#আমার_হায়াতি
পর্ব : ২৮
লেখিকা : #Nahar_Adrita
(প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। 🚫যারা আমার গল্প পছন্দ করেন না, তারা দূরে থাকুন।)
রুমে ঢুকেই যেন ঝড় বয়ে গেলো আদিবের ভেতরে। চোখ লাল, মুখ গম্ভীর, বুক ওঠানামা করছে দ্রুত শ্বাসে। আচমকা দেয়ালে জুড়ে এক লাথি মারলো সে। গম্ভীর শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো ঘর।
টেবিলের ওপর রাখা কাচের জগটা সে এক ঝটকায় ফেলে দিলো মাটিতে। মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো কাচের টুকরো, সারা ঘরে ঝনঝন শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। হায়াত এগিয়ে আসলো আদিবের দিকে, কাঁপা গলায় বললো,
– আব্ আপনি এম..এমন করছেন…….
আদিব হায়াতের দিকে তাকালো, জুড়ে গলা চেপে ধরলো দুই হাত দিয়ে,
– চুপ , একটা কথাও বলবি না।রুম থেকে বের হ bloody fool !
এরপর হায়াতকে ছেড়ে দিয়ে সজোরে ডিভানে এক লাথি মারলো। ডিভান কেঁপে উঠলো প্রচণ্ড শব্দে, যেন আদিবের ভেতরের রাগ আর অস্থিরতা জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না।
বিছানার এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইলো হায়াত। শুধু চোখে চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠছিলো। বুক কেঁপে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে, তবু সে চুপ। একটিও শব্দ বের হলো না।
ভয়ের কারণে হায়াতের কণ্ঠ যেন গলায় আটকে গেছে। মনে হচ্ছিলো, যেকোনো ভুল শব্দ হয়তো আবার ঝড় ডেকে আনবে। তাই শুধু স্থির দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো আদিবের দিকে।
হায়াত তখনো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলো, শরীরটায় ভয় যেন জমাট বেঁধে আছে। মুহূর্তেই আদিব ঝড়ের মতো এগিয়ে এসে তার কোমল গাল দু’হাতে চেপে ধরে গর্জে উঠলো,
– বাস্টার্ড ! তুই কোন সাহসে এসব করলি ?
আদিবের রাগী কণ্ঠে যেন পুরো রুম কেঁপে উঠলো। হায়াতের গাল লাল হয়ে ফুলে উঠলো, ব্যথার চাপ সামলাতে না পেরে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। শ্বাস নিতে নিতে আদিব যেন নিজের ভেতরের আগুন নিভাতে চাইছিলো। হঠাৎ নিচে ভাঙা কাচের টুকরো চোখে পড়তেই সেটা তুলে নিয়ে নিজের শরীরে চালাতে উদ্যত হলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে হায়াত দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আদিবকে।
– এমন করবেন না প্লিজ, আমি স্যরি।
– সর তুই আমাকে ধরবি না আর ওই হাত দিয়ে ।
আদিব হায়াতকে সরিয়ে ফেলতে চাইলো, হাত ছুঁড়ে দিতে চাইলো। কিন্তু হায়াত বুকের সব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রইলো স্বামীকে। শেষমেশ আদিবও ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলো। হায়াত আদিবের বুকে জড়িয়ে ধরে আছে চুপচাপ। আস্তে আস্তে বললো,
– আমার কথা শুনুন।
– কি ?
– আপনি যখন কাউকে ভালোবাসবেন… তখন এক বুক সমুদ্র নিয়ে ভালবাসতে হবে আপনাকে..নাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারবেন না………!!
ঘন্টা খানেক আগে……….
হায়াতকে প্রশ্ন করতেই হায়াত যেনো পুরো চুপ হয়ে গেলো।এমন সময় রাজ বাকা হাসলো,
– সাদাদ ওকে তুই চিনিস ?
আদিব একটু কপাল কুচকে বললো,
– এটা আমার বউ রাজ, ওকে চিনবো না মানে….আর তুই কিভাবে ওকে চিনিস ….?
আরাবি আর হায়াত দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, হায়াত ভায়ে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে মুখটা। আবারও রাজ বলে ওঠলো,
– হ্যা এই দুজনকে কালকে ওয়ার্শি ব্রিজে কান্না করতে দেখেছিলাম। ফুচকা খেয়ে যা তা অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো এই ছোট্ট মেয়েটার, আমি আবার এসেছিলাম অফিসের কাজে, তো হঠাৎ করেই ওদের অসহায়া ভাবে দেখে পানি দিয়ে এসেছিলাম। আগে যদি জানতাম এটা তোর ওয়াইফ তাহলে…..
আদিব একটু গম্ভীর মুখ করে রাজের দিকে তাকালো, রাজ মূহুর্তেই চুপ করে গেলো, আদিব হায়াতের দিকে তাকালো,
– তোমাকে রাস্তায় নেকাপ খুলে দাড়িয়ে পরপুরুষের সাথে কথা বলার জন্য অনুমতি দিয়েছি আমি ? আর কোনো পরপুরুষের সাথে রং তামাসা করার জন্য, জবাব দাও আমার।
হঠাৎ চেচিঁয়ে উঠে আদিব। বাড়ির সকলে ভয় পেয়ে গেলো। হায়াত মূহুর্তেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন সময় রাহেলা চৌধুরী বললেন,
– এটা কেমন অভদ্রতা দাদুভাই। বাড়ির সকলের সামনে বউকে এভাবে বকতে আছে ?
আদিব রাগে ফুসতে থাকলো,
– দাদি ও কোনো পরপুরুষের সাথে কেনোই কথা বললো বা পানি খেলো।
মিসেস পাখি অর্থাৎ আদিবের ফুপি বললেন,
– আরে কি মুশকিল রাজই তো পানি দিয়েছে, রাজের সাথে কথা বললে কি হবে বাজান,একটু সান্ত হ।
– ফুপিমা ওতো রাজকে চিনতো না তাহলে কেনো খেলো।
এই বলে আদিব হায়াতকে জুড়ে এক চড় মারলো। মিসেস অরোরা দৌড়ে এসে হায়াতকে বুকে চেপে নিলেন। রাজ বাকা হাসলো একটু পর নিজের রুমে চলে গেলো সকলে আদিবকে কথা শুনাতে লাগলো কিন্তু আদিব কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে সিড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেলো।
এখন……
হায়াত বুকে থেকে মাথা সরিয়ে, আদিবের চোখে চোখ রেখে বললো,
– এতো রাগ দেখাচ্ছেন কেনো, একটু পানিই তো খেয়েছিলাম।
– কেউ পানি দিবে আর খেতে হবে, পরপুরুষের হাতের পানিই কেনো।
– কি একটা কথা নিয়ে রাগ তার,আচ্ছা পানি খাওয়ার পর বাড়ি এসে তো ওয়াশরুমে গিয়েছিলামই, তো সেই পানি এখনো পেটে আছে নাকি ?
– আর বলেছিলাম না আমাদের শত্রুর অভাব নেই তবুও কেনো নেকাপ খুলে রাস্তায় তামাশা করতে হবে।
– স্যরি আর এমন করবো না।
আদিব আর হায়াতের চোখে চোখ রাখতেই যেনো রাগ গলে গিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণে পরিণত হলো। মুহূর্তেই আদিব হায়াতকে নিজের বুকে টেনে নিলো। হায়াত ভয়ে কেঁপে উঠলেও পালালো না, বরং নিঃশব্দে মাথা নামিয়ে দিলো।
আদিব ঠোঁটে ঠোঁট রাখে হায়াতের,হায়াত প্রশ্রয় দেয় তার শখের পুরুষকে।আস্তে আস্তে সময় গড়াতে থাকে, দুটি হৃদয় সম্পুর্ন পরিপূরক হয়ে ওঠতে ব্যস্ত।আদিবের গায়ের টি-শার্ট খুলে ফেললো হায়াত। আদিবও তার লাজুকপাখির পড়নের কাপড় আস্তে করে খুলে ফেললো,আলো আধারির খেলায় তার শরীর যেন ভাসছে নগ্ন জোয়ারে। আদিবের চোখ তৃষ্ণার্ত,
আদিবের ওষ্ঠ একে একে ছুঁতে লাগলো হায়াতের সর্বাঙ্গ।প্রতিটি ছোঁয়া যেনো ভালোবাসার সত্য, আহাজারি, ছন্দ। প্রতিটি স্পর্শ যেনো হায়াতের শরীর জুড়ে খেলা করছে,একটু পর পর কেঁপে ওঠে হায়াত।
আদিবের এক হাতের আঙ্গুল হায়াতের কোমড় থেকে আস্তে আস্তে একটানে নিচে চলে যায়। অন্য হাত বক্ষস্থল জুড়ে বিচরণ করছে। মুখ ডুবিয়ে দিলো সর্বাঙ্গে………… হায়াতও আস্তে আস্তে আদিবের শিশ্নে মুখ ডুবিয়ে দিলো । পরম আবেশে হায়াতের চুল গুলো চাপ দিলো সে। হায়াত চুপচাপ খেতে লাগলো। একটু পর আদিব কেঁপে ওঠে বসে পড়লো।লাজুকপাখিকে পরম আবেশে বুকের মাঝে ওঠিয়ে নিলো।
হায়াতের প্রতিটি নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে আদিবের বুকে। আদিব আস্তে আস্তে মত্ত হয় এক প্রেম লিলাময় খেলায়। আদিব ক্রমশ বাড়িয়ে দিলো ছন্দের জোয়ার।
হায়াতের চোখের কোনায় পানি জমে যাচ্ছে, মুখে হালকা ব্যাথাময় আওয়াজ। দুজনেই যেনো অমৃত সাগরের ঢেউয়ে মেতে ওঠলো।
বিছানার চাদরটা খানিক কুঁচকে গেলো,হায়াতের আঙ্গুল গেঁথে গেলো আদিবের পিঠে।হালকা কামড়ে ধরে তার কাধ।
আদিব হাস্কি স্বরে বললো,
– জান আরেকটু সহ্য করো প্লিজ। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই, পরে ঔষধ খাইয়ে দিবো। আপাতত আমাকে আর থামতে বলো না।
– আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে, আর সহ্য করতে পারছি না প্লিজ।
-You don’t stop in the middle of the game of desire. Tonight is all mine.
– আমি আর পারছি না আদি প্লিজ।
– হুসসসসসসস।
আদিবের প্রতিটি স্পর্শে হায়াত কেঁপে উঠছিলো,
স্নিগ্ধ অথচ গভীর এক আবেগে সে আদিবের কাছে আরও ঝুঁকে পড়লো,যেনো সে ভালোবাসার গভীরতম স্রোতে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দিলো।
হঠাৎ করেই নিস্তেজ হয়ে গেলো হায়াত। বেশ কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা বুঝতে পারলো আদিব। হায়াতের ওপর থেকে ওঠে বসলো আদিব । কপাল স্লাইড করে মনে মনে বললো,
– আজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে ওহ সিট। কি করলাম এটা।
শার্ট আর টাউজারটা পড়ে হায়াতকে ভালো করে শুইয়ে দিল। এরপর ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি এনে হায়াতের মাথায় পানি দিতে থাকলো। হায়াতের গাল বেয়ে পানি পড়ছে। আদিব লক্ষ করলো আজ বেশিই বাইটের দাগ হয়ে গিয়েছে হায়াতের পুরো শরীর জুড়ে।
*
*
রাত সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। হায়াতের জ্ঞান ফিরে এলো। আদিব তার পাশে বসে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
– আমার পাখি, কিচ্ছু হয় নি আমার সাপের বাচ্চাটার।
পরম যত্নে আদিব হায়াতের কপালে আলতোভাবে চুমু দিলো। ভয়ে কাঁপা হাত দিয়ে হায়াতের জামাটা ঠিক করে পড়িয়ে দিলো । হায়াত তার বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে রইলো। শরীর যেনো আজ একটু বেশিই দূর্বল হয়ে গিয়েছে।
আদিব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ঔষধ নিয়ে হায়াতকে খাওয়াললো। আলতোভাবে, যত্ন সহকারে। তারপর ধীরে ধীরে হায়াতকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে থাকলো।
রুমে শুধু হায়াতের নিঃশ্বাস আর আদিবের মৃদু শ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে—মুহূর্তগুলো ভরা ছিলো আশ্বস্তি, যত্ন আর গভীর স্নেহে।
******
মৃদু পদক্ষেপে আরাবি রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে এল। রিয়া, নুপুর আর মিনহাজার পাশে গিয়ে দোলনায় বসতেই গল্পের আবহ ছড়িয়ে পড়লো। হায়াত আর তার বন্ধুত্বের নানা খুঁটিনাটি কথা বলতে শুরু করলো ।
এমন সময় ছাদে প্রবেশ করলো রাজ আর আসিফ। দুজনকে দেখে মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়লো সবার, দুই ভাই এগিয়ে এল।
নুপুর আর রিয়া উৎসাহ নিয়ে সিলেটের সাদা পাথর নিয়ে প্রশ্ন করলো, আর রাজ গল্পে রঙ ছড়িয়ে দিতে শুরু করলো। মিনহাজা একটু সরে গিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলো।
এতোক্ষণ চুপচাপ গল্প শোনায় ডুবে থাকা আরাবির মনে হঠাৎ এক অদ্ভুত ঝড় উঠলো। মনে হলো আসিফ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দ্বিধায় চোখ তুলতেই চোখে চোখ মিললো দুজনের। মুহূর্তটা যেন হাওয়ায় ঝুলে রইলো।
পরক্ষণেই আরাবি নিজেকে মনে মনে ধমকালো,
– আরে ছেলেটার তো দুদিন পর অন্য কারো সাথে বিয়ে, আর আমি কিনা এমন কুনজর তাকাই ! ছিঃ আরাবি, ছিঃ।
নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে দোলনা ছেড়ে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। বাতাসে চুল উড়ছিলো, অথচ ভেতরে ভেতরে মনে হচ্ছিলো কিছু একটা অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।
আসিফ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
– মেয়েটার সাথে একটু কথা বললেই বা ক্ষতি কী! কী অদ্ভুত ব্যাপারটা, মাত্র একদিনেই যেন ওকে নিজের খুব কাছের মনে হচ্ছে…..…
ভাবনাগুলো আসিফকে আর আটকালো না। ধীর পায়ে আরাবির পেছন পেছন ছাদের অন্য কোণে এসে দাঁড়ালো সে। কিছু না বলে ফোনে স্ক্রল করতে লাগলো, যেন নিছক কাকতালীয়ভাবে পাশে এসেছে।
আরাবি প্রথমে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলো। চোখে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর অকারণে কেঁপে উঠলো মন।
আরাবি একটু কেঁপে উঠলো, ভয়ে গলা কাঁপতে কাঁপতে বললো,
– ও আল্লাহ, ভুত,না না জ্বিন।
জোরে চিৎকার দিতে যাবে, এমন সময় আসিফ ঠোঁট চেপে হালকা দাঁত কিঁচ মেরে বললো,
– আমি আসিফ। জলজ্যন্ত মানুষ, কোনো ভুত না… অভিসারিণী।
আরাবি ভুরু কুঁচকে তাকালো,
– বুঝতে পেরেছি মিস্টার ভুত। তবে আপনি এখানে কি করছেন? আর অভিসারিণী আবার কে ?
আসিফ ঠোঁটে একচিলতে বাঁকা হাসি খেলালো,
– কেনো, আপনি-ই তো মিসেস……
আরাবি বিরক্তি চেপে স্বরে বললো,
– মিস হবে, মিস আরাবি রাইবা।
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো আসিফ,
– ভাবীর সাথেই পড়েন, তাই তো?
– হু।
চুপচাপ স্থির হয়ে আরাবির দিকে তাকিয়ে রইলো আসিফ। দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছিল না কিছুতেই।
এমন সময় আচমকা তার ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে ঝলমল করছে লেখা, হবু বউ জান…
এক মুহূর্তেই আরাবির বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত শূন্যতা নেমে এলো। চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত, যেন দেখেও দেখেনি। ঠোঁট কামড়ে ভেতরে ভেতরে নিজেকেই ধমক দিলো,মনে মনে বললো,
– তুই পাগল হয়েছিস আরু, অযথা অন্যের ব্যক্তিগত পুরুষের হক নষ্ট করছিস। কেনো কথা বলতে গেলি তুই।
কিন্তু আরাবির মন যেনো কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না, মনযেনো বলে ওঠলো এটাই তোর জীবনের প্রথম ভালোলাগার পুরুষ।
ওদিকে আসিফ কল রিসিভ করে নিঃশব্দে কয়েক কদম দূরে সরে গেলো। ছাদের আলো-আঁধারি ভেদ করে তার কণ্ঠ ভেসে আসছিলো অস্পষ্টভাবে।
আরাবি সবার পাশে গিয়ে বসলো, হঠাৎ নুপুর উল্লাসিত কণ্ঠে ডাক দিয়ে বললো ,
– আরাবি, একটু কফি নিয়ে আসো সোনা। দেখবে রোজি খালা চা বানাচ্ছে, তুমি গিয়ে শুধু বলো আরেকটা কফি বানাতে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ছাদে উঠলেন আদিবের মা, চাচী আর ফুপি। আসিফের মা আরাবিকে বললেন,
– তোমার যেতে হবে না মা। আমি সবার জন্য নিয়ে আসছি। তুমি এখানে বসে গল্প করো।
আরাবি মুচকি হেসে সামান্য মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,
– না না আন্টি, আমিই যাচ্ছি। আপনি বসুন, সবার সাথে গল্প করুন।
*****
রাত নয়টা বেজে সাত মিনিট। হায়াত আর আদিব গোসল শেষে চুল আঁচড়ে নিলো, আদিব বাকা হেসে বললো,
– দেখেছো বউ জান, যতো বেশি আদর করবো ততো বেশি তুমি সুন্দর হবা।
হায়াত একটু কপাল কুঁচকে বললো,
– কেনো আমি কি সুন্দর না নাকি।
– না বউ তুমি অনেক সুন্দর তবে,তোমাকে আদর করলে ওইদিন একটু বেশিই সুন্দর লাগে।
– কচু লাগে,ফালতু লজিক।
– যাহ বউ আমাকে সম্মান দেয় নারে।
আদিব আলতো করে হায়াতের কপালে একটি মৃদু পরশ দিলো, এরপর এক গ্লাস দুধ হাতে নিয়ে সে বললো,
– ধরো খেয়ে নাও, কোনো কথা শুনবো না খেতে হবেই।
হায়াত লাজুক হাসি দিয়ে সেই দুধ খেয়ে নিলো, যেনো লক্ষি মেয়ের মতো শান্তি আর সন্তুষ্টি ভরে উঠলো তার ভেতরে।
দুধ খেয়ে হায়াত মাথায় ওড়না ঠিক করলো, তারপর আদিবের সাথে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
এদিকে আসিফ কল শেষ করে হঠাৎ ফোন কেটে দিলো। আসলে কলটি আসিফের হবু বউ হাফসা থেকে নয়, বরং তার মা দিয়েছিলেন। টুকটাক বিয়ের পোশাকের বিষয় নিয়ে কথা শেষ করে সে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।
আরাবি এক মনে গুনগুন করে নিচের দিকে নামছিল। হঠাৎ ওড়নার সঙ্গে পা বেজে দুটো সিড়ি পড়ে গেলো। ব্যথায় চিৎকার করতে করতে সে হাত বাড়ালো,
– আহ,,,,,, আমার পা!
আসিফ চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে নামলো। ঠিক তখনই আদিব আর হায়াতও ওপরে এসে উপস্থিত হলো।
হায়াত দ্রুত আরাবিকে উঠানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু আরাবির শরীরে হালকা ব্যথা থাকার কারণে নিচু হওয়া সম্ভব হলো না।
অবশেষে আদিব নরম কণ্ঠে বললো,
– আসিফ, আরাবিকে কোলে তুলে নিচে যা। আমি ডাক্তারকে কল করছি।
আরাবিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসিফ চুপচাপ আরাবিকে কোলের মধ্যে তুলে নিলো। আরাবি ব্যথায় আর লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলল।
হায়াত দ্রুত নিচে নেমে তেল গরম করতে আর সাথপ বরফ আনার ব্যবস্থা করল, যেন আরাবির ব্যথা কমানো যায়।
—
রুমে এসে আসিফ আরাবিকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর নরম কণ্ঠে বললো,
– দেখি, কতোটা ব্যথা পেয়েছেন।
আরাবি লজ্জায় চুপচাপ, চোখ বুজে বললো—
– না না, আমার কিছু হয় নি। দেখতে হবে না।
আসিফ কপাল কুঁচকে আরাবির পায়ের দিকে হাত বাড়ালো, নিঃশব্দে একটু প্লাজুটা উঁচু করলো, ব্যথা পরীক্ষা করতে। হঠাৎ আরাবির শরীরের সমস্ত লোম কাঁপতে লাগলো। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে চাদর আঁকড়ে ধরলো।
আসিফ লক্ষ্য করলো, আরাবির পা কিছুটা ফুলে গেছে, তাই সাবধানে আরও মনোযোগী হলো।
সেই সময় রুমে প্রবেশ করলো হায়াত, চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
– ভাইয়া, অনেক ব্যথা পেয়েছে নাকি ?
আসিফ সঙ্গে সঙ্গে প্লাজু ছেড়ে দিলো আর চুপচাপ রুমের দরজা দিকে সরে গেলো। ঠিক সেই সময় ডক্টর এসে উপস্থিত হলেন, সঙ্গে আদিবও।
আরাবি চুপচাপ বিছানায় বসে রইল, আর ততক্ষনে বাড়ির সবাই একে একে তার রুমে এসে হাজির হলো। রুমটি এখন ভরা ছিলো উদ্বেগ, সহানুভূতি এবং যত্নের আবহে।
ডক্টর কিছু ঔষধ দিয়ে চলে গেল, বাড়ির সবাই ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু আসিফ, নুপুর, হায়াত ও মিনহাজা রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল।
হায়াত খেয়াল করলো, আসিফ আরাবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আর আরাবি নিঃশব্দে বিছানায় আধশোয়া হয়ে নুপুরের পায়ের মলন লাগানো দেখছে,
আরাবি সামনের দিকে তাকাতেই আবারও চোখে চোখ আটকে গেলো। নিজেকে খানিকটা লজ্জাজনিতভাবে চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো।
আর হায়াত লক্ষ্য করলো, সে যা চেয়েছিলো তাই হচ্ছে। কিন্তু ভুল সময়ে…… তার মন একটি অদ্ভুত টান অনুভব করছে—যেনো সময়টা থেমে গেছে, অথচ চারপাশে নিঃশব্দে গভীর একটি আবেগের লুকোচুরি চলছে। এর শেষ পরিনতি কি হবে সামনে গেলেই জানা যাবে……
#চলবে
#আমার_হায়াতি
পর্ব : ২৯
লেখিকা : #Nahar_Adrita
চোখের পলকে কেটে গেলো আরও পাঁচ দিন; আগামীকাল হায়াত আর আদিবের দাম্পত্য জীবনের প্রথম এ্যানিভার্সারি।এই পাঁচ দিনের মাঝে আরাবির পায়ের ব্যথা পুরোপুরি সেরে গেছে।
রাত তখন দশটা পঁচিশ। শীতের দিনগুলো প্রায় শেষের পথে, হাওয়ায় বসন্তের হালকা গন্ধ মিশে আছে। হায়াত একা বসে তাদের বিয়ের দিন প্রথম তোলা ছবিটা হাতে নিয়ে ডুবে ছিলো স্মৃতির জগতে। ছবির প্রতিটা রঙ, প্রতিটা ভাঁজ যেন কথা বলছিলো তার সাথে।
ঠিক তখনই আরাবি রুমে ঢুকলো।স্মিথ হেসে বললো,
– কিরে জানু ভাইয়ার আর তোর ছবি নাকি ?
হায়াত ছবিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
– হু, এটা আমাদের বিয়ের দিনের ছবি। তুই যদি থাকতিস, তাহলে আরো অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা যেতো। আর মেডাম ছিলেন নানুর বাসায়। হাহহহ।
– আরে পাগলি রাগ করছিস কেনো, আবার বিয়ে করবি যখন বড় করে, তখন দেখিস এই আরাবি কতো কি করে জানুর জন্য।
– হয়েছে চাপা মা’রা বন্ধ করে বল, এতো রাতে আমার রুমে আসলি যে।
আরাবি বিছানায় শুয়ে বললো,
– কেনো আমি কি তোর রুমে আসতে পারি না জানু।
– উফ নাটক বন্ধ করে আসল কথা বল। সরাদিনে একবারো তো খবর নিলি না,নুপুরদের সাথেই ছিলি….
আরাবি ওঠে হায়াতকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আরে জানু রাগ করছিস কেনো, আমাদের ফ্রেন্ডশিপ সম্পর্কে সবাই তো জানেই। আমি তোর জানু, তোর ননদরা খুব ভালো অনেক ফ্রেন্ডলি… এর জন্যই তো ওদের সাথে একটু গল্প করি।
– হয়েছে আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না। এখন বল কি বলতে এসেছিস ?
– আব্ আমার পায়ের ব্যথা তো সেরে গিয়েছে, বলছিলাম কি কালকে আমি চলে যাবো… প্লিজ রাগ করিস না।
– হ্যা সেই তো আমার শশুর বাড়িতে তোর ভাল্লাগে না তাই না।
– আরে আরে এসব কি বলছিস জানু, তোর শশুর বাড়ি আমার খুব ভাল্লাগে আর আন্টি, আঙ্কেল, ভাইয়া আর এই বাড়ির সকলেই খুব ভালো।
– তাহলে চলে যাওয়ার কথা বলছিস কেনো।
– দেখ হায়াত আমি এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে, আবার এতো মেহমান রয়েছে সাথে আমি এক ঝামেলা তোরই এতো কিছু সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।
হায়াত বিরক্ত হয়ে ‘চ’ শব্দ করে বললো,
– আমি কি একবারও বলেছি, আমার এতো কিছু সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। আর তুই তো আমার জানু লাগিস কতো সুন্দর সব কাজেই হেল্প করিস।
– না তবুও…..
– চুপ কর তো, আর দুইদিন পরই তো আসিফ ভাইয়ার বিয়ে এখন যেতে চাচ্ছিস আবার পরশুদিন-ই তো আসতে হবে তোকে।
আরাবি আর কিছু বললো না চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
হায়াত ছবিটা রেখে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখলো। তারপর নিচে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে বের হতেই, হঠাৎ কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো। মাথায় হাত দিয়ে মুখটা কুঁচকে বললো,
– কোন খাম্বার সাথে ধাক্কা খেলামরে! আল্লাহ, আমার নাক তো বোঁচা হয়ে গেলো!
– তোমার স্বামী আমি আর কোনো খাম্বা না।
মুহূর্তের মধ্যে পাশ থেকে একরাশ হাসির শব্দ ভেসে এলো। হায়াত অবাক হয়ে তাকাতেই দেখে—ওটা কোনো খাম্বা নয়, বরং দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদিব। । চোখেমুখে চাপা হাসি চেপে রেখেছে, কিন্তু থামাতে পারছে না।
হায়াত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
– ওহ আপনি, ধুর যখন তখন সামনে এসে পরেন।
– আরে কি মুশকিল আমি অফিস থেকে মাত্র আসলাম।
– আচ্ছা সরুন তো নিচে যেতে দিন।
আদিব হায়াতকে এক হাত দিয়ে উঁচু করে রুমে নিয়ে গেলো। হায়াতকে নিচে নামিয়ে আদিব দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো। তারপর ধীর ভঙ্গিতে শার্ট খুলে হায়াতের মাথার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় কণ্ঠটা ভারী আর কড়া গলায় বললো,
– আমি না আসা অব্দি রুম থেকে বের হবে না। বাইরে রাজ বসে আছে ড্রইংরুমে।
হায়াত ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর মিনমিন করে বললো,
– এই রাজ ভাইয়াকে নিয়ে তোমার এতো সমস্যা কেনো? উনি তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড! তাও উনার সাথেই এমন ব্যবহার করো কেনো ?
কথাগুলো শেষ করেই সে আদিবের ফেলে রাখা শার্টটা নিয়ে বেলকনির চেয়ারে রেখে দিলো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে আদিবের ফোনটা হাতে তুলে নিলো।
হায়াত ফোনে খুশিপুর সাথে কিছুক্ষন কথা বললো, কিছুক্ষণ পর ফোনটা রেখে দিলো টেবিলের ওপর।
ঠিক তখনই চোখ গেলো ডিভানের ওপর রাখা এক ব্যাগের দিকে। ব্যাগটা সাদামাটা হলেও দেখে মনে হচ্ছে দামি কিছু আছে। আদিব যখন রুমে ঢুকেছিলো তখনই ওটা তার সাথে ছিলো, অথচ হায়াতের চোখে পড়ে নি। এখন যেন চোখ আটকে গেলো ওটার দিকেই।
মুহূর্তে হায়াতের ভেতরে দোটানা শুরু হলো—
– খুলবো ? নাকি না….যদি ওনি রাগ করে, নাহ ওনি না বললে খুলা উচিৎ না।
হায়াত চুপচাপ ডিভানের ওপর বসে রইলো। একটু পরই আদিব ওয়াশরুম থেকে বের হলো। চুল গুলো তোয়েলা দিয়ে মুছে হায়াতকে কোলে নিয়ে বসলো। গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো আর হাত আপনা আপনিই চলে গেলো হায়াতের বক্ষঃস্থলে। নেশালো কন্ঠে বললো,
– বউ খুলে দেখো তো কেমন হয়েছে।
– কি এটাতে……?
হায়াত কৌতূহল সামলাতে পারলো না। ব্যাগ থেকে প্যাকেটটা বের করে ধীরে ধীরে খুলতে লাগলো। ভেতরে বেরিয়ে এলো হালকা রঙের, পাতলা, অতীব দামি একটা শাড়ি।
আঙুল বুলিয়ে হায়াত বিস্ময়ে তাকালো,
– এত্তো সুন্দর !
আদিবের ঠোঁটে হালকা হাসি খেললো। উত্তর না দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে শুধু হায়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টিতে যেন অজস্র অপ্রকাশিত কথা, এমন কিছু যা হায়াতের বুকের ভেতর অস্থিরতা ছড়িয়ে দিলো। আদিব হায়াতের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– আজকে আমার জন্য একটু সাজবে বউ..!!
হায়াত লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– আপনার মনে আছে আমাদের এ্যানিভার্সারির কথা ?
আদিব একটু ঝুকে হায়াতের পুরো মুখে চুমু খেতে লাগলো। হায়াতও আদিবের গালে চুমু একে দিলো। আদিব হায়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
– একটু পর আমাদের এই পবিত্র সম্পর্কের একটা বছর পূর্ণ হবে, আর আমি মনে রাখবো না ?
হায়াত মুচকি হেসে শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। আদিবও ধীরভাবে তার পাশে এসে দাঁড়ালো, পেছন থেকে পরম আবেশে হায়াতকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– চলো, খেয়ে আসি, কেক কাটবো। তারপর আমি তোমাকে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দেবো।
হায়াত একটু বিস্মিত স্বরে বললো,
– আপনি শাড়ি পড়াতে পারবেন কীভাবে ? আপনি তো শুধু শাড়ি খুলতেই জানেন।
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালো হায়াত, মনে মনে বললো,ইস কি বলে ফেললাম, ধুর।
আদিব ঠোঁট কামড়ে, চোখ বন্ধ করে হাসি সামলিয়ে নিলো, তারপর হালকা কণ্ঠে বললো,
– আমার বউ আজকে আমাকে কাছে চাচ্ছে, তাই না বউ ?
হায়াত চট করে কণ্ঠে বললো—
– মোটেও না।
– হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। চলো খেয়ে আসি বউ।
– হ্যা চলুন।
******
এদিকে আরাবি, নুপুর, মিনহাজা, আসিফ আর রিয়া ছাদে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। চারপাশে রঙিন লাইট ঝলমল করছে, ফুল আর ব্যানার সাজানো হচ্ছে যত্নে। বাতাসে হালকা সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে ।
আরাবি গম্ভীর মুখে লাইট ঠিক করছে, নুপুর চুপচাপ ব্যানার টানছে, মিনহাজা রঙিন বেলুন ফুঁকছে, আর রিয়া ছোট ছোট কাগজের ফুল সাজাচ্ছে। আসিফ ব্যস্ত হয়ে সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা যাচাই করছে।
সবকিছু প্রস্তুত হয়ে যাবে ঠিক সময়মতো—অল্প সময়ের মধ্যেই আদিব আর হায়াতের এ্যানিভার্সারি উদযাপন হবে।
হঠাৎ আরাবিকে ধমক দিলো আসিফ,
– এই মেয়ে, ঠিক করে লাইটগুলো সাজাও!
আসিফ একটু রাগী চোখে তাকালো, আর আরাবি পিটপিট করে চোখ করে তাকিয়ে বললো,
– অযথা ঝগড়া করতে আসছেন কেনো ? আমি তো ঠিকঠাক সাজাচ্ছি, আর আপনি তো কোনো কাজই করছেন না।
পাশ থেকে মিনহাজা বললো,
– হ্যাঁ ভাইয়া আর রাজ ভাইয়া তো একেবারেই কোনো কাজ করছে না। সত্যিই ভাইয়া অযথা দাঁড়িয়ে আছিস, আয় আমাদের একটু হেল্প কর।
আসিফ একটু আরাবির দিকে তাকালো,
– সরো আমি করছি,,,,,,,,
আরাবি একটু মিন মিন করে বললো,
– শেষ তো ভাইয়া আমিই করছি।
এরপর আসিফ একটু আরাবির দিকে তাকালো, আর আরাবিও চুপচাপ সরে গেলো নুপুরের পাশে। নুপুরের কাজ প্রায় শেষ হঠাৎ আরাবিকে বললো,
– আচ্ছা আরাবি রাজ ভাইয়াকে তুমি দেখেছো বনু। সেই যে বাহিরে গিয়েছে, আমাদের সাথে একটু কাজ করবে তা না…..
***
এদিকে রাজ একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে। রুম ভরে উঠছে ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে।
সকলের খাওয়া শেষ হলেও, রাজের এখনো খাওয়া হয়নি।
চোখ যেন কোথাও আটকে আছে, মুখে অন্যমনস্ক ভাব।
সিগারের আগুনে শুধু জ্বলছে তার নিঃশব্দ চিন্তা, ধোঁয়ার ফাঁকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে নিজের ভেতরের অস্থিরতা।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হঠাৎ দেয়ালে সজোরে এক ঘুষি দিলো রাজ।
তারপর হাত বাড়িয়ে ধরলো জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনের অংশ।
মুহূর্তেই আগুনের তাপে চামড়া ঝলসে উঠলো, কিন্তু রাজের চোখের পলকও নড়লো না।
মিনিট পাঁচেক পর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিঃশব্দে সিগারেট ফেলে দিলো সে।
আনমনে বসে গভীর স্বরে ফিসফিস করে বললো,
– আফরা… তুমি আমার হবেই। যেভাবেই হোক তোমাকে আমি নিজের করে নেবোই ।
আদিবের ভাগ্য এতটা ভালো হতে আমি দেবো না।
যেভাবেই হোক না কেন, তোর জীবন থেকে আফরাকে কেড়ে নিতেই হবে…তুই বলতি না, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার যা তোরও তাই। তাহলে আজ আমার তোর বউকে লাগবেই,তোদের নেকামি আমার আর সহ্য হচ্ছে না, আমি আর পারছি না এসব নিতে। আফরাকে আমার লাগবেই।
রাজের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি খেললো,
সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই তার কথাগুলো ছড়িয়ে পড়লো অন্ধকার ঘরে।
—
খাওয়া শেষ করে দু’জনে ওপরে রুমে এসে বসলো।
আদিব হেলান দিয়ে হায়াতের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে তার এলোমেলো চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিলো।
হালকা হাসি মুখে বললো,
– চলো, তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিই, বউ…!!
হায়াত অবাক হয়ে কপাল কুঁচকালো।
– কিহ সত্যিই ? পরাবেন নাকি শাড়ি, আপনি পরাতে জানেন ?
আদিব চোখে দুষ্টু দৃষ্টি মেখে বললো,
– কেনো ? আমি কি পারবো না নাকি ?
– হ্যা সেই তো, আমি কি ভুলে গিয়েছি নাকি, বিয়ের কিছুদিন পর আপনি আমাকে মেহেদি পরাতে গিয়ে আমার হাতই নষ্ট করে ফেলেছিলেন।
আদিব আর হায়াতকে কোনো কথা বলতে দিলো না,জামা নিজ হাতে খুলে ব্লাউজ পরিয়ে দিলো। হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, আদিব ইউটিউবে শাড়ি পরানোর ভিডিও অন করলো। আদিব আস্তে আস্তে শাড়ি পড়ানো শুরু করলো, প্রত্যেকটা কুঁচি সযত্নে ভেতরে দিতে লাগলে। নেশালো চোখে হায়াতের দিকে তাকালো আদিব।হায়াত একটু লজ্জা মাখা মুখে আদিবের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। আদিব টেডি স্মাইল দিয়ে বললো,
– বউ এক বছর হয়ে গেলো, তবুও কি তোমার লজ্জা কমে না।
হায়াত কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিব হায়াতের পেটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। হায়াত হালকা কেঁপে ওঠে। আদিব ওঠে দাড়ালো তারপর আস্তে ধীরে হায়াতের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ পুড়ে নিল। প্রায় বিশ মিনিট মধুর সাদ নিতে লাগলো। আস্তে করে শাড়ির আচলটা বুকে থেকে ফেলে সুধা পান করতে লাগলো। একটু একটু করে গলায় বাইট দিতে থাকলো। তারপর ছেড়ে দিলো।
হায়াত একটু রাগী কন্ঠে বললো,
– আপনি এটা কি করলেন, আমার গলায় এতো দাগ হলো এখন কি হবে।
আদিব ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,
– উফ বউ বুঝো না কেনো, কেউ যাতে তোমাকে নজর না লাগায়, এর জন্যই তো ভালোবাসার চিহ্ন একে দিলাম।
– কচু করেছেন। চলুন সকলে অপেক্ষা করছে।
হায়াত আর আদিব রুম থেকে বের হয়ে ছাদে উঠতে লাগলো।ঠিক তখনই আদিবের ফোন বেজে উঠলো।
সে কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ওপরে যেতে লাগলো।
এমন সময় পেছন থেকে হায়াতের ফুপু-শাশুড়ি ডাক দিলেন,
– আম্মু, একটু কাজ করে দিবে ?
হায়াত থেমে মিষ্টি হাসিতে বললো,
– হ্যাঁ ফুপি, বলুন কী করতে হবে…!!
– রাজকে একটু খাবার দিয়ে আসবে? মানে গিয়ে শুধু ডিভানের ওপর রেখে চলে আসবে। ছেলেটার নাকি মাথা ব্যথা খুব, তাই খাবে না।
ফুপির কথা শেষ হতে না হতেই হায়াতের বুকের ভেতর যেন হালকা অস্বস্তি খেলে গেলো। হায়াত বিনয়ের সঙ্গে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,
– আচ্ছা ফুপি, দিয়ে আসছি।
হায়াত ডাইনিং টেবিল থেকে খাবার সাজিয়ে রাজের রুমের দিকে মৃদু পায়ে এগোতে লাগলো।
ওই সময় রাজ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
হালকা অস্বস্তি নিয়ে হায়াত দরজায় নক করলো।
রাজ বিরক্ত চেহারা নিয়ে দরজা খুললো, কিন্তু পরক্ষণেই তার সেই বিরক্তি মিলিয়ে গেলো।
নেশামাখা চোখে তাকিয়ে রইলো হায়াতের দিকে। পিচ-কালারের পাতলা শাড়িতে কতটা অনিন্দ্য লাগছে।হাঁটু অব্দি চুল ছড়িয়ে পড়েছে, মুখে নিঃশব্দ এক জ্যোতি।
হায়াত দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললো,
– ভাইয়া, আপনার খাবার।
রাজ সরে দাঁড়াতেই হায়াত ভেতরে ঢুকে খাবার রাখলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই রাজ হায়াতের দিকে ঝুঁকে এলো।হায়াত ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো রাজের, এক পা পিছিয়ে গেলো ভয়ে।
রাজের দৃষ্টি হঠাৎ আটকে গেলো হায়াতের গলায়, আর মুহূর্তেই তার চোখ লাল হয়ে উঠলো।
হায়াত উৎকণ্ঠিত স্বরে বললো,
– ভাইয়া, ছাদে যেতে হবে… সামনে থেকে সরুন।
কিন্তু রাজ সরলো না। বরং হঠাৎ তার হাত চেপে ধরলো।ভয়ে গুটিয়ে গেলো হায়াত। চিৎকার করতে যাবেই, এমন সময় রাজ তার মুখ চেপে ধরলো।হায়াতের ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দিলো আঙ্গুল দিয়ে।
আকস্মিক আতঙ্কে হায়াত জোরে কামড় বসালো রাজের হাতে, মৃদু ব্যথায় থমকে গেলো রাজ। ঠিক তখনই হায়াত নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক চড় বসালো রাজের গালে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রাজ হায়াতের চুল খামচে ধরলো।ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো হায়াত।
ঠিক সেই মুহূর্তে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মিসেস অরোরা।
চিৎকার শুনে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। হায়াতের চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে, আর রাজ তখনো বিকৃত হাসি মাখা মুখে কিছু একটা ফিসফিস করছে।
মুহূর্তেই মিসেস অরোরা চিৎকার করে উঠলেন।
রাজ বাধ্য হয়ে হাত ছেড়ে দিলো।মিসেস অরোরা ছুটে এসে হায়াতকে আগলে নিলেন। পরক্ষণেই রাজের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরপর সাতটা চড় বসালেন।
রাজ মাথা নিচু করে লজ্জা আর ক্রোধ গোপন করতে লাগলো।
হায়াত আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
মিসেস অরোরা কড়া কণ্ঠে বললেন,
– শুধু শাকিলার কথা ভেবে তোমাকে কিছু বলছি না। নাহলে এখনই ঘাড় ধরে বের করে দিতাম এই বাড়ি থেকে,বেয়াদব কোথাকার। তুমি জানো না হায়াত বিবাহিত ? তবুও এভাবে কেনো করলে?
আজকের পর যদি তোমাকে হায়াতের ত্রিসীমানায় দেখি,তবে ভুলে যাবো, তুমি আমার কে !
হায়াত দৌড়ে রুমে এসে শাড়ি খুলে ফেললো।
ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের গালে নিজেই চড় দিলো, দেয়ালে সজোরে মাথা ঠেকালো।
ঠোঁটের ব্যথা ভুলে গিয়ে সাবান দিয়ে ঘষতে লাগলো, যেন নিজের ওপর রাগ আর হতাশা সব ঝরিয়ে দিতে চায়।
মিসেস অরোরা তৎপর হয়ে হায়াতের রুমে ছুটে এলেন।
হায়াতকে রুমে না পেয়ে, তড়িঘড়ি ওয়াশরুমে ঢুকলেন।
হায়াতকে এমন অবস্থা দেখে তাঁরা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
হায়াত কান্নার থামিয়ে বললো,
– আব্ আম্মু… উনি জানলে আমাকে মে…. মেরে ফেলবেন। উনি আগে বলেছিলেন রাজ ভাইয়ার থেকে দূরে থাকতে, কিন্তু ফুপু বললেন, আর তাই আমি করতে পারিনি। আমি তো জানতাম না রাজ ভাইয়ার এত খারাপ ইন্টেনশন রাখেন।
হায়াতকে শান্ত করার জন্য মিসেস অরোরা বললেন,
– আচ্ছা, কাঁদো না মা। এই ব্যাপারে আদিবকে কিছু বলবে না আর আমিও বলব না। কিছু তো হয়নি। এই বিয়ের ঝামেলা শেষ হোক, তারপর আমি সব ঠিক করে দেব।
যাও, রেডি হও নাকি আমি করে দেব।
হায়াত চোখ মুছে ভেতরের অস্থিরতাকে কিছুটা দমন করে বলল,
– উহু, আমিই হবো, আপনি ছাদে যান।
হায়াত একটা ওয়ানপিস পড়ল, চুলগুলো আলতো করে বেঁধে নিলো।
তারপর আনমনে ছাদে উঠল। সবাই একসাথে মুখে বললো,
” হ্যাপি এনিভার্সারি ”
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সবাই থমকে গেল।
হায়াতকে এভাবে চুপচাপ, সাদামাটা লুকে দেখে…..
আদিব হায়াতের দিকে এগিয়ে আসলো, চোখে খানিকটা অবিশ্বাস।
– তুমি… শাড়ি খুলেছো কেন ? আমি ওটা ভালোবেসে এনেছিলাম, আর তুমি…
ঠিক সেই মুহূর্তে রাজ চলে এলো, বাঁকা হাসি নিয়ে আদিবের দিকে তাকাল।হায়াত খানিকটা চমকে রাজের দিকে তাকালো,
মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফুঁকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, আদিব কেকের ওপর লাথি মারলো।
স্টেজের সব সাজানো কিছু তছনছ করে ফেললো।
সকলে থামাতে চাইলেও কেউ সাহস পেলো না।
হায়াত সামনে এগোতে যেতেই আদিব ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিলো ।
কিছু বলার আগেই আদিব ছাদ থেকে নেমে গেল।
সকলেই আদিবকে ডাকতে লাগলো, কিন্তু সে দাড়ালো না।
হায়াতকে রিয়া ধরতে এগিয়ে এল, কিন্তু হায়াত গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
– আপনারা সবাই নিচে যান, আমি একটু একা থাকবো।
সবাই চলে যেতেই হায়াত একা বসে বসে অঝোরে কান্না করতে লাগলো।
মিন মিন করে বললো,
– আজকের দিনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না… কেন হলো এমন ? আমার কপালটা কি এতোটাই খারাপ।
#চলবে