আমার হৃদয়ে সে পর্ব-২৮

0
707

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-২৮

৪৩.
কতটা সহজ হলে একটা আনম্যারিড ছেলে একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে পারে!কিসে কমতি ছিল তার?অর্থবিত্ত,সামাজিকতা,সৌন্দর্য্যে সে প্রথম দিকে।চাইলেও হাজারটা মেয়েকে রিজেক্ট করতে পারতো।এতদসত্ত্বেও কালরাতে একটিবারের জন্যেও আমার অতীত টানলো না।তার যে আগে আরেকটা বিয়ে হয়েছে তা মনে করার চেষ্টা করলো না।কী শান্ত,স্নিগ্ধ মুখে কাছে টেনে নিল।তার পরম স্নেহাশিস আদর বুলিয়ে দিলো।প্রতিটি স্পর্শের আগে ভাবলো না তাকে আরেকটা ছেলে ছুঁয়েছিল কিনা?!আসলে সত্যিই অভি কখনো আমাকে ছুঁয়ে নি।ছুঁবেই বা কীভাবে বিয়ের প্রথম রাত থেকেই ত আমার সাথে তার কথা বলতে মুখে কুলুপ লাগিয়েছিল।যেখানে কথা বলতো না।সেখানে আবার ছুঁয়ে দেখা।আচ্ছা,হৃদয় কি এই বিষয়টা জানে?নাকি ভেবে রেখেছে অভিও হয়তো আমাকে ছুঁয়েছে কখনো।বিয়ে হয়েছে।ছুঁয়ে দেখবে না।এটা তো হয়না!হঠাৎ ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় আমার।চোখ যায় বিছানার দিকে।হৃদয় তার গাঁয়ের কম্বলটা পা দিয়ে এক সপাটে নেচে ফেলে আবার কাঁত হয়ে শোয়।অনেক বেলা হয়েছে।নটার মতন বাজে।আমি সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠেছি।এরমাঝে গোসল সেরেছি।নাস্তা বানাতে খালামণিকে সাহায্য করেছি।প্রতিটি রুমের জগে পানি ভর্তি করেছি।আর এই লাপাত্তার মতন ছেলেটা এখনো ঘুমচ্ছে।আর ঘুমতে কি করে দিই?ভেবেই ছটাং হৃদয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।গাঁয়ে আলতো ধাক্কা মারলাম।বললাম,

“এই যে উঠুন?বেলা অনেক হয়েছে।”

কোনো উত্তর নেই।আবারো ধাক্কা দিলাম।প্রথম ধাক্কা থেকে এই ধাক্কাটা একটু জোরে ছিল।তাই সে মুহূর্তের জন্যে চোখজোড়া হালকা খুলে ফেলে।খুলেও লাভ বিশেষ হলো না।কাঁত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে।আমি আবারো মুখ উঁচিয়ে কিছু বলতে গেলে হঠাৎ চোখজোড়া আঁটকে যায় তার প্রশস্ত বুকের উপর।ধবধবে সাদা বুকে কালো লোমগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে।গাঁয়ের রং শুভ্র হওয়ার ধরুনে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে যেন।যে কেউ তাকে এই অবস্থায় তাকে দেখলে দ্বিতীয়বার তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে।আমিও পড়েছি।নেশা ধরে যায় চোখে।মাদকের মতন নেশা।হঠাৎ মনের কোণে অবাধ্য ইচ্ছেরা উঁকি দেয়।হাতটা সন্তপর্ণে বাড়িয়ে দিই সেদিকে!আর ওমনি কেউ টুপ করে আমার ডান হাতটা ধরে ফেলে।আমি ভয় পাওয়ার মতন চমকে যাই।হৃদয়ের মুখ পানে তাকাই।সে আমার হাতটা ধরে রেখে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।আমি ওমনি একটা ঝাঁকি দিয়ে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিই।সে বোধহয় এরইমাঝে আমার দিকে তাকিয়ে কুটিল হেসে দেয়।শোয়া থেকে বসতে বসতে বলে,
“চোরের মতন কি করছিলে?আমার মতন নিষ্পাপ ছেলেকে একা পেয়ে নির্যাতন করার চেষ্টা করছিলে?”

বলে আবারো কুটিল হেসে দেয়।আমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে টগবগ চোখে এদিকওদিক তাকাই।তবে, এভাবে তাকালে তো হবে না।মান রক্ষা করতে ইনার এক হাত উপরে আমাকে দৌড়াতে হবে।শক্ত গলায় বলে উঠি,

“অসভ্যের মতন কি যা তা বলতেছেন?আমিতো আপনাকে শুধু উঠানোর জন্যে ওখানে হাত দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।”
“মুখ বলে মিথ্যা।চোখ বলে সত্য।”
“ম-মা নে?”
“মানে কিছু না।ফ্রেশ হবো।”

বলে উঠে বসা থেকে এক সপাটে উঠে দাঁড়ায়।আর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
“আমার প্যান্ট,শার্ট কোথায় যেন রেখেছি?”

আমি নৈঃশব্দে মুখে হাত উঁচিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করি।আমি গোসলের করতে যাওয়ার সময় হৃদয় গতকাল রাতে সঙ্গে তার আনা শার্ট-প্যান্ট ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখি দিই।সাথে আমার নতুন একটা তোয়ালেও।যাতে সে গোসল করতে যেতে এগুলো খুঁজতে না হয়।সে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তার শার্টপ্যান্ট হাতে নেয়।তারপর মুখে লম্বা মতন একটা শিষ টেনে বাথরুমে ঢুকে যায়।বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে আমি জোরে একটা শ্বাস ছাড়ি,

“কত অসভ্য ছেলে!ঘুমের ভাণ ধরে আমাকে লজ্জা দেবার চেষ্টা চালিয়েছে।আর আমিও না যেচে লজ্জাটা তুলে নিলাম।এখন নিজের চুল নিজেরই টানতে ইচ্ছে হয়।আর চোখ গুলোও আমার বড্ড নির্লজ্জ!”

৪৪.
আজ আমাদের বিয়ের তিনদিন হতে চলছে।সেদিনের পর হৃদয় রাতে খালামণিদের বাসায় আর আসে নি।আসে নি বলতে একেবারে যে আসে নি তা নয়।অবশ্যি দিনের বেলায় আসে।এসে আমার সাথে দেখা করে যায়।আমাদের ফ্যামিলির সবার সাথে দেখা করে যায়।সাক্ষাৎ করে যায়।রাতে আসতে তার নাকি লজ্জা লাগে।শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদা মেটাতে রাতে আসবে এই দৃশ্যটা আমাদের ফ্যামিলির এবং তার ফ্যামিলির কাছে নাকি খারাপ দেখাবে তাই ভেবে আসে নি।ওর এহেন দেখে আমার মা,খালামণি বাবা এবং আঙ্কেল তো ওকে ভদ্রতা উপাধি দিয়েই ফেলেছে।অবশ্যি ওকে আমি ভদ্রতা বলবো না।কেননা ও ভদ্রতা নামক লজ্জাটা আমার সামনে আর চেপে রাখে না।আমাকে ফোনে ফেলেই নির্লজ্জের মতন উড়াধুরা ওর মনের সবকথা ছেড়ে দেয়।গতকাল কাল রাত কি হলো?আমি ওর কল রিসিভ করতেই বলে উঠে,

“আমার বিছানার পাশের জায়গাটা খালি পড়ে আছে।তুমি কবে আসবে?শূন্যতা শূন্যতা লাগছে।তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্তেও থাকতে পারছি না।এই বাবার জন্যে কত অপেক্ষা করবো?দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার!বাবা কি আমার মনের ব্যথা বুঝিতেছে না!আমার প্রেয়সীকে দুইদিন কাছে পাইনি।এটা একজন নতুন বিয়ে করা ছেলের কাছে কেমন লাগে বলো ত?এতটা জুলুম বাবা কীভাবে করতে পারে আমাদের উপর!”

ওর কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে যায়।হেঁচকির মাঝে ফোনের ওপাশ থেকে ওর আবার চিন্তিত গলার স্বর ভেসে আসে,
“পারিসা,সরি,সরি।তোমাকে আসতে হবে না।প্লিজ, পারিসা শান্ত হও।শান্ত হও, প্লিজ?আরেহ আমিতো মজা করেছি জাস্ট!হেঁচকি কমেছে তোমার?এই পারিসা এই?”

ওর কথা শুনে তখন আমার টানা হেঁচকি তোলা মুখের কোণে ফুঁটে ওঠে হাসির রেখা।দুষ্ট রকমের হাসি।হেঁচকি তো শুধুমাত্র ওর রোমান্টিক কথা বন্ধ করতে তুলি। এটা যে আমার অভিনয়ের হেঁচকি হৃদয় বুঝতে পারেনি।পরশুও এরকম করেছি।হৃদয় তাও ভেবে নিল ওর ওসব কথা শুনে হেঁচকি উঠেছে।

৪৫.
ফাহিমকে একটু পড়াচ্ছি।পাশের রুমে খালামণি এবং আঙ্কেল দুজনে কথা বলছেন।ফাহিমের রুম এবং উনাদের রুম পাশাপাশি।তাই একটু টু শব্দ করলেও ও রুম থেকে এ রুমে সহজে শোনা যায়।কথা বলার বিষয়বস্তু আমাকে নিয়েই।খালামণি বলতে চাচ্ছেন,

“পারিসার এখানে যেহেতু এনগেজমেন্ট সুবাধে বিয়েটা হয়েছে।অনুষ্ঠানটা নাহয় এখানেই করা হোক।তাছাড়া,এখানে অনুষ্ঠান হলে আপা এবং ভাইয়া দ্বিমত করনেন না আমার মনে হয়।”

আঙ্কেল বলছেন,
“নাহ,রাহেলা।মেয়েরা তার মা-বাবার থেকে পরের বাড়িতে বিদেয় নেওয়া টা ভালো আমার দৃষ্টিতে।কারণ এটা নিয়ম।নিয়ম বরখেলাপ করার দরকার নেই।এমনিতেই মেয়েটার এটা দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে।ভাগ্য বলে একটা ব্যাপারস্যাপার আছে।”

“হৃদয়ের বাবা কবে শহরে ফিরছেন?”
“হৃদয়ের থেকে আজ সকালে শুনলাম তিনি নাকি শীঘ্রই ফিরছেন।”
“কবে?”
“এই সপ্তাহের মধ্যেই নাকি।”
“তাহলে ত আর সময় বেশি নেই।অনুষ্ঠানের সব আয়োজন তাড়াতাড়ি শুরু করা উচিত।”
“হ্যাঁ।তুমি পারিসাকে তাদের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
“আচ্ছা।”

ফাহিম পড়ছে”,”the little cat is eating milk,the little cat is eating milk,the little cat is eating milk.” ওর মুখে বারবার প্রতিধ্বনিত করা পড়াগুলো আমার মাথায় ভো ভো করছে।শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না।আগের মনোযোগটা এখন আর নেই।ভেতরে উৎপাত করছে কোনো এক অজানা উত্তেজনায়।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।।বললাম,

“ফাহিম আপুর মাথা ঘুরছে খুব।আপু তোকে পরে পড়াবো।”

বলে চলে এলাম।ফাহিমের উত্তরের অপেক্ষা করলাম না।রুমে এসে দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করলাম।দরজার কাঠে সোঁজা হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম।ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়লাম।মুখে লজ্জা মিশ্রিত একটা হাসি ফুঁটে উঠলো।
পরক্ষণে এগিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম।মেসেজে লিখলাম,

“মিথ্যেবাদী,বাবা শুনলাম এই সপ্তাহে আসবে।আর আপনি আমাকে আরো দিনেক বিশে লাগবে আসতে এ’কথা বললেন কেন?আসুন আমার সামনে মিথ্যে বলা মুখটা সেলাই করে দেব।”

লিখে হেসে দিলাম।আবারো লজ্জামিশ্রিত হাসি।তারপর ফোনটা আবার বিছানার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বেলকনির দিকে দৌড়ে গেলাম।আকাশ পানে তাকালাম।।বিকেলের শেষ সময় এখন।নরম মিষ্টি রোদ।গাছের পাতাফোকরে রোদগুলো ঝকঝক করে নাচছে।তার সাথে তাল মিলিয়ে আমার ভেতরটাও কোনো অজানা এক চাপা উত্তেজনায় নাচছে।অপেক্ষা করছে সেই শুভ দিনের।সেই শুভ মিলনের।সেই শুভ প্রিয় মুখের।সেই শুভ প্রিয় সংসারের।
ভাবনার মাঝে হঠাৎ কেউ দুইহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে।আমি চমকে উঠি।পেছন ফিরি।চারপাশের মিষ্টির রোদের সহিত তাল মিলিয়ে আমার সামনের মানুষটিও মিষ্টি হেসে বলে উঠে,

“বউ,আমার?মিস ইউ!”

বলেই মাথাটা তার এগিয়ে এনে আমার ঠোঁটজোড়ার উপর আলতো একটা চুম্বন এঁকে দেয়।আমি জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই।নাক ফুলিয়ে চাপা অভিমানটা এবার আমার মাথায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।ধড়াম বলে উঠি,

“মিথ্যাবাদী!”

চলবে….