধুরী ছেলের বউকে সামলাতে গিয়ে নিজেই চিৎকার করে কেদে দিলো। আদিবের চাচী মন শক্ত করতে হায়াতকে ধরে বুকে নিলেন,
– হায়াত কান্না করলে তোমার বাবা কষ্ট পাবে,তুমি বাবার জন্য দোয়া করো মা।

হায়াতের কান্নার বেগ আরো জুড়ে বাড়লো

– আমার বাবা,আমার বাবা,ও আব্বু দেখো তোমার মেয়ে পড়ছে, কতো সুখপ আছে তুমি তাও কেন চলে গেলা,মেয়েকে একা ফেলে কেনো চলে গেলা।

হায়াত শেষবারের মতো বাবার মুখের দিকে তাকাল। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন তার অন্তরের সাথে মিলিত হয়ে গভীর বেদনার আভাস দিচ্ছিল।হায়াত তার বাবার মুখে হাত রেখে পাথর গলায় বললো,

– চইলা গেলা তো আমারে রাইখা,আমারে এখন কে ভালোবাসবো,তুমি গেলা গা বাবা,ও বাবা চোখ খোলো না প্লিজ বলো, আফরা তোর জন্য চকলেট এনেছি।

—-
রাত নয়টা হায়াতের বাবার জানাজা সম্পন্ন হলো। হায়াত দাঁড়িয়ে রইল, চোখ ভরা অশ্রু আর হৃদয় ভেঙে যাওয়ার ব্যথায়, শেষ বিদায়ের মুহূর্তটি হৃদয়ে কাঁপুনি ফেলল।

কবর দেওয়া হলো…… চারপাশে কবরস্থানের শান্তি আর মৃদু বাতাসে মিলিত হয়ে একটা দুঃখময় নিস্তব্ধতা সৃষ্টি করল।

সারারাত দোয়ারে বসে কাদতে লাগলো হায়াত। নাক বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর চোখ দিয়ে পানি। পুরো রাত শেষ হলো।

সকাল ছয়টা আদিব বাংলাদেশে এসে পৌঁছালো। একটা পরিচিত ভাইয়ের বাইক নিয়ে উলাইল আসলো।টিনের গেট খুলতেই দেখতে পেলো সকলে কান্নায় আহাজারি ব্যস্ত । আর দোয়ারে বসে বাবার শার্ট বুকে নিয়ে আছে হায়াত, নাকে রক্ত গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। আদিব কিভাবে সবাইকে শান্তনা দিবে বা হায়াতকে সামলাবে কিচ্ছু মাথায় আসছে না।

হায়াতকে শক্ত করে বুকে চেপে মাটিতেই বসে পড়লো আদিব,হায়াত করুন চোখে তাকালো আদিবের পানে,আদিবকে পেয়ে মনে হলো দুনিয়া ধরে পেয়ে গেলো হায়াত,জুড়ে জুড়ে চিৎকার করে কাঁদছে হায়াত। আদিব হায়াতের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলছে,

– আমার পাখি আমার ময়না আব্বুর সময় হয়েছে তাই আল্লাহর কাছে চলে গেলো,তুমি অবুঝ না জান, তুমি কান্না করলে বাবা কষ্ট পাবে,তুমি আব্বুর জন্য দোয়া করবে, আব্বু তোমাকে এভাবে দেখলে তার রুহ যে শান্তি পাবে না।আমি এসে গিয়েছি তো আমার দুনিয়া কান্না করলে মাথায় চাপ পড়তে স্মৃতি চলে যাবে তোমার।

– আমি আব্বুর জন্য দোয়া করবো,আমার আব্বুর কবরের সামনে বসে আমি কোরআন তেলাওয়াত করবো,আব্ব আব্বু শান্তি পাবে।

– হ্যা পাখি আমিও পড়বো চলো।

এই বলে হায়াতের নাকের লেপ্টে থাকা রক্ত মুছে দিলো আদিব। দুজনেই মানুষটার কবরের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করলো,আদিব বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, হায়াত মাটি হাতদিয়ে কান্না করছে নয়তো কবর জড়িয়ে কাঁদছে। এভাবেই সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে লাগলো…………হায়াত মনকে স্থির করলো আর কাঁদবে না তার বাবা কষ্ট পাবে।

আদিব হায়াতকে নিয়ে বাড়ি আসলে,হায়াতের মা জায়নামাজে বসেই ডুকরে কাঁদছে, মিসেস অরোরা চোখের পানি মুছলো।

#চলবে…