আমার হৃদয়ে সে পর্ব-৩০

0
680

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩০

৪৮.
স্বপ্ন ছিল অন্যরকম।বিয়েতে ঢাকঢোল বাজবে।মেহমান আসবে।বড় আয়োজন করে খাবারদাবার হবে।আমি বধূ সেজে সবাইকে বিদেয় জানিয়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করবো।সেই বাড়ির সবাই আমাকে “বউমা” বলে সম্বোধন করে সাদরে গ্রহণ করবে।কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা আমার ভাটা পড়া নদীর মতন হয়ে গেল।হৃদয়ের বাবার অসম্মতিতেও এখন ছুটে চলছি সেই বাড়িতে।মানে হৃদয়ের বাড়িতে।হৃদয় আমার পাশে বসা।উদাসীন মনে সি.এন.জির বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আমাকে অন্যহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে।আমার মনে ওকে নিয়ে প্রচন্ড রকমের অভিমান!তার বাবা যেহেতু আমাকে বউ করতে রাজি নেই তাহলে কেন আমাকে সে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে?তার ভালোবাসার মান রাখতে কেন বাবার চোখে খারাপ হবে সে?সে কি বুঝে না ডিভোর্সিদের দয়া দেখাতে যেয়ে সমাজে বাপ-মায়ের মুখ ছোট্ট হয়ে আসে।এতটা দয়ালু কেন সাজতে গেলো এই ছেলে?আবারো আরেক দফা কেঁপে উঠলাম।এই মুহূর্তে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।ভীষণ রকম কান্না।হৃদয় হালকা নড়ে উঠে।তার হাতের বাঁধন হালকা হয়ে আসে।আমি ওমনি ওড়না টেনে চোখের কোণের জলে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে,

“পারিসা?আর কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাবো।”

বলে হাতের বাঁধন আবার শক্ত করে নেয়।আমি চুপ করে রইল।মিনিট সাতেশ পর সি.এন.জি একটা দো’তালা বাড়ির সামনে এসে থামে।

“পারিসা?চলে এসেছি।নামো।”

আমি কেনজানি বসে থাকলাম।নামার মতন পায়ে শক্তি পেলাম না।হৃদয় ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে,
“মামা?ধরুন আপনার বিল?”

ড্রাইভার টাকাটা হাতে নেওয়ার পর হৃদয় আবার আমার দিকে ফিরে।দেখে এখনো বসে।সে আর না দাঁড়িয়ে আমার সিটের দিকে এগিয়ে আসে।কিছু না বলে ধপ করে তার দুইহাতে আমাকে তুলে নেয়।এ দৃশ্য দেখে আমিও যতটা না অবাক,ততটা ড্রাইভারও।তবে আমি লজ্জায় পেয়ে যাই।পরক্ষণে ড্রাইভার অবাক চোখে দুষ্ট চাহনি এঁটে উল্টো দিকে তাকিয়ে মুচকি মুঁচকি হাসে।তারপর বলে,

“যাই মা-আব্বা।তোমাদের জন্যে দোয়া রইলো।”
হৃদয় বলে,
“হ্যাঁ মামা।তারসাথে দোয়া করবেন আমার এই বউটার মনেও যেনো কোনো কষ্ট না থাকে।”

কথার পিঠে ড্রাইভার মৃদু হাসে।তারপর গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়।হৃদয় আমাকে তার দু’হাতের মধ্যে রেখেই সামনে হাঁটা ধরে।গন্তব্য সদর দরজা।সদর দরজার সামনে আসতে হৃদয় এবার আমাকে নিচে নামায়।আমি হৃদয়ের দিকে তাকাই।হৃদয় বলে উঠে,
“সরি বউ!তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।এছাড়া আর উপায় ছিল না।”

বলে হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আমি হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে আমাকে এখানে এভাবে নিয়ে এসে বেশ খুশি নয়।আমার মতন তারও মনে চাপা ব্যথা।সেও হয়তো চেয়েছিল তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুক।কিন্তু ভাগ্য তা আমার সহায় না।দরজা খুললেই কিছু মানুষের দেখা যাবে হাসি মাখা মুখ।আবার কিছু মানুষের রক্তলাল চোখ।হৃদয় কলিংবেল চাপে।কয়েক মিনিট বাদে কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়।আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি হৃদয়ের মা দাঁড়িয়ে। মানে আমার শাশুড়ী মা।আমি দেরী না করে উনাকে সালাম করে উঠি।উনি আমাকে দেখে যেন ভারী খুশি হলেন।চোখমুখ আনন্দে ঝলকে উঠলো।উত্তেজনায় পেছনে তাকিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলতে যেয়ে চুপসে যান।আমাদের দিকে ফিরে গলার স্বর নিচু করে,

“বউমা কে নিয়ে ভেতরে যা।তোর বাবা তার রুমের ভেতর আছেন।”

উনার কথায় বুঝতে পারলাম হৃদয় যে আমাকে এখানে নিয়ে আসবে উনি তা আগে থেকেই জানেন।হৃদয় বললো,
“তো কি হয়েছে,মা?বিয়েটা কি আমি লুকিয়ে করেছি যে বাবার ভয়ে বউকে নিয়ে লুকিয়ে থাকবো?আর পারিসা তো খারাপ মেয়ে না।আমি সৎ,নৈতিকতা সম্পূর্ণ একজনকে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি এটা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”

হৃদয়ের মার মুখটা আরে উজ্জ্বল হয়ে গেল।তিনি দরজাটা আরো মেলে দেন।হৃদয় আমার ডান হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়।আমি চারপাশে একবার চোখ বুলাই।নিচে তেমন কাউকে চোখে পড়লো না।তবে হ্যাঁ,কিচেনের দরজা বরাবর অল্প বয়সী একটা মেয়েকে দেখলাম।মেয়েটা কি যেন রান্না করছে।দেখেই বুঝা সহজ সে এই বাড়িতে কাজ করে।সে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ হাতে করে ফেলে।লাফ মেরে বলে উঠে,

“ভাবী আইছে।ভাবী আইছে।”

ওর গলার ধ্বনি খুব উঁচু ছিল,পুরো বাড়িটা যেন বেজে উঠলো।হৃদয়ের মা মেয়েটিকে থামাতে কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।কিন্তু উনার চলার গতি হঠাৎ থমকে গেলো বামপাশে তাকাতে।আমি এবং হৃদয় উনার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকাই।তাকিয়ে একজন বুড়া মতন লোক।অবশ্যি বেশি বুড়া না।এই বয়স ৫৬/৫৭ এর মতন হবে।উনি আমাদের দেখে চোখে থাকা চশমা চোখজোড়া থেকে তরতর করে খুলে ফেলেন। কপালের চামড়া ঘন করে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে আনেন।হৃদয় তা উপেক্ষা করে আমাকে বলে উঠে,

“আমার বাবা।সালাম করো।”

আমি সালাম করে উঠলাম।উনি আমার সালামের জবাব দেননি।সরাসরি হৃদয়ের দিকে তাকান।বলেন,

“এ তোমার বউ?”
“হ্যাঁ,বাবা।”
“অতঃপর আমাদের না জানিয়ে নিয়েই আসলে।”
“উপায় ছিল না।”
“এক্সকিউজ শুনছি না।এনেছো ভালো করেছো।এবার সংসার করো।”

বলে চশমাটা আবারো চোখে এঁটে শক্ত চোখমুখে যে রুম থেকে বেরিয়েছেন সেই রুমে আবার পা বাড়ান।সেকেন্ডের ভেতর রুমে ঢুকে যান।আমাদের সবার চোখের সামনে দরজা ভিড়িয়ে দেন।হৃদয় আমাকে শুধায়,

“রুমে চলো পারিসা।”

রুমে আসতে হৃদয়কে ফ্রেশ হবার কথা বলে বাথরুমে ঢুকি।দরজা চাপিয়ে ফ্লোরের উপর জবুথবু বসে পড়ি।চেপে রাখা চোখের বাঁধ এবার উন্মুক্ত হয়ে যায়।ঝরঝর করে পড়তে থাকে দুই চোখের অশ্রু!বুকের মাঝখানটা ভেঙ্গেচুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আর যে আমি পারছি না,হবে আল্লাহ!কেমন অগ্নি পরিক্ষায় ফেললে তুমি!কি পাপ করেছি!কি পাপ!জীবনটা আমার এতটা সাদা খাতার মতন কেন কিছু লিখতে গেলেই কলমের কালি ফুরিয়ে যায়!ঠায় এভাবে কিছুটা সময় বসে থাকি।হঠাৎ মনে পড়ে হৃদয়কে আমি ফ্রেশ হয়ে আসার কথা বলেছি। এতটা সময় পার হলো হৃদয় ডাকে নি ত?এমন সময় ওপাশ থেকে হৃদয়ের গলার স্বর,

“পারিসা?পারিসা?”

কথার রেশে বুঝা যাচ্ছে আগেও অনেকবার ডেকেছে।আমি নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করি।সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াই।মাথার এলোমেলো চুলগুলো কানের দুই পাশে গুঁজে কল ওপেন করি।
মুখে কয়েক কোষ পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হই।বের হতেই হৃদয় সামনে পড়ে।আমার দুই হাত ধরে ফেলে।

“এতক্ষণ লেগেছে কেন বউ তোমার?কাঁদছিলে তুমি?”
“আরেক নাহ।কাঁদবো কেন!?যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হৃদয়কে পাশ কেঁটে বিছানার দিকে আসি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি ফের আবার পেছন ফিরি।বলি,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?”

ভাবলাম হৃদয় এবার বাথরুমে ঢুকে পড়বে।তা না করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে।নিষ্পাপ চোখে তাকায় ছোট বাচ্চাদের মতন।
“এই হৃদয়কে তোমার ভরসা হয়না?একটুও ভরসা হয়না?”

ওর ওমন প্রশ্নে ওর চোখের দিকে তাকাই।বলে,
“পারিসা?বাবার ওমন ব্যবহারে আমিও দুঃখিত।বাবার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।তবে,বাবা আমাদের নিয়ে এই বিয়ের মনোমালিন্যটা দেখো একদিন ঠিকই চুকে যাবে।তোমাকে তার বউমা না শুধু,নিজের মেয়ে বলে কাছে টেনে নেবে।কারণ তুমি লক্ষী মেয়ে।লক্ষী মেয়েদের থেকে কেউ কখনো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।”

বলে হৃদয় আমার গালে আলতো ছুঁয়ে।আবার বলে,
“কেঁদেছিলে এতক্ষণে, না?তুমি বলো নি।কিন্তু দেখো তোমার চোখের ভাষা আমাকে তাই বলে দিচ্ছে।কেনো কাঁদো তুমি?কেনো?কান্নাটা যে হৃদয়ের বুকের মাঝখানটা জ্বলেপুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে।শুনো আমার মনোকান্না?কেনো আমাকে কষ্ট দাও!কেনো বউ?কেনো?!”

চোখের অশ্রু চেপে রাখতে পারলাম না।অবাধ্য পানি গড়গড়িয়ে আবারো বেয়ে পড়লো!

চলবে……